‘সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অনেক স্কুলে বিশেষ ক্লাসের নামে কোচিং চলছে’
নতুন শিক্ষাক্রমে ‘গলদগর্ম’ অবস্থায় পড়েছে শিক্ষা প্রশাসন। এ শিক্ষাক্রমে চলতি শিক্ষাবর্ষে ৮ম ও ৯ম শ্রেণীতে পাঠদান শুরু হয়েছে। শিক্ষাবর্ষের দুই মাস অতিবাহিত হলেও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটেনি। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা বাতিল করা হলেও শিক্ষা প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অনেক স্কুলেই ‘বিশেষ’ ক্লাসের নামে বাধ্যতামূলক কোচিং করা হচ্ছে।
এই ধরনের কোচিং না করাতে সারাদেশের শিক্ষকদের সতর্ক করে গত ৪ মার্চ নোটিশ জারি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এবার ৮ম ও ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষার ‘ফরমেট’ বা কাঠামো কেমন হবে সেটিও ঠিক করতে হিমশিম খাচ্ছে শিক্ষা প্রশাসন।
নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীনে। এনসিটিবি কর্মকর্তারা নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষা বা মূল্যায়ন পদ্ধতি কেমন হবে সেটি নির্ধারণ করতে গত ২ মার্চ বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- এমন তিনজন কর্মকর্তা সংবাদকে জানিয়েছেন।
এর আগে নতুন শিক্ষাক্রমে করণীয় নির্ধারণে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর আন্তজার্তিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক সভায় বসেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান এবং একাধিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা। ওই সভায় ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষার ধরন কেমন হতে পারে সেই বিষয়ে একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করা হয় এনসিটিবির পক্ষ্য থেকে। এতে ‘সন্তেুাষ্ট’ হতে পারেননি শিক্ষামন্ত্রী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা শিক্ষা বোর্ডগুলোর সঙ্গে আবারো বৈঠকে বসবো।’
নতুন শিক্ষাক্রমে সীমিত পরিসরে পরীক্ষা পদ্ধতি পূনর্বহাল হচ্ছে কী না, নাকি পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল থাকবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফরমেট কেমন হবে- সেটি নির্ধারণের কাজ চলমান আছে।’
২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা কীভাবে হবে, পরীক্ষার বিষয় ও প্রশ্নপত্রের ধরন কী হবে সেই বিষয়ে করণীয় ঠিক করতেই বারবার বৈঠকের আয়োজন করা হচ্ছে। কারণ নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে ‘সূচক’ বা ‘চিহ্নভিত্তিক’ মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে ‘বিভ্রান্তি ও অসন্তোষ’ রয়েছে।
এ বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার সংবাদকে বলেছেন, ‘এনসিটিবি আমাদের নিয়ে বসেছিল। সেখানে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর একটি ধারণাপত্র দেয়া হয়েছিল। আমরা পরিষ্কার ধারণা পায়নি। এ কারণে কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।’
এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে ‘মূল্যায়ন’ প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এরপরও অনেক কাজ বাকি থাকবে। নতুন করে সব পরীক্ষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে; মডারেটরদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে; পরীক্ষার প্রস্তুতিও সেভাবে নিতে হবে।’
পরীক্ষা ফেরাতে কমিটি
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে গতকাল ৫ মার্চ একটি কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৪ সদস্যের এই কমিটি জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সুপারিশ বা মতামত দিতে হবে। এ কমিটি পাবলিক পরীক্ষাসহ মূল্যায়ন পদ্ধতি পর্যালোচনা করে তা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে সুপারিশ করবে।
এছাড়া পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, সংশোধন, পরিমার্জন এবং নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয় পর্যালোচনা ও সুপারিশ দিতে পারবে এ কমিটি।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (উন্নয়ন) আহ্বায়ক ও একই বিভাগের যুগ্ম-সচিবকে (সরকারি মাধ্যমিক অধিশাখা) সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটিতে ১২টি বোর্ড, অধিদপ্তর ও উন্মমুক্ত বিশ^বিদ্যালয় থেকে একজন করে প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।
৫ সদস্যের কমিটিও প্রতিবেদন দেয়নি
সপ্তম শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে পাঠের অংশ হিসেবে ‘শরীফার গল্প’ রাখা হয়েছে। এনিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
