alt

উপ-সম্পাদকীয়

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

শেখর ভট্টাচার্য

: শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
image

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়লে কিংবা মাথাপিছু আয় বাড়লেই উন্নয়ন সাধন হয়ে যায় এ কথাটি কিন্তু আজকাল আর আধুনিক অর্থনীতিবিদরা মানতে চান না

চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে পানি বের হয়ে যাওয়ার অঙ্কটা কী আছে এখনও স্কুলের অঙ্কের সিলেবাসে? চৌবাচ্চার একটি ফুটো দিয়ে পানি বের হয়ে যাচ্ছে এবং অন্য একটি নল দিয়ে সে পরিমাণ পানি পূরণের চেষ্টা চলছে। ফুটো দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে যে পরিমাণ পানি বের হয়ে যায় সে পরিমাণ পানি নল দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করা হলে, কতো সময় লাগবে এবং কী পরিমাণ পানি লাগবে চৌবাচ্চাটি ভরতে, এই হলো অঙ্কের মূল সমস্যা। অঙ্ক বলতেই তো সমস্যার উপস্থাপন। তবে এই সমস্যা বা অঙ্কে একটি কথা বলা নেই, চৌবাচ্চা যখন পূর্ণ হয়ে যাবে তখন কী ফুটোটি বন্ধ করা হবে? সুশাসনের অভাবে সম্প্রতি আর্থিক ক্ষেত্রে যে অরাজকতা, সেখানে ফুটো দিয়ে যে পরিমাণ পানি বেরিয়ে গেছে সে পরিমাণ পানি চৌবাচ্চায় ঢালতে আমরা সমর্থ হয়েছে কিনা তা আম-জনতার পক্ষে বলা বড় কঠিন। সামান্য ঢেলে দেয়া হলেও চৌবাচ্চা পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরে ফুটো যে বন্ধ করা হয়নি এ ব্যাপারে আমরা প্রায় নিশ্চিত। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের শৈশব, কৈশোরে কী অসাধারণ বিষয়ের সমাধান করতে বলা হতো, যেসব সমস্যা প্রাচীন কাল থেকে আমরা আমাদের দেশে সযতেœ চাষ করে যাচ্ছি।

আমাদের অভাগা দেশটির চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে স্বাধীনতার পর থেকেই বিরামহীনভাবে পানি বের হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে যখন চৌবাচ্চা পরিপূর্ণ হয় তখন ফুটোটি আর কেউ বন্ধ করে না। বন্ধ করলে বিপদ। উপচে পড়া পানি দেখে কিছু বুদ্ধিমান মানুষ তখন বলতে পারে উপচে পড়া পানিকে তো অন্য কোথাও সংরক্ষণ করা যায়। বড়ই চতুর যারা চৌবাচ্চা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন। চৌবাচ্চা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা শৈশবে আর একটা সমস্যা আমাদেরকে সমাধান করতে দিতেন। তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার সমস্যা। এ অঙ্ককে বলা হতো তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্ক। বানর ওঠে আবার পিছলে নিচে নেমে আসে। বানরের কতো চেষ্টা ওপরে ওঠার। বানর যাতে ওপরে উঠতে না পারে এ জন্য বাঁশটি তৈল দিয়ে পিচ্ছিল করে রাখা হতো। চৌবাচ্চার অঙ্কের সাথে বানরের অঙ্কের একটি সদৃশ আছে। চৌবাচ্চা যেমন স্থায়ীভাবে পরিপূর্ণ হতে না পারে এজন্য ফুটোটি বন্ধ করা হয় না; একইভাবে বানর ওরফে ম্যাংগো পিপল ওরফে আম-জনতা যাতে সহজে ওপরে উঠতে না পারে এজন্য বাঁশকে তেল দিয়ে পিচ্ছিল করে রাখা হয়।

তবে অঙ্ক বা সমস্যা যারা তৈরি করতেন তারা কিন্তু নির্দয় ছিলেন না। সর্বসাধারন যাতে বেঁচে বর্তে থাকতে পারে এজন্য তারা দয়া পরবশ হয়ে আর একটি সমস্যা সমাধানের কৌশল শেখানোর চেষ্টা করতেন। কৌশলটি বড়ই বাস্তব সম্মত। সেটি হলো দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করে লাভ বের করার কৌশল। কম শ্রমে, কম বিনিয়োগে মানুষকে ঠকিয়ে লাভ করার অঙ্ক। সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা দেয়ার এরকম ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোথাও আছে বা ছিলো কিনা আমার জানা নেই। দুধে জল মেশানোর অংক শিখিয়ে জাতিকে উন্নয়ন চিন্তার এক অভূতপূর্ব মহাসড়কে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। সুফল পাওয়া যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালে। আমরা দেখছি, রডের সাথে বাঁশ মেশানো, সিমেন্টের সাথে অধিক পরিমাণ বালি মেশানো, ফলের রস না দিয়ে ক্যামিকেল মিশিয়ে বিশুদ্ধ ফলের রস বিক্রি করা- এসব বড়ই চমকপ্রদ। ফাইলকে টাকার সাথে মিশিয়ে ফেলেছে বাঙালি। এরকম বহুমাত্রিক মেশানো, জুড়ানোর অঙ্ক শিখে দেশে এবং বিদেশে অনেকেই মেধার পতাকা পত পত করে ওড়াচ্ছেন। এখন আর একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে অঙ্কে সেটি হলো ধর্ম চর্চা। ধর্ম যুদ্ধে গোলাবারুদ, সৈন্য সামন্ত শহীদ হয়ে যাওয়ার সমস্যাকে অংকের মাধ্যমে সমাধান করতে দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ করে গণিত শিক্ষায় বৈচিত্র্য আছে বলা যায়। উদ্ভাবনী শক্তির অভাব নেই। একটি দরজা বন্ধ হলে অন্য দরজা দিয়ে অঙ্কের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা। অঙ্ক তো নয় যেনো দর্শন শিক্ষা। হায় সেলুকাস!

এতক্ষণ অঙ্ক নিয়ে যে কথা বলা হলো, তাহলো টোন সেটিং। গানের শুরুতে যেমন কিছুক্ষণ হারমোনিয়াম বাজিয়ে টোন সেট করতে হয়, অঙ্কের আলোচনা অনেকটা এরকম। মুল আলোচনা হলো আমাদের উন্নয়নের গতি প্রকৃতি। অঙ্কের আলোচনা হলো আমাদের উন্নয়ন নিয়ে সামান্য আলোচনার টোন সেটিং।

উন্নয়ন বিষয়টি ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে যখন আটকে আছে তখন সাধারণ, অসাধারণ মানুষদের লাভ ক্ষতি, গড় নির্ণয়ের অংক শেখানোটাই উত্তম। উন্নয়ন বিষয়টি বাংলাদেশে উপস্থাপন করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ এবং মানুষের মাথা পিছু আয়কে ব্যাখ্যা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়লে কিংবা মাথাপিছু আয় বাড়লেই উন্নয়ন সাধন হয়ে যায় এ কথাটি কিন্তু আজকাল আর আধুনিক অর্থনীতিবিদরা মানতে চান না। আমাদের অর্থনীতিবিদরা নাছোড়বান্দা, দেশের শীর্ষ শিল্পপতির হাজারকোটি প্রদর্শিত আয়ের সাথে আমার মতো গঙ্গা তেলির আয়কে যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ করে তারা বলতে চান দেখো, আমাদের গঙ্গার বা গঙ্গাদের এখন মাথাপিছু আয় এতো হাজার কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় কিন্তু অর্থনীতির নিয়মে এভাবেই বের করতে হয়, সুতরাং শাস্ত্রীয়ভাবে তারা কিন্তু ঠিক রাগটিই গাইছেন অর্থাৎ তারা ভোরের আলোর কোমল পরিবেশে শুদ্ধভাবেই রাগ পরিবেশন করছেন। এর ভেতরে যে কিছু ফকিঝুঁকি আছে, এরকম গড় অঙ্ক যে আধুনিক অর্থনীতি মেনে নিতে চায় না এ বিষয়টি তারা মনে নেন কিন্তু মেনে নিতে চান না। মানব উনয়ন ও মানবিক উন্নয়নকে এক পাল্লায় উঠিয়ে উন্নয়নের পাল্লাকে ভারি করতে চান তারা।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন মানব উন্নয়নকে তরান্বিত করে। এই যে পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা এতো আবেগাপ্লুত হলাম তা কিন্তু আমাদের মানব উন্নয়নে অপরিমেয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। মানব উন্নয়ন হলো মানুষের জীবন ধারনের মানের উন্নয়ন। মানব উনয়নের বিষয়ে সুসংগঠিত মতামত প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। ওই সালে মানুষের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি নতুন অ্যাপ্রোচ বা দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভাবন ঘটে। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয়, মানুষের জীবনের সমৃদ্ধিকে বৃদ্ধি করাই মানব উন্নয়ন। এই উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেÑ ১. মানুষ, ২. তাদের সুযোগ এবং ৩. তাদের পছন্দ।

