কার্লোস ফুয়েন্তেসের গল্প
অনুবাদ : জয়া চৌধুরী
- তোমাকে জাগিয়েছি, না?
- না না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছিল।
- তাড়াতাড়ি...
- ঠিক তুমি যখন গেলে তার পরেই।
- এখন কী করছ?
- বললাম তো তোমায়। সবকিছু এলোমেলো ছত্রখান হয়ে আছে, আবার দ্বিতীয় দিনের শ্যুটিঙ শুরু হয়ে যাবে। রুথ খুব বেশিদূর যায়নি, অথচ আমাদের কুড়িখানা নতুন বস্তা পছন্দ করে নিতে হবে। সেগুলো সঙ্গে যাবে। তার জন্য ওই ইউরোপিয়ানদের মতো হলদে জামা পরা বড় বড় চোখওয়ালা মেয়েটার কাছে কিনতে যেতে পারি। তুমি তো জান আমার ওপর দেশের সম্মান জড়িয়ে আছে...। তোমাকে বলিনি, না? আগে মেক্সিকো বলতে পাঞ্চো ভিইয়া কে (পাঞ্চো ভিইয়া-মেক্সিকোর বিপ্লব ‘মেক্সিকান রেভলিউশনারি’-র সবচেয়ে বিখ্যাত জেনারেল) বোঝাতো। আর এখন সেটা হচ্ছি আমি।
- তাহলে, খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছ?
- কোথায় আছ, সোনা! ব্রেকডাউনটা তৈরি। ওরা ইতালিতে লোকেশান বেছে রেখেছে, আমার ব্যাগের মধ্যে প্লেনের টিকিট রাখা।
- ও তো সবসময়ই থাকে।
- আজ্ঞে হ্যাঁ। এতে আশ্চর্য হবার কী আছে।
- আর দশ দিন শুধু।
- একদিন বেশিও নয়, একদিন কমও নয়। এখন বল ফোন করেছ কেন...
- মা, ইয়ে গতকালÑ
- ওটা কোন ব্যাপার নয়। কিছু হয়নি।
- আমি ওটা মিটিয়ে নিতে চেয়েছিলাম, এই আর কি।
- লক্ষ্মী সোনা। কোথাও বিচ্ছিরি ভিড়ভাট্টার মধ্যে যদি দেখ আমি পড়ে গেছি, নিশ্চিত জেনো আমি তোমার কথাই ভাবি তখন।
- সত্যি?
- ভগবানের দিব্যি।
- ইস্ এখন তোমার কাছে থাকতে ইচ্ছে করছে।
- আমারও। বিশ্বাস করো।
- জানো, যদি লাইনটা টপকে তোমার কাছে চলে যেতে পারতাম, তোমাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু দিতে পারতাম...
- এঃ হেঃ
- মা...
- ব্যথার জায়গায় প্রলেপ পড়ে না এতে, টনটনানি থেকেই যায়।
- হুঁ তালে তাই। কিন্তু আমি তো তোমায় ব্যথা দিইনি।
- তো? তুমি কি ভাবছ ঘর থেকে চিৎকার করতে করতে বেরোবে? কান খাড়া করে থাকা নিচের লোকগুলোকে ওখানেই থামিয়ে দেয়া আছে।
- আর তুমি? এমন নয় যে সে আর একজন ফোটোগ্রাফার শুধু। হয়তো তুমি তাকে কুশলও জিজ্ঞাসা করেছিলে; হাল্কা খাবারের ট্রে হাতে একজন পরিচারকের বেশি আর কিছু নয়...
- কে পাঠিয়েছে তোমাকে? তুমি তো জানো আমার পেশাদারী জীবন আর ব্যক্তিগত জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। তাতে নাক গলানো... তুমি সমস্যা খুঁজে বেড়াচ্ছ।
- আমি যখন চলে এলাম কী করলে তুমি?
- আজ সকালে তুমি চমকে গেছিলে, না? আসলে আমি ঘুমিয়েছিলাম। অতসব কা-কারখানা হয়ে যাবার পরে ভাবছ যে আমার খারাপ লেগেছে?
- সেকথা আগেই বলেছ তুমি। তোমার কথায় যুক্তি আছে। প্লিজ মাফ করে দাও।
- আরেঃ, কী ব্যাপারে মাফ? আমার মন থেকে তেতো ভাব যায় না।
- আমি জানি সেটা। কিন্তু... কিন্তু বেরিয়ে আসার আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার ফিরে এসে যদি মাফ চাইতাম আমি...
- আমাকে বিছানায় শোয়া দেখতে তুমি, বুক আর পিঠের মাঝখানে একটা নিম্বুটাল খেয়ে।
- তুমি একা ছিলে।
- না, রুথ আমাকে পিলটা দিল। খুব কাজে দিয়েছে ওষুধটা। হুম্ম্ম্ কীভাবে যে ঠা-া বাতাস আর হৈ চৈ গ-গোলের মধ্যে রাতটা কাটিয়েছি তা যদি দেখতে।
- তোমার সঙ্গে থাকতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।
- আজ সময় নেই। সব ক’টা ড্রয়ার উপুড় করে দিয়েছি। মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধক্ষেত্র। এই ছত্রখান হয়ে থাকা বিশৃঙ্খলাটা আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে।
- এক মিনিট সময় দাও।
- না। তোমরই দোষ।
- কেন?
- তোমাকে তো বলেছি গতকাল অনুমতি ছাড়াই ওখানে এলে, লোকে লোকারণ্য ছিল। একটু অপেক্ষা করতে যদি আজ আমাকে একলা পেতে।
- দেখছি অনেক মাস হয়ে গেল একলাই থাকছ।
- আমি সেরে উঠেছি, মনা।
- হাসালে।
- কী নিয়ে?
- কী সাবধানী হয়ে গেছ তুমি! তুমি কি ভুলে গেলে বিশ বছর হয়ে গেল আমরা আনন্দ করে একসঙ্গে হইনি?
- নিশ্চয়ই। দেখো তুমি এখনো কী...।
- ওহ্ মা। এসবের তী দরকার...
- দরকার? দরকার জেলবন্দিদের যারা এখনো ফুটপাথটাও দেখেনি...
- প্লিজ আমি ঝগড়া করবার জন্য একথা বলিনি।
- এখনো ‘আমার সঙ্গে ঝগড়া করো তুমি’ সেকথা তোমার বলা অভ্যাস হয়নি।
- ঠিক বলেছো। শুধু নিজেকে বুঝ দেওয়ার জন্য বললাম।
- কী ব্যাপার মনা?
- এই যে গতকাল রাত্তিরে ঘটা ঘটনার কোনো গুরুত্ব নেই।
- কথাটা আসলে হলোÑ আমি খেই হারিয়ে ফেলেছি।
- ঐ হ্যান্ডসাম ছেলেটা যার গা দিয়ে ল্যাভে-ারের গন্ধ বেরুচ্ছিল।
- গিইয়েরমো। গিইয়েরমি তো। মিতো।
- হেসো না।
- আমি ওকে পাঠিয়ে দেব তোমার কাছে। ওহ্্ রাজা হেরোদ!
- এই যে তুমি হেসো না। তুমি জানো না ও...
- ফোনটা রুথকে দিচ্ছি। বাই।
- কে?
-হ্যালো উইলিয়াম নাকি?
- হ্যাঁ, রুথ।
- পৌনে আটটায় ম্যাডাম আমায় ফোন করতে বলেছিলেন। আমি বাথটাবে ছিলাম। ওনার গায়ে বাথ টাওয়েল জড়িয়ে দিয়েছিলাম। দারচিনি দেওয়া এক কাপ চা চাইলেন উনি। যেসময় আমি চায়ের অর্ডার করতে গেছিলাম, সেই ফাঁকে উনি গা হাত পা মুছে শুকনো হয়ে নিলেন। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন ম্যাডাম। চায়ের সঙ্গে একটা সিডেটিভ খেলেন। আমি ওনার গা হাত পা ম্যাসাজ করে দিলাম। সাড়ে আটটার পর উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। একটানা বারো ঘণ্টা ঘুমালেন।
- ব্রাভো। এটা ভালো রুথ। ধন্যবাদ।
- তুমি শুনলে ভালো ছেলে? তুমি বিশ্বাস করবে না সারাটা দিন ধরে তোমার আজব ফ্যান্টাসি আমাকে কত নাকাল করে। কোনো খুশির কথা বলো।
- সরি।
- এখন তুমি ফোন করেছ কেন?
