alt

উপ-সম্পাদকীয়

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার ৩১ দিন পর বাংলাদেশী পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ এবং এর ২৩ নাবিক মুক্তি পেয়েছেন। গত ১২ মার্চ কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার পথে ২৩ নাবিকসহ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজকে জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এই জাহাজটির মালিক বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপ। মুক্তির পর জলদস্যুরা জাহাজের ক্যাপ্টেনকে একটি চিঠি দিয়ে উল্লেখ করেছে যে, জাহাজটি নিরাপদে দুবাই যেতে পারবে, পথে অন্য জলদস্যুরা আটক করতে এলে তাদের এই চিঠি দেখালে ছেড়ে দেবে। তারপরও জাহাজটিকে স্পেন ও ইতালীয় নৌ বাহিনী পাহারা দিয়ে ভারত মহাসাগরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অতিক্রমে সহায়তা করেছে।

জাহাজ মুক্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর উত্তর-পূর্ব সোমালিয়ার ফেডারেল রাজ্য পুন্টল্যান্ডের পুলিশ ৮ জলদস্যুকে গ্রেপ্তার করেছে। মুক্তিপণ দেয়ার কথা কেউ স্বীকার করছে না, কিন্তু মুক্তিপণ ছাড়া জাহাজ ও নাবিকদের মুক্তি পাওয়ার কথা বিশ্বাস করা কঠিন। ৬৫ জন জলদস্যু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাহাজটি আটক করেছিল। তারা বাণিজ্য জাহাজ ভেবে মাঝে মাঝে যুদ্ধ জাহাজে আক্রমণ করে জীবন খোয়ায়।

তাই মুক্তিপণ আদায় না করে কোন জিম্মি করা জাহাজ মুক্তি দেয়ার নজির নেই। একটি ভিডিওতে দেখা গেল সাগরে কতগুলো প্যাকেট নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এবং কিছু লোক দুটি স্পিডবোটে সেই প্যাকেট কুড়িয়ে নিচ্ছে। জলদস্যুদের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, মুক্তিপণ হিসেবে ৫ মিলিয়ন ডলার বা ৫৫ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি বিমা প্রতিষ্ঠান এই অর্থ পরিশোধ করেছে। কুড়িয়ে নেয়া প্যাকেটের অর্থ আসল-নকল যাচাই করার পরই জলদস্যুরা জিম্মি করা জাহাজ, নাবিক ও ক্রুদের মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু এভাবে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি লাভ জলদস্যুদের উৎসাহিত করবে। ভারতীয় এবং ইউরোপের যুদ্ধ জাহাজগুলো শক্তি প্রয়োগ করে বাংলাদেশের নাবিকদের উদ্ধারের অনুমতি চেয়েছিল, কিন্তু নাবিকদের জীবনহানির আশঙ্কায় অনুমতি দেয়া হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতা থাকায় দস্যুরা কিছুটা চাপে ছিল বলেই দ্রুত সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছে।

সোমালিয়ার ৯৯ শতাংশ লোক মুসলমান। ১৯৬০ সালে ইতালির ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পায় সোমালিয়া। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাত হলে পরের দুই দশকের বেশি সময় ধরে যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমলিয়াতে কার্যকর কোনো সরকার ছিল না। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তখন আশপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে ট্রলার নিয়ে এসে জেলেরা সোমালিয়ার উপকূল থেকে মাছ ধরে নিয়ে যেত, প্রতিবাদ করলে গুলি ছুড়ত। বিদেশি জেলেদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও ছিল না সোমালিয়ার। ভিনদেশি জেলেদের প্রতিরোধ করতে গিয়েই সোমালিয়ার গরিব, নিরীহ জেলেরা ক্রমান্বয়ে জলদস্যু হয়ে ওঠে। সোমালিয়ার গরিব জেলেরা সংঘবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগঠনের মাধ্যমে বিদেশি মাছ ধরার ট্রলার ও জাহাজকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করতে শুরু করে। মাছ ধরার ট্রলার জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করতে করতে একসময় এই গরিব জেলেরাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জাহাজ জিম্মি করতে শুরু করে এবং এর মাধ্যমে অধিক মুক্তিপণ আদায় করা সম্ভব হয়। বর্তমানে এদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে সোমালিয়ার সশস্ত্র ইসলামপন্থী আল-শাবাক গোষ্ঠী।