এ বিষয়টি পর্যালোচনার পাশাপাশি নতুন শিক্ষাক্রমের ‘ভুল-ভ্রান্তি’ শনাক্ত করতে গত ২৪ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের কমিটি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইআরবি) উপাচার্য আবদুর রশীদকে কমিটির আহ্বায়ক এবং এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামানকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়। এ মূল্যায়ন কমিটির তিন সদস্য হলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর কফিল উদ্দীন সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হালিম এবং ঢাকা সরকারি আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুর রশিদ।
এ কমিটির একজন সদস্য সংবাদকে জানিয়েছেন, তাদের প্রতিবেদন মন্ত্রনালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর ঝুলে আছে। কারণ ‘শরীফার গল্প’ থাকবে কী না সে বিষয়ে তারা সরকারের ‘ইঙ্গিতের’ অপেক্ষায় আছেন।
‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষকদের তালিকা নেই
নতুন শিক্ষাক্রমে ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’ বিষয়ে কতজন শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছে সেই তালিকা নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষকদের তালিকা চেয়েছে মাউশি।
একই সঙ্গে সংস্থাটি নতুন শিক্ষাক্রমে ৮ম ও ৯ম শ্রেণীর ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ের উপজেলা পর্যায়ে পাঁচ দিনব্যাপী ‘প্রোগ্রামিং অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং’ বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিতে ইচ্ছুক শিক্ষকদের তালিকা চেয়েছে।
গত ৪ মার্চ মাউশির ‘ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিম সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট স্কিমের’ পরিচালক সৈয়দ মাহফুজ আলী স্বাক্ষরিত নির্দেশনা সব জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছে। বুধবার (৬ মার্চ) মাউশির ওয়েবসাইটে এটি প্রকাশ করা হয়।
আদেশে বলা হয়, ‘ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিমের’ আওতায় ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ের উপজেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের পাঁচ দিনব্যাপী ‘প্রোগ্রামিং অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং’বিষয়ক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সারাদেশের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে শীঘ্রর আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছ।
এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে যেসব শিক্ষক ইতঃপূর্বে ৩৬ ক্লাস্টারে ৮ম ও ৯ম শ্রেণীর জন্য উপজেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, তাদের তালিকা প্রয়োজন। যারা প্রশিক্ষণ নিতে চান তাদের তালিকাও ২৮ মার্চের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে।
এনসিটিবি থেকে জানা গেছে, গত বছর দুই ধাপে চার লাখ ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষককে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর সাত দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর ‘কোচিং’
ঢাকাসহ সারাদেশেই শিক্ষকরা কমবেশি কোচিং করান। সম্প্রতি কোচিং সেন্টারে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মুরাদ হোসেন। এরপর টনক নড়ে। প্রতিষ্ঠানটি সব শিক্ষকের কোচিং করানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
মাউশির পক্ষ্য থেকেও সারাদেশে শিক্ষকদের কোচিং না করাতে সতর্ক করে গত ৪ মার্চ চিঠি দেয়া হয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলামে (শিক্ষাক্রম) বিশেষ ক্লাসের নামে শিক্ষার্থীদের কোচিং করানো বা কোচিংয়ে বাধ্য করা হলে প্রতিষ্ঠানপ্রধান ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন।
কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ ক্লাসের নামে শিক্ষার্থীদের কোচিং করানো বা কোচিংয়ে বাধ্য করা হচ্ছে জানিয়ে মাউশি বলছে, কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলাম বিস্তরণ ও মূল্যায়নের সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও তা লঙ্ঘন করে সাপ্তাহিক বা মাসিক মূল্যায়নের নামে গতানুগতিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হচ্ছে।
২০২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং মাধ্যমিকের ৮ম ও ৯ম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এই শিক্ষাবর্ষ থেকে ৯ম শ্রেণীতে বিভাগ (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) বিভাজনও থাকছে না।
এ বিষয়ে গত বছরের ২৩ অক্টোবর প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়ে আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের আলাদা বিভাগ বেঁচে নেয়ার সুযোগ থাকছে না। সব শিক্ষার্থীকে একই পাঠ্যবই পড়তে হবে।
২০২৫ সালে এ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণীতে উঠবে, ওই সময়ও বিভাগ বিভাজনের সুযোগ থাকবে না। ২০২৬ সালে এ শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে।
