এম এ হোসাইন
ডেঙ্গু জ্বর আবারও বাংলাদেশে তার প্রাণঘাতী রূপে ফিরে এসেছে। যা একটি নিয়ন্ত্রিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে মোকাবিলা করা যেত, তা আজ পরিণত হয়েছে জাতীয় জরুরি অবস্থায়। বছর ঘুরে একই গল্প Ñ সংক্রমণ বাড়ছে, হাসপাতালগুলোতে জায়গা নেই, স্বজনরা দৌড়াচ্ছে রক্তের খোঁজে, আর সরকার নড়েচড়ে বসছে অনেক দেরিতে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক সত্য হলো, এ বিপর্যয়ের অনেকটাই প্রতিরোধ করা যায়।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের প্রথম দশ মাসেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ২৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধুমাত্র অক্টোবর মাসে সেপ্টেম্বরের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ শতাংশ বেড়েছে, যা স্পষ্ট ইঙ্গিত যে প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো, গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করে যে কর্তৃপক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়নি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ এবং মৃত্যু হয়েছিল ১,৭০৫ জনের, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২৪ সালে আক্রান্তের সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়ে যায় এবং প্রাণ যায় আরও ৫৭৫ জনের। এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা নয়, বরং অবহেলা ও অদূরদৃষ্টির প্রতিচ্ছবি।
দশকের পর দশক ধরে কীটতত্ত্ববিদরা একই সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন, বর্ষার আগে ‘এডিস ইজিপ্টি’ মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। তারা বারবার বলেছেন, মশার লার্ভা ধ্বংস করা কোনো জটিল কাজ নয় বরং সবচেয়ে কার্যকর ও সহজ উপায় এ রোগ নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু প্রতি বছরই কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা করে যতক্ষণ না হাসপাতালগুলো ভরে যায়। তারপর দেখা যায় শহরে ফগিং মেশিন, কিছু প্রচার প্রচারণা, আর সরকারের তরফ থেকে আশ্বাসবাণী। তখন সবকিছুই অনেক দেরি হয়ে যায়।
বিদ্রƒপাত্মক বিষয়টি হলো, সরকার প্রতি বছরই বর্ষাপূর্ব কীটতত্ত্বগত জরিপ চালায় মশার ঘনত্ব নিরূপণ এবং প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য। এসব জরিপে একই ফলাফল বারবার উঠে এসেছে Ñ পানির ট্যাঙ্ক, জমে থাকা পানি এবং প্লাস্টিকের ড্রাম, ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ারের মতো গৃহস্থালি পাত্রগুলো মশার মূল প্রজননক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। এডিস লার্ভার সর্বোচ্চ ঘনত্ব পাওয়া গেছে বহুতল ভবনে, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরাঞ্চলে, যেখানে ছাদের পানির ট্যাঙ্ক এবং ফুলের টবে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না।
২০২৫ সালের বর্ষাপূর্ব জরিপ আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। জানুয়ারিতে একাধিক জেলায় অস্বাভাবিক উচ্চমাত্রায় মশার লার্ভার ঘনত্ব শনাক্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা গুরুত্ব সহকারে পূর্ব সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন যে যদি অবিলম্বে একটি সমন্বিত নির্মূল অভিযান না চালানো হয়, তাহলে দেশটি আরও একটি ভয়াবহ ডেঙ্গু মৌসুমের মুখোমুখি হতে পারে। তাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী, দুর্ভাগ্যবশত, সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, কেন বাংলাদেশ প্রতি বছর একই বিপদচক্রে আটকে পড়ে? সংক্ষিপ্ত উত্তরÑঅবহেলা। আর বিস্তারিত উত্তরÑপ্রশাসনিক অদক্ষতা, সমন্বয়ের অভাব এবং নাগরিক উদাসীনতা।
