alt

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

গৌতম রায়

: শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ভারতের লোকসভা নির্বাচনপর্ব (২০২৪) চলাকালীন পশ্চিমবঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশন নিয়ন্ত্রিত চাকরি দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্টের রায় এই মুহূর্তে এ রাজ্যে সব থেকে বেশি রাজনীতির আলোচ্য বিষয়। কলকাতা হাইকোর্টের রায় ২০১৬ সালে চাকরি পাওয়া প্রায় পঁচিশ হাজার জনকে বরখাস্ত করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে যে সীমাহীন দুর্নীতি করে চলেছে, যা নিয়ে বামপন্থিরা এবং কংগ্রেস মাঠে ময়দানে বহু আন্দোলন করেছে, প্যানেলভুক্ত হবু শিক্ষকরা দিনের পর দিন কলকাতার রাজপথে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা উপেক্ষা করে অবস্থান করেছেন। সেই সমস্ত অভিযোগ কেই শেষ পর্যন্ত সিলমোহর দিল কলকাতা হাইকোর্ট।

দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি ঘিরে মমতা সরকারের একদা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জেলে রয়েছে। তাছাড়াও তার দলের একাধিক বিধায়ক জেল বাস করছে। বিভিন্ন সরকারি আধিকারিকেরাও জেল বাস করছে। গোটা ব্যাপারটিকে ধামাচাপা দেওয়ার বহু চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল। তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও করা হয়েছিল। রাজ্যের মানুষদের করের টাকায় দুর্নীতিগ্রস্তদের আড়াল করবার জন্য বিভিন্ন স্তরের আদালতে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার।

তবুও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না মমতা। লোকসভা নির্বাচনের গোটা প্রক্রিয়া চলাকালীন শিক্ষক নিয়োগ মামলায় সরকারের ভয়াবহ দুর্নীতির বিষয়টিকে সিলমোহর দিয়ে কলকাতা হাইকোর্ট এটাই বুঝিয়ে দিলেন যে, আপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত রয়েছে সরকার। এ তো শুধু শিক্ষক নিয়োগ ঘিরে একটা সামান্য পর্ব ঘিরে আদালতের রায় দান। এমন আরো বহু মামলা, যা মমতা সরকারের আমলে ভয়াবহ দুর্নীতি ঘিরে রয়েছে। সেগুলো মহামান্য আদালতের বিচারাধীন আছে। তাছাড়াও গরু পাচার থেকে শুরু করে কয়লা পাচার, হেন অপরাধ নেই যেগুলোর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সমস্ত স্তরের নেতাদের সংযোগ ঘিরে অভিযোগ নেই।

সেসব অভিযোগের ভিত্তিতে বহু তাবড়-তাবড় তৃণমূলের নেতা এখন শ্রী ঘরে রয়েছে। স্কুল সার্ভিস নিয়োগ কমিশনের নিয়োগ সংক্রান্ত এ ভয়াবহ দুর্নীতির জেরে ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া একটা বড় অংশের লোকেদের মধ্যে বেশ কিছু যোগ্য প্রার্থীর ও চাকরি গেছে।

