alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

মিথুশিলাক মুরমু

: বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

৬ নভেম্বর ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ- আজ থেকে প্রায় ৯ বছর আগে পুলিশ বাহিনী কর্তৃক তিনজন সাঁওতালকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম এলাকা থেকে আদিবাসী সাঁওতাল ও বাঙালিদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নয়জন পুলিশ তীরবিদ্ধ, অর্ধশতাধিক আদিবাসী সাঁওতাল আহত ও চারজন সাঁওতাল গুলিবিদ্ধ হয়। তাদের মধ্যে তিনজন সাঁওতাল- শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সেদিন আদিবাসী নারী ও শিশুরা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। পরবর্তী বছর থেকে অদ্যাবধি ৬ নভেম্বর ‘সাঁওতাল হত্যা দিবস’ হিসেবে ফার্মের আন্দোলনকারীরা মর্যাদার সঙ্গে পালন করে আসছে।

বাগদা ফার্মের এলাকাটি বেশ বিস্তৃত। গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জের রামপুরা, সাপমারা, মাদারপুর, নারাঙ্গাবাদ, চক রাহিমপুর মৌজাগুলোর মোট ১ হাজার ৮৪২.৩০ একর জমি পাকিস্তান সরকার ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরের মহিমাগঞ্জ সুগার মিলের জন্য কাঁচামাল উৎপাদনের লক্ষ্যে অধিগ্রহণ করেছিল। অধিগ্রহণের শর্তানুযায়ী পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার চিনিকল থেকে চিনি উৎপাদনে ব্যর্থ হলে স্থানীয় আদিবাসীরা অধিগ্রহণকৃত জমি ফেরতের জোর দাবি জানায়।

আদিবাসী-বাঙালিদের ঐক্যের বন্ধন শক্তপোক্ত হতে শুরু করে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে। বৈঠকের পর বৈঠক এবং নিজেদের মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে তারা একজোট হয়ে আন্দোলনে নামে। আদিবাসী-বাঙালিরা স্থানীয় প্রশাসনকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, যেহেতু শর্তানুযায়ী আখ চাষ ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং অধিগ্রহণকৃত জমিতে সরিষা, ভুট্টা, গম, ধানসহ প্রভৃতি সবজি উৎপাদিত হচ্ছে- সেটি সরাসরি অধিগ্রহণের নিয়ম লঙ্ঘন করে। চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমিটি লিজ দিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহার করছিল। শর্তানুযায়ীই প্রকৃত মালিকদের কাছে হস্তান্তরের বিধান সংরক্ষিত রয়েছে। আদিবাসীরা এই কথাগুলোই স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং ন্যায়সংগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

৬ নভেম্বর ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে আদিবাসী-বাঙালিরা সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের প্রত্যাশায় রাজপথ অবরোধ, অনশন, মিটিং-মিছিল ও আন্দোলন করেছে। মূলত সরকারের কাছ থেকে দ্রুত এবং কার্যকর সমাধান না পেয়ে আদিবাসী-বাঙালিরা চরমভাবে হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে। তারপরও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে তারা বারবার ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে, জানাতে চেয়েছে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সচেতন নাগরিকদেরÑ তারা কতটুকু অসহায় ও অন্যায্যতার শিকার। উন্নয়নের শেষ প্রান্তে থাকা এই জনগোষ্ঠী অনুমান করতে পেরেছে যে, প্রশাসন বা সরকার তাদের কোনো দাবিই আমলে নিচ্ছে না; বরং ইপিজেড বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৌশলে পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রে মত্ত হয়েছে।

আমরা জেনেছি যে, সরকার বাগদা ফার্মের জমিতে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) স্থাপনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিল্প মন্ত্রণালয় জমিটি বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং বেপজার কর্মকর্তারা এলাকা পরিদর্শন করেছেন। আর তাই তো জীবনের মায়া ত্যাগ করে নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধরা শুধুমাত্র অস্তিত্বের তাগিদে রাস্তা অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

আর কত স্মারকলিপি! আদিবাসী, বাঙালি, স্বল্পসংখ্যক হিন্দু ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে গেছেন। আদিবাসীরা শর্তানুযায়ী দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি’র ব্যানারে সরকার প্রধান, জেলা প্রশাসক, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, পুলিশ সুপার, রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম জমি উদ্ধার কমিটি’ গঠনের পর থেকে আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বারবার স্মারকলিপি প্রদান করে আসছে। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ নভেম্বর, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে- এছাড়াও আলোচনা, সংলাপ, সভা প্রভৃতি তো অসংখ্যবার অনুষ্ঠিত হয়েছে।

স্মারকলিপিতে উপস্থাপিত বিষয়গুলো ছিল- অধিগ্রহণকৃত জমি ফেরত দেওয়া; ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ নভেম্বর সংঘটিত ঘটনার ন্যায়বিচার; মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার; উচ্ছেদ বন্ধ; ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুতপূর্বক ক্ষতিপূরণ; ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা; ইপিজেড স্থাপন বন্ধ; ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিতকরণ; পুনঃখনন ও সেচব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ; নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

আদিবাসীরা বারবার অভিযোগ করেছেন- আদিবাসী-বাঙালিদের উচ্ছেদ করে ইপিজেড গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তৎকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকগণ জড়িত ছিলেন। সাঁওতালরা প্রকাশ্য জনসভায় অভিযোগ করে আসছে- গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের তৎকালীন জনপ্রতিনিধি সরাসরি জড়িত ছিলেন। আদিবাসী উচ্ছেদের নীলনকশা বাস্তবায়নে পুলিশ, সিআইডি, পিবিআই-ও মাঠে নেমেছিল।

আমরা দেখেছি, থমাস হেমব্রম বাদী হয়ে শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশের হত্যাকা-ে হুকুমদান ও সরাসরি জড়িত ৩৩ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করলে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-কে। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুলাই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে আদিবাসীরা অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং অনাস্থা পিটিশন ৪ সেপ্টেম্বর গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল করে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রতিবেদনে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং কোনো পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়নি। তারপর অধিকতর তদন্তের জন্য ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)-এর কাছে মামলা হস্তান্তর করা হয়। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২ ডিসেম্বর পূর্বের মতোই প্রায় হুবহু প্রতিবেদন জমা দিলে আদিবাসী সাঁওতালরা পুনরায় প্রত্যাখ্যান করে। নারাজি পিটিশন মামলাটি ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর আদালতে শুনানির পর ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছিল।

আদিবাসী-বাঙালিদের আন্দোলনে পাশে দাঁড়িয়েছে- বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম, গাইবান্ধা পরিবেশ আন্দোলন, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ (জেলা শাখা), জনউদ্যোগ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, এএলআরডি, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়ন, কাপেং ফাউন্ডেশন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ব্লাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।

লক্ষ্য একটিই- সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে সমস্যাগুলোর একটি ন্যায়পূর্ণ ও যৌক্তিক সমাধানে সরকারকে ভূমিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। সরকার মানবাধিকার রক্ষার মাধ্যমে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের নাগরিকদের তথা প্রান্তিক আদিবাসীদের অবস্থা পর্যালোচনা করেই যুগান্তকারী পদক্ষেপ ঘোষণা করবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

মিথুশিলাক মুরমু

বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

৬ নভেম্বর ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ- আজ থেকে প্রায় ৯ বছর আগে পুলিশ বাহিনী কর্তৃক তিনজন সাঁওতালকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম এলাকা থেকে আদিবাসী সাঁওতাল ও বাঙালিদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নয়জন পুলিশ তীরবিদ্ধ, অর্ধশতাধিক আদিবাসী সাঁওতাল আহত ও চারজন সাঁওতাল গুলিবিদ্ধ হয়। তাদের মধ্যে তিনজন সাঁওতাল- শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সেদিন আদিবাসী নারী ও শিশুরা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। পরবর্তী বছর থেকে অদ্যাবধি ৬ নভেম্বর ‘সাঁওতাল হত্যা দিবস’ হিসেবে ফার্মের আন্দোলনকারীরা মর্যাদার সঙ্গে পালন করে আসছে।

বাগদা ফার্মের এলাকাটি বেশ বিস্তৃত। গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জের রামপুরা, সাপমারা, মাদারপুর, নারাঙ্গাবাদ, চক রাহিমপুর মৌজাগুলোর মোট ১ হাজার ৮৪২.৩০ একর জমি পাকিস্তান সরকার ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরের মহিমাগঞ্জ সুগার মিলের জন্য কাঁচামাল উৎপাদনের লক্ষ্যে অধিগ্রহণ করেছিল। অধিগ্রহণের শর্তানুযায়ী পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার চিনিকল থেকে চিনি উৎপাদনে ব্যর্থ হলে স্থানীয় আদিবাসীরা অধিগ্রহণকৃত জমি ফেরতের জোর দাবি জানায়।

আদিবাসী-বাঙালিদের ঐক্যের বন্ধন শক্তপোক্ত হতে শুরু করে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে। বৈঠকের পর বৈঠক এবং নিজেদের মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে তারা একজোট হয়ে আন্দোলনে নামে। আদিবাসী-বাঙালিরা স্থানীয় প্রশাসনকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, যেহেতু শর্তানুযায়ী আখ চাষ ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং অধিগ্রহণকৃত জমিতে সরিষা, ভুট্টা, গম, ধানসহ প্রভৃতি সবজি উৎপাদিত হচ্ছে- সেটি সরাসরি অধিগ্রহণের নিয়ম লঙ্ঘন করে। চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমিটি লিজ দিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহার করছিল। শর্তানুযায়ীই প্রকৃত মালিকদের কাছে হস্তান্তরের বিধান সংরক্ষিত রয়েছে। আদিবাসীরা এই কথাগুলোই স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং ন্যায়সংগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

৬ নভেম্বর ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে আদিবাসী-বাঙালিরা সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের প্রত্যাশায় রাজপথ অবরোধ, অনশন, মিটিং-মিছিল ও আন্দোলন করেছে। মূলত সরকারের কাছ থেকে দ্রুত এবং কার্যকর সমাধান না পেয়ে আদিবাসী-বাঙালিরা চরমভাবে হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে। তারপরও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে তারা বারবার ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে, জানাতে চেয়েছে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সচেতন নাগরিকদেরÑ তারা কতটুকু অসহায় ও অন্যায্যতার শিকার। উন্নয়নের শেষ প্রান্তে থাকা এই জনগোষ্ঠী অনুমান করতে পেরেছে যে, প্রশাসন বা সরকার তাদের কোনো দাবিই আমলে নিচ্ছে না; বরং ইপিজেড বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৌশলে পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রে মত্ত হয়েছে।

আমরা জেনেছি যে, সরকার বাগদা ফার্মের জমিতে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) স্থাপনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিল্প মন্ত্রণালয় জমিটি বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং বেপজার কর্মকর্তারা এলাকা পরিদর্শন করেছেন। আর তাই তো জীবনের মায়া ত্যাগ করে নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধরা শুধুমাত্র অস্তিত্বের তাগিদে রাস্তা অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

আর কত স্মারকলিপি! আদিবাসী, বাঙালি, স্বল্পসংখ্যক হিন্দু ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে গেছেন। আদিবাসীরা শর্তানুযায়ী দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি’র ব্যানারে সরকার প্রধান, জেলা প্রশাসক, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, পুলিশ সুপার, রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম জমি উদ্ধার কমিটি’ গঠনের পর থেকে আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বারবার স্মারকলিপি প্রদান করে আসছে। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ নভেম্বর, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে- এছাড়াও আলোচনা, সংলাপ, সভা প্রভৃতি তো অসংখ্যবার অনুষ্ঠিত হয়েছে।

স্মারকলিপিতে উপস্থাপিত বিষয়গুলো ছিল- অধিগ্রহণকৃত জমি ফেরত দেওয়া; ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ নভেম্বর সংঘটিত ঘটনার ন্যায়বিচার; মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার; উচ্ছেদ বন্ধ; ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুতপূর্বক ক্ষতিপূরণ; ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা; ইপিজেড স্থাপন বন্ধ; ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিতকরণ; পুনঃখনন ও সেচব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ; নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

আদিবাসীরা বারবার অভিযোগ করেছেন- আদিবাসী-বাঙালিদের উচ্ছেদ করে ইপিজেড গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তৎকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকগণ জড়িত ছিলেন। সাঁওতালরা প্রকাশ্য জনসভায় অভিযোগ করে আসছে- গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের তৎকালীন জনপ্রতিনিধি সরাসরি জড়িত ছিলেন। আদিবাসী উচ্ছেদের নীলনকশা বাস্তবায়নে পুলিশ, সিআইডি, পিবিআই-ও মাঠে নেমেছিল।

আমরা দেখেছি, থমাস হেমব্রম বাদী হয়ে শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশের হত্যাকা-ে হুকুমদান ও সরাসরি জড়িত ৩৩ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করলে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-কে। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুলাই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে আদিবাসীরা অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং অনাস্থা পিটিশন ৪ সেপ্টেম্বর গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল করে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রতিবেদনে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং কোনো পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়নি। তারপর অধিকতর তদন্তের জন্য ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)-এর কাছে মামলা হস্তান্তর করা হয়। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২ ডিসেম্বর পূর্বের মতোই প্রায় হুবহু প্রতিবেদন জমা দিলে আদিবাসী সাঁওতালরা পুনরায় প্রত্যাখ্যান করে। নারাজি পিটিশন মামলাটি ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর আদালতে শুনানির পর ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছিল।

আদিবাসী-বাঙালিদের আন্দোলনে পাশে দাঁড়িয়েছে- বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম, গাইবান্ধা পরিবেশ আন্দোলন, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ (জেলা শাখা), জনউদ্যোগ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, এএলআরডি, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়ন, কাপেং ফাউন্ডেশন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ব্লাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।

লক্ষ্য একটিই- সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে সমস্যাগুলোর একটি ন্যায়পূর্ণ ও যৌক্তিক সমাধানে সরকারকে ভূমিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। সরকার মানবাধিকার রক্ষার মাধ্যমে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের নাগরিকদের তথা প্রান্তিক আদিবাসীদের অবস্থা পর্যালোচনা করেই যুগান্তকারী পদক্ষেপ ঘোষণা করবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

back to top