শামসুর রাহমান
গৌতম রায়
শামসুর রাহমানের কাব্যের ভুবন প্রথম বিকশিত হয়েছিল জীবনানন্দের পুষ্পরেণুর আঘ্রাণ মিশিয়ে। নিজের আত্মবিম্বকে লিরিকের আঙ্গিকে উপস্থাপনার ভেতর দিয়েই বাংলা কবিতার জগতে শামসুরের প্রথম আত্মপ্রকাশ।অন্তঃশীল আবেগের প্রকাশে কবি সে সময়েজীবনানন্দেই অবগাহন করছেন।যদিও নিজের দেশের বাইরে এপার বাংলার বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সংযোগ তাঁর চেতনার আরোহিনীতে আনতে শুরু করেছে অনেক নতুন সঙ্কেত।এইপর্বেই ঘটে গেছে শান্তিনিকেতনের সাহিত্যমেলা(১৯৫৩)। অন্নদাশঙ্কর রায়ের উদ্যোগে সেই মেলা এপার বাংলার কাব্য ভুবনের সঙ্গে কবির সরাসরি সংযোগ ঘটিয়েছে।সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কবির ব্যক্তি আলাপ শান্তিনিকেতনের সাহিত্য মেলাতেই।প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ রেখেও গদ্য-পদ্যের এমন সোনায়বাঁধানো হাত শামসুরকে অনেক আগেই মুগ্ধ করেছিল। সেই মানুষটির সঙ্গে ব্যক্তি পরিচয়, শামসুরের চেতনালোকে একটা অন্য ধরনের স্পন্দন ফেলে দিলো।
লিরিকের মধ্যে কবির স্বপ্রতিবিম্বের যে ধারণা নিয়েশামসুর রাহমান কাব্যচর্চা করতে শুরু করেছিলেন, যেখানে জীবনানন্দীয়প্রভাব ছিল অনেকটাই বেশি, সেই বোধের ভূগোল হলো তখন আন্দোলিত। আন্দোলনের কম্পন কবির সৃষ্টির ভুবনকে একটা নতুন বোধে উপনীত করতে শুরু করলো। নিজের আবেষ্টনীকে ভেদ করে নিজেকে বের করে আনা আর সেই বাইরের সঙ্গে বিশ্ব আবেষ্টনীর সংযোগ ঘটানোÑ কবি জীবনের প্রথম পর্বেই এই কাজে সাফল্যের সঙ্গে নিজেকে উত্তীর্ণ করেছিলেন শামসুর। আর সেখানেই সামাজিক আবেষ্টন একটা বড়পর্ব হিসেবে তাঁর কাব্যের ভুবনকে বেষ্টিত করে ফেলে।
এই বেষ্টন ঘিরে ব্যক্তি শামসুর তাঁর কবিজীবন নিয়েকখনো কখনো একটু খুঁতখুঁতে হয়েপড়তেন বই কী! তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ বৃত্ত জানতো কবির একেবারে মনের গহীনে থাকা সঙ্কোচটিকে।কখনো কখনো প্রকাশ্যে, কোনো না কোনো সাক্ষাৎকারে তাঁর কাব্যের ভুবনের সামাজিক বেষ্টন দার্শনিকতার খামতি ঘটাচ্ছে, এমন কথাও কবি বলেছেন।
কিন্তু শামসুরের কাব্যের দুনিয়াকে যদি আমরা মন্থন করি, তাতে যে অমৃত উঠে আসে, সেখানে কিন্তু সামাজিক বেষ্টন সমসাময়িকতাকে সময়ের নিরিখে স্থিত করেও আগামীর স্বপ্ন দেখায়।দর্শন ও তো আগামীর স্বপ্নবাহী এক মানবিক আস্বাদন। তাই ‘বিষাদের বি¯্রস্ত তনিমা’ (পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ, রৌদ্র করোটিতে, প্রকাশকাল ১৯৬৩) যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়বিষণœতার অনুবর্তনে একঝলক হাসি উঠে আসবেই। তনিমার নিরলম্ব আবেশ কখনো বিষণœতার আকাশকে স্থায়ী করবে না।
এই বোধটাই শামসুরের কাব্যজীবনকে সমাজবীক্ষা আর দর্শনবোধের এক অত্যাশ্চর্য দুনিয়াতে স্থিত করেছে। গোটা জীবনব্যপী কাব্য সাধনাতে শামসুর যেভাবে নিজের মেধাকে উজার করে দিয়েছেন, সেই সঙ্গে দিয়েছেন, নিজের জীবনের সর্বসেরা শ্রম, শ্বেদ, মননÑ সেটা যেন এক সার্বজননীতার শুচিশুভ্র পদচারণা হিসেবে কবির সামগ্রিক সত্তাকে চিরকালের কবিতার দুনিয়াকে আবেষ্টন করে আছে। সেই আবেষ্টনের মাঝে কবিতার ভুবনায়নে নিজের সৃষ্টিকে শামসুর রাহমান যেভাবে স্থিত করতে সমর্থ হয়েছেন, তেমন সুযোগ অনেক কবির ভাগ্যেই ঘটে না। এটা শামসুর রাহমানের নিজস্ব অর্জন।এই অর্জনের লক্ষ্যেই যেন কবিতার কাছে গোটা জীবন ধরে নিরলস সাধনা করে গিয়েছেন তিনি।
নিজের মেধা, মনন, শ্রমÑ সবকিছুকেই কবিতার পায়েসমর্পণ করেও শামসুর রাহমান কিন্তু নিজের ভিতরের অন্তঃস্বরকে কখনও অস্বীকার করেন নি। এই অন্তঃস্বরের ডাকÑ এটা শামসুরের কবিসত্তার একটা বড়রকমের অভিযোজন। সেই লক্ষ্যে সৃষ্টির আবর্তনকে পরিচালিত করা, সেভাবেই সবকিছুকে পরিচালিত করেছেন শামসুর। সেই পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে সমসাময়িকতা এসেছে। সে আসা কিন্তু কবির চিন্তার দুনিয়াকে পথরুদ্ধ করা নয়। পথকে যেন আরো বেশি করে বন্ধনহীন করবার চেষ্টা নিয়েই সমসাময়িকতাকে শামসুর রাহমান তাঁর সৃষ্টির দুনিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিয়েছিলেন।সময়ের ব্যাখ্যানে শামসুর ছিলেন সময়কে অতিক্রম করে আগামী ভবিষৎকে দেখতে পাওয়া এক দার্শনিক। সেকারণেই তাঁর সৃষ্টি ছিল সমকালে যেমন প্রাসঙ্গিক, তেমনই রয়েছে বর্তমান কালে প্রাসঙ্গিক।এবং থেকে যাবে ভাবী কালের জন্যে ও প্রাসঙ্গিক।
কবির অন্তঃস্বর হিসেবে কেউ কেউ জীবনানন্দের অন্তঃস্বর স্বরূপ তাঁর ‘ক্যাম্পে’ বা ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাগুলিকে চিহ্নিত করেন। ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি লেখবার সময়েজীবনানন্দের মননলোকের যে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ছিল, সেখানে সবথেকে বেশি স্পন্দিত হয়েছিল কবির নিজের জীবনের সঙ্কটটি।বিশেষ করে অর্থনৈতিক সঙ্কটটি।আর এই কবিতাটি লেখবার পর, কবিতাটিকে ঘিরে পিউরিটানদের যে অহেতুক কৌতূহল, অশ্লীলতার অভিযোগÑ এগুলি ব্যক্তি জীবনানন্দের সঙ্কটকে আরো তীব্র করে তুলেছিল।জীবনানন্দের অন্তঃস্বর যেন এই কবিতার সমকালীনতা ঘিরে শুষ্ক মরুভূমিতে পর্যবসিত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তি জীবনের সঙ্কট, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সঙ্কটের সঙ্গে একাত্ম হয়ে।এই সঙ্কট থেকে জীবদ্দশায়কখনো উত্তরিত হতে পেরেছিলেন কি না জীবনানন্দÑ সেটা তর্কাতীত বিষয়।
আসলে সমকালীনতার একটা আবর্ত থাকে। ব্রিটিশ শাসনকালে ব্রাহ্ম সমাজের নানা সংস্কার আন্দোলন এবং সেসব ঘিরে নানা আবর্তনÑ যার শিকার হয়েছিলেন জীবনানন্দ, সেই আবর্তনের সামাজিক পটভূমিকাটি আমাদের কাছে খুব পরিস্কার হয়েযায়, যদি আমাদের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উনিশ শতক ঘিরে লেখা উপন্যাস ‘সেই সময়’ পড়া থাকে।
উনিশ শতককে ঘিরে এপার বাংলার বেশিরভাগ লেখালেখিতেই মুসলমান সমাজ থেকে যায়অনুল্লিখিত।সুনীলের এই উপন্যাস সে ক্ষেত্রে একটা বড়ব্যতিক্রম দাবি করে। এই উপন্যাসে ব্রাহ্ম সমাজের আর এক ধরনের রক্ষণশীলতার অনুপুঙ্খ বিবরণ আছে।
জীবনানন্দ নিজেও ব্রাহ্ম পরিম-লের মানুষ ছিলেন।তাঁর অনেক উপন্যাসেই বরিশাল শহর বা জেলা কেন্দ্রিক বিশ শতকর বিবরণ আছে। কিন্তু ‘ক্যাম্পে’ কবিতা ঘিরে জীবনানন্দের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছিল তার সঙ্গে কিন্তু সেকালের গ্রাম বাংলার ব্রাহ্ম পরিম-লের চালচলন, আদবকায়দর এতটুকু সাদৃশ্য নেই।
সুনীল যে কলকাতা কেন্দ্রিক ব্রাহ্ম সমাজীদের সামাজিক আচরণের নানা কাহিনী তাঁর উপন্যাসে লিখেছেন, জীবনানন্দের সঙ্গে অবিচার যেন সেই কলকাতা মহানগরী কেন্দ্রিক ব্রাহ্ম আদবকায়দার সঙ্গে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ।তাই একথা বলতেই হয় যে এক অদ্ভুত নাটকীয়অভিযোজনায়নানা ধরনের ব্যবহারিক বিষয়ের প্রশংসার ভিতর দিয়ে‘ক্যাম্পে’ কবিতাটিতে জীবনানন্দ যে বিষয়ভিত্তিক কণ্ঠ তুলেছিলেন, তা তো বাইরের কারো কণ্ঠ ছিল না। সে কণ্ঠ তো ছিল কবি জীবনানন্দের একান্ত ব্যক্তিগত কন্ঠস্বরই। সেই কণ্ঠকে তো এককথায়জীবনানন্দের ‘মেধাবী বেদনা’র ধ্বনি প্রতিধ্বনি বলেই আমাদের সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বীকার করে নিতে হয়।
শামসুর রাহমানের যে কবিতাটির কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই কবিতায় যে ‘খঞ্জ’ শব্দটি কবি ব্যবহার করেছেন এই শব্দটির মর্মমূলে কী আছে? ‘খঞ্জ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ খোঁড়া, বিকল পা। পার্কের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে একটা অচল পায়ের এই যে সংযোগ শামসুর রাহমান স্থাপন করছেন, এই স্থাপনার মধ্যে প্রতীক-বিপ্রতীপের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ মিলেমিশে একাকার হয়েআছে।
কবিতার শিরোনামের পর মূল কবিতায়প্রবেশ করে মনেহয়, ‘খঞ্জ’ শব্দটি কি কবি স্বকল্পোচিত্র আঁকতেই ব্যবহার করেছেন? স্টেশন ওয়াগানে মোহাজিরদের দেখে এককালে যে যন্ত্রণা কবি পাবেন ’৭১ উত্তরকালে, সেই যন্ত্রণারই কি এক অগ্রিম বার্তা হিসেবে পার্কের নিস্তব্ধতা আর নিজের একটা স্থবিরতার কার্যকারণ সম্পর্ক তৈরি করছেন শামসুর রাহমান এখানে? সম্পর্কহীন কারণ, কবির ভীষণ অপছন্দের বিষয়। নিজের সৃষ্টিতে একটা অক্ষরও তিনি কখনো সম্পর্কহীনভাবে উৎকীর্ণ করেননি। শব্দ খোঁদাইতে তাঁর এই পেশাদারিত্ব ছিল যেন সমাধি প্রস্তরে শিল্পীর এপিটাফ খোঁদাই। সে খোদাই টিকে একটা টানও যদি এদিক-ওদিক হয়েযায়, তবে যে স্মরণলেখর অর্থটাই যাবে বদলে।তাই অনেক সময়েই মনেহয়, যেন জ্যামিতি বাক্স হাতে নিয়েকাগজে শব্দ খোদাই করে যেতেন শামসুর রাহমান।
