alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিজয়ের মাস

বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনী

সাদেকুর রহমান

: বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩

একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর ছিল বুধবার, সময়ের পরিক্রমায় আজ শুক্রবার। এদিন পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ঢাকার দিকে পালাবার কোনো পথই হানাদার বাহিনীর সামনে খোলা ছিল না। একের সঙ্গে অন্যের যোগ দেয়ারও কোনো উপায় ছিল না। এই সুযোগে মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করে পুরো দখলদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। জেনারেল জগজিৎ সিংকে অন্তত তিনটি কলাম নিয়ে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য বলা হয় এবং একটি ব্রিগেডকে হালুয়াঘাটের দিক থেকে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয় বলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আর্কাইভে সংরক্ষিত তথ্যপুঞ্জি থেকে জানা যায়।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্যভান্ডার থেকে আরও জানা যায়, তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে এই আশ্বাস দেন যে, আত্মসমর্পণ করলে তাদের (পাকিস্তানি বাহিনী) প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। জেনারেল মানেকশর এই আহ্বান ভারতের রেডিও আকাশবানী থেকে নানা ভাষায় বারবার প্রচার করা হয়।

পূর্ব সীমান্ত থেকে জেনারেল জগৎ সিংয়ের প্রায় সবকটা বাহিনীই এখন দ্রুতগতিতে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি দল এগোচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করে ঢাকার দিকে। অপর একটি বাহিনী আশুগঞ্জের সেতুর দিকে এগোচ্ছিল।

৫৭তম ভারতীয় মাউন্টেন ডিভিশন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছায়। পাকিস্তানি বাহিনী এর আগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে চলে যায়। যুগপৎভাবে ‘এস-ফোর্স’ও বিনা বাধায় সরাইলে পৌঁছায়।

সন্ধ্যার মধ্যে একাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আশুগঞ্জের পূর্ব পাশে আজমপুর এবং দুর্গাপুরে সমাবেশ করে। সরাইল এবং শাহবাজপুরের মধ্যে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল এবং সেক্টরভুক্ত এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পেছন দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে। ভারতীয় ৩১১তম মাউন্টেন ব্রিগেডের দশম বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিণে সমবেত হয়। যৌথবাহিনীর এই অগ্রগতির ফলে পাকিস্তান সরকার ও তাদের মিত্রদেশগুলোর বুঝতে বাকি থাকে না যে, যুদ্ধে তাদের হার নিশ্চিত।

এদিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি পালন এবং সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে।

সাধারণ পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি শ্রী সমর সেন বলেন, ‘পাকিস্তানের অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে। উপমহাদেশে শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের কোন প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা যাবে না।’

এদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভারতীয় নৌবাহিনী ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক রাজধানী করাচীর নৌবন্দর আক্রমণ করে, যা ‘অপারেশন পাইথন’ নামে পরিচিত। যখন ভারতীয় সৈন্য বাহিনী এবং বিমান বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্থলসীমা অবরুদ্ধ করে রাখে তখন ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্রসীমা থেকে চাপ প্রয়োগ করার জন্য নৌযুদ্ধ শুরু করে। যেহেতু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের নৌ-বন্দর অরক্ষিত তাই পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনারা নৌবাহিনী ছাড়াই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ছিল অপ্রতিরোধ্য ভারতীয় বাহিনীকে প্রতিরোধের একটি ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন নৌবাহিনী বন্দরে থাকার পরিকল্পনা করে।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থে এ দিনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করেন এভাবে- ‘ভারতের চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এস এইচ এফ মানেকশ’ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থা লক্ষ্য করে মনস্তাত্বিক যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। তার ভাষণ বেতারে ঘন ঘন প্রচারিত হতে থাকে। তার বাণী প্রচারপত্রের মাধ্যমে বিমানের সহায়তায় পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর বিলি করা হয়। মানেকশ বলেন, ‘অস্ত্র সংরক্ষণ করো, নইলে মৃত্যু অবধারিত। যৌথবাহিনী তোমাদের চারদিকে ঘিরে ফেলেছে। তোমাদের বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস, ও দিয়ে আর কোনো সাহায্য পাবে না। বন্দরগুলোও এখন অবরুদ্ধ, তাই বাইরে থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা বৃথা। মুক্তিবাহিনী এবং জনগণ এখন প্রতিশোধ নিতে উদ্যত। তোমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। সময় থাকতে অস্ত্র সংবরণ করলে তোমাদের সৈনিকদের যোগ্য মর্যাদা দেয়া হবে।’