সোমালিয়ার জলপথে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার জাহাজ চলাচল করে। ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে এটিই সবচেয়ে ছোট সামুদ্রিক পথ। সোমালিয়ার উপকূলে দস্যুতা চরম পর্যায়ে পৌঁছায় ২০০৫ সাল থেকে। ১৪ বছর আগে বাংলাদেশের একই মালিকের আরেকটি জাহাজও একইভাবে মুক্তিপণ দিয়ে জলদস্যুদের জিম্মি থেকে ৯৯ দিন পর মুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। ২০১১ সালে বিভিন্ন দেশের ৩১টি এবং ২০১২ সালে ৮টি জাহাজ মুক্তিপণ দিয়ে জলদস্যুদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়। ২০১১ সালে প্রতিটি জাহাজ ছাড়া পেতে গড় সময় লেগেছে ১৭৮ দিন এবং ২০১২ সালে লেগেছে ৩১৬ দিন। মালয়েশীয়ার একটি জাহাজের মুক্তি পেতে সময় লেগেছিল ৩ বছর এবং মায়ানমারের মাছ ধরার একটি জাহাজ মুক্ত হয়েছিল ৫ বছরের মাথায়, এই সময়ে ৬ জন নাবিক অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। জিম্মি অবস্থায় জলদস্যু ও জিম্মি নাবিকদের খাবার সরবরাহ করার কোম্পানিও আছে, পরে মুক্তিপণ থেকে একটি অংশ তারা পায়।

জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে অনেক কোম্পানি নিজেদের জাহাজে সশস্ত্র লোকের পাহারার ব্যবস্থা রেখেছে, কিন্তু এতে পণ্যের পরিবহণ খরচ বেড়ে যায়। এই অবস্থায় জলদস্যুদের প্রতিহত করতে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয় এবং এই তৎপরতায় ২০১৩ সাল থেকে বহু বছর ধরে সোমালিয়ার জলদস্যুরা নিষ্কৃয় ছিল; কিন্তু এখন ইয়েমেনের হুথিদের আক্রমণ মোকাবিলায় পশ্চিমা শক্তি বেশি নিবিষ্ট থাকায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সোমালিয়া আফ্রিকার একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ।

২০০১ সালে ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হরকাত আল শাবাব আল মুজাহিদিন সংক্ষেপে আল-শাবাব গঠিত হয়। ২০০৬ সালে সংগঠনটি তাদের সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে এবং সোমালিয়ার অন্তবর্তীকালীন সরকার ও কেনিয়ার সামরিক জোটকে পরাজিত করে রাজধানী মোগাদিসুসহ বিভিন্ন শহর ও বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু আমেরিকা ও ইউরোপের সহযোগিতায় কেনিয়া পশ্চিমা সমর্থিত সোমালিয়ান সরকারের পক্ষে ২০১১ সালে সেনা প্রেরণ করলে আল-শাবাব গোষ্ঠী পেছন হটতে বাধ্য হয়। আল-শাবাব প্রতিবেশী দেশগুলোতেও হামলা চালাচ্ছে; এজন্য প্রতিবেশী দেশগুলোও আফ্রিকান ইউনিয়ন বাহিনীর অংশ হিসেবে ২০১২ সালে শাবাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

সোমালিয়ান সরকার এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের যৌথবাহিনীর কাছে অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আল-শাবাব চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে, অর্থের জন্য জলদস্যুদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার পর আল-শাবাব তাদের যাবতীয় খরচ মেটায় সশস্ত্র দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে। জলদস্যুদের ২০ শতাংশ এই সশস্ত্র সংগঠনের সদস্য। তাদের অধিকৃত এলাকায় কঠোর শরিয়া আইন বলবৎ করলেও তাদের আয়ের প্রধান উৎস শরিয়াবিরোধী অবৈধ ব্যবসাÑ অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি ও নারী পাচার। আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় আফগানিস্তানের তালেবানদেরও আয়ের প্রধান উৎস ছিল মাদক ব্যবসা। সশস্ত্র জিহাদি কর্মকা- চালিয়ে নেয়ার জন্য প্রায় সব ইসলামপন্থী সংগঠন অবৈধ আয়কে বৈধতা দিয়ে থাকে।

আল-শাবাবের অবশ্য বৈধ আয়ও আছে। তারা তাদের অধিকৃত এলাকা থেকে শুল্ক ও কর আদায় করে, তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার সড়ক, সেতু থেকে টোল আদায় করে, তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ২.৫% হারে করপোরেট জাকাত আদায় করে। দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তারা চাকরিজীবীদের বেতন থেকে ৫% হারে কর্তন করে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। সোমালিয়ায় শরিয়া আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও আল-শাবাব নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থীরা সোমালিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। আফগানিস্তানের আইএস-এর মতো আল-শাবাবও জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত সোমালিয়ান সরকারকে মেনে নিতে পারছে না। আল-শাবাব সৌদি আরবের ওহাবি আদর্শে বিশ্বাসী হলেও আন্তর্জাতিক জিহাদের অংশ হিসেবে তারা আল-কায়েদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে। আল-কায়েদার মতো আল-শাবাবও পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থে আঘাত করার জন্য সুযোগ খোঁজে।

