alt

opinion » post-editorial

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

গাজী তারেক আজিজ

: বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫

একসময় গান ছিল কানে শোনার বিষয়। চোখ বন্ধ করে রেডিও শোনা হতো, মনে মনে ছবি আঁকা চলতÑ গানের কথায় ভেসে যেত মানুষ স্মৃতির স্রোতে। তখন ছিল ক্যাসেট প্লেয়ার, রেডিও, ডেকসেট কিংবা কম্প্যাক্ট ডিস্কের যুগ। এরপর এলো এমপ্লিফায়ার, এমপিথ্রি প্লেয়ার, এফএম রেডিও, আর ডাউনলোড করে গান শোনার অভ্যাস। শব্দ, সুর আর আবেগের একত্র সহাবস্থান ছিল তখন।

আজ সে বাস্তবতা অনেকটাই বদলে গেছে। এখন গান ‘শোনা’ নয়, ‘দেখা’ হয়। ইউটিউব, ফেসবুক, রিলস, টিকটকের স্ক্রিনে গানের স্থান। শ্রবণের অভিজ্ঞতা রূপ নিয়েছে দৃষ্টির আনন্দে।

এই পরিবর্তন শুধু প্রযুক্তির কারণে নয়; এটি এক সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর। গান এখন আর নিছক সুর বা কথার বিষয় নয়Ñ এটি এখন এক ভিজ্যুয়াল প্যাকেজ, যার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে দৃশ্য, পোশাক, লোকেশন ও শরীরী ভাষা। প্রশ্ন হচ্ছে, এই রূপান্তর আমাদের ব্যক্তি জীবন, সংস্কৃতি ও সমাজকে কিভাবে প্রভাবিত করছে? এবং এর পরিণতি কী হতে পারে?

শ্রোতা থেকে দর্শক : মননের পরিবর্তন গান শোনার মাধ্যম বদলেছে। রেডিওর জায়গা নিয়েছে স্মার্টফোন, ক্যাসেটের জায়গায় এসেছে স্ট্রিমিং অ্যাপ; কিন্তু শুধু মাধ্যম নয়, বদলে গেছে গানের আত্মাও।

মানুষ এখন পুরো গান শোনে না, ৩০ সেকেন্ডের ক্লিপ দেখে। গানের আবেদন সুর-শব্দে নয়, বরং ভিডিওর ঝলমলে রূপে। যার পোশাক আকর্ষণীয়, ভিডিওতে বিদেশি লোকেশন ও আকর্ষণীয় নাচ আছে, সেই-ই আজকের ‘ভিউসের রাজা’।

এই ভিউস নির্ভরতা শ্রোতাকে পরিণত করছে দর্শকে। মনোযোগের জায়গা দখল করছে চোখ। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে সেই মনোসংযোগ, যা গান শোনার মৌলিক শর্ত। আগে গান শোনা হতো বিবিধ ভারতী, বিটিভির ‘ছায়াছন্দ’ বা ‘ইত্যাদির’ মাধ্যমে। এখন ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম রিলস, টিকটকÑসবই ভিউসের যুদ্ধক্ষেত্র।

গান ‘হিট’ হয় যদি ভিডিও ভাইরাল হয়। শিল্পীর কণ্ঠ, গানের কথা, সুরÑ এসব প্রেক্ষাপটে পড়ে থাকে। ভিডিওতে চটক, শরীরী উপস্থাপন, লোকেশন ও ক্যামেরার কারসাজি মূল বিবেচ্য হয়। এই জনপ্রিয়তা বেশিরভাগ সময়ই হয় ক্ষণস্থায়ীÑদীর্ঘস্থায়ী শ্রবণের অভিজ্ঞতা নয়।

প্রযুক্তির উৎকর্ষ না বাজারের অপব্যবহার? অবশ্যই প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। ইউটিউব, স্পটিফাই, অ্যামাজন মিউজিকÑ সবই আমাদের গানকে কাছে এনে দিয়েছে; কিন্তু যখন সেই প্রযুক্তি কেবল মনোযোগ ছিনিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত হয়, তখন তা সাংস্কৃতিক ক্ষতির কারণ হয়।

একসময় গান ছিল অনুভবের বিষয়। এখন তা প্রদর্শনের উপাদান। গানের চেয়ে ভিডিওতে বেশি বাজেট বরাদ্দ হয়। কণ্ঠশিল্পীর গায়কির চেয়ে মডেলের শরীর গুরুত্ব পায়। অথচ একটা সময় ছিল, গান তৈরি হতো কথা ও সুরকে ঘিরে। এখন আগে লেখা হয় ভিডিওর স্ক্রিপ্ট, পরে হয় গান। শিল্পী বাছাইয়ে মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায় ‘কে দেখতে ভালো লাগবে’। ফলে অনেক ভালো শিল্পী গান প্রকাশ করতে পারছেন না, শুধুমাত্র ভিডিও না থাকার কারণে।

গান ছিল আবেগের একান্ত জায়গা। কেউ ভালোবাসায় আঘাত পেলে গান শুনত, কেউ আনন্দে গান ধরত। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে ‘সেলিব্রিটির কেমন পোশাক ছিল’ বা ‘কে কিভাবে নাচল’ সেই আলোচনা।

সামাজিক প্রভাব : পরিবারের ভিত নড়ছে একসঙ্গে বসে গান শোনার যে পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল, তা আজ হারিয়ে গেছে। এখন গান মানেই একাকী স্ক্রিনের সামনে সময় কাটানো। শিশুরা গান শুনে শেখে না, দেখে শেখেÑযেখানে থাকে ফ্যাশন, গ্ল্যামার এবং কখনো অশালীন অঙ্গভঙ্গি। এই ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতি তাদের ভাষা, রুচি ও মানসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত স্ক্রিননির্ভর গান গ্রহণ করলে শিশু-কিশোরদের মনোযোগ কমে, ভাষা বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে। বাংলাদেশেও এর প্রতিফলন আমরা আশপাশেই দেখতে পাচ্ছি।

ব্যক্তিগত পরিণতি : ক্লান্তি ও আবেগের সংকোচন গান শোনা এক সময় ধ্যানের মতো ছিল। এখন একটার পর একটা শর্টস দেখতে দেখতে শ্রোতা পরিণত হয় শ্রান্ত দর্শকে। এর ফলেÑ মনোযোগ কমে যায়, স্নায়বিক চাপ বাড়ে, আবেগের গভীরতা হারায়। শরীর ক্লান্ত না হলেও, মস্তিষ্ক হয়ে পড়ে অবসন্ন। শিল্পীর কণ্ঠ ও গানের গভীরতা ঢেকে যায় ক্যামেরা আর এডিটিংয়ের চাকচিক্যে।

সৃজনশীলতার সংকট : গান নয়, কনটেন্ট এক সময় গান ছিল শিল্প। এখন তা কনটেন্ট। গানের বিষয় নির্ধারিত হয় প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম মাথায় রেখেÑ‘ব্রেকআপ’, ‘রোমান্স’, ‘ট্রেন্ডিং’। ভাইরাল হবে কি না, সেটাই এখন মুখ্য। ফলত সত্যিকারের শিল্পীরা হারিয়ে যাচ্ছেন। যারা ভালো গান করেন, কিন্তু ভিজ্যুয়াল উপস্থাপন দিতে পারেন নাÑ তারা আজ অবহেলিত। এই ফাঁকে হিরো আলমদের উত্থান ঘটে।

শ্রবণচর্চার অবসান : স্মৃতিহীন প্রজন্ম? এক সময় বলা হতো ‘অন্তরে গান বাজে’। আজ তা যেন শুধুই বাক্য। গান এখন হয়ে গেছে চটুল, ক্ষণস্থায়ী, স্মৃতিবর্জিত। আগামীর প্রজন্ম হয়তো বলবে না, ‘ওই গানটা শুনে প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম।’ বরং বলবে, ‘ওই রিলটা ভাইরাল হয়েছিল।’

উদ্বেগ : শ্রোতা সংস্কৃতির বিলুপ্তি শ্রোতা হারালে শিল্পীও হারিয়ে যায়। শ্রোতা তৈরি হয় পরিবারে, পাঠশালায়, সাংস্কৃতিক চর্চায়। আজ সেটা বিলীনপ্রায়। এর ফলে আমরা হারাচ্ছি- কবিতার গানের ঐতিহ্য, লোকগানের প্রাণ, আধ্যাত্মিক গানের গভীরতা, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, আধুনিক বাংলা গান, বাউল- মরমীÑসবই কোণঠাসা; পথ আছে, যদি ইচ্ছা থাকে আমরা কি পারি না আবার শ্রোতা হতে? পারি নিশ্চয়ই, যদি আমরা অডিও সংস্কৃতি চর্চা করি- রেডিও শুনি, স্পিকার চালিয়ে গান শুনি।

মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ অভ্যাস গড়ে তুলি- কথার মানে বুঝি, সুর অনুধাবন করি। ভালো শিল্পীদের উৎসাহ দিই- যারা ভিডিও নয়, গানকেই ভালোবাসেন। শিশুদের গান শোনার শিক্ষা দিই- শুধু গান নয়, গান শোনার রীতিও শেখাই।

গান শোনা কেন বিজ্ঞানসম্মতভাবে উপকারী? ডোপামিন নিঃসরণ : প্রিয় গান শুনলে মস্তিষ্কে আনন্দের হরমোন ডোপামিন নিঃসরণ হয়, যা প্রশান্তি আনে। স্ট্রেস কমায় : ধীরগতির গান করটিসল কমায়Ñসেজন্য সংগীত থেরাপিতে শুধু অডিও ব্যবহার হয়।

মনোযোগ বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি উন্নত করে: আলঝেইমার রোগীদের ক্ষেত্রেও সংগীত থেরাপি কার্যকর।

গান দেখা কি ক্ষতিকর? না, ভালো ভিডিও প্রশান্তিও দিতে পারে। কিন্তু বারবার স্ক্রিন দেখা : চোখ ও মস্তিষ্কে ক্লান্তি আনে, মনোযোগ সরিয়ে নেয় সুর থেকে দৃশ্যে, উত্তেজনা বা বিভ্রান্তি বাড়ায়, বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, শ্রবণসংগীতই প্রকৃত ‘সঙ্গীতচিকিৎসা’। গান যদি হৃদয় ছোঁয়, তবে তা হয় শান্তির ওষুধ।

উপসংহার প্রযুক্তি দরকার, ভিজ্যুয়াল দরকারÑতবে গানকে যদি কেবল চোখের বিনোদনে সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে তা সাংস্কৃতিক আত্মঘাতের শামিল। গান যদি মন না ছোঁয়, কানে না বাজে, হৃদয় না দুলায়Ñতবে তা গান নয়, নিছক ডিজিটাল ক্লিপ। এই রোবোটিক যুগে দরকার কিছু আবেগের আশ্রয়। গান হতে পারে সেই আশ্রয়Ñযদি আমরা তাকে শোনার অধিকার দিই। তাই আসুন, আবার শুনি। দেখি নয়Ñশুনি।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

tab

opinion » post-editorial

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

গাজী তারেক আজিজ

বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫

একসময় গান ছিল কানে শোনার বিষয়। চোখ বন্ধ করে রেডিও শোনা হতো, মনে মনে ছবি আঁকা চলতÑ গানের কথায় ভেসে যেত মানুষ স্মৃতির স্রোতে। তখন ছিল ক্যাসেট প্লেয়ার, রেডিও, ডেকসেট কিংবা কম্প্যাক্ট ডিস্কের যুগ। এরপর এলো এমপ্লিফায়ার, এমপিথ্রি প্লেয়ার, এফএম রেডিও, আর ডাউনলোড করে গান শোনার অভ্যাস। শব্দ, সুর আর আবেগের একত্র সহাবস্থান ছিল তখন।

আজ সে বাস্তবতা অনেকটাই বদলে গেছে। এখন গান ‘শোনা’ নয়, ‘দেখা’ হয়। ইউটিউব, ফেসবুক, রিলস, টিকটকের স্ক্রিনে গানের স্থান। শ্রবণের অভিজ্ঞতা রূপ নিয়েছে দৃষ্টির আনন্দে।

এই পরিবর্তন শুধু প্রযুক্তির কারণে নয়; এটি এক সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর। গান এখন আর নিছক সুর বা কথার বিষয় নয়Ñ এটি এখন এক ভিজ্যুয়াল প্যাকেজ, যার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে দৃশ্য, পোশাক, লোকেশন ও শরীরী ভাষা। প্রশ্ন হচ্ছে, এই রূপান্তর আমাদের ব্যক্তি জীবন, সংস্কৃতি ও সমাজকে কিভাবে প্রভাবিত করছে? এবং এর পরিণতি কী হতে পারে?