জীবনানন্দীয়অভিক্ষেপের থেকে নিজেকে যখন বের করে আনেন শামসুর রাহমান তখন থেকেই কিন্তু কখনো নেচারিস্ট বা প্রকৃতি কেন্দ্রিক একটা অভিধারার ভেতরে নিজেকে নিবিষ্ট রেখে তিনি আত্মমুক্তির কোনোরকম পথ খোঁজেননি। নিজেকে চিরদিন ব্যাপৃত রেখেছেন সমসাময়িকতার সঙ্গে। সেই সমসাময়িকতায়তাঁর নিজের দেশের রাজনৈতিক নানা উত্থান পতন এসেছে। এসেছে আন্তর্জাতিক স্তরের নানা রকম রাজনৈতিক ঘটনাক্রম।আবার এসেছে তাঁর নিজের দেশ হোক,তাঁর সমকাল হোক, বহির্বিশ্ব হোক, সার্বিকভাবে মানবতার সংকট, মনুষত্বের সংকটের বিষয়টি।
বিশেষ করে মানুষের জীবন এবং যাপন ঘিরে নানা ধরনের সংকটের আবর্তনগুলি শামসুর রাহমানের সৃষ্টির যে কাব্যিক অভিজ্ঞান, সেখানে বারবার ফুটে উঠেছে।শহরের পার্ক। ভিড়েগিজগিজ করা রাজপথ।আর সেইসঙ্গে হাজার মুখের আলো।
এই হাজার মুখের আলোর প্রতি শামসুরের বরাবরই একটি বিশেষ রকমের আকর্ষণ ছিল। সেই আকর্ষণ কোনো দেহজ কামনা জনিত আকর্ষণ নয়। সেই আকর্ষণের মধ্যে বারবার ধ্বনিত হয়েছে,প্রতিধ্বনিত হয়েছে, মানুষের, ‘ক্ষুধা ও ক্ষুধার যত পরিণাম’ (এটি কবি অমিয়চক্রবর্তীর ‘সংগতি’ কবিতার অংশ)। ক্ষুধাকীর্ণ মানুষ,তাঁদের জীবন যন্ত্রণা, শামসুর চিরদিন অন্তর থেকে উপলব্ধি করেছেন। কোনোদিন কোনো অবস্থাতেই দুঃখী মানুষের জীবনের কান্না হাসির দোল দোলানো থেকে তিনি নিজেকে যেমন বিচ্ছিন্ন করেননি, ঠিক তেমনিভাবেই নিজের সৃষ্টিকেও কখনো বিচ্ছিন্ন হতে দেননি।
এখানে কিন্তু কবি শামসুর রাহমানের ব্যক্তি এবং সৃষ্টির মানব প্রেমিক সত্তা বিশেষভাবে আমাদের সামনে এসে ধরা দেয়। মানুষের মধ্যেই তিনি তাঁর নিজের কাব্যিক অভিজ্ঞান দিয়ে,একটা সংবেদনশীল বস্তু সঙ্গতিকে সবসময় খোঁজবার চেষ্টা করেছেন।এই বস্তু সংগতির বিষয়টি কিন্তু শামসুর রাহমানের সৃষ্টির ভুবনকে একটা ক্ষুধার তীক্ষèতার মধ্যে এনে আকীর্ণ করেছিল।
যে আকীর্ণতার মধ্যে কোনো বেড়াজাল ছিল না। তার মধ্যে কোনো বিভাজনের সীমারেখা ছিল না।যতি চিহ্ন, তার মধ্যে কোনো অসংগতির প্রতি সংগতি জ্ঞাপনের প্রচেষ্টা ধ্বনিত হয়নি।প্রতিধ্বনিতও হয়নি। আর সেই কারণে বস্তুগত সংহতিকে যেমন শামসুর রাহমান বারবার নিজের সৃষ্টির ভুবনে কাক্সিক্ষত একটি বিষয়বলে মনে করেছেন, ঠিক তেমনিভাবেই সেই বস্তুগত সংগতিতে তিনি উপস্থাপিত করেছেন, সময়কে উপস্থাপিত করেছেন। মানুষ আর সেই উপস্থাপনার মধ্যে একটা চেনা-অচেনা বৃত্তের মধ্যে দিয়েউঠে এসেছে চিরন্তন দার্শনিকতার এক অন্তহীন জাগর।
বস্তু সংগতিকে তাঁর অনেক সমালোচকের কাছে কিছুটা বেমানান ঠেকেছে।তাঁদের মনে হয়েছে শামসুর রাহমানের এই বস্তু সঙ্গতির ভেতরে একটা অহেতুকতার সংস্পর্শ থেকে গেছে। সেই অহেতুকতার সংস্পর্শকে তাঁরা শেষ পর্যন্ত কবির নৈঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্নতাকেই সাংকেতিকভাবে তুলে ধরবার একটা উপক্রম বলে মনে করেছেন।
ভাবতে অবাক লাগে শামসুর রাহমানের সামগ্রিক সৃষ্টি অনুধাবন করবার পর তাঁকে যেভাবে অহেতুকতার সংস্পর্শ দোষে দুষ্ট করা হচ্ছে, এই বিশেষণ তাঁর প্রতি জারি করবার ক্ষেত্রে,তাঁর সমালোচকেরা কিন্তু একটি বারের জন্য কোনো উদাহরণ উপস্থাপিত করছেন না।
শামসুরের প্রকৃতি এষণা, সেটিকে তাঁর সংবেদনশীলতার সঙ্গে কি অদ্ভুতভাবে তাঁর সমালোচকেরা গুলিয়ে ফেলছেন, তা ভাবলে অবাকই হতে হয়। কবির প্রকৃতি এষণার সঙ্গে পার্কে, রাজপথে অবস্থানকে এক বন্ধনী ভুক্ত করতে চান যাঁরা, তাঁরা হয়তো কখনো সেই স্টেশন ওয়াগানে মোহাজির পরিবারকে দেখে কবির অন্তরের ক্ষরণ, যা তাঁর কবিতায়উঠে এসেছিল, তাকে অনুধাবন করবার মতোই বোধইঅর্জন করতে পারেননি।
সেই কারণে হয়তো কোনো কোনো আধুনিক আলোচকের কাছে শামসুর রাহমানের পার্কের নিঃসঙ্গতা কবির ব্যক্তি আকাক্সক্ষার,বাসনার, দিশা বিদিশা বলে মনে হয়েছে।
শামসুর রাহমানের আত্মমগ্নতাকে অনুধাবন করতে গেলে,তাঁরই ভাষায়; কবিতার সঙ্গে গেরস্তালি পাতাতে হয়। অনেক সময়শামসুর রাহমানের আত্মমগ্নতা,তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুবাদে এই নিবন্ধকারের মনে হয়েছে, কবির এক ধরনের নিঃসঙ্গতা। সেই নিঃসঙ্গতার সঙ্গে কোথাও যেন একটা এসে মিলেমিশে গিয়েছে তাঁর অন্তহীন সৌন্দর্য ক্ষুধা। তাইতো তিনি একটা সময়উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন; ‘সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া।’ এই সৌন্দর্য ক্ষুধার তিয়াস, শামসুর রাহমানের কাব্যের ভুবনকে যেভাবে আত্মনিমগ্নতায়অভিষিক্ত করেছে, সেই অভিনিবেশ বাংলা কবিতার জগতে নিঃসন্দেহে একটি মোড়। একটা দিক চিহ্ন।এই দিক চিহ্ন নির্মাণ শামসুর রাহমানের কাব্য দুনিয়ার দিক দিগন্ত বিস্তারের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ রকমের দিকনির্বাহী অভিক্ষেপণ।
