তরিকুল ইসলাম
বর্তমানে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ ও ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’ থাকলেও সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। সড়কে মৃত্যু ও আহত কমাতে প্রয়োজন শক্তিশালী নীতি ও আইনি কাঠামো। তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে একটি সমন্বিত ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে হোক নতুন বছরের নিরাপদ সড়কের অঙ্গীকার।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুযায়ী সড়কে গত বছর প্রতিদিন গড়ে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৩ সালের সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে বিআরটিএ জানান, ২০২৩ সালে সারা দেশে ৫ হাজার ৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৫ হাজার ২৪ জনের মৃত্যু হয়। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৪৯৫ জন আহত হয়েছেন বলেও জানায় বিআরটিএ।
বিআইডিএসের গবেষণায় দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিবছর জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। রোডক্যাশকে সহনীয় মাত্রায় রাখতে তথা সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও অসুস্থতা এবং সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি লাঘবের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তার সদস্যভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাথে নিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, প্রতিবছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে প্রতি লাখে রোডর্ক্যাশে মৃত্যু ছিল ১৫.৩ এবং ২০২১ সালে এই মৃত্যু বেড়ে হয় প্রতি লাখে ১৮.৬ জনের মতো। অন্যদিকে, বিআরটিএ’র হিসাবমতে, প্রতিবছর দেশে গড়ে প্রায় ৫ হাজার মানুষ মারা যায় ও ১০ হাজারের বেশি বিভিন্ন বিভিন্ন মাত্রায় আহত এবং পঙ্গুত্ব বরণ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত ‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি ২০২৩’ এ আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে রোডক্যাশে মৃত্যু হয়েছে, ২১ হাজার ৩১৬ জনের। তবে পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩৭৬ জনের। একইভাবে ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে ২৪ হাজার ৯৪৪ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৬৩৫ জনের। ২০২১ সালের রিপোর্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে মৃত্যু হয়েছে ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৬ সালে প্রতি লাখে মৃত্যুহার ছিল ১৫.৩ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এই মৃত্যুহার ছিল প্রতি লাখে ১৯ জনের মতো।
গ্লোবাল প্ল্যান ফর সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ২০২১-২০৩০ এর আওতায় ৫টি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো-বহুমুখী যানবাহন ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো, নিরাপদ সড়ক ব্যবহার, সড়ক দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়াও সড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য ৫টি আচরণগত ঝুঁকি যেমন, গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ না করা, সিট বেল্ট ব্যবহার না করা, মানসম্মত হেলমেট পরিধান না করা, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো এবং শিশুবান্ধব বিশেষায়িত আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পৃথিবীর অনেক দেশ কিন্তু সড়কে মৃত্যু শূন্যের কোঠায় কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করে নীতি প্রণয়ন করছে। বিশ্বব্যাপী এই লক্ষ্যকে বলা হয় ‘ভিশন জিরো’। বিশ্বের অনেক দেশ এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে। সড়কে নাগরিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং জাতিসংঘের গ্লোবাল প্ল্যানের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রতিরোধযোগ্য রোডর্ক্যাশ, মৃত্যু ও আহত হওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে হবে। এজন্য দরকার উপযুক্ত শক্তিশালী নীতি ও আইনি কাঠামো। বর্তমানে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ ও ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’ বলবৎ থাকলেও সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি।
সড়ক নিরাপত্তায় সরকারের পৃথক আইন প্রণয়নে একটি কমিটি গঠিত হলেও তা এখন স্থবির অবস্থায় আছে। সরকারের উচিত এখন সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নে সচেষ্ট হওয়া এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে আইন প্রণয়ন করা। তাহলেই এবছরের তরুণদের যে অঙ্গীকার তা বাস্তবায়িত হবে। তাই সড়ক নিরাপত্তায় সংস্কার ভাবনা এখন সময়ের দাবি।
[ লেখক : অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন), রোড সেইফটি প্রকল্প, স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ]
তরিকুল ইসলাম
বুধবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫
বর্তমানে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ ও ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’ থাকলেও সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। সড়কে মৃত্যু ও আহত কমাতে প্রয়োজন শক্তিশালী নীতি ও আইনি কাঠামো। তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে একটি সমন্বিত ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে হোক নতুন বছরের নিরাপদ সড়কের অঙ্গীকার।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুযায়ী সড়কে গত বছর প্রতিদিন গড়ে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৩ সালের সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে বিআরটিএ জানান, ২০২৩ সালে সারা দেশে ৫ হাজার ৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৫ হাজার ২৪ জনের মৃত্যু হয়। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৪৯৫ জন আহত হয়েছেন বলেও জানায় বিআরটিএ।
বিআইডিএসের গবেষণায় দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিবছর জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। রোডক্যাশকে সহনীয় মাত্রায় রাখতে তথা সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও অসুস্থতা এবং সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি লাঘবের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তার সদস্যভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাথে নিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, প্রতিবছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে প্রতি লাখে রোডর্ক্যাশে মৃত্যু ছিল ১৫.৩ এবং ২০২১ সালে এই মৃত্যু বেড়ে হয় প্রতি লাখে ১৮.৬ জনের মতো। অন্যদিকে, বিআরটিএ’র হিসাবমতে, প্রতিবছর দেশে গড়ে প্রায় ৫ হাজার মানুষ মারা যায় ও ১০ হাজারের বেশি বিভিন্ন বিভিন্ন মাত্রায় আহত এবং পঙ্গুত্ব বরণ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত ‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি ২০২৩’ এ আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে রোডক্যাশে মৃত্যু হয়েছে, ২১ হাজার ৩১৬ জনের। তবে পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩৭৬ জনের। একইভাবে ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে ২৪ হাজার ৯৪৪ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৬৩৫ জনের। ২০২১ সালের রিপোর্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে মৃত্যু হয়েছে ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৬ সালে প্রতি লাখে মৃত্যুহার ছিল ১৫.৩ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এই মৃত্যুহার ছিল প্রতি লাখে ১৯ জনের মতো।
গ্লোবাল প্ল্যান ফর সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ২০২১-২০৩০ এর আওতায় ৫টি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো-বহুমুখী যানবাহন ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো, নিরাপদ সড়ক ব্যবহার, সড়ক দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়াও সড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য ৫টি আচরণগত ঝুঁকি যেমন, গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ না করা, সিট বেল্ট ব্যবহার না করা, মানসম্মত হেলমেট পরিধান না করা, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো এবং শিশুবান্ধব বিশেষায়িত আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পৃথিবীর অনেক দেশ কিন্তু সড়কে মৃত্যু শূন্যের কোঠায় কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করে নীতি প্রণয়ন করছে। বিশ্বব্যাপী এই লক্ষ্যকে বলা হয় ‘ভিশন জিরো’। বিশ্বের অনেক দেশ এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে। সড়কে নাগরিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং জাতিসংঘের গ্লোবাল প্ল্যানের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রতিরোধযোগ্য রোডর্ক্যাশ, মৃত্যু ও আহত হওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে হবে। এজন্য দরকার উপযুক্ত শক্তিশালী নীতি ও আইনি কাঠামো। বর্তমানে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ ও ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’ বলবৎ থাকলেও সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি।
সড়ক নিরাপত্তায় সরকারের পৃথক আইন প্রণয়নে একটি কমিটি গঠিত হলেও তা এখন স্থবির অবস্থায় আছে। সরকারের উচিত এখন সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নে সচেষ্ট হওয়া এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে আইন প্রণয়ন করা। তাহলেই এবছরের তরুণদের যে অঙ্গীকার তা বাস্তবায়িত হবে। তাই সড়ক নিরাপত্তায় সংস্কার ভাবনা এখন সময়ের দাবি।
[ লেখক : অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন), রোড সেইফটি প্রকল্প, স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ]