alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

গাজী তারেক আজিজ

: বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেবল একটি সাংবিধানিক অধিকার নয়; এটি নাগরিক অস্তিত্বের মূল শর্ত। রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের ভিত তৈরি হয় এই স্বাধীনতার ওপর- যেখানে মানুষ চিন্তা করবে, বলবে, প্রশ্ন তুলবে, সমালোচনা করবে, এমনকি ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেও কথা বলবে, কিন্তু তার জন্য ভয় পাবে না। যে সমাজে মানুষ কথা বলতে ভয় পায়, সেখানে উন্নয়ন যতই হোক, সেটি হয় কেবল পরিকাঠামোর উন্নয়ন; উপলব্ধির নয়।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে- প্রত্যেক নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবে কি সেই স্বাধীনতা পূর্ণভাবে প্রয়োগ করা যায়?

আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা দেখছি, মত প্রকাশের অধিকারের সামনে কতগুলো অদৃশ্য প্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে- ভয়, দমননীতি, মামলা, সাইবার সিকিউরিটি আইন, রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও সামাজিক বিভাজন। এরই প্রেক্ষিতে মবক্রেসি, খুন, গুমসহ ভয়াবহ দমন-পীড়ন। যা থেকে মানুষ মুক্তি পেতে চায়।

গণতন্ত্রের শক্তি আসে বহুমতের স্বীকৃতি থেকে। যে দেশে কেবল এক মতের আধিপত্য থাকে, সেখানে গণতন্ত্র কেবল কাগজে টিকে থাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে শুধু সমালোচনা করা নয়, বরং বিকল্প মতামত রাখারও অধিকার। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘দ্বিমত’কে প্রায়ই ‘শত্রুতা’ হিসেবে দেখা হয়। ফলে ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা থাকেন, তাদের পক্ষে কথা বললে দেশপ্রেমিক; আর বিপরীতে বললে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ তকমা জোটে। এভাবে চলতে দেয়ার নামই সয়ে যাওয়া।

এ যেন এক অদ্ভুত সময়- যেখানে স্লোগান দেওয়া নিরাপদ, কিন্তু প্রশ্ন করা বিপজ্জনক। অথচ প্রশ্নই নাগরিকের সবচেয়ে বড় শক্তি। যে নাগরিক প্রশ্ন করতে পারে না, সে আসলে প্রজায় পরিণত হয়। প্রকারান্তরে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের প্রশ্নটি বরাবরই জটিল। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি সরকারই এই অধিকারের ক্ষেত্রে দ্বৈত আচরণ করেছে- ক্ষমতায় থাকলে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে’, আর বিরোধী দলে থাকলে ‘দমননীতির বিপক্ষে’।

এ যেন এক চক্র- সরকার বদলায়, কিন্তু আচরণ বদলায় না। ১৯৭৫-এর পর সামরিক শাসনের সময় সংবাদপত্র বন্ধ হয়েছে, সেন্সরশিপ জারি হয়েছে; নব্বইয়ের পরের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সময়েও সাংবাদিক গ্রেফতার, সম্পাদক হয়রানি, ডিজিটাল আইনে মামলা- কিছুই বাদ যায়নি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (এখন ‘সাইবার সিকিউরিটি আইন’) নামে একটি আইনি আবরণে ভয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মানুষ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার আগে ভাবে- “এটা কি মামলা খেতে পারে?” সাংবাদিক রিপোর্ট লেখার আগে ভাবে-“এটা ছাপলে কি কারও আক্রোশে পড়া লাগবে?” এই আত্মসেন্সরশিপই মত প্রকাশের সবচেয়ে বড় শত্রু।

শুধু রাষ্ট্রীয় দমন নয়, সামাজিক বিভাজনও আজ মতপ্রকাশের অন্যতম প্রতিবন্ধক। সমাজ এমনভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে যে, তুমি যদি এক পক্ষের সমর্থক হও, অন্যপক্ষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তোমাকে ঘৃণা করবে। এই বিভাজন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যুক্তি, তথ্য, বা মানবিকতা- সবকিছুই রাজনীতির চশমায় দেখা হয়।

ফলে এখন আর মানুষ সত্য বলে না, বলে দলীয় সত্য। কেউ সরকারবিরোধী কিছু বললেই সে ‘দেশবিরোধী’; কেউ সরকারের প্রশংসা করলেই সে ‘চাটুকার’। এই মেরুকরণে নাগরিক চেতনা হারিয়ে যাচ্ছে, মানুষ হয়ে উঠছে রাজনৈতিক যন্ত্র। গণতন্ত্রে দ্বিমত মানে শত্রুতা নয়, বরং প্রয়োজনীয় ভারসাম্য। একদল যে নীতি গ্রহণ করবে, অন্য দল সেটির ভুল ধরবে- এই প্রক্রিয়াতেই রাষ্ট্রে জবাবদিহিতা তৈরি হয়।