ক্ষমতায় আসবার আগে বিরোধী নেত্রী হিসেবে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের সম্পর্কের নানা ধরনের কথা মমতা বলতেন। বামফ্রন্টের দুর্নীতি নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন তিনি তুলতেন। সাধারণ মানুষকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মানুষকে স্বনির্ভর হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি একটা আশা আকাক্সক্ষা জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন নানা রাজনৈতিক সমীকরণের মাধ্যমে। সেই জায়গা থেকে একটা বড় অংশের মানুষ মমতাকে ভোট দিয়েছিলেন। বামপন্থিদের সম্পর্কে জাতীয়- আন্তর্জাতিক স্তরে যে ভয়াবহ মিথ্যাচার, তার ফাঁদে পা দিয়ে একটা অংশের মানুষ ভেবেছিলেন, মমতাকে ভোট দিলে বেকার যুবক-যুবতীরা চাকরি পাবে। মানুষ দুবেলা পেট ভরে খেতে পারবে। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা বেসরকারি হাতছানি মুক্ত হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে একটা উন্মুক্ত পরিবেশ তৈরি হবে। মানুষকে পড়াশোনা শেখার ক্ষেত্রে বেসরকারি মাধ্যমে অনেক বেশি টাকা খরচ করার পরিবর্তে, সরকারি মাধ্যমে কম টাকায় সঠিক শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করে দেবেন। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকবে। মুসলমান নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসরতার দরুন গোটা মুসলমান সমাজ নানা ধরনের সামাজিক অনগ্রসরতার শিকার হয়ে রয়েছেন। সেসব গুলি কাটাতে মুসলমান সমাজকে আধুনিক শিক্ষার দিকে পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে মমতা বিশেষ ভূমিকা পালন করবেন।

এ সমস্তই মিথ্যা আশাকুহকিনী। এসব নিয়েই নিজেদের জীবনকে পরিচালিত করতে হচ্ছে এপার বাংলার নতুন প্রজন্মের প্রায় প্রত্যেকটি মানুষকেই। এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত যে মামলার রায়ে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের চাকরি গেছে, তার মধ্যে প্রত্যেকেই যে কোনো না কোনো ভাবে মমতার দলের কর্তা ব্যক্তিদের ঘুষ দিয়ে, ফাঁকা পরীক্ষাপত্রের জেরে চাকরি পেয়েছেন, এমনটা ভেবে নেওয়া উচিত নয়। একটা বড় অংশের যোগ্য প্রার্থী ওই তালিকায় ছিলেন। তারা চাকরি পেয়েছেন শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং এসএসসির শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই। কিন্তু তাদের সঙ্গেই যেভাবে একটা বড় অংশের নিয়োগ ঘটেছে কেবলমাত্র ঘুষের বিনিময়ে, ফাঁকা উত্তরপত্র জমা দেওয়ার বিনিময়ে, সেই দুর্নীতির সঙ্গে নিজেরা দুর্নীতি না করেও পরিব্যপ্ত থাকবার ‘অপরাধে’ নিরপরাধী মানুষজনেরা চাকরি গেল।

মহামান্য হাইকোর্ট সকলকে বেতন সুদসহ ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নিরাপরাধ মানুষজনেরাও একটা ভয়াবহ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসম্মানের মধ্যে পড়লেন। সমাজমাধ্যমে এমনও কিছু বিষয় উঠে আসছে যে, এই চাকরি যাওয়া ছেলেমেয়েরা যাতে কোনোরকম মানসিক যন্ত্রণায় আত্মহত্যার মতো ঘটনা না ঘটায়, তার জন্য তাদের পরিবার উদ্বিগ্নভাবে তাদের সব সময় পাহারা দিচ্ছে।

যে পর্বত প্রমাণ দুর্নীতির মধ্যে আকীর্ণ রয়েছেন, নিমজ্জিত রয়েছে রাজ্য সরকার তার একটি ক্ষুদ্রতম অংশ হলো, এই স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি। মমতা যদি সত্যিই মানুষের প্রতি আস্থাবান থাকতেন, মমতা যদি সত্যিই ভারতের সংবিধানের প্রতি আস্থাবান থাকতেন, তিনি যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থা বানতেন, তাহলে কুল সার্ভিস কমিশনের ২০১৬ সালের নিয়োগ সংক্রান্ত কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের পর অবিলম্বে পদত্যাগ করতেন তিনি। সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইতেন তার নিজের এবং সতীর্থদের কৃতকর্মের জন্য।

