alt

সাময়িকী

হিমু ও হুমায়ূন আহমেদ

বাসার তাসাউফ

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট : বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪

হুমায়ূন আহমেদ

আমি যদি শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে চেঁচিয়ে বলি, আজকে সূর্য পুবদিকে উদিত হয়েছে আর পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যাবে। লোকজন হাসবে। বলবে, এ আর নতুন কী। কিন্তু যদি উল্টোটা বলি, চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে আমাকে পাগল বলে গালি দেবে। ঠিক সেই রকম হুমায়ূন আহমেদ ও হিমুর ব্যাপারটা। হিমুর নামটা মুখে উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মনের কোণে হুমায়ূূন আহমেদের নামটা ভেসে ওঠে। আবার হুমায়ূন আহমেদের নাম মুখে উচ্চারণ করলেও হিমুর নামটা ভেসে ওঠে মনের দর্পণে। অনেকেই মনে করেন, হিমু হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের নিজের চরিত্রেরই লিখিত রূপ।

১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশ হওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে পাঠকমহলে নন্দিত হয়েছেন তার ধারেকাছেও বাংলাদেশের আর কোনো লেখক পৌঁছাতে পারেননি। ‘নন্দিত নরকে’ দিয়ে শুরু করার পর ‘দেয়াল’ পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেকটি সাহিত্যকর্মই পাঠকপ্রিয়তায় অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে তাঁকে। কী যে যাদু আছে তার লেখায়!

হুমায়ূন আহমেদের অমর সৃষ্টি হিমু। যতদূর জানি, হুমায়ূন আহমেদ লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তায় তুঙ্গস্পর্শের নেপথ্যে লুকিয়ে আছে হিমু, শুভ্র, মিসিরি আলী ও রূপা নামের জনপ্রিয় কিছু চরিত্র। এসব চরিত্রেরে মধ্যে ‘হিমু’র জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি। তার নামটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবে আমাদের মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে হলুদ পাঞ্জাবি পরা খালি পায়ে হেঁটে চলা ভবঘুরে এক যুবকের ছবি।

হিমু চরিত্রের আসল নাম হিমালয়। এ নামটি রেখেছিল তার বাবা। হুমায়ূন আহমেদ ‘হিমু’র বাবাকে বর্ণনা করেছেন একজন বিকারগ্রস্ত মানুষ হিসেবে, যার বিশ্বাস ছিল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার যদি প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা যায়, তবে একইভাবে মহাপুরুষ তৈরি করাও সম্ভব। মহাপুরুষ তৈরির জন্য একটি বিদ্যালয় তৈরি করেছিল সে, যার একমাত্র ছাত্র ছিল তার সন্তান হিমু। হিমুর পোশাক ছিল পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবী। হলুদ বৈরাগ্যের রঙ বলেই পোশাকের রঙ হলুদ নির্বাচিত করা হয়েছিল। ঢাকা শহরের পথে-পথে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো তার কর্মকা-ের মধ্যে অন্যতম। প্রায়ই তার মধ্যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ দেখা যায়। যদিও হিমু নিজে তার কোন আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা স্বীকার করে না। হিমুর আচার-আচরণ বিভ্রান্তিকর। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার প্রতিক্রিয়াও অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করে এবং এই এরকম করা তার অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজ। প্রেম-ভালোবাসা উপেক্ষা করা হিমুর ধর্মের মধ্যে আছে। কখনোই কোনো মায়া তাকে কাবু করতে পারেনি। মায়াজালে আটকা পড়তে গেলেই সে উধাও হয়ে যায়। তাকে সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না, আবার অস্বীকার করা যায় না তার প্রবল মানবিকতাকেও। সে একই সাথে আনন্দাচ্ছন্ন, আবার বিষাদজড়িত। চাকরির সুযোগ থাকলেও সে কখনো তা করে না।

নব্বইয়ের দশকের গোড়াতে ‘ময়ূরাক্ষী’ উপন্যাসের মাধ্যমে হিমুর আবির্ভাব ঘটে। সেখানে প্রবল দুর্দশা এবং অস্বচ্ছলতার ভেতর থেকে একটুকরো সুখ খুঁজে নিতে হিমুকে কল্পনার ‘ময়ূরাক্ষী’র তীরে চলে যেতে দেখা যায়। ইচ্ছে হলেই যে কোনো সময়ে সে নদীতীরে ভ্রমণ করতে পারে, চাইলে যে কাউকে সঙ্গেও নিয়ে যেতে পারে। মাঝে মাঝে সেখানে তার মাকেও দেখতে পায় হিমু। এ উপন্যাসটিতে দেখা যায় হিমুর বাবা প্রায় বিকারগ্রস্ত একজন মানুষ, যে ছেলেকে ‘মহাপুরুষ’ বানাবার জন্য উঠেপড়ে লাগে। মহাপুরুষ বানানোর কাজে বিঘœ ঘটতে পারার আশঙ্কায় হিমুর মাকে হত্যাও হয়তো সে-ই করে। ঘটনাক্রমে জীবনের একটা সময় এমনও এসেছিল যখন হিমুকে তার পিশাচসম মামাদের সাথে বসবাস করতে হতো। সেখানে সে জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সাথে পরিচিত হয়। এভাবেই হিমু সিরিজের সূচনা হয়েছিল।

হিমুর পিতামহ হিমুর নাম রেখেছিলেন চৌধুরী ইমতিয়াজ টুটুল। তবে পিতামহের দেয়া এ নামটির বদলে জীবনের অন্য সব কিছুর মতোই হিমু গ্রহণ করে তার বাবার দেয়া নাম হিমালয়। তার বাবার ধারণা ছিল হিমালয় নামটি পর্বতের মতোই মহত্ত্ব প্রকাশ করে। কারণ হিমালয়কে ছোঁয়া কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। হিমালয় থেকে সংক্ষেপে তার নাম হয়ে যায় হিমু। বাবার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে হিমু। এ যেন অদ্ভুত এক বাধ্যতা! বাবার দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী সব সময় খালি পায়ে হেঁটে বেড়ায় এবং পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি তার নিয়মিত পোশাক হয়ে যায়। হিমুর বাবার মহাপুরুষ বানানোর প্রয়াস হিমুকে কতটুকু মহাপুরুষ করতে পেরেছিল তা জানা যায় নি। তবে হিমুকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটি চরিত্রে রূপান্তরিত করেছিল। হিমুর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় হিমু ২৫-৩০ বছর বয়সী অনাড়ম্বর একজন যুবক। তবে অনাড়ম্বর হলেও তার মধ্যে বেশ কিছু উদ্ভট আচরণ ছিল- যা সাধারণ থেকে তাকে করেছে আলাদা। কারো কাছে সেটা বিরক্তিকর আর কারো কাছে একদমই মহাপুরষ!

হিমু নিজেকে একজন অবিরাম হন্টক হিসেবে দাবি করে এবং তার একমাত্র কাজ রাত-বিরাতে ঘুরে বেড়ানো। প্রায়ই হিমু পার্কে এবং রাস্তায় রাত কাটায়। এ কারণে তাকে কয়েকবার সন্দেহভাজন হিসেবে কারাবাসও করতে হয় আর এই সুযোগে বিভিন্ন থানার অফিসারদের সাথে বেশ মজার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আবার অন্য দিকে কিছু খুনি-সন্ত্রাসীর সাথেও গড়ে ওঠে তার ভালো সখ্য।

হিমুর একটি বিশেষ গুণ হলো, যেকোনো পরিস্থিতিতেই সে স্বাভাবিক থাকতে পারে এবং খুব সহজেই মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। সুন্দর করে হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিমায় কথা বলাও তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে এসব হাস্যরসের মাঝে শহুরে ভ-ামির নানান দিক ফুটে ওঠার পাশাপাশি মানবজীবনের অন্তর্লীন বিষাদগ্রস্ততার চিত্রও খুব সহজেই ধরা দেয়। এ কারণে অনেক সময় হিমুকে অকর্মা যুবকও মনে হতে পারে। কিন্তু সে কখনো অন্যের অন্বিষ্ট করে না এবং দিন শেষে প্রতিটি উপন্যাসেই হিমুকে নিঃস্বার্থ এবং পরোপকারী হিসেবে দেখা যায়।

হিমুর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউই তাকে খুব ভালো চোখে দেখে না, তবে মাজেদা খালা ব্যতিক্রম। মাজেদা খালা হিমু সিরিজের বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র। এছাড়া হিমুর ফুপাতো ভাই বাদলকেও বিভিন্ন উপন্যাসে দেখতে পাওয়া যায়, যে কিনা হিমুর একান্ত ভক্তদের মধ্যে অন্যতম।

হিমু হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে হিমুর বাবার পর সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে হিমুর বান্ধবী রূপা। হিমুকে পছন্দ করে রূপা, হয়তোবা ভালোও বাসে। হিমুও যে রূপাকে অপছন্দ করে, তা নয়। মাঝে মাঝে রূপাকে কোনো এক দোকান থেকে ফোন করে নীল শাড়ি পরে তাদের বারান্দায় দাঁড়াতে বলে হিমু। রূপা তাই হিমুর জন্য অপেক্ষা থাকে। কিন্তু হিমু আসে না। রূপা তারপরও অবাক হয় না। বরং সে হিমুকে তার মেসে চিঠি পাঠায়, চিঠিতে একটুখানি অনুযোগ থাকে শুধু, আর কিছু না। হিমুর এমন উদ্ভটতায় রাগ করে না রূপা। এ জন্য হিমুর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে এই মহাপুুরুষগিরি ছেড়ে-ছুড়ে স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সেটা করা হয়ে ওঠে না। কারণ হিমুদের আবেগ গায়ে মাখতে নেই, হিমুদের ভালোবাসতে নেই। হিমুরা কাউকে ভালবাসে না।

হিমুরা কাউকে ভালো না বাসলেও অজস্র পাঠক হিমুকে ভালোবাসে। তাইতো হিমু চরিত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকেই এখনো হিমু হবার চেষ্টা করছে। আর এটাই হিমু চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ। কেননা হিমু শুধু বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, মিশে গেছে সাধারণ মানুষের সাথে। অনেকেই বলা নেই কওয়া নেই, হিমু হতে চায়! কিন্তু হিমু-স্রষ্টা আমাদের থেকে বিদায় নেওয়ায় হিমুর জীবনযাপনও যেন স্থির হয়েছে আছে। তাই হিমুর খালি পায়ে পরা হয়নি জুতো। হলুদ পাঞ্জাবিতে যুক্ত হয়নি পকেট।

হিমু-¯্রষ্টার প্রস্থান হয়েছে, কিন্তু হিমুর বিনাশ ঘটেনি, থেমে আছে হিমুর নগ্ন পায়ে চলাচল। তবে একজন হিমুর স্থিরতায় অজস্র হিমু আজ শহরের অলিতে-গলিতে দেখা যায়, মুধু শহর নয়, সুদূর গ্রামেও অনেক হিমুকে দেখা যায় পকেট বিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতে। এখনো বাড়ির ছাদে বিষণœ বদনে, উদাসী নয়নে অপেক্ষার আনন্দ উপভোগ করে নীল শাড়ি পরা রূপা।

এখানে এসে একটি প্রশ্ন রাখছি, পাঠকের কাছে কে বেশি প্রিয়? হিমু নাকি হুমায়ূন আহমেদ? হুমায়ূন আহমেদের এমন গগনস্পর্শী জনপ্রিয়তার নেপথ্যে হিমু চরিত্রের যে অনেক বড় ভূমিকা আছে সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু হিমুকে নিয়ে যে পাঠকের কৌতূহলের শেষ নেই। অনেক তরুণ এখনো হিমুকে অনুসরণ করে, হিমুর মতো হতে চায়। কিন্তু কেউ হুমায়ূন আহমেদ হতে চায় না।

আজ হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে নেই, কিন্তু তার সৃষ্ট চরিত্ররা বেঁচে আছে। কী আশ্চর্য় মেধা নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন! কী আশ্চর্য সম্মোহনী শক্তি ছিল তাঁর লেখায়, তাঁর সৃষ্ট কাল্পনিক সব চরিত্রের!

