মনজুর শামস
দুনিয়াতেও দোজখ, আখেরাতেও দোজখ! সলিম মিয়ার কাছে এই দুনিয়াটাকে দোজখখানা বলেই মনে হয়। আর মরার পর সে যে দোজখেই যাবে এতে একটুও সন্দেহ নেই তার। ওয়াজ মাহফিলে হুজুরের বয়ান শুনে শুনে তার যেটুকু ধর্মজ্ঞান জন্মেছে তাতে সে একেবারেই নিশ্চিত মরার পরে দোজখই রয়েছে তার কপালে। সে নামাজ পড়ে না, রোজাও রাখতে পারে না সব কয়টা। মিথ্যে কথা তাকে বলতেই হয়, না বললে সংসার চলে না। তার চাকরিটাই তো থাকবে না মিথ্যে বলতে না পারলে! খুব চালু এক অফিসে অফিস সহকারীর চাকরি করে সে। অতো বড় নাম তার মুখে আসে না, নিজেকে সে পিওন বলেই পরিচয় দেয়। অবশ্য যদি দরকার হয়! চালু অফিস মানে অনেক লোকজনের আনাগোনায় সব সময় গমগম করতে থাকে অফিসটা। আর এখানে যারা চাকরি করে তাদের প্রায় সবারই বেতনের তিন/চার গুণ বেশি উপরি কামাই। সলিম যে কয়টা টাকা বেতন পায় তা দিয়ে তার সাতজনের সংসারের দশ দিনের খরচও সামাল দেয়া সম্ভব হয় না। আটজনের সংসারই ছিল। বছরখানেক হলো বউ মারা গেছে। লোকে বলে বউ মরে ভাগ্যবানের! সলিম মিয়ারও কথাটা ভাবতে খুব পুলক জাগে মনে। তবে এখনো সেই ভাগ্যের কোনো আলামত দেখতে পাচ্ছে না সে।
অফিসে তার স্যারেরা যে পথে উপরি কামাইগুলো করে তার শুরুটা হয় এই সলিমের হাত দিয়েই। এখানে নানা কাজে আসা লোকদের মনে মিথ্যে ভয় ধরিয়ে দিয়ে কাজ উদ্ধার করে দেয়ার প্রলোভনে উপরি আদায়ের ঝাঁপিটা খোলে সে। তাদের কাছে তাকেই বলতে হয় প্রথম মিথ্যে কথাটা। এই প্রক্রিয়ার শেষ ধাপটাও তাকেই টপকাতে হয়। তার সাহেবেরা উপরির টাকাটা নিজের হাতে নিতে ভারি লজ্জা পান! শত হলেও তারা তো ইজ্জতদার আদমি! এমনকি দ্বিতীয় ধাপে কোন ফাইলের জন্য কত দিতে হবে সেই হিসেবটাও তাকে কষে দিতে হয়। শুরুটা আর শেষটা তার হাত দিয়ে হলেও বখরাটা আবার সবচেয়ে কম জোটে তার কপালেই। যে অদৃশ্য শেকলটা দিয়ে এখানে কাজ উদ্ধারে আসা অমেরুদ-ি পাবলিকদের বেঁধে ফেলা হয় সেই শেকলটা সে-ই গাঁথতে শুরু করে; গুটিয়েও আনে সে। তবে হিস্যে পাওয়ার বেলায় ছিটকে আসা একটা ফোঁটাই জোটে কেবল কপালে। পিয়নদের কোটিপতি বনে যাওয়ার যে ঘটনাগুলো ফাঁস করে মিডিয়ার কাগজ বা চ্যানেলগুলো ধান্ধা বাগায় সলিম কখনো তাদের মতো হতে পারেনি। বয়সকালেই পারেনি, আর এখন তো বুড়োদের কাতারে চলে গেছে!
এইসব গুনাহ্র কাজ করতে তার একটুও ইচ্ছে করে না, কিন্তু উপায় নেই। কখনোই কোনো সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার তার কোনো উপায় থাকে না। সেই জন্মের পর থেকেই। জীবনে কখনো তার কোনো ইচ্ছে পূরণ হয়েছে বলে মনে করতে পারে না সে। এই জগতটায় জন্মানোতে তার নিজের কোনো ইচ্ছে কাজ করেনি। তাকে এই দুনিয়ার আলো দেখানোর তার মা-বাবার আদৌ কোনো ইচ্ছে ছিল কিনা বলতে পারবে না সে। তারাও তা বলতে পারবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে তার। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে তার যখন যা ইচ্ছে তা করতে পারেনি। লেখাপড়া করতে মন চায়নি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে আরবি পড়তে মসজিদে আর অন্যান্য পড়ার জন্য স্কুলে গিয়ে বেদম মার খেতে হয়েছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে পরীক্ষা দিয়ে ফেল করে নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে হয়েছে। বিয়ের পর নিজের সংসারেও নিজের ইচ্ছেমতো কোনোকিছু করতে পারেনি। আটঘাটের পানি খেয়ে শেষমেশ পিওনের একটি চাকরি জোটাতে পেরেছিল যদিও, কিন্তু সেখানকার প্রায় সব কাজই তাকে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে মাকে নিজের সংসারে ঠাঁই দিতে হয়েছে, অন্য কোনো ভাই-বোন তার কোনো দায়-দায়িত্ব নেয়নি। তিন মেয়ে দুই ছেলের ভেতর বড় মেয়ে এক বখাটে ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছেÑ যেখানে তার কোনো ইচ্ছে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। অন্য দুই মেয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার করেছে, যাতে তার ইচ্ছে তো দূরে থাক, সায়ও ছিলো না। আর ছোট ছেলে তো তার কোনো ইচ্ছেকে পাত্তা দেয়নি কোনোকালেই। কৈশোরেই পুরো বখে গেছে। তার কানে এসেছে, তার এই ছেলে নাকি মহল্লার কিশোর গ্যাং-এর পাতি নেতা হয়ে গেছে। অনিচ্ছায় যাপিত তার এই বেনাগরিক মনটা যখন ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ে ছটফট করতে থাকে তখন তার ভীষণ মরে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এ ইচ্ছেটাও পূরণ হয় না তার। এতো বড় একটা আন্দোলন হলো, কতো মানুষ প্রাণ দিল, এতোবার ইচ্ছে হলো মিছিলে গিয়ে হাত মুঠো করে স্লোগান দেবে, অথচ সে ইচ্ছেটা থেকেও দূরে দূরেই থাকতে হলো তাকে।
কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে সে ছুটে চলেছে পুরোপুরি নিজের ইচ্ছেতেই। পড়িমরি করে। কদিন ধরেই সারাদেশ টালমাটাল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশটা ফুঁসছে। ‘বৈষম্যহীন’ শব্দটা সলিমকেও ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। কী যে ভালো হতো এই সমাজটায় কোনো বৈষম্য না থাকলেÑ মনে মনে ভেবেছে সে। গুলি করে ছাত্র মারার পর আরো মরিয়া হয়ে উঠেছে আন্দোলনকারীরা। এরপর অবুঝ শিশু ও নারীরাও গুলিতে প্রাণ দিতে থাকলে সাধারণ মানুষও পথে নেমে এসেছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং সরকারের পতন ঘটেছে। পরে সে জানতে পেরেছে, বেপরোয়া জনতা গণভবনে ঢুকে লুটপাট শুরু করলে দলবল নিয়ে তার ছোট ছেলে সেখানে গিয়ে চড়াও হয়েছিল। নিজেরা তো লুটপাট করেছিলই, অন্যদের লুটে আনা জিনিসপত্রও সস্তায় কিনে এনে দারুণ ব্যবসা ফেঁদেছিল তারা। এর আগে দুদিন ধরে তার কোনো খোঁজ ছিল না। বাড়ি ফিরছিল না। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, আজকাল প্রায়ই বাড়ি ফেরে না সে। এতে সলিমের কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। আগে যাও ছেলে-মেয়েকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কিছুটা চেষ্টা করতো; পারতো না, তবুও। কিন্তু স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একেবারেই সে-চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়েছে সে। ওদের জন্য এখন এমনকি সামান্য দায়ও বোধ করে না সে। ইস, তার ছেলেটা যদি এই আন্দোলনে শরিক থাকতো! উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলের জন্য মনে কোনো অনুভূতিই হয় না এখন তার।
কিন্তু আজ হলো। বাড়িতেই ছিল সে তখন। অফিস আজ কয়েকদিন ধরে বন্ধ। ছোট মেয়ে যখন কাকে যেন ফোন করে জেনে জানালো যে তার ছোট ভাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একটি টায়ারের কারখানায় যন্ত্রপাতি লুট করতে গিয়েছিল দলবলের সঙ্গে। কিন্তু তার পর থেকে তাকে নাকি আর মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না। একটু আগেই টিভির খবরে ওই কারখানায় আগুন লাগার ছবি দেখাচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, অনেকেই নাকি সেই জ¦লন্ত কারখানায় আটকা পড়েছে। কিন্তু সলিম কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না কাদের পাল্লায় পড়েছে তার ছেলে। কালই তো সে এখানে গণভবন লুটেছিল! আজ আবার? তাও এতোটা পথ ঠেঙিয়ে সেই রূপগঞ্জে? নিশ্চয় বড় কোনো গ্যাঙের পাল্লায় পড়েছে! সময়মতো কিছু বলেনি, বাধা দেয়া তো দূরে থাক। এখন একেবারে গোল্লায় চলে যাওয়ার পর হুঁশ হলো তার।
এতোদিনে যেন তার ভেতরে বাবার দায়িত্ব উথলে উঠল। তা তাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলল রূপগঞ্জের সেই কারখানাটার দিকে। রাত দশটার খবর দেখছিল সে। রাস্তায় বেরুল সাড়ে দশটার একটু পড়ে। সে জানতো রাস্তায় কোনো পুলিশ নেই। যানবাহন তেমন একটা চলছে না। বাস যে পাবে না জানা কথা। মুগদা থেকে অনেক খুঁজে একটি রিক্সাকে রাজি করাতে পারল যাত্রাবাড়ি পার করে দিতে। যাত্রাবাড়ি নেমে সে হাঁটতে শুরু করল। শনির আখড়া পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার পর ভাগ্যক্রমে একটি টেম্পো পেয়ে গেল কাচপুর ব্রিজের গোড়া পর্যন্ত। হেঁটে কাচপুর ব্রিজ পার হয়ে রূপগঞ্জের দিকে যেতে থাকা একটি ট্রাকের হেল্পারকে অনেক বলেকয়ে রাজি করিয়ে ট্রাকে চড়ে বসল সে। পথের ধারে এমন দুর্দিনের রাতেও খোলা থাকা একটি চায়ের দোকানে চা খেতে ট্রাক থামিয়েছিল ড্রাইভার। গথঘাটও চেনা ছিল না। বিপদের কথা জানানোয় হেলপার দয়া দেখিয়ে তাকে সেই কারখানায় যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে এক জায়গায় তাকে ট্রাক থেকে নামিয়ে দিল।
তাকে নামিয়ে দিয়ে ট্রাকটা চলে যাওয়ার পর ভীষণ অসহায় হয়ে পড়ল সলিম। উত্তরদিকে আরো অনেক দূর হাঁটতে হবে তাকে। হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করল সে। সিটি কর্পোরেশন এলাকার বাইরে বলে কোনো সড়কবাতি নেই। কিছুদূর হাঁটার পর ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। এখানে রাস্তার পাশে বাড়িঘর নেই বলে আলোও জ¦লছে না কোথাও। মাঝেমাঝে দু-একটি গাড়ি চলে গেলে সেগুলোর হেডলাইটের আলোয় এক ঝলক করে পথ দেখা যাচ্ছিল। বাকি সময়টুকু ঘুটঘুটে অন্ধকার। আগুন কি এখনো জ¦লছে? সামনে তাকিয়ে আগুনের শিখা খুঁজতে থাকে সে। না নেই। আগুনের আভার কোথাও কোনো আভাস নেই। আরো কিছুক্ষণ পা চালিয়ে হাঁটার পর সামনে কয়েকজন মানুষের চলমান ছায়ামূর্তি দেখতে পেল সে। তারাও সামনের দিকে যাচ্ছে। আরো দ্রুত পা চালাতে থাকল সে। এই বুড়ো বয়সে এমন জোরকদমে হাঁটা! প্রতি মুহূর্তে শরীরটা নেতিয়ে পড়তে চাইছে। জান খিঁচে নিজেকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সামনের লোকেদের নাগালে পৌঁছে তাদের জোরে জোরে বলা উত্তেজিত কথা থেকে সে জেনে গেল তারাও ওই আগুনলাগা কারখানায় ছুটে যাচ্ছে স্বজনদের খোঁজে। কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে তাদের সঙ্গে তাল রেখে হাঁটতে থাকল সে।
কারখানার গেটে পৌঁছেই সবাই দৌড় লাগাল আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া জায়গাটার দিকে। সলিমও ছুটল। কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে তাদের থেমে যেতে হলো। কোনো পুলিশ নেই, কিন্তু ফায়ারসার্ভিসের লোকজন জায়গাটা ঘিরে রেখেছে। কাউকে পোড়া জায়গায় যেতে দিচ্ছে না। এখনো কয়েক জায়গা থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তাদের লক্ষ্য করে ফায়ারসার্ভিসের একজন বলল, ‘কাল সকালে আমরা খুঁজে দেখবো ওখানে কোনো লাশ আছে কিনা। থাকলে আপনাদের জানাবো।’
চরম শ্রান্তিতে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই ধপ করে বসে পড়ল সে। সারাশরীর বেয়ে দরদরিয়ে ঝরতে থাকল ঘাম। দোজখের ঘাম।
মনজুর শামস
বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪
দুনিয়াতেও দোজখ, আখেরাতেও দোজখ! সলিম মিয়ার কাছে এই দুনিয়াটাকে দোজখখানা বলেই মনে হয়। আর মরার পর সে যে দোজখেই যাবে এতে একটুও সন্দেহ নেই তার। ওয়াজ মাহফিলে হুজুরের বয়ান শুনে শুনে তার যেটুকু ধর্মজ্ঞান জন্মেছে তাতে সে একেবারেই নিশ্চিত মরার পরে দোজখই রয়েছে তার কপালে। সে নামাজ পড়ে না, রোজাও রাখতে পারে না সব কয়টা। মিথ্যে কথা তাকে বলতেই হয়, না বললে সংসার চলে না। তার চাকরিটাই তো থাকবে না মিথ্যে বলতে না পারলে! খুব চালু এক অফিসে অফিস সহকারীর চাকরি করে সে। অতো বড় নাম তার মুখে আসে না, নিজেকে সে পিওন বলেই পরিচয় দেয়। অবশ্য যদি দরকার হয়! চালু অফিস মানে অনেক লোকজনের আনাগোনায় সব সময় গমগম করতে থাকে অফিসটা। আর এখানে যারা চাকরি করে তাদের প্রায় সবারই বেতনের তিন/চার গুণ বেশি উপরি কামাই। সলিম যে কয়টা টাকা বেতন পায় তা দিয়ে তার সাতজনের সংসারের দশ দিনের খরচও সামাল দেয়া সম্ভব হয় না। আটজনের সংসারই ছিল। বছরখানেক হলো বউ মারা গেছে। লোকে বলে বউ মরে ভাগ্যবানের! সলিম মিয়ারও কথাটা ভাবতে খুব পুলক জাগে মনে। তবে এখনো সেই ভাগ্যের কোনো আলামত দেখতে পাচ্ছে না সে।
অফিসে তার স্যারেরা যে পথে উপরি কামাইগুলো করে তার শুরুটা হয় এই সলিমের হাত দিয়েই। এখানে নানা কাজে আসা লোকদের মনে মিথ্যে ভয় ধরিয়ে দিয়ে কাজ উদ্ধার করে দেয়ার প্রলোভনে উপরি আদায়ের ঝাঁপিটা খোলে সে। তাদের কাছে তাকেই বলতে হয় প্রথম মিথ্যে কথাটা। এই প্রক্রিয়ার শেষ ধাপটাও তাকেই টপকাতে হয়। তার সাহেবেরা উপরির টাকাটা নিজের হাতে নিতে ভারি লজ্জা পান! শত হলেও তারা তো ইজ্জতদার আদমি! এমনকি দ্বিতীয় ধাপে কোন ফাইলের জন্য কত দিতে হবে সেই হিসেবটাও তাকে কষে দিতে হয়। শুরুটা আর শেষটা তার হাত দিয়ে হলেও বখরাটা আবার সবচেয়ে কম জোটে তার কপালেই। যে অদৃশ্য শেকলটা দিয়ে এখানে কাজ উদ্ধারে আসা অমেরুদ-ি পাবলিকদের বেঁধে ফেলা হয় সেই শেকলটা সে-ই গাঁথতে শুরু করে; গুটিয়েও আনে সে। তবে হিস্যে পাওয়ার বেলায় ছিটকে আসা একটা ফোঁটাই জোটে কেবল কপালে। পিয়নদের কোটিপতি বনে যাওয়ার যে ঘটনাগুলো ফাঁস করে মিডিয়ার কাগজ বা চ্যানেলগুলো ধান্ধা বাগায় সলিম কখনো তাদের মতো হতে পারেনি। বয়সকালেই পারেনি, আর এখন তো বুড়োদের কাতারে চলে গেছে!
এইসব গুনাহ্র কাজ করতে তার একটুও ইচ্ছে করে না, কিন্তু উপায় নেই। কখনোই কোনো সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার তার কোনো উপায় থাকে না। সেই জন্মের পর থেকেই। জীবনে কখনো তার কোনো ইচ্ছে পূরণ হয়েছে বলে মনে করতে পারে না সে। এই জগতটায় জন্মানোতে তার নিজের কোনো ইচ্ছে কাজ করেনি। তাকে এই দুনিয়ার আলো দেখানোর তার মা-বাবার আদৌ কোনো ইচ্ছে ছিল কিনা বলতে পারবে না সে। তারাও তা বলতে পারবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে তার। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে তার যখন যা ইচ্ছে তা করতে পারেনি। লেখাপড়া করতে মন চায়নি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে আরবি পড়তে মসজিদে আর অন্যান্য পড়ার জন্য স্কুলে গিয়ে বেদম মার খেতে হয়েছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে পরীক্ষা দিয়ে ফেল করে নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে হয়েছে। বিয়ের পর নিজের সংসারেও নিজের ইচ্ছেমতো কোনোকিছু করতে পারেনি। আটঘাটের পানি খেয়ে শেষমেশ পিওনের একটি চাকরি জোটাতে পেরেছিল যদিও, কিন্তু সেখানকার প্রায় সব কাজই তাকে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে মাকে নিজের সংসারে ঠাঁই দিতে হয়েছে, অন্য কোনো ভাই-বোন তার কোনো দায়-দায়িত্ব নেয়নি। তিন মেয়ে দুই ছেলের ভেতর বড় মেয়ে এক বখাটে ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছেÑ যেখানে তার কোনো ইচ্ছে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। অন্য দুই মেয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার করেছে, যাতে তার ইচ্ছে তো দূরে থাক, সায়ও ছিলো না। আর ছোট ছেলে তো তার কোনো ইচ্ছেকে পাত্তা দেয়নি কোনোকালেই। কৈশোরেই পুরো বখে গেছে। তার কানে এসেছে, তার এই ছেলে নাকি মহল্লার কিশোর গ্যাং-এর পাতি নেতা হয়ে গেছে। অনিচ্ছায় যাপিত তার এই বেনাগরিক মনটা যখন ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ে ছটফট করতে থাকে তখন তার ভীষণ মরে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এ ইচ্ছেটাও পূরণ হয় না তার। এতো বড় একটা আন্দোলন হলো, কতো মানুষ প্রাণ দিল, এতোবার ইচ্ছে হলো মিছিলে গিয়ে হাত মুঠো করে স্লোগান দেবে, অথচ সে ইচ্ছেটা থেকেও দূরে দূরেই থাকতে হলো তাকে।
কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে সে ছুটে চলেছে পুরোপুরি নিজের ইচ্ছেতেই। পড়িমরি করে। কদিন ধরেই সারাদেশ টালমাটাল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশটা ফুঁসছে। ‘বৈষম্যহীন’ শব্দটা সলিমকেও ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। কী যে ভালো হতো এই সমাজটায় কোনো বৈষম্য না থাকলেÑ মনে মনে ভেবেছে সে। গুলি করে ছাত্র মারার পর আরো মরিয়া হয়ে উঠেছে আন্দোলনকারীরা। এরপর অবুঝ শিশু ও নারীরাও গুলিতে প্রাণ দিতে থাকলে সাধারণ মানুষও পথে নেমে এসেছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং সরকারের পতন ঘটেছে। পরে সে জানতে পেরেছে, বেপরোয়া জনতা গণভবনে ঢুকে লুটপাট শুরু করলে দলবল নিয়ে তার ছোট ছেলে সেখানে গিয়ে চড়াও হয়েছিল। নিজেরা তো লুটপাট করেছিলই, অন্যদের লুটে আনা জিনিসপত্রও সস্তায় কিনে এনে দারুণ ব্যবসা ফেঁদেছিল তারা। এর আগে দুদিন ধরে তার কোনো খোঁজ ছিল না। বাড়ি ফিরছিল না। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, আজকাল প্রায়ই বাড়ি ফেরে না সে। এতে সলিমের কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। আগে যাও ছেলে-মেয়েকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কিছুটা চেষ্টা করতো; পারতো না, তবুও। কিন্তু স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একেবারেই সে-চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়েছে সে। ওদের জন্য এখন এমনকি সামান্য দায়ও বোধ করে না সে। ইস, তার ছেলেটা যদি এই আন্দোলনে শরিক থাকতো! উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলের জন্য মনে কোনো অনুভূতিই হয় না এখন তার।
কিন্তু আজ হলো। বাড়িতেই ছিল সে তখন। অফিস আজ কয়েকদিন ধরে বন্ধ। ছোট মেয়ে যখন কাকে যেন ফোন করে জেনে জানালো যে তার ছোট ভাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একটি টায়ারের কারখানায় যন্ত্রপাতি লুট করতে গিয়েছিল দলবলের সঙ্গে। কিন্তু তার পর থেকে তাকে নাকি আর মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না। একটু আগেই টিভির খবরে ওই কারখানায় আগুন লাগার ছবি দেখাচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, অনেকেই নাকি সেই জ¦লন্ত কারখানায় আটকা পড়েছে। কিন্তু সলিম কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না কাদের পাল্লায় পড়েছে তার ছেলে। কালই তো সে এখানে গণভবন লুটেছিল! আজ আবার? তাও এতোটা পথ ঠেঙিয়ে সেই রূপগঞ্জে? নিশ্চয় বড় কোনো গ্যাঙের পাল্লায় পড়েছে! সময়মতো কিছু বলেনি, বাধা দেয়া তো দূরে থাক। এখন একেবারে গোল্লায় চলে যাওয়ার পর হুঁশ হলো তার।
এতোদিনে যেন তার ভেতরে বাবার দায়িত্ব উথলে উঠল। তা তাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলল রূপগঞ্জের সেই কারখানাটার দিকে। রাত দশটার খবর দেখছিল সে। রাস্তায় বেরুল সাড়ে দশটার একটু পড়ে। সে জানতো রাস্তায় কোনো পুলিশ নেই। যানবাহন তেমন একটা চলছে না। বাস যে পাবে না জানা কথা। মুগদা থেকে অনেক খুঁজে একটি রিক্সাকে রাজি করাতে পারল যাত্রাবাড়ি পার করে দিতে। যাত্রাবাড়ি নেমে সে হাঁটতে শুরু করল। শনির আখড়া পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার পর ভাগ্যক্রমে একটি টেম্পো পেয়ে গেল কাচপুর ব্রিজের গোড়া পর্যন্ত। হেঁটে কাচপুর ব্রিজ পার হয়ে রূপগঞ্জের দিকে যেতে থাকা একটি ট্রাকের হেল্পারকে অনেক বলেকয়ে রাজি করিয়ে ট্রাকে চড়ে বসল সে। পথের ধারে এমন দুর্দিনের রাতেও খোলা থাকা একটি চায়ের দোকানে চা খেতে ট্রাক থামিয়েছিল ড্রাইভার। গথঘাটও চেনা ছিল না। বিপদের কথা জানানোয় হেলপার দয়া দেখিয়ে তাকে সেই কারখানায় যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে এক জায়গায় তাকে ট্রাক থেকে নামিয়ে দিল।
তাকে নামিয়ে দিয়ে ট্রাকটা চলে যাওয়ার পর ভীষণ অসহায় হয়ে পড়ল সলিম। উত্তরদিকে আরো অনেক দূর হাঁটতে হবে তাকে। হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করল সে। সিটি কর্পোরেশন এলাকার বাইরে বলে কোনো সড়কবাতি নেই। কিছুদূর হাঁটার পর ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। এখানে রাস্তার পাশে বাড়িঘর নেই বলে আলোও জ¦লছে না কোথাও। মাঝেমাঝে দু-একটি গাড়ি চলে গেলে সেগুলোর হেডলাইটের আলোয় এক ঝলক করে পথ দেখা যাচ্ছিল। বাকি সময়টুকু ঘুটঘুটে অন্ধকার। আগুন কি এখনো জ¦লছে? সামনে তাকিয়ে আগুনের শিখা খুঁজতে থাকে সে। না নেই। আগুনের আভার কোথাও কোনো আভাস নেই। আরো কিছুক্ষণ পা চালিয়ে হাঁটার পর সামনে কয়েকজন মানুষের চলমান ছায়ামূর্তি দেখতে পেল সে। তারাও সামনের দিকে যাচ্ছে। আরো দ্রুত পা চালাতে থাকল সে। এই বুড়ো বয়সে এমন জোরকদমে হাঁটা! প্রতি মুহূর্তে শরীরটা নেতিয়ে পড়তে চাইছে। জান খিঁচে নিজেকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সামনের লোকেদের নাগালে পৌঁছে তাদের জোরে জোরে বলা উত্তেজিত কথা থেকে সে জেনে গেল তারাও ওই আগুনলাগা কারখানায় ছুটে যাচ্ছে স্বজনদের খোঁজে। কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে তাদের সঙ্গে তাল রেখে হাঁটতে থাকল সে।
কারখানার গেটে পৌঁছেই সবাই দৌড় লাগাল আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া জায়গাটার দিকে। সলিমও ছুটল। কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে তাদের থেমে যেতে হলো। কোনো পুলিশ নেই, কিন্তু ফায়ারসার্ভিসের লোকজন জায়গাটা ঘিরে রেখেছে। কাউকে পোড়া জায়গায় যেতে দিচ্ছে না। এখনো কয়েক জায়গা থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তাদের লক্ষ্য করে ফায়ারসার্ভিসের একজন বলল, ‘কাল সকালে আমরা খুঁজে দেখবো ওখানে কোনো লাশ আছে কিনা। থাকলে আপনাদের জানাবো।’
চরম শ্রান্তিতে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই ধপ করে বসে পড়ল সে। সারাশরীর বেয়ে দরদরিয়ে ঝরতে থাকল ঘাম। দোজখের ঘাম।