alt

সাময়িকী

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

দেলোয়ার হাসান

: বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

‘আবার নরকুম্বীর’ উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে স্কুল বয় মৃণাল ঘোষ ওরফে খোকনের অপমৃত্যুর সংবাদ পরিবেশন কেন্দ্র করে। খোকনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালিকচ্ছ গ্রাম। খোকনের বাবা গোয়ালা। ১২-১৩ বছরের ছেলে খোকন স্কুলে পড়ার পাশাপাশি বাবার কাজে সহযোগিতাও তার একটি কাজ। খোকন ভালো সাতারু। খোকন ব্রাহ্মাণবাড়িয়ার মেড্ডা বাজার থেকে পৌষের মেলায় যাবার সময় নিখোঁজ হয়। তার লাশ উদ্ধার হয় কুরোলিয়া খাল থেকে। খোকনের মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে উপমহাদেশের বিপ্লবীদের ইতিহাস এবং মফস্বল সাংবাদিকতা ও আঞ্চলিক সংবাদপত্রের সংবাদ পরিবেশন, পুলিশ এমনকি বৃটিশ শাসন সর্বোপরি ধর্মবোধকে চুরমার করে নায়ক সাংবাদিক ঝন্টুর সঙ্গে কলেজ শিক্ষিকা নবনিতা ঘোষের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে কিংবদন্তী গায়ক শচীন দেব বর্মণের সেই গানে ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে’। উপন্যাসের লেখক তওফিক মুজতাবা ও জুনায়েদ সাদেক। উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আবিষ্কার। প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমীন।

আধুনিকতা একটি দার্শনিক আন্দোলনÑ যা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা সমাজে সুদূর প্রসারী ও ব্যাপক রূপান্তরের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রবণতা ও পরিবর্তনের সাথে সাথে উত্থান লাভ করে। যেসব ফ্যাক্টর আধুনিকতাবাদকে বর্তমান রূপ দান করে তার মধ্যে শিল্পভিত্তিক সমাজ গঠন, নগরের দ্রুত বিকাশ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। নবকুম্ভরী গ্রন্থের পাতায় পাতায় পাঠক সেই স্বাদ পাবেন।

আধুনিকতাবাদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো আত্মসচেতনতা। সাংবাদিক ঝণ্টু, তার ফুফু, ফুফা এমনকি উপন্যাসের অপরাপর চরিত্রে তা ফুটে উঠেছে।

লেখক জুনায়েদ সাদেক প্রায় ছ’যুগ আগের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি গল্পে সার্থকভাবে জড়িয়ে দিয়েছেন দেশভাগ থেকে বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের অত্যাচারের নির্মমতা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বয়ান। বিশেষ করে পশ্চিমা জনগণ, যারা একে সমাজে চিন্তার প্রগতিশীল ভাবধারা বলে মনে করে, যা মানুষকে ব্যবহারিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা প্রযুক্তির সাহায্যে তাদের পরিবেশ সৃষ্টি, উন্নয়ন ও পুনঃনির্মাণ করার ক্ষমতাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এদিক থেকে আধুনিকতাবাদ যা অগ্রগতিকে আটকে রেখেছিল তা খুঁজে বের করার লক্ষ্যে বাণিজ্য থেকে দর্শন পর্যন্ত অস্তিত্বের প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিবেচনাকে একই প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য নতুন উপায়ে তা প্রতিস্থাপন করার লক্ষ্যে উৎসাহ দেয়। অন্যরা নান্দনিক আত্মদর্শন হিসাবে আধুনিকতার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করেন।

যদিও কিছু কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে, আধুনিকতা বিশ শতকেও অব্যাহত হয়েছে, অন্যদের মতে এটি বিলম্বিত-আধুনিকতা বা উচ্চ আধুনিকতাবাদে পরিবর্তিত হয়েছে, যে জায়গা পরে উত্তর-আধুনিকতা দখল করে।

লেখক তওফিক মুজতাবার কথায়, ছোটবেলায় আমি খাবার নিয়ে বড্ড বিরক্ত করতাম। এটা বেশি ভেজা ভেজা লাগে, ওটা কটকটা শুকনো, এটা খুব শক্ত, ওটা বেশি নরম, এটা ঝাল তো ওটা বেশি মিষ্টি, এটা আজ ভাল লাগছে না, ওটা তো কোনো দিনই মজা না, এখন খিদে নেই, এরকম একটা না একটা অজুহাত লেগেই থাকত। অন্যেরা যখন বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিতেন, আমার নানু তখন অনেক কষ্ট করে গল্প বলে বলে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে খাওয়াতেন। আমি আবার রোজ রোজ এক গল্প শুনতে নারাজ। ওদিকে নানু বেচারা প্রতি দিন নতুন নতুন গল্প সাজাতে সাজাতে ক্লান্ত। কিন্তু ছাড়াছাড়ি নেই, নানু আমার নিয়মিত উদর পূর্তি করেই ছাড়বেন! এতে করে আমার পুষ্টি নিশ্চয়তা ছাড়াও তাঁর এবং আমার দু’জনারই অজান্তে আমার আসল প্রাপ্তি হয়ে উঠত হাজারও রঙিন কল্পনা, ‘যদি’র যাদু ভরা হাজারও স্বপ্ন।

এসব গল্পের মধ্যে একবার শুনেছিলাম, ইচ্ছে করলেই কুমিরে রূপান্তরিত হবার অলৌকিক শক্তিধারি এক জাদুকরের কাহিনী। এর অন্তত পঞ্চাশ বছর পর, হঠাৎ এক দিন হয়ত অবচেতন মনের তাগিদেই, ‘নরকুম্ভীর’ নামে একটা গল্প লিখে ফেলেছিলাম, সেও আজ থেকে দশ-এগারো বছর আগের কথা। তারপর ভুলে গেছি।

নরকুম্ভীর যে কোনোদিন কোনও পাঠককে গভীরভাবে কৌতূহলী করে তুলতে পারে, তা কখনও ভাবিনি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে এত দিন পর জুনায়েদ সাদেক লিখে ফেলেছেন এক অনবদ্য গল্প, ‘নরকুম্ভীর ২’। আর এ দুটো গল্প মিলে সৃষ্টি হয়েছে, ‘আবার নরকুম্ভীর’।

‘নরকুম্ভীর’ post modernism (উত্তর-আধুনিকতা)’র দর্শন মেনে লেখা। বলতে লজ্জা নেই, বইপত্র প্রায় পড়ি না বলে এই পদ্ধতিটার সাথে আমি খুব বেশি পরিচিত নই। তবু, তথ্যসমৃদ্ধ কাহিনী, রচনা শৈলী এবং ভাষা প্রয়োগে জুনায়েদের মুন্সিয়ানা আমাকে মুগ্ধ করেছে। লেখাটা অনেকের কাছেই ভাল লাগবে বলে মনে করি।

জুনায়েদ সাদেক বলেছেন, আশির দশকের প্রথম দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালে এক বন্ধুর উৎপীড়নে একটি ছোটগল্প লিখেছিলেন স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক বার্তার জন্যে। এরপর থেকে বন্ধুদের মনোরঞ্জনের জন্যে অল্পবিস্তর লিখতাম। মাঝে দীর্ঘ বিরতি। তারপর ২০১০ সালে ‘সুরেশ বৃন্দাবনি’ ও ‘নরকুম্ভীর’ দিয়ে তওফিক মুজতাবা লেখালেখির জগতে প্রবেশ করলে তাঁর উৎসাহে সেই ঝোঁকটা আবার ফিরে আসে। এমনি করে মূলত ছোটগল্পের আঙিনায় অনিয়মিত উঁকিঝুঁকি কয়েক যুগ ধরে। মাঝে মধ্যে আরো দু’চারটা গল্প সমাদৃত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। ১৯৯২ সালে ভূতত্ত্বে উচ্চশিক্ষার জন্যে নরওয়ে গেলে এক বাঙালি যুবকের সঙ্গে দেখা হয়। সেই যুবক তখন সেখানকার ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তাকে ভয়ে ভয়ে আমার গল্পটা পড়ে শুনালাম। সে লাফিয়ে উঠে বলল, আরে ভাই আপনিতো দেখি কি সাংঘাতিক ডিকন্সট্রাকশন করে ফেলেছেন। আপনাকে তো আমার একজন পোস্টমডার্নিস্ট বলেই মনে হচ্ছে। কতটুকু সার্থক হয়েছে তা বলবেন পাঠক। ছোট্ট উপন্যাসটি পাবেন রকমারি ডটকমে ও আবিষ্কার বইয়ের দোকানে। তবে ‘আবার নরকুম্ভীর’ই বই আকারে তাঁর লেখার প্রথম আত্মপ্রকাশ। জুনায়েদ সাদেক ১৯৬৪ সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় পরিবেশ ভূতত্ত্ববিদ। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস থেকে পিএইচডি শেষ করে দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কে তিনি এ বইয়ের অন্য লেখক তওফিক মুজতাবার ভ্রাতুষ্পুত্র।

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

tab

সাময়িকী

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

দেলোয়ার হাসান

বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

‘আবার নরকুম্বীর’ উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে স্কুল বয় মৃণাল ঘোষ ওরফে খোকনের অপমৃত্যুর সংবাদ পরিবেশন কেন্দ্র করে। খোকনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালিকচ্ছ গ্রাম। খোকনের বাবা গোয়ালা। ১২-১৩ বছরের ছেলে খোকন স্কুলে পড়ার পাশাপাশি বাবার কাজে সহযোগিতাও তার একটি কাজ। খোকন ভালো সাতারু। খোকন ব্রাহ্মাণবাড়িয়ার মেড্ডা বাজার থেকে পৌষের মেলায় যাবার সময় নিখোঁজ হয়। তার লাশ উদ্ধার হয় কুরোলিয়া খাল থেকে। খোকনের মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে উপমহাদেশের বিপ্লবীদের ইতিহাস এবং মফস্বল সাংবাদিকতা ও আঞ্চলিক সংবাদপত্রের সংবাদ পরিবেশন, পুলিশ এমনকি বৃটিশ শাসন সর্বোপরি ধর্মবোধকে চুরমার করে নায়ক সাংবাদিক ঝন্টুর সঙ্গে কলেজ শিক্ষিকা নবনিতা ঘোষের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে কিংবদন্তী গায়ক শচীন দেব বর্মণের সেই গানে ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে’। উপন্যাসের লেখক তওফিক মুজতাবা ও জুনায়েদ সাদেক। উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আবিষ্কার। প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমীন।

আধুনিকতা একটি দার্শনিক আন্দোলনÑ যা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা সমাজে সুদূর প্রসারী ও ব্যাপক রূপান্তরের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রবণতা ও পরিবর্তনের সাথে সাথে উত্থান লাভ করে। যেসব ফ্যাক্টর আধুনিকতাবাদকে বর্তমান রূপ দান করে তার মধ্যে শিল্পভিত্তিক সমাজ গঠন, নগরের দ্রুত বিকাশ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। নবকুম্ভরী গ্রন্থের পাতায় পাতায় পাঠক সেই স্বাদ পাবেন।

আধুনিকতাবাদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো আত্মসচেতনতা। সাংবাদিক ঝণ্টু, তার ফুফু, ফুফা এমনকি উপন্যাসের অপরাপর চরিত্রে তা ফুটে উঠেছে।

লেখক জুনায়েদ সাদেক প্রায় ছ’যুগ আগের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি গল্পে সার্থকভাবে জড়িয়ে দিয়েছেন দেশভাগ থেকে বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের অত্যাচারের নির্মমতা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বয়ান। বিশেষ করে পশ্চিমা জনগণ, যারা একে সমাজে চিন্তার প্রগতিশীল ভাবধারা বলে মনে করে, যা মানুষকে ব্যবহারিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা প্রযুক্তির সাহায্যে তাদের পরিবেশ সৃষ্টি, উন্নয়ন ও পুনঃনির্মাণ করার ক্ষমতাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এদিক থেকে আধুনিকতাবাদ যা অগ্রগতিকে আটকে রেখেছিল তা খুঁজে বের করার লক্ষ্যে বাণিজ্য থেকে দর্শন পর্যন্ত অস্তিত্বের প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিবেচনাকে একই প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য নতুন উপায়ে তা প্রতিস্থাপন করার লক্ষ্যে উৎসাহ দেয়। অন্যরা নান্দনিক আত্মদর্শন হিসাবে আধুনিকতার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করেন।

যদিও কিছু কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে, আধুনিকতা বিশ শতকেও অব্যাহত হয়েছে, অন্যদের মতে এটি বিলম্বিত-আধুনিকতা বা উচ্চ আধুনিকতাবাদে পরিবর্তিত হয়েছে, যে জায়গা পরে উত্তর-আধুনিকতা দখল করে।

লেখক তওফিক মুজতাবার কথায়, ছোটবেলায় আমি খাবার নিয়ে বড্ড বিরক্ত করতাম। এটা বেশি ভেজা ভেজা লাগে, ওটা কটকটা শুকনো, এটা খুব শক্ত, ওটা বেশি নরম, এটা ঝাল তো ওটা বেশি মিষ্টি, এটা আজ ভাল লাগছে না, ওটা তো কোনো দিনই মজা না, এখন খিদে নেই, এরকম একটা না একটা অজুহাত লেগেই থাকত। অন্যেরা যখন বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিতেন, আমার নানু তখন অনেক কষ্ট করে গল্প বলে বলে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে খাওয়াতেন। আমি আবার রোজ রোজ এক গল্প শুনতে নারাজ। ওদিকে নানু বেচারা প্রতি দিন নতুন নতুন গল্প সাজাতে সাজাতে ক্লান্ত। কিন্তু ছাড়াছাড়ি নেই, নানু আমার নিয়মিত উদর পূর্তি করেই ছাড়বেন! এতে করে আমার পুষ্টি নিশ্চয়তা ছাড়াও তাঁর এবং আমার দু’জনারই অজান্তে আমার আসল প্রাপ্তি হয়ে উঠত হাজারও রঙিন কল্পনা, ‘যদি’র যাদু ভরা হাজারও স্বপ্ন।

এসব গল্পের মধ্যে একবার শুনেছিলাম, ইচ্ছে করলেই কুমিরে রূপান্তরিত হবার অলৌকিক শক্তিধারি এক জাদুকরের কাহিনী। এর অন্তত পঞ্চাশ বছর পর, হঠাৎ এক দিন হয়ত অবচেতন মনের তাগিদেই, ‘নরকুম্ভীর’ নামে একটা গল্প লিখে ফেলেছিলাম, সেও আজ থেকে দশ-এগারো বছর আগের কথা। তারপর ভুলে গেছি।

নরকুম্ভীর যে কোনোদিন কোনও পাঠককে গভীরভাবে কৌতূহলী করে তুলতে পারে, তা কখনও ভাবিনি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে এত দিন পর জুনায়েদ সাদেক লিখে ফেলেছেন এক অনবদ্য গল্প, ‘নরকুম্ভীর ২’। আর এ দুটো গল্প মিলে সৃষ্টি হয়েছে, ‘আবার নরকুম্ভীর’।

‘নরকুম্ভীর’ post modernism (উত্তর-আধুনিকতা)’র দর্শন মেনে লেখা। বলতে লজ্জা নেই, বইপত্র প্রায় পড়ি না বলে এই পদ্ধতিটার সাথে আমি খুব বেশি পরিচিত নই। তবু, তথ্যসমৃদ্ধ কাহিনী, রচনা শৈলী এবং ভাষা প্রয়োগে জুনায়েদের মুন্সিয়ানা আমাকে মুগ্ধ করেছে। লেখাটা অনেকের কাছেই ভাল লাগবে বলে মনে করি।

জুনায়েদ সাদেক বলেছেন, আশির দশকের প্রথম দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালে এক বন্ধুর উৎপীড়নে একটি ছোটগল্প লিখেছিলেন স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক বার্তার জন্যে। এরপর থেকে বন্ধুদের মনোরঞ্জনের জন্যে অল্পবিস্তর লিখতাম। মাঝে দীর্ঘ বিরতি। তারপর ২০১০ সালে ‘সুরেশ বৃন্দাবনি’ ও ‘নরকুম্ভীর’ দিয়ে তওফিক মুজতাবা লেখালেখির জগতে প্রবেশ করলে তাঁর উৎসাহে সেই ঝোঁকটা আবার ফিরে আসে। এমনি করে মূলত ছোটগল্পের আঙিনায় অনিয়মিত উঁকিঝুঁকি কয়েক যুগ ধরে। মাঝে মধ্যে আরো দু’চারটা গল্প সমাদৃত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। ১৯৯২ সালে ভূতত্ত্বে উচ্চশিক্ষার জন্যে নরওয়ে গেলে এক বাঙালি যুবকের সঙ্গে দেখা হয়। সেই যুবক তখন সেখানকার ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তাকে ভয়ে ভয়ে আমার গল্পটা পড়ে শুনালাম। সে লাফিয়ে উঠে বলল, আরে ভাই আপনিতো দেখি কি সাংঘাতিক ডিকন্সট্রাকশন করে ফেলেছেন। আপনাকে তো আমার একজন পোস্টমডার্নিস্ট বলেই মনে হচ্ছে। কতটুকু সার্থক হয়েছে তা বলবেন পাঠক। ছোট্ট উপন্যাসটি পাবেন রকমারি ডটকমে ও আবিষ্কার বইয়ের দোকানে। তবে ‘আবার নরকুম্ভীর’ই বই আকারে তাঁর লেখার প্রথম আত্মপ্রকাশ। জুনায়েদ সাদেক ১৯৬৪ সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় পরিবেশ ভূতত্ত্ববিদ। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস থেকে পিএইচডি শেষ করে দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কে তিনি এ বইয়ের অন্য লেখক তওফিক মুজতাবার ভ্রাতুষ্পুত্র।

back to top