এম এ হোসাইন
একটি সাহসী ও নিখুঁত যুদ্ধকৌশলের প্রদর্শনী হিসেবে ইসরায়েল সম্প্রতি ইরানে একটি আগাম সামরিক অভিযান চালিয়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন।’ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে এবং ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফেনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই বিমান অভিযানের লক্ষ্য ছিল মূলত ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করা এবং তেহরান-সমর্থিত আঞ্চলিক ছায়া শক্তিগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিরোধ করা। এই সামরিক অভিযানের প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং তা বৈশ্বিক নিরাপত্তা, কূটনীতি ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির ওপর এক গভীর আঘাত হেনেছে।
অপারেশন রাইজিং লায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্য : ইরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে না পারে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানা যায়, ইরান ইতোমধ্যেই প্রায় নয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরির মতো ইউরেনিয়াম সংরক্ষণ করেছে এবং তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি দ্রুত উন্নয়ন করছে। এতে তেলআবিবে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে তেহরান পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির এক বিপজ্জনক সংমিশ্রণ অর্জনের দ্বারপ্রান্তে।
এই আশঙ্কার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুথিদের মতো ছায়া শক্তিগুলোর জন্য ইরানের সক্রিয় সামরিক ও আর্থিক সহায়তা। এই সমন্বিত হুমকি মূল্যায়ন করে ইসরায়েল সিদ্ধান্তে আসে যে, চুপ করে বসে থাকার ঝুঁকি নেয়া তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। ফলে, ইসরায়েল তাদের বহুল পরিচিত ‘কৌশলগত আগাম হামলা’ নীতির আশ্রয় নেয়, যার মূল দর্শন হলো, অস্তিত্ব সংকট তৈরি হওয়ার আগেই তা নির্মূল করে ফেলা। এই অভিযান যে শুধু আগ্রাসী ছিল তা নয়, বরং এতে সুপরিকল্পনা, উন্নতমানের গোয়েন্দা তথ্য এবং সর্বাধুনিক সামরিক প্রযুক্তির সমন্বয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ ইসরায়েলের বিমান অভিযানের যে নিখুঁত ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা বহুদিনের পরিচিত, তা আবারও প্রমাণ করেছে। আনুমানিক ৩০ থেকে ৬০টি যুদ্ধবিমান এই অভিযানে অংশ নেয়Ñএর মধ্যে ছিল এফ-৩৫আই আদির স্টেলথ ফাইটার, এফ-১৫আই রা’আম বোমারু বিমান এবং গালফস্ট্রিম সার সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফর্ম। অভিযানের সময় ইলেকট্রনিক ও সাইবার যুদ্ধ ইউনিটগুলো ইরানের রাডার ব্যবস্থা জ্যাম করে দেয় এবং প্রাথমিক সতর্কতা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে ফেলে। ভোরবেলার অভিযানটি ছিল একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত যা রাত ও দিনের সংযোগ সময় ব্যবহার করে ইরানি বাহিনীর সাড়া ও শনাক্তকরণ ক্ষমতা দুর্বল করে ফেলে।
প্রধান পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে নাতাঞ্জ, খন্দাব ও খোরামাবাদে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে নাতাঞ্জ কেন্দ্রটি টানা বোমাবর্ষণ ও আগুনের কারণে পুরোপুরি কার্যক্রমহীন হয়ে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে জানা গেছে। তেহরান সংলগ্ন অঞ্চলে অবস্থিত ক্ষেপণাস্ত্র গুদাম ও বিমানঘাঁটিসহ অন্যান্য সামরিক স্থাপনাও হামলার লক্ষ্য হয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের কমান্ডার হোসেইন সালামি ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী ফেরেইদুন আব্বাসি দাভানি-সহ একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
অভিযানটি যত বিস্তৃতই হোক না কেন, বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ছিল নগণ্য। এটি সম্ভব হয়েছে অত্যন্ত নিখুঁত লক্ষ্যভিত্তিক আঘাত এবং সুনিপুণ গোয়েন্দা তথ্যের কারণে, যা ইসরায়েলের বিমানবাহিনীকে শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সুযোগ করে দেয়।
ইসরায়েলের এই দুর্বার অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়া ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুতর দুর্বলতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। যেসব বাবর-৩৭৩ ও এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ইরান বরাবরই অত্যন্ত আধুনিক ও কার্যকর বলে প্রচার করেছে, সেগুলো স্টেলথ ফাইটার শনাক্ত তো করতেই পারেনি, বাধাও দিতে পারেনি। ইলেকট্রনিক জ্যামিং ও সাইবার আক্রমণের কারণে ইরানের আর্লি ওয়ার্নিং রাডার কার্যত অন্ধ হয়ে পড়ে।
এই ব্যর্থতার পেছনে আরেকটি বড় কারণ ছিল গোয়েন্দা বিভাগে চরম ভ্রান্তি। ইরান এ ধরনের হামলার পূর্বাভাস পাওয়ার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, যা তাদের সাধারণত কঠোর পাল্টা গোয়েন্দা নজরদারি ক্ষমতার প্রেক্ষাপটে বিস্ময়কর। এটি এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন ইরান প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে এক সপ্তাহের মধ্যে হামলার হুমকি দিচ্ছিল। এই অতি আত্মবিশ্বাস এবং অতিরঞ্জিত বাকযুদ্ধ এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ফলে ইরান বাধ্য হতে পারে তাদের সামরিক নীতিমালা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে মৌলিক পুনর্মূল্যায়নে।
‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’র পর আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিক্রিয়া ছিল বিচ্ছিন্ন, সংযত এবং কৌশলগতভাবে পরিমিত। যুক্তরাষ্ট্র, যাকে অভিযানের আগে অবহিত করা হয়েছিল, অনানুষ্ঠানিকভাবে এর অনুমোদন দিয়েছে বলে খবর মিলেছে, যদিও তারা সরাসরি সম্পৃক্ততা থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে। ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে ফ্রান্স ও জার্মানি উদ্বেগ প্রকাশ করে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে, তবে তারা ইসরায়েলের ওপর সরাসরি নিন্দা জানাতে বিরত থেকেছে।
ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া কঠোর আপত্তি জানিয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, তারা তেহরানের কাছে আরও বেশি অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাবে। চীন বরাবরের মতো ‘সংযমের’ আহ্বান জানিয়েছে, আর ভারত কৌশলগত নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেÑইরানের সঙ্গে জ্বালানি নির্ভরতা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বের ভারসাম্য রক্ষা করতে।
অন্যদিকে সৌদি আরব, তুরস্ক ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো হয় নীরব থেকেছে, নয়তো আনুষ্ঠানিক ও দুর্বল প্রতিবাদ জানিয়েছে, কোনো সামরিক বা কূটনৈতিক পদক্ষেপের ইঙ্গিত ছাড়াই। মধ্যপ্রাচ্যের বদলে যাওয়া মিত্রতা ও অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ইরানকে একাকী করে ফেলেছে, যদিও তারা দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই হামলার পরপরই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এটিকে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে অভিহিত করেন এবং এর জন্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রÑউভয়কেই দায়ী করেন। পাল্টা জবাব হিসেবে ইরান প্রায় ১০০টি ড্রোন ইসরায়েলের দিকে ছুড়ে দেয় বলে জানা গেছে। তবে ইসরায়েলের বহুস্তরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাÑবিশেষ করে আয়রন ডোম ও অ্যারো সিস্টেমের কারণে এ হামলার প্রভাব সীমিত ছিল।
একই সময়ে, ইরান তৃতীয় একটি পারমাণবিক কেন্দ্রে দ্রুত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে এবং অস্ত্র উৎপাদনও বাড়ানোর কথা বলেছে। আঞ্চলিক যুদ্ধের পরোক্ষ বিস্তারের আশঙ্কা প্রবল। হিজবুল্লাহসহ ইরানপন্থি গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে অসম যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েলের ওপর পাল্টা চাপ সৃষ্টি করতে পারে তেহরান।
জাতিসংঘে জরুরি অধিবেশন আহ্বানের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার কারণে কার্যকর কোনো প্রস্তাব পাস হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। সামনের কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলের আরও নতুন অভিযান, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে সহিংসতার নতুন ঢেউ এবং অর্থনৈতিক অভিঘাত বিশেষ করে জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে তেলের দামে বড় ধরনের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে জ্বালানি-নির্ভর অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
অপারেশন রাইজিং লায়ন মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত সমীকরণ বদলে দিয়েছে। কিন্তু সরাসরি সংঘর্ষের বাইরে, এটি আধুনিক সামরিক নীতিমালা, গোয়েন্দাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে সফল অভিযান এবং ভূরাজনৈতিক চালচিত্রের একটি পাঠ্যপুস্তকের উদাহরণ হয়ে থাকবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছেÑএই উত্তেজনার নিরসনে আন্তর্জাতিক সমাজের অবিলম্বে হস্তক্ষেপ জরুরি। নয়তো এই সংঘাত আরও বিস্তৃত হয়ে বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ইসরায়েল আজ এক ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ হয়ে উঠেছেÑযার নির্বোধ আচরণে পুরো অঞ্চল অনিশ্চয়তার মুখে। একে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বিশ্ব তাকিয়ে আছে। কোন সামরিক শক্তি নয় শুধু কূটনীতিই এখন একমাত্র টেকসই পথ যা একটি ধ্বংসাত্মক আঞ্চলিক যুদ্ধকে ঠেকাতে পারে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ]
এম এ হোসাইন
সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫
একটি সাহসী ও নিখুঁত যুদ্ধকৌশলের প্রদর্শনী হিসেবে ইসরায়েল সম্প্রতি ইরানে একটি আগাম সামরিক অভিযান চালিয়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন।’ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে এবং ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফেনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই বিমান অভিযানের লক্ষ্য ছিল মূলত ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করা এবং তেহরান-সমর্থিত আঞ্চলিক ছায়া শক্তিগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিরোধ করা। এই সামরিক অভিযানের প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং তা বৈশ্বিক নিরাপত্তা, কূটনীতি ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির ওপর এক গভীর আঘাত হেনেছে।
অপারেশন রাইজিং লায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্য : ইরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে না পারে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানা যায়, ইরান ইতোমধ্যেই প্রায় নয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরির মতো ইউরেনিয়াম সংরক্ষণ করেছে এবং তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি দ্রুত উন্নয়ন করছে। এতে তেলআবিবে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে তেহরান পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির এক বিপজ্জনক সংমিশ্রণ অর্জনের দ্বারপ্রান্তে।
এই আশঙ্কার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুথিদের মতো ছায়া শক্তিগুলোর জন্য ইরানের সক্রিয় সামরিক ও আর্থিক সহায়তা। এই সমন্বিত হুমকি মূল্যায়ন করে ইসরায়েল সিদ্ধান্তে আসে যে, চুপ করে বসে থাকার ঝুঁকি নেয়া তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। ফলে, ইসরায়েল তাদের বহুল পরিচিত ‘কৌশলগত আগাম হামলা’ নীতির আশ্রয় নেয়, যার মূল দর্শন হলো, অস্তিত্ব সংকট তৈরি হওয়ার আগেই তা নির্মূল করে ফেলা। এই অভিযান যে শুধু আগ্রাসী ছিল তা নয়, বরং এতে সুপরিকল্পনা, উন্নতমানের গোয়েন্দা তথ্য এবং সর্বাধুনিক সামরিক প্রযুক্তির সমন্বয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ ইসরায়েলের বিমান অভিযানের যে নিখুঁত ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা বহুদিনের পরিচিত, তা আবারও প্রমাণ করেছে। আনুমানিক ৩০ থেকে ৬০টি যুদ্ধবিমান এই অভিযানে অংশ নেয়Ñএর মধ্যে ছিল এফ-৩৫আই আদির স্টেলথ ফাইটার, এফ-১৫আই রা’আম বোমারু বিমান এবং গালফস্ট্রিম সার সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফর্ম। অভিযানের সময় ইলেকট্রনিক ও সাইবার যুদ্ধ ইউনিটগুলো ইরানের রাডার ব্যবস্থা জ্যাম করে দেয় এবং প্রাথমিক সতর্কতা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে ফেলে। ভোরবেলার অভিযানটি ছিল একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত যা রাত ও দিনের সংযোগ সময় ব্যবহার করে ইরানি বাহিনীর সাড়া ও শনাক্তকরণ ক্ষমতা দুর্বল করে ফেলে।
প্রধান পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে নাতাঞ্জ, খন্দাব ও খোরামাবাদে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে নাতাঞ্জ কেন্দ্রটি টানা বোমাবর্ষণ ও আগুনের কারণে পুরোপুরি কার্যক্রমহীন হয়ে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে জানা গেছে। তেহরান সংলগ্ন অঞ্চলে অবস্থিত ক্ষেপণাস্ত্র গুদাম ও বিমানঘাঁটিসহ অন্যান্য সামরিক স্থাপনাও হামলার লক্ষ্য হয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের কমান্ডার হোসেইন সালামি ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী ফেরেইদুন আব্বাসি দাভানি-সহ একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
অভিযানটি যত বিস্তৃতই হোক না কেন, বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ছিল নগণ্য। এটি সম্ভব হয়েছে অত্যন্ত নিখুঁত লক্ষ্যভিত্তিক আঘাত এবং সুনিপুণ গোয়েন্দা তথ্যের কারণে, যা ইসরায়েলের বিমানবাহিনীকে শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সুযোগ করে দেয়।
ইসরায়েলের এই দুর্বার অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়া ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুতর দুর্বলতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। যেসব বাবর-৩৭৩ ও এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ইরান বরাবরই অত্যন্ত আধুনিক ও কার্যকর বলে প্রচার করেছে, সেগুলো স্টেলথ ফাইটার শনাক্ত তো করতেই পারেনি, বাধাও দিতে পারেনি। ইলেকট্রনিক জ্যামিং ও সাইবার আক্রমণের কারণে ইরানের আর্লি ওয়ার্নিং রাডার কার্যত অন্ধ হয়ে পড়ে।
