মিথুশিলাক মুরমু
দিন-দুয়েক আগে মোবাইলে কথা হচ্ছিল দিনাজপুর, বীরগঞ্জ উপজেলার কাশিমনগর আদিবাসী সাঁওতাল মুংলু বেসরার সঙ্গে। তার সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, সে সময় মুংলু ছিলেন নিজ পৈতৃক ভিটা কাশিমনগরের প্রবেশমুখ জামতলী বাজারে। জানালেন, ৭ আগস্ট নিজ ভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর এই প্রথম তিনি নাড়িপোতা কাশিমনগরে এসেছেন। ৭ আগস্ট দুর্বৃত্তরা তাকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে, লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। তার শোবারঘর, গরু-ছাগলের গোয়ালঘর, রান্নাঘর সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতাবানরা কলাগাছ লাগিয়েছে। সেদিন নিজের চোখে দেখলেন, বিশ^াস করতে কষ্ট হচ্ছিল। চোখের জল যেন শুকিয়ে গেছে, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বেড়েছে বৈ কমেনি। কলাগাছগুলো এখন বেশ বড় হয়েছে, বোঝার কোনো উপায় নেই, এখানে মাস-তিনেক আগে কোনো পরিবার ছিল। পরিবারে ছিল মুংলু বেসরা ও তার স্ত্রী, মুংলুর বাবা-মা এবং ছেলে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন; মাত্র দুই মাস আগেই ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তার মধ্যেই গত ৭ নভেম্বর তার লাগানো প্রায় সাড়ে পাঁচ বিঘা জমির ধানের মধ্যে অর্ধেকেই কেটে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। এসব দুর্বৃত্ত অচেনা কেউ নয়। ‘উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম’ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় থানা-পুলিশ এবং বিবাদমান দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ৯ নভেম্বর, ২০২৪ সালে বীরগঞ্জ থানায়। সাঁওতাল মুংলু বেসরা বাপ-দাদার জমিতে ধান লাগিয়েছে, এটি তার অধিকার, তারই জমি। আগস্ট ৭ তারিখের পরে নিজ গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়ায় আশ্রয় নেন দূরাত্মীয়ের বাড়িতে। এই সুযোগে মুংলুর পৈতৃক জমিতেও দৃৃষ্টি পড়ে দুর্বৃত্তদের। ধান পেকেছে, দেরি না করেই ধান কেটে ঘরে উঠিয়েছে তারা। বীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় মুংলুকে ৬০ ভাগ এবং দুর্বৃত্তদের ৪০ ভাগ জমির ধান দেয়ার মাধ্যমে ফয়সালা হয়েছে। জমির কাগজপত্র কোনো কিছুই দেখেননি বা জানার চেষ্টাও করেননি। মুংলু বলেছেন, তার হারানোর আর কিছু নেই। যা ছিল তা ইতোমধ্যে হারিয়েছেনÑ বসতভিটা, সহায়-সম্পদ সবকিছুই। গলার স্বর ভারি হয়ে আসছিল, ভারি গলায় বললেন, ‘আমি থাকি আত্মীয়ের বাড়িতে, আমার স্ত্রী থাকে আরেক জায়গায়, মা-বাবা থাকে অন্যত্র। এটা কি কোনো জীবন! কখনো কখনো মনে হয়, সবকিছু ছেড়ে দেশ ছেড়ে চলে যাই।’ তিনি বলেই চলেছেন, ‘সামনে শীতের দিন ঘনিয়ে আসছে, কোথায় থাকব, কোনো নিশ্চয়তা নেই। জানেন তো আদিবাসী সাঁওতালদের ঘরে কী ধরনের শীতবস্ত্র থাকে! কীভাবে এই শীত কাটাবে আমার পরিবার, ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছি না। ঘরও নেই, ন্যায়বিচারও পাচ্ছি না; তাহলে এ দেশে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো, বাধ্য হয়েই কী ভারতে চলে যাব!’