হুমায়ূন আহমেদ আর হিমু পাঠকের কাছে এক অপার ভালোবাসার নাম। দুজনেই পাঠকের মনের কোণে বহুদিন বেঁচে থাকবে এ কথা অকপটে বলে দেয়া যায়

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

tab

সাময়িকী

হিমু ও হুমায়ূন আহমেদ

বাসার তাসাউফ

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

হুমায়ূন আহমেদ

বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪

আমি যদি শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে চেঁচিয়ে বলি, আজকে সূর্য পুবদিকে উদিত হয়েছে আর পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যাবে। লোকজন হাসবে। বলবে, এ আর নতুন কী। কিন্তু যদি উল্টোটা বলি, চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে আমাকে পাগল বলে গালি দেবে। ঠিক সেই রকম হুমায়ূন আহমেদ ও হিমুর ব্যাপারটা। হিমুর নামটা মুখে উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মনের কোণে হুমায়ূূন আহমেদের নামটা ভেসে ওঠে। আবার হুমায়ূন আহমেদের নাম মুখে উচ্চারণ করলেও হিমুর নামটা ভেসে ওঠে মনের দর্পণে। অনেকেই মনে করেন, হিমু হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের নিজের চরিত্রেরই লিখিত রূপ।

১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশ হওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে পাঠকমহলে নন্দিত হয়েছেন তার ধারেকাছেও বাংলাদেশের আর কোনো লেখক পৌঁছাতে পারেননি। ‘নন্দিত নরকে’ দিয়ে শুরু করার পর ‘দেয়াল’ পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেকটি সাহিত্যকর্মই পাঠকপ্রিয়তায় অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে তাঁকে। কী যে যাদু আছে তার লেখায়!

হুমায়ূন আহমেদের অমর সৃষ্টি হিমু। যতদূর জানি, হুমায়ূন আহমেদ লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তায় তুঙ্গস্পর্শের নেপথ্যে লুকিয়ে আছে হিমু, শুভ্র, মিসিরি আলী ও রূপা নামের জনপ্রিয় কিছু চরিত্র। এসব চরিত্রেরে মধ্যে ‘হিমু’র জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি। তার নামটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবে আমাদের মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে হলুদ পাঞ্জাবি পরা খালি পায়ে হেঁটে চলা ভবঘুরে এক যুবকের ছবি।

হিমু চরিত্রের আসল নাম হিমালয়। এ নামটি রেখেছিল তার বাবা। হুমায়ূন আহমেদ ‘হিমু’র বাবাকে বর্ণনা করেছেন একজন বিকারগ্রস্ত মানুষ হিসেবে, যার বিশ্বাস ছিল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার যদি প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা যায়, তবে একইভাবে মহাপুরুষ তৈরি করাও সম্ভব। মহাপুরুষ তৈরির জন্য একটি বিদ্যালয় তৈরি করেছিল সে, যার একমাত্র ছাত্র ছিল তার সন্তান হিমু। হিমুর পোশাক ছিল পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবী। হলুদ বৈরাগ্যের রঙ বলেই পোশাকের রঙ হলুদ নির্বাচিত করা হয়েছিল। ঢাকা শহরের পথে-পথে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো তার কর্মকা-ের মধ্যে অন্যতম। প্রায়ই তার মধ্যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ দেখা যায়। যদিও হিমু নিজে তার কোন আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা স্বীকার করে না। হিমুর আচার-আচরণ বিভ্রান্তিকর। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার প্রতিক্রিয়াও অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করে এবং এই এরকম করা তার অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজ। প্রেম-ভালোবাসা উপেক্ষা করা হিমুর ধর্মের মধ্যে আছে। কখনোই কোনো মায়া তাকে কাবু করতে পারেনি। মায়াজালে আটকা পড়তে গেলেই সে উধাও হয়ে যায়। তাকে সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না, আবার অস্বীকার করা যায় না তার প্রবল মানবিকতাকেও। সে একই সাথে আনন্দাচ্ছন্ন, আবার বিষাদজড়িত। চাকরির সুযোগ থাকলেও সে কখনো তা করে না।