এসব আশা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিকের কাছে করা মানে ভষ্মে জল ঢালা। নিজের দলের লোকেদের করা কোনো দুর্নীতিকে, মমতা কোনদিনও দুর্নীতি বলে স্বীকার করতে পারেননি তার প্রশাসক জীবনে। একজন দুর্নীতিবাজকেও তিনি দলীয় স্তরে কোন শাস্তি দেননি। কুনাল ঘোষের মতো লোক সারদা কেলেঙ্কারির জেরে যাকে মমতার পুলিশি গ্রেফতার করেছিল। দীর্ঘদিন কারাবাস করেছেন যে কুনাল মমতার পুলিশের মামলার জেরে। কোর্টে যাওয়া আসার পথে যে কুনাল ঘোষ সমস্ত দুর্নীতির উৎসমুখ হলেন মমতা স্বয়ং একথা বারবার গণমাধ্যমের সামনে বলেছেন। সেই কুনালকেই এখন আবার মমতা নিজের দলের অন্তর্ভুক্তই শুধু করেননি, মুখপাত্র হিসেবে তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। যে নিয়োগের ফলে নানা ধরনের রাজনৈতিক অশালীন কুশ্রী বাক্য ফোয়ারার মতো উদগত হচ্ছে কুনাল ঘোষের মুখ থেকে।

শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি, মমতার দুর্নীতির হিমশৈলের একটি ছোট্ট কণা মাত্র। সরকারি স্তরে প্রত্যেকটি দপ্তরের চাকরির ক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্নীতি হয়েছে বলে নানা জায়গা থেকে অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়। প্রস্তুত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত প্রায় ১২-১৩ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে ধরনের দুর্নীতি, স্বজন পোষণÑ এ বিষয়গুলোকে একটা দস্তুরে পরিণত করেছেন; তার জেরে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, বাঙালি সমাজ আজ গোটা ভারতের কাছে একটা উপহাসের পাত্র মাত্র।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

জেগে উঠুক সুকুমার বৃত্তি

প্রসঙ্গ : লোকসভা নির্বাচন

ছবি

বারবার পুড়ছে বাংলাদেশের ফুসফুস

শিশুমৃত্যু রোধে দক্ষ মিডওয়াইফদের ভূমিকা

বিসিএস জ্বরে পুড়ছে তারুণ্য

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পৃথিবী

নমিনির অনুপস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির গচ্ছিত টাকা পাবে কে

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

যদি শুধু বিনোদন সংস্কৃতি হয় তাহলে বাকি সব কী?

নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিক্ষা

বন্ধ হোক প্রশ্ন ফাঁস

ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

গৌতম রায়

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ভারতের লোকসভা নির্বাচনপর্ব (২০২৪) চলাকালীন পশ্চিমবঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশন নিয়ন্ত্রিত চাকরি দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্টের রায় এই মুহূর্তে এ রাজ্যে সব থেকে বেশি রাজনীতির আলোচ্য বিষয়। কলকাতা হাইকোর্টের রায় ২০১৬ সালে চাকরি পাওয়া প্রায় পঁচিশ হাজার জনকে বরখাস্ত করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে যে সীমাহীন দুর্নীতি করে চলেছে, যা নিয়ে বামপন্থিরা এবং কংগ্রেস মাঠে ময়দানে বহু আন্দোলন করেছে, প্যানেলভুক্ত হবু শিক্ষকরা দিনের পর দিন কলকাতার রাজপথে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা উপেক্ষা করে অবস্থান করেছেন। সেই সমস্ত অভিযোগ কেই শেষ পর্যন্ত সিলমোহর দিল কলকাতা হাইকোর্ট।

দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি ঘিরে মমতা সরকারের একদা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জেলে রয়েছে। তাছাড়াও তার দলের একাধিক বিধায়ক জেল বাস করছে। বিভিন্ন সরকারি আধিকারিকেরাও জেল বাস করছে। গোটা ব্যাপারটিকে ধামাচাপা দেওয়ার বহু চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল। তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও করা হয়েছিল। রাজ্যের মানুষদের করের টাকায় দুর্নীতিগ্রস্তদের আড়াল করবার জন্য বিভিন্ন স্তরের আদালতে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার।