৫ আগস্ট দেশের পটপরিবর্তনের পর ৭ আগস্ট দলবদ্ধ লোকজন কাশিমনগর আদিবাসী সাঁওতাল পল্লীতে মারধর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। কাশিমনগর সাঁওতাল পল্লীতে দুর্বৃত্তরা আদিবাসীদের ছন ও টিনের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। কাশিমনগর সাঁওতাল পল্লী দুটি ভাগে বিভক্ত; একসঙ্গে রয়েছে প্রায় ৫০-৬০টি পরিবার ও সামান্য দূরে, অর্থাৎ ৮-১০ মিনিট হাঁটারাস্তা দূরে ৭টি পরিবারের অবস্থান। এই পরিবারগুলো থেকে অনতিদূরে পাকা রাস্তা বীরগঞ্জ থেকে দেবীগঞ্জের দিকে চলে গেছে। মুংলুর দগ্ধ বসতভিটাতে চিহ্নিত ক্ষমতাবানরা ট্র্যাক্টর এনে রীতিমতো চাষ করে এবং কলাগাছ রোপণ করে। বোঝার উপায় নেই এখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কোনো আদিবাসী পরিবার ঘর বেঁধে জীবনযাপন করতেন। শুধু মুংলু নয়, সেখানকার ৭টি পরিবারই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ৭ আগস্ট রাতে ২৫-৩০ জনের একটি দল কাশিমনগরের সাতটি সাঁওতাল আদিবাসী পরিবারকে উচ্ছেদ করতে রাতে ঘরের চালে পেট্রোল ছিটিয়ে দিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত লোকেরা সোম বেসরা, মুংলু বেসরা, রামু বেসরা ও রবি বেসরাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে। পেট্রোলের গন্ধ এবং আগুনের লেলিহানে বাঁশের শব্দে ঘুম ভেঙে পালিয়ে বাঁচতে চাইলেও রামু বেসরাকে ধরে সুপারিগাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক মারতে থাকে। মুংলু বেসরার ২টি গাভী, ১টি বাছুর, ৬টি ছাগল, ১টি শুকর লুট করে নিয়ে যায়। আদিবাসী পরিবারের কেউই রেহাই পাননি লুটপাট থেকে; গৃহপালিত পশুপাখি ছাড়াও মূল্যবান গাছ-গাছালিও কেটে নিয়ে যায়। আতঙ্কিত আদিবাসীরা প্রাণভয়ে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালিয়ে নিজেদের বাঁচিয়েছে। তা-ব চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ঘরের মূল্যবান আসবাব, কাগড়-চোপড়ও বাকি রাখেনি; সবকিছুই নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছিল। দুর্বৃত্তরা রামু বেসরাকে জোরপূর্বক সাদাকাগজে টিপসই করিয়ে ছেড়ে দেন, এটি কিসের জন্যে টিপসই; সেটির রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়নি। মুংলু বেসরা দূরবর্তী মামার বাড়িতে অবস্থান করছেন, অন্যরাও জীবন বাঁচাতে স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-কন্যা ও প্রবীণদের নিয়ে নিরাপদ স্থানকে বেছে নিয়েছিলেন। মুংলু বেসরা ১০ আগস্ট বীরগঞ্জ থানায় গিয়েছিলেন কিন্তু কোনো মামলা নেয়া হয়নি। অদ্যাবধি থানায় অভিযোগটি রয়েছে। অভিযোগে মুংলু উল্লেখ করেছিলেন, ‘বর্তমানে ২নং আসামি মো. ভোলা বিভিন্ন সময় আমারে মোবাইল ফোনে রিং করিয়া বলে যে, ‘ব্যাটা! এলাকায় আসিলে তোকে খুন করে তোর লাশ গায়েব করে দিব, লোক ঠিক করে রেখেছি, তোকে যেখানেই পাবে সেখানেই খুন করবে।’ প্রাণভয়ে পালিয়ে থাকা আদিবাসীরা কী তাদের পৈতৃক ভিটাতে ফিরে যেতে পারবে! যে মাটিতে পূর্বপুরুষদের নাড়িপোতা রয়েছে, অস্থিমজ্জা রয়েছে; মাটির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছে যুগ থেকে যুগান্তরে, আজ সেই মাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার বেদনা, রক্তক্ষরণকে উপলব্ধি করতে হয়। গ্রামের সোম বেসরা জানাচ্ছিলেন, কয়েক দিন হলো লুট করে নিয়ে যাওয়া ছাগল ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিছু লোক ফেরত দিয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি তবে নীরবে দিয়েই চলে গেছে। তবে এখনও আমাদের জমি দখল করে আছে। বর্ষা মৌসুমে ৬-৭ বিঘাতে ধান রোপণ করি, অনেক টাকা খরচ করেছি। বর্তমানে হিমু নামের একজন জমিগুলো দেখভাল করে আসছে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তার নিকটাত্মীয়। স্থানীয়দের ধারণা, এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা জমিজমা দখল, বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের নক্সার কলকাঠি নড়াচ্ছে। সেখানে বসবাসকারী বাকি ছয়টি আদিবাসী সাঁওতাল পরিবার এখন আতঙ্কে রয়েছেন, এই বুঝি আবারও উচ্ছেদ কিংবা মৃত্যুর মতো পরোয়ানা হাজির হয়। ঘটনার পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট’ (ব্লাস্ট) পক্ষে ব্যারিস্টার সারা হোসেনের নেতৃত্বে ১২-১৪ সদস্য একটি টিম সাঁওতাল পল্লী কাশিমনগর পরিদর্শন করেছেন। ব্লাস্ট ছাড়াও নাগরিক উদ্যোগের জাকির হোসেন, এলআরডির শামসুল হুদা, মাইনোরিটি রাইটস ফোরামের অ্যাডভোকেট উৎপল বিশ^াস, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম থেকে অ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু উপস্থিত হয়েছিলেন। মুংলু বেসরা বললেন, ‘আশায় আশায় বুক বেঁধে আছি কিন্তু ভাগ্যবিধাতা মনে হয় প্রসন্ন নন! বসতভিটা, পরিবার কিংবা জায়গা-জমির কোনো বিষয়ে কিছুই এগোয়নি। দিনে দিনে হতাশা আমাকে গ্রাস করে ফেলছে।’ কখনো কখনো উপলব্ধি হয় যে, সংখ্যালঘু হিসেবে জন্মগ্রহণ যেন অন্যের কৃপায় বেঁচে থাকা, অন্যের দয়ায় টিকে থাকা; একজন নাগরিক হিসেবে অধিকার ও সম্মান, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার কোনোই মূল্য নেই। গ্রামের প্রতিটি মানুষের অবয়বে রয়েছে অনিশ্চয়তা জীবনের হাতছানি। এভাবে তো থাকা যায় না, তারা ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করেছেন। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানে ব্যর্থ হওয়া শুধু অত্র এলাকার দায়বদ্ধতা নয়, সমগ্র দেশের নাগরিক এটির নৈতিক দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। গত ১০ নভেম্বর আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে আরও দুটি ঘটনা ঘটেছে।
প্রথমটিÑ ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলা সদরে; উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিংগু মুরমুকে উপজেলা চত্বরেই ক্ষমতাবানরা প্রকাশ্যে মারার হুমকি দিয়েছেন। জমি-সংক্রান্ত সংলাপে খোদ থানাতেই উচ্চাবাচ্চ্য এবং তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছে। দ্বিতীয়টিÑ রাজশাহীর তানোর উপজেলার গঙ্গারামপুর সাঁওতাল গ্রামে। এখানেও জমি-সংক্রান্ত বিবাদমান পক্ষদ্বয় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে মুখোমুখি হয়েছিলেন। আদিবাসী সাঁওতালদের পৈতৃক জায়গা-জমি দখলের পাঁয়তারা এবং শোডাউন সাঁওতালদের হৃদয়ে কম্পনের সৃষ্টি করেছে। দেশের পুলিশ এমনকি সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে দেশের নাগরিককে শারীরিক ও মানসিকভাবে অপদস্ত, হেনস্তা এমনকি রক্তপাতের ঘটনায় আমাদের আরও উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত করে তুলেছে। খোদ রাজধানীতে শত-সহ¯্র লোকের সম্মুখে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে নির্বিচারে লাঠিসোঁটা, স্যান্ডেল-জুতা কিংবা কিলঘুষি দিয়ে দমন-পীড়নের সংবাদ মুহূর্তের মধ্যেই গ্রাম-গ্রামান্তরে পৌঁছাচ্ছে। আর এতে করে নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় সাঁওতালসহ আদিবাসীরা উৎকণ্ঠিত, চিন্তিত এবং খুবই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিনীত আরজ, পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক ও নিরীহ আদিবাসীদের নিরাপত্তার বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করুন, দেশের মাটির সন্তানদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে দ্রুত ভূমিকা গ্রহণ করুন।
[লেখক: কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
দিন-দুয়েক আগে মোবাইলে কথা হচ্ছিল দিনাজপুর, বীরগঞ্জ উপজেলার কাশিমনগর আদিবাসী সাঁওতাল মুংলু বেসরার সঙ্গে। তার সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, সে সময় মুংলু ছিলেন নিজ পৈতৃক ভিটা কাশিমনগরের প্রবেশমুখ জামতলী বাজারে। জানালেন, ৭ আগস্ট নিজ ভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর এই প্রথম তিনি নাড়িপোতা কাশিমনগরে এসেছেন। ৭ আগস্ট দুর্বৃত্তরা তাকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে, লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। তার শোবারঘর, গরু-ছাগলের গোয়ালঘর, রান্নাঘর সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতাবানরা কলাগাছ লাগিয়েছে। সেদিন নিজের চোখে দেখলেন, বিশ^াস করতে কষ্ট হচ্ছিল। চোখের জল যেন শুকিয়ে গেছে, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বেড়েছে বৈ কমেনি। কলাগাছগুলো এখন বেশ বড় হয়েছে, বোঝার কোনো উপায় নেই, এখানে মাস-তিনেক আগে কোনো পরিবার ছিল। পরিবারে ছিল মুংলু বেসরা ও তার স্ত্রী, মুংলুর বাবা-মা এবং ছেলে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন; মাত্র দুই মাস আগেই ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তার মধ্যেই গত ৭ নভেম্বর তার লাগানো প্রায় সাড়ে পাঁচ বিঘা জমির ধানের মধ্যে অর্ধেকেই কেটে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। এসব দুর্বৃত্ত অচেনা কেউ নয়। ‘উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম’ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় থানা-পুলিশ এবং বিবাদমান দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ৯ নভেম্বর, ২০২৪ সালে বীরগঞ্জ থানায়। সাঁওতাল মুংলু বেসরা বাপ-দাদার জমিতে ধান লাগিয়েছে, এটি তার অধিকার, তারই জমি। আগস্ট ৭ তারিখের পরে নিজ গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়ায় আশ্রয় নেন দূরাত্মীয়ের বাড়িতে। এই সুযোগে মুংলুর পৈতৃক জমিতেও দৃৃষ্টি পড়ে দুর্বৃত্তদের। ধান পেকেছে, দেরি না করেই ধান কেটে ঘরে উঠিয়েছে তারা। বীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় মুংলুকে ৬০ ভাগ এবং দুর্বৃত্তদের ৪০ ভাগ জমির ধান দেয়ার মাধ্যমে ফয়সালা হয়েছে। জমির কাগজপত্র কোনো কিছুই দেখেননি বা জানার চেষ্টাও করেননি। মুংলু বলেছেন, তার হারানোর আর কিছু নেই। যা ছিল তা ইতোমধ্যে হারিয়েছেনÑ বসতভিটা, সহায়-সম্পদ সবকিছুই। গলার স্বর ভারি হয়ে আসছিল, ভারি গলায় বললেন, ‘আমি থাকি আত্মীয়ের বাড়িতে, আমার স্ত্রী থাকে আরেক জায়গায়, মা-বাবা থাকে অন্যত্র। এটা কি কোনো জীবন! কখনো কখনো মনে হয়, সবকিছু ছেড়ে দেশ ছেড়ে চলে যাই।’ তিনি বলেই চলেছেন, ‘সামনে শীতের দিন ঘনিয়ে আসছে, কোথায় থাকব, কোনো নিশ্চয়তা নেই। জানেন তো আদিবাসী সাঁওতালদের ঘরে কী ধরনের শীতবস্ত্র থাকে! কীভাবে এই শীত কাটাবে আমার পরিবার, ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছি না। ঘরও নেই, ন্যায়বিচারও পাচ্ছি না; তাহলে এ দেশে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো, বাধ্য হয়েই কী ভারতে চলে যাব!’
৫ আগস্ট দেশের পটপরিবর্তনের পর ৭ আগস্ট দলবদ্ধ লোকজন কাশিমনগর আদিবাসী সাঁওতাল পল্লীতে মারধর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। কাশিমনগর সাঁওতাল পল্লীতে দুর্বৃত্তরা আদিবাসীদের ছন ও টিনের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। কাশিমনগর সাঁওতাল পল্লী দুটি ভাগে বিভক্ত; একসঙ্গে রয়েছে প্রায় ৫০-৬০টি পরিবার ও সামান্য দূরে, অর্থাৎ ৮-১০ মিনিট হাঁটারাস্তা দূরে ৭টি পরিবারের অবস্থান। এই পরিবারগুলো থেকে অনতিদূরে পাকা রাস্তা বীরগঞ্জ থেকে দেবীগঞ্জের দিকে চলে গেছে। মুংলুর দগ্ধ বসতভিটাতে চিহ্নিত ক্ষমতাবানরা ট্র্যাক্টর এনে রীতিমতো চাষ করে এবং কলাগাছ রোপণ করে। বোঝার উপায় নেই এখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কোনো আদিবাসী পরিবার ঘর বেঁধে জীবনযাপন করতেন। শুধু মুংলু নয়, সেখানকার ৭টি পরিবারই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ৭ আগস্ট রাতে ২৫-৩০ জনের একটি দল কাশিমনগরের সাতটি সাঁওতাল আদিবাসী পরিবারকে উচ্ছেদ করতে রাতে ঘরের চালে পেট্রোল ছিটিয়ে দিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত লোকেরা সোম বেসরা, মুংলু বেসরা, রামু বেসরা ও রবি বেসরাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে। পেট্রোলের গন্ধ এবং আগুনের লেলিহানে বাঁশের শব্দে ঘুম ভেঙে পালিয়ে বাঁচতে চাইলেও রামু বেসরাকে ধরে সুপারিগাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক মারতে থাকে। মুংলু বেসরার ২টি গাভী, ১টি বাছুর, ৬টি ছাগল, ১টি শুকর লুট করে নিয়ে যায়। আদিবাসী পরিবারের কেউই রেহাই পাননি লুটপাট থেকে; গৃহপালিত পশুপাখি ছাড়াও মূল্যবান গাছ-গাছালিও কেটে নিয়ে যায়। আতঙ্কিত আদিবাসীরা প্রাণভয়ে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালিয়ে নিজেদের বাঁচিয়েছে। তা-ব চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ঘরের মূল্যবান আসবাব, কাগড়-চোপড়ও বাকি রাখেনি; সবকিছুই নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছিল। দুর্বৃত্তরা রামু বেসরাকে জোরপূর্বক সাদাকাগজে টিপসই করিয়ে ছেড়ে দেন, এটি কিসের জন্যে টিপসই; সেটির রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়নি। মুংলু বেসরা দূরবর্তী মামার বাড়িতে অবস্থান করছেন, অন্যরাও জীবন বাঁচাতে স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-কন্যা ও প্রবীণদের নিয়ে নিরাপদ স্থানকে বেছে নিয়েছিলেন। মুংলু বেসরা ১০ আগস্ট বীরগঞ্জ থানায় গিয়েছিলেন কিন্তু কোনো মামলা নেয়া হয়নি। অদ্যাবধি থানায় অভিযোগটি রয়েছে। অভিযোগে মুংলু উল্লেখ করেছিলেন, ‘বর্তমানে ২নং আসামি মো. ভোলা বিভিন্ন সময় আমারে মোবাইল ফোনে রিং করিয়া বলে যে, ‘ব্যাটা! এলাকায় আসিলে তোকে খুন করে তোর লাশ গায়েব করে দিব, লোক ঠিক করে রেখেছি, তোকে যেখানেই পাবে সেখানেই খুন করবে।’ প্রাণভয়ে পালিয়ে থাকা আদিবাসীরা কী তাদের পৈতৃক ভিটাতে ফিরে যেতে পারবে! যে মাটিতে পূর্বপুরুষদের নাড়িপোতা রয়েছে, অস্থিমজ্জা রয়েছে; মাটির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছে যুগ থেকে যুগান্তরে, আজ সেই মাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার বেদনা, রক্তক্ষরণকে উপলব্ধি করতে হয়। গ্রামের সোম বেসরা জানাচ্ছিলেন, কয়েক দিন হলো লুট করে নিয়ে যাওয়া ছাগল ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিছু লোক ফেরত দিয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি তবে নীরবে দিয়েই চলে গেছে। তবে এখনও আমাদের জমি দখল করে আছে। বর্ষা মৌসুমে ৬-৭ বিঘাতে ধান রোপণ করি, অনেক টাকা খরচ করেছি। বর্তমানে হিমু নামের একজন জমিগুলো দেখভাল করে