দ্বিমতের মাধ্যমেই নীতি শুদ্ধ হয়, দুর্নীতি প্রকাশ পায়, এবং ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়। কিন্তু যখন দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ থাকে না, তখন ক্ষমতা সীমাহীন হয়ে যায়, এবং সেই সীমাহীন ক্ষমতাই একসময় রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। আদতে উল্টোটাই ঘটে।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দুর্ভাগ্যবশত ‘শত্রু সংস্কৃতি’-তে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দলের বক্তব্য শুনলে মনে হয়, শাসক দল দেশ ধ্বংস করছে; আবার শাসক দলের বক্তব্য শুনলে মনে হয়, বিরোধীরা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রী। এই শত্রুভাবাপন্ন রাজনীতি সমাজে মতপ্রকাশের জায়গা সংকুচিত করেছে, এমনকি পরিবারের মধ্যেও বিভাজন তৈরি করেছে।

আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সংকট হলো ‘নীরবতা’। মানুষ কথা বলে না, কারণ জানে- বললে বিপদ। এই নীরবতা কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিকও। যখন হাজার হাজার মানুষ নীরব থাকে, তখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো সম্মিলিত প্রতিবাদ হয় না। ফলে রাষ্ট্র ধীরে ধীরে একপাক্ষিক হয়ে যায়। ইউরোপে বা আমেরিকায় রাজনীতিকরা প্রতিদিন কঠিন সমালোচনার মুখে পড়েন, কিন্তু তারা মামলা করেন না, গ্রেফতার করান না। কারণ তারা বোঝেন- সমালোচনাই গণতন্ত্রের প্রাণ।

অথচ আমাদের দেশে সমালোচনা মানেই ‘ষড়যন্ত্র’। কথা বলাই দোষে। আর কে-ই বা চায় নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনতে! তবে এটাও সত্য- মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর দায়িত্বশীল ব্যবহারের প্রয়োজনও অপরিসীম। ফেসবুক বা ইউটিউবে অনেকে ঘৃণা, বিদ্বেষ বা মিথ্যা প্রচার করে ‘মতপ্রকাশ’ নামের আড়ালে। এই অপব্যবহার রোধে আইন দরকার, কিন্তু আইন যেন দমনযন্ত্র না হয়ে ওঠে। অন্যথায় ‘ভুয়া খবরের’ অজুহাতে সত্যিকারের সাংবাদিকতা দমন হবে, আর মানুষ আবার ভয় পাবে। তবে উল্টো চিত্রও দৃশ্যমান থাকার নজির রয়েছে।

একটি রাষ্ট্র তখনই টিকে থাকে, যখন তার নাগরিকরা সক্রিয় থাকে- যখন তারা সরকারের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে, বিরোধী দলের কৌশল বিশ্লেষণ করে, এবং স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারে। আজকের তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় হলেও, তাদের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণে ভুগছে। কারণ তারা জানে, অনলাইনেও নজরদারি আছে। এই বাস্তবতা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। কারণ, ভয় পাওয়া নাগরিক কখনও গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারে না।

প্রথমত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে আইনি কাঠামো হতে হবে ন্যায়সংগত ও স্বচ্ছ। সাইবার আইনকে অবশ্যই মানবাধিকার– সঙ্গতভাবে সংস্কার করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যেই সমালোচনা গ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

তৃতীয়ত, মিডিয়ার স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, কারণ সংবাদপত্র বা টেলিভিশন কেবল ব্যবসা নয়- তারা রাষ্ট্রের বিবেক।

সবশেষে নাগরিকদেরও দায়িত্ব আছে- সত্য ও তথ্য যাচাই করে মতপ্রকাশ করা, গুজব নয়। মত প্রকাশের অধিকার যেমন আমাদের রক্ষা করে, তেমনি আমাদেরও রক্ষা করতে হয় সেই অধিকারকে।

মতপ্রকাশ ও দ্বিমত পোষণ কোনো বিলাসিতা নয়- এটি নাগরিকের জন্মগত অধিকার বলেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যেমনটি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচ্য। যে রাষ্ট্রে মানুষ ভয়ে কথা বলে না, সেই রাষ্ট্র যতই উন্নত হোক, আসলে তা অন্ধকারে ঢাকা। বাংলাদেশ একসময় রাস্তায় নেমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, মুক্তির স্লোগান তুলেছে- “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” আজ সেই ভালোবাসার পরীক্ষা এই জায়গাতেই- আমরা কি এখনো একে অপরের কথা শুনতে পারি? যে সমাজে সবাই কথা বলতে পারে, সেখানে সত্য টিকে থাকে। আর যেখানে সবাই নীরব, সেখানে মিথ্যাই রাজা হয়। প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করে যায়।

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

গাজী তারেক আজিজ

বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেবল একটি সাংবিধানিক অধিকার নয়; এটি নাগরিক অস্তিত্বের মূল শর্ত। রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের ভিত তৈরি হয় এই স্বাধীনতার ওপর- যেখানে মানুষ চিন্তা করবে, বলবে, প্রশ্ন তুলবে, সমালোচনা করবে, এমনকি ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেও কথা বলবে, কিন্তু তার জন্য ভয় পাবে না। যে সমাজে মানুষ কথা বলতে ভয় পায়, সেখানে উন্নয়ন যতই হোক, সেটি হয় কেবল পরিকাঠামোর উন্নয়ন; উপলব্ধির নয়।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে- প্রত্যেক নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবে কি সেই স্বাধীনতা পূর্ণভাবে প্রয়োগ করা যায়?

আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা দেখছি, মত প্রকাশের অধিকারের সামনে কতগুলো অদৃশ্য প্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে- ভয়, দমননীতি, মামলা, সাইবার সিকিউরিটি আইন, রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও সামাজিক বিভাজন। এরই প্রেক্ষিতে মবক্রেসি, খুন, গুমসহ ভয়াবহ দমন-পীড়ন। যা থেকে মানুষ মুক্তি পেতে চায়।

গণতন্ত্রের শক্তি আসে বহুমতের স্বীকৃতি থেকে। যে দেশে কেবল এক মতের আধিপত্য থাকে, সেখানে গণতন্ত্র কেবল কাগজে টিকে থাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে শুধু সমালোচনা করা নয়, বরং বিকল্প মতামত রাখারও অধিকার। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘দ্বিমত’কে প্রায়ই ‘শত্রুতা’ হিসেবে দেখা হয়। ফলে ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা থাকেন, তাদের পক্ষে কথা বললে দেশপ্রেমিক; আর বিপরীতে বললে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ তকমা জোটে। এভাবে চলতে দেয়ার নামই সয়ে যাওয়া।

এ যেন এক অদ্ভুত সময়- যেখানে স্লোগান দেওয়া নিরাপদ, কিন্তু প্রশ্ন করা বিপজ্জনক। অথচ প্রশ্নই নাগরিকের সবচেয়ে বড় শক্তি। যে নাগরিক প্রশ্ন করতে পারে না, সে আসলে প্রজায় পরিণত হয়। প্রকারান্তরে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের প্রশ্নটি বরাবরই জটিল। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি সরকারই এই অধিকারের ক্ষেত্রে দ্বৈত আচরণ করেছে- ক্ষমতায় থাকলে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে’, আর বিরোধী দলে থাকলে ‘দমননীতির বিপক্ষে’।

এ যেন এক চক্র- সরকার বদলায়, কিন্তু আচরণ বদলায় না। ১৯৭৫-এর পর সামরিক শাসনের সময় সংবাদপত্র বন্ধ হয়েছে, সেন্সরশিপ জারি হয়েছে; নব্বইয়ের পরের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সময়েও সাংবাদিক গ্রেফতার, সম্পাদক হয়রানি, ডিজিটাল আইনে মামলা- কিছুই বাদ যায়নি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (এখন ‘সাইবার সিকিউরিটি আইন’) নামে একটি আইনি আবরণে ভয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মানুষ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার আগে ভাবে- “এটা কি মামলা খেতে পারে?” সাংবাদিক রিপোর্ট লেখার আগে ভাবে-“এটা ছাপলে কি কারও আক্রোশে পড়া লাগবে?” এই আত্মসেন্সরশিপই মত প্রকাশের সবচেয়ে বড় শত্রু।

শুধু রাষ্ট্রীয় দমন নয়, সামাজিক বিভাজনও আজ মতপ্রকাশের অন্যতম প্রতিবন্ধক। সমাজ এমনভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে যে, তুমি যদি এক পক্ষের সমর্থক হও, অন্যপক্ষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তোমাকে ঘৃণা করবে। এই বিভাজন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যুক্তি, তথ্য, বা মানবিকতা- সবকিছুই রাজনীতির চশমায় দেখা হয়।

ফলে এখন আর মানুষ সত্য বলে না, বলে দলীয় সত্য। কেউ সরকারবিরোধী কিছু বললেই সে ‘দেশবিরোধী’; কেউ সরকারের প্রশংসা করলেই সে ‘চাটুকার’। এই মেরুকরণে নাগরিক চেতনা হারিয়ে যাচ্ছে, মানুষ হয়ে উঠছে রাজনৈতিক যন্ত্র। গণতন্ত্রে দ্বিমত মানে শত্রুতা নয়, বরং প্রয়োজনীয় ভারসাম্য। একদল যে নীতি গ্রহণ করবে, অন্য দল সেটির ভুল ধরবে- এই প্রক্রিয়াতেই রাষ্ট্রে জবাবদিহিতা তৈরি হয়।

দ্বিমতের মাধ্যমেই নীতি শুদ্ধ হয়, দুর্নীতি প্রকাশ পায়, এবং ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়। কিন্তু যখন দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ থাকে না, তখন ক্ষমতা সীমাহীন হয়ে যায়, এবং সেই সীমাহীন ক্ষমতাই একসময় রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। আদতে উল্টোটাই ঘটে।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দুর্ভাগ্যবশত ‘শত্রু সংস্কৃতি’-তে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দলের বক্তব্য শুনলে মনে হয়, শাসক দল দেশ ধ্বংস করছে; আবার শাসক দলের বক্তব্য শুনলে মনে হয়, বিরোধীরা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রী। এই শত্রুভাবাপন্ন রাজনীতি সমাজে মতপ্রকাশের জায়গা সংকুচিত করেছে, এমনকি পরিবারের মধ্যেও বিভাজন তৈরি করেছে।

আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সংকট হলো ‘নীরবতা’। মানুষ কথা বলে না, কারণ জানে- বললে বিপদ। এই নীরবতা কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিকও। যখন হাজার হাজার মানুষ নীরব থাকে, তখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো সম্মিলিত প্রতিবাদ হয় না। ফলে রাষ্ট্র ধীরে ধীরে একপাক্ষিক হয়ে যায়। ইউরোপে বা আমেরিকায় রাজনীতিকরা প্রতিদিন কঠিন সমালোচনার মুখে পড়েন, কিন্তু তারা মামলা করেন না, গ্রেফতার করান না। কারণ তারা বোঝেন- সমালোচনাই গণতন্ত্রের প্রাণ।

অথচ আমাদের দেশে সমালোচনা মানেই ‘ষড়যন্ত্র’। কথা বলাই দোষে। আর কে-ই বা চায় নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনতে! তবে এটাও সত্য- মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর দায়িত্বশীল ব্যবহারের প্রয়োজনও অপরিসীম। ফেসবুক বা ইউটিউবে অনেকে ঘৃণা, বিদ্বেষ বা মিথ্যা প্রচার করে ‘মতপ্রকাশ’ নামের আড়ালে। এই অপব্যবহার রোধে আইন দরকার, কিন্তু আইন যেন দমনযন্ত্র না হয়ে ওঠে। অন্যথায় ‘ভুয়া খবরের’ অজুহাতে সত্যিকারের সাংবাদিকতা দমন হবে, আর মানুষ আবার ভয় পাবে। তবে উল্টো চিত্রও দৃশ্যমান থাকার নজির রয়েছে।

একটি রাষ্ট্র তখনই টিকে থাকে, যখন তার নাগরিকরা সক্রিয় থাকে- যখন তারা সরকারের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে, বিরোধী দলের কৌশল বিশ্লেষণ করে, এবং স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারে। আজকের তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় হলেও, তাদের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণে ভুগছে। কারণ তারা জানে, অনলাইনেও নজরদারি আছে। এই বাস্তবতা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। কারণ, ভয় পাওয়া নাগরিক কখনও গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারে না।

প্রথমত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে আইনি কাঠামো হতে হবে ন্যায়সংগত ও স্বচ্ছ। সাইবার আইনকে অবশ্যই মানবাধিকার– সঙ্গতভাবে সংস্কার করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যেই সমালোচনা গ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

তৃতীয়ত, মিডিয়ার স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, কারণ সংবাদপত্র বা টেলিভিশন কেবল ব্যবসা নয়- তারা রাষ্ট্রের বিবেক।

সবশেষে নাগরিকদেরও দায়িত্ব আছে- সত্য ও তথ্য যাচাই করে মতপ্রকাশ করা, গুজব নয়। মত প্রকাশের অধিকার যেমন আমাদের রক্ষা করে, তেমনি আমাদেরও রক্ষা করতে হয় সেই অধিকারকে।

মতপ্রকাশ ও দ্বিমত পোষণ কোনো বিলাসিতা নয়- এটি নাগরিকের জন্মগত অধিকার বলেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যেমনটি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচ্য। যে রাষ্ট্রে মানুষ ভয়ে কথা বলে না, সেই রাষ্ট্র যতই উন্নত হোক, আসলে তা অন্ধকারে ঢাকা। বাংলাদেশ একসময় রাস্তায় নেমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, মুক্তির স্লোগান তুলেছে- “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” আজ সেই ভালোবাসার পরীক্ষা এই জায়গাতেই- আমরা কি এখনো একে অপরের কথা শুনতে পারি? যে সমাজে সবাই কথা বলতে পারে, সেখানে সত্য টিকে থাকে। আর যেখানে সবাই নীরব, সেখানে মিথ্যাই রাজা হয়। প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করে যায়।

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top