‘পূর্ব পাকিস্তান’ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট জেনারেল এ কে নিয়াজীর সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এম এ মালিক বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তার জবাব এসেছিল ৮ ডিসেম্বর। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক টেলেক্স বার্তায় যুদ্ধ অব্যাহত রাখার জন্য গভর্নরকে নির্দেশ দেন। এরপর কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে খানসেনারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাকবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিভিশন অকেজো হয়ে পড়ে। দেশের দক্ষিণে খুলনাতেও আটকে পড়ে খানসেনারা। উত্তরে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার মধ্যবর্তী বেশ কয়েকটি এলাকায় তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। জামালপুর, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রামেও শত্রুসেনারা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে।

যুক্তরাজ্যের ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ ৮ ডিসেম্বরের ঢাকার বর্ণনায় লিখেছেন, ‘সামনে এগিয়ে চলা ভারতীয় বাহিনীর কামানের গোলাবর্ষণের আওয়াজ এখন ঢাকা থেকে শোনা যাচ্ছে, সারাপৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ঢাকা। শুধু কয়েকটি টেলিফোন কাজ করছে এবং টেলিগ্রাফ মাঝে মধ্যে সচল হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, যেখানে আমি রয়েছি, সেখানকার বাগানে একদল লোক ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে।’

পত্রিকাটির অপর এক খবরে বলা হয়, ‘রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের এক সামরিক মুখপাত্র বলেছেন, পাকিস্তানি বাহিনী চমৎকারভাবে লড়ে চলেছে এবং যশোর ও সিলেটের পতনের খবর হচ্ছে ‘অবিশ্বাস্য রকম নির্লজ্জ মিথ্যাচার’।’

এদিনের কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য কাজী ফজলুর রহমান। তিনি তার ‘দিনলিপি একাত্তর’ শীর্ষক গ্রন্থে মেদহীন বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘ভারতীয় বেতার আর বিবিসি’র খবর-যশোর বিমান ঘাঁটি আর ক্যান্টনমেন্ট দুই-ই মিত্র বাহিনী দখল করে নিয়েছে। পাক সেনাদের হটিয়ে দেয়া হয়েছে সীমান্তের কাছাকাছি প্রায় সব জেলা ও মহকুমা শহর থেকে, তার মাঝে ফেনীও আছে। এক কথায় ‘পৃথিবীর সেরা সৈন্যবাহিনী’ মার খেয়ে কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে ঢাকার দিকে। এর মাঝে প্রায় প্রতিদিনই চট্টগ্রামে ভারতীয় বিমান হামলা হয়েছে। রেডিওতে শুনলাম, কলকাতা বা আগরতলা থেকে নয়, এই হামলা হচ্ছে ভারতীয় বিমান বাহিনীর রণতরি ‘ভীক্রান্ত’ থেকে। আজ পাকিস্তানি এন্টি-এয়ারক্র্যাফটের আওয়াজও তেমন শোনা যায়নি।... জাতিসংঘে ডিবেট চলছে। চীন তর্জন-গর্জন করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও পাকিস্তানের অখন্ডতার দোহাই দিচ্ছে, নানা প্যাঁচালো প্রস্তাব আনছে যুদ্ধবিরতির জন্য। সোভিয়েতের একনিষ্ঠ ও দৃঢ় সমর্থন না হলে ভারত একা চীনা-মার্কিন উদ্যোগ ঠেকিয়ে রাখতে পারত না। নানা বেতারের খবর শুনে তাই বোঝা যায়।’

এদিকে, অপ্রতিরোধ্য মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রায় এদিন হানাদার মুক্ত হয় মৌলভীবাজার, বরিশাল, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, পিরোজপুর, চট্টগ্রামের মীরসরাই, ময়মনসিংহের গৌরীপুরসহ বিভিন্ন এলাকা। মুক্ত জনপদবাসী বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে।

অন্যদিকে, অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এদিন মুজিবনগর থেকে দেয়া এক বেতার ভাষণে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত ও ভুটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কাছে আবেদন জানান।

একই সঙ্গে তিনি নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এই উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তাব তুলেছে, তাতে বোঝাই গেছে সংঘর্ষের মূলে সে পৌঁছায়নি। এর মূল কারণ বিষয়ে আমেরিকা চোখ বন্ধ করে আছে। এটা তার মানসিক বিকৃতির পরিচায়ক। চীন পাকিস্তানকে সবসময় বাংলাদেশে গণহত্যা চালাতে উসকানি দিয়েছে।’