মানব উন্নয়ের মাধ্যমে আয়ের নানা সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ থাকে। মানুষের অবকাঠামোগত সুযোগ, দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ, প্রযুক্তিগত সুযোগ। এসব সুযোগ ব্যবহার করে মানুষ আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

মানব উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের নৈতিকতা বৃদ্ধির সুযোগ নেই। নৈতিকতা বৃদ্ধির সুযোগ ঘটে মানবিকতার উন্নয়নের মাধ্যমে। মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ মানুষ যে কোন উপায়ে মানব উন্নয়ন ঘটাতে চাইবেন না। তারা উন্নয়নের জন্য প্রকৃতি বিনাশী কোন পরিকল্পনা হাতে নেয়ার বিষয়টি মেনে নেবেন না। মানবিক উন্নয়ন মানুষকে দায়িত্বশীল করে তোলে। মানুষের প্রতি দেশের প্রতি ভালবাসা বিস্তীর্ণ হয়। একাত্তরে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মানবিক গুণাবলী ছিলো অতুলনীয়। দেশকে নিঃশর্তে ভালোবেসে মারণাস্ত্রের সামনে ঝাঁপ দেয়া তখনই সম্ভব হয় যখন মানুষ তার মানবিক গুণাবলীর সর্বোচ্চটা অর্জন করতে সক্ষম হয়।

প্রতিটি মানুষের ভেতরে একটি মানবিক মন আছে বলে দার্শনিকেরা মনে করেন। তবে অনেক সময় মানুষ সেটি হারিয়ে অন্যের সাথে হিংস্র আচরণ করে। অন্যের মতামত, কথা, আচরণ, ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি সহনশীল হয় না। মানবিক উন্নয়ন সাধিত হলে মানুষ অমায়িক হয়, সহনশীল হয়, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং সর্বোপরি সবাইকে আপন করে নেয়। এ কারণে শুধু মানব উন্নয়ন নয়, মানবিক উন্নয়নের প্রতিও আমাদের সমান মনোযোগ ও গুরুত্ব থাকা উচিত।

মানব উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হয় যখন মানুষে মানুষে ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হয়। বন্ধন দৃঢ় হয় কী করে? মানুষ যখন একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক এবং জন অংশগ্রহণে পরিপূর্ণ সমাজ গঠন করতে পারে। স্বচ্ছ জবাবদিহীমূলক সমাজ গঠিত হয় মানবিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধ বাজার ব্যবস্থা সভ্য, মানবিক জাতি গঠনের একমাত্র নিয়ামক শক্তি নয়। একটি উদাহরণ দেই। শত শত ইটকে পাশাপাশি রেখে কোন অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব হয় না, অবকাঠামো নির্মানের জন্য প্রয়োজন ইটের সাথে ইটের বন্ধন। সে বন্ধনের উপাদান হলো সিমেন্ট। উন্নত মানবিক গুণাবলী হলো বন্ধন বা বন্ডিং ম্যাটেরিয়েলস। মানবিক গুণাবলীর উন্নয়ন সাধন না করে একটি সমদৃষ্টির, সমতাভিত্তিক জাতি গঠন সম্ভব নয়। আমাদেরকে এবার গুরুত্বের সাথে মানব উন্নয়নের সাথে মানবিক উন্নয়নের দিকে চোখ ফেরাতে হবে। আমরা যদি তা করতে অসমর্থ হই তাহলে চৌবাচ্চার ফুটো কিন্তু থেকে যাবে। তেল মাখানো বাঁশের উপরে উঠতে না পেরে আমরা হয়তো ভূপতিত হতে পারি। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে মানব উন্নয়ন ও মানবিক উন্নয়নকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

জেগে উঠুক সুকুমার বৃত্তি

প্রসঙ্গ : লোকসভা নির্বাচন

ছবি

বারবার পুড়ছে বাংলাদেশের ফুসফুস

শিশুমৃত্যু রোধে দক্ষ মিডওয়াইফদের ভূমিকা

বিসিএস জ্বরে পুড়ছে তারুণ্য

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পৃথিবী

নমিনির অনুপস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির গচ্ছিত টাকা পাবে কে

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

যদি শুধু বিনোদন সংস্কৃতি হয় তাহলে বাকি সব কী?

নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিক্ষা

বন্ধ হোক প্রশ্ন ফাঁস

ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

শেখর ভট্টাচার্য

image

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়লে কিংবা মাথাপিছু আয় বাড়লেই উন্নয়ন সাধন হয়ে যায় এ কথাটি কিন্তু আজকাল আর আধুনিক অর্থনীতিবিদরা মানতে চান না

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে পানি বের হয়ে যাওয়ার অঙ্কটা কী আছে এখনও স্কুলের অঙ্কের সিলেবাসে? চৌবাচ্চার একটি ফুটো দিয়ে পানি বের হয়ে যাচ্ছে এবং অন্য একটি নল দিয়ে সে পরিমাণ পানি পূরণের চেষ্টা চলছে। ফুটো দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে যে পরিমাণ পানি বের হয়ে যায় সে পরিমাণ পানি নল দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করা হলে, কতো সময় লাগবে এবং কী পরিমাণ পানি লাগবে চৌবাচ্চাটি ভরতে, এই হলো অঙ্কের মূল সমস্যা। অঙ্ক বলতেই তো সমস্যার উপস্থাপন। তবে এই সমস্যা বা অঙ্কে একটি কথা বলা নেই, চৌবাচ্চা যখন পূর্ণ হয়ে যাবে তখন কী ফুটোটি বন্ধ করা হবে? সুশাসনের অভাবে সম্প্রতি আর্থিক ক্ষেত্রে যে অরাজকতা, সেখানে ফুটো দিয়ে যে পরিমাণ পানি বেরিয়ে গেছে সে পরিমাণ পানি চৌবাচ্চায় ঢালতে আমরা সমর্থ হয়েছে কিনা তা আম-জনতার পক্ষে বলা বড় কঠিন। সামান্য ঢেলে দেয়া হলেও চৌবাচ্চা পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরে ফুটো যে বন্ধ করা হয়নি এ ব্যাপারে আমরা প্রায় নিশ্চিত। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের শৈশব, কৈশোরে কী অসাধারণ বিষয়ের সমাধান করতে বলা হতো, যেসব সমস্যা প্রাচীন কাল থেকে আমরা আমাদের দেশে সযতেœ চাষ করে যাচ্ছি।

আমাদের অভাগা দেশটির চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে স্বাধীনতার পর থেকেই বিরামহীনভাবে পানি বের হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে যখন চৌবাচ্চা পরিপূর্ণ হয় তখন ফুটোটি আর কেউ বন্ধ করে না। বন্ধ করলে বিপদ। উপচে পড়া পানি দেখে কিছু বুদ্ধিমান মানুষ তখন বলতে পারে উপচে পড়া পানিকে তো অন্য কোথাও সংরক্ষণ করা যায়। বড়ই চতুর যারা চৌবাচ্চা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন। চৌবাচ্চা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা শৈশবে আর একটা সমস্যা আমাদেরকে সমাধান করতে দিতেন। তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার সমস্যা। এ অঙ্ককে বলা হতো তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্ক। বানর ওঠে আবার পিছলে নিচে নেমে আসে। বানরের কতো চেষ্টা ওপরে ওঠার। বানর যাতে ওপরে উঠতে না পারে এ জন্য বাঁশটি তৈল দিয়ে পিচ্ছিল করে রাখা হতো। চৌবাচ্চার অঙ্কের সাথে বানরের অঙ্কের একটি সদৃশ আছে। চৌবাচ্চা যেমন স্থায়ীভাবে পরিপূর্ণ হতে না পারে এজন্য ফুটোটি বন্ধ করা হয় না; একইভাবে বানর ওরফে ম্যাংগো পিপল ওরফে আম-জনতা যাতে সহজে ওপরে উঠতে না পারে এজন্য বাঁশকে তেল দিয়ে পিচ্ছিল করে রাখা হয়।

তবে অঙ্ক বা সমস্যা যারা তৈরি করতেন তারা কিন্তু নির্দয় ছিলেন না। সর্বসাধারন যাতে বেঁচে বর্তে থাকতে পারে এজন্য তারা দয়া পরবশ হয়ে আর একটি সমস্যা সমাধানের কৌশল শেখানোর চেষ্টা করতেন। কৌশলটি বড়ই বাস্তব সম্মত। সেটি হলো দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করে লাভ বের করার কৌশল। কম শ্রমে, কম বিনিয়োগে মানুষকে ঠকিয়ে লাভ করার অঙ্ক। সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা দেয়ার এরকম ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোথাও আছে বা ছিলো কিনা আমার জানা নেই। দুধে জল মেশানোর অংক শিখিয়ে জাতিকে উন্নয়ন চিন্তার এক অভূতপূর্ব মহাসড়কে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। সুফল পাওয়া যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালে। আমরা দেখছি, রডের সাথে বাঁশ মেশানো, সিমেন্টের সাথে অধিক পরিমাণ বালি মেশানো, ফলের রস না দিয়ে ক্যামিকেল মিশিয়ে বিশুদ্ধ ফলের রস বিক্রি করা- এসব বড়ই চমকপ্রদ। ফাইলকে টাকার সাথে মিশিয়ে ফেলেছে বাঙালি। এরকম বহুমাত্রিক মেশানো, জুড়ানোর অঙ্ক শিখে দেশে এবং বিদেশে অনেকেই মেধার পতাকা পত পত করে ওড়াচ্ছেন। এখন আর একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে অঙ্কে সেটি হলো ধর্ম চর্চা। ধর্ম যুদ্ধে গোলাবারুদ, সৈন্য সামন্ত শহীদ হয়ে যাওয়ার সমস্যাকে অংকের মাধ্যমে সমাধান করতে দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ করে গণিত শিক্ষায় বৈচিত্র্য আছে বলা যায়। উদ্ভাবনী শক্তির অভাব নেই। একটি দরজা বন্ধ হলে অন্য দরজা দিয়ে অঙ্কের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা। অঙ্ক তো নয় যেনো দর্শন শিক্ষা। হায় সেলুকাস!

এতক্ষণ অঙ্ক নিয়ে যে কথা বলা হলো, তাহলো টোন সেটিং। গানের শুরুতে যেমন কিছুক্ষণ হারমোনিয়াম বাজিয়ে টোন সেট করতে হয়, অঙ্কের আলোচনা অনেকটা এরকম। মুল আলোচনা হলো আমাদের উন্নয়নের গতি প্রকৃতি। অঙ্কের আলোচনা হলো আমাদের উন্নয়ন নিয়ে সামান্য আলোচনার টোন সেটিং।

উন্নয়ন বিষয়টি ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে যখন আটকে আছে তখন সাধারণ, অসাধারণ মানুষদের লাভ ক্ষতি, গড় নির্ণয়ের অংক শেখানোটাই উত্তম। উন্নয়ন বিষয়টি বাংলাদেশে উপস্থাপন করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ এবং মানুষের মাথা পিছু আয়কে ব্যাখ্যা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়লে কিংবা মাথাপিছু আয় বাড়লেই উন্নয়ন সাধন হয়ে যায় এ কথাটি কিন্তু আজকাল আর আধুনিক অর্থনীতিবিদরা মানতে চান না। আমাদের অর্থনীতিবিদরা নাছোড়বান্দা, দেশের শীর্ষ শিল্পপতির হাজারকোটি প্রদর্শিত আয়ের সাথে আমার মতো গঙ্গা তেলির আয়কে যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ করে তারা বলতে চান দেখো, আমাদের গঙ্গার বা গঙ্গাদের এখন মাথাপিছু আয় এতো হাজার কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় কিন্তু অর্থনীতির নিয়মে এভাবেই বের করতে হয়, সুতরাং শাস্ত্রীয়ভাবে তারা কিন্তু ঠিক রাগটিই গাইছেন অর্থাৎ তারা ভোরের আলোর কোমল পরিবেশে শুদ্ধভাবেই রাগ পরিবেশন করছেন। এর ভেতরে যে কিছু ফকিঝুঁকি আছে, এরকম গড় অঙ্ক যে আধুনিক অর্থনীতি মেনে নিতে চায় না এ বিষয়টি তারা মনে নেন কিন্তু মেনে নিতে চান না। মানব উনয়ন ও মানবিক উন্নয়নকে এক পাল্লায় উঠিয়ে উন্নয়নের পাল্লাকে ভারি করতে চান তারা।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন মানব উন্নয়নকে তরান্বিত করে। এই যে পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা এতো আবেগাপ্লুত হলাম তা কিন্তু আমাদের মানব উন্নয়নে অপরিমেয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। মানব উন্নয়ন হলো মানুষের জীবন ধারনের মানের উন্নয়ন। মানব উনয়নের বিষয়ে সুসংগঠিত মতামত প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। ওই সালে মানুষের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি নতুন অ্যাপ্রোচ বা দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভাবন ঘটে। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয়, মানুষের জীবনের সমৃদ্ধিকে বৃদ্ধি করাই মানব উন্নয়ন। এই উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেÑ ১. মানুষ, ২. তাদের সুযোগ এবং ৩. তাদের পছন্দ।

মানব উন্নয়ের মাধ্যমে আয়ের নানা সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ থাকে। মানুষের অবকাঠামোগত সুযোগ, দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ, প্রযুক্তিগত সুযোগ। এসব সুযোগ ব্যবহার করে মানুষ আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

মানব উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের নৈতিকতা বৃদ্ধির সুযোগ নেই। নৈতিকতা বৃদ্ধির সুযোগ ঘটে মানবিকতার উন্নয়নের মাধ্যমে। মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ মানুষ যে কোন উপায়ে মানব উন্নয়ন ঘটাতে চাইবেন না। তারা উন্নয়নের জন্য প্রকৃতি বিনাশী কোন পরিকল্পনা হাতে নেয়ার বিষয়টি মেনে নেবেন না। মানবিক উন্নয়ন মানুষকে দায়িত্বশীল করে তোলে। মানুষের প্রতি দেশের প্রতি ভালবাসা বিস্তীর্ণ হয়। একাত্তরে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মানবিক গুণাবলী ছিলো অতুলনীয়। দেশকে নিঃশর্তে ভালোবেসে মারণাস্ত্রের সামনে ঝাঁপ দেয়া তখনই সম্ভব হয় যখন মানুষ তার মানবিক গুণাবলীর সর্বোচ্চটা অর্জন করতে সক্ষম হয়।

প্রতিটি মানুষের ভেতরে একটি মানবিক মন আছে বলে দার্শনিকেরা মনে করেন। তবে অনেক সময় মানুষ সেটি হারিয়ে অন্যের সাথে হিংস্র আচরণ করে। অন্যের মতামত, কথা, আচরণ, ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি সহনশীল হয় না। মানবিক উন্নয়ন সাধিত হলে মানুষ অমায়িক হয়, সহনশীল হয়, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং সর্বোপরি সবাইকে আপন করে নেয়। এ কারণে শুধু মানব উন্নয়ন নয়, মানবিক উন্নয়নের প্রতিও আমাদের সমান মনোযোগ ও গুরুত্ব থাকা উচিত।

মানব উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হয় যখন মানুষে মানুষে ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হয়। বন্ধন দৃঢ় হয় কী করে? মানুষ যখন একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক এবং জন অংশগ্রহণে পরিপূর্ণ সমাজ গঠন করতে পারে। স্বচ্ছ জবাবদিহীমূলক সমাজ গঠিত হয় মানবিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধ বাজার ব্যবস্থা সভ্য, মানবিক জাতি গঠনের একমাত্র নিয়ামক শক্তি নয়। একটি উদাহরণ দেই। শত শত ইটকে পাশাপাশি রেখে কোন অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব হয় না, অবকাঠামো নির্মানের জন্য প্রয়োজন ইটের সাথে ইটের বন্ধন। সে বন্ধনের উপাদান হলো সিমেন্ট। উন্নত মানবিক গুণাবলী হলো বন্ধন বা বন্ডিং ম্যাটেরিয়েলস। মানবিক গুণাবলীর উন্নয়ন সাধন না করে একটি সমদৃষ্টির, সমতাভিত্তিক জাতি গঠন সম্ভব নয়। আমাদেরকে এবার গুরুত্বের সাথে মানব উন্নয়নের সাথে মানবিক উন্নয়নের দিকে চোখ ফেরাতে হবে। আমরা যদি তা করতে অসমর্থ হই তাহলে চৌবাচ্চার ফুটো কিন্তু থেকে যাবে। তেল মাখানো বাঁশের উপরে উঠতে না পেরে আমরা হয়তো ভূপতিত হতে পারি। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে মানব উন্নয়ন ও মানবিক উন্নয়নকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top