নব্বইয়ের দশকের গোড়াতে ‘ময়ূরাক্ষী’ উপন্যাসের মাধ্যমে হিমুর আবির্ভাব ঘটে। সেখানে প্রবল দুর্দশা এবং অস্বচ্ছলতার ভেতর থেকে একটুকরো সুখ খুঁজে নিতে হিমুকে কল্পনার ‘ময়ূরাক্ষী’র তীরে চলে যেতে দেখা যায়। ইচ্ছে হলেই যে কোনো সময়ে সে নদীতীরে ভ্রমণ করতে পারে, চাইলে যে কাউকে সঙ্গেও নিয়ে যেতে পারে। মাঝে মাঝে সেখানে তার মাকেও দেখতে পায় হিমু। এ উপন্যাসটিতে দেখা যায় হিমুর বাবা প্রায় বিকারগ্রস্ত একজন মানুষ, যে ছেলেকে ‘মহাপুরুষ’ বানাবার জন্য উঠেপড়ে লাগে। মহাপুরুষ বানানোর কাজে বিঘœ ঘটতে পারার আশঙ্কায় হিমুর মাকে হত্যাও হয়তো সে-ই করে। ঘটনাক্রমে জীবনের একটা সময় এমনও এসেছিল যখন হিমুকে তার পিশাচসম মামাদের সাথে বসবাস করতে হতো। সেখানে সে জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সাথে পরিচিত হয়। এভাবেই হিমু সিরিজের সূচনা হয়েছিল।

হিমুর পিতামহ হিমুর নাম রেখেছিলেন চৌধুরী ইমতিয়াজ টুটুল। তবে পিতামহের দেয়া এ নামটির বদলে জীবনের অন্য সব কিছুর মতোই হিমু গ্রহণ করে তার বাবার দেয়া নাম হিমালয়। তার বাবার ধারণা ছিল হিমালয় নামটি পর্বতের মতোই মহত্ত্ব প্রকাশ করে। কারণ হিমালয়কে ছোঁয়া কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। হিমালয় থেকে সংক্ষেপে তার নাম হয়ে যায় হিমু। বাবার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে হিমু। এ যেন অদ্ভুত এক বাধ্যতা! বাবার দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী সব সময় খালি পায়ে হেঁটে বেড়ায় এবং পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি তার নিয়মিত পোশাক হয়ে যায়। হিমুর বাবার মহাপুরুষ বানানোর প্রয়াস হিমুকে কতটুকু মহাপুরুষ করতে পেরেছিল তা জানা যায় নি। তবে হিমুকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটি চরিত্রে রূপান্তরিত করেছিল। হিমুর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় হিমু ২৫-৩০ বছর বয়সী অনাড়ম্বর একজন যুবক। তবে অনাড়ম্বর হলেও তার মধ্যে বেশ কিছু উদ্ভট আচরণ ছিল- যা সাধারণ থেকে তাকে করেছে আলাদা। কারো কাছে সেটা বিরক্তিকর আর কারো কাছে একদমই মহাপুরষ!

হিমু নিজেকে একজন অবিরাম হন্টক হিসেবে দাবি করে এবং তার একমাত্র কাজ রাত-বিরাতে ঘুরে বেড়ানো। প্রায়ই হিমু পার্কে এবং রাস্তায় রাত কাটায়। এ কারণে তাকে কয়েকবার সন্দেহভাজন হিসেবে কারাবাসও করতে হয় আর এই সুযোগে বিভিন্ন থানার অফিসারদের সাথে বেশ মজার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আবার অন্য দিকে কিছু খুনি-সন্ত্রাসীর সাথেও গড়ে ওঠে তার ভালো সখ্য।

হিমুর একটি বিশেষ গুণ হলো, যেকোনো পরিস্থিতিতেই সে স্বাভাবিক থাকতে পারে এবং খুব সহজেই মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। সুন্দর করে হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিমায় কথা বলাও তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে এসব হাস্যরসের মাঝে শহুরে ভ-ামির নানান দিক ফুটে ওঠার পাশাপাশি মানবজীবনের অন্তর্লীন বিষাদগ্রস্ততার চিত্রও খুব সহজেই ধরা দেয়। এ কারণে অনেক সময় হিমুকে অকর্মা যুবকও মনে হতে পারে। কিন্তু সে কখনো অন্যের অন্বিষ্ট করে না এবং দিন শেষে প্রতিটি উপন্যাসেই হিমুকে নিঃস্বার্থ এবং পরোপকারী হিসেবে দেখা যায়।

