আমিনুর রহমান সুলতান
মিলন কান্তি দে যাত্রাশিল্পের অনুশীলন করে চলেছেন এই পড়ন্ত বিকেলেও। গোধূলি খুবই সন্নিকটে। তারপর রাত। ধলপ্রহর পেরিয়ে আবার সকাল। একেকটি সকালকে, একেকটি দিনকে, একেকটি রাতকে তিনি মূল্যমান করে রাখার প্রয়াসী তাঁর যাত্রাশিল্পজগতকে কেন্দ্রে রেখে।
যাত্রাপালায় অভিনয়ে, রচনায়, নির্দেশনায়, সুরক্ষায় সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠান গড়ার মধ্য দিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও আন্দোলন গড়ে তোলা, যাত্রাশিল্পের সেকালকে একালের আলোকে দেখা, যাত্রাশিল্পকে-শিল্পীকে অধিকারবোধে জায়গা করে দেওয়ার জন্য লেখালেখি প্রভৃতির যে-শিল্পবোধ তা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
পড়ন্ত বিকেলে যাত্রাশিল্পের সারকথা ‘আত্মজীবনী: আমি যে এক যাত্রাওয়ালা’-র প্রতিটি পৃষ্ঠায় ব্যক্ত হয়েছে রসেরও যে, একটি রূপ আছেÑ তা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
তাঁর শিল্পবাড়ি দুটি। এক. যাত্রাবাড়ি, অর্থাৎ যাত্রাশিল্পের বাড়ি। দুই. গ্রামের বাড়ি, যে বাড়িতে এখন সংসার আগলে রেখেছেন তাঁর স্ত্রী গীতা রাণী দে। যাত্রাজগতকে ভালোবেসেছেন আপন সংসারকে ভালোবাসার বাইরে রেখে নয় বা আপন সংসারকে ভালোবেসেছেন যাত্রাজগতকে ভালোবাসার বাইরে রেখে নয়।
তিনি তিন পুত্র ও এক কন্যার জনক। তারা তাদের স্ব স্ব অবস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত; সুখী সংসার জীবনেও।
সাফল্য অর্জনে তিনি ব্যর্থ নন, অতন্ত্র প্রহরীর মতো আগলে রেখেছেন দুইটি বাড়িকেই।
প্রতিটি মানুষের ভেতরই শিল্পবোধ জেগে আছে নানান মাত্রিকতায়। কখনও কলা হিসেবে কখনও বা পরিবেশনা হিসেবে। পরিবেশনা মাধ্যমের কোনো কোনোটিতে আবার বিনোদনের ছাপ রেখে যায়। সভ্যতা বিকাশের ধারায় বিনোদনও জড়িয়ে আছে ব্যক্তি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রে। পরিবেশনা হিসেবে বিশেষ সময়ের বিবরণ বিস্তারিতভাবে মজুত রয়েছে যাত্রাচার্য্য মিলন কান্তি দে-র আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশে।
আত্মজীবনীতে থাকে ঘটনাবলি, তবে শুধুই কাহিনি বা ঘটনাবলি নয়, মূল্যবোধের কিছু ভিত্তি, জগতকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক দৃষ্টান্ত, কর্মময় জীবনের বাঁকে বাঁকে ইতিহাসের মোড়, সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ও টানাপোড়েন, জীবন সংগ্রামের কথা, শিল্পের সংগ্রামের কথা, -আর এতোসবের মধ্য থেকেই আমরা খুঁজে পাই সাহিত্যমূল্য, আত্মজীবনীকারের কীর্তির কথা।
কীর্তিমান মিলন কান্তি দে’র গ্রন্থে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এই বাংলাদেশে যাত্রাশিল্প আবহমান বাংলার কাদামাটির প্রতিবেশ থেকে উত্থিত হয়ে যে, আমাদের বাঙালির সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের গভীরে অমূল্য সম্পদ হয়ে উজ্জ¦ল ও জীবন্ত-তার সার্থক রূপটিকেও খুঁজে পাই আমরা।
