alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

উপকূলে মটরশুটি চাষ: মাটি ও মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা

এম জি নিয়োগী

: বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ ২০২২
image

বাংলাদেশে মটরশুটি অত্যন্ত পরিচিত এবং জনপ্রিয় একটি সবজি, যা অত্যন্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ। এই সবুজ মটরশুটিই পরিপক‹ হলে এটি মটর ডালে পরিণত হয়। তখন এটিকে মটর ডাল হিসাবে খাওয়া হয়। দুভাবেই বাংলাদেশের মানুষ এটি খেয়ে থাকে। এছাড়া শাক হিসাবেও বাংলাদেশের মানুষ এটিকে পছন্দ করে। মটরসুটি বা মটর ডালের বহুবিধ খাদ্য ও অনেক পুষ্টি সমৃদ্ধতা এবং জনপ্রিয়তার কারনে নিরামিষভোজী মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। অর্ধেক কাপ মটরশুটিতে ৪ গ্রাম প্রোটিন এবং ৪ গ্রাম আঁশ আছে। সেখানে একই পরিমান গাজরে মাত্র এক গ্রাম প্রোটিন আছে। এতে বোঝা যায়, কেন এই মটরশুটি বা মটরের ডাল নিরামিষাশীদের কাছে আদরনীয়!

মটরশুটিতে প্রচুর ফলিক এসিড আছে। এটি ভিটামিন সি বা এসকরবিক এসিডের অন্যতম উৎস, যেটি মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মটরশুটিতে যথেষ্ট পরিমান ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, ম্যাঙ্গানিজ, থায়ামিন, আয়রন এবং ফসফরাস আছে। হাড় এবং মাংসপেশীর দৃঢ়তার জন্য মটরশুটি অত্যন্ত উপযোগী - বিশেষ করে আর্থাইটিস ও অস্টিওপরোসিস রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। মটরশুটি বার্ধক্যের লক্ষণগুলোকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। মটরশুটি ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে। আলঝেইমার ও ব্রংকাইটিস রোগ প্রতিরোধে মটরশুটি কার্যকর। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রনেও মটরশুটি ভাল ভূমিকা রাখে। পাকস্থলীর ক্যানসার প্রতিরোধে মটরশুটি অত্যন্ত কার্যকর। হৃদযন্ত্রের জন্য মটরশুটি ভাল। কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে মটরশুটি ইতিবাচক। শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে মটরশুটি কার্যকর। মটরশুটি বা মটর ডালের বহুবিধ খাদ্য ও পুষ্টিমানের কারণে এবং মটরসুটি বা মটর ডাল উভয়েরই ভোক্তার কাছে যথেষ্ট চাহিদা এবং ভাল বাজার থাকার জন্য অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের এই যৌথ প্রকল্প মটরশুটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে এর উন্নয়নে গবেষণা করছে।

মটরশুটি শীত পছন্দকারী ফসল। বাংলাদেশে শীত মৌসুমে এই ফসলের জন্য অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করে বিধায় শীত মৌসুমে মটরশুটির চাষাবাদ হয়ে থাকে। মটরশুটি ফসল ১০ থেকে ২৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার মধ্যে ভালো ফলন দেয়। সেজন্য বাংলাদেশে মটরশুটির বীজ বপনের জন্য সবচেয়ে ভালো সময় নভেম্বর মাস। তবে নভেম্বর মাসে জমিতে আমন ধান থাকে। সেজন্য কৃষকরা আমন ধান থাকা অবস্থাতেই নভেম্বর মাসে জমি কাঁদা কাঁদা থাকা অবস্থায় বিঘা প্রতি ২০-২৫ কেজি মটরশুটির বীজ ধানের জমিতে ছিটিয়ে দেয়। এই পদ্ধতিকে রিলে ফসল চাষ পদ্ধতি বলা হয়। এই পদ্ধতির বদৌলতে কৃষকরা সঠিক সময়ে অর্থাৎ নভেম্বর মাসেই মটরশুটির বীজ বুনতে পারছে। এভাবে নভেম্বর মাসে কাঁদাযুক্ত জমিতে বীজ ছিটানোর কারনে বীজ ভালভাবে গজাতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো - এ পদ্ধতিতে কৃষক জমি তৈরির খরচ থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে এবং সঠিক সময়ে চাষাবাদের কারনে ভাল ফলন নিশ্চিত হচ্ছে। মটরশুটি বীজ বোনার ২০-৩০ দিনের মধ্যে কৃষক পাকা আমন ধান কেটে নেওয়ার পর জমিতে ছোট ছোট মটরশুটির চারা দেখা যাবে। ধান কাটার পর মটরশুটির চারা রোদ-বাতাস পেয়ে দ্রুত বেড়ে উঠবে।

বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, জলবায়ুর মাত্রাতিরিক্ত পরিবর্তনজনিত কারনে - বিশেষ করে অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে মটরশুটি ফসলের জমিতে কয়েকদিনের জন্য জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। মূলতঃ বৃষ্টির পানি নিস্কাশন না করার কারনে বা নিস্কাশনের ব্যবস্থা না থাকার কারনে প্রায় প্রতি বছর মটরশুটি ফসল নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে কৃষক মটরশুটিসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে শুস্ক মৌসুমে উপকূলের অনাবাদী জমিকে আবাদের আওতায় আনতে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের যৌথ প্রকল্পের আওতায় (CIM-ACIAR-2014-076) অস্ট্রেলিয়ার এসিআইএআর (ACIAR) এবং বাংলাদেশের কেজিএফ (KGF) এর অর্থায়নে ইউনিভার্সিটি অব ওয়ের্স্টান অস্ট্রেলিয়া, সিএসআইআরও (CSIRO), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম ও ভূট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গত ২০১৭ সন থেকে গবেষণা করে আসছে।

যেহেতু সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে শুস্ক মৌসুমে বা শীতকালীন সময়ে বিস্তীর্ন জমি পতিত থাকে, সে কারণে এই অঞ্চলেই ফসলটি বিস্তারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কয়েক বছরের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে শুস্ক মৌসুমে উপকূলের অনাবাদী জমিতে ডাল ও গম ফসলের উšনত চাষাবাদের জন্য এই যৌথ প্রকল্প পোভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে ব্লক প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করছে।

বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি মটর-৩ উচ্চ ফলনশীল একটি মটরশুটির জাত। এটি চাষাবাদে ভাল ফলন পাওয়া যেতে পারে। এটি তুলনামূলকভাবে কিছুটা জলাবদ্ধতাও সহ্য করতে পারে। কৃষক মটরশুটি বীজ বোনার ৬৫-৭৫ দিনের মধ্যেই মটরশুটি তুলতে পারবে, খেতে পারবে এবং বাজারে বিক্রিও করতে পারবে। সাধারণত বীজ বপনের ৭৫ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত কৃষক প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বাজারে মটরশুটি বিক্রি করেছেন এবং খেয়েছেনও। এরপরে যে ছেইগুলো থেকে যায়, সেগুলো মটর ডালে পরিণত হয়। বীজ বপনের ১৩০-১৪০ দিন পরে গাছ শুকিয়ে গেলে, রোদে দিয়ে মাড়াই করে নিতে হয়।

গবেষনায় দেখা গেছে, ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে ধান কাঁটার সময় উপকূলের জমিতে সাধারনত: লবণাক্ততা কম থাকে। ফেব্রুয়ারী মাসেও লবণাক্ততা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। মার্চ মাসে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে এবং এপ্রিল-মে মাসে খুবই বেড়ে যায়। নভেম্বর মাসে মটরশুটি বীজ বপন করলে মার্চ মাসেই অর্থাৎ লবণাক্ততা বাড়ার পূর্বেই মটরশুটি ঘরে তোলা যায়।

গত ১২ নভেম্বর ২০২১ তারিখে বরিশালের উজিরপুর পৌরসভার ইচলাদিতে কৃষক সুলতান হাওলাদারহ সহ ১৩ জন কৃষকের ৭ বিঘা আমন ধানের ব্লকে প্রথমবারের মতো বারি মটর-৩ জাতের বীজ ছিটানো হয়েছিল। ধান গাছ দাঁড়ানো অবস্থায় ছিল বিধায় ছিটানো মটরশুটির বীজ কর্দমাক্ত জমিতে ভালভাবে পড়েছিল। সে কারনে প্রায় সব বীজ ঠিকমতো গজিয়েছিল। কৃষক সাধারনত রিলে মটরশুটি জমিতে কোন প্রকার সার প্রয়োগ করে না। বীজ বপনের ঠিক ১ দিন পূর্বে অর্থাৎ ১১ নভেম্বর বিঘাপ্রতি ৭.৫ কেজি টিএসপি, ৪.৫ কেজি পটাশ এবং ৪.৫ জিপসাম ছিটানো হয়েছিল। কৃষক নভেম্বরের ৩০ তারিখে আমন ধান কেঁটে নেওয়ার পর ছোট ছোট চারা রোদ-বাতাস পেয়ে খুব দ্রুত বেড়ে উঠেছে। ধান কেটে নেওয়ার পর কৃষক বিঘাপতি ৮ কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়েছিলো। এতে ভালো ফলন নিশ্চিত হয়। সার ও বীজ ছিটানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে, ধান গাছ যেন জমিতে দাঁড়ানো অবস্থায় থাকে। শুইয়ে পড়া ধান গাছের জমিতে রিলে মটরশুটি চাষাবাদ করা যাবে না। গাছ ভেজা থাকা অবস্থায়ও সার ছিটানো ঠিক হবে না। এছাড়া বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানি যেন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে পারে, সেজন্য নালা কেটে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করা ছিল।

গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন আগাম বৃষ্টি হচ্ছে। অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছাস হচ্ছে। ফলে ডাল জাতীয় ফসল নষ্ট হচ্ছে। যে জমিতে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা নেই বা অপেক্ষাকৃত নীচু জমি, সে জমিতে কোন অবস্থাতেই ডাল জাতীয় ফসল চাষাবাদ করা যাবে না। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের তান্ডবে হাজার হাজার হেক্টর ফসলী জমি ৩-৪ দিনের অনবরত বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। দেখা গেছে, যে সমস্ত জমিতে কৃষক পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করতে পেরেছিল অর্থাৎ জমি থেকে পানি বের করে দিতে পেরেছিল, সে সমস্ত জমিতে মটরশুটি ফসলের তেমন ক্ষতি হয়নি। সে কারনে ডিসেম্বরের ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ বা ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে প্রচন্ড বৃষ্টিতেও মটরশুটি গাছ নষ্ট হয়নি। এরপর গত ২০ ফেব্রুয়ারিতেও সারা রাত বৃষ্টি হয়েছিল। সে সময়ও জমি থেকে পানি ঠিকমতো বের করে দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ যথোপযুক্ত পানি নিস্কাশন ব্যবস্থাধীন জমি ডাল ফসল চাষাবাদের পূর্বশর্ত।

ধান কাটার সময় জমিতে অন্তত ৬-৮ ইঞ্চি নাড়া থাকে - সে ব্যবস্থা কৃষকদের করতে হবে। জমিতে বড় বড় নাড়া থাকলে মটরশুটি গাছ ভালভাবে উপরের দিকে উঠতে পারবে। উপরের দিকে উঠতে পারার কারণে গাছ চারিদিক দিয়ে প্রচুর আলো-বাতাস পাবে এবং প্রতিটি গাছে প্রচুর ফুল-ফল আসবে। এতে ফলন অনেক বেশি হবে।

বরিশাল বিমানবন্দর উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের ডিক্রিরচর গ্রামে বেশ কিছু জমিতে কৃষক মটরশুটির চাষাবাদ করছেন এবং লাভবান হচ্ছেন। এরকম একজন কৃষক নূরুল আমিন জানালেন মটরশুটি কাঁচা অবস্থায় বেশ সুস্বাদু। তারা সবজী, তরকারী, পোলাও, খিচুরী ইত্যাদি রান্না করার সময় সবুজ মটরশুটি ব্যবহার করে থাকেন। এ ছাড়া ৫০-৭০ টাকা কেজি হিসাবে বাজারেও বিক্রি করেন। মটরশুটি মৌসুমে কৃষকরা প্রায় প্রতি সপ্তাহে সবুজ মটরশুটি বাজারে নিয়ে যান এবং তা বিক্রি করে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনে থাকেন। মটরশুটির ভাল বাজার থাকাতে এ ফসল সম্প্রসারনের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।

যমুনা সেতুর কারণে নাটোর সহ ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় মটরশুটির আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় বড় বাজারে বাজারজাত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালু হলে বরিশাল অঞ্চলে মটরশুটিসহ বিভিন্ন ডাল জাতীয় ফসলের চাহিদা বাড়বে এবং তা ঢাকার বাজারসহ বিভিন্ন শহরে বাজারজাত করে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হবে।

কৃষকদের ধারণা, তারা এখান থেকে বিঘা প্রতি ২০০ কেজিরও বেশি মটরশুটি পাবেন, যার আনুমানিক বাজার মূল্য ১০ হাজার টাকারও বেশি। বাজারে এখন এক কেজি মটরশুটির মূল্য ৫০-৭০ টাকা। অথচ ধানের জমিতে রিলে পদ্ধতিতে মটরশুটি চাষাবাদে বীজ ও সারসহ খরচ বিঘা প্রতি মাত্র ১ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, মটরশুটি গাছের শিকড়ে নডুউল তৈরি হয়, যা মাটিকে উর্বর করে। অর্থাৎ ডাল ফসল আবাদের কারণে জমির উর্বরতা শক্তিও বাড়বে। মটরশুটি ফসল তোলার পর ধান গাছের নাড়া জমিতে মিশিয়ে দিলেও জমির উর্বরতা বাড়বে। এতে জমির লবণাক্ততাও কিছুটা কমে যাবে। ফলে পরবর্তী ফসল ভাল হবে।

তাই, উপকূলে মটরশুটি আবাদে নি¤েœর বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবেঃ

১। পাানি নিস্কাশন ব্যবস্থা ছাড়া মটরশুটি চাষাবাদ করা ঠিক হবে না।

২। ধান কাটার ২০-২৫ দিন পূর্বে নভেম্বর মাসে কর্দমাক্ত বা ভিজা জমিতে মটরশুটির বীজ ছিটাতে হবে।

৩। মটরশুটির বীজ ছিটানোর সময় ধান গাছ দাড়ানো অবস্থায় থাকতে হবে। ধান গাছ মাটিতে শুইয়ে পড়লে ঐ জমিতে মটরশুটি চাষাবাদ করা যাবে না।

৪। ধান কাটার সময় অন্তত জমিতে ৬-৮ ইঞ্চি পরিমান নাড়া রেখে ধান কাটতে হবে। এতে মটরশুটি গাছ ধান গাছের নাড়াকে অবলম্বন করে বাউনির সাহায্যে উপরে উঠতে পারে, যা অধিক ফলনে সহায়ক।

৫। ধানের জমিতে মটরশুটি বীজ ছিটানোর ১ দিন পূর্বে বিঘা প্রতি ৭.৫ কেজি টিএসপি, ৪.৫ কেজি পটাশ এবং ৪.৫ জিপসাম ছিটিয়ে দিলে ফলন ভাল হবে।

৬। ধান কাটার পর মটরশুটি রিলে জমিতে বিকালের দিকে বিঘা প্রতি ৮ কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিলে ফলন ভাল হবে। খেয়াল রাখতে হবে, এসময় জমি যেন ভেজা ভেজা থাকে।

গত কয়েক বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত লবণাক্ততা বা প্রতিকূল অবহাওয়ার কারণে ফসলের জীবনকাল স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গেছে। আমরা গম ফসলের বেলায় দেখেছি অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারনে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় ১৫-২০ দিন আগেই গম ফসল পেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমানু গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কিছু স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, যেগুলো ভালো ফলন দিতে সক্ষম। আবার বেশ কিছু জাত উদ্ভাবন হয়েছে, সেগুলো পাকার সময় ধান গাছ দাড়ানো অবস্থায় থাকে। লবণাক্ততা সহিষ্ণু বেশ কিছু জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যেগুলো উপকূলের লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ করে ভাল ফলন পাওয়া যেতে পারে। এ সমস্ত প্রতিকূলতা সহিষ্ণু স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উপকূলের লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ করলে পরবর্তী ডাল বা গম ফসল শুস্ক মৌসুমে সময়মতো চাষাবাদ করে কাঙ্খিত ফলন ঘরে তোলা যাবে।

রিলে মটরশুটি ফসল চাষাবাদের জন্য বীজ এবং সার ছাড়া আর কোন খরচ নেই। এভাবেই উপকূলের পানি নিস্কাশনযোগ্য আমন ধানের কাদাময় জমিতে নভেম্বর মাসে বারি মটর-৩ জাতের বীজ ও সার ছিটিয়ে পতিত জমিতে কৃষক একটি অতিরিক্ত ফসল ফলাতে পারে। এতে কৃষক অত্যন্ত কম খরচে বিঘাপ্রতি ২০০ কেজি মটর ডাল পাবে। পাশাপাশি ডাল ফসলের শিকড়ে নডুউল হওয়ার কারণে এবং তা জমিতে মিশে যাওয়ার ফলে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়বে। শুধু তাই নয়, গরু-ছাগলের পুষ্টিতেও এই ফসল অবদান রাখবে।

[লখেক:স্বাধীনতা পুরষ্কার পদক প্রাপ্ত বিজ্ঞানী, ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েষ্টার্ণ অস্ট্রেলিয়া]

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

উপকূলে মটরশুটি চাষ: মাটি ও মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা

এম জি নিয়োগী

image

বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ ২০২২

বাংলাদেশে মটরশুটি অত্যন্ত পরিচিত এবং জনপ্রিয় একটি সবজি, যা অত্যন্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ। এই সবুজ মটরশুটিই পরিপক‹ হলে এটি মটর ডালে পরিণত হয়। তখন এটিকে মটর ডাল হিসাবে খাওয়া হয়। দুভাবেই বাংলাদেশের মানুষ এটি খেয়ে থাকে। এছাড়া শাক হিসাবেও বাংলাদেশের মানুষ এটিকে পছন্দ করে। মটরসুটি বা মটর ডালের বহুবিধ খাদ্য ও অনেক পুষ্টি সমৃদ্ধতা এবং জনপ্রিয়তার কারনে নিরামিষভোজী মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। অর্ধেক কাপ মটরশুটিতে ৪ গ্রাম প্রোটিন এবং ৪ গ্রাম আঁশ আছে। সেখানে একই পরিমান গাজরে মাত্র এক গ্রাম প্রোটিন আছে। এতে বোঝা যায়, কেন এই মটরশুটি বা মটরের ডাল নিরামিষাশীদের কাছে আদরনীয়!

মটরশুটিতে প্রচুর ফলিক এসিড আছে। এটি ভিটামিন সি বা এসকরবিক এসিডের অন্যতম উৎস, যেটি মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মটরশুটিতে যথেষ্ট পরিমান ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, ম্যাঙ্গানিজ, থায়ামিন, আয়রন এবং ফসফরাস আছে। হাড় এবং মাংসপেশীর দৃঢ়তার জন্য মটরশুটি অত্যন্ত উপযোগী - বিশেষ করে আর্থাইটিস ও অস্টিওপরোসিস রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। মটরশুটি বার্ধক্যের লক্ষণগুলোকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। মটরশুটি ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে। আলঝেইমার ও ব্রংকাইটিস রোগ প্রতিরোধে মটরশুটি কার্যকর। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রনেও মটরশুটি ভাল ভূমিকা রাখে। পাকস্থলীর ক্যানসার প্রতিরোধে মটরশুটি অত্যন্ত কার্যকর। হৃদযন্ত্রের জন্য মটরশুটি ভাল। কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে মটরশুটি ইতিবাচক। শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে মটরশুটি কার্যকর। মটরশুটি বা মটর ডালের বহুবিধ খাদ্য ও পুষ্টিমানের কারণে এবং মটরসুটি বা মটর ডাল উভয়েরই ভোক্তার কাছে যথেষ্ট চাহিদা এবং ভাল বাজার থাকার জন্য অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের এই যৌথ প্রকল্প মটরশুটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে এর উন্নয়নে গবেষণা করছে।

মটরশুটি শীত পছন্দকারী ফসল। বাংলাদেশে শীত মৌসুমে এই ফসলের জন্য অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করে বিধায় শীত মৌসুমে মটরশুটির চাষাবাদ হয়ে থাকে। মটরশুটি ফসল ১০ থেকে ২৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার মধ্যে ভালো ফলন দেয়। সেজন্য বাংলাদেশে মটরশুটির বীজ বপনের জন্য সবচেয়ে ভালো সময় নভেম্বর মাস। তবে নভেম্বর মাসে জমিতে আমন ধান থাকে। সেজন্য কৃষকরা আমন ধান থাকা অবস্থাতেই নভেম্বর মাসে জমি কাঁদা কাঁদা থাকা অবস্থায় বিঘা প্রতি ২০-২৫ কেজি মটরশুটির বীজ ধানের জমিতে ছিটিয়ে দেয়। এই পদ্ধতিকে রিলে ফসল চাষ পদ্ধতি বলা হয়। এই পদ্ধতির বদৌলতে কৃষকরা সঠিক সময়ে অর্থাৎ নভেম্বর মাসেই মটরশুটির বীজ বুনতে পারছে। এভাবে নভেম্বর মাসে কাঁদাযুক্ত জমিতে বীজ ছিটানোর কারনে বীজ ভালভাবে গজাতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো - এ পদ্ধতিতে কৃষক জমি তৈরির খরচ থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে এবং সঠিক সময়ে চাষাবাদের কারনে ভাল ফলন নিশ্চিত হচ্ছে। মটরশুটি বীজ বোনার ২০-৩০ দিনের মধ্যে কৃষক পাকা আমন ধান কেটে নেওয়ার পর জমিতে ছোট ছোট মটরশুটির চারা দেখা যাবে। ধান কাটার পর মটরশুটির চারা রোদ-বাতাস পেয়ে দ্রুত বেড়ে উঠবে।

বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, জলবায়ুর মাত্রাতিরিক্ত পরিবর্তনজনিত কারনে - বিশেষ করে অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে মটরশুটি ফসলের জমিতে কয়েকদিনের জন্য জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। মূলতঃ বৃষ্টির পানি নিস্কাশন না করার কারনে বা নিস্কাশনের ব্যবস্থা না থাকার কারনে প্রায় প্রতি বছর মটরশুটি ফসল নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে কৃষক মটরশুটিসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে শুস্ক মৌসুমে উপকূলের অনাবাদী জমিকে আবাদের আওতায় আনতে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের যৌথ প্রকল্পের আওতায় (CIM-ACIAR-2014-076) অস্ট্রেলিয়ার এসিআইএআর (ACIAR) এবং বাংলাদেশের কেজিএফ (KGF) এর অর্থায়নে ইউনিভার্সিটি অব ওয়ের্স্টান অস্ট্রেলিয়া, সিএসআইআরও (CSIRO), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম ও ভূট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গত ২০১৭ সন থেকে গবেষণা করে আসছে।

যেহেতু সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে শুস্ক মৌসুমে বা শীতকালীন সময়ে বিস্তীর্ন জমি পতিত থাকে, সে কারণে এই অঞ্চলেই ফসলটি বিস্তারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কয়েক বছরের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে শুস্ক মৌসুমে উপকূলের অনাবাদী জমিতে ডাল ও গম ফসলের উšনত চাষাবাদের জন্য এই যৌথ প্রকল্প পোভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে ব্লক প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করছে।

বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি মটর-৩ উচ্চ ফলনশীল একটি মটরশুটির জাত। এটি চাষাবাদে ভাল ফলন পাওয়া যেতে পারে। এটি তুলনামূলকভাবে কিছুটা জলাবদ্ধতাও সহ্য করতে পারে। কৃষক মটরশুটি বীজ বোনার ৬৫-৭৫ দিনের মধ্যেই মটরশুটি তুলতে পারবে, খেতে পারবে এবং বাজারে বিক্রিও করতে পারবে। সাধারণত বীজ বপনের ৭৫ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত কৃষক প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বাজারে মটরশুটি বিক্রি করেছেন এবং খেয়েছেনও। এরপরে যে ছেইগুলো থেকে যায়, সেগুলো মটর ডালে পরিণত হয়। বীজ বপনের ১৩০-১৪০ দিন পরে গাছ শুকিয়ে গেলে, রোদে দিয়ে মাড়াই করে নিতে হয়।

গবেষনায় দেখা গেছে, ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে ধান কাঁটার সময় উপকূলের জমিতে সাধারনত: লবণাক্ততা কম থাকে। ফেব্রুয়ারী মাসেও লবণাক্ততা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। মার্চ মাসে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে এবং এপ্রিল-মে মাসে খুবই বেড়ে যায়। নভেম্বর মাসে মটরশুটি বীজ বপন করলে মার্চ মাসেই অর্থাৎ লবণাক্ততা বাড়ার পূর্বেই মটরশুটি ঘরে তোলা যায়।

গত ১২ নভেম্বর ২০২১ তারিখে বরিশালের উজিরপুর পৌরসভার ইচলাদিতে কৃষক সুলতান হাওলাদারহ সহ ১৩ জন কৃষকের ৭ বিঘা আমন ধানের ব্লকে প্রথমবারের মতো বারি মটর-৩ জাতের বীজ ছিটানো হয়েছিল। ধান গাছ দাঁড়ানো অবস্থায় ছিল বিধায় ছিটানো মটরশুটির বীজ কর্দমাক্ত জমিতে ভালভাবে পড়েছিল। সে কারনে প্রায় সব বীজ ঠিকমতো গজিয়েছিল। কৃষক সাধারনত রিলে মটরশুটি জমিতে কোন প্রকার সার প্রয়োগ করে না। বীজ বপনের ঠিক ১ দিন পূর্বে অর্থাৎ ১১ নভেম্বর বিঘাপ্রতি ৭.৫ কেজি টিএসপি, ৪.৫ কেজি পটাশ এবং ৪.৫ জিপসাম ছিটানো হয়েছিল। কৃষক নভেম্বরের ৩০ তারিখে আমন ধান কেঁটে নেওয়ার পর ছোট ছোট চারা রোদ-বাতাস পেয়ে খুব দ্রুত বেড়ে উঠেছে। ধান কেটে নেওয়ার পর কৃষক বিঘাপতি ৮ কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়েছিলো। এতে ভালো ফলন নিশ্চিত হয়। সার ও বীজ ছিটানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে, ধান গাছ যেন জমিতে দাঁড়ানো অবস্থায় থাকে। শুইয়ে পড়া ধান গাছের জমিতে রিলে মটরশুটি চাষাবাদ করা যাবে না। গাছ ভেজা থাকা অবস্থায়ও সার ছিটানো ঠিক হবে না। এছাড়া বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানি যেন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে পারে, সেজন্য নালা কেটে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করা ছিল।

গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন আগাম বৃষ্টি হচ্ছে। অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছাস হচ্ছে। ফলে ডাল জাতীয় ফসল নষ্ট হচ্ছে। যে জমিতে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা নেই বা অপেক্ষাকৃত নীচু জমি, সে জমিতে কোন অবস্থাতেই ডাল জাতীয় ফসল চাষাবাদ করা যাবে না। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের তান্ডবে হাজার হাজার হেক্টর ফসলী জমি ৩-৪ দিনের অনবরত বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। দেখা গেছে, যে সমস্ত জমিতে কৃষক পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করতে পেরেছিল অর্থাৎ জমি থেকে পানি বের করে দিতে পেরেছিল, সে সমস্ত জমিতে মটরশুটি ফসলের তেমন ক্ষতি হয়নি। সে কারনে ডিসেম্বরের ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ বা ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে প্রচন্ড বৃষ্টিতেও মটরশুটি গাছ নষ্ট হয়নি। এরপর গত ২০ ফেব্রুয়ারিতেও সারা রাত বৃষ্টি হয়েছিল। সে সময়ও জমি থেকে পানি ঠিকমতো বের করে দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ যথোপযুক্ত পানি নিস্কাশন ব্যবস্থাধীন জমি ডাল ফসল চাষাবাদের পূর্বশর্ত।

ধান কাটার সময় জমিতে অন্তত ৬-৮ ইঞ্চি নাড়া থাকে - সে ব্যবস্থা কৃষকদের করতে হবে। জমিতে বড় বড় নাড়া থাকলে মটরশুটি গাছ ভালভাবে উপরের দিকে উঠতে পারবে। উপরের দিকে উঠতে পারার কারণে গাছ চারিদিক দিয়ে প্রচুর আলো-বাতাস পাবে এবং প্রতিটি গাছে প্রচুর ফুল-ফল আসবে। এতে ফলন অনেক বেশি হবে।

বরিশাল বিমানবন্দর উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের ডিক্রিরচর গ্রামে বেশ কিছু জমিতে কৃষক মটরশুটির চাষাবাদ করছেন এবং লাভবান হচ্ছেন। এরকম একজন কৃষক নূরুল আমিন জানালেন মটরশুটি কাঁচা অবস্থায় বেশ সুস্বাদু। তারা সবজী, তরকারী, পোলাও, খিচুরী ইত্যাদি রান্না করার সময় সবুজ মটরশুটি ব্যবহার করে থাকেন। এ ছাড়া ৫০-৭০ টাকা কেজি হিসাবে বাজারেও বিক্রি করেন। মটরশুটি মৌসুমে কৃষকরা প্রায় প্রতি সপ্তাহে সবুজ মটরশুটি বাজারে নিয়ে যান এবং তা বিক্রি করে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনে থাকেন। মটরশুটির ভাল বাজার থাকাতে এ ফসল সম্প্রসারনের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।

যমুনা সেতুর কারণে নাটোর সহ ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় মটরশুটির আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় বড় বাজারে বাজারজাত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালু হলে বরিশাল অঞ্চলে মটরশুটিসহ বিভিন্ন ডাল জাতীয় ফসলের চাহিদা বাড়বে এবং তা ঢাকার বাজারসহ বিভিন্ন শহরে বাজারজাত করে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হবে।

কৃষকদের ধারণা, তারা এখান থেকে বিঘা প্রতি ২০০ কেজিরও বেশি মটরশুটি পাবেন, যার আনুমানিক বাজার মূল্য ১০ হাজার টাকারও বেশি। বাজারে এখন এক কেজি মটরশুটির মূল্য ৫০-৭০ টাকা। অথচ ধানের জমিতে রিলে পদ্ধতিতে মটরশুটি চাষাবাদে বীজ ও সারসহ খরচ বিঘা প্রতি মাত্র ১ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, মটরশুটি গাছের শিকড়ে নডুউল তৈরি হয়, যা মাটিকে উর্বর করে। অর্থাৎ ডাল ফসল আবাদের কারণে জমির উর্বরতা শক্তিও বাড়বে। মটরশুটি ফসল তোলার পর ধান গাছের নাড়া জমিতে মিশিয়ে দিলেও জমির উর্বরতা বাড়বে। এতে জমির লবণাক্ততাও কিছুটা কমে যাবে। ফলে পরবর্তী ফসল ভাল হবে।

তাই, উপকূলে মটরশুটি আবাদে নি¤েœর বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবেঃ

১। পাানি নিস্কাশন ব্যবস্থা ছাড়া মটরশুটি চাষাবাদ করা ঠিক হবে না।

২। ধান কাটার ২০-২৫ দিন পূর্বে নভেম্বর মাসে কর্দমাক্ত বা ভিজা জমিতে মটরশুটির বীজ ছিটাতে হবে।

৩। মটরশুটির বীজ ছিটানোর সময় ধান গাছ দাড়ানো অবস্থায় থাকতে হবে। ধান গাছ মাটিতে শুইয়ে পড়লে ঐ জমিতে মটরশুটি চাষাবাদ করা যাবে না।

৪। ধান কাটার সময় অন্তত জমিতে ৬-৮ ইঞ্চি পরিমান নাড়া রেখে ধান কাটতে হবে। এতে মটরশুটি গাছ ধান গাছের নাড়াকে অবলম্বন করে বাউনির সাহায্যে উপরে উঠতে পারে, যা অধিক ফলনে সহায়ক।

৫। ধানের জমিতে মটরশুটি বীজ ছিটানোর ১ দিন পূর্বে বিঘা প্রতি ৭.৫ কেজি টিএসপি, ৪.৫ কেজি পটাশ এবং ৪.৫ জিপসাম ছিটিয়ে দিলে ফলন ভাল হবে।

৬। ধান কাটার পর মটরশুটি রিলে জমিতে বিকালের দিকে বিঘা প্রতি ৮ কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিলে ফলন ভাল হবে। খেয়াল রাখতে হবে, এসময় জমি যেন ভেজা ভেজা থাকে।

গত কয়েক বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত লবণাক্ততা বা প্রতিকূল অবহাওয়ার কারণে ফসলের জীবনকাল স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গেছে। আমরা গম ফসলের বেলায় দেখেছি অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারনে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় ১৫-২০ দিন আগেই গম ফসল পেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমানু গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কিছু স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, যেগুলো ভালো ফলন দিতে সক্ষম। আবার বেশ কিছু জাত উদ্ভাবন হয়েছে, সেগুলো পাকার সময় ধান গাছ দাড়ানো অবস্থায় থাকে। লবণাক্ততা সহিষ্ণু বেশ কিছু জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যেগুলো উপকূলের লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ করে ভাল ফলন পাওয়া যেতে পারে। এ সমস্ত প্রতিকূলতা সহিষ্ণু স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উপকূলের লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ করলে পরবর্তী ডাল বা গম ফসল শুস্ক মৌসুমে সময়মতো চাষাবাদ করে কাঙ্খিত ফলন ঘরে তোলা যাবে।

রিলে মটরশুটি ফসল চাষাবাদের জন্য বীজ এবং সার ছাড়া আর কোন খরচ নেই। এভাবেই উপকূলের পানি নিস্কাশনযোগ্য আমন ধানের কাদাময় জমিতে নভেম্বর মাসে বারি মটর-৩ জাতের বীজ ও সার ছিটিয়ে পতিত জমিতে কৃষক একটি অতিরিক্ত ফসল ফলাতে পারে। এতে কৃষক অত্যন্ত কম খরচে বিঘাপ্রতি ২০০ কেজি মটর ডাল পাবে। পাশাপাশি ডাল ফসলের শিকড়ে নডুউল হওয়ার কারণে এবং তা জমিতে মিশে যাওয়ার ফলে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়বে। শুধু তাই নয়, গরু-ছাগলের পুষ্টিতেও এই ফসল অবদান রাখবে।

[লখেক:স্বাধীনতা পুরষ্কার পদক প্রাপ্ত বিজ্ঞানী, ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েষ্টার্ণ অস্ট্রেলিয়া]

back to top