গাজী তারেক আজিজ
আমাদের লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিক প্রতি বছর রওনা হন অজানা ভবিষ্যতের দিকে। হাতে থাকে সামান্য কিছু টাকা, বুকভরা স্বপ্ন এবং একটি অদৃশ্য টান- পরিবারকে রক্ষা করার, সমাজে সম্মান পাওয়ার, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার। অথচ এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা যেন অদৃশ্য থেকেই যান আমাদের নীতি-নির্ধারকদের চোখে। এই রেমিটেন্স যোদ্ধারা থেকে যান উপেক্ষিত। অধরা থেকে যায় তাদের স্বপ্ন ও স্বপ্নের পরিম-ল।
তারা শুধু রেমিটেন্স পাঠান, অথচ রেমিটেন্সের উৎসের মুখগুলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়- দুর্ঘটনা, রোগ, অতিরিক্ত কাজের চাপে। আজকের বাংলাদেশ যে বৈদেশিক মুদ্রার শক্তিতে দাঁড়িয়ে, তার ভিত্তি তৈরি করা এই শ্রমিকরা অনেক সময়ই রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার শিকার; যা দেখেও কেউ যেন দেখে না! তাদের চিৎকার কেউ শোনে না! তাদের বোবাকান্নার ঢেউ স্পর্শ করে আমাদের দেশের উঁচুতলায় বসতি গড়া লোকগুলোকে।
বর্তমানে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কর্মরত। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপ- সবখানেই ছড়িয়ে আছে তারা। কিন্তু এই শ্রম রপ্তানির ধারণাটিই প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ মানবিক মর্যাদা ছাড়া কোনো শ্রম প্রকৃত অর্থে ‘সম্পদ’ নয়। প্রদত্ত শ্রম যান্ত্রিকতার নামান্তর!
প্রবাসীরা কাজ করেন নির্মাণ সাইটে, ফ্যাক্টরিতে, কৃষিক্ষেত্রে, গৃহপরিচারিকারূপেÑ অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে। একদিকে মালিক পক্ষের নিপীড়ন, অন্যদিকে নিয়োগকারী দেশের আইনগত দুর্বলতাÑ এই দুইয়ের মাঝখানে পড়ে যান শ্রমিকেরা। অনেকেই বেতন পান না, অনেকে মৃত্যুর পর ফেরত আসেন কফিনবন্দি হয়ে। অথচ দক্ষ শ্রম বাজার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পদ। সেদিকে নজর দেয়ার কি কারো সময় রয়েছে? আমাদের রাষ্ট্র কেবল রেমিটেন্স প্রবাহে খুশি। বছরে ২২-২৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রবেশ করে। অথচ রাষ্ট্রীয় নীতি, কূটনৈতিক চাপ, আইনি সহায়তা-সবই গড়পড়তা।
এসবই আমরা জানতে পারি প্রবাসে অবস্থানরত শ্রমিকদের কাছে থেকে। যা চরম হতাশার। বিভিন্ন সময় অভিযোগ ওঠে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলোতে শ্রমিকদের প্রতি অবহেলা রয়েছে। কনস্যুলার সেবায় দীর্ঘসূত্রতা, শ্রমিকদের ভাষায় অস্পষ্টতা এবং সহযোগিতার অভাব তাদের দুর্দশা বাড়িয়ে দেয়। অথচ এর থেকে উত্তরণের কোন উপায় খুঁজতে সকলের এত এত অনীহার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করাও খুব জরুরি।
কাজের পরিবেশ, বাসস্থান, চিকিৎসা, বীমা- এসব মৌলিক চাহিদার দিকে কোনো নজর নেই। অথচ উন্নত দেশগুলোতে এমনকি কৃষিশ্রমিকের জন্যও স্পষ্ট চুক্তি, ইনস্যুরেন্স, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা রাখা হয়। আমরা তা পারি না কেন? আমাদের দূর্বলতা ঠিক কোথায়, কেউ দেখিয়ে দেবেন? কেন আমরা স্পষ্ট হতে শিখিনি! যখন প্রবাসে কোনো শ্রমিক মারা যান, তখন পরিবারে নেমে আসে সর্বনাশ। একটি স্বপ্নের মৃত্যুতে গোটা ভবিষ্যৎ মুখ থুবড়ে পড়ে। বহু নারী বিধবা হন, সন্তান এতিম হয়। অনেক সময় তাদের লাশ আনতেও অসহনীয় ভোগান্তি, বিলম্ব হয়, প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের অনুমতি আর দীর্ঘ কাগজপত্রের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় পরিবারকে। এসবেও পরিবারগুলো ধাতস্ত হয়েছে, এর বিকল্পই বা কী? কিন্তু এরপরও এই পরিবারগুলো নীরব থাকে। কারণ তারা জানে-আর কোনো উপায় নেই।
আবার কেউ না কেউ পরবর্তী প্রজন্ম থেকে সেই দিকেই পা বাড়াবে। বৃত্তটি ভাঙে না। যে কেউ অদৃশ্য থেকে চোখ রাঙাচ্ছে। যাতে অসন্তুষ্ট হলে তাদের ওপর ভিন্ন কোন চাপ নেমে আসে! এই দেখে তারা সয়ে যায়। সয়ে যেতে শেখে। সয়ে যেতে অভ্যস্ত হয়ে যেন নিস্তার পায়! হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। যেন এটাই হওয়ার কথা ছিল। হয়েছেও তাই।
প্রবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হলে চাই কূটনৈতিক দৃঢ়তা, শ্রমচুক্তিতে মানবাধিকার অন্তর্ভুক্ত করা এবং নিয়োগপ্রাপ্ত দেশগুলোর আইনি কাঠামোতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। যখন ভারত বা ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো চুক্তিভিত্তিক বিদেশি শ্রম পাঠায়, সেখানে বেতন, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিরতির নিশ্চয়তা থাকে। বাংলাদেশ তেমন অবস্থানে নেই কেন? এই যৌক্তিক প্রশ্নটি করার হিম্মতও কি কারো নেই?
আমরা এখনো দালালদের মাধ্যমে শ্রমিক পাঠাই, যাদের হাত ধরে কোটি কোটি টাকা বিদেশে যায়, অথচ শ্রমিক পড়ে যান দারিদ্র্যের গভীরে। রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না আনলে এই শ্রমবাজার ধসে পড়বে। যদিও সরকারি হিসেবের চেয়ে বেশি খরচ নেয় এজেন্সি তথা দালাল চক্র! সরকার শ্রমবাজারের এই যোদ্ধাদের সে অধিকারটুকুও নিশ্চিত করতে পারেনি। অন্যদিকে দালাল চক্র এক কাজের কথা বলে অন্য কাজে নিয়ে দেয়; যা বাস্তবতার সাথে না মেলায় শ্রমিকও যথাযথ শ্রম প্রদানে ব্যর্থ। ঋণ করে প্রবাস জীবন বেছে নিয়ে একই ঋণের বোঝা তাড়া করে ফেরে। এর থেকেও পরিত্রাণ খুব সহজে মেলে না।
প্রবাসী নারীদের অবস্থাও করুণ। অনেক নারী গৃহপরিচারিকার কাজ করতে গিয়ে যৌন নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতন, এমনকি নিখোঁজ হওয়ার শিকার হন। কয়েক বছর আগে সৌদি আরব থেকে অনেক নারী ফিরেছিলেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে। এই নারীদের জন্য আলাদা চুক্তি, পর্যবেক্ষণ দল এবং দেশে ফেরার পর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া প্রয়োজন। তারা যেন সমাজে অবজ্ঞার শিকার না হন, বরং লড়াই করে ফেরত আসা একজন যোদ্ধা হিসেবে মর্যাদা পান। সেদিকটা নিশ্চিত করাও দেশেরই দায়িত্ব। পুনর্বাসনে গড়িমসি করলে তারা সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হতাশায় পড়ে অপ্রাসঙ্গিক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে; যা হবে আরও হতাশার।
রাষ্ট্রের ভেতরেও একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আছে। প্রবাসী শ্রমিকদের আমরা দেখি কেবল ডলার পাঠানোর যন্ত্র হিসেবে। অথচ তারা হচ্ছেন জাতির সবচেয়ে সাহসী অংশ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অচেনা ভাষা ও সংস্কৃতির মাঝে, দিনে ১২-১৬ ঘণ্টা কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন। তাদের সন্তানরা বেড়ে ওঠে বাবার বা মায়ের ছায়া ছাড়া। বৃদ্ধ পিতামাতা অপেক্ষায় থাকেন ফোনের ওপারে। এটা এক ধীরে বিষপানে বাঁচা জীবন। আর তারাই আর্থিক নিশ্চয়তা ব্যাতীত দেশে এসে অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে চলেন; যা কতটা নির্মম কেবল ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়া কেউ না জানলেও সমাজে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। তাই সরকার যেমন করে বৈধ প্রবাহে রেমিটেন্স পাঠানোয় উৎসাহ দিতে প্রতি লাখ টাকায় ১-৩ পার্সেন্ট হিসেবে বাড়তি প্রণোদনা দিয়ে আসছিল। ঠিক তেমন করেই, স্থায়ীভাবে প্রবাস ফেরত সবাইকে এককালীন উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ দিয়ে, তাদেরসহ অন্যান্যদের প্রবাসের প্রতি উৎসাহী করাও কাজে আসতে পারে। এতে তারা অসহায় বোধ করবে না।
সমাধান কী? প্রথমত, রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়াকে দালালনির্ভর থেকে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ও স্বচ্ছ করতে হবে। প্রতিটি শ্রমচুক্তি নিরীক্ষা ও অনুবাদের মাধ্যমে শ্রমিকদের জানিয়ে পাঠাতে হবে; যা ব্যয় তা-ই গ্রহণ করতে হবে, এর বেশি হয়। দ্বিতীয়ত, গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে মানবাধিকার, চিকিৎসা, সুরক্ষা ও পারিশ্রমিক নির্ধারণে কঠোরতা চাই। তৃতীয়ত, প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড ও দূতাবাসে শ্রমিক সেবা সেল গঠন করে তা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে। চতুর্থত, দেশে ফিরে আসা শ্রমিকদের জন্য পুনঃবাসন, প্রশিক্ষণ ও বিনিয়োগ সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। যেন তারা নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারেন।
অর্থ পাঠানো মানেই দায়িত্ব শেষ নয়। রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হবে, প্রবাসীরা শুধু অর্থের উৎস নয়- তারা আমাদের কূটনৈতিক সম্মান, মানবিক মুখ এবং অর্থনৈতিক ভিত। তাদের মৃত্যু যেন কেবল সংখ্যা না হয়, তাদের কান্না যেন বাতাসে মিলিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি সত্যিই জনমুখী হতে চায়, তবে এই শ্রমিকদের মুখেই তার প্রকৃত চেহারা দেখা যাবে।
একটি জাতির মর্যাদা নির্ধারিত হয় তার দুর্বলতম মানুষের প্রতি আচরণে। প্রবাসী শ্রমিকেরা আমাদের অর্থনীতির শক্তি, আমাদের গর্ব। কিন্তু আমরা যদি তাদের অভিবাসনের পেছনে থাকা কষ্ট, অপমান ও মৃত্যু ভুলে যাই, তবে আমাদের আত্ম-পরিচয়ের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। না হলে শ্রমবাজারে দেশের মানুষ নিজেদের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন হবে না। এতে করে চোরের কিল খাওয়ার মতো করে হজম করে যেতে যেতে আগ্রহ হারিয়ে দেশে কিংবা প্রবাসে বেআইনি কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হয়ে পড়তে পারে; যা দেশের জন্য মঙ্গল তো নয়ই অমঙ্গল ডেকে আনবে।
আমরা চাই, তারা হোক স্বপ্নের বহ্নিশিখা-শোষণের শিকার নয়। তাদের জীবন হোক নিরাপদ, শ্রম হোক মর্যাদার, আর প্রবাস হোক শুধু টাকা নয়, সম্মানের ঠিকানা। তারপরই একটা দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারে।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫
আমাদের লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিক প্রতি বছর রওনা হন অজানা ভবিষ্যতের দিকে। হাতে থাকে সামান্য কিছু টাকা, বুকভরা স্বপ্ন এবং একটি অদৃশ্য টান- পরিবারকে রক্ষা করার, সমাজে সম্মান পাওয়ার, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার। অথচ এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা যেন অদৃশ্য থেকেই যান আমাদের নীতি-নির্ধারকদের চোখে। এই রেমিটেন্স যোদ্ধারা থেকে যান উপেক্ষিত। অধরা থেকে যায় তাদের স্বপ্ন ও স্বপ্নের পরিম-ল।
তারা শুধু রেমিটেন্স পাঠান, অথচ রেমিটেন্সের উৎসের মুখগুলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়- দুর্ঘটনা, রোগ, অতিরিক্ত কাজের চাপে। আজকের বাংলাদেশ যে বৈদেশিক মুদ্রার শক্তিতে দাঁড়িয়ে, তার ভিত্তি তৈরি করা এই শ্রমিকরা অনেক সময়ই রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার শিকার; যা দেখেও কেউ যেন দেখে না! তাদের চিৎকার কেউ শোনে না! তাদের বোবাকান্নার ঢেউ স্পর্শ করে আমাদের দেশের উঁচুতলায় বসতি গড়া লোকগুলোকে।
বর্তমানে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কর্মরত। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপ- সবখানেই ছড়িয়ে আছে তারা। কিন্তু এই শ্রম রপ্তানির ধারণাটিই প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ মানবিক মর্যাদা ছাড়া কোনো শ্রম প্রকৃত অর্থে ‘সম্পদ’ নয়। প্রদত্ত শ্রম যান্ত্রিকতার নামান্তর!
প্রবাসীরা কাজ করেন নির্মাণ সাইটে, ফ্যাক্টরিতে, কৃষিক্ষেত্রে, গৃহপরিচারিকারূপেÑ অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে। একদিকে মালিক পক্ষের নিপীড়ন, অন্যদিকে নিয়োগকারী দেশের আইনগত দুর্বলতাÑ এই দুইয়ের মাঝখানে পড়ে যান শ্রমিকেরা। অনেকেই বেতন পান না, অনেকে মৃত্যুর পর ফেরত আসেন কফিনবন্দি হয়ে। অথচ দক্ষ শ্রম বাজার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পদ। সেদিকে নজর দেয়ার কি কারো সময় রয়েছে? আমাদের রাষ্ট্র কেবল রেমিটেন্স প্রবাহে খুশি। বছরে ২২-২৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রবেশ করে। অথচ রাষ্ট্রীয় নীতি, কূটনৈতিক চাপ, আইনি সহায়তা-সবই গড়পড়তা।
এসবই আমরা জানতে পারি প্রবাসে অবস্থানরত শ্রমিকদের কাছে থেকে। যা চরম হতাশার। বিভিন্ন সময় অভিযোগ ওঠে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলোতে শ্রমিকদের প্রতি অবহেলা রয়েছে। কনস্যুলার সেবায় দীর্ঘসূত্রতা, শ্রমিকদের ভাষায় অস্পষ্টতা এবং সহযোগিতার অভাব তাদের দুর্দশা বাড়িয়ে দেয়। অথচ এর থেকে উত্তরণের কোন উপায় খুঁজতে সকলের এত এত অনীহার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করাও খুব জরুরি।
কাজের পরিবেশ, বাসস্থান, চিকিৎসা, বীমা- এসব মৌলিক চাহিদার দিকে কোনো নজর নেই। অথচ উন্নত দেশগুলোতে এমনকি কৃষিশ্রমিকের জন্যও স্পষ্ট চুক্তি, ইনস্যুরেন্স, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা রাখা হয়। আমরা তা পারি না কেন? আমাদের দূর্বলতা ঠিক কোথায়, কেউ দেখিয়ে দেবেন? কেন আমরা স্পষ্ট হতে শিখিনি! যখন প্রবাসে কোনো শ্রমিক মারা যান, তখন পরিবারে নেমে আসে সর্বনাশ। একটি স্বপ্নের মৃত্যুতে গোটা ভবিষ্যৎ মুখ থুবড়ে পড়ে। বহু নারী বিধবা হন, সন্তান এতিম হয়। অনেক সময় তাদের লাশ আনতেও অসহনীয় ভোগান্তি, বিলম্ব হয়, প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের অনুমতি আর দীর্ঘ কাগজপত্রের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় পরিবারকে। এসবেও পরিবারগুলো ধাতস্ত হয়েছে, এর বিকল্পই বা কী? কিন্তু এরপরও এই পরিবারগুলো নীরব থাকে। কারণ তারা জানে-আর কোনো উপায় নেই।