তবুও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না মমতা। লোকসভা নির্বাচনের গোটা প্রক্রিয়া চলাকালীন শিক্ষক নিয়োগ মামলায় সরকারের ভয়াবহ দুর্নীতির বিষয়টিকে সিলমোহর দিয়ে কলকাতা হাইকোর্ট এটাই বুঝিয়ে দিলেন যে, আপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত রয়েছে সরকার। এ তো শুধু শিক্ষক নিয়োগ ঘিরে একটা সামান্য পর্ব ঘিরে আদালতের রায় দান। এমন আরো বহু মামলা, যা মমতা সরকারের আমলে ভয়াবহ দুর্নীতি ঘিরে রয়েছে। সেগুলো মহামান্য আদালতের বিচারাধীন আছে। তাছাড়াও গরু পাচার থেকে শুরু করে কয়লা পাচার, হেন অপরাধ নেই যেগুলোর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সমস্ত স্তরের নেতাদের সংযোগ ঘিরে অভিযোগ নেই।

সেসব অভিযোগের ভিত্তিতে বহু তাবড়-তাবড় তৃণমূলের নেতা এখন শ্রী ঘরে রয়েছে। স্কুল সার্ভিস নিয়োগ কমিশনের নিয়োগ সংক্রান্ত এ ভয়াবহ দুর্নীতির জেরে ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া একটা বড় অংশের লোকেদের মধ্যে বেশ কিছু যোগ্য প্রার্থীর ও চাকরি গেছে।

ক্ষমতায় আসবার আগে বিরোধী নেত্রী হিসেবে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের সম্পর্কের নানা ধরনের কথা মমতা বলতেন। বামফ্রন্টের দুর্নীতি নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন তিনি তুলতেন। সাধারণ মানুষকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মানুষকে স্বনির্ভর হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি একটা আশা আকাক্সক্ষা জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন নানা রাজনৈতিক সমীকরণের মাধ্যমে। সেই জায়গা থেকে একটা বড় অংশের মানুষ মমতাকে ভোট দিয়েছিলেন। বামপন্থিদের সম্পর্কে জাতীয়- আন্তর্জাতিক স্তরে যে ভয়াবহ মিথ্যাচার, তার ফাঁদে পা দিয়ে একটা অংশের মানুষ ভেবেছিলেন, মমতাকে ভোট দিলে বেকার যুবক-যুবতীরা চাকরি পাবে। মানুষ দুবেলা পেট ভরে খেতে পারবে। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা বেসরকারি হাতছানি মুক্ত হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে একটা উন্মুক্ত পরিবেশ তৈরি হবে। মানুষকে পড়াশোনা শেখার ক্ষেত্রে বেসরকারি মাধ্যমে অনেক বেশি টাকা খরচ করার পরিবর্তে, সরকারি মাধ্যমে কম টাকায় সঠিক শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করে দেবেন। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকবে। মুসলমান নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসরতার দরুন গোটা মুসলমান সমাজ নানা ধরনের সামাজিক অনগ্রসরতার শিকার হয়ে রয়েছেন। সেসব গুলি কাটাতে মুসলমান সমাজকে আধুনিক শিক্ষার দিকে পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে মমতা বিশেষ ভূমিকা পালন করবেন।

এ সমস্তই মিথ্যা আশাকুহকিনী। এসব নিয়েই নিজেদের জীবনকে পরিচালিত করতে হচ্ছে এপার বাংলার নতুন প্রজন্মের প্রায় প্রত্যেকটি মানুষকেই। এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত যে মামলার রায়ে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের চাকরি গেছে, তার মধ্যে প্রত্যেকেই যে কোনো না কোনো ভাবে মমতার দলের কর্তা ব্যক্তিদের ঘুষ দিয়ে, ফাঁকা পরীক্ষাপত্রের জেরে চাকরি পেয়েছেন, এমনটা ভেবে নেওয়া উচিত নয়। একটা বড় অংশের যোগ্য প্রার্থী ওই তালিকায় ছিলেন। তারা চাকরি পেয়েছেন শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং এসএসসির শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই। কিন্তু তাদের সঙ্গেই যেভাবে একটা বড় অংশের নিয়োগ ঘটেছে কেবলমাত্র ঘুষের বিনিময়ে, ফাঁকা উত্তরপত্র জমা দেওয়ার বিনিময়ে, সেই দুর্নীতির সঙ্গে নিজেরা দুর্নীতি না করেও পরিব্যপ্ত থাকবার ‘অপরাধে’ নিরপরাধী মানুষজনেরা চাকরি গেল।

মহামান্য হাইকোর্ট সকলকে বেতন সুদসহ ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নিরাপরাধ মানুষজনেরাও একটা ভয়াবহ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসম্মানের মধ্যে পড়লেন। সমাজমাধ্যমে এমনও কিছু বিষয় উঠে আসছে যে, এই চাকরি যাওয়া ছেলেমেয়েরা যাতে কোনোরকম মানসিক যন্ত্রণায় আত্মহত্যার মতো ঘটনা না ঘটায়, তার জন্য তাদের পরিবার উদ্বিগ্নভাবে তাদের সব সময় পাহারা দিচ্ছে।

যে পর্বত প্রমাণ দুর্নীতির মধ্যে আকীর্ণ রয়েছেন, নিমজ্জিত রয়েছে রাজ্য সরকার তার একটি ক্ষুদ্রতম অংশ হলো, এই স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি। মমতা যদি সত্যিই মানুষের প্রতি আস্থাবান থাকতেন, মমতা যদি সত্যিই ভারতের সংবিধানের প্রতি আস্থাবান থাকতেন, তিনি যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থা বানতেন, তাহলে কুল সার্ভিস কমিশনের ২০১৬ সালের নিয়োগ সংক্রান্ত কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের পর অবিলম্বে পদত্যাগ করতেন তিনি। সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইতেন তার নিজের এবং সতীর্থদের কৃতকর্মের জন্য।

এসব আশা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিকের কাছে করা মানে ভষ্মে জল ঢালা। নিজের দলের লোকেদের করা কোনো দুর্নীতিকে, মমতা কোনদিনও দুর্নীতি বলে স্বীকার করতে পারেননি তার প্রশাসক জীবনে। একজন দুর্নীতিবাজকেও তিনি দলীয় স্তরে কোন শাস্তি দেননি। কুনাল ঘোষের মতো লোক সারদা কেলেঙ্কারির জেরে যাকে মমতার পুলিশি গ্রেফতার করেছিল। দীর্ঘদিন কারাবাস করেছেন যে কুনাল মমতার পুলিশের মামলার জেরে। কোর্টে যাওয়া আসার পথে যে কুনাল ঘোষ সমস্ত দুর্নীতির উৎসমুখ হলেন মমতা স্বয়ং একথা বারবার গণমাধ্যমের সামনে বলেছেন। সেই কুনালকেই এখন আবার মমতা নিজের দলের অন্তর্ভুক্তই শুধু করেননি, মুখপাত্র হিসেবে তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। যে নিয়োগের ফলে নানা ধরনের রাজনৈতিক অশালীন কুশ্রী বাক্য ফোয়ারার মতো উদগত হচ্ছে কুনাল ঘোষের মুখ থেকে।

শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি, মমতার দুর্নীতির হিমশৈলের একটি ছোট্ট কণা মাত্র। সরকারি স্তরে প্রত্যেকটি দপ্তরের চাকরির ক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্নীতি হয়েছে বলে নানা জায়গা থেকে অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়। প্রস্তুত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত প্রায় ১২-১৩ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে ধরনের দুর্নীতি, স্বজন পোষণÑ এ বিষয়গুলোকে একটা দস্তুরে পরিণত করেছেন; তার জেরে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, বাঙালি সমাজ আজ গোটা ভারতের কাছে একটা উপহাসের পাত্র মাত্র।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top