- জানি না। আমার ইচ্ছে করছিল আজ যেন অবশ্যই আমরা একসঙ্গে হাসি-আড্ডা করতে দেখা করি।
- তোমাকে তোমার মা চেনেন। উনি তা করবেন না। বাই।
- না, শোনো এভাবে ছেড়ো না। কী করে ওর সঙ্গে চেষ্টা করলে তুমি? আমায় বলো।
- হে ভগবান! কার সঙ্গে?
- ঐ ল্যাভে-ারের গন্ধমাখা ছেলেটার সঙ্গে। কোন খুয়ান বা লোথার বা বুরিদান বা সানসন বা সান খুয়ান বাউতিস্তা আর কি। কীভাবে চেষ্টা করলে? প্লিজ আমরা এক সঙ্গে হাসব। এইটুকুই চাই আমি। তোমাকে ফোন করেছি শুধু আমরা দুজন একটু এক সঙ্গে হাসব, তাই...
- আহ্ সোনা। তোমার মনে হয় দুঃস্বপ্নগুলো জাদু করে।
- বলো, প্লিজ।
- দেখি... হ্যাঁ মনে হয়। ওই অভদ্র ছেলেটা এইটাই ভাবল যে নায়করা যখন নায়িকার সঙ্গে এক বিছানায় কাটায় তখনই তাদের কেতা বা স্টাইল হয়। আমি তোমাকে বলছি এর থেকে কারো কিচ্ছু জন্মায় না। ঠিক আছে চলো।
আমরা ওকে ওর কল্পনার খোরাক যুগিয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত এগুলোর জন্যই পুরুষ মানুষ বাঁচে, সাদা চামড়ার জন্য নয়।
- হ্যাঁ মা, কী করবে?
- লিখে নাও বেচারা রঙমাখা ছোকরা ভেবেছিল যে আমি বাস্তবেও সিনেমার মতো...
- হ্যাঁ, হ্যাঁ...
- যেন আমি ক্লিওপেট্রার মতো পোশাক পরেছি। বিছানায় বসে ওর জন্যে অপেক্ষা করছি। দুজন নিগ্রো আমার জন্য হামেহাল হাজির। আমার মাথায় মুকুট, চোখের মণি গাঢ় নীল। মণিমুক্তা খচিত মুকুট আর তাতে ময়ূরের পালক গোঁজা। তোমাকে কী করেছে ও?
- আহ্ মা, তোমায় আদর।
- ঐভাবে হেসো না। আমাকে বলতে দাও। ঠিক যেমন নির্বাক ছবি ভ্যালেন্টিনোতে দেখেছিলে সেইভাবে এই ছেলেটা ঢুকল। ঐ ছবিটা গোটাটাই তাঙ্গো ছিল। ছেলেটার সাদা আর হাতদুটো বুকের ওপর রাখা।
- মা, আর বলো না। মেরে ফেলছ আমায়।
- হাঁটু গেঁড়ে বসল। আমাকে খেয়ে ফেলো! -ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠল। আমার দিকে ছুটে এল ঠিক যেন অস্ট্রেলিয়ান হামাগুড়ি চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই জিততে আসছে।
- তারপর?
- তারপর আমি আস্তে আস্তে টুপিটা খুললাম। আর তার নিচে গোটা কয়েক কাচোরোন এনেছিলাম আমি।
- কী জিনিস?
- একটা ফ্লানেলের জামা আমার দাদু যেটা ব্যবহার করতোÑ মশলাদার টুনামাছের মতো পুরো হাঁটু পর্যন্ত বোতাম লাগানো...
- তারপর, তারপর...
- কী? ভাবছ তুমি? কালো নিগ্রোরা ওকে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গেল, আর অ্যায়সা এক ঘুঁষি মারল তাকে যে আমি রয়ে গেলাম আফিলিখিদোর সন্ত খ্রিস্টের মতো। ব্যস ইতি।
- মা, সবসময় যদি এরকম হতো।
- আসলে সবসময়ই এই রকমই হয় কুত্তা। তুমি তা দেখতেই পাও না। আমার জন্য ভেবো না। রুথের কাছে তোমার মাসিক হাত খরচার টাকাটা আছে। ও তোমাকে দিতে ভুলবে না। আর এখন থেকে চেক তোমার কাছে পৌঁছে যাবে বরাবরের মতোই।
- কিন্তু তুমি তো আমাকে বললে না বুর্দিয়ানের পরে কী হলো? ওই যখন নিগ্রোরা ওকে মারধর করে ছেড়ে দিল।
- বেলা কে জিজ্ঞেস করো। বাই।
- মা... ক্লাউদিয়াÑ উত্তর দাও। মা, উত্তর দাও। ফোনটা রেখে দিও না। কী বললে? মা! প্লিজ সত্যি সত্যি একবার বলো কী বললে! মা! দিব্যি করে বলো এটা ঠিক নয়!
লেখক পরিচিতি : মেক্সিকান লেখক কার্লোস ফুয়েন্তেসের জন্ম : ১১ নভেম্বর ১৯২৮ এবং মৃত্যু : ১৫ মে ২০১২। পুরো নাম কার্লোস মানুয়েল ফুয়েন্তেস মাসিয়াস (Carlos Manuel Fuentes Macias) গত শতকের লাতিন আমেরিকান ‘বুম’ প্রজন্মের অন্যতম প্রভাবশালী লেখক তিনি। তাঁর প্রজন্মের অপরাপর পুরোধাগণ হলেন নোবেল লরিয়েট কলাম্বিয়ার গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, পেরুর মারিও বার্গাস য়োসা, চিলির জোসো দোনোসো, আর্জেটিনার হুলিও কোর্তাসার। সম্মিলিতভাবে তাঁদেরকে ‘ম্যাজিক্যাল রিয়ালিস্টস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও বাস্তবে ফুয়েন্তেস রচিত সাহিত্য তাঁর ক্ষেত্রে এ অভিধা বাতিল করে দেয়। সামাজিক দলিলদস্তাবেজ, চেতনার স্রোত, রূপকথা, কৌতুক, ভূতের গল্প, রাজনৈতিক মন্তব্য ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে তার কলম ছিল অনর্গল বহমান। প্রধান উপন্যাস ‘দ্য ডেথ অব আরতেমিও ক্রুজ’, ‘তেরা নোস্ত্রা’ ও ‘দ্য ইয়ারস উইথ লরা ডায়াজ’ বিশালন্ত ক্যানভাসের মহকাব্যধর্মী উপন্যাস। এসব উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর দেশের ইতিহাস, বিপ্লব, ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের দুর্নীতি এবং জাতীয় পরিচিতির উভয় সঙ্কটের চিত্র।
কার্লোস ফুয়েন্তেসের গল্প
অনুবাদ : জয়া চৌধুরী
বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
- তোমাকে জাগিয়েছি, না?
- না না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছিল।
- তাড়াতাড়ি...
- ঠিক তুমি যখন গেলে তার পরেই।
- এখন কী করছ?
- বললাম তো তোমায়। সবকিছু এলোমেলো ছত্রখান হয়ে আছে, আবার দ্বিতীয় দিনের শ্যুটিঙ শুরু হয়ে যাবে। রুথ খুব বেশিদূর যায়নি, অথচ আমাদের কুড়িখানা নতুন বস্তা পছন্দ করে নিতে হবে। সেগুলো সঙ্গে যাবে। তার জন্য ওই ইউরোপিয়ানদের মতো হলদে জামা পরা বড় বড় চোখওয়ালা মেয়েটার কাছে কিনতে যেতে পারি। তুমি তো জান আমার ওপর দেশের সম্মান জড়িয়ে আছে...। তোমাকে বলিনি, না? আগে মেক্সিকো বলতে পাঞ্চো ভিইয়া কে (পাঞ্চো ভিইয়া-মেক্সিকোর বিপ্লব ‘মেক্সিকান রেভলিউশনারি’-র সবচেয়ে বিখ্যাত জেনারেল) বোঝাতো। আর এখন সেটা হচ্ছি আমি।
- তাহলে, খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছ?
- কোথায় আছ, সোনা! ব্রেকডাউনটা তৈরি। ওরা ইতালিতে লোকেশান বেছে রেখেছে, আমার ব্যাগের মধ্যে প্লেনের টিকিট রাখা।
- ও তো সবসময়ই থাকে।
- আজ্ঞে হ্যাঁ। এতে আশ্চর্য হবার কী আছে।
- আর দশ দিন শুধু।
- একদিন বেশিও নয়, একদিন কমও নয়। এখন বল ফোন করেছ কেন...
- মা, ইয়ে গতকালÑ
- ওটা কোন ব্যাপার নয়। কিছু হয়নি।
- আমি ওটা মিটিয়ে নিতে চেয়েছিলাম, এই আর কি।
- লক্ষ্মী সোনা। কোথাও বিচ্ছিরি ভিড়ভাট্টার মধ্যে যদি দেখ আমি পড়ে গেছি, নিশ্চিত জেনো আমি তোমার কথাই ভাবি তখন।
- সত্যি?
- ভগবানের দিব্যি।
- ইস্ এখন তোমার কাছে থাকতে ইচ্ছে করছে।
- আমারও। বিশ্বাস করো।
- জানো, যদি লাইনটা টপকে তোমার কাছে চলে যেতে পারতাম, তোমাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু দিতে পারতাম...
- এঃ হেঃ
- মা...
- ব্যথার জায়গায় প্রলেপ পড়ে না এতে, টনটনানি থেকেই যায়।
- হুঁ তালে তাই। কিন্তু আমি তো তোমায় ব্যথা দিইনি।
- তো? তুমি কি ভাবছ ঘর থেকে চিৎকার করতে করতে বেরোবে? কান খাড়া করে থাকা নিচের লোকগুলোকে ওখানেই থামিয়ে দেয়া আছে।
- আর তুমি? এমন নয় যে সে আর একজন ফোটোগ্রাফার শুধু। হয়তো তুমি তাকে কুশলও জিজ্ঞাসা করেছিলে; হাল্কা খাবারের ট্রে হাতে একজন পরিচারকের বেশি আর কিছু নয়...
- কে পাঠিয়েছে তোমাকে? তুমি তো জানো আমার পেশাদারী জীবন আর ব্যক্তিগত জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। তাতে নাক গলানো... তুমি সমস্যা খুঁজে বেড়াচ্ছ।
- আমি যখন চলে এলাম কী করলে তুমি?
- আজ সকালে তুমি চমকে গেছিলে, না? আসলে আমি ঘুমিয়েছিলাম। অতসব কা-কারখানা হয়ে যাবার পরে ভাবছ যে আমার খারাপ লেগেছে?
- সেকথা আগেই বলেছ তুমি। তোমার কথায় যুক্তি আছে। প্লিজ মাফ করে দাও।
- আরেঃ, কী ব্যাপারে মাফ? আমার মন থেকে তেতো ভাব যায় না।
- আমি জানি সেটা। কিন্তু... কিন্তু বেরিয়ে আসার আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার ফিরে এসে যদি মাফ চাইতাম আমি...
- আমাকে বিছানায় শোয়া দেখতে তুমি, বুক আর পিঠের মাঝখানে একটা নিম্বুটাল খেয়ে।
- তুমি একা ছিলে।
- না, রুথ আমাকে পিলটা দিল। খুব কাজে দিয়েছে ওষুধটা। হুম্ম্ম্ কীভাবে যে ঠা-া বাতাস আর হৈ চৈ গ-গোলের মধ্যে রাতটা কাটিয়েছি তা যদি দেখতে।
- তোমার সঙ্গে থাকতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।
- আজ সময় নেই। সব ক’টা ড্রয়ার উপুড় করে দিয়েছি। মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধক্ষেত্র। এই ছত্রখান হয়ে থাকা বিশৃঙ্খলাটা আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে।
- এক মিনিট সময় দাও।
- না। তোমরই দোষ।
- কেন?
- তোমাকে তো বলেছি গতকাল অনুমতি ছাড়াই ওখানে এলে, লোকে লোকারণ্য ছিল। একটু অপেক্ষা করতে যদি আজ আমাকে একলা পেতে।
- দেখছি অনেক মাস হয়ে গেল একলাই থাকছ।
- আমি সেরে উঠেছি, মনা।
- হাসালে।
- কী নিয়ে?
- কী সাবধানী হয়ে গেছ তুমি! তুমি কি ভুলে গেলে বিশ বছর হয়ে গেল আমরা আনন্দ করে একসঙ্গে হইনি?
- নিশ্চয়ই। দেখো তুমি এখনো কী...।
- ওহ্ মা। এসবের তী দরকার...
- দরকার? দরকার জেলবন্দিদের যারা এখনো ফুটপাথটাও দেখেনি...
- প্লিজ আমি ঝগড়া করবার জন্য একথা বলিনি।
- এখনো ‘আমার সঙ্গে ঝগড়া করো তুমি’ সেকথা তোমার বলা অভ্যাস হয়নি।
- ঠিক বলেছো। শুধু নিজেকে বুঝ দেওয়ার জন্য বললাম।
- কী ব্যাপার মনা?
- এই যে গতকাল রাত্তিরে ঘটা ঘটনার কোনো গুরুত্ব নেই।
- কথাটা আসলে হলোÑ আমি খেই হারিয়ে ফেলেছি।
- ঐ হ্যান্ডসাম ছেলেটা যার গা দিয়ে ল্যাভে-ারের গন্ধ বেরুচ্ছিল।
- গিইয়েরমো। গিইয়েরমি তো। মিতো।
- হেসো না।
- আমি ওকে পাঠিয়ে দেব তোমার কাছে। ওহ্্ রাজা হেরোদ!
- এই যে তুমি হেসো না। তুমি জানো না ও...
- ফোনটা রুথকে দিচ্ছি। বাই।
- কে?
-হ্যালো উইলিয়াম নাকি?
- হ্যাঁ, রুথ।
- পৌনে আটটায় ম্যাডাম আমায় ফোন করতে বলেছিলেন। আমি বাথটাবে ছিলাম। ওনার গায়ে বাথ টাওয়েল জড়িয়ে দিয়েছিলাম। দারচিনি দেওয়া এক কাপ চা চাইলেন উনি। যেসময় আমি চায়ের অর্ডার করতে গেছিলাম, সেই ফাঁকে উনি গা হাত পা মুছে শুকনো হয়ে নিলেন। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন ম্যাডাম। চায়ের সঙ্গে একটা সিডেটিভ খেলেন। আমি ওনার গা হাত পা ম্যাসাজ করে দিলাম। সাড়ে আটটার পর উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। একটানা বারো ঘণ্টা ঘুমালেন।
- ব্রাভো। এটা ভালো রুথ। ধন্যবাদ।
- তুমি শুনলে ভালো ছেলে? তুমি বিশ্বাস করবে না সারাটা দিন ধরে তোমার আজব ফ্যান্টাসি আমাকে কত নাকাল করে। কোনো খুশির কথা বলো।
- সরি।
- এখন তুমি ফোন করেছ কেন?
- জানি না। আমার ইচ্ছে করছিল আজ যেন অবশ্যই আমরা একসঙ্গে হাসি-আড্ডা করতে দেখা করি।
- তোমাকে তোমার মা চেনেন। উনি তা করবেন না। বাই।
- না, শোনো এভাবে ছেড়ো না। কী করে ওর সঙ্গে চেষ্টা করলে তুমি? আমায় বলো।
- হে ভগবান! কার সঙ্গে?
- ঐ ল্যাভে-ারের গন্ধমাখা ছেলেটার সঙ্গে। কোন খুয়ান বা লোথার বা বুরিদান বা সানসন বা সান খুয়ান বাউতিস্তা আর কি। কীভাবে চেষ্টা করলে? প্লিজ আমরা এক সঙ্গে হাসব। এইটুকুই চাই আমি। তোমাকে ফোন করেছি শুধু আমরা দুজন একটু এক সঙ্গে হাসব, তাই...
- আহ্ সোনা। তোমার মনে হয় দুঃস্বপ্নগুলো জাদু করে।
- বলো, প্লিজ।
- দেখি... হ্যাঁ মনে হয়। ওই অভদ্র ছেলেটা এইটাই ভাবল যে নায়করা যখন নায়িকার সঙ্গে এক বিছানায় কাটায় তখনই তাদের কেতা বা স্টাইল হয়। আমি তোমাকে বলছি এর থেকে কারো কিচ্ছু জন্মায় না। ঠিক আছে চলো।
আমরা ওকে ওর কল্পনার খোরাক যুগিয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত এগুলোর জন্যই পুরুষ মানুষ বাঁচে, সাদা চামড়ার জন্য নয়।
- হ্যাঁ মা, কী করবে?
- লিখে নাও বেচারা রঙমাখা ছোকরা ভেবেছিল যে আমি বাস্তবেও সিনেমার মতো...
- হ্যাঁ, হ্যাঁ...
- যেন আমি ক্লিওপেট্রার মতো পোশাক পরেছি। বিছানায় বসে ওর জন্যে অপেক্ষা করছি। দুজন নিগ্রো আমার জন্য হামেহাল হাজির। আমার মাথায় মুকুট, চোখের মণি গাঢ় নীল। মণিমুক্তা খচিত মুকুট আর তাতে ময়ূরের পালক গোঁজা। তোমাকে কী করেছে ও?
- আহ্ মা, তোমায় আদর।
- ঐভাবে হেসো না। আমাকে বলতে দাও। ঠিক যেমন নির্বাক ছবি ভ্যালেন্টিনোতে দেখেছিলে সেইভাবে এই ছেলেটা ঢুকল। ঐ ছবিটা গোটাটাই তাঙ্গো ছিল। ছেলেটার সাদা আর হাতদুটো বুকের ওপর রাখা।
- মা, আর বলো না। মেরে ফেলছ আমায়।
- হাঁটু গেঁড়ে বসল। আমাকে খেয়ে ফেলো! -ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠল। আমার দিকে ছুটে এল ঠিক যেন অস্ট্রেলিয়ান হামাগুড়ি চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই জিততে আসছে।
- তারপর?
- তারপর আমি আস্তে আস্তে টুপিটা খুললাম। আর তার নিচে গোটা কয়েক কাচোরোন এনেছিলাম আমি।
- কী জিনিস?
- একটা ফ্লানেলের জামা আমার দাদু যেটা ব্যবহার করতোÑ মশলাদার টুনামাছের মতো পুরো হাঁটু পর্যন্ত বোতাম লাগানো...
- তারপর, তারপর...
- কী? ভাবছ তুমি? কালো নিগ্রোরা ওকে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গেল, আর অ্যায়সা এক ঘুঁষি মারল তাকে যে আমি রয়ে গেলাম আফিলিখিদোর সন্ত খ্রিস্টের মতো। ব্যস ইতি।
- মা, সবসময় যদি এরকম হতো।
- আসলে সবসময়ই এই রকমই হয় কুত্তা। তুমি তা দেখতেই পাও না। আমার জন্য ভেবো না। রুথের কাছে তোমার মাসিক হাত খরচার টাকাটা আছে। ও তোমাকে দিতে ভুলবে না। আর এখন থেকে চেক তোমার কাছে পৌঁছে যাবে বরাবরের মতোই।
- কিন্তু তুমি তো আমাকে বললে না বুর্দিয়ানের পরে কী হলো? ওই যখন নিগ্রোরা ওকে মারধর করে ছেড়ে দিল।
- বেলা কে জিজ্ঞেস করো। বাই।
- মা... ক্লাউদিয়াÑ উত্তর দাও। মা, উত্তর দাও। ফোনটা রেখে দিও না। কী বললে? মা! প্লিজ সত্যি সত্যি একবার বলো কী বললে! মা! দিব্যি করে বলো এটা ঠিক নয়!
লেখক পরিচিতি : মেক্সিকান লেখক কার্লোস ফুয়েন্তেসের জন্ম : ১১ নভেম্বর ১৯২৮ এবং মৃত্যু : ১৫ মে ২০১২। পুরো নাম কার্লোস মানুয়েল ফুয়েন্তেস মাসিয়াস (Carlos Manuel Fuentes Macias) গত শতকের লাতিন আমেরিকান ‘বুম’ প্রজন্মের অন্যতম প্রভাবশালী লেখক তিনি। তাঁর প্রজন্মের অপরাপর পুরোধাগণ হলেন নোবেল লরিয়েট কলাম্বিয়ার গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, পেরুর মারিও বার্গাস য়োসা, চিলির জোসো দোনোসো, আর্জেটিনার হুলিও কোর্তাসার। সম্মিলিতভাবে তাঁদেরকে ‘ম্যাজিক্যাল রিয়ালিস্টস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও বাস্তবে ফুয়েন্তেস রচিত সাহিত্য তাঁর ক্ষেত্রে এ অভিধা বাতিল করে দেয়। সামাজিক দলিলদস্তাবেজ, চেতনার স্রোত, রূপকথা, কৌতুক, ভূতের গল্প, রাজনৈতিক মন্তব্য ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে তার কলম ছিল অনর্গল বহমান। প্রধান উপন্যাস ‘দ্য ডেথ অব আরতেমিও ক্রুজ’, ‘তেরা নোস্ত্রা’ ও ‘দ্য ইয়ারস উইথ লরা ডায়াজ’ বিশালন্ত ক্যানভাসের মহকাব্যধর্মী উপন্যাস। এসব উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর দেশের ইতিহাস, বিপ্লব, ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের দুর্নীতি এবং জাতীয় পরিচিতির উভয় সঙ্কটের চিত্র।