আনোয়ারুল হক
জুলাই আন্দোলনের একজন অকুতোভয় ছাত্রনেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্র কোটা থেকে উপদেষ্টা হয়েছেন। ১৬ মাস যাবত যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং একই সাথে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সামাল দিচ্ছেন। একদিকে জুলাই আন্দোলনে রাজপথের ও তারপরে ১৬ মাস মন্ত্রণালয় পরিচালনার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তিনি। তবে শুধুমাত্র নিজ মন্ত্রণালয়ই নয় গোটা দেশ নিয়ে তার ভাবনা কাজ করে। আর তারাই যেহেতু কথিত ‘নিয়োগকর্তা’ তাই ছাত্র উপদেষ্টাদের বিচরণ নিজ নিজ মন্ত্রনালয়ের বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। যেমন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ জানিয়েছে শেখ হাসিনার মামলার বিচারের রায় কবে হবে তা জানানো হবে ১৩ নভেম্বর। আর উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ৪ নভেম্বরেই জানিয়ে দিলেন আগামী সপ্তাহে ‘ফ্যাসিস্ট খুনি শেখ হাসিনার’ বিচারের রায় পাবো। তবু ভালো কী রায় পাবো আগাম জানিয়ে দেননি!
দেশ নিয়ে ভাবনার অংশ হিসেবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের পরিকল্পনামত ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপি কেন্দ্রে ১৮-৩৫ বছর বয়সী ৮ হাজার ২৫০ জন তরুণ ও ৬শ’ তরুণীকে পনেরো দিনের আবাসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদেরকে আত্মরক্ষামূলক নানা কলাকৌশল ও আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এ বাবদ তাদেরকে চার হাজার ২০০ টাকা ভাতা এবং থাকা, খাওয়া ও পোশাক দেওয়া হবে। চলতি মাস থেকে এ কর্মসূচি শুরু হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এধরনের ট্রেনিং দেওয়া কি একটা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের মধ্যে পড়ে? এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, একটা মন্ত্রণালয়ের ধারণা থেকে এটা আসছে; কাজেই কোনো জাতীয় নীতিমালা আছে বলে আমি মনে করছি না। এ ধরনের কার্যক্রম জাতীয় নীতিমালা ছাড়া করা যায় না। কারণ এর সঙ্গে স্পর্শকাতর জিনিসপত্র জড়িত থাকে, জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত থাকে।’ এ কর্মসূচি নিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা নতুন এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন।
শুরু থেকেই ছাত্র উপদেষ্টাদের মধ্যে সবাইকে টেক্কা দিয়ে নিজ গুনে এগিয়ে আছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। বিতর্ক তার পিছু ছাড়ছে না। উপদেষ্টা হিসেবে তৎপরতা শুরুই করলেন জাতিকে এক ‘হেলিকপ্টার বিলাস কাহিনী’ উপহার দিয়ে।তারপরে নিজ এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে শুরু হলো বিতর্ক। স্থানীয় ঠিকাদারি কাজে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে তার পিতা যিনি স্থানীয় একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক Ñ তিনি ‘মেসার্স ইসরাত এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স করেন। এলইজিডি উপদেষ্টার পিতার নামে এলইজিডি-র সরবরাহকৃত লাইসেন্স নিয়ে সমালোচনার মুখে আসিফ মাহমুদ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট দিয়ে ক্ষমা চান এবং তার বাবাও লাইসেন্স প্রত্যাহার করে নেন।
এলাকায় নির্বাচনী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় শুরু থেকেই তার অনুসারীরা বিএনপির সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। পত্রপত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া ও বিতর্কের মুখে এবং নবগঠিত নাগরিক পার্টির সাথে তার সংশ্লিষ্টতা থাকায় অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং আসিফ মাহমুদের পদত্যাগের দাবি ওঠে। কিন্তু তার সাফ কথা তিনি নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা হলে পদত্যাগ করবেন, তার আগে নয়। নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তার নিজ জেলা কুমিল্লার সড়ক ও অন্যান্য গ্রামীণ অবকাঠামো মেরামত ও উন্নয়নে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে আসিফ মাহমুদের নিজ উপজেলা মুরাদনগরে ৪৫৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর উপজেলা দেবীদ্বারে ৩৩৮ কোটি টাকা।বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের এক সময়ের সমন্বয়করা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং দেশের পিছিয়ে থাকা উপজেলাগুলিকে এ ধরনের বরাদ্দে পিছিয়ে রেখে বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার লড়াইয়ে নেমেছেন। উপদেষ্টা বরাদ্দ দিচ্ছেন সরকারের টাকা আর এলাকায় প্রচার করার ব্যবস্থা হয়েছে তার নামে। বিভিন্ন রাস্তাঘাট বা স্থাপনা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপদেষ্টার চাচাতো ভাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুরাদনগর উপজেলার আহ্বায়ক উবায়দুল সিদ্দিকীকে এ কাজে রাখা হয়েছে। অবশ্য ‘মুরাদনগরের মাটি, আসিফের ঘাঁটি’ - এই স্লোগান দিয়ে তার অনুসারীরা নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেও শেষ খবর অনুযায়ী এখন তিনি ঢাকার কোনো একটি আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী।
ইতোমধ্যে ধানম-ি এলাকা থেকে ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। তার একদিন আগে তিনি বলেছিলেন নির্বাচন করতে হলে ১০-২০ কোটি টাকা লাগে। তাই ভাবতে হচ্ছে। একদিনেই ভাবনার অবসান। তিনি ঢাকা থেকেই নির্বাচন করবেন। তবে এই মুহুর্তে উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করছেন না। সরকারে উপদেষ্টা বিশেষত স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে থেকে সবকিছু নিজের মত গুছিয়ে নিয়ে তারপরে তিনি ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন!
গুলশানের সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় আসিফ মাহমুদের সংশ্লিষ্টতা আছে একথা অভিযুক্ত দাবী করেছেন। আসিফ মাহমুদদের এপিএস-এর তদবির বানিজ্যের দুর্নীতির কাহিনী বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের কর্মচারীদের মুখে মুখে। নাগরিক পার্টি সংশ্লিষ্ট যাদের বিরুদ্ধেই দুদকে দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের হয়েছে সেগুলো দুদকের হিমাগারে বিশ্রামে আছে। আর এভাবেই গড়ে উঠছে দুর্নীতি মুক্ত দেশ! শুরুতে এ ধরনের ঘটনাগুলোতে মানুষের মাঝে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হলেও বৈষম্য বিরোধী অভ্যুত্থানের ১৬ মাস পরে এসে এসব মানুষকে আর অতা আলোড়িত করছে না। পুরানো বন্দোবস্তে তো মানুষ অভ্যস্ত ছিলোই। এখন নতুন বন্দোবস্তের নামে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতিই যখন গ্রহণ করে নিয়েছে তরুণ নেতৃত্ব আর তরুণদের দল Ñ তখন মানুষের কিই বা করার আছে! চব্বিশের জুলাই এর পরে মনে হয়েছিল এই তরুণ নেতৃত্ব হয়তো সুবিধাবাদের শৃঙ্খল এবং পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে বের হবেন। কিন্তু কী দেখছি? দিন শেষে সবাই সুবিধালাভের জন্য মরিয়া।
মানুষ ‘ওয়েস্টিনের হাঁস’ নিয়ে হাসাহাসি করলেও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে সজীব ভূঁইয়ার আত্মরক্ষামূলক বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা শুনে। অস্ত্র আর আসিফ কেমন একটা সংযোগ দীর্ঘদিনের! বিমানবন্দরে তার ব্যাগ থেকে গুলির ম্যাগজিন উদ্ধার হওয়ার পর অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে নানা বিতর্ক হলো। এর আগে অবাক করার মত ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেছিলেন তারা নাকি সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করেছিলেন! কোন উদ্দেশ্য সাধনে, তিনি বা তারা সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করেছিলেন তার কোন ব্যাখ্যা তিনি আজ অবধি দেননি। তিনি এখন ক্ষমতায়। সেজন্য সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলেও পার পেয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতার গুণে। সময় কিন্তু সব সময় অনুকূলে থাকে না।
যেহেতু তিনি প্রথম থেকেই সিভিল ওয়ারের ভয় দেখাচ্ছেন সেহেতু তার ‘আত্মরক্ষামূলক নানা কলাকৌশল ও শুটিং শেখানো’ র কর্মসুচীর কথা শুনে সমাজে ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে। এ ধরনের বাহিনী গড়ে তোলার ঘোষণার প্রভাব রাজনীতিতে পড়ছে। তাইতো দেশের জন্মশত্রুদের বাহিনীও ‘৭১ -এর মতো আঙুল বাঁকা করতে চায়। এসব পরিকল্পনায় জাতি বিচ্ছিন্ন হবে, রক্তাক্ত হবে। আর এই ধরনের রক্তপাতের শুরু আছে, শেষ নেই। ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পরে দেশকে দ্রুততার সাথে স্থিতিশীলতা ও জাতীয় নির্বাচনের দিকে নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে অগ্রসর না হওয়ার কারণে দেশ এক গভীর সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিতে এক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শাসকদের উদ্দেশ্যে তাই এ কথাই শুধু বলা যায়,
‘দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে,/ অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।’
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
আনোয়ারুল হক
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫
জুলাই আন্দোলনের একজন অকুতোভয় ছাত্রনেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্র কোটা থেকে উপদেষ্টা হয়েছেন। ১৬ মাস যাবত যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং একই সাথে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সামাল দিচ্ছেন। একদিকে জুলাই আন্দোলনে রাজপথের ও তারপরে ১৬ মাস মন্ত্রণালয় পরিচালনার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তিনি। তবে শুধুমাত্র নিজ মন্ত্রণালয়ই নয় গোটা দেশ নিয়ে তার ভাবনা কাজ করে। আর তারাই যেহেতু কথিত ‘নিয়োগকর্তা’ তাই ছাত্র উপদেষ্টাদের বিচরণ নিজ নিজ মন্ত্রনালয়ের বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। যেমন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ জানিয়েছে শেখ হাসিনার মামলার বিচারের রায় কবে হবে তা জানানো হবে ১৩ নভেম্বর। আর উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ৪ নভেম্বরেই জানিয়ে দিলেন আগামী সপ্তাহে ‘ফ্যাসিস্ট খুনি শেখ হাসিনার’ বিচারের রায় পাবো। তবু ভালো কী রায় পাবো আগাম জানিয়ে দেননি!
দেশ নিয়ে ভাবনার অংশ হিসেবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের পরিকল্পনামত ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপি কেন্দ্রে ১৮-৩৫ বছর বয়সী ৮ হাজার ২৫০ জন তরুণ ও ৬শ’ তরুণীকে পনেরো দিনের আবাসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদেরকে আত্মরক্ষামূলক নানা কলাকৌশল ও আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এ বাবদ তাদেরকে চার হাজার ২০০ টাকা ভাতা এবং থাকা, খাওয়া ও পোশাক দেওয়া হবে। চলতি মাস থেকে এ কর্মসূচি শুরু হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এধরনের ট্রেনিং দেওয়া কি একটা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের মধ্যে পড়ে? এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, একটা মন্ত্রণালয়ের ধারণা থেকে এটা আসছে; কাজেই কোনো জাতীয় নীতিমালা আছে বলে আমি মনে করছি না। এ ধরনের কার্যক্রম জাতীয় নীতিমালা ছাড়া করা যায় না। কারণ এর সঙ্গে স্পর্শকাতর জিনিসপত্র জড়িত থাকে, জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত থাকে।’ এ কর্মসূচি নিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা নতুন এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন।
শুরু থেকেই ছাত্র উপদেষ্টাদের মধ্যে সবাইকে টেক্কা দিয়ে নিজ গুনে এগিয়ে আছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। বিতর্ক তার পিছু ছাড়ছে না। উপদেষ্টা হিসেবে তৎপরতা শুরুই করলেন জাতিকে এক ‘হেলিকপ্টার বিলাস কাহিনী’ উপহার দিয়ে।তারপরে নিজ এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে শুরু হলো বিতর্ক। স্থানীয় ঠিকাদারি কাজে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে তার পিতা যিনি স্থানীয় একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক Ñ তিনি ‘মেসার্স ইসরাত এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স করেন। এলইজিডি উপদেষ্টার পিতার নামে এলইজিডি-র সরবরাহকৃত লাইসেন্স নিয়ে সমালোচনার মুখে আসিফ মাহমুদ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট দিয়ে ক্ষমা চান এবং তার বাবাও লাইসেন্স প্রত্যাহার করে নেন।
এলাকায় নির্বাচনী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় শুরু থেকেই তার অনুসারীরা বিএনপির সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। পত্রপত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া ও বিতর্কের মুখে এবং নবগঠিত নাগরিক পার্টির সাথে তার সংশ্লিষ্টতা থাকায় অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং আসিফ মাহমুদের পদত্যাগের দাবি ওঠে। কিন্তু তার সাফ কথা তিনি নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা হলে পদত্যাগ করবেন, তার আগে নয়। নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তার নিজ জেলা কুমিল্লার সড়ক ও অন্যান্য গ্রামীণ অবকাঠামো মেরামত ও উন্নয়নে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে আসিফ মাহমুদের নিজ উপজেলা মুরাদনগরে ৪৫৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর উপজেলা দেবীদ্বারে ৩৩৮ কোটি টাকা।বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের এক সময়ের সমন্বয়করা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং দেশের পিছিয়ে থাকা উপজেলাগুলিকে এ ধরনের বরাদ্দে পিছিয়ে রেখে বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার লড়াইয়ে নেমেছেন। উপদেষ্টা বরাদ্দ দিচ্ছেন সরকারের টাকা আর এলাকায় প্রচার করার ব্যবস্থা হয়েছে তার নামে। বিভিন্ন রাস্তাঘাট বা স্থাপনা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপদেষ্টার চাচাতো ভাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুরাদনগর উপজেলার আহ্বায়ক উবায়দুল সিদ্দিকীকে এ কাজে রাখা হয়েছে। অবশ্য ‘মুরাদনগরের মাটি, আসিফের ঘাঁটি’ - এই স্লোগান দিয়ে তার অনুসারীরা নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেও শেষ খবর অনুযায়ী এখন তিনি ঢাকার কোনো একটি আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী।
ইতোমধ্যে ধানম-ি এলাকা থেকে ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। তার একদিন আগে তিনি বলেছিলেন নির্বাচন করতে হলে ১০-২০ কোটি টাকা লাগে। তাই ভাবতে হচ্ছে। একদিনেই ভাবনার অবসান। তিনি ঢাকা থেকেই নির্বাচন করবেন। তবে এই মুহুর্তে উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করছেন না। সরকারে উপদেষ্টা বিশেষত স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে থেকে সবকিছু নিজের মত গুছিয়ে নিয়ে তারপরে তিনি ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন!