হিমুর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউই তাকে খুব ভালো চোখে দেখে না, তবে মাজেদা খালা ব্যতিক্রম। মাজেদা খালা হিমু সিরিজের বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র। এছাড়া হিমুর ফুপাতো ভাই বাদলকেও বিভিন্ন উপন্যাসে দেখতে পাওয়া যায়, যে কিনা হিমুর একান্ত ভক্তদের মধ্যে অন্যতম।

হিমু হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে হিমুর বাবার পর সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে হিমুর বান্ধবী রূপা। হিমুকে পছন্দ করে রূপা, হয়তোবা ভালোও বাসে। হিমুও যে রূপাকে অপছন্দ করে, তা নয়। মাঝে মাঝে রূপাকে কোনো এক দোকান থেকে ফোন করে নীল শাড়ি পরে তাদের বারান্দায় দাঁড়াতে বলে হিমু। রূপা তাই হিমুর জন্য অপেক্ষা থাকে। কিন্তু হিমু আসে না। রূপা তারপরও অবাক হয় না। বরং সে হিমুকে তার মেসে চিঠি পাঠায়, চিঠিতে একটুখানি অনুযোগ থাকে শুধু, আর কিছু না। হিমুর এমন উদ্ভটতায় রাগ করে না রূপা। এ জন্য হিমুর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে এই মহাপুুরুষগিরি ছেড়ে-ছুড়ে স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সেটা করা হয়ে ওঠে না। কারণ হিমুদের আবেগ গায়ে মাখতে নেই, হিমুদের ভালোবাসতে নেই। হিমুরা কাউকে ভালবাসে না।

হিমুরা কাউকে ভালো না বাসলেও অজস্র পাঠক হিমুকে ভালোবাসে। তাইতো হিমু চরিত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকেই এখনো হিমু হবার চেষ্টা করছে। আর এটাই হিমু চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ। কেননা হিমু শুধু বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, মিশে গেছে সাধারণ মানুষের সাথে। অনেকেই বলা নেই কওয়া নেই, হিমু হতে চায়! কিন্তু হিমু-স্রষ্টা আমাদের থেকে বিদায় নেওয়ায় হিমুর জীবনযাপনও যেন স্থির হয়েছে আছে। তাই হিমুর খালি পায়ে পরা হয়নি জুতো। হলুদ পাঞ্জাবিতে যুক্ত হয়নি পকেট।

হিমু-¯্রষ্টার প্রস্থান হয়েছে, কিন্তু হিমুর বিনাশ ঘটেনি, থেমে আছে হিমুর নগ্ন পায়ে চলাচল। তবে একজন হিমুর স্থিরতায় অজস্র হিমু আজ শহরের অলিতে-গলিতে দেখা যায়, মুধু শহর নয়, সুদূর গ্রামেও অনেক হিমুকে দেখা যায় পকেট বিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতে। এখনো বাড়ির ছাদে বিষণœ বদনে, উদাসী নয়নে অপেক্ষার আনন্দ উপভোগ করে নীল শাড়ি পরা রূপা।

এখানে এসে একটি প্রশ্ন রাখছি, পাঠকের কাছে কে বেশি প্রিয়? হিমু নাকি হুমায়ূন আহমেদ? হুমায়ূন আহমেদের এমন গগনস্পর্শী জনপ্রিয়তার নেপথ্যে হিমু চরিত্রের যে অনেক বড় ভূমিকা আছে সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু হিমুকে নিয়ে যে পাঠকের কৌতূহলের শেষ নেই। অনেক তরুণ এখনো হিমুকে অনুসরণ করে, হিমুর মতো হতে চায়। কিন্তু কেউ হুমায়ূন আহমেদ হতে চায় না।

আজ হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে নেই, কিন্তু তার সৃষ্ট চরিত্ররা বেঁচে আছে। কী আশ্চর্য় মেধা নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন! কী আশ্চর্য সম্মোহনী শক্তি ছিল তাঁর লেখায়, তাঁর সৃষ্ট কাল্পনিক সব চরিত্রের!

হুমায়ূন আহমেদ আর হিমু পাঠকের কাছে এক অপার ভালোবাসার নাম। দুজনেই পাঠকের মনের কোণে বহুদিন বেঁচে থাকবে এ কথা অকপটে বলে দেয়া যায়

back to top