আনোয়ারুল হক
জুলাই সনদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে, তা কার্যকর করার পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের বিপরীতে বিভাজন সৃষ্টি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের কাজ শেষ করেছে। শোনা যায় কমিশন সংশ্লিষ্ট অনেকেই দায়িত্ব শেষ করে এখনকার ‘নিজ দেশে’ ফিরে গেছে।
দুনিয়ার কোনো দেশে কি এভাবে সংবিধান সংশোধন হয়েছে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর করার উদাহরণ আছে? একে গণতন্ত্র বলা হবে; না ফ্যাসিবাদের আরেক রূপ হিসেবে গণ্য হবে? পার্লামেন্টকে কোনো কিছু করতে বাধ্য করলে সেটা কি আর পার্লামেন্ট থাকে
সাংবিধানিক পরিবর্তন বা সংবিধান সংশোধনের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় - এমন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশেষ মতপার্থক্য নাই। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে এতদিনে সে সব সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে দিতে পারত। গোল বেঁধেছে সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে। আর এর দায় প্রধানত অন্তর্বর্তী সরকার এবং তার নিয়োজিত কমিশনের উপর বর্তায়। দেশবাসী যেমন জানে, সরকার আরো ভালোভাবে জানে তারা সংবিধানের ১০৬ ধারার রেফারেন্স বলে অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে সরকারের নিয়মিত দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং সে অনুযায়ী শপথ নিয়েছে। ১৫ মাস যাবত বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী এই সরকার দেশ পরিচালনা করছে। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগসহ গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা এই সংবিধানের অধীনেই চলছে। সেখানে কোন আইন বা ক্ষমতাবলে সরকার সংবিধান বহির্ভূত কোনো আদেশ দেবে? ’অন্তর্বর্তী সরকার’ নামটার মাঝেই কিন্তু সরকারের দায়িত্ব স্ব ব্যাখ্যামূলক। শেষ পর্যন্ত অবশ?্য রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে আদেশ জারি হয়েছে।
তাছাড়া বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক শাসনে যে ‘নির্বাচনবিহীন সংস্কৃতি’ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ফরজ কাজটি হলো একটি অবাধ নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আয়োজন সম্পন্ন করা। ফরজ বাদ দিয়ে তারা নফল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে, প্রয়োজনীয় নির্বাচনী সংস্কার করে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে না যেয়ে তারা দেশ ও দশের সংস্কার কাজে মনোনিবেশ করলেন। শুরুতেই নির্বাচনের পথে না হাঁটায় ঐ সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটে নাই। সারা দেশেই কমবেশি মবজাস্টিস ও মবোল্লাসের রাজত্ব চলতে থাকে। নারীর স্বাধীনভাবে চলাফেরা, তার পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদির উপর নীতিপুলিশী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন - এ সবের মাধ্যমে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক শক্তি বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যাদের তীব্র আক্রোশ সেই জামায়াত ইসলাম ও তার মিত্রদের উত্থান পরিলক্ষিত হয়।
সংস্কারের নামে, গণভোটের নামে তাদের লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশটাকে পাল্টে দেওয়া। শেখ হাসিনার প্রতি তাদের যতটুকু আক্রোশ তার চেয়ে বেশি আক্রোশ শেখ মুজিবের প্রতি। আবার শেখ মুজিব অপেক্ষা আরো বেশি আক্রোশ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতা তো আর পরিবর্তন করা সম্ভব না; তাই তারা চান মুক্তিযুদ্ধের সংবিধানটাকে পাল্টে ফেলতে। ’৭২-এর সংবিধানে অসম্পূর্ণতা ছিলো। সে অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা কখনো হয়নি। বরং সব শাসকেরা যার যার মতো সংশোধন করে ওটাকে বিকৃত করেছেন। সর্বশেষ শেখ হাসিনার সরকার এক ভয়ানক কতৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা ও তা রক্ষা কল্পে নানা সংশোধনী এনেছে। সুতরাং সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে এবং তা করার জন্য রাজনীতিকদের কম বেশি দায়বদ্ধতা রয়েছে। মার্কিন মুলুক থেকে উড়ে এসে কেউ করে দিয়ে যাবেন তা হয় না।
সাংবিধানিক সংস্কারের সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক পন্থা রয়েছে। বর্তমান সংবিধানের আওতায় শপথ নেয়া সরকারকে সংবিধান সম্মতভাবেই সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে। সামরিক শাসন আমলে তো সংবিধান স্থগিত রাখা ছিলো। তাই সামরিক শাসকেরা ফরমান বলে সংশোধন- সংযোজন করতে পেরেছেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টের কাছেই যেতে হয়েছে।বর্তমান শাসকদের যদি সংবিধান পরিবর্তন করার আকাক্সক্ষা আগে থেকেই থাকতো তবে সংবিধানের ১০৬ ধারার রেফারেন্স অনুযায়ী সরকার গঠন করলেন কেন? কেন সংবিধানকে সম্মুন্নত রাখার শপথ নিলেন? ‘হ্যাডম’ থাকলে বিপ্লবী সরকার গঠন করতেন, সংবিধান বাতিল ঘোষণা করতেন। কেনো বর্তমান সরকারের নিয়োগকারীদের অনেককেই, শিবিরের অনেককেই ছাত্রলীগ করতে হলো? ঘি খাওয়ার জন্য? ’৭১-এ গণহত্যাকারী জান্তার সাথে হাত মিলিয়ে মন্ত্রী পরিষদে জায়গা করে নিয়ে তাদের পূর্বসূরীরা ঘি খেলেন, বিগত বছরগুলোতে ছাত্রলীগে লুক্কায়িত থেকেও তাদের তরুণরা ঘি খেলেন। আর কত ঘি চাই? বিরোধী সংগঠনে অন্য যারা ছিলেন তাদেরতো জেল-জুলুম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে সংগঠন করতে হয়েছে। ছাত্রলীগ করে এসে এখন তাদের মুখে বেশি বড়ো বড়ো কথা মানায় না।
যে কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়াই সর্বসম্মত ঐকমত্য হয়েছে অন্তত সেটুকু তো নির্বাচিত পার্লামেন্ট সংবিধানসম্মত পন্থায় সংবিধানের সংস্কার করবেন।এর বাইরেও জুলাই আন্দোলনের দিনগুলোতে মূর্ত না হলেও বিমূর্তভাবে বৈষম্যমুক্ত এক মানবিক বাংলাদেশের যে জনআকাংখা আজও দেয়ালে দেয়ালে আঁকা রয়েছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সেগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে মানুষের লড়াই কিন্তু জারি থাকবে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন কী করলো? যা কখনো আলোচনাই হয়নি এবং যে বিষয়ে সকলে একমত হয়নি এমন একটা প্রস্তাব সরকারের কাছে রাখলেন। নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও তা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে উল্লেখ থাকবে না এবং নির্বাচিত আইন সভাকে ২৭০ দিনের মধ্যে সংশোধনীগুলো অনুমোদন করতে হবে। না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গৃহীত বলে গণ্য হবে অর্থাৎ প্রস্তাবিত সংশোধনী সমূহ অটোপাস হিসেবে বিবেচিত হবে। দুনিয়ার কোনো দেশে কি এভাবে সংবিধান সংশোধন হয়েছে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর করার উদাহরণ আছে? একে গণতন্ত্র বলা হবে; না ফ্যাসিবাদের আরেক রূপ হিসেবে গণ্য হবে? পার্লামেন্টকে কোনো কিছু করতে বাধ্য করলে সেটা কি আর পার্লামেন্ট থাকে। গণতন্ত্রের এই বিকৃত রূপ এবং আরো উগ্র ফ্যাসিবাদ দেখার জন্য কি এত রক্ত আর অশ্রুর জুলাই আন্দোলন!
অবশ্য প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে তার ভাষণে ১৮০ দিনের মধ্যমে সাংবিধানিক সংস্কার কাজ সম্পন্ন করতে হবে এবং এই সময়কালে পার্লামেন্ট সদস্যগণ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসাবেও কাজ করবে - শুধু এটুকুই উল্লেখ করেছেন। তবে ঐকমত্য কমিশনের সনদে সাংবিধানিক পরিষদের কোনো উল্লেখ ছিল না। তবে গণভোটের ৪টি প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে-
১. আপনি কি ভাত খেয়েছেন; ২. আপনি কি ভাতের সাথে মাছ খেয়েছেন; ৩. ভাত খাওয়ার পরে আপনি কি পানি খেয়েছেন; ৪. আপনি কি বোতলের পানি খেয়েছেন? এবার চারটি প্রশ্নের উত্তরে আপনি একটি হ্যাঁ বা না উত্তর দেন। প্রধান উপদেষ্টা জাতিকে বিরাট পরীক্ষার মধে?্য ফেলে দিলেন - যে পরীক্ষায় পাশ করা কঠিন।
জামায়াত আমীর বলছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সমূহের মতামতের ভিত্তিতে একটা চার্টার তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রের কথা যে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা যা বলবে, বাকিরা তাই মেনে নেবে। বাংলাদেশের মানুষকে এত বোকা ভাবা ঠিক না ‘আমীরে মিল্লাত’। সংখ্যায় বেশি দলগুলোই কি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে? জনগনের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় ব্যালটের মাধ্যমে- যেটা জামাত কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাইছে। আর দলের সংখ্যাও তো দেখছি ৩০টির মধ্যে মাত্র ৫-৭ টি দল জামাতের সাথে আছে। তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল তো আপনাদের সাথে নেই। আবার ৩০ দলের বাইরে দেশে অন্তত আরো ৩০টি দল আছে যারা ঐকমত্য আলোচনায় ছিলো না। জামায়াতের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সূত্র অনুযায়ী সংখ্যায় বেশি দল এই জাতীয় সনদের সাথে সম্পৃক্ত নয়। সেক্ষেত্রে সনদের কী হবে? জামাত- হেফাজত- চর মোনাই পতিত শাসকদের ন্যায় ব্যালটকে এড়িয়ে, সংবিধানকে এড়িয়ে এক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করতে মরিয়া। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সেটাই হবে তাদের প্রতিশোধ।
জামায়াত ইসলাম ‘গণতন্ত্রের এই বন্দী রূপ’ দেখতে আর ঘি খাওয়ার জন্য এতো মরীয়া কেন? ’৭১-এর ‘ঘি খাওয়ার হিসাব নিকাশ’ তো এখনো শেষ হয়নি। গত ১১ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে বর্তমান সরকার যে অধ্যাদেশ জারি করেছে এতে ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ১৯৭১- এর গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, সংখ্যালঘু ও নারী নির্যাতন এবং ‘গোটা জাতির উপর বন্দুকের ট্রিগার চাপতে আংগুল বাঁকা করার’ অপরাধে এতদিনে তো জামায়াত ইসলামের দল হিসাবে বিচার শুরু হওয়ার কথা। অপরাধের প্রমাণ-আলামত তো এই সরকারের অধ্যাদেশেই উল্লেখ রয়েছে।
অধ্যাদেশে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ অর্থ বলতে বলা হয়েছে, ‘একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ... প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ’। দল হিসাবে সুসংগঠিত এবং অর্থবিত্তে প্রতাপশালী হলেও দলের অপরাধ নাকচ হয়ে যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার তো সব অপরাধের বিচারের দায়িত্ব নিয়েছে। তাই জামাতী অপরাধের বিচারের প্রশ্নেও ‘নো হাংকি পাংকি!’ এই সরকারের সেই নৈতিক শক্তি বা মনোবল আছে কি?
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
আনোয়ারুল হক
বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
জুলাই সনদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে, তা কার্যকর করার পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের বিপরীতে বিভাজন সৃষ্টি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের কাজ শেষ করেছে। শোনা যায় কমিশন সংশ্লিষ্ট অনেকেই দায়িত্ব শেষ করে এখনকার ‘নিজ দেশে’ ফিরে গেছে।
দুনিয়ার কোনো দেশে কি এভাবে সংবিধান সংশোধন হয়েছে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর করার উদাহরণ আছে? একে গণতন্ত্র বলা হবে; না ফ্যাসিবাদের আরেক রূপ হিসেবে গণ্য হবে? পার্লামেন্টকে কোনো কিছু করতে বাধ্য করলে সেটা কি আর পার্লামেন্ট থাকে
সাংবিধানিক পরিবর্তন বা সংবিধান সংশোধনের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় - এমন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশেষ মতপার্থক্য নাই। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে এতদিনে সে সব সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে দিতে পারত। গোল বেঁধেছে সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে। আর এর দায় প্রধানত অন্তর্বর্তী সরকার এবং তার নিয়োজিত কমিশনের উপর বর্তায়। দেশবাসী যেমন জানে, সরকার আরো ভালোভাবে জানে তারা সংবিধানের ১০৬ ধারার রেফারেন্স বলে অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে সরকারের নিয়মিত দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং সে অনুযায়ী শপথ নিয়েছে। ১৫ মাস যাবত বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী এই সরকার দেশ পরিচালনা করছে। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগসহ গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা এই সংবিধানের অধীনেই চলছে। সেখানে কোন আইন বা ক্ষমতাবলে সরকার সংবিধান বহির্ভূত কোনো আদেশ দেবে? ’অন্তর্বর্তী সরকার’ নামটার মাঝেই কিন্তু সরকারের দায়িত্ব স্ব ব্যাখ্যামূলক। শেষ পর্যন্ত অবশ?্য রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে আদেশ জারি হয়েছে।
তাছাড়া বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক শাসনে যে ‘নির্বাচনবিহীন সংস্কৃতি’ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ফরজ কাজটি হলো একটি অবাধ নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আয়োজন সম্পন্ন করা। ফরজ বাদ দিয়ে তারা নফল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে, প্রয়োজনীয় নির্বাচনী সংস্কার করে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে না যেয়ে তারা দেশ ও দশের সংস্কার কাজে মনোনিবেশ করলেন। শুরুতেই নির্বাচনের পথে না হাঁটায় ঐ সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটে নাই। সারা দেশেই কমবেশি মবজাস্টিস ও মবোল্লাসের রাজত্ব চলতে থাকে। নারীর স্বাধীনভাবে চলাফেরা, তার পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদির উপর নীতিপুলিশী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন - এ সবের মাধ্যমে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক শক্তি বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যাদের তীব্র আক্রোশ সেই জামায়াত ইসলাম ও তার মিত্রদের উত্থান পরিলক্ষিত হয়।
সংস্কারের নামে, গণভোটের নামে তাদের লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশটাকে পাল্টে দেওয়া। শেখ হাসিনার প্রতি তাদের যতটুকু আক্রোশ তার চেয়ে বেশি আক্রোশ শেখ মুজিবের প্রতি। আবার শেখ মুজিব অপেক্ষা আরো বেশি আক্রোশ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতা তো আর পরিবর্তন করা সম্ভব না; তাই তারা চান মুক্তিযুদ্ধের সংবিধানটাকে পাল্টে ফেলতে। ’৭২-এর সংবিধানে অসম্পূর্ণতা ছিলো। সে অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা কখনো হয়নি। বরং সব শাসকেরা যার যার মতো সংশোধন করে ওটাকে বিকৃত করেছেন। সর্বশেষ শেখ হাসিনার সরকার এক ভয়ানক কতৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা ও তা রক্ষা কল্পে নানা সংশোধনী এনেছে। সুতরাং সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে এবং তা করার জন্য রাজনীতিকদের কম বেশি দায়বদ্ধতা রয়েছে। মার্কিন মুলুক থেকে উড়ে এসে কেউ করে দিয়ে যাবেন তা হয় না।
সাংবিধানিক সংস্কারের সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক পন্থা রয়েছে। বর্তমান সংবিধানের আওতায় শপথ নেয়া সরকারকে সংবিধান সম্মতভাবেই সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে। সামরিক শাসন আমলে তো সংবিধান স্থগিত রাখা ছিলো। তাই সামরিক শাসকেরা ফরমান বলে সংশোধন- সংযোজন করতে পেরেছেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টের কাছেই যেতে হয়েছে।বর্তমান শাসকদের যদি সংবিধান পরিবর্তন করার আকাক্সক্ষা আগে থেকেই থাকতো তবে সংবিধানের ১০৬ ধারার রেফারেন্স অনুযায়ী সরকার গঠন করলেন কেন? কেন সংবিধানকে সম্মুন্নত রাখার শপথ নিলেন? ‘হ্যাডম’ থাকলে বিপ্লবী সরকার গঠন করতেন, সংবিধান বাতিল ঘোষণা করতেন। কেনো বর্তমান সরকারের নিয়োগকারীদের অনেককেই, শিবিরের অনেককেই ছাত্রলীগ করতে হলো? ঘি খাওয়ার জন্য? ’৭১-এ গণহত্যাকারী জান্তার সাথে হাত মিলিয়ে মন্ত্রী পরিষদে জায়গা করে নিয়ে তাদের পূর্বসূরীরা ঘি খেলেন, বিগত বছরগুলোতে ছাত্রলীগে লুক্কায়িত থেকেও তাদের তরুণরা ঘি খেলেন। আর কত ঘি চাই? বিরোধী সংগঠনে অন্য যারা ছিলেন তাদেরতো জেল-জুলুম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে সংগঠন করতে হয়েছে। ছাত্রলীগ করে এসে এখন তাদের মুখে বেশি বড়ো বড়ো কথা মানায় না।
যে কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়াই সর্বসম্মত ঐকমত্য হয়েছে অন্তত সেটুকু তো নির্বাচিত পার্লামেন্ট সংবিধানসম্মত পন্থায় সংবিধানের সংস্কার করবেন।এর বাইরেও জুলাই আন্দোলনের দিনগুলোতে মূর্ত না হলেও বিমূর্তভাবে বৈষম্যমুক্ত এক মানবিক বাংলাদেশের যে জনআকাংখা আজও দেয়ালে দেয়ালে আঁকা রয়েছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সেগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে মানুষের লড়াই কিন্তু জারি থাকবে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন কী করলো? যা কখনো আলোচনাই হয়নি এবং যে বিষয়ে সকলে একমত হয়নি এমন একটা প্রস্তাব সরকারের কাছে রাখলেন। নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও তা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে উল্লেখ থাকবে না এবং নির্বাচিত আইন সভাকে ২৭০ দিনের মধ্যে সংশোধনীগুলো অনুমোদন করতে হবে। না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গৃহীত বলে গণ্য হবে অর্থাৎ প্রস্তাবিত সংশোধনী সমূহ অটোপাস হিসেবে বিবেচিত হবে। দুনিয়ার কোনো দেশে কি এভাবে সংবিধান সংশোধন হয়েছে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর করার উদাহরণ আছে? একে গণতন্ত্র বলা হবে; না ফ্যাসিবাদের আরেক রূপ হিসেবে গণ্য হবে? পার্লামেন্টকে কোনো কিছু করতে বাধ্য করলে সেটা কি আর পার্লামেন্ট থাকে। গণতন্ত্রের এই বিকৃত রূপ এবং আরো উগ্র ফ্যাসিবাদ দেখার জন্য কি এত রক্ত আর অশ্রুর জুলাই আন্দোলন!
অবশ্য প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে তার ভাষণে ১৮০ দিনের মধ্যমে সাংবিধানিক সংস্কার কাজ সম্পন্ন করতে হবে এবং এই সময়কালে পার্লামেন্ট সদস্যগণ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসাবেও কাজ করবে - শুধু এটুকুই উল্লেখ করেছেন। তবে ঐকমত্য কমিশনের সনদে সাংবিধানিক পরিষদের কোনো উল্লেখ ছিল না। তবে গণভোটের ৪টি প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে-
১. আপনি কি ভাত খেয়েছেন; ২. আপনি কি ভাতের সাথে মাছ খেয়েছেন; ৩. ভাত খাওয়ার পরে আপনি কি পানি খেয়েছেন; ৪. আপনি কি বোতলের পানি খেয়েছেন? এবার চারটি প্রশ্নের উত্তরে আপনি একটি হ্যাঁ বা না উত্তর দেন। প্রধান উপদেষ্টা জাতিকে বিরাট পরীক্ষার মধে?্য ফেলে দিলেন - যে পরীক্ষায় পাশ করা কঠিন।
জামায়াত আমীর বলছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সমূহের মতামতের ভিত্তিতে একটা চার্টার তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রের কথা যে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা যা বলবে, বাকিরা তাই মেনে নেবে। বাংলাদেশের মানুষকে এত বোকা ভাবা ঠিক না ‘আমীরে মিল্লাত’। সংখ্যায় বেশি দলগুলোই কি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে? জনগনের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় ব্যালটের মাধ্যমে- যেটা জামাত কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাইছে। আর দলের সংখ্যাও তো দেখছি ৩০টির মধ্যে মাত্র ৫-৭ টি দল জামাতের সাথে আছে। তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল তো আপনাদের সাথে নেই। আবার ৩০ দলের বাইরে দেশে অন্তত আরো ৩০টি দল আছে যারা ঐকমত্য আলোচনায় ছিলো না। জামায়াতের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সূত্র অনুযায়ী সংখ্যায় বেশি দল এই জাতীয় সনদের সাথে সম্পৃক্ত নয়। সেক্ষেত্রে সনদের কী হবে? জামাত- হেফাজত- চর মোনাই পতিত শাসকদের ন্যায় ব্যালটকে এড়িয়ে, সংবিধানকে এড়িয়ে এক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করতে মরিয়া। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সেটাই হবে তাদের প্রতিশোধ।
জামায়াত ইসলাম ‘গণতন্ত্রের এই বন্দী রূপ’ দেখতে আর ঘি খাওয়ার জন্য এতো মরীয়া কেন? ’৭১-এর ‘ঘি খাওয়ার হিসাব নিকাশ’ তো এখনো শেষ হয়নি। গত ১১ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে বর্তমান সরকার যে অধ্যাদেশ জারি করেছে এতে ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ১৯৭১- এর গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, সংখ্যালঘু ও নারী নির্যাতন এবং ‘গোটা জাতির উপর বন্দুকের ট্রিগার চাপতে আংগুল বাঁকা করার’ অপরাধে এতদিনে তো জামায়াত ইসলামের দল হিসাবে বিচার শুরু হওয়ার কথা। অপরাধের প্রমাণ-আলামত তো এই সরকারের অধ্যাদেশেই উল্লেখ রয়েছে।
অধ্যাদেশে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ অর্থ বলতে বলা হয়েছে, ‘একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ... প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ’। দল হিসাবে সুসংগঠিত এবং অর্থবিত্তে প্রতাপশালী হলেও দলের অপরাধ নাকচ হয়ে যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার তো সব অপরাধের বিচারের দায়িত্ব নিয়েছে। তাই জামাতী অপরাধের বিচারের প্রশ্নেও ‘নো হাংকি পাংকি!’ এই সরকারের সেই নৈতিক শক্তি বা মনোবল আছে কি?
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]