গুলশানের সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় আসিফ মাহমুদের সংশ্লিষ্টতা আছে একথা অভিযুক্ত দাবী করেছেন। আসিফ মাহমুদদের এপিএস-এর তদবির বানিজ্যের দুর্নীতির কাহিনী বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের কর্মচারীদের মুখে মুখে। নাগরিক পার্টি সংশ্লিষ্ট যাদের বিরুদ্ধেই দুদকে দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের হয়েছে সেগুলো দুদকের হিমাগারে বিশ্রামে আছে। আর এভাবেই গড়ে উঠছে দুর্নীতি মুক্ত দেশ! শুরুতে এ ধরনের ঘটনাগুলোতে মানুষের মাঝে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হলেও বৈষম্য বিরোধী অভ্যুত্থানের ১৬ মাস পরে এসে এসব মানুষকে আর অতা আলোড়িত করছে না। পুরানো বন্দোবস্তে তো মানুষ অভ্যস্ত ছিলোই। এখন নতুন বন্দোবস্তের নামে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতিই যখন গ্রহণ করে নিয়েছে তরুণ নেতৃত্ব আর তরুণদের দল Ñ তখন মানুষের কিই বা করার আছে! চব্বিশের জুলাই এর পরে মনে হয়েছিল এই তরুণ নেতৃত্ব হয়তো সুবিধাবাদের শৃঙ্খল এবং পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে বের হবেন। কিন্তু কী দেখছি? দিন শেষে সবাই সুবিধালাভের জন্য মরিয়া।
মানুষ ‘ওয়েস্টিনের হাঁস’ নিয়ে হাসাহাসি করলেও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে সজীব ভূঁইয়ার আত্মরক্ষামূলক বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা শুনে। অস্ত্র আর আসিফ কেমন একটা সংযোগ দীর্ঘদিনের! বিমানবন্দরে তার ব্যাগ থেকে গুলির ম্যাগজিন উদ্ধার হওয়ার পর অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে নানা বিতর্ক হলো। এর আগে অবাক করার মত ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেছিলেন তারা নাকি সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করেছিলেন! কোন উদ্দেশ্য সাধনে, তিনি বা তারা সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করেছিলেন তার কোন ব্যাখ্যা তিনি আজ অবধি দেননি। তিনি এখন ক্ষমতায়। সেজন্য সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলেও পার পেয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতার গুণে। সময় কিন্তু সব সময় অনুকূলে থাকে না।
যেহেতু তিনি প্রথম থেকেই সিভিল ওয়ারের ভয় দেখাচ্ছেন সেহেতু তার ‘আত্মরক্ষামূলক নানা কলাকৌশল ও শুটিং শেখানো’ র কর্মসুচীর কথা শুনে সমাজে ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে। এ ধরনের বাহিনী গড়ে তোলার ঘোষণার প্রভাব রাজনীতিতে পড়ছে। তাইতো দেশের জন্মশত্রুদের বাহিনীও ‘৭১ -এর মতো আঙুল বাঁকা করতে চায়। এসব পরিকল্পনায় জাতি বিচ্ছিন্ন হবে, রক্তাক্ত হবে। আর এই ধরনের রক্তপাতের শুরু আছে, শেষ নেই। ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পরে দেশকে দ্রুততার সাথে স্থিতিশীলতা ও জাতীয় নির্বাচনের দিকে নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে অগ্রসর না হওয়ার কারণে দেশ এক গভীর সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিতে এক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শাসকদের উদ্দেশ্যে তাই এ কথাই শুধু বলা যায়,
‘দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে,/ অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।’
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]