আনোয়ারুল হক
বাংলাদেশের সরকার প্রধানরা স্পর্শকাতর কোনো ইস্যু নিয়ে দেশ অভ্যন্তরে যে সুরে কথা বলে থাকেন বিদেশে যেয়ে অথবা বিদেশি সংবাদমাধ্যমে ভিন্ন সুরে কথা বলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও বিকল্প পথে না যেয়ে সে ধারাবাহিকতাই অনুসরণ করছেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে দেশ অভ্যন্তরে তিনি বলছেনÑ হয় ডিসেম্বরের মধ্যে অথবা জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে। তবে তার কথার সুরে নির্বাচন কতটা সামনে টেনে নেয়া যায় সেই সুপ্ত আকাক্সক্ষা প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পায়। অবশ্য পরবর্তীতে তার স্মার্ট মুখপাত্র যে ব্যাখ্যা দেন তাতে আর বিষয়টি প্রচ্ছন্ন থাকে না।
প্রধান উপদেষ্টা যখন বিদেশি গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন তখন বলে থাকেন, ডিসেম্বরেই নির্বাচন। আবার দেশে যখন কথা বলেন, তখন সংস্কারই অগ্রাধিকার (আধা সংস্কার হলে ডিসেম্বরে ও পূর্ণ সংস্কার হলে জুনে)। বিমসটেক সম্মেলনে বললেন দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই তার সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। রাজনীতিবিদরা তো বটেই! দেশবাসীও কিন্তু নির্বাচন নিয়ে ধন্ধে আছেন। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট পথরেখা ঘোষণা না করে, ডিসেম্বর-জুনের এক্কাদোক্কা খেলা রাজনীতির পরিবেশটাকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। বিশেষ করে প্রফেসর ইউনূসের ‘নিয়োগ কর্তাদের’ কথা বার্তায় মানুষ সন্দিহান হয়ে পড়ছে এবং গুজবের ডালপালা বিস্তার করছে।
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই এটাই দেখবো পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রায়কে অস্বীকার করার কারণেই সেদিনের পূর্ববাংলার মানুষ স্বায়ত্তশাসন-স্বাধিকারের সংগ্রামের ধারায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাংলাদেশে তখন সংগ্রামী দল ও নেতার অভাব ছিলো না। মাওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, আতাউর রহমান, মনি সিংহ প্রমুখ নেতারাও জনপ্রিয় ছিলেন এবং গণতন্ত্র ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তারাও অসামান্য অবদান রেখেছেন। ভাসানী, মোজাফফর, মনি সিংহ মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদেও ছিলেন। তবে কেউ পছন্দ করেন আর নাই করেন, ১৯৭০-এর ভোটের ফলাফলই দেশে এবং গোটা বিশ্বে শেখ মুজিবর রহমানকে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং তিনিই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ওয়াশিংটনে যে প্রথম সমাবেশ হয়েছিল সেদিন নিউইয়র্ক থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত হয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি তা ভুলে যাননি। অথচ আজ তিনি স্বাধীনতা দিবসের দিনটিতেও তার নাম মুখে নিতে সংকোচবোধ করেন। এ সব বিষয় ভিন্ন প্রসংগ। আলোচনার বিষয় নির্বাচন এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনের গণরায়ের ফলাফল বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
এরপর ১৯৭৩-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে ছাত্রলীগের বৃহত্তর অংশ এবং আওয়ামী লীগের এক ক্ষুদ্র অংশ মিলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করে সরকারকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা মুজিব বিরোধী নানা শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা সমর্থন পায়। মুজিব তার দল থেকে বের হয়ে যাওয়া বিরোধীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেন। তবে আওয়ামী লীগাররা জোরেসোরে সেøাগান তোলেন মশাল, ধানের শীষ আর কুঁড়েঘর ভেঙেচুরে নৌকায় ভর। সারাদেশে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ন্যাপ পার্টির প্রতীক কুঁড়েঘর ভাংচুর করা হয়। এভাবে ভোট অনুষ্ঠান পর্ব সম্পন্ন হওয়ার পরেও কিছু আসনে ভোটের ফলাফলই পাল্টে দেওয়া হয়। ভোট আয়োজন এবং ফলাফল যথাযথভাবে ঘোষিত হলে ন্যাপ, জাসদ ও ভাসানী ন্যাপ বড়জোর ২০-২৫টি আসনে জয়লাভ করতো এবং তাতে করে গণতন্ত্রই শক্তিশালী হতো। কিন্তু পার্লামেন্টকে বিরোধী শূন্য করে মুজিব নিজেই দূর্বল হলেন। তার যে সর্বপ্লাবী নেতৃত্ব ও জনপ্রিয়তা তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হলো। এ সুযোগে ষড়যন্ত্রের ডালপালা বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করতে জাতীয়ভাবে দেশে একটি দল প্রতিষ্ঠা এবং সেই একদলের শাসন ব্যবস্থা কায়েম করায় অবাধ ভোটের অধিকার ক্ষুণœ হয় এবং ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন বা অন্তত সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সুযোগ রহিত হয়। ফলশ্রুতিতে ষড়যন্ত্রের শক্তিই জয়লাভ করে। পাকিস্তানিরা যার জন্য মিয়ানওয়ালি কারাগারে কবর খোঁড়া সম্পন্ন করেও বিশ্ব জনমতের চাপে শেষপর্যন্ত ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলাতে পারেনি সেই বিশ্ব নন্দিত নেতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ষড়যন্ত্রের বলি হলেন। সপরিবারে নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হলেন। এক্ষেত্রেও ১৯৭৩ সনের নির্বাচনে সীমিত হলেও অপ্রয়োজনীয় কারচুপি থেকে এবং পরবর্তীতে বহুদলের অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচনের সুযোগকে সংকুচিত করার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রেও শক্তি দ্রুত তাদের ডালপালার বিস্তার করার সুযোগ পায়।
জেনারেল জিয়ার হ্যাঁ-না ভোটে সারাদিন ভোট কেন্দ্র ভোটারশূন্য থাকলেও ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ৮৮% এবং হ্যাঁ ভোট প্রাপ্তি দেখানো হয় ৯৯% যা জিয়ার ইমেজকে কিছুটা ক্ষুণœ করে। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু আসনে জাসদকে ছাড় দিয়ে জাসদের সাথে দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করেন। সবচেয়ে বেশি ছাড় দেয়া হয় ইসলামপন্থিদের। আওয়ামী লীগকে চাপের মধ্যে না রাখলে তারা আরো কয়েকটি আসন পেতে পারত। অভিযোগ আছে ‘নীল নকশা অনুযায়ী সবকিছুই নির্ধারিত হয়েছে নির্বাচনের আগে নেওয়া বিভিন্ন সংস্থার জরিপের ভিত্তিতে; যাই হোক নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়ে জিয়াউর রহমান কোন চ্যালেঞ্জ বা বিপদে পড়েননি। এক অস্থির পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীকে নিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েও সামরিক বাহিনীরই একাংশের হাতে তিনি নিহত হন।
জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ সামরিক শাসন আমলে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের তত্ত্বাবধানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় ঐক্যজোট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় ঐক্যজোট দীর্ঘ সময় যাবৎ যুগপৎ লড়াই অব্যাহত রাখে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে না বরং প্রতিরোধ করা হবে- এটাই ছিলো দুই জোটের প্রধান ক্যাম্পিং। তারপরেও নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দুই জোটের সাথেই সামরিক সরকার নানা ধরনের আলোচনা ও সমঝোতার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। এবং তারা কৌশল গ্রহন করেন যাতে করে দুই জোট একত্রে নির্বাচনে না আসে। তারা সেই কৌশলে সফল হন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট বয়কট করে। ১৫ দলীয় জোটের এ সিদ্ধান্তে সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিশেষত শেখ হাসিনার ইমেজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরো বেশি ইমেজ সংকটে পড়ে ১৫ দলের শরিক সিপিবি। সিপিবি-র অবস্থান বাম মুুুুুুুুুুুুুুুুুনস্ক মানুষসহ সাধারণ মধ্যবিত্তকে হতাশ করে। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বামধারার ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন সারাদেশে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে অনেকটা পিভোর্টাল ভূমিকায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ১৯৮৬-এর নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রশ্নে ছাত্র ইউনিয়নের অবস্থান তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছাত্রদের থেকে ছাত্র ইউনিয়নকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এবং সেই থেকে ছাত্র ইউনিয়নে যে ভাটার টান শুরু হলো যা আজও অব্যাহত আছে। এক অর্থে ‘৮৬র নির্বাচন অঘটনই সৃষ্টি করে।
তবে মজার বিষয় হলো নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি কার্যত ১৫ দলীয় জোটের কাছে পরাজিত হয়। ১৫ দলীয় জোটের প্রার্থীরা অধিকাংশ আসনে এগিয়ে থাকা অবস্থায় গভীর রাতে ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরদিন নানা ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে জাতীয় পার্টিকে বিজয়ী দেখানো হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়েই যেহেতু মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ছিলো তাই ১৫ দল বা আওয়ামী লীগ ফলাফল ঘোষণায় কারচুপির বিরুদ্ধে কার্যত কোনো প্রতিরোধ দাঁড় করাতে পারেনি। বরং নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া আপোষহীন নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। পরবর্তীতে এক ভিন্ন পরিস্থিতে ১৫ দলীয় জোটের সদস্যরা পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করে পুনরায় ৭ দলীয় জোটের সাথে যুগপৎ আন্দোলনে শামিল হন এবং এক পর্যায়ে এরশাদ সরকারের পতন হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয় এবং তাদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বা কেউই এমনকি বিএনপি নেতৃত্বও ধারণা করেননি যে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করবেন; কিন্তু সেই ঘটনাই ঘটলো।
আবার ১৯৯৬-এর নির্বাচনের পূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার বিষয়ে বিএনপি গড়িমসি করায় এবং তা মানুষের মাঝে দৃশ্যমান হওয়ায় শেষপর্যন্ত আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপিকে পরাজিত হতে হয়। তেমনি ২০০৬ সালের নির্বাচনের পূর্বে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজ পক্ষে ব্যবহার করার যে ফন্দি-ফিকির বিএনপি করে তার জন্য ‘এক-এগারোর’ শাসন নেমে আসে এবং বিএনপিকে কড়া মূল্য দিতে হয়। ২০০৮ এর নির্বাচনে তাদের ৩০টি আসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আবার ২০০৮ এ ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যাবস্থাই বাতিল করে ও জনগণের ভোটাধিকার হরন করে বিনা ভোটে, নৈশ ভোটে এবং ডামি ভোটে পর পর তিনটি নির্বাচন করে আজ তার ভয়াবহ মাশুল তাদের গুনতে হচ্ছে।
জনগণের ভোটাধিকার হরণের পরিনতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, জনগণের ভোটাধিকার হরণের পরিনতিতে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান, জনগণের ভোটাধিকার হরণের চক্রান্তের পরিনতিতে এক-এগারো, জনগণের ভোটাধিকার হরণের পরিনতি-এক স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণে শেখ হাসিনার অবমাননাকর দেশত্যাগ, জনগণের ভোটাধিকার হরণের পরিনতি- স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের ‘নাই’ হয়ে যাওয়া।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। নোবেলজয়ী এই প্রবীণ মানুষটির শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক প্রস্থানের জন্যও দ্রুত অতিদ্রুত জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ করে দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। আরেকটি অচলাবস্থার দিকে না যেতে চাইলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার পুরোনো কৌশল নিয়ে পর্দার আড়ালের খেলা বন্ধ করতে হবে। একটি ভালো নির্বাচনের জন্য বছরের পর বছর মানুষ অপেক্ষায় রয়েছেন এবং অনিশ্চিয়তা অস্থিরতার বিপরীতে অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনই স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রে উত্তরণের সব থেকে গ্রহণযোগ্য পন্থা। এই সত্যটি সম্মানিত উপদেষ্টা পরিষদ যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন তত সবার জন্য মঙ্গল।
[লখেক : সাবেক ছাত্র নেতা]
আনোয়ারুল হক
বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫
বাংলাদেশের সরকার প্রধানরা স্পর্শকাতর কোনো ইস্যু নিয়ে দেশ অভ্যন্তরে যে সুরে কথা বলে থাকেন বিদেশে যেয়ে অথবা বিদেশি সংবাদমাধ্যমে ভিন্ন সুরে কথা বলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও বিকল্প পথে না যেয়ে সে ধারাবাহিকতাই অনুসরণ করছেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে দেশ অভ্যন্তরে তিনি বলছেনÑ হয় ডিসেম্বরের মধ্যে অথবা জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে। তবে তার কথার সুরে নির্বাচন কতটা সামনে টেনে নেয়া যায় সেই সুপ্ত আকাক্সক্ষা প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পায়। অবশ্য পরবর্তীতে তার স্মার্ট মুখপাত্র যে ব্যাখ্যা দেন তাতে আর বিষয়টি প্রচ্ছন্ন থাকে না।
প্রধান উপদেষ্টা যখন বিদেশি গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন তখন বলে থাকেন, ডিসেম্বরেই নির্বাচন। আবার দেশে যখন কথা বলেন, তখন সংস্কারই অগ্রাধিকার (আধা সংস্কার হলে ডিসেম্বরে ও পূর্ণ সংস্কার হলে জুনে)। বিমসটেক সম্মেলনে বললেন দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই তার সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। রাজনীতিবিদরা তো বটেই! দেশবাসীও কিন্তু নির্বাচন নিয়ে ধন্ধে আছেন। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট পথরেখা ঘোষণা না করে, ডিসেম্বর-জুনের এক্কাদোক্কা খেলা রাজনীতির পরিবেশটাকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। বিশেষ করে প্রফেসর ইউনূসের ‘নিয়োগ কর্তাদের’ কথা বার্তায় মানুষ সন্দিহান হয়ে পড়ছে এবং গুজবের ডালপালা বিস্তার করছে।
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই এটাই দেখবো পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রায়কে অস্বীকার করার কারণেই সেদিনের পূর্ববাংলার মানুষ স্বায়ত্তশাসন-স্বাধিকারের সংগ্রামের ধারায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাংলাদেশে তখন সংগ্রামী দল ও নেতার অভাব ছিলো না। মাওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, আতাউর রহমান, মনি সিংহ প্রমুখ নেতারাও জনপ্রিয় ছিলেন এবং গণতন্ত্র ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তারাও অসামান্য অবদান রেখেছেন। ভাসানী, মোজাফফর, মনি সিংহ মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদেও ছিলেন। তবে কেউ পছন্দ করেন আর নাই করেন, ১৯৭০-এর ভোটের ফলাফলই দেশে এবং গোটা বিশ্বে শেখ মুজিবর রহমানকে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং তিনিই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ওয়াশিংটনে যে প্রথম সমাবেশ হয়েছিল সেদিন নিউইয়র্ক থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত হয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি তা ভুলে যাননি। অথচ আজ তিনি স্বাধীনতা দিবসের দিনটিতেও তার নাম মুখে নিতে সংকোচবোধ করেন। এ সব বিষয় ভিন্ন প্রসংগ। আলোচনার বিষয় নির্বাচন এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনের গণরায়ের ফলাফল বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
এরপর ১৯৭৩-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে ছাত্রলীগের বৃহত্তর অংশ এবং আওয়ামী লীগের এক ক্ষুদ্র অংশ মিলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করে সরকারকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা মুজিব বিরোধী নানা শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা সমর্থন পায়। মুজিব তার দল থেকে বের হয়ে যাওয়া বিরোধীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেন। তবে আওয়ামী লীগাররা জোরেসোরে সেøাগান তোলেন মশাল, ধানের শীষ আর কুঁড়েঘর ভেঙেচুরে নৌকায় ভর। সারাদেশে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ন্যাপ পার্টির প্রতীক কুঁড়েঘর ভাংচুর করা হয়। এভাবে ভোট অনুষ্ঠান পর্ব সম্পন্ন হওয়ার পরেও কিছু আসনে ভোটের ফলাফলই পাল্টে দেওয়া হয়। ভোট আয়োজন এবং ফলাফল যথাযথভাবে ঘোষিত হলে ন্যাপ, জাসদ ও ভাসানী ন্যাপ বড়জোর ২০-২৫টি আসনে জয়লাভ করতো এবং তাতে করে গণতন্ত্রই শক্তিশালী হতো। কিন্তু পার্লামেন্টকে বিরোধী শূন্য করে মুজিব নিজেই দূর্বল হলেন। তার যে সর্বপ্লাবী নেতৃত্ব ও জনপ্রিয়তা তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হলো। এ সুযোগে ষড়যন্ত্রের ডালপালা বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করতে জাতীয়ভাবে দেশে একটি দল প্রতিষ্ঠা এবং সেই একদলের শাসন ব্যবস্থা কায়েম করায় অবাধ ভোটের অধিকার ক্ষুণœ হয় এবং ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন বা অন্তত সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সুযোগ রহিত হয়। ফলশ্রুতিতে ষড়যন্ত্রের শক্তিই জয়লাভ করে। পাকিস্তানিরা যার জন্য মিয়ানওয়ালি কারাগারে কবর খোঁড়া সম্পন্ন করেও বিশ্ব জনমতের চাপে শেষপর্যন্ত ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলাতে পারেনি সেই বিশ্ব নন্দিত নেতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ষড়যন্ত্রের বলি হলেন। সপরিবারে নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হলেন। এক্ষেত্রেও ১৯৭৩ সনের নির্বাচনে সীমিত হলেও অপ্রয়োজনীয় কারচুপি থেকে এবং পরবর্তীতে বহুদলের অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচনের সুযোগকে সংকুচিত করার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রেও শক্তি দ্রুত তাদের ডালপালার বিস্তার করার সুযোগ পায়।
জেনারেল জিয়ার হ্যাঁ-না ভোটে সারাদিন ভোট কেন্দ্র ভোটারশূন্য থাকলেও ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ৮৮% এবং হ্যাঁ ভোট প্রাপ্তি দেখানো হয় ৯৯% যা জিয়ার ইমেজকে কিছুটা ক্ষুণœ করে। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু আসনে জাসদকে ছাড় দিয়ে জাসদের সাথে দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করেন। সবচেয়ে বেশি ছাড় দেয়া হয় ইসলামপন্থিদের। আওয়ামী লীগকে চাপের মধ্যে না রাখলে তারা আরো কয়েকটি আসন পেতে পারত। অভিযোগ আছে ‘নীল নকশা অনুযায়ী সবকিছুই নির্ধারিত হয়েছে নির্বাচনের আগে নেওয়া বিভিন্ন সংস্থার জরিপের ভিত্তিতে; যাই হোক নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়ে জিয়াউর রহমান কোন চ্যালেঞ্জ বা বিপদে পড়েননি। এক অস্থির পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীকে নিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েও সামরিক বাহিনীরই একাংশের হাতে তিনি নিহত হন।
জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ সামরিক শাসন আমলে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের তত্ত্বাবধানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় ঐক্যজোট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় ঐক্যজোট দীর্ঘ সময় যাবৎ যুগপৎ লড়াই অব্যাহত রাখে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে না বরং প্রতিরোধ করা হবে- এটাই ছিলো দুই জোটের প্রধান ক্যাম্পিং। তারপরেও নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দুই জোটের সাথেই সামরিক সরকার নানা ধরনের আলোচনা ও সমঝোতার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। এবং তারা কৌশল গ্রহন করেন যাতে করে দুই জোট একত্রে নির্বাচনে না আসে। তারা সেই কৌশলে সফল হন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট বয়কট করে। ১৫ দলীয় জোটের এ সিদ্ধান্তে সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিশেষত শেখ হাসিনার ইমেজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরো বেশি ইমেজ সংকটে পড়ে ১৫ দলের শরিক সিপিবি। সিপিবি-র অবস্থান বাম মুুুুুুুুুুুুুুুুুনস্ক মানুষসহ সাধারণ মধ্যবিত্তকে হতাশ করে। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বামধারার ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন সারাদেশে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে অনেকটা পিভোর্টাল ভূমিকায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ১৯৮৬-এর নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রশ্নে ছাত্র ইউনিয়নের অবস্থান তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছাত্রদের থেকে ছাত্র ইউনিয়নকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এবং সেই থেকে ছাত্র ইউনিয়নে যে ভাটার টান শুরু হলো যা আজও অব্যাহত আছে। এক অর্থে ‘৮৬র নির্বাচন অঘটনই সৃষ্টি করে।
তবে মজার বিষয় হলো নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি কার্যত ১৫ দলীয় জোটের কাছে পরাজিত হয়। ১৫ দলীয় জোটের প্রার্থীরা অধিকাংশ আসনে এগিয়ে থাকা অবস্থায় গভীর রাতে ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরদিন নানা ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে জাতীয় পার্টিকে বিজয়ী দেখানো হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়েই যেহেতু মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ছিলো তাই ১৫ দল বা আওয়ামী লীগ ফলাফল ঘোষণায় কারচুপির বিরুদ্ধে কার্যত কোনো প্রতিরোধ দাঁড় করাতে পারেনি। বরং নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া আপোষহীন নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। পরবর্তীতে এক ভিন্ন পরিস্থিতে ১৫ দলীয় জোটের সদস্যরা পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করে পুনরায় ৭ দলীয় জোটের সাথে যুগপৎ আন্দোলনে শামিল হন এবং এক পর্যায়ে এরশাদ সরকারের পতন হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয় এবং তাদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বা কেউই এমনকি বিএনপি নেতৃত্বও ধারণা করেননি যে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করবেন; কিন্তু সেই ঘটনাই ঘটলো।
আবার ১৯৯৬-এর নির্বাচনের পূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার বিষয়ে বিএনপি গড়িমসি করায় এবং তা মানুষের মাঝে দৃশ্যমান হওয়ায় শেষপর্যন্ত আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপিকে পরাজিত হতে হয়। তেমনি ২০০৬ সালের নির্বাচনের পূর্বে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজ পক্ষে ব্যবহার করার যে ফন্দি-ফিকির বিএনপি করে তার জন্য ‘এক-এগারোর’ শাসন নেমে আসে এবং বিএনপিকে কড়া মূল্য দিতে হয়। ২০০৮ এর নির্বাচনে তাদের ৩০টি আসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আবার ২০০৮ এ ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যাবস্থাই বাতিল করে ও জনগণের ভোটাধিকার হরন করে বিনা ভোটে, নৈশ ভোটে এবং ডামি ভোটে পর পর তিনটি নির্বাচন করে আজ তার ভয়াবহ মাশুল তাদের গুনতে হচ্ছে।
জনগণের ভোটাধিকার হরণের পরিনতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, জনগণের ভোটাধিকার হরণের পরিনতিতে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান, জনগণের ভোটাধিকার হরণের চক্রান্তের পরিনতিতে এক-এগারো, জনগণের ভোটাধিকার হরণের পরিনতি-এক স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণে শেখ হাসিনার অবমাননাকর দেশত্যাগ, জনগণের ভোটাধিকার হরণের পরিনতি- স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের ‘নাই’ হয়ে যাওয়া।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। নোবেলজয়ী এই প্রবীণ মানুষটির শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক প্রস্থানের জন্যও দ্রুত অতিদ্রুত জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ করে দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। আরেকটি অচলাবস্থার দিকে না যেতে চাইলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার পুরোনো কৌশল নিয়ে পর্দার আড়ালের খেলা বন্ধ করতে হবে। একটি ভালো নির্বাচনের জন্য বছরের পর বছর মানুষ অপেক্ষায় রয়েছেন এবং অনিশ্চিয়তা অস্থিরতার বিপরীতে অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনই স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রে উত্তরণের সব থেকে গ্রহণযোগ্য পন্থা। এই সত্যটি সম্মানিত উপদেষ্টা পরিষদ যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন তত সবার জন্য মঙ্গল।
[লখেক : সাবেক ছাত্র নেতা]