এম এ হোসাইন
ডনাল্ড ট্রাম্প যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন, তখন মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার জন্য নতুন উদ্যম দেখাচ্ছেন। এই প্রতিক্রিয়া আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের মধ্যে ট্রাম্পের নীতির পূর্বানুমানযোগ্যতাকে পছন্দ করার একটি দৃষ্টান্তকে তুলে ধরে, যা বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিপরীতে কাজ করবে। জো বাইডেনের মেয়াদ মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত এবং জোটের নিস্ক্রিয়তা দ্বারা চিহ্নিত হলেও, ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন এই অঞ্চলে আরও পরিচিত ঐতিহাসিক মার্কিন নীতির প্রত্যাশা নিয়ে আসবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যে গাজা এবং লেবাননের যুদ্ধ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক শিপিং লেনে বাধা দেয়া ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের সক্রিয়তা পর্যন্ত অসংখ্য সংঘাত প্রত্যক্ষ করা গেছে। বাইডেনের প্রথম দিকের পদক্ষেপগুলো, যেমন উপসাগরীয় মিত্রদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করা এবং ঐতিহ্যবাহী অংশীদারদের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করা, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৎক্ষণাৎ উত্তেজনাপূর্ণ করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, বাইডেনের ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী তালিকা থেকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত এবং পরে তাদের পুনরায় তালিকাভুক্ত করা সমালোচিত হয়েছিল, কারণ হুথিরা তখনও রেড সি এবং তার বাইরেও জাহাজে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল।
এই নীতিগুলো অনেক উপসাগরীয় দেশের মধ্যে মার্কিন নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি করেছিল, বিশেষ করে ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আকস্মিক প্রত্যাহারের পর। বাইডেনের এই টানাপোড়েন মেরামত করার প্রচেষ্টা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের দ্বারা ছাপিয়ে গিয়েছিল, যার মধ্যে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাত এবং অন্যান্য চলমান আঞ্চলিক উত্তেজনা উল্লেখযোগ্য।
উপসাগরীয় নেতাদের জন্য, ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন তার প্রথম মেয়াদে লালিত ইতিবাচক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার একটি সুযোগ নির্দেশ করে। ট্রাম্পের অবস্থান ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে চলমান গাজা এবং লেবানন সংঘাতের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য কূটনৈতিক চাপের সৃষ্টি করবে। ট্রাম্পের ২০১৭ সালে সৌদি আরবকে তার প্রথম সরকারি বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে বেছে নেয়া এবং ইরানের প্রভাবের বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থান উপসাগরীয় নেতাদের মধ্যে একটি স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে চলমান সহযোগিতার আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো এবং সুদানের মধ্যে শান্তি চুক্তি সম্পাদনের জন্য আব্রাহাম চুক্তির অধীনে দুই দেশের ঐতিহাসিক সামঞ্জস্যকে জোর দিয়েছেন।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়া এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাইডেন সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করলেও, ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের ইসরায়েলে হামলা এবং এর পরবর্তী গাজায় সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞে এই প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়। গাজা এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের কঠোর নীতিগুলো আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে আরও জটিল করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর এবং জর্ডানের মতো দেশগুলো ইসরায়েলের কর্মকা- এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপাত নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
নেতানিয়াহুর সরকারের উগ্র ডানপন্থী শরিকরা শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে, যা সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে বাধাগ্রস্ত করছে। তবে, ট্রাম্প পূর্বে নেতানিয়াহুকে গাজা সংঘাত সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং লেবাননে শান্তি আলোচনা পরিচালনার পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের প্রভাব নেতানিয়াহুকে এই অঞ্চলের যুদ্ধ শেষ করার দিকে মনোযোগী করতে উৎসাহিত করতে পারে, যাতে মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্ক ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে উপসাগরীয় দেশগুলো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তার সীমাবদ্ধতার প্রতিক্রিয়ায় একটি পরিবর্তনের প্রতিফলন। উপসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিশেষভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে ২০২৩ সালে সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে ঐতিহাসিক পুনর্মিলন ঘটানোর পর। এটি সরাসরি সংঘাত হ্রাস এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করেছে। এটি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে উচ্চ-উত্তেজনার সময় থেকে একটি পরিবর্তন নির্দেশ করে, যখন ইরানি বাহিনী সৌদির তেল অবকাঠামোতে হামলা চালায় এবং বাইডেনের শাসনামলে হুথিরা আবুধাবিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়েছিল। উভয় ক্ষেত্রেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়ার অভাব উপসাগরীয় দেশগুলোকে তাদের অংশীদারিত্ব বহুমাত্রিক করার জন্য উৎসাহিত করেছিল।
চীনের দিকে এই ঝোঁক ঐতিহ্যবাহী মার্কিন-উপসাগরীয় নিরাপত্তাব্যবস্থার থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে উপসাগরীয় দেশগুলো জ্বালানি সম্পদে প্রবেশাধিকার প্রদান করত এবং এর বিনিময়ে মার্কিন সামরিক সুরক্ষা পেত। বর্তমানে উপসাগরীয় দেশগুলো আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকিগুলো মোকাবিলার জন্য চীনের সঙ্গে আরও বিস্তৃত নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের সন্ধান করছে।
লেবানন-ইসরায়েল সংঘাত ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। লেবাননে স্থিতিশীলতা আনার জন্য ট্রাম্পের লক্ষ্য হলো একটি জটিল পরিবেশের মধ্য দিয়ে কাজ করা, যেখানে লেবাননের অর্থনৈতিক পতন, অকার্যকর শাসনব্যবস্থা, এবং ইসরায়েলি হস্তক্ষেপ দ্বারা উসকে দেয়া রাজনৈতিক উত্তেজনা বিদ্যমান। লেবাননের নেতারা, যাদের মধ্যে হিজবুল্লাহ এবং হিজবুল্লাহ বিরোধী গোষ্ঠীগুলো রয়েছে, সতর্কভাবে আশাবাদী যে ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘায়িত সংঘাতের পরিবর্তে শান্তি প্রচেষ্টায় মনোনিবেশ করবে। আরব-আমেরিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন, যা তার মেয়ের শ্বশুর ম্যাসাদ বুলোসের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। এই সমর্থন লেবাননে শান্তি এবং স্থিতিশীলতার প্রতি প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত দেয়।
তাছাড়া ট্রাম্প বাইডেনের ইরাক চুক্তি উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করবেন, যা আইএসআইএসের বিরুদ্ধে লড়াই শেষ করার জন্য আন্তর্জাতিক জোটের প্রত্যাহারের পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও ট্রাম্প পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি হ্রাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, তবে পেন্টাগনের প্রাক্তন কর্মকর্তা ডানা স্ট্রোলসহ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে একটি তাড়াহুড়ো করে প্রত্যাহার সিরিয়া এবং ইরাকে আইএসআইএস বিরোধী কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রচেষ্টা বাড়িয়েছে, যা আইএসআইএসের বিদ্যমান হুমকির প্রতি ইঙ্গিত করে।
ট্রাম্প সম্ভবত সিরিয়ার আসাদ সরকারের সঙ্গে আলোচনার নতুন প্রচেষ্টা শুরু করবেন, যা আমেরিকান বন্দীদের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে, যদিও আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা মার্কিন আইনের অধীনে নিষিদ্ধ। তবে আসাদ সরকারের সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য ট্রাম্পের ইচ্ছা, যা লেবাননে ইরানের প্রভাব হ্রাস এবং ক্যাপটাগন পাচার সীমিত করতে পারে। এই পদক্ষেপের ফলে সিরিয়া সম্পর্কে ট্রাম্পের একটি বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে। আরব লিগ সম্প্রতি আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় এই অঞ্চলের মনোভাবের পরিবর্তনকে তুলে ধরেছে, যদিও ট্রাম্প এই সম্পর্কগুলো ইরানের অস্থিতিশীল প্রভাব মোকাবিলার জন্য কাজে লাগাতে পারেন।
ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করার সঙ্গে, মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা তার প্রশাসনের দিকে এক ধরনের আশাবাদ এবং সতর্কতামূলক পন্থার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে আছে। উপসাগরীয় দেশগুলো ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের দৃঢ় মৈত্রী পুনরুদ্ধারে আগ্রহী, তবে লেবানন, ইরাক এবং সিরিয়ার মতো দেশগুলো জটিল বাধার কথাও মনে করিয়ে দেয়। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ কৌশল, যা জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এবং মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলার নীতিমালাটি তার দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক নীতির একটি প্রধান দিক।
তবে ট্রাম্পের সাফল্য নির্ভর করবে তার পক্ষে শান্তি চুক্তি নিশ্চিত করা, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনয়ন, উপসাগরীয় মিত্র এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সম্পর্ক পরিচালনার দক্ষতার ওপর। উপসাগরীয় দেশগুলো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই পুনর্গঠিত আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এবং কৌশলগত স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। এই অঞ্চলটি এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছে যেখানে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির সিদ্ধান্ত পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য মার্কিন-মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণ করবে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]
এম এ হোসাইন
শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪
ডনাল্ড ট্রাম্প যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন, তখন মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার জন্য নতুন উদ্যম দেখাচ্ছেন। এই প্রতিক্রিয়া আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের মধ্যে ট্রাম্পের নীতির পূর্বানুমানযোগ্যতাকে পছন্দ করার একটি দৃষ্টান্তকে তুলে ধরে, যা বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিপরীতে কাজ করবে। জো বাইডেনের মেয়াদ মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত এবং জোটের নিস্ক্রিয়তা দ্বারা চিহ্নিত হলেও, ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন এই অঞ্চলে আরও পরিচিত ঐতিহাসিক মার্কিন নীতির প্রত্যাশা নিয়ে আসবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যে গাজা এবং লেবাননের যুদ্ধ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক শিপিং লেনে বাধা দেয়া ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের সক্রিয়তা পর্যন্ত অসংখ্য সংঘাত প্রত্যক্ষ করা গেছে। বাইডেনের প্রথম দিকের পদক্ষেপগুলো, যেমন উপসাগরীয় মিত্রদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করা এবং ঐতিহ্যবাহী অংশীদারদের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করা, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৎক্ষণাৎ উত্তেজনাপূর্ণ করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, বাইডেনের ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী তালিকা থেকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত এবং পরে তাদের পুনরায় তালিকাভুক্ত করা সমালোচিত হয়েছিল, কারণ হুথিরা তখনও রেড সি এবং তার বাইরেও জাহাজে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল।
এই নীতিগুলো অনেক উপসাগরীয় দেশের মধ্যে মার্কিন নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি করেছিল, বিশেষ করে ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আকস্মিক প্রত্যাহারের পর। বাইডেনের এই টানাপোড়েন মেরামত করার প্রচেষ্টা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের দ্বারা ছাপিয়ে গিয়েছিল, যার মধ্যে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাত এবং অন্যান্য চলমান আঞ্চলিক উত্তেজনা উল্লেখযোগ্য।
উপসাগরীয় নেতাদের জন্য, ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন তার প্রথম মেয়াদে লালিত ইতিবাচক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার একটি সুযোগ নির্দেশ করে। ট্রাম্পের অবস্থান ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে চলমান গাজা এবং লেবানন সংঘাতের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য কূটনৈতিক চাপের সৃষ্টি করবে। ট্রাম্পের ২০১৭ সালে সৌদি আরবকে তার প্রথম সরকারি বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে বেছে নেয়া এবং ইরানের প্রভাবের বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থান উপসাগরীয় নেতাদের মধ্যে একটি স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে চলমান সহযোগিতার আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো এবং সুদানের মধ্যে শান্তি চুক্তি সম্পাদনের জন্য আব্রাহাম চুক্তির অধীনে দুই দেশের ঐতিহাসিক সামঞ্জস্যকে জোর দিয়েছেন।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়া এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাইডেন সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করলেও, ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের ইসরায়েলে হামলা এবং এর পরবর্তী গাজায় সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞে এই প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়। গাজা এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের কঠোর নীতিগুলো আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে আরও জটিল করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর এবং জর্ডানের মতো দেশগুলো ইসরায়েলের কর্মকা- এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপাত নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
নেতানিয়াহুর সরকারের উগ্র ডানপন্থী শরিকরা শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে, যা সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে বাধাগ্রস্ত করছে। তবে, ট্রাম্প পূর্বে নেতানিয়াহুকে গাজা সংঘাত সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং লেবাননে শান্তি আলোচনা পরিচালনার পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের প্রভাব নেতানিয়াহুকে এই অঞ্চলের যুদ্ধ শেষ করার দিকে মনোযোগী করতে উৎসাহিত করতে পারে, যাতে মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্ক ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে উপসাগরীয় দেশগুলো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তার সীমাবদ্ধতার প্রতিক্রিয়ায় একটি পরিবর্তনের প্রতিফলন। উপসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিশেষভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে ২০২৩ সালে সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে ঐতিহাসিক পুনর্মিলন ঘটানোর পর। এটি সরাসরি সংঘাত হ্রাস এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করেছে। এটি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে উচ্চ-উত্তেজনার সময় থেকে একটি পরিবর্তন নির্দেশ করে, যখন ইরানি বাহিনী সৌদির তেল অবকাঠামোতে হামলা চালায় এবং বাইডেনের শাসনামলে হুথিরা আবুধাবিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়েছিল। উভয় ক্ষেত্রেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়ার অভাব উপসাগরীয় দেশগুলোকে তাদের অংশীদারিত্ব বহুমাত্রিক করার জন্য উৎসাহিত করেছিল।
চীনের দিকে এই ঝোঁক ঐতিহ্যবাহী মার্কিন-উপসাগরীয় নিরাপত্তাব্যবস্থার থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে উপসাগরীয় দেশগুলো জ্বালানি সম্পদে প্রবেশাধিকার প্রদান করত এবং এর বিনিময়ে মার্কিন সামরিক সুরক্ষা পেত। বর্তমানে উপসাগরীয় দেশগুলো আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকিগুলো মোকাবিলার জন্য চীনের সঙ্গে আরও বিস্তৃত নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের সন্ধান করছে।
লেবানন-ইসরায়েল সংঘাত ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। লেবাননে স্থিতিশীলতা আনার জন্য ট্রাম্পের লক্ষ্য হলো একটি জটিল পরিবেশের মধ্য দিয়ে কাজ করা, যেখানে লেবাননের অর্থনৈতিক পতন, অকার্যকর শাসনব্যবস্থা, এবং ইসরায়েলি হস্তক্ষেপ দ্বারা উসকে দেয়া রাজনৈতিক উত্তেজনা বিদ্যমান। লেবাননের নেতারা, যাদের মধ্যে হিজবুল্লাহ এবং হিজবুল্লাহ বিরোধী গোষ্ঠীগুলো রয়েছে, সতর্কভাবে আশাবাদী যে ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘায়িত সংঘাতের পরিবর্তে শান্তি প্রচেষ্টায় মনোনিবেশ করবে। আরব-আমেরিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন, যা তার মেয়ের শ্বশুর ম্যাসাদ বুলোসের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। এই সমর্থন লেবাননে শান্তি এবং স্থিতিশীলতার প্রতি প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত দেয়।
তাছাড়া ট্রাম্প বাইডেনের ইরাক চুক্তি উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করবেন, যা আইএসআইএসের বিরুদ্ধে লড়াই শেষ করার জন্য আন্তর্জাতিক জোটের প্রত্যাহারের পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও ট্রাম্প পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি হ্রাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, তবে পেন্টাগনের প্রাক্তন কর্মকর্তা ডানা স্ট্রোলসহ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে একটি তাড়াহুড়ো করে প্রত্যাহার সিরিয়া এবং ইরাকে আইএসআইএস বিরোধী কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রচেষ্টা বাড়িয়েছে, যা আইএসআইএসের বিদ্যমান হুমকির প্রতি ইঙ্গিত করে।
ট্রাম্প সম্ভবত সিরিয়ার আসাদ সরকারের সঙ্গে আলোচনার নতুন প্রচেষ্টা শুরু করবেন, যা আমেরিকান বন্দীদের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে, যদিও আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা মার্কিন আইনের অধীনে নিষিদ্ধ। তবে আসাদ সরকারের সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য ট্রাম্পের ইচ্ছা, যা লেবাননে ইরানের প্রভাব হ্রাস এবং ক্যাপটাগন পাচার সীমিত করতে পারে। এই পদক্ষেপের ফলে সিরিয়া সম্পর্কে ট্রাম্পের একটি বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে। আরব লিগ সম্প্রতি আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় এই অঞ্চলের মনোভাবের পরিবর্তনকে তুলে ধরেছে, যদিও ট্রাম্প এই সম্পর্কগুলো ইরানের অস্থিতিশীল প্রভাব মোকাবিলার জন্য কাজে লাগাতে পারেন।
ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করার সঙ্গে, মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা তার প্রশাসনের দিকে এক ধরনের আশাবাদ এবং সতর্কতামূলক পন্থার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে আছে। উপসাগরীয় দেশগুলো ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের দৃঢ় মৈত্রী পুনরুদ্ধারে আগ্রহী, তবে লেবানন, ইরাক এবং সিরিয়ার মতো দেশগুলো জটিল বাধার কথাও মনে করিয়ে দেয়। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ কৌশল, যা জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এবং মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলার নীতিমালাটি তার দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক নীতির একটি প্রধান দিক।
তবে ট্রাম্পের সাফল্য নির্ভর করবে তার পক্ষে শান্তি চুক্তি নিশ্চিত করা, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনয়ন, উপসাগরীয় মিত্র এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সম্পর্ক পরিচালনার দক্ষতার ওপর। উপসাগরীয় দেশগুলো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই পুনর্গঠিত আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এবং কৌশলগত স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। এই অঞ্চলটি এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছে যেখানে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির সিদ্ধান্ত পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য মার্কিন-মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণ করবে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]