‘মাসুদ রানা’ কী তার ছায়া? কিংবা তিনি কী ‘মাসুদ রানা’ হতে চেয়েছিলেন? তা জানা এখন আর সম্ভব নয়। দেশের জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ মাসুদ রানার স্রষ্টা এবং সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেন এখন অনেক দূরের মানুষ। চলে গেছেন এ পৃথিবী ছেড়ে। বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তার পুত্রবধূ মাসুমা মায়মুরের কাছ থেকে তার মৃত্যুর খবরটি জানা যায়। তিনি জানান, ক্যানসারে আক্রান্ত তার শ্বশুর ১০ জানুয়ারি থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
ফেইসবুকে মায়মুর লিখেছেন, ‘নিভে গেছে দীপ, জনমের তরে জ্বলিবে না সে তো আর।- দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে আমার ছেলেটা। আমার ছোট্ট ছেলেটা। আর কোনো দিনও আমার পিছু পিছু ঘুরে খুঁজবে না মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ। কোনো দিনই না। কিন্তু মাকে ছেড়ে থাকবে কীভাবে, ওই অন্ধকার ঘরে আমার ছেলেটা?
মায়মুর জানান, গত ৩১ অক্টোবর কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে। মাঝে পাঁচ বার হাসপাতালে ছিলেন। ‘চিকিৎসার সুযোগ খুব একটা পাওয়া যায়নি। একটা ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক হয়ে সব শেষ হয়ে গেল। ১০ জানুয়ারি থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। আজ চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।’
১৯৬৬ সালে শুরু, বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে মাসুদ রানার প্রথম বই ‘ধ্বংস পাহাড়’ প্রকাশ করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। হইচই পড়ে যায়। প্রশংসা ও নিন্দা দুই-ই জুটেছিলো। একে গুপ্তচরবৃত্তি ও অ্যাডভেঞ্চার, তার ওপর যৌনতা। এরপর ওই সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘ভরতনাট্যম’। এবার রক্ষণশীলেরা গেলেন খেপে। কিন্তু তরুণসমাজ ও প্রগতিমনস্কদের অনেকেই স্বাগত জানালেন।
বিখ্যাত বাবার ছেলে। বাবা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মা সাজেদা খাতুন। কাজী আনোয়ার হোসেনর জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই, ঢাকায়। পাঠকের কাছে তিনি ছিলেন ‘কাজীদা’।
জানা যায় লেখক হওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না তার। তার সংগে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল সাংবাদিক আসজাদুল কিবরিয়ার। তিনি বলছেন, কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখক হিসেবে শুরুটাও ছিল বেশ রোমাঞ্চকর। পাখি শিকারের জন্য একটা বন্দুক কেনার টাকা যোগাড় করতেই বই লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দুটো পা-ুলিপিও তৈরি করে ফেলেন। কিন্তু প্রকাশক? এক প্রকাশক শর্ত দিয়েছিলেন, অন্তত ১০টি বই আগে লিখে দিতে হবে। তারপর কিছু টাকা-পয়সা দেওয়া যেতে পারে। আর আরেক প্রকাশকের মত – বই লিখতে কী-ই বা খরচ হয়েছে, কাগজ আর কালি ছাড়া।
হলো না বই প্রকাশ। তবে বাবা কাজী মোতাহার হোসেন পা-ুলিপি দুটো পড়ে বলেছিলেন রেখে দিতে। সুযোগ পেলে নিজেই ছেপে বের করার পরামর্শ ছিল তার। প্রেসের ব্যবসাও হবে, বইও প্রকাশ করা হবে—এই চিন্তা থেকেই ‘সেগুনবাগান প্রেসের’ যাত্রা শুরু। সেটা ১৯৬৪ সালে। পরে সেটাই রূপ নিল সেবা প্রকাশনীতে। মূলত কিশোর পাঠকদের রহস্যজগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই ‘কুয়াশা’ সিরিজ দিয়েই যাত্রা শুরু।
‘বিদ্যুৎ মিত্র’ ছদ্মনামেই লিখতে শুরু করেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। জানা যায় সেই সময় বন্ধু মাহবুব আমিন প্রকাশিত বইগুলো পড়ে জেমস বন্ডের ডক্টর নো ধরিয়ে দিয়েছিলেন তার হাতে। সেই বই পড়েই সিদ্ধান্ত, বাংলাতেই ওই রকম থ্রিলার লিখবেন। তারপরই পড়তে শুরু করেন বিদেশি বই।
তবে নকল নয়, মৌলিকত্ব রাখতে চেয়েছিলেন বাংলা স্পাই থ্রিলারে। সেই ১৯৬৫ সালে মোটরসাইকেলে করে আনোয়ার হোসেন ঘুরে এসেছিলেন চট্টগ্রাম, কাপ্তাই ও রাঙামাটি। কেন? কাহিনি সাজানোর জন্য! এরপর সাত মাস সময় নিয়ে লিখেন ধ্বংস-পাহাড়। বাংলা ভাষার প্রথম মৌলিক স্পাই থ্রিলার। এরপর বাকীটা ইতিহাস।
জীবিকার উৎস হিসেবে এই লেখা ও প্রকাশনাকেই বেছে নেন। আর সেবা প্রকাশনী থেমে থাকল না স্পাই থ্রিলারে। বিশ্ববিখ্যাত ক্ল্যাসিকগুলো সংক্ষিপ্ত রূপান্তর বা পুরো অনুবাদ করে প্রকাশ করা শুরু করে। বেনহার, রবিনসন ক্রশো, সুইস ফ্যামিলি রবিনসন, ট্রেজার আইল্যান্ড, কপালকু-লাসহ বিশ্বসাহিত্যে নামীদামি গ্রন্থগুলো বাংলা ভাষাভাষী কিশোর পাঠকদের কাছে নিয়ে আসা হলো। তারপর জুলভার্নের সায়েন্স ফিকশন।
মাসুদ রানার কাহিনি সংগ্রহ করা হয়েছে অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিন, জেমস হেডলি চেজ, রবার্ট লুডলাম, উইলবার স্মিথ, ইয়ান ফ্লেমিংসহ অসংখ্য লেখকের বই থেকে। তবে মূল কাহিনির কাঠামো রেখে প্রচুর ভাঙচুড় ও চরিত্র সংযোজন-বিয়োজন করে ‘মাসুদ রানা’র প্রতিটি বই লেখা হয়েছে। ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের বই ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে।
পড়াশোনা শেষ করে গানে মনোযোগী হয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সিনেমায় প্লেব্যাকও করতেন। যদিও পরে সে পেশা ছেড়ে দেন। এছাড়া ১৯৭৪ সালে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয?িতা হিসেবে বাচসাস পুরস্কার পান। পেয়েছেন সিনেমা পত্রিকা ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কারও।
রেডিওতে গান গাইতে গিয়েই কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরিচয়। তারপর পছন্দ ও বিয়ে। তার তিন বোন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন এবং মাহমুদা খাতুনও সঙ্গীতশিল্পী এবং বিখ্যাত।
তার দুই ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন ও কাজী মায়মুর হোসেন এবং মেয়ে শাহরীন সোনিয়া।
বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী ২০২২
‘মাসুদ রানা’ কী তার ছায়া? কিংবা তিনি কী ‘মাসুদ রানা’ হতে চেয়েছিলেন? তা জানা এখন আর সম্ভব নয়। দেশের জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ মাসুদ রানার স্রষ্টা এবং সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেন এখন অনেক দূরের মানুষ। চলে গেছেন এ পৃথিবী ছেড়ে। বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তার পুত্রবধূ মাসুমা মায়মুরের কাছ থেকে তার মৃত্যুর খবরটি জানা যায়। তিনি জানান, ক্যানসারে আক্রান্ত তার শ্বশুর ১০ জানুয়ারি থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
ফেইসবুকে মায়মুর লিখেছেন, ‘নিভে গেছে দীপ, জনমের তরে জ্বলিবে না সে তো আর।- দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে আমার ছেলেটা। আমার ছোট্ট ছেলেটা। আর কোনো দিনও আমার পিছু পিছু ঘুরে খুঁজবে না মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ। কোনো দিনই না। কিন্তু মাকে ছেড়ে থাকবে কীভাবে, ওই অন্ধকার ঘরে আমার ছেলেটা?
মায়মুর জানান, গত ৩১ অক্টোবর কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে। মাঝে পাঁচ বার হাসপাতালে ছিলেন। ‘চিকিৎসার সুযোগ খুব একটা পাওয়া যায়নি। একটা ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক হয়ে সব শেষ হয়ে গেল। ১০ জানুয়ারি থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। আজ চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।’
১৯৬৬ সালে শুরু, বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে মাসুদ রানার প্রথম বই ‘ধ্বংস পাহাড়’ প্রকাশ করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। হইচই পড়ে যায়। প্রশংসা ও নিন্দা দুই-ই জুটেছিলো। একে গুপ্তচরবৃত্তি ও অ্যাডভেঞ্চার, তার ওপর যৌনতা। এরপর ওই সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘ভরতনাট্যম’। এবার রক্ষণশীলেরা গেলেন খেপে। কিন্তু তরুণসমাজ ও প্রগতিমনস্কদের অনেকেই স্বাগত জানালেন।
বিখ্যাত বাবার ছেলে। বাবা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মা সাজেদা খাতুন। কাজী আনোয়ার হোসেনর জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই, ঢাকায়। পাঠকের কাছে তিনি ছিলেন ‘কাজীদা’।
জানা যায় লেখক হওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না তার। তার সংগে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল সাংবাদিক আসজাদুল কিবরিয়ার। তিনি বলছেন, কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখক হিসেবে শুরুটাও ছিল বেশ রোমাঞ্চকর। পাখি শিকারের জন্য একটা বন্দুক কেনার টাকা যোগাড় করতেই বই লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দুটো পা-ুলিপিও তৈরি করে ফেলেন। কিন্তু প্রকাশক? এক প্রকাশক শর্ত দিয়েছিলেন, অন্তত ১০টি বই আগে লিখে দিতে হবে। তারপর কিছু টাকা-পয়সা দেওয়া যেতে পারে। আর আরেক প্রকাশকের মত – বই লিখতে কী-ই বা খরচ হয়েছে, কাগজ আর কালি ছাড়া।
হলো না বই প্রকাশ। তবে বাবা কাজী মোতাহার হোসেন পা-ুলিপি দুটো পড়ে বলেছিলেন রেখে দিতে। সুযোগ পেলে নিজেই ছেপে বের করার পরামর্শ ছিল তার। প্রেসের ব্যবসাও হবে, বইও প্রকাশ করা হবে—এই চিন্তা থেকেই ‘সেগুনবাগান প্রেসের’ যাত্রা শুরু। সেটা ১৯৬৪ সালে। পরে সেটাই রূপ নিল সেবা প্রকাশনীতে। মূলত কিশোর পাঠকদের রহস্যজগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই ‘কুয়াশা’ সিরিজ দিয়েই যাত্রা শুরু।
‘বিদ্যুৎ মিত্র’ ছদ্মনামেই লিখতে শুরু করেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। জানা যায় সেই সময় বন্ধু মাহবুব আমিন প্রকাশিত বইগুলো পড়ে জেমস বন্ডের ডক্টর নো ধরিয়ে দিয়েছিলেন তার হাতে। সেই বই পড়েই সিদ্ধান্ত, বাংলাতেই ওই রকম থ্রিলার লিখবেন। তারপরই পড়তে শুরু করেন বিদেশি বই।
তবে নকল নয়, মৌলিকত্ব রাখতে চেয়েছিলেন বাংলা স্পাই থ্রিলারে। সেই ১৯৬৫ সালে মোটরসাইকেলে করে আনোয়ার হোসেন ঘুরে এসেছিলেন চট্টগ্রাম, কাপ্তাই ও রাঙামাটি। কেন? কাহিনি সাজানোর জন্য! এরপর সাত মাস সময় নিয়ে লিখেন ধ্বংস-পাহাড়। বাংলা ভাষার প্রথম মৌলিক স্পাই থ্রিলার। এরপর বাকীটা ইতিহাস।
জীবিকার উৎস হিসেবে এই লেখা ও প্রকাশনাকেই বেছে নেন। আর সেবা প্রকাশনী থেমে থাকল না স্পাই থ্রিলারে। বিশ্ববিখ্যাত ক্ল্যাসিকগুলো সংক্ষিপ্ত রূপান্তর বা পুরো অনুবাদ করে প্রকাশ করা শুরু করে। বেনহার, রবিনসন ক্রশো, সুইস ফ্যামিলি রবিনসন, ট্রেজার আইল্যান্ড, কপালকু-লাসহ বিশ্বসাহিত্যে নামীদামি গ্রন্থগুলো বাংলা ভাষাভাষী কিশোর পাঠকদের কাছে নিয়ে আসা হলো। তারপর জুলভার্নের সায়েন্স ফিকশন।
মাসুদ রানার কাহিনি সংগ্রহ করা হয়েছে অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিন, জেমস হেডলি চেজ, রবার্ট লুডলাম, উইলবার স্মিথ, ইয়ান ফ্লেমিংসহ অসংখ্য লেখকের বই থেকে। তবে মূল কাহিনির কাঠামো রেখে প্রচুর ভাঙচুড় ও চরিত্র সংযোজন-বিয়োজন করে ‘মাসুদ রানা’র প্রতিটি বই লেখা হয়েছে। ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের বই ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে।
পড়াশোনা শেষ করে গানে মনোযোগী হয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সিনেমায় প্লেব্যাকও করতেন। যদিও পরে সে পেশা ছেড়ে দেন। এছাড়া ১৯৭৪ সালে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয?িতা হিসেবে বাচসাস পুরস্কার পান। পেয়েছেন সিনেমা পত্রিকা ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কারও।
রেডিওতে গান গাইতে গিয়েই কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরিচয়। তারপর পছন্দ ও বিয়ে। তার তিন বোন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন এবং মাহমুদা খাতুনও সঙ্গীতশিল্পী এবং বিখ্যাত।
তার দুই ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন ও কাজী মায়মুর হোসেন এবং মেয়ে শাহরীন সোনিয়া।