alt

সাময়িকী

রূপান্তরিত

আলী সিদ্দিকী

: বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

তার শতাব্দী প্রাচীন দৃষ্টিটা খর খর করে উঠলো। প্রচ- ঘৃণায় নাক কুঁচকে কপালে ভাঁজ ফেললো রমিজ মিয়া। সে ভাবতে পারে না মানুষ কী করে কুকুর বিড়ালের মতো পথেঘাটে এমন আচরণ করতে পারে! মনে হলো ছেলে তাকে হাবিয়া দোযখে এনে ফেলেছে। এমন জানলে সে কখনো এদেশে আসতে রাজি হতো না। বিছানায় বসে জানালায় মুখ রেখে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে সে ভাবছে এসব কথা। বড়ো রাস্তার উপর চারতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় বসে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় অনায়াসে। অবাক চোখে দেখে মানুষ আর যানবাহন সমানতালে ছুটছে প্রাণপণ। পায়ে চলা মানুষগুলোও যেন উড়ে উড়ে চলছে। ছুটছে বাসে, না হয় কারে নয়তো ট্রেনে ছুটছে বিরামহীন। পাশাপাশি সে দেখতে পায় ছেলেমেয়েরা জোড়ায় জোড়ায় কোমর জড়াজড়ি করে হাঁটছে আর মুখে মুখ লাগিয়ে... নাউজুবিল্লাহ! তার পা থেকে মাথার তালু পর্যন্ত রি রি করে ওঠে ঘৃণায়। তীব্র পাপবোধে আক্রান্ত হয়ে সে ভীষণ মনোকষ্টে ভুগতে থাকে। দু’চোখ দিয়ে এমন নাজায়েজ দৃশ্য দেখার কারণে সে তার চোখ দুটোকে দেখার পাপ থেকে কেয়ামতের দিন মাফ করে দেয়ার জন্য খোদাতালার কাছে ফরিয়াদ করে। এমন বেলেল্লাপনার দেশে খোদা কেন তার রিজিক রাখলো সে বুঝতে পারে না। সে জীবনে সজ্ঞানে কোনো অন্যায় করেনি। বহু কষ্টে ছেলেমেয়ে তিনটাকে মানুষ করেছে গ্রামে পড়ে থেকে। ছোট ছেলে আমজাদ লটারি পেয়ে বারো বছর আগে বৌ-বাচ্চা নিয়ে গ্রাম ছেড়ে বিদেশ করছে। সে কখনো ছেলের রোজগারের টাকায় সংসার চালায়নি। নদী ভাঙনের আগ পর্যন্ত নিজের জমি চাষ করে তার ভালোই আয় হতো। বড়ো ছেলে জেলা শহরে স্থিতি হলো আর খোদা তাকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে এলো এই দোযখে। যে লোক জন্মের পর থেকে দুয়েকবারের বেশি জেলা শহরেরও মুখ দেখেনি তাকে কিনা ছুঁড়ে ফেলা হলো এতো বড়ো শহরে, হায় আল্লা! কি অপরাধে এমন শাস্তি দিলা আমারে? রাতদিন কাঁদে আর আল্লার কাছে ফরিয়াদ করে রমিজ মিয়া। তার অন্তরাত্মা হাহাকার করে ফেলে আসা দেশের জন্য, মানুষজনদের জন্য। সারাক্ষণ তার চোখে ভাসে গ্রামের কাদামাখা পথ, হালের গোরু, ধান মাড়াই, নদীর ভাঙনের শব্দ, ঘনজঙ্গলময় আম সুপারীর বাগানের নির্জন দূপুর, বাজারে বয়াতিদের গানের আসর আর বাপদাদার ভিটেয় তার সুখী সময়গুলো।

গত ক’দিন ঘরের ভেতর নাতি-নাতনিকে নিয়ে একপ্রকার সুখের সময় কেটেছে তার। নাতনি সায়মাকে (সবাই ডাকে জেনি) দেখেছে এক বছর বয়েসে। গত বারো বছরে সে অনেক বড়ো হয়ে গেছে। নাতি রণিকে তো সে দেখেইনি। প্রথম প্রথম দু’জন তো কাছেই আসেনি। আস্তে আস্তে তারা দাদুর কাছে সহজ হয়ে উঠলো। কিন্তু জেনি যেন কেমন। ওর হাবভাব বোঝা যায় না। মাত্র বারো ক্লাসে পড়ছে সে কিন্তু কথাবার্তায় কোনো আদব-কায়দা নেই। জামা-কাপড়গুলো বড্ড চোখে লাগে। আজ সকালে সে যখন স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হলো তখন তাকে দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে রমিজ মিয়া, আল্লা মাফ করো, মাবুদ! বাড়ন্ত মেয়েটার জামাকাপড়ের দিকে না আমজাদ না দিলারার নজর আছে! দিলারা নিজেও শার্ট প্যান্ট পরে কাজে যাচ্ছে। গ্রামের নুর হোসেনের ফাইভ পড়া মেয়েটার জামাকাপড়, চলাফেরা দেখে সে অবাক মানে। এখানে কি এমন জাদু আছে যে এদের এতো পাল্টে দিলো?

চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠার সাথে সাথে মাথায় বুঝি রক্তও চেপে যায় রমিজ মিয়ার। বেরুবার সময় জেনিকে থামিয়ে বলে, তোমার এই জামা বদলাইয়া ফ্যালো।

হোয়াট ডু য়্যু মিন? ব্লু জিনসের উপর পরা শর্ট স্লিভের দিকে ইঙ্গিত করছে বুঝতে পেরে জেনি একপ্রকার চিৎকার করে ওঠে।

দিলারা তৈরি হচ্ছিল। মেয়ের গলা শুনে ছুটে এলো লিভিং রুমে। মেয়ের প্রচ- রাগী মুখটা থেকে চোখ সরিয়ে সে রমিজ মিয়ার দিকে তাকায়। রমিজ মিয়ার চোখ দুটো গ্রামের হালটে রাতের বেলায় নিশাচরের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে। ‘ওরে এই জামা বদলাইতে কও বৌ’ অন্যদিকে তাকিয়ে বলে রমিজ মিয়া। ব্যাপারটা চালাক দিলারা পলকেই বুঝে নিলো। আড়চোখে নিজের জামার দিকে চেয়ে অলক্ষ্যে হেসে নিলো আলতো করে। ভাবলো, এ হলো পুরুষ চোখ। একটা অস্বস্তিময় লেহন যেন তাদের চোখে চুক চুক করে। এটি যেমন জন্মগত তেমনি শিক্ষাগত। এটা নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই বরং তিক্ততা বাড়বে। সে মেয়েকে গাড়িতে গিয়ে বসতে বলে।

ননসেন্স! দুদ্দাড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় জেনি।

রমিজ মিয়া অবাক চোখে তাকালো দিলারার দিকে। সে ভাবতে পারছে না দিলারা কী করে তার কথাটা উপেক্ষা করতে পারলো! প্রচ- রাগ হতে লাগলো তার। সে দপ করে সোফায় বসে পড়ে। বৌয়ের কাছে এমন অপমান হতে হবে সে ভাবতেও পারেনি। কালকের মেয়ে দিলু, যার সারাক্ষণ নাক ঝরতো, যার বাপ দু’বেলা ঠিক মতো খাওন-পরন দিতে পারতো না, আজ সে তাকে নাতনির সামনে এমন অপমান করতে পারলো? দাঁতে দাঁত চেপে সে বুকের ভেতরের অসহ্য জ্বালাকে দমন করার চেষ্টা করলো। দিলারা শুশ্বরকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে, যে দেশের যে বেশ আপনাকে সে বেশেই চলতে হবে। খাপ খাইয়ে চলতে হবে। সে নিজের পোশাকের দিকে ইঙ্গিত করে জানায়, আমাকে কাজে এই পোশাক পরেই যেতে হবে। তেমনি জেনিকেও ক্লাসের অন্যান্য ছাত্রীদের মতোই পোশাক পরতে হবে। পোশাকে কি নোংরামি থাকে বাবা, নোংরামি তো মনে।

রমিজ মিয়ার ইচ্ছে হচ্ছে কানে হাত চাপা দিতে নয়তো দিলারার টুঁটি চেপে ধরতে। একটা অক্ষম জ্বালা আটকে থাকে তার গলায়। দিলারার কথাগুলো বিষের মতো লাগছে তার। ভাবছে, তার ছোট ছেলেটা পরিবারসুদ্ধ এদেশে হারিয়ে যাবে। কী মস্ত ভুলই না করেছে আমজাদ! একদিন তাকে এর মাসুল দিতেই হবে। দিলারা যখন সাথে যেতে বললো তখন রমিজ মিয়ার ভেতরে রাগ দুঃখ ক্ষোভ আর কান্না উৎরাচ্ছে কলবল কলবল। তার মুখ দেখে দিলারা জানালো জেনিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে সে তাকে আমজাদের দোকানে নামিয়ে দিয়ে কাজে যাবে শুনে রমিজ মিয়া তড়াক করে লাফ দিয়ে তৈরি হয়ে নেয়। এটা ভালো হলো। মনে মনে ভাবলো আমজাদকে বলবে তাকে দেশে পাঠিয়ে দিতে। এই পাপীষ্ঠদের দেশে সে আর এক মুহূর্তও থাকতে চায় না। কিন্তু তার পোশাক দেখে দিলারা এমনভাবে হাসা শুরু করলো যে, রমিজ মিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজের পোশাক পরখ করে কিছুই বুঝতে পারে না। সবুজ পাঞ্জাবীর সাথে ডোরাকাটা লুঙ্গি, বাটার সেন্ডেল আর মাথায় গোলটুপিতে সমস্যাটা কোথায় সে বুঝতে পারে না। এ জামা-ই তো সে এতো বছর ধরে পরে আসছে কিন্তু কেউ তো কখনো কিছু বলেনি! তাহলে কি তাকে আবারো অপমান করছে? রাগে তার মাথার তালুতে যেন আগুন ধরে গেলো।

দিলারা হাসতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। বাংলাদেশের মানুষগুলোর ইগো খুব মারাত্মক। তারা যেটা বোঝে পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ তাদের ডিঙ্গাতে পারবে না। হামবড়া একটা ভাব নিয়ে সবাইকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারলেই তাদের যতো আনন্দ! গত বারো বছরে তো কম দেখলো না! কিছুতেই হার মানবে না, প্রয়োজনে অন্যায়ভাবে হলেও জিতবে। শুশ্বর জামাই বাপ সবই একই জাতের, ধাঁচের। মনে মনে ভাবলো, শুশ্বরকে সামলাতে তাকে অনেক কষ্ট পেতে হবে। সে ভিতরে গিয়ে দেশ থেকে আনা নতুন পাজামা-পাঞ্জাবী এনে রমিজ মিয়ার হাতে দিলো। আমজাদের কথা মতো রমিজ মিয়াই এগুলো এনেছে কিন্তু অনভ্যাসের কারণে পরতে খুবই লজ্জা পাচ্ছিল সে। এমন ধবধবে আর মখমলি জামা-কাপড় তো এলাকার মাতবর-চৌধুরী আর মৌলভীরাই পরে। গঞ্জের হাট থেকে কেনার সময়ও সে খুব লজ্জা পাচ্ছিল, কেউ দেখে ফেললো না তো! দিলারা যখন হাতে গুঁজে দিলো তখন একেবারে কুঁকড়ে যায় রমিজ মিয়া। কিন্তু দিলারা যেভাবে বলেছে না শুনলে শুধুই অশান্তি বাড়বে। নিভাঁজ পাজামা-পাঞ্জাবী পরে রমিজ মিয়া গাড়ির কাছে এলে মা-মেয়ে নীরবে চোখাচোখি করে নেয়। আলতো হেসে দিলারা দরোজা খুলে দিলে পেছনের সিটে জেনি থেকে দূরত্ব রেখে বসে কাঠমুখো রমিজ মিয়া। ভেতরে ভেতরে ভাপা পিঠার ডেকচির পানির মতো অভিমান উতরাচ্ছে। বংশে শুধু আমজাদের ঘরে মেয়ে আছে। আর তো সবার ছেলে। নিজেরও কোনো বোন ছিলো না। আজীবন বোনের কাঙাল ছিলো সে। কাউকে বুজি ডাকার সুযোগ পায় নি। তাই যখন সায়মা (কি যে জেনি ছেনি ডাকে!) জন্ম নিলো, রমিজ মিয়া আল্লার কাছে শোকরানা আদায় করেছে। নাতনির জন্যে তার বুকে কতো মায়া আকুলি বিকুলি করছে অথচ নাতনি একটুও তোয়াক্কা করে না তাকে। কেমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ করে। পর পর ভাব দেখায়। তবে রমিজ মিয়া অবাক হয়ে দেখছে দিলারার পরিবর্তন। অজপাড়াগাঁ’র মেয়ে কি নিপুণ হাতে হাজারো গাড়ির ভিড় ঠেলে কোনো ঠোকাঠুকি ছাড়াই গাড়ি চালাচ্ছে। সে গ্রামের অনেকের মুখে শুনেছে আমেরিকায় গেলে মানুষ বদলে যায় রাতারাতি। যারা তাকে এসব বলেছে তারাও অন্যদের থেকে শুনে বলেছে কিন্তু আজ সে স্বচক্ষে দেখছে গ্রামের সাধারণ মেয়েটি কি অবলীলায় নিউইর্য়কের গিঞ্জি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে নিঃসংকোচে। গর্বে বুক ভরে যায় রমিজ মিয়ার কিন্তু অভিমানে তার কান্না এসে যায়। আব্বা, দেখেন তো এদের চিনতে পারেন কি না?

জেনি “বাই মম্” বলে গাড়ি থেকে নেমে স্কুল গেটের জটলায় মিশে যেতেই দিলারা বলে। রমিজ মিয়া দেখলে সব মেয়েরাই জেনির মতো জিন্স আর হাতকাটা গেঞ্জি পরেছে। কেউ কেউ তো হাটুর উপরেই পরেছে হাফপ্যান্ট । হরেক রঙের চেহারা হলেও পোশাকে অনেক মিল আছে। পোশাকের গুণে মানুষের চেহারা এমন পাল্টে যেতে পারে ভাবাই যায় না। দিলারা বোঝায় জেনি তো এখানেই বড় হচ্ছে, এখানকার আলোবাতাসই তো ওর প্রিয় হবে, ঠিক তেমনি এখানকার খাবার দাবার, পোশাক-আশাক। এও বোঝালো যে, যদি ছেলেমেয়েরা এখানে সামাজিক না হয় তাহলে তো ওরা একা হয়ে যাবে, হীনম্মন্যতায় ভুগবে। দিলারার কথাবার্তায় অবাক হয় রমিজ মিয়া। গঞ্জের হাটে দেখা টিনের বাক্সে প্রথম বায়োস্কোপ দেখে যেমন ক্যাবলা হয়ে গিয়েছিলো এ মুহূর্তেও নিজেকে তেমন মনে হচ্ছে তার। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো, পাঁচ ক্লাস পড়া দিলারা তাকে সবক দিচ্ছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, তার বুঝতে ভুল হচ্ছে, পুরনো চোখে নতুন বিষয়-আশয় দেখতে সহজ বোধ করছে না। সত্যি, দিলারার কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলেও অস্বীকার করতে পারছে না। তবে এটা সে ঠিকই বুঝতে পারছে যে, মানুষ জীবন জীবিকার জন্যেই নিজেদের বদলে ফেলে। যে দেশের যে ভাও সে ভাবে চলে।

আমজাদের দোকান দেখে তো রমিজ মিয়ার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। রাস্তা লাগোয়া দোকানটা বেশ বড়োসড়ো। আমজাদ বলেছিলো, আমেরিকান ফুডের দোকান। বার্গার, স্যান্ডউইচ, হোগি, উইংস প্রভৃতি নাকি বেচে সে। এখন তো সকাল বেলা। এখন এতো ভিড়! সাদা-কালো হরেক রঙের খদ্দের ঠাসা দোকান। আমজাদের দম ফেলার অবকাশ নেই। সে দিলারাকে বললো ভেতরের রুমটা দেখিয়ে দিতে। ছোট্ট কাঁচের জানালা লাগানো ঘরটায় এসে বসে রমিজ মিয়া। এখান থেকে পুরো দোকানটা দেখা যায় সহজে। আমজাদ খদ্দের সামলাতে গলদঘর্ম। এ তার ছেলে! স্কুলে বার বার ফেল করা আমজাদকে দিয়ে জীবনে কিচ্ছুই হবে না ভাবতো সে। কিন্তু আমজাদের মা’র খুব টান ছিলো ছেলের জন্য, বলতো, আমার ছেলে একদিন অনেক বড়ো হবে। এই তো বছর দুই আগে, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বলেছিলো, আমার কথা ঠিক হলো তো? সে বছর আমজাদ বাড়িতে একতলা ঘরটা করে দিয়েছে। কিন্তু এটাতো সত্য যে, গ্রামের চৌধুরী আর তালুকদাররা তাকে কখনোই দু’পয়সার মূল্য দেয় নি। আজ আমজাদ অনেক আশা জাগালো তার মনে। জীবনে আর কয়দিন! মৃত্যুর আগে হলেও সমাজের মধ্যমণি হতে তার মনে চায় এখন। চাষাভুষা হিসেবে যারা তাকে সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, অবজ্ঞা অবহেলা করেছে তাদের কাছে নিজেকে সম্মানিত হিসেবে তুলে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে। জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে বুকের ভেতর একটি দগদগে জীবন্ত ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে রমিজ মিয়া। আজকের জমির চৌধুরীর বাবা সুলুক চৌধুরী ছিলো একেবারে পিশাচ জাতীয়। এলাকায় সে মদের ভাটিখানা বসিয়েছিলো। মাস্তান আর পুলিশ দেখিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। ছেলে আরমান তখন ফাইভ পাশ দিয়ে হাইস্কুলে গেছে জমিরের সাথে। ফুটবল খেলতে গিয়ে আরমানের বলে আঘাত পেয়েছিলো জমির আর সুলুক চৌধুরীর চাপে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয় আরমানকে। অন্যায় হলেও রমিজ মিয়া সুলুক চৌধুরীর হাতে পায়ে ধরেছিলো। উপরন্তু, তাকে সুলুক চৌধুরী হুমকি দিয়ে বলেছে, বাড়াবাড়ি করলে গ্রাম ছাড়া করবে রমিজ মিয়াকে। রমিজ মিয়া নীরবে অপমান সয়ে গেছে এবং আরমানকে থানা সদরে ওর খালা নিলুফারের বাড়িতে রেখে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। ছোটবেলাতেই ছেলেটা তার কোলছাড়া হয়েছে চৌধুরীদের কারণে। সে কথা মনে হলে আজো তার ভেতরে জাহান্নামি আগুন খলবল করে ওঠে। ভেতরের চাপটুকু হাতে চলে এলে পটাস্ শব্দে জুসের বোতলটা ভেঙে হাত কেটে গেলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। একি করলে বাবা! আমজাদ দ্রুত ব্যান্ডেজ নিয়ে আসে। বাবা, একডা কাম করবার পারবি? রমিজ মিয়া ছেলের মুখের দিকে তাকায়।

কী কাজ?

আমাগো নামের মিয়া কাইডা চোদরি করবার পারবি?

কেন? অবাক হয় আমজাদ। সে শুনেছে জমির চৌধুরীর বাবা সুলুক চৌধুরী বাবাকে অনেক অপমান করেছিলো। সেতো অনেক বছর আগে। সে ভাবলো, মানুষ আসলে ক্ষতের জ্বালা কখনো ভোলে না। সে বুঝলো এটা বাবার ছোট্ট প্রতিশোধ। মুচকি হেসে জানালো কালকেই সব ব্যবস্থা করা হবে। একজন আইনজীবী দিয়ে নাম পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা হলো এবং সদ্যাগত বলে রমিজ মিয়াকে তেমন বেগ পেতে হলো না। অবশ্য আমজাদকে একটু বেশি ডলার খরচ করতে হলো। এতে সে অখুশি নয় বরং বাবার জ্বলজ্বলে চেহারা দেখে তৃপ্তি পেলো।

বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় নতুন গ্রোসারি দোকান খুললো আমজাদ। হরেক রকম দেশি মালপত্র মাছ মাংস, তরিতরকারি, ডাল তেল নুন মরিচ মশল্লা, থালা বাসন থেকে শুরু করে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু রাখা হলো। দশটা ফ্রিজ আর অনেকগুলো কুলার ও মাছ-মাংস কাটার আলাদা রুম করে জমজমাট ব্যবসা নিয়ে বসলেন রমিজ চৌধুরী। অল্প দিনেরই ট্রেনিং পেয়ে পাকা ব্যবসায়ি হয়ে উঠলো সে। দোকানে প্রায় সারাদেশের মানুষ আসে। তাদের সান্নিধ্যে দেশের স্বাদ যেমন পায় তেমনি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। দোকানে দু’জন কর্মচারি আছে সার্বক্ষণিক, রমিজ চৌধুরী ক্যাশ দেখভাল করে। মাঝেমধ্যে বিদেশি খদ্দের এসে পড়লে প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও এখন সে একটু আধটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি বলতে পারে। এই বলতে পারার মধ্যে দিয়ে সে জ্ঞান লাভ করে যে, মানুষ নিজের প্রয়োজনেই ভাষা রপ্ত করে নেয়। সে জীবনে অ আ ক খ পড়েনি, স্কুলের দরোজায় পা রাখা হয়নি তার। বুদ্ধি হবার পর থেকেই জমি জিরেতের কাজই করে আসছে। কিন্তু দোকানে রাখা পত্রপত্রিকা পড়ে মানুষজন যখন দেশের রাজনীতিটিতি নিয়ে কথা বলে তখন সেও আস্তে আস্তে কথা বুঝতে ও বলতে শিখে যায়। অতিসত্বর রমিজ চৌধুরীর চেহারায়, পোশাক-আশাকে ব্যাপক পরিবর্তন চলে আসে। জঙ্গলাকীর্ণ দাঁড়িগোঁফ ছেঁটে অনেক ভদ্রস্থ করে নেয় এবং নিয়মিত প্যান্টশার্টে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তবে টুপী মাথায় রাখে আর নামাজ আদায়ের চেষ্টা করে সময় মতো। নাতি-নাতনিদের পোশাক-আশাকে, চলাফেরায় সে এখন আগের মতো আর অস্বস্তি বোধ করে না। রাস্তায়, সাবওয়েতে কিংবা ট্রেনের ভেতর চুম্বনরত নারী পুরুষদের দেখে জ্বালা করে ওঠে না তার। চোখ সওয়া জিনিসগুলো ক্রমশ তার মন সওয়া হয়ে গেলো। অনেক পরিবর্তন আসলো খাওয়া দাওয়াতেও। দেশি ফুডের পাশাপাশি রমিজ চৌধুরী এখন আমেরিকান বার্গার, স্যান্ডউইচ ভালোবাসে।

আজ নাতি রনির অষ্টম জন্মদিন। আমজাদ আর দিলারা তাদের নতুন কেনা বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে বেশ বড়োসড়ো আয়োজন করেছে। রমিজ চৌধুরী আগেভাগে দোকান বন্ধ করে নাতির জন্য একটা সুন্দর হাত ঘড়ি নিয়ে ফিরলো। আলো ঝলমলে অনুষ্ঠানে সিল্কের নতুন পাজামা পাঞ্জাবী পরে সে যখন নেমে এলো জেনি ছুটে এসে বলে, দাদু তোমাকে ফ্যান্টাস্টিক লাগছে।

কি স্টিক? কৌতুক করে চৌধুরী।

স্টিক না, স্টিক না, ফ্যান্টাস্টিক, কল কল করে হেসে ওঠে জেনির সঙ্গীরা।

নাতনি যেন পরী। বাড়িটা যেন ভাসছে আনন্দের ফোয়ারায়। মানুষের ভিড়ে সুখি সুখি মুখে রমিজ চৌধুরী ঘুরে বেড়াতে লাগলো হাতে কখনো কোক, আবার কখনো জুসের বোতল। সবাইকে কুশলাদি জিগ্যেস করতে লাগলো সোৎসাহে। দিলারা আজ ঝকমকে লেহাঙ্গা পরেছে, যেন রাজকুমারি। রনি কেক কাটলো দাদুকে পাশে রেখে। সবাই ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু য়্যু, হ্যাপি বার্থ ডে টু রনি’ বলে গান গাইলো সুর করে। সেও বেসুরো, ভাঙা গলা মেলালো। সবাই যে যার মতো প্লেটে খাওয়া তুলে নিচ্ছে। কখনো হিন্দি কখনো ইংরেজি গান বাজছে তুমুল শব্দে। হইচই করে সবাই খাচ্ছে, কথার তুবড়ি, হাসি মশকরায় মেতে আছে সকলে। নজরুলের ছেলে আসিফ ভিডিও করছে ঘুরে ঘুরে। কাছে এসে বলে “দাদু, এদিকে তাকান, বলেন চি-ই-জ।” রমিজ চৌধুরী দাঁত বের করে হেসে ঘাড় কাত করে। একটু দূরে দিলারা আর আমজাদ বার বার তাকাচ্ছে তার দিকে। সে ওদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে হাসলো।

এ্যাই, একটা জিনিস খেয়াল করেছো? দিলারা আমজাদের কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে বলে।

কি? আমজাদ ঘাড় কাত করে।

আব্বার পরিবর্তন।

এটাই স্বাভাবিক, আমজাদ বিয়ারে চুমুক দেয়, মানুষ যেমন পরিবেশ বদলায় তেমনি পরিবেশও মানুষকে বদলায়।

দিলারা এ সময় দেশে একটা কল করতে চাপ দেয়। আরমান ভাইয়ের বাসায়। আমজাদ বুঝতে পারে না এ সময় কল দেয়ার কী আছে? দিলারা স্মরণ করিয়ে দিলো আজ কোটি টাকার জমি রেজিস্ট্রি হচ্ছে। চৌধুরীরা সবাই আসবে। এই চূড়ান্ত মুহূর্তে আব্বা চৌধুরীদের সাথে কথা না বললে আর কখন বলবে? দিলারার বুদ্ধিমত্তায় চমৎকৃত হয় আমজাদ। ফোন পেয়ে খুশি হয় বড়ভাই আরমান। জানায় সব ঠিকঠাক আছে। দলিল লেখা হয়েছে, উকিল সাহেব এক্ষুণি এসে পড়বে। আমজাদ জানায় রনির জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে অনেক মেহমান বাড়িতে। আমজাদ জমির চৌধুরীকে ফোন দিতে বলে। দিলারার চোখেমুখে তৃপ্তি উপচে পড়ছে যেন। সে তার শ্বশুরকে ডাক দেয়। রমিজ চৌধুরী এগিয়ে আসে, কার সাথে কথা বলছিস এখন?

কথা বলো, আমজাদ সেলফোন এগিয়ে দেয়।

হ্যালো, রমিজ চৌধুরী বলছি, সোরগোল বাঁচিয়ে একটু উচ্চৈঃস্বরে বলে রসিজ চৌধুরী, হ্যালো কে? জমির চৌধুরী? হ্যাঁ হ্যাঁ ভালো আছি। শোন, জমি বেচলে তুমি আমার কাছে বেচবে, বুঝেছো? আমার চেয়ে বেশি দাম কেউ দিতে পারবে না। না না ঠকাবো না। ঠিক আছে ঠিক আছে...।

দিলারা আর আমজাদ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো নতুন ভঙ্গিতে আলাপরত রমিজ চৌধুরীর দিকে। ভাবে কতোভাবেই না মানুষের রূপান্তর ঘটে সাক্ষি না হলে তা বোঝা যায় না।

ছবি

আমার রমণীর ফল

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আমেরিকার কবিতাকাশে এক স্বতন্ত্র নক্ষত্র

ছবি

কবি বেলাল চৌধুরী কাছ থেকে দেখা

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কামুর ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এ প্রকৃতি ও সূর্য

ছবি

দোজখের ঘাম

ছবি

‘ব্যাস’ সম্পর্কে কিছু অনিবার্য কথা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

সমর সেন : কেন প্রাসঙ্গিক

ছবি

কবিতার রাজপুত্র

ছবি

অস্কার ওয়াইল্ড : সৌন্দর্য ও বেদনার শিল্পিত রূপকার

ছবি

কথা কম কাজ বেশি

ছবি

সম্পাদনার পেশাদারিত্ব ও আবুল হাসনাত

ছবি

সৈয়দ আবদুস সাদিক শোক-পঙ্ক্তি

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

প্রসঙ্গ : লেখকের বুদ্ধিবৃৃত্তিক দায় ও দর্শনের খোঁজে

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অর্বাচীন নোঙর

ছবি

যে কবিতায় শামসুর রাহমানকে চিনেছি

ছবি

শামসুর রাহমানের রাজনীতির কবিতা, কবিতার রাজনীতি

ছবি

জীবনানন্দ দাশ: শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

আহমদ ছফা ও অলাতচক্র

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দ্য হোয়াইট বুক

ছবি

হান কাঙের ৫টি কবিতা

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

ছোট ছোট ঘটনাই আমার অনুপ্রেরণা-হান কাং

ছবি

হান কাংয়ের প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্য

ছবি

নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক

ছবি

শহীদ কাদরীর কবি হয়ে ওঠা

ছবি

মাথার ওপর ছাতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অমিয়ভূষণ : ধ্রুপদীয়া আর স্ববিরোধের সমন্বয়

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব

ছবি

মার্কেস ও আমার বিস্ময়

tab

সাময়িকী

রূপান্তরিত

আলী সিদ্দিকী

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪

তার শতাব্দী প্রাচীন দৃষ্টিটা খর খর করে উঠলো। প্রচ- ঘৃণায় নাক কুঁচকে কপালে ভাঁজ ফেললো রমিজ মিয়া। সে ভাবতে পারে না মানুষ কী করে কুকুর বিড়ালের মতো পথেঘাটে এমন আচরণ করতে পারে! মনে হলো ছেলে তাকে হাবিয়া দোযখে এনে ফেলেছে। এমন জানলে সে কখনো এদেশে আসতে রাজি হতো না। বিছানায় বসে জানালায় মুখ রেখে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে সে ভাবছে এসব কথা। বড়ো রাস্তার উপর চারতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় বসে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় অনায়াসে। অবাক চোখে দেখে মানুষ আর যানবাহন সমানতালে ছুটছে প্রাণপণ। পায়ে চলা মানুষগুলোও যেন উড়ে উড়ে চলছে। ছুটছে বাসে, না হয় কারে নয়তো ট্রেনে ছুটছে বিরামহীন। পাশাপাশি সে দেখতে পায় ছেলেমেয়েরা জোড়ায় জোড়ায় কোমর জড়াজড়ি করে হাঁটছে আর মুখে মুখ লাগিয়ে... নাউজুবিল্লাহ! তার পা থেকে মাথার তালু পর্যন্ত রি রি করে ওঠে ঘৃণায়। তীব্র পাপবোধে আক্রান্ত হয়ে সে ভীষণ মনোকষ্টে ভুগতে থাকে। দু’চোখ দিয়ে এমন নাজায়েজ দৃশ্য দেখার কারণে সে তার চোখ দুটোকে দেখার পাপ থেকে কেয়ামতের দিন মাফ করে দেয়ার জন্য খোদাতালার কাছে ফরিয়াদ করে। এমন বেলেল্লাপনার দেশে খোদা কেন তার রিজিক রাখলো সে বুঝতে পারে না। সে জীবনে সজ্ঞানে কোনো অন্যায় করেনি। বহু কষ্টে ছেলেমেয়ে তিনটাকে মানুষ করেছে গ্রামে পড়ে থেকে। ছোট ছেলে আমজাদ লটারি পেয়ে বারো বছর আগে বৌ-বাচ্চা নিয়ে গ্রাম ছেড়ে বিদেশ করছে। সে কখনো ছেলের রোজগারের টাকায় সংসার চালায়নি। নদী ভাঙনের আগ পর্যন্ত নিজের জমি চাষ করে তার ভালোই আয় হতো। বড়ো ছেলে জেলা শহরে স্থিতি হলো আর খোদা তাকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে এলো এই দোযখে। যে লোক জন্মের পর থেকে দুয়েকবারের বেশি জেলা শহরেরও মুখ দেখেনি তাকে কিনা ছুঁড়ে ফেলা হলো এতো বড়ো শহরে, হায় আল্লা! কি অপরাধে এমন শাস্তি দিলা আমারে? রাতদিন কাঁদে আর আল্লার কাছে ফরিয়াদ করে রমিজ মিয়া। তার অন্তরাত্মা হাহাকার করে ফেলে আসা দেশের জন্য, মানুষজনদের জন্য। সারাক্ষণ তার চোখে ভাসে গ্রামের কাদামাখা পথ, হালের গোরু, ধান মাড়াই, নদীর ভাঙনের শব্দ, ঘনজঙ্গলময় আম সুপারীর বাগানের নির্জন দূপুর, বাজারে বয়াতিদের গানের আসর আর বাপদাদার ভিটেয় তার সুখী সময়গুলো।

গত ক’দিন ঘরের ভেতর নাতি-নাতনিকে নিয়ে একপ্রকার সুখের সময় কেটেছে তার। নাতনি সায়মাকে (সবাই ডাকে জেনি) দেখেছে এক বছর বয়েসে। গত বারো বছরে সে অনেক বড়ো হয়ে গেছে। নাতি রণিকে তো সে দেখেইনি। প্রথম প্রথম দু’জন তো কাছেই আসেনি। আস্তে আস্তে তারা দাদুর কাছে সহজ হয়ে উঠলো। কিন্তু জেনি যেন কেমন। ওর হাবভাব বোঝা যায় না। মাত্র বারো ক্লাসে পড়ছে সে কিন্তু কথাবার্তায় কোনো আদব-কায়দা নেই। জামা-কাপড়গুলো বড্ড চোখে লাগে। আজ সকালে সে যখন স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হলো তখন তাকে দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে রমিজ মিয়া, আল্লা মাফ করো, মাবুদ! বাড়ন্ত মেয়েটার জামাকাপড়ের দিকে না আমজাদ না দিলারার নজর আছে! দিলারা নিজেও শার্ট প্যান্ট পরে কাজে যাচ্ছে। গ্রামের নুর হোসেনের ফাইভ পড়া মেয়েটার জামাকাপড়, চলাফেরা দেখে সে অবাক মানে। এখানে কি এমন জাদু আছে যে এদের এতো পাল্টে দিলো?

চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠার সাথে সাথে মাথায় বুঝি রক্তও চেপে যায় রমিজ মিয়ার। বেরুবার সময় জেনিকে থামিয়ে বলে, তোমার এই জামা বদলাইয়া ফ্যালো।

হোয়াট ডু য়্যু মিন? ব্লু জিনসের উপর পরা শর্ট স্লিভের দিকে ইঙ্গিত করছে বুঝতে পেরে জেনি একপ্রকার চিৎকার করে ওঠে।

দিলারা তৈরি হচ্ছিল। মেয়ের গলা শুনে ছুটে এলো লিভিং রুমে। মেয়ের প্রচ- রাগী মুখটা থেকে চোখ সরিয়ে সে রমিজ মিয়ার দিকে তাকায়। রমিজ মিয়ার চোখ দুটো গ্রামের হালটে রাতের বেলায় নিশাচরের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে। ‘ওরে এই জামা বদলাইতে কও বৌ’ অন্যদিকে তাকিয়ে বলে রমিজ মিয়া। ব্যাপারটা চালাক দিলারা পলকেই বুঝে নিলো। আড়চোখে নিজের জামার দিকে চেয়ে অলক্ষ্যে হেসে নিলো আলতো করে। ভাবলো, এ হলো পুরুষ চোখ। একটা অস্বস্তিময় লেহন যেন তাদের চোখে চুক চুক করে। এটি যেমন জন্মগত তেমনি শিক্ষাগত। এটা নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই বরং তিক্ততা বাড়বে। সে মেয়েকে গাড়িতে গিয়ে বসতে বলে।

ননসেন্স! দুদ্দাড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় জেনি।

রমিজ মিয়া অবাক চোখে তাকালো দিলারার দিকে। সে ভাবতে পারছে না দিলারা কী করে তার কথাটা উপেক্ষা করতে পারলো! প্রচ- রাগ হতে লাগলো তার। সে দপ করে সোফায় বসে পড়ে। বৌয়ের কাছে এমন অপমান হতে হবে সে ভাবতেও পারেনি। কালকের মেয়ে দিলু, যার সারাক্ষণ নাক ঝরতো, যার বাপ দু’বেলা ঠিক মতো খাওন-পরন দিতে পারতো না, আজ সে তাকে নাতনির সামনে এমন অপমান করতে পারলো? দাঁতে দাঁত চেপে সে বুকের ভেতরের অসহ্য জ্বালাকে দমন করার চেষ্টা করলো। দিলারা শুশ্বরকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে, যে দেশের যে বেশ আপনাকে সে বেশেই চলতে হবে। খাপ খাইয়ে চলতে হবে। সে নিজের পোশাকের দিকে ইঙ্গিত করে জানায়, আমাকে কাজে এই পোশাক পরেই যেতে হবে। তেমনি জেনিকেও ক্লাসের অন্যান্য ছাত্রীদের মতোই পোশাক পরতে হবে। পোশাকে কি নোংরামি থাকে বাবা, নোংরামি তো মনে।

রমিজ মিয়ার ইচ্ছে হচ্ছে কানে হাত চাপা দিতে নয়তো দিলারার টুঁটি চেপে ধরতে। একটা অক্ষম জ্বালা আটকে থাকে তার গলায়। দিলারার কথাগুলো বিষের মতো লাগছে তার। ভাবছে, তার ছোট ছেলেটা পরিবারসুদ্ধ এদেশে হারিয়ে যাবে। কী মস্ত ভুলই না করেছে আমজাদ! একদিন তাকে এর মাসুল দিতেই হবে। দিলারা যখন সাথে যেতে বললো তখন রমিজ মিয়ার ভেতরে রাগ দুঃখ ক্ষোভ আর কান্না উৎরাচ্ছে কলবল কলবল। তার মুখ দেখে দিলারা জানালো জেনিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে সে তাকে আমজাদের দোকানে নামিয়ে দিয়ে কাজে যাবে শুনে রমিজ মিয়া তড়াক করে লাফ দিয়ে তৈরি হয়ে নেয়। এটা ভালো হলো। মনে মনে ভাবলো আমজাদকে বলবে তাকে দেশে পাঠিয়ে দিতে। এই পাপীষ্ঠদের দেশে সে আর এক মুহূর্তও থাকতে চায় না। কিন্তু তার পোশাক দেখে দিলারা এমনভাবে হাসা শুরু করলো যে, রমিজ মিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজের পোশাক পরখ করে কিছুই বুঝতে পারে না। সবুজ পাঞ্জাবীর সাথে ডোরাকাটা লুঙ্গি, বাটার সেন্ডেল আর মাথায় গোলটুপিতে সমস্যাটা কোথায় সে বুঝতে পারে না। এ জামা-ই তো সে এতো বছর ধরে পরে আসছে কিন্তু কেউ তো কখনো কিছু বলেনি! তাহলে কি তাকে আবারো অপমান করছে? রাগে তার মাথার তালুতে যেন আগুন ধরে গেলো।

দিলারা হাসতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। বাংলাদেশের মানুষগুলোর ইগো খুব মারাত্মক। তারা যেটা বোঝে পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ তাদের ডিঙ্গাতে পারবে না। হামবড়া একটা ভাব নিয়ে সবাইকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারলেই তাদের যতো আনন্দ! গত বারো বছরে তো কম দেখলো না! কিছুতেই হার মানবে না, প্রয়োজনে অন্যায়ভাবে হলেও জিতবে। শুশ্বর জামাই বাপ সবই একই জাতের, ধাঁচের। মনে মনে ভাবলো, শুশ্বরকে সামলাতে তাকে অনেক কষ্ট পেতে হবে। সে ভিতরে গিয়ে দেশ থেকে আনা নতুন পাজামা-পাঞ্জাবী এনে রমিজ মিয়ার হাতে দিলো। আমজাদের কথা মতো রমিজ মিয়াই এগুলো এনেছে কিন্তু অনভ্যাসের কারণে পরতে খুবই লজ্জা পাচ্ছিল সে। এমন ধবধবে আর মখমলি জামা-কাপড় তো এলাকার মাতবর-চৌধুরী আর মৌলভীরাই পরে। গঞ্জের হাট থেকে কেনার সময়ও সে খুব লজ্জা পাচ্ছিল, কেউ দেখে ফেললো না তো! দিলারা যখন হাতে গুঁজে দিলো তখন একেবারে কুঁকড়ে যায় রমিজ মিয়া। কিন্তু দিলারা যেভাবে বলেছে না শুনলে শুধুই অশান্তি বাড়বে। নিভাঁজ পাজামা-পাঞ্জাবী পরে রমিজ মিয়া গাড়ির কাছে এলে মা-মেয়ে নীরবে চোখাচোখি করে নেয়। আলতো হেসে দিলারা দরোজা খুলে দিলে পেছনের সিটে জেনি থেকে দূরত্ব রেখে বসে কাঠমুখো রমিজ মিয়া। ভেতরে ভেতরে ভাপা পিঠার ডেকচির পানির মতো অভিমান উতরাচ্ছে। বংশে শুধু আমজাদের ঘরে মেয়ে আছে। আর তো সবার ছেলে। নিজেরও কোনো বোন ছিলো না। আজীবন বোনের কাঙাল ছিলো সে। কাউকে বুজি ডাকার সুযোগ পায় নি। তাই যখন সায়মা (কি যে জেনি ছেনি ডাকে!) জন্ম নিলো, রমিজ মিয়া আল্লার কাছে শোকরানা আদায় করেছে। নাতনির জন্যে তার বুকে কতো মায়া আকুলি বিকুলি করছে অথচ নাতনি একটুও তোয়াক্কা করে না তাকে। কেমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ করে। পর পর ভাব দেখায়। তবে রমিজ মিয়া অবাক হয়ে দেখছে দিলারার পরিবর্তন। অজপাড়াগাঁ’র মেয়ে কি নিপুণ হাতে হাজারো গাড়ির ভিড় ঠেলে কোনো ঠোকাঠুকি ছাড়াই গাড়ি চালাচ্ছে। সে গ্রামের অনেকের মুখে শুনেছে আমেরিকায় গেলে মানুষ বদলে যায় রাতারাতি। যারা তাকে এসব বলেছে তারাও অন্যদের থেকে শুনে বলেছে কিন্তু আজ সে স্বচক্ষে দেখছে গ্রামের সাধারণ মেয়েটি কি অবলীলায় নিউইর্য়কের গিঞ্জি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে নিঃসংকোচে। গর্বে বুক ভরে যায় রমিজ মিয়ার কিন্তু অভিমানে তার কান্না এসে যায়। আব্বা, দেখেন তো এদের চিনতে পারেন কি না?

জেনি “বাই মম্” বলে গাড়ি থেকে নেমে স্কুল গেটের জটলায় মিশে যেতেই দিলারা বলে। রমিজ মিয়া দেখলে সব মেয়েরাই জেনির মতো জিন্স আর হাতকাটা গেঞ্জি পরেছে। কেউ কেউ তো হাটুর উপরেই পরেছে হাফপ্যান্ট । হরেক রঙের চেহারা হলেও পোশাকে অনেক মিল আছে। পোশাকের গুণে মানুষের চেহারা এমন পাল্টে যেতে পারে ভাবাই যায় না। দিলারা বোঝায় জেনি তো এখানেই বড় হচ্ছে, এখানকার আলোবাতাসই তো ওর প্রিয় হবে, ঠিক তেমনি এখানকার খাবার দাবার, পোশাক-আশাক। এও বোঝালো যে, যদি ছেলেমেয়েরা এখানে সামাজিক না হয় তাহলে তো ওরা একা হয়ে যাবে, হীনম্মন্যতায় ভুগবে। দিলারার কথাবার্তায় অবাক হয় রমিজ মিয়া। গঞ্জের হাটে দেখা টিনের বাক্সে প্রথম বায়োস্কোপ দেখে যেমন ক্যাবলা হয়ে গিয়েছিলো এ মুহূর্তেও নিজেকে তেমন মনে হচ্ছে তার। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো, পাঁচ ক্লাস পড়া দিলারা তাকে সবক দিচ্ছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, তার বুঝতে ভুল হচ্ছে, পুরনো চোখে নতুন বিষয়-আশয় দেখতে সহজ বোধ করছে না। সত্যি, দিলারার কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলেও অস্বীকার করতে পারছে না। তবে এটা সে ঠিকই বুঝতে পারছে যে, মানুষ জীবন জীবিকার জন্যেই নিজেদের বদলে ফেলে। যে দেশের যে ভাও সে ভাবে চলে।

আমজাদের দোকান দেখে তো রমিজ মিয়ার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। রাস্তা লাগোয়া দোকানটা বেশ বড়োসড়ো। আমজাদ বলেছিলো, আমেরিকান ফুডের দোকান। বার্গার, স্যান্ডউইচ, হোগি, উইংস প্রভৃতি নাকি বেচে সে। এখন তো সকাল বেলা। এখন এতো ভিড়! সাদা-কালো হরেক রঙের খদ্দের ঠাসা দোকান। আমজাদের দম ফেলার অবকাশ নেই। সে দিলারাকে বললো ভেতরের রুমটা দেখিয়ে দিতে। ছোট্ট কাঁচের জানালা লাগানো ঘরটায় এসে বসে রমিজ মিয়া। এখান থেকে পুরো দোকানটা দেখা যায় সহজে। আমজাদ খদ্দের সামলাতে গলদঘর্ম। এ তার ছেলে! স্কুলে বার বার ফেল করা আমজাদকে দিয়ে জীবনে কিচ্ছুই হবে না ভাবতো সে। কিন্তু আমজাদের মা’র খুব টান ছিলো ছেলের জন্য, বলতো, আমার ছেলে একদিন অনেক বড়ো হবে। এই তো বছর দুই আগে, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বলেছিলো, আমার কথা ঠিক হলো তো? সে বছর আমজাদ বাড়িতে একতলা ঘরটা করে দিয়েছে। কিন্তু এটাতো সত্য যে, গ্রামের চৌধুরী আর তালুকদাররা তাকে কখনোই দু’পয়সার মূল্য দেয় নি। আজ আমজাদ অনেক আশা জাগালো তার মনে। জীবনে আর কয়দিন! মৃত্যুর আগে হলেও সমাজের মধ্যমণি হতে তার মনে চায় এখন। চাষাভুষা হিসেবে যারা তাকে সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, অবজ্ঞা অবহেলা করেছে তাদের কাছে নিজেকে সম্মানিত হিসেবে তুলে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে। জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে বুকের ভেতর একটি দগদগে জীবন্ত ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে রমিজ মিয়া। আজকের জমির চৌধুরীর বাবা সুলুক চৌধুরী ছিলো একেবারে পিশাচ জাতীয়। এলাকায় সে মদের ভাটিখানা বসিয়েছিলো। মাস্তান আর পুলিশ দেখিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। ছেলে আরমান তখন ফাইভ পাশ দিয়ে হাইস্কুলে গেছে জমিরের সাথে। ফুটবল খেলতে গিয়ে আরমানের বলে আঘাত পেয়েছিলো জমির আর সুলুক চৌধুরীর চাপে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয় আরমানকে। অন্যায় হলেও রমিজ মিয়া সুলুক চৌধুরীর হাতে পায়ে ধরেছিলো। উপরন্তু, তাকে সুলুক চৌধুরী হুমকি দিয়ে বলেছে, বাড়াবাড়ি করলে গ্রাম ছাড়া করবে রমিজ মিয়াকে। রমিজ মিয়া নীরবে অপমান সয়ে গেছে এবং আরমানকে থানা সদরে ওর খালা নিলুফারের বাড়িতে রেখে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। ছোটবেলাতেই ছেলেটা তার কোলছাড়া হয়েছে চৌধুরীদের কারণে। সে কথা মনে হলে আজো তার ভেতরে জাহান্নামি আগুন খলবল করে ওঠে। ভেতরের চাপটুকু হাতে চলে এলে পটাস্ শব্দে জুসের বোতলটা ভেঙে হাত কেটে গেলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। একি করলে বাবা! আমজাদ দ্রুত ব্যান্ডেজ নিয়ে আসে। বাবা, একডা কাম করবার পারবি? রমিজ মিয়া ছেলের মুখের দিকে তাকায়।

কী কাজ?

আমাগো নামের মিয়া কাইডা চোদরি করবার পারবি?

কেন? অবাক হয় আমজাদ। সে শুনেছে জমির চৌধুরীর বাবা সুলুক চৌধুরী বাবাকে অনেক অপমান করেছিলো। সেতো অনেক বছর আগে। সে ভাবলো, মানুষ আসলে ক্ষতের জ্বালা কখনো ভোলে না। সে বুঝলো এটা বাবার ছোট্ট প্রতিশোধ। মুচকি হেসে জানালো কালকেই সব ব্যবস্থা করা হবে। একজন আইনজীবী দিয়ে নাম পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা হলো এবং সদ্যাগত বলে রমিজ মিয়াকে তেমন বেগ পেতে হলো না। অবশ্য আমজাদকে একটু বেশি ডলার খরচ করতে হলো। এতে সে অখুশি নয় বরং বাবার জ্বলজ্বলে চেহারা দেখে তৃপ্তি পেলো।

বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় নতুন গ্রোসারি দোকান খুললো আমজাদ। হরেক রকম দেশি মালপত্র মাছ মাংস, তরিতরকারি, ডাল তেল নুন মরিচ মশল্লা, থালা বাসন থেকে শুরু করে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু রাখা হলো। দশটা ফ্রিজ আর অনেকগুলো কুলার ও মাছ-মাংস কাটার আলাদা রুম করে জমজমাট ব্যবসা নিয়ে বসলেন রমিজ চৌধুরী। অল্প দিনেরই ট্রেনিং পেয়ে পাকা ব্যবসায়ি হয়ে উঠলো সে। দোকানে প্রায় সারাদেশের মানুষ আসে। তাদের সান্নিধ্যে দেশের স্বাদ যেমন পায় তেমনি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। দোকানে দু’জন কর্মচারি আছে সার্বক্ষণিক, রমিজ চৌধুরী ক্যাশ দেখভাল করে। মাঝেমধ্যে বিদেশি খদ্দের এসে পড়লে প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও এখন সে একটু আধটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি বলতে পারে। এই বলতে পারার মধ্যে দিয়ে সে জ্ঞান লাভ করে যে, মানুষ নিজের প্রয়োজনেই ভাষা রপ্ত করে নেয়। সে জীবনে অ আ ক খ পড়েনি, স্কুলের দরোজায় পা রাখা হয়নি তার। বুদ্ধি হবার পর থেকেই জমি জিরেতের কাজই করে আসছে। কিন্তু দোকানে রাখা পত্রপত্রিকা পড়ে মানুষজন যখন দেশের রাজনীতিটিতি নিয়ে কথা বলে তখন সেও আস্তে আস্তে কথা বুঝতে ও বলতে শিখে যায়। অতিসত্বর রমিজ চৌধুরীর চেহারায়, পোশাক-আশাকে ব্যাপক পরিবর্তন চলে আসে। জঙ্গলাকীর্ণ দাঁড়িগোঁফ ছেঁটে অনেক ভদ্রস্থ করে নেয় এবং নিয়মিত প্যান্টশার্টে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তবে টুপী মাথায় রাখে আর নামাজ আদায়ের চেষ্টা করে সময় মতো। নাতি-নাতনিদের পোশাক-আশাকে, চলাফেরায় সে এখন আগের মতো আর অস্বস্তি বোধ করে না। রাস্তায়, সাবওয়েতে কিংবা ট্রেনের ভেতর চুম্বনরত নারী পুরুষদের দেখে জ্বালা করে ওঠে না তার। চোখ সওয়া জিনিসগুলো ক্রমশ তার মন সওয়া হয়ে গেলো। অনেক পরিবর্তন আসলো খাওয়া দাওয়াতেও। দেশি ফুডের পাশাপাশি রমিজ চৌধুরী এখন আমেরিকান বার্গার, স্যান্ডউইচ ভালোবাসে।

আজ নাতি রনির অষ্টম জন্মদিন। আমজাদ আর দিলারা তাদের নতুন কেনা বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে বেশ বড়োসড়ো আয়োজন করেছে। রমিজ চৌধুরী আগেভাগে দোকান বন্ধ করে নাতির জন্য একটা সুন্দর হাত ঘড়ি নিয়ে ফিরলো। আলো ঝলমলে অনুষ্ঠানে সিল্কের নতুন পাজামা পাঞ্জাবী পরে সে যখন নেমে এলো জেনি ছুটে এসে বলে, দাদু তোমাকে ফ্যান্টাস্টিক লাগছে।

কি স্টিক? কৌতুক করে চৌধুরী।

স্টিক না, স্টিক না, ফ্যান্টাস্টিক, কল কল করে হেসে ওঠে জেনির সঙ্গীরা।

নাতনি যেন পরী। বাড়িটা যেন ভাসছে আনন্দের ফোয়ারায়। মানুষের ভিড়ে সুখি সুখি মুখে রমিজ চৌধুরী ঘুরে বেড়াতে লাগলো হাতে কখনো কোক, আবার কখনো জুসের বোতল। সবাইকে কুশলাদি জিগ্যেস করতে লাগলো সোৎসাহে। দিলারা আজ ঝকমকে লেহাঙ্গা পরেছে, যেন রাজকুমারি। রনি কেক কাটলো দাদুকে পাশে রেখে। সবাই ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু য়্যু, হ্যাপি বার্থ ডে টু রনি’ বলে গান গাইলো সুর করে। সেও বেসুরো, ভাঙা গলা মেলালো। সবাই যে যার মতো প্লেটে খাওয়া তুলে নিচ্ছে। কখনো হিন্দি কখনো ইংরেজি গান বাজছে তুমুল শব্দে। হইচই করে সবাই খাচ্ছে, কথার তুবড়ি, হাসি মশকরায় মেতে আছে সকলে। নজরুলের ছেলে আসিফ ভিডিও করছে ঘুরে ঘুরে। কাছে এসে বলে “দাদু, এদিকে তাকান, বলেন চি-ই-জ।” রমিজ চৌধুরী দাঁত বের করে হেসে ঘাড় কাত করে। একটু দূরে দিলারা আর আমজাদ বার বার তাকাচ্ছে তার দিকে। সে ওদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে হাসলো।

এ্যাই, একটা জিনিস খেয়াল করেছো? দিলারা আমজাদের কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে বলে।

কি? আমজাদ ঘাড় কাত করে।

আব্বার পরিবর্তন।

এটাই স্বাভাবিক, আমজাদ বিয়ারে চুমুক দেয়, মানুষ যেমন পরিবেশ বদলায় তেমনি পরিবেশও মানুষকে বদলায়।

দিলারা এ সময় দেশে একটা কল করতে চাপ দেয়। আরমান ভাইয়ের বাসায়। আমজাদ বুঝতে পারে না এ সময় কল দেয়ার কী আছে? দিলারা স্মরণ করিয়ে দিলো আজ কোটি টাকার জমি রেজিস্ট্রি হচ্ছে। চৌধুরীরা সবাই আসবে। এই চূড়ান্ত মুহূর্তে আব্বা চৌধুরীদের সাথে কথা না বললে আর কখন বলবে? দিলারার বুদ্ধিমত্তায় চমৎকৃত হয় আমজাদ। ফোন পেয়ে খুশি হয় বড়ভাই আরমান। জানায় সব ঠিকঠাক আছে। দলিল লেখা হয়েছে, উকিল সাহেব এক্ষুণি এসে পড়বে। আমজাদ জানায় রনির জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে অনেক মেহমান বাড়িতে। আমজাদ জমির চৌধুরীকে ফোন দিতে বলে। দিলারার চোখেমুখে তৃপ্তি উপচে পড়ছে যেন। সে তার শ্বশুরকে ডাক দেয়। রমিজ চৌধুরী এগিয়ে আসে, কার সাথে কথা বলছিস এখন?

কথা বলো, আমজাদ সেলফোন এগিয়ে দেয়।

হ্যালো, রমিজ চৌধুরী বলছি, সোরগোল বাঁচিয়ে একটু উচ্চৈঃস্বরে বলে রসিজ চৌধুরী, হ্যালো কে? জমির চৌধুরী? হ্যাঁ হ্যাঁ ভালো আছি। শোন, জমি বেচলে তুমি আমার কাছে বেচবে, বুঝেছো? আমার চেয়ে বেশি দাম কেউ দিতে পারবে না। না না ঠকাবো না। ঠিক আছে ঠিক আছে...।

দিলারা আর আমজাদ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো নতুন ভঙ্গিতে আলাপরত রমিজ চৌধুরীর দিকে। ভাবে কতোভাবেই না মানুষের রূপান্তর ঘটে সাক্ষি না হলে তা বোঝা যায় না।

back to top