প্রথমত, দায়বদ্ধতার ঘাটতি। সিটি কর্পোরেশনগুলোর কাজ মূলত প্রতিক্রিয়াশীল, পূর্বপ্রস্তুত নয়। সারা বছর নজরদারির পরিবর্তে তারা অভিযান শুরু করে তখনই, যখন সংক্রমণ বেড়ে যায়। অকার্যকর বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে ফগিং করা হয়, যা শুধুই প্রাপ্তবয়স্ক মশা মারে, লার্ভাকে নয়। ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়।
দ্বিতীয়ত, নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা। দ্রুত নগরায়ণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন এডিস মশার জন্য এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে। অদক্ষ ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ছাদের পানির ট্যাংক, সব মিলিয়ে যেন মশার প্রজননের জন্য “স্বর্গরাজ্য”। নির্মাণাধীন ভবন, ভাঙা সামগ্রী ও ফেলে রাখা টায়ার জমে থাকা পানির ক্ষুদ্র উৎস তৈরি করছে। এসব এলাকায় পৌর কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকর নজরদারি নেই।
তৃতীয়ত, জনসচেতনতার ঘাটতি। গণমাধ্যমে প্রচার থাকা সত্ত্বেও অনেক মানুষই জানে না তাদের গৃহস্থালি অভ্যাস ডেঙ্গুর জন্ম দেয়। বাড়ির আঙিনায় টায়ার, ফুলের টবে জমে থাকা পানি, খোলা পানির পাত্র, সবই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হতে পারে। সরকারি উদ্যোগ একা সফল হতে পারে না, নাগরিক দায়িত্ববোধ জরুরি।
সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অনুপস্থিতি। স্বাস্থ্য খাত ডেঙ্গুকে এখনো মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখে, স্থায়ী হুমকি হিসেবে নয়। স্থায়ী মশা নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নেই, কোনো সার্বক্ষণিক নজরদারি ব্যবস্থা নেই, আগাম শনাক্তকরণের সক্ষমতাও সীমিত। ডেঙ্গু এখন সারা বছরব্যাপী ঝুঁকি, কিন্তু বর্ষা শেষ হলেই সব অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।
অন্যদিকে, প্রতিবেশী দেশগুলো দেখিয়ে দিয়েছে যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সরকারি নীতি কী অর্জন করতে পারে। যেমন, সিঙ্গাপুর কয়েক দশক আগে একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল কিন্তু একটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে ( কঠোর পৌর বাস্তবায়ন, জনশিক্ষা এবং অবিরত নজরদারি) ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছিল। মালয়েশিয়া এবং শ্রীলঙ্কাও তথ্যভিত্তিক ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশও পারত অনুরূপ পদক্ষেপ নিতে, কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক অঙ্গীকারের ঘাটতি রয়ে গেছে।
এই ব্যর্থতার মানবিক মূল্য অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রতিটি পরিসংখ্যানের পেছনে রয়েছে একেকটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি Ñ সিট-না পাওয়া একটি শিশুর ভিড়ে ঠাসা হাসপাতালের ওয়ার্ডে মৃত্যু, একজন প্রিয়জনের জন্য প্লাটিলেটের অভাবে একটি পরিবারের হাহাকার, একজন শ্রমিকের অসুস্থতার কারণে আয় হারানো। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিও সমানভাবে গুরুতর। বিশ্ব ব্যাংকের অনুমান, ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ে দেশগুলোকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই আর্থিক বোঝা অসহনীয়।
ভবিষ্যৎ পথ চলার জন্য প্রয়োজন একটি মৌলিক পরিবর্তন - প্রতিক্রিয়া থেকে প্রতিরোধে, অস্থায়ী অভিযান থেকে টেকসই ব্যবস্থায় রূপান্তর। কর্তৃপক্ষকে বর্ষাপূর্ব মশা নিধন কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যেখানে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় লার্ভাকে টার্গেট করতে হবে। স্বচ্ছ প্রতিবেদন এবং তৃতীয় পক্ষের নজরদারির সাথে স্থানীয় সরকারের সমন্বয় শক্তিশালী করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি জাতীয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স গঠন করা উচিত, যা শুধু সংকটের সময় নয়, সারা বছর কাজ করবে।
জনসম্পৃক্ততাও জরুরি। সচেতনতামূলক প্রচারণাকে স্লোগানের গ-ি পেরিয়ে যেতে হবে। স্কুল, কর্মস্থল এবং স্থানীয় কাউন্সিলগুলোকে সক্রিয়ভাবে বাসিন্দাদের সাপ্তাহিক পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেসব সম্পত্তির মালিক প্রজননক্ষেত্র বজায় রাখতে দেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর জরিমানা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রযুক্তিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্মার্টফোন-ভিত্তিক রিপোর্টিং সিস্টেমের মাধ্যমে নাগরিকরা দ্রুত পদক্ষেপের জন্য সম্ভাব্য মশার হটস্পট চিহ্নিত করতে পারবেন।
নীতিনির্ধারকদের জন্য এ সংকট এক সতর্কবার্তা হওয়া উচিত। জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুরবস্থা ডেঙ্গুর বিস্তারকে বাড়াচ্ছে। এখনই যদি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নীতি না নেওয়া হয়, তবে ডেঙ্গু শিগগিরই স্থায়ী মহামারিতে রূপ নেবে, যা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলবে। গতিপথ পরিবর্তনের জন্য এখনও খুব দেরি হয়নি। কিন্তু সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গু এখন আর একটি মৌসুমি রোগ নয়, এটি একটি জাতীয় দূর্যোগ যার জন্য সারা বছরব্যাপী সতর্কতা প্রয়োজন। গত এক দশকের মৃত্যুর সংখ্যায় শিক্ষা স্পষ্টÑপ্রতিরোধে দেরি মানে বিপর্যয় অনিবার্য। বাংলাদেশকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবেÑহাসপাতাল ভরে গেলে নয়, শিরোনামে মৃত্যুর খবর আসার আগেই। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয় বর্ষার আগেইÑদায়িত্ব, দূরদৃষ্টি ও জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব বুঝে তা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া যায় না।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
এম এ হোসাইন
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫
ডেঙ্গু জ্বর আবারও বাংলাদেশে তার প্রাণঘাতী রূপে ফিরে এসেছে। যা একটি নিয়ন্ত্রিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে মোকাবিলা করা যেত, তা আজ পরিণত হয়েছে জাতীয় জরুরি অবস্থায়। বছর ঘুরে একই গল্প Ñ সংক্রমণ বাড়ছে, হাসপাতালগুলোতে জায়গা নেই, স্বজনরা দৌড়াচ্ছে রক্তের খোঁজে, আর সরকার নড়েচড়ে বসছে অনেক দেরিতে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক সত্য হলো, এ বিপর্যয়ের অনেকটাই প্রতিরোধ করা যায়।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের প্রথম দশ মাসেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ২৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধুমাত্র অক্টোবর মাসে সেপ্টেম্বরের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ শতাংশ বেড়েছে, যা স্পষ্ট ইঙ্গিত যে প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো, গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করে যে কর্তৃপক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়নি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ এবং মৃত্যু হয়েছিল ১,৭০৫ জনের, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২৪ সালে আক্রান্তের সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়ে যায় এবং প্রাণ যায় আরও ৫৭৫ জনের। এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা নয়, বরং অবহেলা ও অদূরদৃষ্টির প্রতিচ্ছবি।
দশকের পর দশক ধরে কীটতত্ত্ববিদরা একই সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন, বর্ষার আগে ‘এডিস ইজিপ্টি’ মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। তারা বারবার বলেছেন, মশার লার্ভা ধ্বংস করা কোনো জটিল কাজ নয় বরং সবচেয়ে কার্যকর ও সহজ উপায় এ রোগ নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু প্রতি বছরই কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা করে যতক্ষণ না হাসপাতালগুলো ভরে যায়। তারপর দেখা যায় শহরে ফগিং মেশিন, কিছু প্রচার প্রচারণা, আর সরকারের তরফ থেকে আশ্বাসবাণী। তখন সবকিছুই অনেক দেরি হয়ে যায়।
বিদ্রƒপাত্মক বিষয়টি হলো, সরকার প্রতি বছরই বর্ষাপূর্ব কীটতত্ত্বগত জরিপ চালায় মশার ঘনত্ব নিরূপণ এবং প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য। এসব জরিপে একই ফলাফল বারবার উঠে এসেছে Ñ পানির ট্যাঙ্ক, জমে থাকা পানি এবং প্লাস্টিকের ড্রাম, ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ারের মতো গৃহস্থালি পাত্রগুলো মশার মূল প্রজননক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। এডিস লার্ভার সর্বোচ্চ ঘনত্ব পাওয়া গেছে বহুতল ভবনে, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরাঞ্চলে, যেখানে ছাদের পানির ট্যাঙ্ক এবং ফুলের টবে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না।
২০২৫ সালের বর্ষাপূর্ব জরিপ আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। জানুয়ারিতে একাধিক জেলায় অস্বাভাবিক উচ্চমাত্রায় মশার লার্ভার ঘনত্ব শনাক্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা গুরুত্ব সহকারে পূর্ব সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন যে যদি অবিলম্বে একটি সমন্বিত নির্মূল অভিযান না চালানো হয়, তাহলে দেশটি আরও একটি ভয়াবহ ডেঙ্গু মৌসুমের মুখোমুখি হতে পারে। তাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী, দুর্ভাগ্যবশত, সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, কেন বাংলাদেশ প্রতি বছর একই বিপদচক্রে আটকে পড়ে? সংক্ষিপ্ত উত্তরÑঅবহেলা। আর বিস্তারিত উত্তরÑপ্রশাসনিক অদক্ষতা, সমন্বয়ের অভাব এবং নাগরিক উদাসীনতা।
প্রথমত, দায়বদ্ধতার ঘাটতি। সিটি কর্পোরেশনগুলোর কাজ মূলত প্রতিক্রিয়াশীল, পূর্বপ্রস্তুত নয়। সারা বছর নজরদারির পরিবর্তে তারা অভিযান শুরু করে তখনই, যখন সংক্রমণ বেড়ে যায়। অকার্যকর বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে ফগিং করা হয়, যা শুধুই প্রাপ্তবয়স্ক মশা মারে, লার্ভাকে নয়। ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়।
দ্বিতীয়ত, নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা। দ্রুত নগরায়ণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন এডিস মশার জন্য এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে। অদক্ষ ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ছাদের পানির ট্যাংক, সব মিলিয়ে যেন মশার প্রজননের জন্য “স্বর্গরাজ্য”। নির্মাণাধীন ভবন, ভাঙা সামগ্রী ও ফেলে রাখা টায়ার জমে থাকা পানির ক্ষুদ্র উৎস তৈরি করছে। এসব এলাকায় পৌর কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকর নজরদারি নেই।
তৃতীয়ত, জনসচেতনতার ঘাটতি। গণমাধ্যমে প্রচার থাকা সত্ত্বেও অনেক মানুষই জানে না তাদের গৃহস্থালি অভ্যাস ডেঙ্গুর জন্ম দেয়। বাড়ির আঙিনায় টায়ার, ফুলের টবে জমে থাকা পানি, খোলা পানির পাত্র, সবই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হতে পারে। সরকারি উদ্যোগ একা সফল হতে পারে না, নাগরিক দায়িত্ববোধ জরুরি।
সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অনুপস্থিতি। স্বাস্থ্য খাত ডেঙ্গুকে এখনো মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখে, স্থায়ী হুমকি হিসেবে নয়। স্থায়ী মশা নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নেই, কোনো সার্বক্ষণিক নজরদারি ব্যবস্থা নেই, আগাম শনাক্তকরণের সক্ষমতাও সীমিত। ডেঙ্গু এখন সারা বছরব্যাপী ঝুঁকি, কিন্তু বর্ষা শেষ হলেই সব অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।