শ্রোতা থেকে দর্শক : মননের পরিবর্তন গান শোনার মাধ্যম বদলেছে। রেডিওর জায়গা নিয়েছে স্মার্টফোন, ক্যাসেটের জায়গায় এসেছে স্ট্রিমিং অ্যাপ; কিন্তু শুধু মাধ্যম নয়, বদলে গেছে গানের আত্মাও।

মানুষ এখন পুরো গান শোনে না, ৩০ সেকেন্ডের ক্লিপ দেখে। গানের আবেদন সুর-শব্দে নয়, বরং ভিডিওর ঝলমলে রূপে। যার পোশাক আকর্ষণীয়, ভিডিওতে বিদেশি লোকেশন ও আকর্ষণীয় নাচ আছে, সেই-ই আজকের ‘ভিউসের রাজা’।

এই ভিউস নির্ভরতা শ্রোতাকে পরিণত করছে দর্শকে। মনোযোগের জায়গা দখল করছে চোখ। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে সেই মনোসংযোগ, যা গান শোনার মৌলিক শর্ত। আগে গান শোনা হতো বিবিধ ভারতী, বিটিভির ‘ছায়াছন্দ’ বা ‘ইত্যাদির’ মাধ্যমে। এখন ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম রিলস, টিকটকÑসবই ভিউসের যুদ্ধক্ষেত্র।

গান ‘হিট’ হয় যদি ভিডিও ভাইরাল হয়। শিল্পীর কণ্ঠ, গানের কথা, সুরÑ এসব প্রেক্ষাপটে পড়ে থাকে। ভিডিওতে চটক, শরীরী উপস্থাপন, লোকেশন ও ক্যামেরার কারসাজি মূল বিবেচ্য হয়। এই জনপ্রিয়তা বেশিরভাগ সময়ই হয় ক্ষণস্থায়ীÑদীর্ঘস্থায়ী শ্রবণের অভিজ্ঞতা নয়।

প্রযুক্তির উৎকর্ষ না বাজারের অপব্যবহার? অবশ্যই প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। ইউটিউব, স্পটিফাই, অ্যামাজন মিউজিকÑ সবই আমাদের গানকে কাছে এনে দিয়েছে; কিন্তু যখন সেই প্রযুক্তি কেবল মনোযোগ ছিনিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত হয়, তখন তা সাংস্কৃতিক ক্ষতির কারণ হয়।

একসময় গান ছিল অনুভবের বিষয়। এখন তা প্রদর্শনের উপাদান। গানের চেয়ে ভিডিওতে বেশি বাজেট বরাদ্দ হয়। কণ্ঠশিল্পীর গায়কির চেয়ে মডেলের শরীর গুরুত্ব পায়। অথচ একটা সময় ছিল, গান তৈরি হতো কথা ও সুরকে ঘিরে। এখন আগে লেখা হয় ভিডিওর স্ক্রিপ্ট, পরে হয় গান। শিল্পী বাছাইয়ে মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায় ‘কে দেখতে ভালো লাগবে’। ফলে অনেক ভালো শিল্পী গান প্রকাশ করতে পারছেন না, শুধুমাত্র ভিডিও না থাকার কারণে।

গান ছিল আবেগের একান্ত জায়গা। কেউ ভালোবাসায় আঘাত পেলে গান শুনত, কেউ আনন্দে গান ধরত। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে ‘সেলিব্রিটির কেমন পোশাক ছিল’ বা ‘কে কিভাবে নাচল’ সেই আলোচনা।

সামাজিক প্রভাব : পরিবারের ভিত নড়ছে একসঙ্গে বসে গান শোনার যে পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল, তা আজ হারিয়ে গেছে। এখন গান মানেই একাকী স্ক্রিনের সামনে সময় কাটানো। শিশুরা গান শুনে শেখে না, দেখে শেখেÑযেখানে থাকে ফ্যাশন, গ্ল্যামার এবং কখনো অশালীন অঙ্গভঙ্গি। এই ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতি তাদের ভাষা, রুচি ও মানসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত স্ক্রিননির্ভর গান গ্রহণ করলে শিশু-কিশোরদের মনোযোগ কমে, ভাষা বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে। বাংলাদেশেও এর প্রতিফলন আমরা আশপাশেই দেখতে পাচ্ছি।

ব্যক্তিগত পরিণতি : ক্লান্তি ও আবেগের সংকোচন গান শোনা এক সময় ধ্যানের মতো ছিল। এখন একটার পর একটা শর্টস দেখতে দেখতে শ্রোতা পরিণত হয় শ্রান্ত দর্শকে। এর ফলেÑ মনোযোগ কমে যায়, স্নায়বিক চাপ বাড়ে, আবেগের গভীরতা হারায়। শরীর ক্লান্ত না হলেও, মস্তিষ্ক হয়ে পড়ে অবসন্ন। শিল্পীর কণ্ঠ ও গানের গভীরতা ঢেকে যায় ক্যামেরা আর এডিটিংয়ের চাকচিক্যে।

সৃজনশীলতার সংকট : গান নয়, কনটেন্ট এক সময় গান ছিল শিল্প। এখন তা কনটেন্ট। গানের বিষয় নির্ধারিত হয় প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম মাথায় রেখেÑ‘ব্রেকআপ’, ‘রোমান্স’, ‘ট্রেন্ডিং’। ভাইরাল হবে কি না, সেটাই এখন মুখ্য। ফলত সত্যিকারের শিল্পীরা হারিয়ে যাচ্ছেন। যারা ভালো গান করেন, কিন্তু ভিজ্যুয়াল উপস্থাপন দিতে পারেন নাÑ তারা আজ অবহেলিত। এই ফাঁকে হিরো আলমদের উত্থান ঘটে।

শ্রবণচর্চার অবসান : স্মৃতিহীন প্রজন্ম? এক সময় বলা হতো ‘অন্তরে গান বাজে’। আজ তা যেন শুধুই বাক্য। গান এখন হয়ে গেছে চটুল, ক্ষণস্থায়ী, স্মৃতিবর্জিত। আগামীর প্রজন্ম হয়তো বলবে না, ‘ওই গানটা শুনে প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম।’ বরং বলবে, ‘ওই রিলটা ভাইরাল হয়েছিল।’

উদ্বেগ : শ্রোতা সংস্কৃতির বিলুপ্তি শ্রোতা হারালে শিল্পীও হারিয়ে যায়। শ্রোতা তৈরি হয় পরিবারে, পাঠশালায়, সাংস্কৃতিক চর্চায়। আজ সেটা বিলীনপ্রায়। এর ফলে আমরা হারাচ্ছি- কবিতার গানের ঐতিহ্য, লোকগানের প্রাণ, আধ্যাত্মিক গানের গভীরতা, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, আধুনিক বাংলা গান, বাউল- মরমীÑসবই কোণঠাসা; পথ আছে, যদি ইচ্ছা থাকে আমরা কি পারি না আবার শ্রোতা হতে? পারি নিশ্চয়ই, যদি আমরা অডিও সংস্কৃতি চর্চা করি- রেডিও শুনি, স্পিকার চালিয়ে গান শুনি।

মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ অভ্যাস গড়ে তুলি- কথার মানে বুঝি, সুর অনুধাবন করি। ভালো শিল্পীদের উৎসাহ দিই- যারা ভিডিও নয়, গানকেই ভালোবাসেন। শিশুদের গান শোনার শিক্ষা দিই- শুধু গান নয়, গান শোনার রীতিও শেখাই।

গান শোনা কেন বিজ্ঞানসম্মতভাবে উপকারী? ডোপামিন নিঃসরণ : প্রিয় গান শুনলে মস্তিষ্কে আনন্দের হরমোন ডোপামিন নিঃসরণ হয়, যা প্রশান্তি আনে। স্ট্রেস কমায় : ধীরগতির গান করটিসল কমায়Ñসেজন্য সংগীত থেরাপিতে শুধু অডিও ব্যবহার হয়।

মনোযোগ বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি উন্নত করে: আলঝেইমার রোগীদের ক্ষেত্রেও সংগীত থেরাপি কার্যকর।

গান দেখা কি ক্ষতিকর? না, ভালো ভিডিও প্রশান্তিও দিতে পারে। কিন্তু বারবার স্ক্রিন দেখা : চোখ ও মস্তিষ্কে ক্লান্তি আনে, মনোযোগ সরিয়ে নেয় সুর থেকে দৃশ্যে, উত্তেজনা বা বিভ্রান্তি বাড়ায়, বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, শ্রবণসংগীতই প্রকৃত ‘সঙ্গীতচিকিৎসা’। গান যদি হৃদয় ছোঁয়, তবে তা হয় শান্তির ওষুধ।

উপসংহার প্রযুক্তি দরকার, ভিজ্যুয়াল দরকারÑতবে গানকে যদি কেবল চোখের বিনোদনে সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে তা সাংস্কৃতিক আত্মঘাতের শামিল। গান যদি মন না ছোঁয়, কানে না বাজে, হৃদয় না দুলায়Ñতবে তা গান নয়, নিছক ডিজিটাল ক্লিপ। এই রোবোটিক যুগে দরকার কিছু আবেগের আশ্রয়। গান হতে পারে সেই আশ্রয়Ñযদি আমরা তাকে শোনার অধিকার দিই। তাই আসুন, আবার শুনি। দেখি নয়Ñশুনি।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top