এই ব্যর্থতার পেছনে আরেকটি বড় কারণ ছিল গোয়েন্দা বিভাগে চরম ভ্রান্তি। ইরান এ ধরনের হামলার পূর্বাভাস পাওয়ার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, যা তাদের সাধারণত কঠোর পাল্টা গোয়েন্দা নজরদারি ক্ষমতার প্রেক্ষাপটে বিস্ময়কর। এটি এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন ইরান প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে এক সপ্তাহের মধ্যে হামলার হুমকি দিচ্ছিল। এই অতি আত্মবিশ্বাস এবং অতিরঞ্জিত বাকযুদ্ধ এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ফলে ইরান বাধ্য হতে পারে তাদের সামরিক নীতিমালা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে মৌলিক পুনর্মূল্যায়নে।
‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’র পর আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিক্রিয়া ছিল বিচ্ছিন্ন, সংযত এবং কৌশলগতভাবে পরিমিত। যুক্তরাষ্ট্র, যাকে অভিযানের আগে অবহিত করা হয়েছিল, অনানুষ্ঠানিকভাবে এর অনুমোদন দিয়েছে বলে খবর মিলেছে, যদিও তারা সরাসরি সম্পৃক্ততা থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে। ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে ফ্রান্স ও জার্মানি উদ্বেগ প্রকাশ করে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে, তবে তারা ইসরায়েলের ওপর সরাসরি নিন্দা জানাতে বিরত থেকেছে।
ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া কঠোর আপত্তি জানিয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, তারা তেহরানের কাছে আরও বেশি অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাবে। চীন বরাবরের মতো ‘সংযমের’ আহ্বান জানিয়েছে, আর ভারত কৌশলগত নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেÑইরানের সঙ্গে জ্বালানি নির্ভরতা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বের ভারসাম্য রক্ষা করতে।
অন্যদিকে সৌদি আরব, তুরস্ক ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো হয় নীরব থেকেছে, নয়তো আনুষ্ঠানিক ও দুর্বল প্রতিবাদ জানিয়েছে, কোনো সামরিক বা কূটনৈতিক পদক্ষেপের ইঙ্গিত ছাড়াই। মধ্যপ্রাচ্যের বদলে যাওয়া মিত্রতা ও অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ইরানকে একাকী করে ফেলেছে, যদিও তারা দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই হামলার পরপরই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এটিকে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে অভিহিত করেন এবং এর জন্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রÑউভয়কেই দায়ী করেন। পাল্টা জবাব হিসেবে ইরান প্রায় ১০০টি ড্রোন ইসরায়েলের দিকে ছুড়ে দেয় বলে জানা গেছে। তবে ইসরায়েলের বহুস্তরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাÑবিশেষ করে আয়রন ডোম ও অ্যারো সিস্টেমের কারণে এ হামলার প্রভাব সীমিত ছিল।
একই সময়ে, ইরান তৃতীয় একটি পারমাণবিক কেন্দ্রে দ্রুত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে এবং অস্ত্র উৎপাদনও বাড়ানোর কথা বলেছে। আঞ্চলিক যুদ্ধের পরোক্ষ বিস্তারের আশঙ্কা প্রবল। হিজবুল্লাহসহ ইরানপন্থি গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে অসম যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েলের ওপর পাল্টা চাপ সৃষ্টি করতে পারে তেহরান।
জাতিসংঘে জরুরি অধিবেশন আহ্বানের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার কারণে কার্যকর কোনো প্রস্তাব পাস হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। সামনের কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলের আরও নতুন অভিযান, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে সহিংসতার নতুন ঢেউ এবং অর্থনৈতিক অভিঘাত বিশেষ করে জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে তেলের দামে বড় ধরনের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে জ্বালানি-নির্ভর অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
অপারেশন রাইজিং লায়ন মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত সমীকরণ বদলে দিয়েছে। কিন্তু সরাসরি সংঘর্ষের বাইরে, এটি আধুনিক সামরিক নীতিমালা, গোয়েন্দাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে সফল অভিযান এবং ভূরাজনৈতিক চালচিত্রের একটি পাঠ্যপুস্তকের উদাহরণ হয়ে থাকবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছেÑএই উত্তেজনার নিরসনে আন্তর্জাতিক সমাজের অবিলম্বে হস্তক্ষেপ জরুরি। নয়তো এই সংঘাত আরও বিস্তৃত হয়ে বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ইসরায়েল আজ এক ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ হয়ে উঠেছেÑযার নির্বোধ আচরণে পুরো অঞ্চল অনিশ্চয়তার মুখে। একে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বিশ্ব তাকিয়ে আছে। কোন সামরিক শক্তি নয় শুধু কূটনীতিই এখন একমাত্র টেকসই পথ যা একটি ধ্বংসাত্মক আঞ্চলিক যুদ্ধকে ঠেকাতে পারে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ]