রকিবুল হাসান
জীবন চলার পথে কিছু অসামান্য মানুষের সঙ্গে পরিচয়-সম্পর্ক-স্নেহ-শ্রদ্ধা-সান্নিধ্য, জীবনের সবচেয়ে পরম পাওয়া ও খুব গর্বের বলে অনুভূত হয়। একজীবনে এরকম যে অসংখ্য মানুষের সান্নিধ্যলাভ সম্ভব হয়, তাও নয়। ব্যাপারটি বিরল। বিশেষ করে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে। আবার একসঙ্গে চলার সময় বা অধিক ¯েœহে-সান্নিধ্যে বিখ্যাত মানুষটিকে বিখ্যাত মনে হয় না, যেন আর দশজনের মতোই সাধারণ। ব্যাপারটি একদমই তা নয়। এসব ক্ষণজন্মা-পুরুষ তাঁদের জীবনযাপনে আচার-আচরণে-ভালোবাসায় সাধারণের ভেতর অতি সাধারণ হয়েই জীবনকে যাপন করেন। কিন্তু অন্তরে মস্তিষ্কে তাঁরা সৃষ্টির নেশায় মত্ত-সাধকব্যক্তিত্ব। তা সাহিত্য হতে পারে-বিজ্ঞান হতে পারে-দর্শন হতে পারে-অনেক কিছুই হতে পারে। তাঁরা নিজস্ব সাধনাশক্তিকে সমাজ-রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাতিঘর হয়ে-ওঠেন। কবি বেলাল চৌধুরী ছিলেন এরকমই এক কবি-ব্যক্তিত্ব। তিনি ষাটের দশকের কবি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এমন একজন বিখ্যাত কবি-ব্যক্তিত্বের স্নেহ-সান্নিধ্য লাভের। তিনি বাংলা সাহিত্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি। তিনি সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং সম্পাদক হিসাবে খ্যাতিমান ছিলেন। তিনি ১৯৮৪ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১৪ সালে একুশে পদক অর্জন করেন। তিনি দীর্ঘকাল ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃক প্রকাশিত ‘ভারত বিচিত্রা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ,-‘বত্রিশ নম্বর’, ‘মৃত্যুর কড়ানাড়া’, ‘আমার কলকাতা’, ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’, ‘যাওয়ার আগে আরেক চুমুক’, ‘সেলাই করা ছায়া’, ‘যে ধ্বনি চৈত্রে, শিমুলে’ প্রভৃতি।
বেলাল চৌধুরীর বাসায় প্রথম যাই কথাসাহিত্যিক আতা সরকারের সঙ্গে। ২০০৯-এর দিকে। মনে হলো কাগজের স্তূপের মধ্যে বসে আছেন। আমি খুব অবাক হই, হাফপ্যান্ট পরে খালি গায়ে কাগজের ভেতর দরকারি কোনো কাগজ খুঁজছেন, পুরনো কোনো লেখা হয়তো খুঁজছেন। আমরা পাশে বসি, সোফায়। সোফার উপরও ছড়ানো ছিটানো বই পত্রপত্রিকা। কাগজ খুঁজতে খুঁজতেই তিনি কথা বলছেন, আতা সরকারের সঙ্গে। আমি নীরব শ্রোতা। তাঁকে এই প্রথম দেখছি। গভীরভাবে দেখতে থাকি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত এক কবি, বেলাল চৌধুরীকে। কথা বলতে বলতেই এক সময় বিখ্যাত এই মানুষটির সঙ্গে কথাসাহিত্যিক আতা সরকার আমার পরিচয় করিয়ে দেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি যখন জানলেন আমি পাবনাতে সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে পড়ালেখা করেছি। তখন তিনি বললেন, ‘পাবনাতে তো কবি ওমর আলী থাকেন। চেনো উনাকে?’
বললাম, ‘উনি তো আমার কলেজের শিক্ষক। ইংরেজি পড়ান।’ বলতেই আমার দিকে তিনি চোখ তুলে তাকালেন। এই প্রথম আমার দিকে তাকালেন। তিনি এতক্ষণ যে কথা বলছিলেন কাগজের স্তূপের ভেতর কিছু একটা গভীরভাবে খুঁজছিলেন, আর কথা বলছিলেন, তার চোখ কাগজের স্তূপের ভেতরই ডুবে ছিল। হঠাৎ চোখ তুলে এবার বললেন,
‘ওমর আলী আমার বন্ধু। বড় কবি। তুমি তো সৌভাগ্যবান, তাঁর ছাত্র হতে পেরেছে।’
আমি আগবাড়িয়ে বললাম, ওমর আলী আমাকে অনেক ¯েœহ করেন। তাঁর কবিতা নিয়মিত পড়ি। ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’, ‘তা¤্র যুগ প্রস্তর যুগ’, ‘তেমাথার শেষে নদী’, ‘এখনো তাকিয়ে আছি’, ‘ডাকছে সংসার’, ‘ফেরার সময়’-এসব কাব্য আমি পড়েছি।
‘তাই নাকি!’-
এ সুযোগে বললাম, স্যারের উপন্যাস ‘খান ম্যানসনের মেয়ে’, ‘কুতুবপুরের হাসনাহেনা’ও পড়েছি।
শুনে খুশি হন তিনি।
এরপর কথা যে খুব আগালো তা নয়। তাঁর ব্যস্ততা দেখে আতা সরকার নিজেও বেশিক্ষণ আলাপ বাড়ালেন না। ক্ষণিক পরিচয়, এই একটু একটু কথা শেষে সে যাত্রায় ফিরতে হয় আমাদের।
এরপর কবি বেলাল চৌধুরীর বাসায় অনেকবার যাওয়া হয়েছে। সেই একই দৃশ্য। কাগজের স্তূপের ভেতর বসে আছেন, কিছু একটা পড়ছেন, কিছু একটা খুঁজছেন। আবার পাশে রেখে দিচ্ছেন। তাঁকে দেখে কখনোই তাঁকে মনে হয়নি তিনি এত বড় বিখ্যাত একজন কবি।মনে হয়েছে একজন দিব্যি ঋষি-সাধক।জীবনভর কিছু একটা খুঁজেই যাচ্ছেন। তার বাসায় যখনই গিয়েছি, তখনই দেখেছি কাগজের স্তূপের ভেতর সাধকের মতো কিছু একটা খুঁজছেন, পড়ছেন। এর ভেতর দিয়েই কথা হতো। ছোট ছোট করে কথা বলতেন। একটা কথা বলার পর শুনতেন বেশি, বলতেন কম, খুবই কম। সঙ্গে যারা থাকতেন তারা বলতেন, কবি বেলাল চৌধুরী তরুণদের কথা শুনতেন, বোধহয় একটু বেশিই শুনতেন। লেখালেখির খোঁজ নিতেন। তিনি আশ্চর্যজনকভাবে তরুণদের লেখালেখি বিষয়ে বিস্তর খবর রাখতেন। আমরা এক-আধটু যা বলতাম, তিনি নীরবে তা মনোযোগ সহকারে শুনতেন। তবে তার মধ্যেই কোন না কোন লেখাতে চোখ বুলাতেন।
গণমাধ্যম সংস্থা ‘ঘাসফুলে’র উদ্যোগে আমার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘কয়ায় রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন এবং প্রাজ্ঞজন’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখময়ী শ্যমবর্ণ রাত’ নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে আয়োজন করা হয়, গুলশানে বিগ আড্ডায়। মূল উদ্যোক্তা কথাসাহিত্যিক আতা সরকার। প্রধান অতিথি কবি বেলাল চৌধুরী। তিনি যে আসবেন এটা ভাবিনি। কারণ তাঁর শরীরটা একটু খারাপ ছিল। কিন্তু তিনি আসলেন। আতা সরকারকে তিনি অনেক ভালোবাসতেন। মূলত সে কারণেই হয়তো এসেছেন। আমাকে যতটুকু চেনেন, জানেন, তাতে অত বিখ্যাত একজন কবির আসার কথা নয়। এ কৃতিত্ব মূলত আতা সরকারের। অনুষ্ঠানে অভিনো-লেখক খায়রুল আলম সবুজ, এ এস এম কামাল উদ্দিন, কবি-প্রফেসর ড. অনীক মাহমুদ, প্রফেসর ড. রাশিদ আসকারী, প্রফেসর সরদার আব্দুস সাত্তার প্রমুখ দুটি গ্রন্থের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু খুব অবাক হয়েছি, কবি বেলাল চৌধুরী যখন ‘কয়ায় রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন এবং প্রাজ্ঞজন’ গ্রন্থটি সম্পর্কে বলার সময় প্রথমেই বললেন, ‘রকিবের এই বইয়ে আমার বন্ধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা আছে মাত্র এক লাইনে। তবে ভালো রাগছে ও (রকিব) আমার বন্ধুর গ্রামের ছেলে।’ এটুকু শুনেই আমার যতোটা ভালো লাগে, ভাবনা বাড়িয়ে দেয় তার চেয়ে অনেক বেশি। সত্যিকার অর্থে আমি তখন জানতাম না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কীভাবে কোন সূত্রে কয়া গ্রামের সন্তান! তাঁর এই কথাটা আমার মাথার ভেতর জলের ¯্রােতের মতো ঘুরতে থাকে। আমি চেষ্টা করতে থাকি এটা আবিষ্কারের। শেষে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে যেটা পাওয়া গেলো, তা হলো,- ‘উপমহাদেশের কিংবদন্তি এই অভিনেতা পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামে, যে গ্রামটি আমারও। কয়ার চাটুর্জে বাড়ির পরিচিতি শুধু কুষ্টিয়া নয়, গোটা ভারতবর্ষেও এ পরিবারের বিশেষ একটি পরিচিতি আছে। কারণ এ বাড়ির বিখ্যাত সন্তান (ভাগ্নে) বাঘা যতীন। তাঁর কারণেই এ বাড়ির পরিচিতি গোটা ভারত জুড়েই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম এ গ্রামে না-হলেও তাঁর শেকড় এখানেই। তাঁর পূর্বপুরুষরা এ গ্রামের দাপুটে ক্ষমতাশীল ব্যক্তি ছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি, কৃষ্ণনগরে। তাঁর পিতামহের আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহ ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় কয়া গ্রামেই বাস করতেন। তিনিও একসময় তাঁর সন্তানদের নিয়ে কৃষ্ণনগর চলে যান। তাঁর ভাইয়েরা আরও আগে থেকেই কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন।
কবি বেলাল চৌধুরী যদি সেদিন অনুষ্ঠানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে ওভাবে না বলতেন, তাহলে আমার হয়তো কখনোই আবিষ্কার করা হতো না এতো বড় কিংবদন্তি অভিনেতার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আদি-শেকড়, যারা কয়া গ্রামের মানুষ ছিলেন। পরবর্তীতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছি। এর প্রেরণা কবি বেলাল চৌধুরী। আমারও কবি বেলাল চৌধুরীর উপর অধিকার বেশি করে জন্মালো-আমি তাঁর বন্ধু কবি ওমর আলীর ছাত্র, আর এক বন্ধু অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গ্রামের সন্তান এবং প্রিয়ভাজর কথাসাহিত্যিক আতা সরকারের ¯েœহভাজন। এ সবের ভেতর দিয়েই তাঁর ¯েœহভাজন হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। আর লেখালেখির ব্যাপারটি তো ছিলোই।
আমি যখন উত্তরা বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করি, তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে ‘আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে’ শিরোনামে একটা আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি, ২০১২ সালের নভেম্বরে। দুজনেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন। তাঁদের কবিতা উপন্যাস পাঠকদের মস্তিষ্কে নিত্যসময় অনুরণিত হয়। বলা যায়, সেই সময়ে দুজনেই জনপ্রিয়তার ঝড়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। এরকম জনপ্রিয়তা অর্জন খুব কম বাঙালি লেখকেরই ভাগ্যে জুটেছে। আমরা জানতাম, কবি বেলাল চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ফলে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বন্ধু হিসেবে প্রধান অতিথি হিসেবে কবি বেলাল চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানাই। যাতে করে একজন কবির কাছ থেকে দেখা একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমরা অনুভব করতে পারি- তাঁর লেখালেখি জীবনযাপন চিন্তাভাবনা রাজনৈতিক দর্শন। যখন কবি বেলাল চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানাই তখন তাঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। কিন্তু সুনীল-হূমায়ুন- স্মরণসভার কথা শুনে না করতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে বিশেষ অতিথি ছিলেন কথাসাহিত্যিক আতা সরকার। কবি বেলাল চৌধুরী প্রায় সারাটা দিন সেদিন বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীর সঙ্গে ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর যে বন্ধুত্ব-লেখালেখি-জীবনযাপন-অজ¯্র স্মৃতি, তা দীর্ঘ সময় ধরে বললেন। তার বক্তব্য আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। পিনপতন শব্দ ছিল না। তাঁর বক্তব্যের ভেতর দিয়ে আমরা যেন মানস-চোখে কলকাতার শিল্প-সাহিত্যচর্চা-সেখানকার পরিবেশ-তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের তুমুল আলোচনা-সমালোচনা-বাক-বিত-া- কবিতা নিয়ে মস্ত একটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা-সবকিছু অনুভব করছিলাম।
অনুষ্ঠানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা আবৃত্তি-পর্ব ছিল। তিনি মুগ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীদেও কবিতা আবৃত্তি শুনলেন। অনুষ্ঠানের পরেও তিনি আমাদের সঙ্গে থাকলেন, গল্প করলেন তাঁর কলকাতা জীবন নিয়ে। অদ্ভুত মোহনীয় ক্ষমতা-তিনি ধীরে বলছেন, কথাগুলো যেন যাদুর মতো আমাদের স্পর্শ করছে, চুম্বকের মতো করে ধরে রাখছে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা। তিনি একেবারেই অতি সাধারণ মানুষের মতো থাকতেন, সহজ-সরল জীবন ছিল, নিরাহংকার নির্লোভ অসামান্য এক ব্যক্তিত্ব। অথচ তিনি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত একজন কবি। কথাবার্তায় চালচলনে জীবনযাপনে যা কখনো বিন্দুমাত্র অনুভূত হতো না।
আমার খুব সৌভাগ্য হয়েছিল কবি বেলাল চৌধুরীকে আমার তিনটি গ্রন্থের প্রকাশনা ও আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে পাই। আমার গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন’ গ্রন্থের আলোচনা আনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল কথাসাহিত্যিক আতা সরকারের ঘাসফুল। এই অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে ভিআইপি কনফারেন্স রুমে। ৯ জুলাই ২০১৩ সালে। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আলোচনা করেছিলেন অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমেদ, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, এএসএম কামালউদ্দিন, কথাসাহিত্যিক আতা সরকার কবি বিলু কবীর, ড. গাজী রহমান, ড. আমিনুর রহমান সুলতান, ড. শহীদ ইকবাল প্রমুখ। তিনি কথা বলতে বলতে একসময় বললেন, ‘রকিব ভালো কবিতা লেখে জানতাম। কিন্তু ও যে একজন ভালো গবেষক তা জানলাম মাত্র কয়েকদিন আগে, যখন আতা সরকার ওর এই গবেষণা গ্রন্থটি আমাকে দিলো।’ এর আগে উল্লেখ করেছি তিনি আমার ‘কয়ায় রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন এবং প্রাজ্ঞজন’ প্রবন্ধ গ্রন্থ ও ‘দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন।
একপর্যায়ে কবি বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিবারের সকলের চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়। আমার কন্যা কাব্যকে কাছে পেলেই আদর করে কাছে নিতেন। সেসব স্মৃতি এখন ছবিবন্দি। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর সান্নিধ্য যতটুকু পেয়েছি, যতদিন তাঁকে দেখেছি, সবসময়ই তাঁকে অতিসাধারণ মনে হয়েছে। কখনো কখনো আত্মভোলাও মনে হয়েছে। সত্যিকারের বড় মানুষেওে হয়তো এরকমই হোন-নিজেকে কখনোই ভাবেন না, নিজের কর্মযজ্ঞে সৃষ্টির নেশায় আপনমনে ডুবে থাকাই হয়তো তাদের জীবনের সাধনা। যে সাধনার ফলে সৃষ্টি হয় শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান বিভিন্ন ক্ষেত্রে অজস্র আলো। কবি বেলাল চৌধুরীও ছিলেন বাংলা সাহিত্যে কবিতার আকাশে আলো ছড়িয়ে দেওয়া এক নক্ষত্র আলো।
রকিবুল হাসান
বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪
জীবন চলার পথে কিছু অসামান্য মানুষের সঙ্গে পরিচয়-সম্পর্ক-স্নেহ-শ্রদ্ধা-সান্নিধ্য, জীবনের সবচেয়ে পরম পাওয়া ও খুব গর্বের বলে অনুভূত হয়। একজীবনে এরকম যে অসংখ্য মানুষের সান্নিধ্যলাভ সম্ভব হয়, তাও নয়। ব্যাপারটি বিরল। বিশেষ করে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে। আবার একসঙ্গে চলার সময় বা অধিক ¯েœহে-সান্নিধ্যে বিখ্যাত মানুষটিকে বিখ্যাত মনে হয় না, যেন আর দশজনের মতোই সাধারণ। ব্যাপারটি একদমই তা নয়। এসব ক্ষণজন্মা-পুরুষ তাঁদের জীবনযাপনে আচার-আচরণে-ভালোবাসায় সাধারণের ভেতর অতি সাধারণ হয়েই জীবনকে যাপন করেন। কিন্তু অন্তরে মস্তিষ্কে তাঁরা সৃষ্টির নেশায় মত্ত-সাধকব্যক্তিত্ব। তা সাহিত্য হতে পারে-বিজ্ঞান হতে পারে-দর্শন হতে পারে-অনেক কিছুই হতে পারে। তাঁরা নিজস্ব সাধনাশক্তিকে সমাজ-রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাতিঘর হয়ে-ওঠেন। কবি বেলাল চৌধুরী ছিলেন এরকমই এক কবি-ব্যক্তিত্ব। তিনি ষাটের দশকের কবি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এমন একজন বিখ্যাত কবি-ব্যক্তিত্বের স্নেহ-সান্নিধ্য লাভের। তিনি বাংলা সাহিত্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি। তিনি সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং সম্পাদক হিসাবে খ্যাতিমান ছিলেন। তিনি ১৯৮৪ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১৪ সালে একুশে পদক অর্জন করেন। তিনি দীর্ঘকাল ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃক প্রকাশিত ‘ভারত বিচিত্রা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ,-‘বত্রিশ নম্বর’, ‘মৃত্যুর কড়ানাড়া’, ‘আমার কলকাতা’, ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’, ‘যাওয়ার আগে আরেক চুমুক’, ‘সেলাই করা ছায়া’, ‘যে ধ্বনি চৈত্রে, শিমুলে’ প্রভৃতি।
বেলাল চৌধুরীর বাসায় প্রথম যাই কথাসাহিত্যিক আতা সরকারের সঙ্গে। ২০০৯-এর দিকে। মনে হলো কাগজের স্তূপের মধ্যে বসে আছেন। আমি খুব অবাক হই, হাফপ্যান্ট পরে খালি গায়ে কাগজের ভেতর দরকারি কোনো কাগজ খুঁজছেন, পুরনো কোনো লেখা হয়তো খুঁজছেন। আমরা পাশে বসি, সোফায়। সোফার উপরও ছড়ানো ছিটানো বই পত্রপত্রিকা। কাগজ খুঁজতে খুঁজতেই তিনি কথা বলছেন, আতা সরকারের সঙ্গে। আমি নীরব শ্রোতা। তাঁকে এই প্রথম দেখছি। গভীরভাবে দেখতে থাকি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত এক কবি, বেলাল চৌধুরীকে। কথা বলতে বলতেই এক সময় বিখ্যাত এই মানুষটির সঙ্গে কথাসাহিত্যিক আতা সরকার আমার পরিচয় করিয়ে দেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি যখন জানলেন আমি পাবনাতে সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে পড়ালেখা করেছি। তখন তিনি বললেন, ‘পাবনাতে তো কবি ওমর আলী থাকেন। চেনো উনাকে?’
বললাম, ‘উনি তো আমার কলেজের শিক্ষক। ইংরেজি পড়ান।’ বলতেই আমার দিকে তিনি চোখ তুলে তাকালেন। এই প্রথম আমার দিকে তাকালেন। তিনি এতক্ষণ যে কথা বলছিলেন কাগজের স্তূপের ভেতর কিছু একটা গভীরভাবে খুঁজছিলেন, আর কথা বলছিলেন, তার চোখ কাগজের স্তূপের ভেতরই ডুবে ছিল। হঠাৎ চোখ তুলে এবার বললেন,
‘ওমর আলী আমার বন্ধু। বড় কবি। তুমি তো সৌভাগ্যবান, তাঁর ছাত্র হতে পেরেছে।’
আমি আগবাড়িয়ে বললাম, ওমর আলী আমাকে অনেক ¯েœহ করেন। তাঁর কবিতা নিয়মিত পড়ি। ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’, ‘তা¤্র যুগ প্রস্তর যুগ’, ‘তেমাথার শেষে নদী’, ‘এখনো তাকিয়ে আছি’, ‘ডাকছে সংসার’, ‘ফেরার সময়’-এসব কাব্য আমি পড়েছি।
‘তাই নাকি!’-
এ সুযোগে বললাম, স্যারের উপন্যাস ‘খান ম্যানসনের মেয়ে’, ‘কুতুবপুরের হাসনাহেনা’ও পড়েছি।
শুনে খুশি হন তিনি।
এরপর কথা যে খুব আগালো তা নয়। তাঁর ব্যস্ততা দেখে আতা সরকার নিজেও বেশিক্ষণ আলাপ বাড়ালেন না। ক্ষণিক পরিচয়, এই একটু একটু কথা শেষে সে যাত্রায় ফিরতে হয় আমাদের।
এরপর কবি বেলাল চৌধুরীর বাসায় অনেকবার যাওয়া হয়েছে। সেই একই দৃশ্য। কাগজের স্তূপের ভেতর বসে আছেন, কিছু একটা পড়ছেন, কিছু একটা খুঁজছেন। আবার পাশে রেখে দিচ্ছেন। তাঁকে দেখে কখনোই তাঁকে মনে হয়নি তিনি এত বড় বিখ্যাত একজন কবি।মনে হয়েছে একজন দিব্যি ঋষি-সাধক।জীবনভর কিছু একটা খুঁজেই যাচ্ছেন। তার বাসায় যখনই গিয়েছি, তখনই দেখেছি কাগজের স্তূপের ভেতর সাধকের মতো কিছু একটা খুঁজছেন, পড়ছেন। এর ভেতর দিয়েই কথা হতো। ছোট ছোট করে কথা বলতেন। একটা কথা বলার পর শুনতেন বেশি, বলতেন কম, খুবই কম। সঙ্গে যারা থাকতেন তারা বলতেন, কবি বেলাল চৌধুরী তরুণদের কথা শুনতেন, বোধহয় একটু বেশিই শুনতেন। লেখালেখির খোঁজ নিতেন। তিনি আশ্চর্যজনকভাবে তরুণদের লেখালেখি বিষয়ে বিস্তর খবর রাখতেন। আমরা এক-আধটু যা বলতাম, তিনি নীরবে তা মনোযোগ সহকারে শুনতেন। তবে তার মধ্যেই কোন না কোন লেখাতে চোখ বুলাতেন।
গণমাধ্যম সংস্থা ‘ঘাসফুলে’র উদ্যোগে আমার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘কয়ায় রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন এবং প্রাজ্ঞজন’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখময়ী শ্যমবর্ণ রাত’ নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে আয়োজন করা হয়, গুলশানে বিগ আড্ডায়। মূল উদ্যোক্তা কথাসাহিত্যিক আতা সরকার। প্রধান অতিথি কবি বেলাল চৌধুরী। তিনি যে আসবেন এটা ভাবিনি। কারণ তাঁর শরীরটা একটু খারাপ ছিল। কিন্তু তিনি আসলেন। আতা সরকারকে তিনি অনেক ভালোবাসতেন। মূলত সে কারণেই হয়তো এসেছেন। আমাকে যতটুকু চেনেন, জানেন, তাতে অত বিখ্যাত একজন কবির আসার কথা নয়। এ কৃতিত্ব মূলত আতা সরকারের। অনুষ্ঠানে অভিনো-লেখক খায়রুল আলম সবুজ, এ এস এম কামাল উদ্দিন, কবি-প্রফেসর ড. অনীক মাহমুদ, প্রফেসর ড. রাশিদ আসকারী, প্রফেসর সরদার আব্দুস সাত্তার প্রমুখ দুটি গ্রন্থের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু খুব অবাক হয়েছি, কবি বেলাল চৌধুরী যখন ‘কয়ায় রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন এবং প্রাজ্ঞজন’ গ্রন্থটি সম্পর্কে বলার সময় প্রথমেই বললেন, ‘রকিবের এই বইয়ে আমার বন্ধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা আছে মাত্র এক লাইনে। তবে ভালো রাগছে ও (রকিব) আমার বন্ধুর গ্রামের ছেলে।’ এটুকু শুনেই আমার যতোটা ভালো লাগে, ভাবনা বাড়িয়ে দেয় তার চেয়ে অনেক বেশি। সত্যিকার অর্থে আমি তখন জানতাম না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কীভাবে কোন সূত্রে কয়া গ্রামের সন্তান! তাঁর এই কথাটা আমার মাথার ভেতর জলের ¯্রােতের মতো ঘুরতে থাকে। আমি চেষ্টা করতে থাকি এটা আবিষ্কারের। শেষে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে যেটা পাওয়া গেলো, তা হলো,- ‘উপমহাদেশের কিংবদন্তি এই অভিনেতা পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামে, যে গ্রামটি আমারও। কয়ার চাটুর্জে বাড়ির পরিচিতি শুধু কুষ্টিয়া নয়, গোটা ভারতবর্ষেও এ পরিবারের বিশেষ একটি পরিচিতি আছে। কারণ এ বাড়ির বিখ্যাত সন্তান (ভাগ্নে) বাঘা যতীন। তাঁর কারণেই এ বাড়ির পরিচিতি গোটা ভারত জুড়েই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম এ গ্রামে না-হলেও তাঁর শেকড় এখানেই। তাঁর পূর্বপুরুষরা এ গ্রামের দাপুটে ক্ষমতাশীল ব্যক্তি ছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি, কৃষ্ণনগরে। তাঁর পিতামহের আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহ ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় কয়া গ্রামেই বাস করতেন। তিনিও একসময় তাঁর সন্তানদের নিয়ে কৃষ্ণনগর চলে যান। তাঁর ভাইয়েরা আরও আগে থেকেই কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন।
কবি বেলাল চৌধুরী যদি সেদিন অনুষ্ঠানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে ওভাবে না বলতেন, তাহলে আমার হয়তো কখনোই আবিষ্কার করা হতো না এতো বড় কিংবদন্তি অভিনেতার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আদি-শেকড়, যারা কয়া গ্রামের মানুষ ছিলেন। পরবর্তীতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছি। এর প্রেরণা কবি বেলাল চৌধুরী। আমারও কবি বেলাল চৌধুরীর উপর অধিকার বেশি করে জন্মালো-আমি তাঁর বন্ধু কবি ওমর আলীর ছাত্র, আর এক বন্ধু অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গ্রামের সন্তান এবং প্রিয়ভাজর কথাসাহিত্যিক আতা সরকারের ¯েœহভাজন। এ সবের ভেতর দিয়েই তাঁর ¯েœহভাজন হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। আর লেখালেখির ব্যাপারটি তো ছিলোই।
আমি যখন উত্তরা বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করি, তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে ‘আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে’ শিরোনামে একটা আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি, ২০১২ সালের নভেম্বরে। দুজনেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন। তাঁদের কবিতা উপন্যাস পাঠকদের মস্তিষ্কে নিত্যসময় অনুরণিত হয়। বলা যায়, সেই সময়ে দুজনেই জনপ্রিয়তার ঝড়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। এরকম জনপ্রিয়তা অর্জন খুব কম বাঙালি লেখকেরই ভাগ্যে জুটেছে। আমরা জানতাম, কবি বেলাল চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ফলে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বন্ধু হিসেবে প্রধান অতিথি হিসেবে কবি বেলাল চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানাই। যাতে করে একজন কবির কাছ থেকে দেখা একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমরা অনুভব করতে পারি- তাঁর লেখালেখি জীবনযাপন চিন্তাভাবনা রাজনৈতিক দর্শন। যখন কবি বেলাল চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানাই তখন তাঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। কিন্তু সুনীল-হূমায়ুন- স্মরণসভার কথা শুনে না করতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে বিশেষ অতিথি ছিলেন কথাসাহিত্যিক আতা সরকার। কবি বেলাল চৌধুরী প্রায় সারাটা দিন সেদিন বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীর সঙ্গে ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর যে বন্ধুত্ব-লেখালেখি-জীবনযাপন-অজ¯্র স্মৃতি, তা দীর্ঘ সময় ধরে বললেন। তার বক্তব্য আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। পিনপতন শব্দ ছিল না। তাঁর বক্তব্যের ভেতর দিয়ে আমরা যেন মানস-চোখে কলকাতার শিল্প-সাহিত্যচর্চা-সেখানকার পরিবেশ-তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের তুমুল আলোচনা-সমালোচনা-বাক-বিত-া- কবিতা নিয়ে মস্ত একটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা-সবকিছু অনুভব করছিলাম।
অনুষ্ঠানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা আবৃত্তি-পর্ব ছিল। তিনি মুগ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীদেও কবিতা আবৃত্তি শুনলেন। অনুষ্ঠানের পরেও তিনি আমাদের সঙ্গে থাকলেন, গল্প করলেন তাঁর কলকাতা জীবন নিয়ে। অদ্ভুত মোহনীয় ক্ষমতা-তিনি ধীরে বলছেন, কথাগুলো যেন যাদুর মতো আমাদের স্পর্শ করছে, চুম্বকের মতো করে ধরে রাখছে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা। তিনি একেবারেই অতি সাধারণ মানুষের মতো থাকতেন, সহজ-সরল জীবন ছিল, নিরাহংকার নির্লোভ অসামান্য এক ব্যক্তিত্ব। অথচ তিনি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত একজন কবি। কথাবার্তায় চালচলনে জীবনযাপনে যা কখনো বিন্দুমাত্র অনুভূত হতো না।
আমার খুব সৌভাগ্য হয়েছিল কবি বেলাল চৌধুরীকে আমার তিনটি গ্রন্থের প্রকাশনা ও আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে পাই। আমার গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন’ গ্রন্থের আলোচনা আনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল কথাসাহিত্যিক আতা সরকারের ঘাসফুল। এই অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে ভিআইপি কনফারেন্স রুমে। ৯ জুলাই ২০১৩ সালে। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আলোচনা করেছিলেন অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমেদ, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, এএসএম কামালউদ্দিন, কথাসাহিত্যিক আতা সরকার কবি বিলু কবীর, ড. গাজী রহমান, ড. আমিনুর রহমান সুলতান, ড. শহীদ ইকবাল প্রমুখ। তিনি কথা বলতে বলতে একসময় বললেন, ‘রকিব ভালো কবিতা লেখে জানতাম। কিন্তু ও যে একজন ভালো গবেষক তা জানলাম মাত্র কয়েকদিন আগে, যখন আতা সরকার ওর এই গবেষণা গ্রন্থটি আমাকে দিলো।’ এর আগে উল্লেখ করেছি তিনি আমার ‘কয়ায় রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন এবং প্রাজ্ঞজন’ প্রবন্ধ গ্রন্থ ও ‘দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন।
একপর্যায়ে কবি বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিবারের সকলের চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়। আমার কন্যা কাব্যকে কাছে পেলেই আদর করে কাছে নিতেন। সেসব স্মৃতি এখন ছবিবন্দি। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর সান্নিধ্য যতটুকু পেয়েছি, যতদিন তাঁকে দেখেছি, সবসময়ই তাঁকে অতিসাধারণ মনে হয়েছে। কখনো কখনো আত্মভোলাও মনে হয়েছে। সত্যিকারের বড় মানুষেওে হয়তো এরকমই হোন-নিজেকে কখনোই ভাবেন না, নিজের কর্মযজ্ঞে সৃষ্টির নেশায় আপনমনে ডুবে থাকাই হয়তো তাদের জীবনের সাধনা। যে সাধনার ফলে সৃষ্টি হয় শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান বিভিন্ন ক্ষেত্রে অজস্র আলো। কবি বেলাল চৌধুরীও ছিলেন বাংলা সাহিত্যে কবিতার আকাশে আলো ছড়িয়ে দেওয়া এক নক্ষত্র আলো।