রাত্রির কাছ থেকে পাওয়া উপহার, সেই উপহারের মধ্যে বিষাদের বি¯্রস্ত তনিমা, সেই তনিমা উপলব্ধ হয়দুর্মর কাপালিকের অভিব্যক্তিতে।
এই যে চিত্রকল্প রচনা, তার ভেতর দিয়েসঙ্গ এবং নিঃসঙ্গের এক অপরূপ লুকোচুরি খেলা যেন কবি আমাদের সামনে মেলে ধরছেন। সে খেলায়আনন্দ আছে। সে খেলায়একটা অনির্বচনীয়উৎসাহ আছে। আছে একটা পাওয়া না পাওয়ার দোদুল্যমানোতার এক ভয়ঙ্কর ভাসমান চিত্র। যে ভাসমান চিত্রের স্থিরতা আর অস্থিরতার মাঝে দুর্মর কাপালিকের সেই ভয়মিশ্রিত অভিব্যক্তি,তা আমাদের পৌঁছে দেয়চন্দ্রমার করোটিতে। যেখানে আকণ্ঠ করবে পান সুতীব্র মুদিরা। এই যে শব্দচয়ন এবং তন্ত্রের নানা ধরনের অভিব্যক্তির আখ্যায়ন, তার ভেতর দিয়েবাঙালির মিশ্র সংস্কৃতির অনবদ্য প্রকাশ।
এমনটা কিন্তু শামসুর রাহমানের সমসাময়িক বাংলা কবিতার সময়কালে আর অন্য কোনো কবির সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই না। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত থেকে শুরু করে বিষ্ণু দে,শামসুরের থেকে একটু আগের সময়ের কবি। তাঁরা তাঁদের সৃষ্টির দুনিয়ায়নানা ধরনের দেশ-বিদেশের উপমা সংযোজিত করেছেন।কিন্তু সেই সব উপমা সংযোজনের মধ্যে দেশীয়উপমা আমরা খুব একটা দেখতে পাই না। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই হোক, লোকায়ত ধর্মই হোক, অন্য কোনো ধরনের ট্যাবুকে ব্যবহার করে কবিতার ভাষার সঙ্গে পাঠকের ভাষা, দেখার চোখ,মননশীলতা,বাস্তব অভিজ্ঞতাÑ এ সমস্ত কিছুর মেলবন্ধন ঘটানোর জায়গাটা কেমন যেন অনুল্লিখিত থেকে যায়।
আর ঠিক সেখানেই দুর্মর কাপালিকে আখ্যান। চন্দ্রমার করোটিতে আকণ্ঠ সুতীব্র মদিরা পানের উল্লেখ। এ যেন আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের এক প্রতিষ্ঠিত ধারা, যে ধারা একটা সময়আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সহনশীলতা, বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য, এবং অবশ্যই সমন্বয়কারী ধারা,তাকে তছনছ করে দিয়েছিল। সেই চৈতন্য পূর্ববর্তী পূর্ববঙ্গের কিছু অঞ্চল, বিশেষ করে অবিভক্ত ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়া অঞ্চলে তন্ত্রের আধিপত্যের মধ্যে দিয়েকীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে একটা রীতিকে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজনের অক্ষরেখা টাকে অনেক তীব্র করে, ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদকে,তাদের শাসনের নামে শোষণের প্রক্রিয়াকে প্রলম্বিত করতে সাহায্য করেছিল। সে সমস্ত ইতিহাস বোধ যেন ইতিহাসের আঁস্তাকুড় থেকে উঠিয়েএনে, এখানে একটা দুটো শব্দের মধ্যে দিয়েশামসুর রাহমান আমাদের সামনে তুলে ধরছেন।
এই যে চিত্রকল্প নির্মাণের দীপ্তি, সেটি যেন পার্কের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে একজন প্রতীকী প্রতিবন্ধী,খঞ্জো মানুষের নানা ধরনের অভিব্যক্তি, বিশেষ করে সেই বঙ্কিমের ভাষা ধার করে নিয়েবলতে হয়; মা কী ছিলেন,কী হইয়াছেনÑ সেই চেতনার স্ফুরণ আমাদের বারবার স্বপ্নালু করে দেয়।
স্বপ্ন দেখতে কে না ভালোবাসে।কবি এবং কবিতার পাঠক স্বপ্নের অঞ্জনে চোখ রাঙিয়েকাব্য জগতে ডুব দিতে পছন্দ করে। কিন্তু সেই ডুব দিয়েউঠে যে কঠিন কঠোর উদ্ধত অসহায়বাস্তবতার সামনে এসে তাকে দাঁড়াতে হয়, সেই দাঁড়ানোর মধ্যে দিয়ে যেন হরিণের কানের মতন পাতা ঝরে।ধ্বনি ঝরে উজ্জ্বল মাছের রুপালি আশেঁর মতো। ধ্বনি ঝ’রে পৃথিবীতে এমন একটা স্বপ্নালু এবং বাস্তবের আকাক্সক্ষা মাখা মনোজগতের মধ্যে আমাদের নিয়েএসে দাঁড়করিয়ে দেয়।
যে জগত আমাদের স্মৃতিকে উসকে তোলে। যে জগত আমাদের বাস্তবের মাটিকে আরো শক্তপোক্ত একটা বনিয়াদের উপর দাঁড়করিয়ে, আমাদের খঞ্জতাকে অতিক্রম করবার জন্য,নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গতায়পরিণত করে।আর যে জগৎ আমাদের দেখাতে থাকে একটা রঙিন ভবিষ্যৎ।
শামসুর রাহমান
গৌতম রায়
বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪
শামসুর রাহমানের কাব্যের ভুবন প্রথম বিকশিত হয়েছিল জীবনানন্দের পুষ্পরেণুর আঘ্রাণ মিশিয়ে। নিজের আত্মবিম্বকে লিরিকের আঙ্গিকে উপস্থাপনার ভেতর দিয়েই বাংলা কবিতার জগতে শামসুরের প্রথম আত্মপ্রকাশ।অন্তঃশীল আবেগের প্রকাশে কবি সে সময়েজীবনানন্দেই অবগাহন করছেন।যদিও নিজের দেশের বাইরে এপার বাংলার বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সংযোগ তাঁর চেতনার আরোহিনীতে আনতে শুরু করেছে অনেক নতুন সঙ্কেত।এইপর্বেই ঘটে গেছে শান্তিনিকেতনের সাহিত্যমেলা(১৯৫৩)। অন্নদাশঙ্কর রায়ের উদ্যোগে সেই মেলা এপার বাংলার কাব্য ভুবনের সঙ্গে কবির সরাসরি সংযোগ ঘটিয়েছে।সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কবির ব্যক্তি আলাপ শান্তিনিকেতনের সাহিত্য মেলাতেই।প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ রেখেও গদ্য-পদ্যের এমন সোনায়বাঁধানো হাত শামসুরকে অনেক আগেই মুগ্ধ করেছিল। সেই মানুষটির সঙ্গে ব্যক্তি পরিচয়, শামসুরের চেতনালোকে একটা অন্য ধরনের স্পন্দন ফেলে দিলো।
লিরিকের মধ্যে কবির স্বপ্রতিবিম্বের যে ধারণা নিয়েশামসুর রাহমান কাব্যচর্চা করতে শুরু করেছিলেন, যেখানে জীবনানন্দীয়প্রভাব ছিল অনেকটাই বেশি, সেই বোধের ভূগোল হলো তখন আন্দোলিত। আন্দোলনের কম্পন কবির সৃষ্টির ভুবনকে একটা নতুন বোধে উপনীত করতে শুরু করলো। নিজের আবেষ্টনীকে ভেদ করে নিজেকে বের করে আনা আর সেই বাইরের সঙ্গে বিশ্ব আবেষ্টনীর সংযোগ ঘটানোÑ কবি জীবনের প্রথম পর্বেই এই কাজে সাফল্যের সঙ্গে নিজেকে উত্তীর্ণ করেছিলেন শামসুর। আর সেখানেই সামাজিক আবেষ্টন একটা বড়পর্ব হিসেবে তাঁর কাব্যের ভুবনকে বেষ্টিত করে ফেলে।
এই বেষ্টন ঘিরে ব্যক্তি শামসুর তাঁর কবিজীবন নিয়েকখনো কখনো একটু খুঁতখুঁতে হয়েপড়তেন বই কী! তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ বৃত্ত জানতো কবির একেবারে মনের গহীনে থাকা সঙ্কোচটিকে।কখনো কখনো প্রকাশ্যে, কোনো না কোনো সাক্ষাৎকারে তাঁর কাব্যের ভুবনের সামাজিক বেষ্টন দার্শনিকতার খামতি ঘটাচ্ছে, এমন কথাও কবি বলেছেন।
কিন্তু শামসুরের কাব্যের দুনিয়াকে যদি আমরা মন্থন করি, তাতে যে অমৃত উঠে আসে, সেখানে কিন্তু সামাজিক বেষ্টন সমসাময়িকতাকে সময়ের নিরিখে স্থিত করেও আগামীর স্বপ্ন দেখায়।দর্শন ও তো আগামীর স্বপ্নবাহী এক মানবিক আস্বাদন। তাই ‘বিষাদের বি¯্রস্ত তনিমা’ (পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ, রৌদ্র করোটিতে, প্রকাশকাল ১৯৬৩) যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়বিষণœতার অনুবর্তনে একঝলক হাসি উঠে আসবেই। তনিমার নিরলম্ব আবেশ কখনো বিষণœতার আকাশকে স্থায়ী করবে না।
এই বোধটাই শামসুরের কাব্যজীবনকে সমাজবীক্ষা আর দর্শনবোধের এক অত্যাশ্চর্য দুনিয়াতে স্থিত করেছে। গোটা জীবনব্যপী কাব্য সাধনাতে শামসুর যেভাবে নিজের মেধাকে উজার করে দিয়েছেন, সেই সঙ্গে দিয়েছেন, নিজের জীবনের সর্বসেরা শ্রম, শ্বেদ, মননÑ সেটা যেন এক সার্বজননীতার শুচিশুভ্র পদচারণা হিসেবে কবির সামগ্রিক সত্তাকে চিরকালের কবিতার দুনিয়াকে আবেষ্টন করে আছে। সেই আবেষ্টনের মাঝে কবিতার ভুবনায়নে নিজের সৃষ্টিকে শামসুর রাহমান যেভাবে স্থিত করতে সমর্থ হয়েছেন, তেমন সুযোগ অনেক কবির ভাগ্যেই ঘটে না। এটা শামসুর রাহমানের নিজস্ব অর্জন।এই অর্জনের লক্ষ্যেই যেন কবিতার কাছে গোটা জীবন ধরে নিরলস সাধনা করে গিয়েছেন তিনি।
নিজের মেধা, মনন, শ্রমÑ সবকিছুকেই কবিতার পায়েসমর্পণ করেও শামসুর রাহমান কিন্তু নিজের ভিতরের অন্তঃস্বরকে কখনও অস্বীকার করেন নি। এই অন্তঃস্বরের ডাকÑ এটা শামসুরের কবিসত্তার একটা বড়রকমের অভিযোজন। সেই লক্ষ্যে সৃষ্টির আবর্তনকে পরিচালিত করা, সেভাবেই সবকিছুকে পরিচালিত করেছেন শামসুর। সেই পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে সমসাময়িকতা এসেছে। সে আসা কিন্তু কবির চিন্তার দুনিয়াকে পথরুদ্ধ করা নয়। পথকে যেন আরো বেশি করে বন্ধনহীন করবার চেষ্টা নিয়েই সমসাময়িকতাকে শামসুর রাহমান তাঁর সৃষ্টির দুনিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিয়েছিলেন।সময়ের ব্যাখ্যানে শামসুর ছিলেন সময়কে অতিক্রম করে আগামী ভবিষৎকে দেখতে পাওয়া এক দার্শনিক। সেকারণেই তাঁর সৃষ্টি ছিল সমকালে যেমন প্রাসঙ্গিক, তেমনই রয়েছে বর্তমান কালে প্রাসঙ্গিক।এবং থেকে যাবে ভাবী কালের জন্যে ও প্রাসঙ্গিক।
কবির অন্তঃস্বর হিসেবে কেউ কেউ জীবনানন্দের অন্তঃস্বর স্বরূপ তাঁর ‘ক্যাম্পে’ বা ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাগুলিকে চিহ্নিত করেন। ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি লেখবার সময়েজীবনানন্দের মননলোকের যে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ছিল, সেখানে সবথেকে বেশি স্পন্দিত হয়েছিল কবির নিজের জীবনের সঙ্কটটি।বিশেষ করে অর্থনৈতিক সঙ্কটটি।আর এই কবিতাটি লেখবার পর, কবিতাটিকে ঘিরে পিউরিটানদের যে অহেতুক কৌতূহল, অশ্লীলতার অভিযোগÑ এগুলি ব্যক্তি জীবনানন্দের সঙ্কটকে আরো তীব্র করে তুলেছিল।জীবনানন্দের অন্তঃস্বর যেন এই কবিতার সমকালীনতা ঘিরে শুষ্ক মরুভূমিতে পর্যবসিত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তি জীবনের সঙ্কট, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সঙ্কটের সঙ্গে একাত্ম হয়ে।এই সঙ্কট থেকে জীবদ্দশায়কখনো উত্তরিত হতে পেরেছিলেন কি না জীবনানন্দÑ সেটা তর্কাতীত বিষয়।
আসলে সমকালীনতার একটা আবর্ত থাকে। ব্রিটিশ শাসনকালে ব্রাহ্ম সমাজের নানা সংস্কার আন্দোলন এবং সেসব ঘিরে নানা আবর্তনÑ যার শিকার হয়েছিলেন জীবনানন্দ, সেই আবর্তনের সামাজিক পটভূমিকাটি আমাদের কাছে খুব পরিস্কার হয়েযায়, যদি আমাদের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উনিশ শতক ঘিরে লেখা উপন্যাস ‘সেই সময়’ পড়া থাকে।
উনিশ শতককে ঘিরে এপার বাংলার বেশিরভাগ লেখালেখিতেই মুসলমান সমাজ থেকে যায়অনুল্লিখিত।সুনীলের এই উপন্যাস সে ক্ষেত্রে একটা বড়ব্যতিক্রম দাবি করে। এই উপন্যাসে ব্রাহ্ম সমাজের আর এক ধরনের রক্ষণশীলতার অনুপুঙ্খ বিবরণ আছে।
জীবনানন্দ নিজেও ব্রাহ্ম পরিম-লের মানুষ ছিলেন।তাঁর অনেক উপন্যাসেই বরিশাল শহর বা জেলা কেন্দ্রিক বিশ শতকর বিবরণ আছে। কিন্তু ‘ক্যাম্পে’ কবিতা ঘিরে জীবনানন্দের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছিল তার সঙ্গে কিন্তু সেকালের গ্রাম বাংলার ব্রাহ্ম পরিম-লের চালচলন, আদবকায়দর এতটুকু সাদৃশ্য নেই।
সুনীল যে কলকাতা কেন্দ্রিক ব্রাহ্ম সমাজীদের সামাজিক আচরণের নানা কাহিনী তাঁর উপন্যাসে লিখেছেন, জীবনানন্দের সঙ্গে অবিচার যেন সেই কলকাতা মহানগরী কেন্দ্রিক ব্রাহ্ম আদবকায়দার সঙ্গে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ।তাই একথা বলতেই হয় যে এক অদ্ভুত নাটকীয়অভিযোজনায়নানা ধরনের ব্যবহারিক বিষয়ের প্রশংসার ভিতর দিয়ে‘ক্যাম্পে’ কবিতাটিতে জীবনানন্দ যে বিষয়ভিত্তিক কণ্ঠ তুলেছিলেন, তা তো বাইরের কারো কণ্ঠ ছিল না। সে কণ্ঠ তো ছিল কবি জীবনানন্দের একান্ত ব্যক্তিগত কন্ঠস্বরই। সেই কণ্ঠকে তো এককথায়জীবনানন্দের ‘মেধাবী বেদনা’র ধ্বনি প্রতিধ্বনি বলেই আমাদের সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বীকার করে নিতে হয়।
শামসুর রাহমানের যে কবিতাটির কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই কবিতায় যে ‘খঞ্জ’ শব্দটি কবি ব্যবহার করেছেন এই শব্দটির মর্মমূলে কী আছে? ‘খঞ্জ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ খোঁড়া, বিকল পা। পার্কের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে একটা অচল পায়ের এই যে সংযোগ শামসুর রাহমান স্থাপন করছেন, এই স্থাপনার মধ্যে প্রতীক-বিপ্রতীপের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ মিলেমিশে একাকার হয়েআছে।
কবিতার শিরোনামের পর মূল কবিতায়প্রবেশ করে মনেহয়, ‘খঞ্জ’ শব্দটি কি কবি স্বকল্পোচিত্র আঁকতেই ব্যবহার করেছেন? স্টেশন ওয়াগানে মোহাজিরদের দেখে এককালে যে যন্ত্রণা কবি পাবেন ’৭১ উত্তরকালে, সেই যন্ত্রণারই কি এক অগ্রিম বার্তা হিসেবে পার্কের নিস্তব্ধতা আর নিজের একটা স্থবিরতার কার্যকারণ সম্পর্ক তৈরি করছেন শামসুর রাহমান এখানে? সম্পর্কহীন কারণ, কবির ভীষণ অপছন্দের বিষয়। নিজের সৃষ্টিতে একটা অক্ষরও তিনি কখনো সম্পর্কহীনভাবে উৎকীর্ণ করেননি। শব্দ খোঁদাইতে তাঁর এই পেশাদারিত্ব ছিল যেন সমাধি প্রস্তরে শিল্পীর এপিটাফ খোঁদাই। সে খোদাই টিকে একটা টানও যদি এদিক-ওদিক হয়েযায়, তবে যে স্মরণলেখর অর্থটাই যাবে বদলে।তাই অনেক সময়েই মনেহয়, যেন জ্যামিতি বাক্স হাতে নিয়েকাগজে শব্দ খোদাই করে যেতেন শামসুর রাহমান।
জীবনানন্দীয়অভিক্ষেপের থেকে নিজেকে যখন বের করে আনেন শামসুর রাহমান তখন থেকেই কিন্তু কখনো নেচারিস্ট বা প্রকৃতি কেন্দ্রিক একটা অভিধারার ভেতরে নিজেকে নিবিষ্ট রেখে তিনি আত্মমুক্তির কোনোরকম পথ খোঁজেননি। নিজেকে চিরদিন ব্যাপৃত রেখেছেন সমসাময়িকতার সঙ্গে। সেই সমসাময়িকতায়তাঁর নিজের দেশের রাজনৈতিক নানা উত্থান পতন এসেছে। এসেছে আন্তর্জাতিক স্তরের নানা রকম রাজনৈতিক ঘটনাক্রম।আবার এসেছে তাঁর নিজের দেশ হোক,তাঁর সমকাল হোক, বহির্বিশ্ব হোক, সার্বিকভাবে মানবতার সংকট, মনুষত্বের সংকটের বিষয়টি।
বিশেষ করে মানুষের জীবন এবং যাপন ঘিরে নানা ধরনের সংকটের আবর্তনগুলি শামসুর রাহমানের সৃষ্টির যে কাব্যিক অভিজ্ঞান, সেখানে বারবার ফুটে উঠেছে।শহরের পার্ক। ভিড়েগিজগিজ করা রাজপথ।আর সেইসঙ্গে হাজার মুখের আলো।
এই হাজার মুখের আলোর প্রতি শামসুরের বরাবরই একটি বিশেষ রকমের আকর্ষণ ছিল। সেই আকর্ষণ কোনো দেহজ কামনা জনিত আকর্ষণ নয়। সেই আকর্ষণের মধ্যে বারবার ধ্বনিত হয়েছে,প্রতিধ্বনিত হয়েছে, মানুষের, ‘ক্ষুধা ও ক্ষুধার যত পরিণাম’ (এটি কবি অমিয়চক্রবর্তীর ‘সংগতি’ কবিতার অংশ)। ক্ষুধাকীর্ণ মানুষ,তাঁদের জীবন যন্ত্রণা, শামসুর চিরদিন অন্তর থেকে উপলব্ধি করেছেন। কোনোদিন কোনো অবস্থাতেই দুঃখী মানুষের জীবনের কান্না হাসির দোল দোলানো থেকে তিনি নিজেকে যেমন বিচ্ছিন্ন করেননি, ঠিক তেমনিভাবেই নিজের সৃষ্টিকেও কখনো বিচ্ছিন্ন হতে দেননি।
এখানে কিন্তু কবি শামসুর রাহমানের ব্যক্তি এবং সৃষ্টির মানব প্রেমিক সত্তা বিশেষভাবে আমাদের সামনে এসে ধরা দেয়। মানুষের মধ্যেই তিনি তাঁর নিজের কাব্যিক অভিজ্ঞান দিয়ে,একটা সংবেদনশীল বস্তু সঙ্গতিকে সবসময় খোঁজবার চেষ্টা করেছেন।এই বস্তু সংগতির বিষয়টি কিন্তু শামসুর রাহমানের সৃষ্টির ভুবনকে একটা ক্ষুধার তীক্ষèতার মধ্যে এনে আকীর্ণ করেছিল।
যে আকীর্ণতার মধ্যে কোনো বেড়াজাল ছিল না। তার মধ্যে কোনো বিভাজনের সীমারেখা ছিল না।যতি চিহ্ন, তার মধ্যে কোনো অসংগতির প্রতি সংগতি জ্ঞাপনের প্রচেষ্টা ধ্বনিত হয়নি।প্রতিধ্বনিতও হয়নি। আর সেই কারণে বস্তুগত সংহতিকে যেমন শামসুর রাহমান বারবার নিজের সৃষ্টির ভুবনে কাক্সিক্ষত একটি বিষয়বলে মনে করেছেন, ঠিক তেমনিভাবেই সেই বস্তুগত সংগতিতে তিনি উপস্থাপিত করেছেন, সময়কে উপস্থাপিত করেছেন। মানুষ আর সেই উপস্থাপনার মধ্যে একটা চেনা-অচেনা বৃত্তের মধ্যে দিয়েউঠে এসেছে চিরন্তন দার্শনিকতার এক অন্তহীন জাগর।
বস্তু সংগতিকে তাঁর অনেক সমালোচকের কাছে কিছুটা বেমানান ঠেকেছে।তাঁদের মনে হয়েছে শামসুর রাহমানের এই বস্তু সঙ্গতির ভেতরে একটা অহেতুকতার সংস্পর্শ থেকে গেছে। সেই অহেতুকতার সংস্পর্শকে তাঁরা শেষ পর্যন্ত কবির নৈঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্নতাকেই সাংকেতিকভাবে তুলে ধরবার একটা উপক্রম বলে মনে করেছেন।
ভাবতে অবাক লাগে শামসুর রাহমানের সামগ্রিক সৃষ্টি অনুধাবন করবার পর তাঁকে যেভাবে অহেতুকতার সংস্পর্শ দোষে দুষ্ট করা হচ্ছে, এই বিশেষণ তাঁর প্রতি জারি করবার ক্ষেত্রে,তাঁর সমালোচকেরা কিন্তু একটি বারের জন্য কোনো উদাহরণ উপস্থাপিত করছেন না।
শামসুরের প্রকৃতি এষণা, সেটিকে তাঁর সংবেদনশীলতার সঙ্গে কি অদ্ভুতভাবে তাঁর সমালোচকেরা গুলিয়ে ফেলছেন, তা ভাবলে অবাকই হতে হয়। কবির প্রকৃতি এষণার সঙ্গে পার্কে, রাজপথে অবস্থানকে এক বন্ধনী ভুক্ত করতে চান যাঁরা, তাঁরা হয়তো কখনো সেই স্টেশন ওয়াগানে মোহাজির পরিবারকে দেখে কবির অন্তরের ক্ষরণ, যা তাঁর কবিতায়উঠে এসেছিল, তাকে অনুধাবন করবার মতোই বোধইঅর্জন করতে পারেননি।
সেই কারণে হয়তো কোনো কোনো আধুনিক আলোচকের কাছে শামসুর রাহমানের পার্কের নিঃসঙ্গতা কবির ব্যক্তি আকাক্সক্ষার,বাসনার, দিশা বিদিশা বলে মনে হয়েছে।
শামসুর রাহমানের আত্মমগ্নতাকে অনুধাবন করতে গেলে,তাঁরই ভাষায়; কবিতার সঙ্গে গেরস্তালি পাতাতে হয়। অনেক সময়শামসুর রাহমানের আত্মমগ্নতা,তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুবাদে এই নিবন্ধকারের মনে হয়েছে, কবির এক ধরনের নিঃসঙ্গতা। সেই নিঃসঙ্গতার সঙ্গে কোথাও যেন একটা এসে মিলেমিশে গিয়েছে তাঁর অন্তহীন সৌন্দর্য ক্ষুধা। তাইতো তিনি একটা সময়উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন; ‘সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া।’ এই সৌন্দর্য ক্ষুধার তিয়াস, শামসুর রাহমানের কাব্যের ভুবনকে যেভাবে আত্মনিমগ্নতায়অভিষিক্ত করেছে, সেই অভিনিবেশ বাংলা কবিতার জগতে নিঃসন্দেহে একটি মোড়। একটা দিক চিহ্ন।এই দিক চিহ্ন নির্মাণ শামসুর রাহমানের কাব্য দুনিয়ার দিক দিগন্ত বিস্তারের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ রকমের দিকনির্বাহী অভিক্ষেপণ।
রাত্রির কাছ থেকে পাওয়া উপহার, সেই উপহারের মধ্যে বিষাদের বি¯্রস্ত তনিমা, সেই তনিমা উপলব্ধ হয়দুর্মর কাপালিকের অভিব্যক্তিতে।
এই যে চিত্রকল্প রচনা, তার ভেতর দিয়েসঙ্গ এবং নিঃসঙ্গের এক অপরূপ লুকোচুরি খেলা যেন কবি আমাদের সামনে মেলে ধরছেন। সে খেলায়আনন্দ আছে। সে খেলায়একটা অনির্বচনীয়উৎসাহ আছে। আছে একটা পাওয়া না পাওয়ার দোদুল্যমানোতার এক ভয়ঙ্কর ভাসমান চিত্র। যে ভাসমান চিত্রের স্থিরতা আর অস্থিরতার মাঝে দুর্মর কাপালিকের সেই ভয়মিশ্রিত অভিব্যক্তি,তা আমাদের পৌঁছে দেয়চন্দ্রমার করোটিতে। যেখানে আকণ্ঠ করবে পান সুতীব্র মুদিরা। এই যে শব্দচয়ন এবং তন্ত্রের নানা ধরনের অভিব্যক্তির আখ্যায়ন, তার ভেতর দিয়েবাঙালির মিশ্র সংস্কৃতির অনবদ্য প্রকাশ।
এমনটা কিন্তু শামসুর রাহমানের সমসাময়িক বাংলা কবিতার সময়কালে আর অন্য কোনো কবির সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই না। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত থেকে শুরু করে বিষ্ণু দে,শামসুরের থেকে একটু আগের সময়ের কবি। তাঁরা তাঁদের সৃষ্টির দুনিয়ায়নানা ধরনের দেশ-বিদেশের উপমা সংযোজিত করেছেন।কিন্তু সেই সব উপমা সংযোজনের মধ্যে দেশীয়উপমা আমরা খুব একটা দেখতে পাই না। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই হোক, লোকায়ত ধর্মই হোক, অন্য কোনো ধরনের ট্যাবুকে ব্যবহার করে কবিতার ভাষার সঙ্গে পাঠকের ভাষা, দেখার চোখ,মননশীলতা,বাস্তব অভিজ্ঞতাÑ এ সমস্ত কিছুর মেলবন্ধন ঘটানোর জায়গাটা কেমন যেন অনুল্লিখিত থেকে যায়।
আর ঠিক সেখানেই দুর্মর কাপালিকে আখ্যান। চন্দ্রমার করোটিতে আকণ্ঠ সুতীব্র মদিরা পানের উল্লেখ। এ যেন আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের এক প্রতিষ্ঠিত ধারা, যে ধারা একটা সময়আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সহনশীলতা, বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য, এবং অবশ্যই সমন্বয়কারী ধারা,তাকে তছনছ করে দিয়েছিল। সেই চৈতন্য পূর্ববর্তী পূর্ববঙ্গের কিছু অঞ্চল, বিশেষ করে অবিভক্ত ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়া অঞ্চলে তন্ত্রের আধিপত্যের মধ্যে দিয়েকীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে একটা রীতিকে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজনের অক্ষরেখা টাকে অনেক তীব্র করে, ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদকে,তাদের শাসনের নামে শোষণের প্রক্রিয়াকে প্রলম্বিত করতে সাহায্য করেছিল। সে সমস্ত ইতিহাস বোধ যেন ইতিহাসের আঁস্তাকুড় থেকে উঠিয়েএনে, এখানে একটা দুটো শব্দের মধ্যে দিয়েশামসুর রাহমান আমাদের সামনে তুলে ধরছেন।
এই যে চিত্রকল্প নির্মাণের দীপ্তি, সেটি যেন পার্কের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে একজন প্রতীকী প্রতিবন্ধী,খঞ্জো মানুষের নানা ধরনের অভিব্যক্তি, বিশেষ করে সেই বঙ্কিমের ভাষা ধার করে নিয়েবলতে হয়; মা কী ছিলেন,কী হইয়াছেনÑ সেই চেতনার স্ফুরণ আমাদের বারবার স্বপ্নালু করে দেয়।
স্বপ্ন দেখতে কে না ভালোবাসে।কবি এবং কবিতার পাঠক স্বপ্নের অঞ্জনে চোখ রাঙিয়েকাব্য জগতে ডুব দিতে পছন্দ করে। কিন্তু সেই ডুব দিয়েউঠে যে কঠিন কঠোর উদ্ধত অসহায়বাস্তবতার সামনে এসে তাকে দাঁড়াতে হয়, সেই দাঁড়ানোর মধ্যে দিয়ে যেন হরিণের কানের মতন পাতা ঝরে।ধ্বনি ঝরে উজ্জ্বল মাছের রুপালি আশেঁর মতো। ধ্বনি ঝ’রে পৃথিবীতে এমন একটা স্বপ্নালু এবং বাস্তবের আকাক্সক্ষা মাখা মনোজগতের মধ্যে আমাদের নিয়েএসে দাঁড়করিয়ে দেয়।
যে জগত আমাদের স্মৃতিকে উসকে তোলে। যে জগত আমাদের বাস্তবের মাটিকে আরো শক্তপোক্ত একটা বনিয়াদের উপর দাঁড়করিয়ে, আমাদের খঞ্জতাকে অতিক্রম করবার জন্য,নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গতায়পরিণত করে।আর যে জগৎ আমাদের দেখাতে থাকে একটা রঙিন ভবিষ্যৎ।