অন্যদিকে, প্রতিবেশী দেশগুলো দেখিয়ে দিয়েছে যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সরকারি নীতি কী অর্জন করতে পারে। যেমন, সিঙ্গাপুর কয়েক দশক আগে একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল কিন্তু একটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে ( কঠোর পৌর বাস্তবায়ন, জনশিক্ষা এবং অবিরত নজরদারি) ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছিল। মালয়েশিয়া এবং শ্রীলঙ্কাও তথ্যভিত্তিক ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশও পারত অনুরূপ পদক্ষেপ নিতে, কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক অঙ্গীকারের ঘাটতি রয়ে গেছে।
এই ব্যর্থতার মানবিক মূল্য অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রতিটি পরিসংখ্যানের পেছনে রয়েছে একেকটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি Ñ সিট-না পাওয়া একটি শিশুর ভিড়ে ঠাসা হাসপাতালের ওয়ার্ডে মৃত্যু, একজন প্রিয়জনের জন্য প্লাটিলেটের অভাবে একটি পরিবারের হাহাকার, একজন শ্রমিকের অসুস্থতার কারণে আয় হারানো। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিও সমানভাবে গুরুতর। বিশ্ব ব্যাংকের অনুমান, ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ে দেশগুলোকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই আর্থিক বোঝা অসহনীয়।
ভবিষ্যৎ পথ চলার জন্য প্রয়োজন একটি মৌলিক পরিবর্তন - প্রতিক্রিয়া থেকে প্রতিরোধে, অস্থায়ী অভিযান থেকে টেকসই ব্যবস্থায় রূপান্তর। কর্তৃপক্ষকে বর্ষাপূর্ব মশা নিধন কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যেখানে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় লার্ভাকে টার্গেট করতে হবে। স্বচ্ছ প্রতিবেদন এবং তৃতীয় পক্ষের নজরদারির সাথে স্থানীয় সরকারের সমন্বয় শক্তিশালী করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি জাতীয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স গঠন করা উচিত, যা শুধু সংকটের সময় নয়, সারা বছর কাজ করবে।
জনসম্পৃক্ততাও জরুরি। সচেতনতামূলক প্রচারণাকে স্লোগানের গ-ি পেরিয়ে যেতে হবে। স্কুল, কর্মস্থল এবং স্থানীয় কাউন্সিলগুলোকে সক্রিয়ভাবে বাসিন্দাদের সাপ্তাহিক পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেসব সম্পত্তির মালিক প্রজননক্ষেত্র বজায় রাখতে দেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর জরিমানা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রযুক্তিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্মার্টফোন-ভিত্তিক রিপোর্টিং সিস্টেমের মাধ্যমে নাগরিকরা দ্রুত পদক্ষেপের জন্য সম্ভাব্য মশার হটস্পট চিহ্নিত করতে পারবেন।
নীতিনির্ধারকদের জন্য এ সংকট এক সতর্কবার্তা হওয়া উচিত। জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুরবস্থা ডেঙ্গুর বিস্তারকে বাড়াচ্ছে। এখনই যদি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নীতি না নেওয়া হয়, তবে ডেঙ্গু শিগগিরই স্থায়ী মহামারিতে রূপ নেবে, যা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলবে। গতিপথ পরিবর্তনের জন্য এখনও খুব দেরি হয়নি। কিন্তু সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গু এখন আর একটি মৌসুমি রোগ নয়, এটি একটি জাতীয় দূর্যোগ যার জন্য সারা বছরব্যাপী সতর্কতা প্রয়োজন। গত এক দশকের মৃত্যুর সংখ্যায় শিক্ষা স্পষ্টÑপ্রতিরোধে দেরি মানে বিপর্যয় অনিবার্য। বাংলাদেশকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবেÑহাসপাতাল ভরে গেলে নয়, শিরোনামে মৃত্যুর খবর আসার আগেই। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয় বর্ষার আগেইÑদায়িত্ব, দূরদৃষ্টি ও জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব বুঝে তা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া যায় না।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]