[লেখক : সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিজয়ের মাস

বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনী

সাদেকুর রহমান

বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩

একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর ছিল বুধবার, সময়ের পরিক্রমায় আজ শুক্রবার। এদিন পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ঢাকার দিকে পালাবার কোনো পথই হানাদার বাহিনীর সামনে খোলা ছিল না। একের সঙ্গে অন্যের যোগ দেয়ারও কোনো উপায় ছিল না। এই সুযোগে মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করে পুরো দখলদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। জেনারেল জগজিৎ সিংকে অন্তত তিনটি কলাম নিয়ে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য বলা হয় এবং একটি ব্রিগেডকে হালুয়াঘাটের দিক থেকে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয় বলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আর্কাইভে সংরক্ষিত তথ্যপুঞ্জি থেকে জানা যায়।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্যভান্ডার থেকে আরও জানা যায়, তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে এই আশ্বাস দেন যে, আত্মসমর্পণ করলে তাদের (পাকিস্তানি বাহিনী) প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। জেনারেল মানেকশর এই আহ্বান ভারতের রেডিও আকাশবানী থেকে নানা ভাষায় বারবার প্রচার করা হয়।

পূর্ব সীমান্ত থেকে জেনারেল জগৎ সিংয়ের প্রায় সবকটা বাহিনীই এখন দ্রুতগতিতে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি দল এগোচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করে ঢাকার দিকে। অপর একটি বাহিনী আশুগঞ্জের সেতুর দিকে এগোচ্ছিল।

৫৭তম ভারতীয় মাউন্টেন ডিভিশন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছায়। পাকিস্তানি বাহিনী এর আগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে চলে যায়। যুগপৎভাবে ‘এস-ফোর্স’ও বিনা বাধায় সরাইলে পৌঁছায়।

সন্ধ্যার মধ্যে একাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আশুগঞ্জের পূর্ব পাশে আজমপুর এবং দুর্গাপুরে সমাবেশ করে। সরাইল এবং শাহবাজপুরের মধ্যে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল এবং সেক্টরভুক্ত এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পেছন দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে। ভারতীয় ৩১১তম মাউন্টেন ব্রিগেডের দশম বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিণে সমবেত হয়। যৌথবাহিনীর এই অগ্রগতির ফলে পাকিস্তান সরকার ও তাদের মিত্রদেশগুলোর বুঝতে বাকি থাকে না যে, যুদ্ধে তাদের হার নিশ্চিত।

এদিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি পালন এবং সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে।

সাধারণ পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি শ্রী সমর সেন বলেন, ‘পাকিস্তানের অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে। উপমহাদেশে শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের কোন প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা যাবে না।’

এদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভারতীয় নৌবাহিনী ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক রাজধানী করাচীর নৌবন্দর আক্রমণ করে, যা ‘অপারেশন পাইথন’ নামে পরিচিত। যখন ভারতীয় সৈন্য বাহিনী এবং বিমান বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্থলসীমা অবরুদ্ধ করে রাখে তখন ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্রসীমা থেকে চাপ প্রয়োগ করার জন্য নৌযুদ্ধ শুরু করে। যেহেতু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের নৌ-বন্দর অরক্ষিত তাই পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনারা নৌবাহিনী ছাড়াই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ছিল অপ্রতিরোধ্য ভারতীয় বাহিনীকে প্রতিরোধের একটি ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন নৌবাহিনী বন্দরে থাকার পরিকল্পনা করে।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থে এ দিনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করেন এভাবে- ‘ভারতের চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এস এইচ এফ মানেকশ’ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থা লক্ষ্য করে মনস্তাত্বিক যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। তার ভাষণ বেতারে ঘন ঘন প্রচারিত হতে থাকে। তার বাণী প্রচারপত্রের মাধ্যমে বিমানের সহায়তায় পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর বিলি করা হয়। মানেকশ বলেন, ‘অস্ত্র সংরক্ষণ করো, নইলে মৃত্যু অবধারিত। যৌথবাহিনী তোমাদের চারদিকে ঘিরে ফেলেছে। তোমাদের বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস, ও দিয়ে আর কোনো সাহায্য পাবে না। বন্দরগুলোও এখন অবরুদ্ধ, তাই বাইরে থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা বৃথা। মুক্তিবাহিনী এবং জনগণ এখন প্রতিশোধ নিতে উদ্যত। তোমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। সময় থাকতে অস্ত্র সংবরণ করলে তোমাদের সৈনিকদের যোগ্য মর্যাদা দেয়া হবে।’