মিলনকান্তি দে-র একাধিক প্রবন্ধগ্রন্থ ও যাত্রাপালা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশনার একটি তালিকা উল্লেখ করতেই হয়-গবেষণা : যাত্রাশিল্পের সেকাল-একাল, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, একুশের বইমেলা, ২০১৫; বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প ও অমলেন্দু বিশ্বাস, বাংলা একাডেমি, ২০২০; যাত্রাপালা : দাতা হাতেম তাই, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, একুশের বইমেলা, ২০১৬; রক্তে রাঙানো বর্ণমালা, চারুলিপি প্রকাশনী, একুশের বইমেলা, ২০১৯; আমি অমলেন্দু বিশ্বাস (একক অভিনয়)-থিয়েটার, ৪৯তম বর্ষ, ২৯ এপ্রিল ২০১৯; এক যে ছিলেন মহারাণী, বিভাস প্রকাশনী, একুশের বইমেলা, ২০২২; বিপ্লবী সোমেন চন্দ, বিভাস প্রকাশনী, একুশের বইমেলা, ২০২২; নির্বাচিত যাত্রাপালা, বাংলা একাডেমি, একুশের বইমেলা, ২০২৫। প্রবন্ধ গ্রন্থগুলো নানান বিষয় ভিত্তিক রচনার সংকলন। যাত্রাপালাগুলোও বিষয় বা কোনো খ্যাতিমানের চরিত্র বা জীবন কর্মভিত্তিক লেখা।
যাত্রাশিল্পে তাঁর যাত্রারম্ভ এবং নানান ঘটনা নানান বিষয় আমার বাসায় আড্ডার সময় শুনেছি। আড্ডার ভেতরই যাত্রাশিল্পের কিংবদন্তি অমলেন্দু বিশ^াস প্রসঙ্গে জানতে পেরে শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিলাম দুজনের প্রতিই। একদিনের আড্ডায় এই প্রাসঙ্গিকতায় তাগাদা দিয়ে বসলাম গবেষণাধর্মী পা-ুলিপি প্রণয়নের জন্য। আমি তখন বাংলা একাডেমির ফোকলোর জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের উপপরিচালকের দায়িত্বে।
কয়েকদিন আমার বাসায় তাকে ধ্যানস্থ ও স্থিতধি হতে বলি। হয়েছেনও তাই বাধ্য বৃদ্ধের মতো। পা-ুলিপি তৈরি করে বাংলা একাডেমিতে জমা দেন। ‘বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প ও অমলেন্দু বিশ^াস’ শিরোনামে। প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে।
তাঁর পক্ষ থেকেও আবার আমার প্রতি তাগাদা ছিল যাত্রাপালা রচনা করার জন্য। তাদের যাত্রা শিল্পের উন্নয়নের জন্য যে সংগঠন আছে সেখানে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের জন্য। আমি তাঁর তাগাদাকে, প্রেরণাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আমার লেখা ‘বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা’ শিরোনামে ঐতিহাসিক যাত্রাপালা তাঁর প্রেরণা ও তাগদার ফসল। সফল মঞ্চায়নও হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন জেলায়। তাঁর নিজস্ব যাত্রাদল দেশ অপেরা প্রথম মঞ্চে আনে পালাটি। পরিবেশিত হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। পালাটি তাঁকেই উৎসর্গ করা। উৎসর্গ পত্রে লিখেছিলাম ‘বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়ক বিশিষ্ট যাত্রাব্যক্তিত্ব মিলন কান্তি দে শ্রদ্ধাস্পদেষু’।
দুজনের সম্পর্কটা এমনই হয়ে যায় যে, তাঁকে দাদা ডাকলেও আমার প্রয়াত পিতা যাত্রাশিল্পী আজিজুর রহমানের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই তাঁর কর্মযজ্ঞে। আমার স্ত্রী ছড়াকার শিলু রহমানও তাঁকে দাদা সম্বোধন করলেও শ^শুরের মর্যাদায় আপ্যায়ন করে। সন্তান নূর নাহিয়ান তাঁকে উচ্চমার্গের যাত্রাশিল্পী হিসেবে তার দাদার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।
