কানন পুরকায়স্হ
আজারবাইজানের রাজধানী বাকু শহরে শুরু হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সম্মেলন, যাকে বলা হয় কনফারেন্স অব পার্টি বা কপ২৯। এই সম্মেলন চলবে ২২ নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত। প্রায় ১৯৮টি দেশ বা পার্টি এতে অংশগ্রহণ করার কথা। অনেকে বিস্মিত যে আজারবাইজানকে সম্মেলনের আমন্ত্রণকারী দেশ হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে; কারণ আজারবাইজানের শতকরা ৯০ ভাগ রপ্তানি আয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আসে এবং এর গ্রিনহাউস নির্গমন কমানোর যে পরিকল্পনা ইতোমধ্যে প্রদান করা হয়েছে তা অপর্যাপ্ত।
বস্তুত, জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির নিয়ম অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ এ বছর কপ২৯ আয়োজন করবে। রাশিয়া যখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোন দেশকে আমন্ত্রণকারী দেশ হিসেবে নির্বাচনে বাধা দেয়, তখন আজারবাইজানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করা হয়।
এদিকে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে অতিক্রম করার সম্ভাবনা লক্ষ্য করা গেছে, তাই অভিযোজন ও উপশম খাতে অর্থায়নের জন্য জলবায়ু তহবিলে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ কপ২৯ এর মূল লক্ষ্য। এ বিষয়ে যে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তাকে বলা হয়ে থাকে ‘ঘবি পড়ষষবপঃরাব য়ঁধহঃরঃধঃরাব মড়ড়ফ (ঘঈছএ)’। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে অধিক আয়ের দেশ নিম্ন আয়ের দেশকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো এবং অভিযোজন খাতে অর্থ জোগান দেবে, যা দান, লোন বা ব্যক্তিগত আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে হতে পারে। এ বিষয়ে ২০০৯ সালে যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তাকে পরিবর্তন করে নতুন লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হবে। নিম্ন আয়ের দেশগুলো ২০২৫ সাল থেকে প্রতি বছর এক ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়নের নিশ্চয়তা চেয়েছে। কে এই অর্থায়নে এগিয়ে আসবে এ নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে।
ইতোপূর্বে ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি সেই সব দেশ করেছে যেসব দেশ জাতিসংঘের তালিকায় শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়। এদিকে চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে এবং তারাও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের তালিকায় এগিয়ে। সঙ্গত কারণেই তাদের কীভাবে অর্থ জোগানদাতা দেশের তালিকায় আনা যায়, এনিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল জলবায়ু তহবিলের বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ২০২২ সালে বাইডেন প্রসাশন ‘ওহভষধঃরড়হ জবফঁপঃরড়হ অপঃ’ নামে একটি আইন অনুমোদন করেছিলেন। যে আইনের মাধ্যমে জলবায়ু সংক্রান্ত প্রকল্পে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা সম্ভব। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এ ধরনের তহবিলে অর্থ জোগানের বিপক্ষে।
এদিকে প্রস্তাব রয়েছে যে কার্বন কর আরোপের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির জোগানদাতা দেশকে জলবায়ু তহবিলে অর্থের দোকানের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এ ধরনের প্রস্তাবে আজারবাইজানের সরকার কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তা দেখার অপেক্ষায় অনেকেই আছেন।
বর্তমানে বিভিন্ন দেশের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অংশগ্রহণ (এনডিসি) থেকে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা ২.৬ থেকে ৩.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা সম্ভব, যা প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী অপর্যাপ্ত। কারণ, এই চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি থেকে ২.০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার কথা। একটি সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, আসামি ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিটি দেশ তাদের জলবায়ু পরিকল্পনা জাতিসংঘের কাছে জমা দেবে এবং ওই পরিকল্পনায় উল্লেখ থাকবে দেশগুলো কীভাবে তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকে কমিয়ে আনবে। কিন্তু এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে, জলবায়ু তহবিলের ওপর। আবার জলবায়ুর তহবিল নির্ভর করছে কোন কোন দেশকে অধিক আয়ের দেশ, শিল্পোন্নত দেশ এবং অধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে তার ওপর।
খসড়া কাগজপত্র পড়ে মনে হয় আজারবাইজান জলবায়ু অর্থায়নের দিকেই বিতর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাবে, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর দিকে নয়। এখানে উল্লেখ্য গত বছর দুবাইতে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে (কফ২৮) জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে এনে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিতকরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যাকে বলা হয়েছিল ‘ঞৎধহংরঃরড়হ ধধিু ভৎড়স ভড়ংংরষ ভঁবষং রহ বহবৎমু ঝুংঃবস’। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই চলমান জলবায়ু সম্মেলনে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর বিষয়টিকে বিবেচনা করা উচিত। এখানে উল্লেখ্য তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেল কি পেল না তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ। কারণ এর সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সরাসরি সম্পৃক্ত। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে এবং অনিশ্চয়তাও রয়েছে। এই বৈজ্ঞানিক অনিশ্চয়তার বিষয়টিকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। তাই জলবায়ু সম্মেলনের বিতর্ক থেকে তাপের উদ্গীরণ নয় বরং আমরা সমাধানের আলো দেখতে চাই।
[লেখক : যুক্তরাজ্যে কর্মরত বিজ্ঞান ও পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা ও অধ্যাপক]
কানন পুরকায়স্হ
বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
আজারবাইজানের রাজধানী বাকু শহরে শুরু হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সম্মেলন, যাকে বলা হয় কনফারেন্স অব পার্টি বা কপ২৯। এই সম্মেলন চলবে ২২ নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত। প্রায় ১৯৮টি দেশ বা পার্টি এতে অংশগ্রহণ করার কথা। অনেকে বিস্মিত যে আজারবাইজানকে সম্মেলনের আমন্ত্রণকারী দেশ হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে; কারণ আজারবাইজানের শতকরা ৯০ ভাগ রপ্তানি আয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আসে এবং এর গ্রিনহাউস নির্গমন কমানোর যে পরিকল্পনা ইতোমধ্যে প্রদান করা হয়েছে তা অপর্যাপ্ত।
বস্তুত, জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির নিয়ম অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ এ বছর কপ২৯ আয়োজন করবে। রাশিয়া যখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোন দেশকে আমন্ত্রণকারী দেশ হিসেবে নির্বাচনে বাধা দেয়, তখন আজারবাইজানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করা হয়।
এদিকে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে অতিক্রম করার সম্ভাবনা লক্ষ্য করা গেছে, তাই অভিযোজন ও উপশম খাতে অর্থায়নের জন্য জলবায়ু তহবিলে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ কপ২৯ এর মূল লক্ষ্য। এ বিষয়ে যে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তাকে বলা হয়ে থাকে ‘ঘবি পড়ষষবপঃরাব য়ঁধহঃরঃধঃরাব মড়ড়ফ (ঘঈছএ)’। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে অধিক আয়ের দেশ নিম্ন আয়ের দেশকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো এবং অভিযোজন খাতে অর্থ জোগান দেবে, যা দান, লোন বা ব্যক্তিগত আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে হতে পারে। এ বিষয়ে ২০০৯ সালে যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তাকে পরিবর্তন করে নতুন লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হবে। নিম্ন আয়ের দেশগুলো ২০২৫ সাল থেকে প্রতি বছর এক ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়নের নিশ্চয়তা চেয়েছে। কে এই অর্থায়নে এগিয়ে আসবে এ নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে।
ইতোপূর্বে ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি সেই সব দেশ করেছে যেসব দেশ জাতিসংঘের তালিকায় শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়। এদিকে চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে এবং তারাও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের তালিকায় এগিয়ে। সঙ্গত কারণেই তাদের কীভাবে অর্থ জোগানদাতা দেশের তালিকায় আনা যায়, এনিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল জলবায়ু তহবিলের বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ২০২২ সালে বাইডেন প্রসাশন ‘ওহভষধঃরড়হ জবফঁপঃরড়হ অপঃ’ নামে একটি আইন অনুমোদন করেছিলেন। যে আইনের মাধ্যমে জলবায়ু সংক্রান্ত প্রকল্পে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা সম্ভব। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এ ধরনের তহবিলে অর্থ জোগানের বিপক্ষে।
এদিকে প্রস্তাব রয়েছে যে কার্বন কর আরোপের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির জোগানদাতা দেশকে জলবায়ু তহবিলে অর্থের দোকানের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এ ধরনের প্রস্তাবে আজারবাইজানের সরকার কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তা দেখার অপেক্ষায় অনেকেই আছেন।
বর্তমানে বিভিন্ন দেশের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অংশগ্রহণ (এনডিসি) থেকে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা ২.৬ থেকে ৩.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা সম্ভব, যা প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী অপর্যাপ্ত। কারণ, এই চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি থেকে ২.০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার কথা। একটি সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, আসামি ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিটি দেশ তাদের জলবায়ু পরিকল্পনা জাতিসংঘের কাছে জমা দেবে এবং ওই পরিকল্পনায় উল্লেখ থাকবে দেশগুলো কীভাবে তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকে কমিয়ে আনবে। কিন্তু এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে, জলবায়ু তহবিলের ওপর। আবার জলবায়ুর তহবিল নির্ভর করছে কোন কোন দেশকে অধিক আয়ের দেশ, শিল্পোন্নত দেশ এবং অধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে তার ওপর।
খসড়া কাগজপত্র পড়ে মনে হয় আজারবাইজান জলবায়ু অর্থায়নের দিকেই বিতর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাবে, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর দিকে নয়। এখানে উল্লেখ্য গত বছর দুবাইতে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে (কফ২৮) জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে এনে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিতকরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যাকে বলা হয়েছিল ‘ঞৎধহংরঃরড়হ ধধিু ভৎড়স ভড়ংংরষ ভঁবষং রহ বহবৎমু ঝুংঃবস’। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই চলমান জলবায়ু সম্মেলনে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর বিষয়টিকে বিবেচনা করা উচিত। এখানে উল্লেখ্য তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেল কি পেল না তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ। কারণ এর সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সরাসরি সম্পৃক্ত। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে এবং অনিশ্চয়তাও রয়েছে। এই বৈজ্ঞানিক অনিশ্চয়তার বিষয়টিকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। তাই জলবায়ু সম্মেলনের বিতর্ক থেকে তাপের উদ্গীরণ নয় বরং আমরা সমাধানের আলো দেখতে চাই।
[লেখক : যুক্তরাজ্যে কর্মরত বিজ্ঞান ও পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা ও অধ্যাপক]