আসছে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তার নিকটাত্মীয়। স্থানীয়দের ধারণা, এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা জমিজমা দখল, বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের নক্সার কলকাঠি নড়াচ্ছে। সেখানে বসবাসকারী বাকি ছয়টি আদিবাসী সাঁওতাল পরিবার এখন আতঙ্কে রয়েছেন, এই বুঝি আবারও উচ্ছেদ কিংবা মৃত্যুর মতো পরোয়ানা হাজির হয়। ঘটনার পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট’ (ব্লাস্ট) পক্ষে ব্যারিস্টার সারা হোসেনের নেতৃত্বে ১২-১৪ সদস্য একটি টিম সাঁওতাল পল্লী কাশিমনগর পরিদর্শন করেছেন। ব্লাস্ট ছাড়াও নাগরিক উদ্যোগের জাকির হোসেন, এলআরডির শামসুল হুদা, মাইনোরিটি রাইটস ফোরামের অ্যাডভোকেট উৎপল বিশ^াস, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম থেকে অ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু উপস্থিত হয়েছিলেন। মুংলু বেসরা বললেন, ‘আশায় আশায় বুক বেঁধে আছি কিন্তু ভাগ্যবিধাতা মনে হয় প্রসন্ন নন! বসতভিটা, পরিবার কিংবা জায়গা-জমির কোনো বিষয়ে কিছুই এগোয়নি। দিনে দিনে হতাশা আমাকে গ্রাস করে ফেলছে।’ কখনো কখনো উপলব্ধি হয় যে, সংখ্যালঘু হিসেবে জন্মগ্রহণ যেন অন্যের কৃপায় বেঁচে থাকা, অন্যের দয়ায় টিকে থাকা; একজন নাগরিক হিসেবে অধিকার ও সম্মান, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার কোনোই মূল্য নেই। গ্রামের প্রতিটি মানুষের অবয়বে রয়েছে অনিশ্চয়তা জীবনের হাতছানি। এভাবে তো থাকা যায় না, তারা ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করেছেন। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানে ব্যর্থ হওয়া শুধু অত্র এলাকার দায়বদ্ধতা নয়, সমগ্র দেশের নাগরিক এটির নৈতিক দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। গত ১০ নভেম্বর আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে আরও দুটি ঘটনা ঘটেছে।
প্রথমটিÑ ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলা সদরে; উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিংগু মুরমুকে উপজেলা চত্বরেই ক্ষমতাবানরা প্রকাশ্যে মারার হুমকি দিয়েছেন। জমি-সংক্রান্ত সংলাপে খোদ থানাতেই উচ্চাবাচ্চ্য এবং তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছে। দ্বিতীয়টিÑ রাজশাহীর তানোর উপজেলার গঙ্গারামপুর সাঁওতাল গ্রামে। এখানেও জমি-সংক্রান্ত বিবাদমান পক্ষদ্বয় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে মুখোমুখি হয়েছিলেন। আদিবাসী সাঁওতালদের পৈতৃক জায়গা-জমি দখলের পাঁয়তারা এবং শোডাউন সাঁওতালদের হৃদয়ে কম্পনের সৃষ্টি করেছে। দেশের পুলিশ এমনকি সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে দেশের নাগরিককে শারীরিক ও মানসিকভাবে অপদস্ত, হেনস্তা এমনকি রক্তপাতের ঘটনায় আমাদের আরও উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত করে তুলেছে। খোদ রাজধানীতে শত-সহ¯্র লোকের সম্মুখে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে নির্বিচারে লাঠিসোঁটা, স্যান্ডেল-জুতা কিংবা কিলঘুষি দিয়ে দমন-পীড়নের সংবাদ মুহূর্তের মধ্যেই গ্রাম-গ্রামান্তরে পৌঁছাচ্ছে। আর এতে করে নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় সাঁওতালসহ আদিবাসীরা উৎকণ্ঠিত, চিন্তিত এবং খুবই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিনীত আরজ, পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক ও নিরীহ আদিবাসীদের নিরাপত্তার বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করুন, দেশের মাটির সন্তানদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে দ্রুত ভূমিকা গ্রহণ করুন।
[লেখক: কলামিস্ট]