আবার একদিনের আড্ডায় নতুন করে তাগাদা ছুঁড়ে দিলাম। দাদা আত্মজীবনী চাই। ছাপার ব্যবস্থা আমি করব।
হচ্ছে, হবে করে করেÑ চলে যায়, বছর দুয়েক। এর মাঝে তিনি ক্যানসার বা কর্কটের কবলে পড়ে যান ২০২৩ সালের প্রথম দিকে। তাঁর যাপিত জীবন হয়ে ওঠে চিকিৎসা-নির্ভর। শরীর আর মন তখন বিপরীতমুখী অবস্থানে।
এরই মাঝে আবার তাগাদা ফুরায় না। হঠাৎ করেই একদিন শুনতে পেলাম, শুরু করে দিয়েছি ‘আমি যে এক যাত্রাওয়ালা’। আনন্দটা তখন অনুভব করলাম শিল্পের সঙ্গে বসবাসের মতো।
আত্মজীবনী লেখার জন্যে তিনি ছুটে গেছেন তাঁর নিজগ্রাম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কেলিশহরে। লেখা তিনভাগের দুই ভাগ শেষ। এমন অবস্থায় একদিন তাঁর ফোন পেলাম। খুব খারাপ অবস্থা গিয়েছে, মানবজীবনে যা সচরাচর ঘটে না। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন বলা যায়। আমি তাঁর কণ্ঠের সম্পূর্ণ আলাদা জগতের সাথে পরিচিত হওয়ায় কিছুক্ষণ পর ড্রইংরুমে এসে কান্না থামাতে পারছিলাম না।
স্বাভাবিক হওয়ার পর ফোন করেছিলাম। তিনি জানালেন, এই যাত্রায় যেহেতু বেঁচে গেছি; আশা করছি দ্রুতই শেষ করে আপনার বাসায় কম্পোজকৃত পা-ুলিপি নিয়ে চলে আসতে পারব।
তিনি চলেও এলেন। গ্রন্থাকারে সাজিয়ে দ্রুত প্রকাশ উপযোগী করার ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতি গবেষক ও কবি আমার অনুজ আশিক আজিজ ও লোকসংস্কৃতি গবেষক মো. সফিকুল ইসলাম ভূমিকা রেখেছে। দ্রুত প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছে মুনীর চৌধুরী রচিত ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের আহমদ শাহ্ আবদালীর ঐতিহাসিক চরিত্রে অভিনয়কারী মিলন কান্তি দে’র ছবি, যে-ছবিটি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের মানবিকতার জয়গানে মুখরতার প্রতীক।
মিলন কান্তি দে’র জন্ম ১৯৪৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর। জন্মেছেন চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ছনহরা গ্রামে। বাবা নগেন্দ্র লাল দে, মা সুনীতি বালা দে। তাঁর যাত্রাশিল্পের সূচনা ১৯৬৬ সালে বরিশালের ‘বাবুল যাত্রাপার্টি’তে যোগদানের মধ্য দিয়ে। পরবর্তী পর্যায়ে নিজেই ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দেশ অপেরা। যার স্বত্বাধিকারীও তিনি নিজে। তাঁর অভিনীত পালার সংখ্যা ১৫১ এবং নির্দেশিত পালার সংখ্যা ১১৫। যাত্রাশিল্পে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন ২০২২ সালে এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা অর্জন করেন ২০২৩ সালে।
‘আত্মজীবনী : আমি যে এক যাত্রাওয়ালা’ প্রকাশ করেছে নবান্ন প্রকাশনী।
আত্মজীবনীÑ আমি যে এক যাত্রাওয়ালা। মিলন কান্তি দে। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ। প্রকাশক : নবান্ন প্রকাশনী। প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০২৪। মূল্য: ৫০০ টাকা
আমিনুর রহমান সুলতান
বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
মিলন কান্তি দে যাত্রাশিল্পের অনুশীলন করে চলেছেন এই পড়ন্ত বিকেলেও। গোধূলি খুবই সন্নিকটে। তারপর রাত। ধলপ্রহর পেরিয়ে আবার সকাল। একেকটি সকালকে, একেকটি দিনকে, একেকটি রাতকে তিনি মূল্যমান করে রাখার প্রয়াসী তাঁর যাত্রাশিল্পজগতকে কেন্দ্রে রেখে।
যাত্রাপালায় অভিনয়ে, রচনায়, নির্দেশনায়, সুরক্ষায় সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠান গড়ার মধ্য দিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও আন্দোলন গড়ে তোলা, যাত্রাশিল্পের সেকালকে একালের আলোকে দেখা, যাত্রাশিল্পকে-শিল্পীকে অধিকারবোধে জায়গা করে দেওয়ার জন্য লেখালেখি প্রভৃতির যে-শিল্পবোধ তা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
পড়ন্ত বিকেলে যাত্রাশিল্পের সারকথা ‘আত্মজীবনী: আমি যে এক যাত্রাওয়ালা’-র প্রতিটি পৃষ্ঠায় ব্যক্ত হয়েছে রসেরও যে, একটি রূপ আছেÑ তা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
তাঁর শিল্পবাড়ি দুটি। এক. যাত্রাবাড়ি, অর্থাৎ যাত্রাশিল্পের বাড়ি। দুই. গ্রামের বাড়ি, যে বাড়িতে এখন সংসার আগলে রেখেছেন তাঁর স্ত্রী গীতা রাণী দে। যাত্রাজগতকে ভালোবেসেছেন আপন সংসারকে ভালোবাসার বাইরে রেখে নয় বা আপন সংসারকে ভালোবেসেছেন যাত্রাজগতকে ভালোবাসার বাইরে রেখে নয়।
তিনি তিন পুত্র ও এক কন্যার জনক। তারা তাদের স্ব স্ব অবস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত; সুখী সংসার জীবনেও।
সাফল্য অর্জনে তিনি ব্যর্থ নন, অতন্ত্র প্রহরীর মতো আগলে রেখেছেন দুইটি বাড়িকেই।
প্রতিটি মানুষের ভেতরই শিল্পবোধ জেগে আছে নানান মাত্রিকতায়। কখনও কলা হিসেবে কখনও বা পরিবেশনা হিসেবে। পরিবেশনা মাধ্যমের কোনো কোনোটিতে আবার বিনোদনের ছাপ রেখে যায়। সভ্যতা বিকাশের ধারায় বিনোদনও জড়িয়ে আছে ব্যক্তি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রে। পরিবেশনা হিসেবে বিশেষ সময়ের বিবরণ বিস্তারিতভাবে মজুত রয়েছে যাত্রাচার্য্য মিলন কান্তি দে-র আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশে।
আত্মজীবনীতে থাকে ঘটনাবলি, তবে শুধুই কাহিনি বা ঘটনাবলি নয়, মূল্যবোধের কিছু ভিত্তি, জগতকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক দৃষ্টান্ত, কর্মময় জীবনের বাঁকে বাঁকে ইতিহাসের মোড়, সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ও টানাপোড়েন, জীবন সংগ্রামের কথা, শিল্পের সংগ্রামের কথা, -আর এতোসবের মধ্য থেকেই আমরা খুঁজে পাই সাহিত্যমূল্য, আত্মজীবনীকারের কীর্তির কথা।
কীর্তিমান মিলন কান্তি দে’র গ্রন্থে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এই বাংলাদেশে যাত্রাশিল্প আবহমান বাংলার কাদামাটির প্রতিবেশ থেকে উত্থিত হয়ে যে, আমাদের বাঙালির সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের গভীরে অমূল্য সম্পদ হয়ে উজ্জ¦ল ও জীবন্ত-তার সার্থক রূপটিকেও খুঁজে পাই আমরা।
মিলনকান্তি দে-র একাধিক প্রবন্ধগ্রন্থ ও যাত্রাপালা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশনার একটি তালিকা উল্লেখ করতেই হয়-গবেষণা : যাত্রাশিল্পের সেকাল-একাল, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, একুশের বইমেলা, ২০১৫; বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প ও অমলেন্দু বিশ্বাস, বাংলা একাডেমি, ২০২০; যাত্রাপালা : দাতা হাতেম তাই, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, একুশের বইমেলা, ২০১৬; রক্তে রাঙানো বর্ণমালা, চারুলিপি প্রকাশনী, একুশের বইমেলা, ২০১৯; আমি অমলেন্দু বিশ্বাস (একক অভিনয়)-থিয়েটার, ৪৯তম বর্ষ, ২৯ এপ্রিল ২০১৯; এক যে ছিলেন মহারাণী, বিভাস প্রকাশনী, একুশের বইমেলা, ২০২২; বিপ্লবী সোমেন চন্দ, বিভাস প্রকাশনী, একুশের বইমেলা, ২০২২; নির্বাচিত যাত্রাপালা, বাংলা একাডেমি, একুশের বইমেলা, ২০২৫। প্রবন্ধ গ্রন্থগুলো নানান বিষয় ভিত্তিক রচনার সংকলন। যাত্রাপালাগুলোও বিষয় বা কোনো খ্যাতিমানের চরিত্র বা জীবন কর্মভিত্তিক লেখা।
যাত্রাশিল্পে তাঁর যাত্রারম্ভ এবং নানান ঘটনা নানান বিষয় আমার বাসায় আড্ডার সময় শুনেছি। আড্ডার ভেতরই যাত্রাশিল্পের কিংবদন্তি অমলেন্দু বিশ^াস প্রসঙ্গে জানতে পেরে শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিলাম দুজনের প্রতিই। একদিনের আড্ডায় এই প্রাসঙ্গিকতায় তাগাদা দিয়ে বসলাম গবেষণাধর্মী পা-ুলিপি প্রণয়নের জন্য। আমি তখন বাংলা একাডেমির ফোকলোর জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের উপপরিচালকের দায়িত্বে।
কয়েকদিন আমার বাসায় তাকে ধ্যানস্থ ও স্থিতধি হতে বলি। হয়েছেনও তাই বাধ্য বৃদ্ধের মতো। পা-ুলিপি তৈরি করে বাংলা একাডেমিতে জমা দেন। ‘বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প ও অমলেন্দু বিশ^াস’ শিরোনামে। প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে।
তাঁর পক্ষ থেকেও আবার আমার প্রতি তাগাদা ছিল যাত্রাপালা রচনা করার জন্য। তাদের যাত্রা শিল্পের উন্নয়নের জন্য যে সংগঠন আছে সেখানে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের জন্য। আমি তাঁর তাগাদাকে, প্রেরণাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আমার লেখা ‘বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা’ শিরোনামে ঐতিহাসিক যাত্রাপালা তাঁর প্রেরণা ও তাগদার ফসল। সফল মঞ্চায়নও হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন জেলায়। তাঁর নিজস্ব যাত্রাদল দেশ অপেরা প্রথম মঞ্চে আনে পালাটি। পরিবেশিত হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। পালাটি তাঁকেই উৎসর্গ করা। উৎসর্গ পত্রে লিখেছিলাম ‘বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়ক বিশিষ্ট যাত্রাব্যক্তিত্ব মিলন কান্তি দে শ্রদ্ধাস্পদেষু’।
দুজনের সম্পর্কটা এমনই হয়ে যায় যে, তাঁকে দাদা ডাকলেও আমার প্রয়াত পিতা যাত্রাশিল্পী আজিজুর রহমানের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই তাঁর কর্মযজ্ঞে। আমার স্ত্রী ছড়াকার শিলু রহমানও তাঁকে দাদা সম্বোধন করলেও শ^শুরের মর্যাদায় আপ্যায়ন করে। সন্তান নূর নাহিয়ান তাঁকে উচ্চমার্গের যাত্রাশিল্পী হিসেবে তার দাদার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।