আবার কেউ না কেউ পরবর্তী প্রজন্ম থেকে সেই দিকেই পা বাড়াবে। বৃত্তটি ভাঙে না। যে কেউ অদৃশ্য থেকে চোখ রাঙাচ্ছে। যাতে অসন্তুষ্ট হলে তাদের ওপর ভিন্ন কোন চাপ নেমে আসে! এই দেখে তারা সয়ে যায়। সয়ে যেতে শেখে। সয়ে যেতে অভ্যস্ত হয়ে যেন নিস্তার পায়! হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। যেন এটাই হওয়ার কথা ছিল। হয়েছেও তাই।
প্রবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হলে চাই কূটনৈতিক দৃঢ়তা, শ্রমচুক্তিতে মানবাধিকার অন্তর্ভুক্ত করা এবং নিয়োগপ্রাপ্ত দেশগুলোর আইনি কাঠামোতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। যখন ভারত বা ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো চুক্তিভিত্তিক বিদেশি শ্রম পাঠায়, সেখানে বেতন, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিরতির নিশ্চয়তা থাকে। বাংলাদেশ তেমন অবস্থানে নেই কেন? এই যৌক্তিক প্রশ্নটি করার হিম্মতও কি কারো নেই?
আমরা এখনো দালালদের মাধ্যমে শ্রমিক পাঠাই, যাদের হাত ধরে কোটি কোটি টাকা বিদেশে যায়, অথচ শ্রমিক পড়ে যান দারিদ্র্যের গভীরে। রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না আনলে এই শ্রমবাজার ধসে পড়বে। যদিও সরকারি হিসেবের চেয়ে বেশি খরচ নেয় এজেন্সি তথা দালাল চক্র! সরকার শ্রমবাজারের এই যোদ্ধাদের সে অধিকারটুকুও নিশ্চিত করতে পারেনি। অন্যদিকে দালাল চক্র এক কাজের কথা বলে অন্য কাজে নিয়ে দেয়; যা বাস্তবতার সাথে না মেলায় শ্রমিকও যথাযথ শ্রম প্রদানে ব্যর্থ। ঋণ করে প্রবাস জীবন বেছে নিয়ে একই ঋণের বোঝা তাড়া করে ফেরে। এর থেকেও পরিত্রাণ খুব সহজে মেলে না।
প্রবাসী নারীদের অবস্থাও করুণ। অনেক নারী গৃহপরিচারিকার কাজ করতে গিয়ে যৌন নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতন, এমনকি নিখোঁজ হওয়ার শিকার হন। কয়েক বছর আগে সৌদি আরব থেকে অনেক নারী ফিরেছিলেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে। এই নারীদের জন্য আলাদা চুক্তি, পর্যবেক্ষণ দল এবং দেশে ফেরার পর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া প্রয়োজন। তারা যেন সমাজে অবজ্ঞার শিকার না হন, বরং লড়াই করে ফেরত আসা একজন যোদ্ধা হিসেবে মর্যাদা পান। সেদিকটা নিশ্চিত করাও দেশেরই দায়িত্ব। পুনর্বাসনে গড়িমসি করলে তারা সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হতাশায় পড়ে অপ্রাসঙ্গিক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে; যা হবে আরও হতাশার।
রাষ্ট্রের ভেতরেও একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আছে। প্রবাসী শ্রমিকদের আমরা দেখি কেবল ডলার পাঠানোর যন্ত্র হিসেবে। অথচ তারা হচ্ছেন জাতির সবচেয়ে সাহসী অংশ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অচেনা ভাষা ও সংস্কৃতির মাঝে, দিনে ১২-১৬ ঘণ্টা কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন। তাদের সন্তানরা বেড়ে ওঠে বাবার বা মায়ের ছায়া ছাড়া। বৃদ্ধ পিতামাতা অপেক্ষায় থাকেন ফোনের ওপারে। এটা এক ধীরে বিষপানে বাঁচা জীবন। আর তারাই আর্থিক নিশ্চয়তা ব্যাতীত দেশে এসে অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে চলেন; যা কতটা নির্মম কেবল ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়া কেউ না জানলেও সমাজে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। তাই সরকার যেমন করে বৈধ প্রবাহে রেমিটেন্স পাঠানোয় উৎসাহ দিতে প্রতি লাখ টাকায় ১-৩ পার্সেন্ট হিসেবে বাড়তি প্রণোদনা দিয়ে আসছিল। ঠিক তেমন করেই, স্থায়ীভাবে প্রবাস ফেরত সবাইকে এককালীন উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ দিয়ে, তাদেরসহ অন্যান্যদের প্রবাসের প্রতি উৎসাহী করাও কাজে আসতে পারে। এতে তারা অসহায় বোধ করবে না।
সমাধান কী? প্রথমত, রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়াকে দালালনির্ভর থেকে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ও স্বচ্ছ করতে হবে। প্রতিটি শ্রমচুক্তি নিরীক্ষা ও অনুবাদের মাধ্যমে শ্রমিকদের জানিয়ে পাঠাতে হবে; যা ব্যয় তা-ই গ্রহণ করতে হবে, এর বেশি হয়। দ্বিতীয়ত, গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে মানবাধিকার, চিকিৎসা, সুরক্ষা ও পারিশ্রমিক নির্ধারণে কঠোরতা চাই। তৃতীয়ত, প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড ও দূতাবাসে শ্রমিক সেবা সেল গঠন করে তা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে। চতুর্থত, দেশে ফিরে আসা শ্রমিকদের জন্য পুনঃবাসন, প্রশিক্ষণ ও বিনিয়োগ সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। যেন তারা নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারেন।
অর্থ পাঠানো মানেই দায়িত্ব শেষ নয়। রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হবে, প্রবাসীরা শুধু অর্থের উৎস নয়- তারা আমাদের কূটনৈতিক সম্মান, মানবিক মুখ এবং অর্থনৈতিক ভিত। তাদের মৃত্যু যেন কেবল সংখ্যা না হয়, তাদের কান্না যেন বাতাসে মিলিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি সত্যিই জনমুখী হতে চায়, তবে এই শ্রমিকদের মুখেই তার প্রকৃত চেহারা দেখা যাবে।
একটি জাতির মর্যাদা নির্ধারিত হয় তার দুর্বলতম মানুষের প্রতি আচরণে। প্রবাসী শ্রমিকেরা আমাদের অর্থনীতির শক্তি, আমাদের গর্ব। কিন্তু আমরা যদি তাদের অভিবাসনের পেছনে থাকা কষ্ট, অপমান ও মৃত্যু ভুলে যাই, তবে আমাদের আত্ম-পরিচয়ের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। না হলে শ্রমবাজারে দেশের মানুষ নিজেদের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন হবে না। এতে করে চোরের কিল খাওয়ার মতো করে হজম করে যেতে যেতে আগ্রহ হারিয়ে দেশে কিংবা প্রবাসে বেআইনি কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হয়ে পড়তে পারে; যা দেশের জন্য মঙ্গল তো নয়ই অমঙ্গল ডেকে আনবে।
আমরা চাই, তারা হোক স্বপ্নের বহ্নিশিখা-শোষণের শিকার নয়। তাদের জীবন হোক নিরাপদ, শ্রম হোক মর্যাদার, আর প্রবাস হোক শুধু টাকা নয়, সম্মানের ঠিকানা। তারপরই একটা দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারে।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]