পশ্চিমের দেশগুলোও আল-শাবাবের ওপর আক্রমণ চালায়, ২০০৮ সালে বিমান হামলা চালিয়ে আল-শাবাবের প্রধান মুয়ালিম আদেন হাশি আইরোকে হত্যা করে। দেশের চরম দারিদ্র সোমালিয়ার যুবকদের আল-শাবাবের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গোষ্ঠীটি সোমালিয়া ও কেনিয়ার বহু মেয়েকে আটক করে যৌনদাসী বানিয়েছে, যাতে যৌনদাসীদের গর্ভে সন্তান জন্ম দিয়ে ইসলামিক যোদ্ধার সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হয়। আল-শাবাব প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে স্বীকার করে না। আন্তর্জাতিক নানামুখী উদ্যোগের পরও সোমলিয়ার জলদস্যুদের সম্পূর্ণ নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়নি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সোমালিয়ায় জলদস্যুদের ৭২ গ্রুপের একটি শেয়ারবাজার আছে, মুক্তিপণ থেকে অধিক লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় এই শেয়ারবাজারে প্রচুর বিনিয়োগ হয়। সোমালিয়ার উপকূল এত বিস্তৃত যে, সারাক্ষণ জলদস্যুদের পাহারা দিয়ে শঙ্কাহীন নিরাপদ বাণিজ্য নিরবচ্ছিন্ন রাখা কঠিন; এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সোমালিয়ান সরকারের জল ও স্থলপথে জলদস্যুদের উচ্ছেদ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করাই যথাযথ পদক্ষেপ বলে মনে হয়।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাবেক এমডি, টাকশাল]

জেগে উঠুক সুকুমার বৃত্তি

প্রসঙ্গ : লোকসভা নির্বাচন

ছবি

বারবার পুড়ছে বাংলাদেশের ফুসফুস

শিশুমৃত্যু রোধে দক্ষ মিডওয়াইফদের ভূমিকা

বিসিএস জ্বরে পুড়ছে তারুণ্য

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পৃথিবী

নমিনির অনুপস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির গচ্ছিত টাকা পাবে কে

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

যদি শুধু বিনোদন সংস্কৃতি হয় তাহলে বাকি সব কী?

নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিক্ষা

বন্ধ হোক প্রশ্ন ফাঁস

ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার ৩১ দিন পর বাংলাদেশী পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ এবং এর ২৩ নাবিক মুক্তি পেয়েছেন। গত ১২ মার্চ কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার পথে ২৩ নাবিকসহ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজকে জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এই জাহাজটির মালিক বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপ। মুক্তির পর জলদস্যুরা জাহাজের ক্যাপ্টেনকে একটি চিঠি দিয়ে উল্লেখ করেছে যে, জাহাজটি নিরাপদে দুবাই যেতে পারবে, পথে অন্য জলদস্যুরা আটক করতে এলে তাদের এই চিঠি দেখালে ছেড়ে দেবে। তারপরও জাহাজটিকে স্পেন ও ইতালীয় নৌ বাহিনী পাহারা দিয়ে ভারত মহাসাগরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অতিক্রমে সহায়তা করেছে।

জাহাজ মুক্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর উত্তর-পূর্ব সোমালিয়ার ফেডারেল রাজ্য পুন্টল্যান্ডের পুলিশ ৮ জলদস্যুকে গ্রেপ্তার করেছে। মুক্তিপণ দেয়ার কথা কেউ স্বীকার করছে না, কিন্তু মুক্তিপণ ছাড়া জাহাজ ও নাবিকদের মুক্তি পাওয়ার কথা বিশ্বাস করা কঠিন। ৬৫ জন জলদস্যু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাহাজটি আটক করেছিল। তারা বাণিজ্য জাহাজ ভেবে মাঝে মাঝে যুদ্ধ জাহাজে আক্রমণ করে জীবন খোয়ায়।

তাই মুক্তিপণ আদায় না করে কোন জিম্মি করা জাহাজ মুক্তি দেয়ার নজির নেই। একটি ভিডিওতে দেখা গেল সাগরে কতগুলো প্যাকেট নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এবং কিছু লোক দুটি স্পিডবোটে সেই প্যাকেট কুড়িয়ে নিচ্ছে। জলদস্যুদের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, মুক্তিপণ হিসেবে ৫ মিলিয়ন ডলার বা ৫৫ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি বিমা প্রতিষ্ঠান এই অর্থ পরিশোধ করেছে। কুড়িয়ে নেয়া প্যাকেটের অর্থ আসল-নকল যাচাই করার পরই জলদস্যুরা জিম্মি করা জাহাজ, নাবিক ও ক্রুদের মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু এভাবে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি লাভ জলদস্যুদের উৎসাহিত করবে। ভারতীয় এবং ইউরোপের যুদ্ধ জাহাজগুলো শক্তি প্রয়োগ করে বাংলাদেশের নাবিকদের উদ্ধারের অনুমতি চেয়েছিল, কিন্তু নাবিকদের জীবনহানির আশঙ্কায় অনুমতি দেয়া হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতা থাকায় দস্যুরা কিছুটা চাপে ছিল বলেই দ্রুত সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছে।

সোমালিয়ার ৯৯ শতাংশ লোক মুসলমান। ১৯৬০ সালে ইতালির ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পায় সোমালিয়া। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাত হলে পরের দুই দশকের বেশি সময় ধরে যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমলিয়াতে কার্যকর কোনো সরকার ছিল না। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তখন আশপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে ট্রলার নিয়ে এসে জেলেরা সোমালিয়ার উপকূল থেকে মাছ ধরে নিয়ে যেত, প্রতিবাদ করলে গুলি ছুড়ত। বিদেশি জেলেদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও ছিল না সোমালিয়ার। ভিনদেশি জেলেদের প্রতিরোধ করতে গিয়েই সোমালিয়ার গরিব, নিরীহ জেলেরা ক্রমান্বয়ে জলদস্যু হয়ে ওঠে। সোমালিয়ার গরিব জেলেরা সংঘবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগঠনের মাধ্যমে বিদেশি মাছ ধরার ট্রলার ও জাহাজকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করতে শুরু করে। মাছ ধরার ট্রলার জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করতে করতে একসময় এই গরিব জেলেরাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জাহাজ জিম্মি করতে শুরু করে এবং এর মাধ্যমে অধিক মুক্তিপণ আদায় করা সম্ভব হয়। বর্তমানে এদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে সোমালিয়ার সশস্ত্র ইসলামপন্থী আল-শাবাক গোষ্ঠী।

সোমালিয়ার জলপথে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার জাহাজ চলাচল করে। ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে এটিই সবচেয়ে ছোট সামুদ্রিক পথ। সোমালিয়ার উপকূলে দস্যুতা চরম পর্যায়ে পৌঁছায় ২০০৫ সাল থেকে। ১৪ বছর আগে বাংলাদেশের একই মালিকের আরেকটি জাহাজও একইভাবে মুক্তিপণ দিয়ে জলদস্যুদের জিম্মি থেকে ৯৯ দিন পর মুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। ২০১১ সালে বিভিন্ন দেশের ৩১টি এবং ২০১২ সালে ৮টি জাহাজ মুক্তিপণ দিয়ে জলদস্যুদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়। ২০১১ সালে প্রতিটি জাহাজ ছাড়া পেতে গড় সময় লেগেছে ১৭৮ দিন এবং ২০১২ সালে লেগেছে ৩১৬ দিন। মালয়েশীয়ার একটি জাহাজের মুক্তি পেতে সময় লেগেছিল ৩ বছর এবং মায়ানমারের মাছ ধরার একটি জাহাজ মুক্ত হয়েছিল ৫ বছরের মাথায়, এই সময়ে ৬ জন নাবিক অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। জিম্মি অবস্থায় জলদস্যু ও জিম্মি নাবিকদের খাবার সরবরাহ করার কোম্পানিও আছে, পরে মুক্তিপণ থেকে একটি অংশ তারা পায়।

জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে অনেক কোম্পানি নিজেদের জাহাজে সশস্ত্র লোকের পাহারার ব্যবস্থা রেখেছে, কিন্তু এতে পণ্যের পরিবহণ খরচ বেড়ে যায়। এই অবস্থায় জলদস্যুদের প্রতিহত করতে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয় এবং এই তৎপরতায় ২০১৩ সাল থেকে বহু বছর ধরে সোমালিয়ার জলদস্যুরা নিষ্কৃয় ছিল; কিন্তু এখন ইয়েমেনের হুথিদের আক্রমণ মোকাবিলায় পশ্চিমা শক্তি বেশি নিবিষ্ট থাকায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সোমালিয়া আফ্রিকার একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ।

২০০১ সালে ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হরকাত আল শাবাব আল মুজাহিদিন সংক্ষেপে আল-শাবাব গঠিত হয়। ২০০৬ সালে সংগঠনটি তাদের সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে এবং সোমালিয়ার অন্তবর্তীকালীন সরকার ও কেনিয়ার সামরিক জোটকে পরাজিত করে রাজধানী মোগাদিসুসহ বিভিন্ন শহর ও বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু আমেরিকা ও ইউরোপের সহযোগিতায় কেনিয়া পশ্চিমা সমর্থিত সোমালিয়ান সরকারের পক্ষে ২০১১ সালে সেনা প্রেরণ করলে আল-শাবাব গোষ্ঠী পেছন হটতে বাধ্য হয়। আল-শাবাব প্রতিবেশী দেশগুলোতেও হামলা চালাচ্ছে; এজন্য প্রতিবেশী দেশগুলোও আফ্রিকান ইউনিয়ন বাহিনীর অংশ হিসেবে ২০১২ সালে শাবাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

সোমালিয়ান সরকার এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের যৌথবাহিনীর কাছে অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আল-শাবাব চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে, অর্থের জন্য জলদস্যুদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার পর আল-শাবাব তাদের যাবতীয় খরচ মেটায় সশস্ত্র দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে। জলদস্যুদের ২০ শতাংশ এই সশস্ত্র সংগঠনের সদস্য। তাদের অধিকৃত এলাকায় কঠোর শরিয়া আইন বলবৎ করলেও তাদের আয়ের প্রধান উৎস শরিয়াবিরোধী অবৈধ ব্যবসাÑ অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি ও নারী পাচার। আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় আফগানিস্তানের তালেবানদেরও আয়ের প্রধান উৎস ছিল মাদক ব্যবসা। সশস্ত্র জিহাদি কর্মকা- চালিয়ে নেয়ার জন্য প্রায় সব ইসলামপন্থী সংগঠন অবৈধ আয়কে বৈধতা দিয়ে থাকে।

আল-শাবাবের অবশ্য বৈধ আয়ও আছে। তারা তাদের অধিকৃত এলাকা থেকে শুল্ক ও কর আদায় করে, তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার সড়ক, সেতু থেকে টোল আদায় করে, তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ২.৫% হারে করপোরেট জাকাত আদায় করে। দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তারা চাকরিজীবীদের বেতন থেকে ৫% হারে কর্তন করে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। সোমালিয়ায় শরিয়া আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও আল-শাবাব নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থীরা সোমালিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। আফগানিস্তানের আইএস-এর মতো আল-শাবাবও জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত সোমালিয়ান সরকারকে মেনে নিতে পারছে না। আল-শাবাব সৌদি আরবের ওহাবি আদর্শে বিশ্বাসী হলেও আন্তর্জাতিক জিহাদের অংশ হিসেবে তারা আল-কায়েদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে। আল-কায়েদার মতো আল-শাবাবও পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থে আঘাত করার জন্য সুযোগ খোঁজে।

পশ্চিমের দেশগুলোও আল-শাবাবের ওপর আক্রমণ চালায়, ২০০৮ সালে বিমান হামলা চালিয়ে আল-শাবাবের প্রধান মুয়ালিম আদেন হাশি আইরোকে হত্যা করে। দেশের চরম দারিদ্র সোমালিয়ার যুবকদের আল-শাবাবের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গোষ্ঠীটি সোমালিয়া ও কেনিয়ার বহু মেয়েকে আটক করে যৌনদাসী বানিয়েছে, যাতে যৌনদাসীদের গর্ভে সন্তান জন্ম দিয়ে ইসলামিক যোদ্ধার সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হয়। আল-শাবাব প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে স্বীকার করে না। আন্তর্জাতিক নানামুখী উদ্যোগের পরও সোমলিয়ার জলদস্যুদের সম্পূর্ণ নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়নি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সোমালিয়ায় জলদস্যুদের ৭২ গ্রুপের একটি শেয়ারবাজার আছে, মুক্তিপণ থেকে অধিক লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় এই শেয়ারবাজারে প্রচুর বিনিয়োগ হয়। সোমালিয়ার উপকূল এত বিস্তৃত যে, সারাক্ষণ জলদস্যুদের পাহারা দিয়ে শঙ্কাহীন নিরাপদ বাণিজ্য নিরবচ্ছিন্ন রাখা কঠিন; এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সোমালিয়ান সরকারের জল ও স্থলপথে জলদস্যুদের উচ্ছেদ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করাই যথাযথ পদক্ষেপ বলে মনে হয়।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাবেক এমডি, টাকশাল]

back to top