আবার একদিনের আড্ডায় নতুন করে তাগাদা ছুঁড়ে দিলাম। দাদা আত্মজীবনী চাই। ছাপার ব্যবস্থা আমি করব।
হচ্ছে, হবে করে করেÑ চলে যায়, বছর দুয়েক। এর মাঝে তিনি ক্যানসার বা কর্কটের কবলে পড়ে যান ২০২৩ সালের প্রথম দিকে। তাঁর যাপিত জীবন হয়ে ওঠে চিকিৎসা-নির্ভর। শরীর আর মন তখন বিপরীতমুখী অবস্থানে।
এরই মাঝে আবার তাগাদা ফুরায় না। হঠাৎ করেই একদিন শুনতে পেলাম, শুরু করে দিয়েছি ‘আমি যে এক যাত্রাওয়ালা’। আনন্দটা তখন অনুভব করলাম শিল্পের সঙ্গে বসবাসের মতো।
আত্মজীবনী লেখার জন্যে তিনি ছুটে গেছেন তাঁর নিজগ্রাম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কেলিশহরে। লেখা তিনভাগের দুই ভাগ শেষ। এমন অবস্থায় একদিন তাঁর ফোন পেলাম। খুব খারাপ অবস্থা গিয়েছে, মানবজীবনে যা সচরাচর ঘটে না। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন বলা যায়। আমি তাঁর কণ্ঠের সম্পূর্ণ আলাদা জগতের সাথে পরিচিত হওয়ায় কিছুক্ষণ পর ড্রইংরুমে এসে কান্না থামাতে পারছিলাম না।
স্বাভাবিক হওয়ার পর ফোন করেছিলাম। তিনি জানালেন, এই যাত্রায় যেহেতু বেঁচে গেছি; আশা করছি দ্রুতই শেষ করে আপনার বাসায় কম্পোজকৃত পা-ুলিপি নিয়ে চলে আসতে পারব।
তিনি চলেও এলেন। গ্রন্থাকারে সাজিয়ে দ্রুত প্রকাশ উপযোগী করার ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতি গবেষক ও কবি আমার অনুজ আশিক আজিজ ও লোকসংস্কৃতি গবেষক মো. সফিকুল ইসলাম ভূমিকা রেখেছে। দ্রুত প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছে মুনীর চৌধুরী রচিত ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের আহমদ শাহ্ আবদালীর ঐতিহাসিক চরিত্রে অভিনয়কারী মিলন কান্তি দে’র ছবি, যে-ছবিটি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের মানবিকতার জয়গানে মুখরতার প্রতীক।
মিলন কান্তি দে’র জন্ম ১৯৪৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর। জন্মেছেন চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ছনহরা গ্রামে। বাবা নগেন্দ্র লাল দে, মা সুনীতি বালা দে। তাঁর যাত্রাশিল্পের সূচনা ১৯৬৬ সালে বরিশালের ‘বাবুল যাত্রাপার্টি’তে যোগদানের মধ্য দিয়ে। পরবর্তী পর্যায়ে নিজেই ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দেশ অপেরা। যার স্বত্বাধিকারীও তিনি নিজে। তাঁর অভিনীত পালার সংখ্যা ১৫১ এবং নির্দেশিত পালার সংখ্যা ১১৫। যাত্রাশিল্পে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন ২০২২ সালে এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা অর্জন করেন ২০২৩ সালে।
‘আত্মজীবনী : আমি যে এক যাত্রাওয়ালা’ প্রকাশ করেছে নবান্ন প্রকাশনী।
আত্মজীবনীÑ আমি যে এক যাত্রাওয়ালা। মিলন কান্তি দে। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ। প্রকাশক : নবান্ন প্রকাশনী। প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০২৪। মূল্য: ৫০০ টাকা