‘সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অনেক স্কুলে বিশেষ ক্লাসের নামে কোচিং চলছে’
বুধবার, ০৬ মার্চ ২০২৪
নতুন শিক্ষাক্রমে ‘গলদগর্ম’ অবস্থায় পড়েছে শিক্ষা প্রশাসন। এ শিক্ষাক্রমে চলতি শিক্ষাবর্ষে ৮ম ও ৯ম শ্রেণীতে পাঠদান শুরু হয়েছে। শিক্ষাবর্ষের দুই মাস অতিবাহিত হলেও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটেনি। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা বাতিল করা হলেও শিক্ষা প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অনেক স্কুলেই ‘বিশেষ’ ক্লাসের নামে বাধ্যতামূলক কোচিং করা হচ্ছে।
এই ধরনের কোচিং না করাতে সারাদেশের শিক্ষকদের সতর্ক করে গত ৪ মার্চ নোটিশ জারি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এবার ৮ম ও ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষার ‘ফরমেট’ বা কাঠামো কেমন হবে সেটিও ঠিক করতে হিমশিম খাচ্ছে শিক্ষা প্রশাসন।
নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীনে। এনসিটিবি কর্মকর্তারা নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষা বা মূল্যায়ন পদ্ধতি কেমন হবে সেটি নির্ধারণ করতে গত ২ মার্চ বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- এমন তিনজন কর্মকর্তা সংবাদকে জানিয়েছেন।
এর আগে নতুন শিক্ষাক্রমে করণীয় নির্ধারণে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর আন্তজার্তিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক সভায় বসেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান এবং একাধিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা। ওই সভায় ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষার ধরন কেমন হতে পারে সেই বিষয়ে একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করা হয় এনসিটিবির পক্ষ্য থেকে। এতে ‘সন্তেুাষ্ট’ হতে পারেননি শিক্ষামন্ত্রী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা শিক্ষা বোর্ডগুলোর সঙ্গে আবারো বৈঠকে বসবো।’
নতুন শিক্ষাক্রমে সীমিত পরিসরে পরীক্ষা পদ্ধতি পূনর্বহাল হচ্ছে কী না, নাকি পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল থাকবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফরমেট কেমন হবে- সেটি নির্ধারণের কাজ চলমান আছে।’
২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা কীভাবে হবে, পরীক্ষার বিষয় ও প্রশ্নপত্রের ধরন কী হবে সেই বিষয়ে করণীয় ঠিক করতেই বারবার বৈঠকের আয়োজন করা হচ্ছে। কারণ নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে ‘সূচক’ বা ‘চিহ্নভিত্তিক’ মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে ‘বিভ্রান্তি ও অসন্তোষ’ রয়েছে।
এ বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার সংবাদকে বলেছেন, ‘এনসিটিবি আমাদের নিয়ে বসেছিল। সেখানে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর একটি ধারণাপত্র দেয়া হয়েছিল। আমরা পরিষ্কার ধারণা পায়নি। এ কারণে কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।’
এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে ‘মূল্যায়ন’ প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এরপরও অনেক কাজ বাকি থাকবে। নতুন করে সব পরীক্ষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে; মডারেটরদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে; পরীক্ষার প্রস্তুতিও সেভাবে নিতে হবে।’
পরীক্ষা ফেরাতে কমিটি
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে গতকাল ৫ মার্চ একটি কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৪ সদস্যের এই কমিটি জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সুপারিশ বা মতামত দিতে হবে। এ কমিটি পাবলিক পরীক্ষাসহ মূল্যায়ন পদ্ধতি পর্যালোচনা করে তা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে সুপারিশ করবে।
এছাড়া পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, সংশোধন, পরিমার্জন এবং নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয় পর্যালোচনা ও সুপারিশ দিতে পারবে এ কমিটি।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (উন্নয়ন) আহ্বায়ক ও একই বিভাগের যুগ্ম-সচিবকে (সরকারি মাধ্যমিক অধিশাখা) সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটিতে ১২টি বোর্ড, অধিদপ্তর ও উন্মমুক্ত বিশ^বিদ্যালয় থেকে একজন করে প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।
৫ সদস্যের কমিটিও প্রতিবেদন দেয়নি
সপ্তম শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে পাঠের অংশ হিসেবে ‘শরীফার গল্প’ রাখা হয়েছে। এনিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