‘পূর্ব পাকিস্তান’ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট জেনারেল এ কে নিয়াজীর সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এম এ মালিক বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তার জবাব এসেছিল ৮ ডিসেম্বর। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক টেলেক্স বার্তায় যুদ্ধ অব্যাহত রাখার জন্য গভর্নরকে নির্দেশ দেন। এরপর কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে খানসেনারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাকবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিভিশন অকেজো হয়ে পড়ে। দেশের দক্ষিণে খুলনাতেও আটকে পড়ে খানসেনারা। উত্তরে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার মধ্যবর্তী বেশ কয়েকটি এলাকায় তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। জামালপুর, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রামেও শত্রুসেনারা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে।

যুক্তরাজ্যের ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ ৮ ডিসেম্বরের ঢাকার বর্ণনায় লিখেছেন, ‘সামনে এগিয়ে চলা ভারতীয় বাহিনীর কামানের গোলাবর্ষণের আওয়াজ এখন ঢাকা থেকে শোনা যাচ্ছে, সারাপৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ঢাকা। শুধু কয়েকটি টেলিফোন কাজ করছে এবং টেলিগ্রাফ মাঝে মধ্যে সচল হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, যেখানে আমি রয়েছি, সেখানকার বাগানে একদল লোক ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে।’

পত্রিকাটির অপর এক খবরে বলা হয়, ‘রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের এক সামরিক মুখপাত্র বলেছেন, পাকিস্তানি বাহিনী চমৎকারভাবে লড়ে চলেছে এবং যশোর ও সিলেটের পতনের খবর হচ্ছে ‘অবিশ্বাস্য রকম নির্লজ্জ মিথ্যাচার’।’

এদিনের কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য কাজী ফজলুর রহমান। তিনি তার ‘দিনলিপি একাত্তর’ শীর্ষক গ্রন্থে মেদহীন বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘ভারতীয় বেতার আর বিবিসি’র খবর-যশোর বিমান ঘাঁটি আর ক্যান্টনমেন্ট দুই-ই মিত্র বাহিনী দখল করে নিয়েছে। পাক সেনাদের হটিয়ে দেয়া হয়েছে সীমান্তের কাছাকাছি প্রায় সব জেলা ও মহকুমা শহর থেকে, তার মাঝে ফেনীও আছে। এক কথায় ‘পৃথিবীর সেরা সৈন্যবাহিনী’ মার খেয়ে কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে ঢাকার দিকে। এর মাঝে প্রায় প্রতিদিনই চট্টগ্রামে ভারতীয় বিমান হামলা হয়েছে। রেডিওতে শুনলাম, কলকাতা বা আগরতলা থেকে নয়, এই হামলা হচ্ছে ভারতীয় বিমান বাহিনীর রণতরি ‘ভীক্রান্ত’ থেকে। আজ পাকিস্তানি এন্টি-এয়ারক্র্যাফটের আওয়াজও তেমন শোনা যায়নি।... জাতিসংঘে ডিবেট চলছে। চীন তর্জন-গর্জন করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও পাকিস্তানের অখন্ডতার দোহাই দিচ্ছে, নানা প্যাঁচালো প্রস্তাব আনছে যুদ্ধবিরতির জন্য। সোভিয়েতের একনিষ্ঠ ও দৃঢ় সমর্থন না হলে ভারত একা চীনা-মার্কিন উদ্যোগ ঠেকিয়ে রাখতে পারত না। নানা বেতারের খবর শুনে তাই বোঝা যায়।’

এদিকে, অপ্রতিরোধ্য মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রায় এদিন হানাদার মুক্ত হয় মৌলভীবাজার, বরিশাল, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, পিরোজপুর, চট্টগ্রামের মীরসরাই, ময়মনসিংহের গৌরীপুরসহ বিভিন্ন এলাকা। মুক্ত জনপদবাসী বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে।

অন্যদিকে, অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এদিন মুজিবনগর থেকে দেয়া এক বেতার ভাষণে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত ও ভুটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কাছে আবেদন জানান।

একই সঙ্গে তিনি নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এই উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তাব তুলেছে, তাতে বোঝাই গেছে সংঘর্ষের মূলে সে পৌঁছায়নি। এর মূল কারণ বিষয়ে আমেরিকা চোখ বন্ধ করে আছে। এটা তার মানসিক বিকৃতির পরিচায়ক। চীন পাকিস্তানকে সবসময় বাংলাদেশে গণহত্যা চালাতে উসকানি দিয়েছে।’

[লেখক : সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা]

back to top