মোহাম্মদ আবু নোমান
ফিলিস্তিনের গাজার শিশুরা উপরের দিকে মুখ তুলে তাকাতেও শিউরে উঠছে, ভয় পায় আকাশ থেকে আগুন বোমা পড়ার আশঙ্কায়। গাজাবাসী বাড়িঘর, স্কুল, কলেজ, কাজকর্ম, হাসপাতাল, এমনকি আশ্রয়শিবির ছেড়ে বোমা হামলা থেকে বাঁচতে আশ্রয়ের জায়গা খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন। যুদ্ধ ফিলিস্তিনেই সীমিত থাকেনি; ইতোমধ্যেই তা লেবানন হয়ে ইরাক, ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ ইসরায়েলের বোমার আঘাতে প্রাণ হারাচ্ছে। তাই বিশ্ব পর্যবেক্ষক মহলের আশঙ্কা, এ যুদ্ধের শেষ পরিণতি কী? এমন আশঙ্কাও অমূলক নয় যে, মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা ডিঙিয়ে অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। যুদ্ধ থামানোর গল্প ও শান্তি ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিরঙ্কুশ জয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। এবারের নির্বাচনী প্রচারে অনেক অনেক নীতিগত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। যদিও বেশির ভাগ সময় তিনি নিজের নীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। মুসলিম-আমেরিমানরা এ বিশ^াসেই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, ট্রাম্প ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবেন।
মিশিগানে এসে ট্রাম্প নিজে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আবারও হোয়াইট হাউসে ফেরায় ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও পররাষ্ট্রনীতি কী হতে পারে, সে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে বিস্তর। এর পাশাপাশি বিশ^জুড়ে চলমান যুদ্ধ-সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে কিনা, সেটি নিয়েও কৌতূহল বাড়ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বন্ধের ক্ষেত্রে তিনি কী পদক্ষেপ নেবেন, তা নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচলে আছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিন ও লেবাননের বাসিন্দারা। আরব বিশে^র দেশগুলোর ভূমিকা সবচেয়ে হতাশাজনক। ফিলিস্তিনিরাও তো আরব। বলা যায়, আরব দেশগুলোর ঘরের মাঠেই ভায়াবহ এ যুদ্ধের ঘটনা ঘটছে এবং তা ঘটছে দীর্ঘদিন ধরেই। ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনিদের ওপর এ ধরনের বর্বরোচিত আচরণ চালিয়ে যায়, তাহলে আরব দেশগুলোর সম্মান কোথায় থাকে? এটা কি ‘আরব বিশ্বের দেশগুলোর লজ্জাজনক অক্ষমতা’ নয়? বিশ্বে বৈষম্য, শোষণ, দমন ও হত্যার ভুরি ভুরি উদাহরণ থাকলেও ইসরায়েলিরা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যে বর্বর আচরণ করে যাচ্ছে, এমন নজির আর নেই। হলোকাস্টের সময় নাৎসিরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে যে ধরনের আচরণ করেছিল, সেটাই হয়তো এর একমাত্র তুলনা হতে পারে বলে ধরে নেয়া যায়। গাজাবাসীদের সঙ্গে ইসরায়েলিরা যা করছে, তার সঙ্গে হলোকাস্টের পার্থক্য কী? মধ্যপ্রাচ্য উত্তেজনা বা যুদ্ধাবস্থা আরববিশ্বকে ছাড়িয়ে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া কিংবা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কাও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে আগে থেকেই গুঞ্জন রয়েছে বিশ্বমহলে। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারে ইউক্রেনের মতো মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি জিতলে গাজায় ইসরায়েল-হামাস এবং লেবাননে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ বন্ধ করবেন বলে জোর দাবি করেছেন।
কিন্তু কীভাবে এ যুদ্ধ বন্ধ করবেন, সে বিষয়ে কোনো কিছু বলেননি। আমেরিকার ফ্লোরিডার মার এ লাগো ক্লাবে আমেরিকা ফার্স্ট পলিসি ইনস্টিটিউটের এক অনুষ্ঠানে গত ১৪ নভেম্বর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তার প্রশাসন। বক্তৃতাকালে ট্রাম্প বলেন, আমরা মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতা বন্ধেও কাজ করতে যাচ্ছি। পাশাপাশি রাশিয়া ও ইউক্রেনের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। কেননা এই যুদ্ধ থামাতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন উভয়কেই থামতে হবে বলেও কড়া বার্তা দিয়েছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট।’ তবে প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের সময় ট্রাম্পের কট্টর ইসরায়েলপন্থি নীতি বিবেচনায় নিলে শঙ্কার জায়গাও রয়েছে। এই ট্রাম্পই ইসরায়েলকে খুশি করতে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে এনেছেন জেরুজালেমে। ওয়াশিংটনে পিএলওর কূটনৈতিক মিশন বন্ধ করে দিয়েছেন। ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের সহায়তাকারী জাতিসংঘ সংস্থার সব মার্কিন অনুদানও তিনি আটকে দেন। সিরিয়ার গোলান হাইটসে ইসরায়েলের অধিগ্রহণ ও পশ্চিম তীরের সব অবৈধ স্থাপনায় তিনি স্বীকৃতি জানান। গাজায় ইসরায়েলি হামলার পর তিনি নেতানিয়াহুকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘কাজটা শেষ করো।’ নির্বাচনের ১০ দিন আগে তিনি নেতানিয়াহুকে ‘তোমার যা ভালো মনে হয়’ করার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে খুব একটা পরিবর্তন হবে না। সমালোচকদের আশঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্যের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আরও উসকে যেতে পারে।
সেক্ষেত্রে ২০২০ সালের শেষে দিকে আব্রাহাম চুক্তিকে সামনে নিয়ে এসেছেন সমালোচকরা। আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ট্রাম্পের উদ্যোগে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ চুক্তিতেও ফিলিস্তিনিদের দাবিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে গেছেন ট্রাম্প। সম্প্রতি ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা বিজয় ইসরায়েলকে দারুণ উল্লসিত করেছে। রাস্তায় বিলবোর্ডে লেখা, ‘ট্রাম্প, মেক ইসরায়েল গ্রেট!’ তাদের সে বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি করে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ বলেছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের অর্থ হলো পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করার সময় এসেছে। শুধু সংযুক্তি বা এনেক্স নয়, এই অঞ্চলের ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি নিশ্চিত করার সময় এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশে বিশেষ করে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল এই মুহূর্তে যে বর্বরতায় মত্ত, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিশ্বব্যাপী সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। গত এক বছরের কথাই যদি ধরা যায়, দেখা যাবে ইসরায়েল শুধু ফিলিস্তিনিদেরই হত্যা করেছে ৪২ হাজারের বেশি। সমগ্র ভূখ- ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধ, প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কণ্ঠ উচ্চকিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। কিন্তু কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তাকে। এ ইস্যুতে বারবার দেখা গেছে আমেরিকার ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন। এমনকি তারা ইসরায়েলকে অস্ত্র ও সেনা দিয়ে সহযোগিতা করছে প্রকাশ্যেই। গাজার সড়কগুলো এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, ওষুধ নেই, খাবার নেই। চারদিকে যতদুর চোখ যায় শুধু ধ্বংসস্তূপ, আর সেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা লাশের গন্ধে বাতাস ভারি। কয়েক সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞার পর সামান্য পরিমাণ খাদ্য ও নিত্যপণ্য প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। যখন অভুক্ত ফিলিস্তিনিরা এই সামান্য খাবার সংগ্রহের জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়, তখন তাদের ওপর গুলি ও আকাশ থেকে বোমা হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর উপত্যকাটির সঙ্গে সব সীমান্তপথ বন্ধ করে দেয় দেশটি। পরে ইসরায়েল কয়েক সপ্তাহ সেখানে কোনো ত্রাণসামগ্রী ঢুকতে দেয়নি। ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, তখন থেকে গাজায় সহায়তাসামগ্রী পাঠাতে ব্যাপকভাবে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। উত্তর গাজায় ‘পুরোদমে দুর্ভিক্ষ’ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।
ইসরায়েলের অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে গাজাবাসী দীর্ঘদিন ধরে বাইরের খাদ্যসহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এরই মধ্যে এ উপত্যকায় যুদ্ধ শুরু করার পর সেখানে মানবিক সহায়তা সরবরাহের ওপর ব্যাপকভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইসরায়েল। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশনের (আইপিসি) ও ডব্লিউএফপি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ চূড়ান্ত রকম ক্ষুধার শিকার এবং ইতিমধ্যে অর্ধেকে উন্নীত হয়েছে। ত্রাণসহায়তায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো বলছে, ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় উত্তর গাজার অধিকাংশ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র বা হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন সেখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগ। সেই সঙ্গে উপত্যকাটিতে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশের ওপর ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেখান থেকে মৃত্যুর সঠিক তথ্য জোগাড় করা কঠিন। সাইদ সিয়াম নামের গাজা সিটির এক বাসিন্দা গণমাধ্যমকে বলেন, দৈনিক একবেলা মূলত কুমড়ার স্যুপ খেয়ে বেঁচে থাকছেন তারা। বাজারে ফলমূল, শাকসবজি ও মাংস নেই বললে চলে। অনাহারে, অর্ধাহারে তাদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, তারা হয়তো আর কখনোই সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। শিশু মৃত্যুসীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং এটা ভয়াবহ যে, শিশুদের কান্না করার মতো শক্তিও অবশিষ্ট নেই। যুক্তরাষ্ট্রের অতীতের নীতিগত অবস্থান থেকে এটি স্পষ্ট যে, তারা পরিস্থিতির পরিবর্তন আনতে আগ্রহী নয়। এখন দেখার বিষয় ট্রাম্পের নির্বাচনের আগের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও একসঙ্গে ইসরায়েলের প্রতি তার দৃঢ় সমর্থন প্রদর্শন এবং গাজা যুদ্ধের অবসানের চেষ্টা কীভাবে করেন। যদিও এ নিয়ে স্পষ্ট করে কোনো কথা এখন পর্যন্ত তিনি বলেননি।
[লেখক : সংবাদকর্মী]
মোহাম্মদ আবু নোমান
মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪
ফিলিস্তিনের গাজার শিশুরা উপরের দিকে মুখ তুলে তাকাতেও শিউরে উঠছে, ভয় পায় আকাশ থেকে আগুন বোমা পড়ার আশঙ্কায়। গাজাবাসী বাড়িঘর, স্কুল, কলেজ, কাজকর্ম, হাসপাতাল, এমনকি আশ্রয়শিবির ছেড়ে বোমা হামলা থেকে বাঁচতে আশ্রয়ের জায়গা খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন। যুদ্ধ ফিলিস্তিনেই সীমিত থাকেনি; ইতোমধ্যেই তা লেবানন হয়ে ইরাক, ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ ইসরায়েলের বোমার আঘাতে প্রাণ হারাচ্ছে। তাই বিশ্ব পর্যবেক্ষক মহলের আশঙ্কা, এ যুদ্ধের শেষ পরিণতি কী? এমন আশঙ্কাও অমূলক নয় যে, মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা ডিঙিয়ে অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। যুদ্ধ থামানোর গল্প ও শান্তি ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিরঙ্কুশ জয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। এবারের নির্বাচনী প্রচারে অনেক অনেক নীতিগত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। যদিও বেশির ভাগ সময় তিনি নিজের নীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। মুসলিম-আমেরিমানরা এ বিশ^াসেই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, ট্রাম্প ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবেন।
মিশিগানে এসে ট্রাম্প নিজে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আবারও হোয়াইট হাউসে ফেরায় ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও পররাষ্ট্রনীতি কী হতে পারে, সে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে বিস্তর। এর পাশাপাশি বিশ^জুড়ে চলমান যুদ্ধ-সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে কিনা, সেটি নিয়েও কৌতূহল বাড়ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বন্ধের ক্ষেত্রে তিনি কী পদক্ষেপ নেবেন, তা নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচলে আছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিন ও লেবাননের বাসিন্দারা। আরব বিশে^র দেশগুলোর ভূমিকা সবচেয়ে হতাশাজনক। ফিলিস্তিনিরাও তো আরব। বলা যায়, আরব দেশগুলোর ঘরের মাঠেই ভায়াবহ এ যুদ্ধের ঘটনা ঘটছে এবং তা ঘটছে দীর্ঘদিন ধরেই। ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনিদের ওপর এ ধরনের বর্বরোচিত আচরণ চালিয়ে যায়, তাহলে আরব দেশগুলোর সম্মান কোথায় থাকে? এটা কি ‘আরব বিশ্বের দেশগুলোর লজ্জাজনক অক্ষমতা’ নয়? বিশ্বে বৈষম্য, শোষণ, দমন ও হত্যার ভুরি ভুরি উদাহরণ থাকলেও ইসরায়েলিরা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যে বর্বর আচরণ করে যাচ্ছে, এমন নজির আর নেই। হলোকাস্টের সময় নাৎসিরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে যে ধরনের আচরণ করেছিল, সেটাই হয়তো এর একমাত্র তুলনা হতে পারে বলে ধরে নেয়া যায়। গাজাবাসীদের সঙ্গে ইসরায়েলিরা যা করছে, তার সঙ্গে হলোকাস্টের পার্থক্য কী? মধ্যপ্রাচ্য উত্তেজনা বা যুদ্ধাবস্থা আরববিশ্বকে ছাড়িয়ে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া কিংবা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কাও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে আগে থেকেই গুঞ্জন রয়েছে বিশ্বমহলে। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারে ইউক্রেনের মতো মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি জিতলে গাজায় ইসরায়েল-হামাস এবং লেবাননে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ বন্ধ করবেন বলে জোর দাবি করেছেন।
কিন্তু কীভাবে এ যুদ্ধ বন্ধ করবেন, সে বিষয়ে কোনো কিছু বলেননি। আমেরিকার ফ্লোরিডার মার এ লাগো ক্লাবে আমেরিকা ফার্স্ট পলিসি ইনস্টিটিউটের এক অনুষ্ঠানে গত ১৪ নভেম্বর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তার প্রশাসন। বক্তৃতাকালে ট্রাম্প বলেন, আমরা মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতা বন্ধেও কাজ করতে যাচ্ছি। পাশাপাশি রাশিয়া ও ইউক্রেনের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। কেননা এই যুদ্ধ থামাতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন উভয়কেই থামতে হবে বলেও কড়া বার্তা দিয়েছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট।’ তবে প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের সময় ট্রাম্পের কট্টর ইসরায়েলপন্থি নীতি বিবেচনায় নিলে শঙ্কার জায়গাও রয়েছে। এই ট্রাম্পই ইসরায়েলকে খুশি করতে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে এনেছেন জেরুজালেমে। ওয়াশিংটনে পিএলওর কূটনৈতিক মিশন বন্ধ করে দিয়েছেন। ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের সহায়তাকারী জাতিসংঘ সংস্থার সব মার্কিন অনুদানও তিনি আটকে দেন। সিরিয়ার গোলান হাইটসে ইসরায়েলের অধিগ্রহণ ও পশ্চিম তীরের সব অবৈধ স্থাপনায় তিনি স্বীকৃতি জানান। গাজায় ইসরায়েলি হামলার পর তিনি নেতানিয়াহুকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘কাজটা শেষ করো।’ নির্বাচনের ১০ দিন আগে তিনি নেতানিয়াহুকে ‘তোমার যা ভালো মনে হয়’ করার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে খুব একটা পরিবর্তন হবে না। সমালোচকদের আশঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্যের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আরও উসকে যেতে পারে।
সেক্ষেত্রে ২০২০ সালের শেষে দিকে আব্রাহাম চুক্তিকে সামনে নিয়ে এসেছেন সমালোচকরা। আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ট্রাম্পের উদ্যোগে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ চুক্তিতেও ফিলিস্তিনিদের দাবিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে গেছেন ট্রাম্প। সম্প্রতি ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা বিজয় ইসরায়েলকে দারুণ উল্লসিত করেছে। রাস্তায় বিলবোর্ডে লেখা, ‘ট্রাম্প, মেক ইসরায়েল গ্রেট!’ তাদের সে বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি করে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ বলেছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের অর্থ হলো পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করার সময় এসেছে। শুধু সংযুক্তি বা এনেক্স নয়, এই অঞ্চলের ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি নিশ্চিত করার সময় এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশে বিশেষ করে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল এই মুহূর্তে যে বর্বরতায় মত্ত, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিশ্বব্যাপী সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। গত এক বছরের কথাই যদি ধরা যায়, দেখা যাবে ইসরায়েল শুধু ফিলিস্তিনিদেরই হত্যা করেছে ৪২ হাজারের বেশি। সমগ্র ভূখ- ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধ, প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কণ্ঠ উচ্চকিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। কিন্তু কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তাকে। এ ইস্যুতে বারবার দেখা গেছে আমেরিকার ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন। এমনকি তারা ইসরায়েলকে অস্ত্র ও সেনা দিয়ে সহযোগিতা করছে প্রকাশ্যেই। গাজার সড়কগুলো এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, ওষুধ নেই, খাবার নেই। চারদিকে যতদুর চোখ যায় শুধু ধ্বংসস্তূপ, আর সেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা লাশের গন্ধে বাতাস ভারি। কয়েক সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞার পর সামান্য পরিমাণ খাদ্য ও নিত্যপণ্য প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। যখন অভুক্ত ফিলিস্তিনিরা এই সামান্য খাবার সংগ্রহের জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়, তখন তাদের ওপর গুলি ও আকাশ থেকে বোমা হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর উপত্যকাটির সঙ্গে সব সীমান্তপথ বন্ধ করে দেয় দেশটি। পরে ইসরায়েল কয়েক সপ্তাহ সেখানে কোনো ত্রাণসামগ্রী ঢুকতে দেয়নি। ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, তখন থেকে গাজায় সহায়তাসামগ্রী পাঠাতে ব্যাপকভাবে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। উত্তর গাজায় ‘পুরোদমে দুর্ভিক্ষ’ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।
ইসরায়েলের অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে গাজাবাসী দীর্ঘদিন ধরে বাইরের খাদ্যসহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এরই মধ্যে এ উপত্যকায় যুদ্ধ শুরু করার পর সেখানে মানবিক সহায়তা সরবরাহের ওপর ব্যাপকভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইসরায়েল। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশনের (আইপিসি) ও ডব্লিউএফপি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ চূড়ান্ত রকম ক্ষুধার শিকার এবং ইতিমধ্যে অর্ধেকে উন্নীত হয়েছে। ত্রাণসহায়তায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো বলছে, ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় উত্তর গাজার অধিকাংশ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র বা হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন সেখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগ। সেই সঙ্গে উপত্যকাটিতে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশের ওপর ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেখান থেকে মৃত্যুর সঠিক তথ্য জোগাড় করা কঠিন। সাইদ সিয়াম নামের গাজা সিটির এক বাসিন্দা গণমাধ্যমকে বলেন, দৈনিক একবেলা মূলত কুমড়ার স্যুপ খেয়ে বেঁচে থাকছেন তারা। বাজারে ফলমূল, শাকসবজি ও মাংস নেই বললে চলে। অনাহারে, অর্ধাহারে তাদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, তারা হয়তো আর কখনোই সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। শিশু মৃত্যুসীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং এটা ভয়াবহ যে, শিশুদের কান্না করার মতো শক্তিও অবশিষ্ট নেই। যুক্তরাষ্ট্রের অতীতের নীতিগত অবস্থান থেকে এটি স্পষ্ট যে, তারা পরিস্থিতির পরিবর্তন আনতে আগ্রহী নয়। এখন দেখার বিষয় ট্রাম্পের নির্বাচনের আগের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও একসঙ্গে ইসরায়েলের প্রতি তার দৃঢ় সমর্থন প্রদর্শন এবং গাজা যুদ্ধের অবসানের চেষ্টা কীভাবে করেন। যদিও এ নিয়ে স্পষ্ট করে কোনো কথা এখন পর্যন্ত তিনি বলেননি।
[লেখক : সংবাদকর্মী]