এ বিষয়টি পর্যালোচনার পাশাপাশি নতুন শিক্ষাক্রমের ‘ভুল-ভ্রান্তি’ শনাক্ত করতে গত ২৪ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের কমিটি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইআরবি) উপাচার্য আবদুর রশীদকে কমিটির আহ্বায়ক এবং এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামানকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়। এ মূল্যায়ন কমিটির তিন সদস্য হলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর কফিল উদ্দীন সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হালিম এবং ঢাকা সরকারি আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুর রশিদ।
এ কমিটির একজন সদস্য সংবাদকে জানিয়েছেন, তাদের প্রতিবেদন মন্ত্রনালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর ঝুলে আছে। কারণ ‘শরীফার গল্প’ থাকবে কী না সে বিষয়ে তারা সরকারের ‘ইঙ্গিতের’ অপেক্ষায় আছেন।
‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষকদের তালিকা নেই
নতুন শিক্ষাক্রমে ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’ বিষয়ে কতজন শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছে সেই তালিকা নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষকদের তালিকা চেয়েছে মাউশি।
একই সঙ্গে সংস্থাটি নতুন শিক্ষাক্রমে ৮ম ও ৯ম শ্রেণীর ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ের উপজেলা পর্যায়ে পাঁচ দিনব্যাপী ‘প্রোগ্রামিং অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং’ বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিতে ইচ্ছুক শিক্ষকদের তালিকা চেয়েছে।
গত ৪ মার্চ মাউশির ‘ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিম সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট স্কিমের’ পরিচালক সৈয়দ মাহফুজ আলী স্বাক্ষরিত নির্দেশনা সব জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছে। বুধবার (৬ মার্চ) মাউশির ওয়েবসাইটে এটি প্রকাশ করা হয়।
আদেশে বলা হয়, ‘ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিমের’ আওতায় ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ের উপজেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের পাঁচ দিনব্যাপী ‘প্রোগ্রামিং অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং’বিষয়ক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সারাদেশের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে শীঘ্রর আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছ।
এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে যেসব শিক্ষক ইতঃপূর্বে ৩৬ ক্লাস্টারে ৮ম ও ৯ম শ্রেণীর জন্য উপজেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, তাদের তালিকা প্রয়োজন। যারা প্রশিক্ষণ নিতে চান তাদের তালিকাও ২৮ মার্চের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে।
এনসিটিবি থেকে জানা গেছে, গত বছর দুই ধাপে চার লাখ ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষককে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর সাত দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর ‘কোচিং’
ঢাকাসহ সারাদেশেই শিক্ষকরা কমবেশি কোচিং করান। সম্প্রতি কোচিং সেন্টারে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মুরাদ হোসেন। এরপর টনক নড়ে। প্রতিষ্ঠানটি সব শিক্ষকের কোচিং করানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
মাউশির পক্ষ্য থেকেও সারাদেশে শিক্ষকদের কোচিং না করাতে সতর্ক করে গত ৪ মার্চ চিঠি দেয়া হয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলামে (শিক্ষাক্রম) বিশেষ ক্লাসের নামে শিক্ষার্থীদের কোচিং করানো বা কোচিংয়ে বাধ্য করা হলে প্রতিষ্ঠানপ্রধান ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন।
কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ ক্লাসের নামে শিক্ষার্থীদের কোচিং করানো বা কোচিংয়ে বাধ্য করা হচ্ছে জানিয়ে মাউশি বলছে, কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলাম বিস্তরণ ও মূল্যায়নের সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও তা লঙ্ঘন করে সাপ্তাহিক বা মাসিক মূল্যায়নের নামে গতানুগতিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হচ্ছে।
২০২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং মাধ্যমিকের ৮ম ও ৯ম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এই শিক্ষাবর্ষ থেকে ৯ম শ্রেণীতে বিভাগ (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) বিভাজনও থাকছে না।
এ বিষয়ে গত বছরের ২৩ অক্টোবর প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়ে আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের আলাদা বিভাগ বেঁচে নেয়ার সুযোগ থাকছে না। সব শিক্ষার্থীকে একই পাঠ্যবই পড়তে হবে।
২০২৫ সালে এ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণীতে উঠবে, ওই সময়ও বিভাগ বিভাজনের সুযোগ থাকবে না। ২০২৬ সালে এ শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে।