মোহাম্মদপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়
পঁয়ষট্টি বছরের পুরনো রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মোহাম্মদপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। সাম্প্রতিককালে এই প্রতিষ্ঠানের সুনামে ‘ভাটা’ পড়েছে, ক্রমেই হারাচ্ছে ‘জৌলুস’। স্কুলটির বর্তমান পরিস্থিতিতে শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্য অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতির কারণ খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে স্কুলটির নানা ‘অনিয়ম, দুর্নীতি’।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্কুলটির ক্রমাগত অবনতির নেপথ্যে ‘স্বার্থ হাসিলে’ গড়ে উঠা ‘সিন্ডিকেট’। প্রতিষ্ঠানটির মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ে অর্থ ‘আত্মসাৎ’ থেকে শুরু করে ‘নিয়োগ বাণিজ্য’ ‘কোটি কোটি’ টাকা ‘হাতিয়ে’ নিয়ে ‘সিন্ডিকেটের’ সদস্যরা অটেল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন। আর এসব থেকে ‘পার’ পেতে থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ‘সখ্য’ গড়ে তুলেছে।
সংবাদের কাছে আসা বিভিন্ন তথ্য, নথিপত্র, অভিযোগপত্র, তদন্ত প্রতিবেদন, ছবি, ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু অর্থ আত্মসাৎই নয়, এই ‘সিন্ডিকেটের’ বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে শোকজ করা হচ্ছে; এমনকি বহিষ্কারও করা হচ্ছে। এর মধ্য একসঙ্গে ৯ জনকে বহিষ্কার করার ঘটনাও ঘটেছে। আর সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করে আসলেও তা আমলে নেয়া হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে নাম প্রকাশ করে কোন কথা বলতেও ‘ভয় পাচ্ছেন’ স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীরা।
‘সিন্ডিকেটে’ কারা?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ‘সিন্ডিকেটের’ নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন সরকার। অন্যরা হলেন- ‘জাল সার্টিফিকেটে’ চাকরি নেয়ার অভিযোগ থাকা শিক্ষক শফিকুর রহমান, শিক্ষক প্রতিনিধি নাসির উদ্দিন মৃধা, আইরিন খান, অভিভাবক সদস্য ওয়ালিউল্লাহ, খুরশিদ আলম রিপন, সুলতান মাহমুদ, সহকারী শিক্ষক হাসিবুর রহমান।
অনুসন্ধানকালে সংবাদের কাছে বেশকিছু ভিডিও ও ছবি এসেছে। এর মধ্যে একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ‘আনন্দ ভ্রমণ’ করছেন প্রধান শিক্ষকসহ এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। সেখানে সরকারি প্রটোকল ভেঙে যোগ দেন থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারও।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, অনুষ্ঠানে কোন অতিথিকে কোন পুরস্কার দেয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করছেন সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য। কাকে তাদের বেশি প্রয়োজন সেই আলোচনা হচ্ছে, আর দরকারি ব্যক্তিকে ‘দামি পুরস্কার’ দেয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ‘সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য হাঁটতে হাঁটতে ‘বড় অঙ্কের টাকা লেনদেনের’ বিষয়ে আলোচনা করছেন।’ বেশকিছু ছবিতে দেখা যায়, ‘আনন্দ ভ্রমণসহ অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁয় বিভিন্ন পার্টি করার দৃশ্য’।
প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শিক্ষক সংবাদকে বলেন, এই পার্টিগুলো ‘নিজের টাকায় হয় না’। মূলত স্কুল থেকে যে ‘অর্থ আত্মসাৎ’ করা হয়, সেই টাকার একটা অংশ দিয়েই এসব পার্টি হয়।
তবে সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অভিযোগ অস্বীকার করেন প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘শিক্ষক প্রতিনিধিদের হয়তো একটু প্রাধান্য দেই। কারণ তাদের নিয়েই তো প্রতিষ্ঠান চালাতে হয়। তাই বলে একে সিন্ডিকেট বলা যাবে না।’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির ‘নাজুক’ পরিস্থিতির বিষয়টি স্বীকার করেন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। স্কুলের এমন পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা তিনিও করছেন বলে জানান। ‘আমি ৭-৮ মাস হলো সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছি। চেষ্টা করছি প্রতিষ্ঠানের সমস্যাগুলো নিরসনে। এজন্য আগামী ২০ তারিখ একটি সভাও ডেকেছি।’ সংবাদকে বলেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি।
যখন থেকে শুরু
১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যালয়টি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিমন্ডলে বেশ সুনাম অর্জন করে আসছিল। বিভিন্ন সময় স্কুলটির শিক্ষার্থীরা সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থানও অর্জন করেছে। প্রায় প্রতিবছরই মেধা তালিকার বেশকিছু স্থান দখলে থাকতো স্কুলটির শিক্ষার্থীদের।
সর্বশেষ ২০১৪ সালেও এসএসসিতে পাসের হার ছিল শতভাগ। কিন্তু এরপর থেকেই স্কুলটির ছন্দপতন শুরু হয়। যার প্রভাবে ক্রমে কমতে থাকে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। এই কয়েক বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে বলে স্কুলটির সূত্র জানায়। বর্তমানে স্কুলটির শিক্ষার্থী সংখ্যা হাজারের কম, যেটি আগে দুই হাজারের বেশি ছিল। অবশ্য প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন সংবাদকে বলেন, তিনি যোগদান করার পর থেকে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমেনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান দেলোয়ার হোসেন। তিনি যোগদান করার পরই ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে তোলেন। যার প্রভাব পড়ে স্কুলটির স্বাভাবিক কার্যক্রমে।
লিখিত অভিযোগ ও কয়েকজন শিক্ষকের বর্নানা অনুযায়ী, এই কয়েক বছরে অনেক সম্পদ গড়েছেন প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন। বিপুল সম্পদ গড়েছেন ‘সার্টিফিকেট জালিয়াতি’র অভিযোগ থাকা ও ‘সিন্ডিকেটের’ অন্যতম সদস্য শফিকুর রহমানও। তাদের মতো স্কুলটি থেকে অটেল অর্থ ‘হাতিয়ে’ নিচ্ছেন ‘সিন্ডিকেটের’ অন্য সদস্যরাও। তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যে বিদ্যালয়ে ধস নামছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ১৫ অক্টোবর স্কুলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের পর সিন্ডিকেটটি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এরপর থেকে যাকেই প্রতিপক্ষ মনে করছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
একসঙ্গে ৯ জনকে সরিয়ে ‘পথ পরিষ্কার’
গত ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ স্কুলটির পাঁচজন নারীসহ ৮ জন শিক্ষক ও ১ জন কর্মচারীকে প্রায় একই রকম চিঠি দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর মধ্যে ৪ জনকে স্থায়ী ও ৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তরা হলেন- সহকারী প্রধান শিক্ষক সাজেদুল হক, সহকারী শিক্ষক মোকাররম হোসেন, নাহিদ রোকসানা, দিলরুবা আক্তার, সারা হুদা, সৈয়দা রোকেয়া সুলতানা, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, নাজমুন্নাহার ও পিয়ন আবদুল বাতেন মিয়া।
চিঠিতে ‘শিক্ষার্থীদের স্কুলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে উৎসাহিত করা, শিক্ষার্থীকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা, শিক্ষকদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করা, ম্যানেজিং কমিটিকে কটূক্তি করা’সহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন এই শিক্ষকরা। তাদের উল্টো অভিযোগ, ‘মূলত প্রধান শিক্ষককে ঘিরে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটের অপকর্ম ঢাকতে ও দুর্নীতির জন্য পথ পরিষ্কারের জন্য বহিষ্কার করা হয়’ তাদের।
চিঠিতে অসংগতি রয়েছে জানিয়ে একজন শিক্ষক বলেন, ‘চিঠি ইস্যু হয়েছে ১২ ডিসেম্বর। আর একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগের ঘটনার ১৫ ডিসেম্বরের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে যখন সমালোচনা শুরু হলো তখন ঘটনার তারিখটি ১৫ নভেম্বর উল্লেখ করে পরিপত্র জারি করা হয়। চিঠি ইস্যুর তিন মাস পর এই পরিপত্র জারি করে।’
বহিষ্কারাদেশ পাওয়া আরেকজন শিক্ষক বলেন, ‘আসলে কোন কারণ ছাড়াই অনৈতিকভাবে আমাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। আর চিঠি ইস্যু করতে হবে, কারণও দেখাতে- তাই মিথ্যা অভিযোগ বানিয়ে চিঠিতে লিখে দেয়া হয়েছে।’
বহিষ্কারদের পাওয়া একাধিক শিক্ষকের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে একজন পিয়নকেও বহিষ্কার করা হয়েছে মূলত দুটো কারণে। একটি ‘নিজেদের অপকর্ম থেকে রক্ষা’ পেতে। আরেকটি সবার মধ্যে ‘ভয় তৈরি’ করতে। যাতে পিয়ন থেকে শুরু করে ‘কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা না বলে’।
তবে সম্প্রতি সাময়িক বহিষ্কার পাওয়া ৫ জনকে চাকরিতে ‘শর্তসাপেক্ষে’ পুনর্বহাল করা হয়েছে। একাদিক সূত্র জানায়, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আগে যখন মামলার প্রস্তুতি চলছিল তখন তাদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য বৈঠক করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। সেখানে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর মাধ্যমে চাকরিতে পুনর্বহালের শর্তজুড়ে দেয়া হয়। কিন্তু বহিষ্কারাদেশপ্রাপ্তরা স্কুল প্যাডে দেয়ার শর্তে রাজি হোন। পরবর্তীতে সমঝোতার মাধ্যমে তাদের বহিষ্কারদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘সুনিদিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই তাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল।’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে শর্ত তো থাকবেই।’
অনিয়মের প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি
প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগ উঠে। এসব অভিযোগের মধ্যে কোন কোনটি প্রমাণিতও হয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালে অনিয়ম করে স্কুলের মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের অভিযোগ। অভিযোগ দিয়েছিলেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। এ সংক্রান্ত একটি তদন্ত প্রতিবেদন সংবাদের হাতে এসেছে।
২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর তারিখে স্বাক্ষরিত ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিভিন্ন তারিখে ও ৪টি রশিদে পুরাতন মালামাল বিক্রয় করা হয়েছে তার কোন প্রমাণপত্র নেই। বিক্রীত মালামালের কোন তালিকা তৈরি করা হয়নি। বিক্রয়ের পূর্বে কোন টেন্ডার করা হয়নি বা কোন কোটেশনও গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া গাছ বিক্রয়ের টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে বিভিন্ন খাতে খরচ করা ও কিছু টাকা হাতে নগদ রাখা বিধিসম্মত হয়নি।’
তবে ওই তদন্ত প্রতিবেদনের পর কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষক। আর প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারীরা ‘মিথ্যা’ অভিযোগ দিয়েছেন। আর সেটি ‘মিথ্যা প্রমাণও’ হয়েছে।
প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
শুধুই মালামাল ও গাছ বিক্রিই নয়, ‘অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির’ অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করেছে স্কুলটির শিক্ষক-কর্মচারীরা। দুদকে দেয়া এক অভিযোগে বলা হয়, ‘প্রধান শিক্ষক দেলোয়ারের যোগদানের পর স্বেচ্ছাচারিতা, অযোগ্যতা ও ভয়াবহ রকমের দুর্নীতির কারণে বিদ্যালয়টি এখন ধ্বংসের মুখে প্রায়। শিক্ষার্থী সংখ্যাও কমে আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। তার অমানবিক নির্যাতনে অসহায় শিক্ষক-কর্মচারীরা অভিযোগ জানাতে বাধ্য হচ্ছে।’
অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘প্রধান শিক্ষক পদে থেকে তিনি বিদ্যালয়ের পুরনো সব আসবাবপত্র, বেঞ্চ, লোহা-লক্কর, পরীক্ষার খাতাপত্র, গাছ বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেন। বিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে মাত্র পাঁচকক্ষ বিশিষ্ট একতলা একটি ভবনের নির্মাণ খরচ এক কোটি পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা দেখিয়ে সেখান থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন তিনি। এছাড়া বিদ্যালয়ে যোগদানের পর কয়েক বছরে (ক) সিলিকনসিটিতে একটি প্লট (খ) মধু সিটিতে একটি প্লট (গ) ঢাকা উদ্যানে একটি ফ্ল্যাট এবং নিজ গ্রামে যৌথভাবে একটি ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করেন তিনি, তার এ অর্থের উৎস সন্দেহজনক।’
সম্প্রতি দুদকে দেয়া একটি অভিযোগে বলা হয়, ঢাকা ও কেরানীগঞ্জ ছাড়াও ময়মনসিংহ, সাভারেও জমি ও ভবন তৈরি করেছেন দেলোয়ার। এগুলো হলো- ময়মনসিংহের কোতয়ালী থানার গোহাইলকান্দি মৌজার এসএ খতিয়ান ৬৩ ও সাভারের আমিন বাজারের হিজলা গ্রাম (দলিল নং ১১০৯২/২০১৮)।
ঢাকা কেরানীগঞ্জের মধু সিটির যে প্লট কিনেছেন সেটির কিছু নথিপত্র সংবাদের কাছে এসেছে। টাকা পরিশোধের কিছু মানি রিসিটও আছে। মধু সিটির নথি অনুযায়ী, প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্লটটি (ব্লক-বি, রোড-২) কিনেছেন ২৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে। এর মধ্যে প্রথম কিস্তি তথা প্লট বুকিংয়ের সময় সোয়া ৬ লাখ টাকা জমা করেন। আর সর্বশেষ আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করেন। আর অন্য কিস্তিগুলো ৮৫ হাজার টাকা করে পরিশোধ করেন।
দুদকে দেয়া অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘প্রধান শিক্ষক পদে দেলোয়ার হোসেনের নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি লিখিত পরীক্ষায় এক থেকে তিনের মধ্যে না খাকলেও তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।’
একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে একটি লিখিত অভিযোগ করেন বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক ও কর্মচারীরা। ওই অভিযোগে বলা হয়, ‘বিদ্যালয়ে যোগদানের এক বছরের মধ্যেই প্রধান শিক্ষক আড়াই লাখ টাকার চেক গ্রহণ করে নিম্নমানের বই পাঠ্য করতে চেয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানির পর টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন তিনি।’
এছাড়া বিদ্যালয়ের মাঠ ও অডিটরিয়াম ভাড়া দিয়ে ‘টাকা আত্মসাতেরও’ অভিযোগ করা হয়েছে। নির্মাণাধীন ছয়তলা একটি ভবনে নিম্নমানের উপকরণ সরবরাহের সুযোগ দিয়ে ‘অনৈতিক বাণিজ্যের’ও অভিযোগ করা হয়েছে।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, প্রধান শিক্ষক তার এসব ‘অপকর্ম’ ঢাকতে ‘অযথা’ সাধারণ শিক্ষকদের শোকজ করতেন। তিনি বিদ্যালয়ের যোগাদানের পর থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষককে নিয়মিত মিটিংয়ে রাখতেন না। এছাড়া প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিভাবকদের সঙ্গে অকথ্য ভাষায় কথা বলা এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মারধরের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
কয়েকজন শিক্ষকের বর্ণনা থেকে জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানকালে দেলোয়ার হোসেনের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পরপরই স্কুলটির কয়েকজন শিক্ষক ঘুরতে গিয়েছিলেন দেলোয়ার হোসেনের গ্রামের বাড়িতে। ঘুরতে যাওয়া এক শিক্ষক সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন তার (দেলোয়ার হোসেন) বাড়িতে। জড়াজীর্ণ বাড়ি ছিল তার। তিনি তখন অনেক গরিব ছিলেন।’
তবে প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে দেয়া সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’
শিক্ষক শফিকের ফিরিস্তি
সহকারী শিক্ষক শফিকুর রহমান ‘ভুয়া সনদে’ ১৮ বছর ধরে চাকরি করছেন বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, ২০০৪ সালে প্রথমে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হলেও একই দিনে তাকে পদোন্নতি দিয়ে কম্পিউটার বিষয়ের সহকারী শিক্ষক করা হয়।
সংবাদের কাছে থাকা নথিপত্র অনুযায়ী, মোহাম্মদপুর উচ্চ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ২০০৪ সালের ১১ জুন ম্যানেজিং কমিটির সভায় শফিকুর রহমানকে অস্থায়ীভাবে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেটি রেজুলেশন বা সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হলেও একই সভায় তাকে কম্পিউটার বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।
রেজুলেশনে দেখা গেছে, ওই সভায় ৯ জন সদস্যের নাম উল্লেখ থাকলেও তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন না বলে সিদ্ধান্তে তাদের স্বাক্ষর নেই।
এই শিক্ষকের সাবেক এক সহকর্মী সংবাদকে বলেন, ‘সভাটি যে প্রতারণামূলক ছিল সেটি রেজুলেশন পেপারই প্রমাণ করে। মূলত তৎকালীন এমপির সুপারিশ বাস্তবায়ন করতেই ওই সভাটি করা হয়েছিল।’
এ নিয়ে মাউশি ও দুদকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে পৃথক পৃথক লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। দাখিল করা অভিযোগগুলোর অনুলিপি সংবাদ সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি যে সার্টিফিকেট দিয়ে শফিকুর রহমান কম্পিউটার অপারেটর ও কম্পিউটার শিক্ষক পদোন্নতি পান, সেটিও সংবাদের কাছে এসেছে।
তিনি সার্টিফিকেটটি নিয়েছেন ‘ন্যাশনাল ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং একাডেমি’ থেকে। সার্টিফিকেট অনুযায়ী, সেখানে ২০০০ সালে এক বছর মেয়াদি ‘গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা’ কোর্স করেন। অনুসন্ধান করে এই নামে একটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পায় সংবাদ। সেটির বর্তমান অবস্থান রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে।
যদিও প্রতিষ্ঠানটি সার্টিফিকেটটি যাচাই করে জানায়, ‘এটি তাদের নয়।’ প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, সার্টিফিকেটটি হাতে লেখা। তাছাড়া তৎকালীন সময় এক বছর মেয়াদি ‘ডিপ্লোমা’ কোর্স থাকলেও ‘গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা’ নামে কোন কোর্স ছিল না।
এই শিক্ষকের কয়েকজন সাবেক সহকর্মী সংবাদকে বলেন, ‘মূলত প্রভাব খাটিয়ে এবং ‘সিন্ডিকেট মেইনটেইন’ করে নিজের চাকরি টিকিয়ে রেখেছেন শফিকুর রহমান। তার সার্টিফিকেটের বিষয়টি স্কুলে ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু তার ‘ক্ষমতার কারণে কেউ কিছু বলতে পারে না’। তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে বলা হয়, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৩১ নং ওয়ার্ডের বিএনপি দলীয় প্রয়াত কমিশনার কে এম আহাম্মেদ রাজুর দেহরক্ষী ছিলেন শফিকুর রহমান’।
কয়েকজন সহকর্মীর বর্ণানা অনুযায়ী, ‘সেই সূত্র ধরেই চাকরি হয়েছিল তার। নিয়োগ পাওয়ার সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ছিলেন বিএনপির নেতা প্রয়াত অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহাবুব। তিনিই সুপারিশ করেছিলেন। সেই সুপারিশেই তৎকালীন কমিটি তাকে নিয়োগ দেয়। রেজুলেশনেও সেটি উল্লেখ রয়েছে।’
শফিকুরের সাবেক কয়েকজন সহকর্মীর ভাষ্য: নিয়োগ পাওয়ার পর ক্রমেই প্রভাব বিস্তার শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে সরকার পাল্টালে খোলসও পাল্টে ফেলেন। বর্তমানে স্কুলটিতে তার প্রভাব আকাশচুম্বী। বিগত দুই দশকে তিনি ‘অটেল সম্পদের মালিক’ বনে গেছেন।
একটি লিখিত অভিযোগে বলা হয়, এই সময়ে ‘মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডের ২৩/৬ নং প্লটে ‘৮ কোটি’ টাকা দিয়ে একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করেছেন শফিকুর। মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকেও একটি ভবন নির্মাণ করেছেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জের বড়মনোহরিয়ার আটিবাজার এলাকায় ৩ কাঠার একটি প্লট কিনেন, যার ঠিকানা- মধু সিটি ০২, ব্লক বি, রোড নং ০২, প্লট নং ১২। একই ঠিকানায় ১৬ নম্বর প্লটটি বোনের নামে ক্রয় করেন। এছাড়াও তিনি গাড়িসহ অনেক সম্পদ গড়েছেন।
এ ব্যাপারে শফিকুর রহমানের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা।’ সম্পদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো আমার পৈত্রিক সম্পদ।’ তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে দুদক এবং মাউশিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে তদন্ত হচ্ছে বলে সংবাদকে একাধিক সূত্র জানায়।
মোহাম্মদপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়
শনিবার, ১৫ জুলাই ২০২৩
পঁয়ষট্টি বছরের পুরনো রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মোহাম্মদপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। সাম্প্রতিককালে এই প্রতিষ্ঠানের সুনামে ‘ভাটা’ পড়েছে, ক্রমেই হারাচ্ছে ‘জৌলুস’। স্কুলটির বর্তমান পরিস্থিতিতে শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্য অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতির কারণ খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে স্কুলটির নানা ‘অনিয়ম, দুর্নীতি’।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্কুলটির ক্রমাগত অবনতির নেপথ্যে ‘স্বার্থ হাসিলে’ গড়ে উঠা ‘সিন্ডিকেট’। প্রতিষ্ঠানটির মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ে অর্থ ‘আত্মসাৎ’ থেকে শুরু করে ‘নিয়োগ বাণিজ্য’ ‘কোটি কোটি’ টাকা ‘হাতিয়ে’ নিয়ে ‘সিন্ডিকেটের’ সদস্যরা অটেল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন। আর এসব থেকে ‘পার’ পেতে থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ‘সখ্য’ গড়ে তুলেছে।
সংবাদের কাছে আসা বিভিন্ন তথ্য, নথিপত্র, অভিযোগপত্র, তদন্ত প্রতিবেদন, ছবি, ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু অর্থ আত্মসাৎই নয়, এই ‘সিন্ডিকেটের’ বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে শোকজ করা হচ্ছে; এমনকি বহিষ্কারও করা হচ্ছে। এর মধ্য একসঙ্গে ৯ জনকে বহিষ্কার করার ঘটনাও ঘটেছে। আর সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করে আসলেও তা আমলে নেয়া হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে নাম প্রকাশ করে কোন কথা বলতেও ‘ভয় পাচ্ছেন’ স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীরা।
‘সিন্ডিকেটে’ কারা?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ‘সিন্ডিকেটের’ নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন সরকার। অন্যরা হলেন- ‘জাল সার্টিফিকেটে’ চাকরি নেয়ার অভিযোগ থাকা শিক্ষক শফিকুর রহমান, শিক্ষক প্রতিনিধি নাসির উদ্দিন মৃধা, আইরিন খান, অভিভাবক সদস্য ওয়ালিউল্লাহ, খুরশিদ আলম রিপন, সুলতান মাহমুদ, সহকারী শিক্ষক হাসিবুর রহমান।
অনুসন্ধানকালে সংবাদের কাছে বেশকিছু ভিডিও ও ছবি এসেছে। এর মধ্যে একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ‘আনন্দ ভ্রমণ’ করছেন প্রধান শিক্ষকসহ এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। সেখানে সরকারি প্রটোকল ভেঙে যোগ দেন থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারও।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, অনুষ্ঠানে কোন অতিথিকে কোন পুরস্কার দেয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করছেন সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য। কাকে তাদের বেশি প্রয়োজন সেই আলোচনা হচ্ছে, আর দরকারি ব্যক্তিকে ‘দামি পুরস্কার’ দেয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ‘সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য হাঁটতে হাঁটতে ‘বড় অঙ্কের টাকা লেনদেনের’ বিষয়ে আলোচনা করছেন।’ বেশকিছু ছবিতে দেখা যায়, ‘আনন্দ ভ্রমণসহ অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁয় বিভিন্ন পার্টি করার দৃশ্য’।
প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শিক্ষক সংবাদকে বলেন, এই পার্টিগুলো ‘নিজের টাকায় হয় না’। মূলত স্কুল থেকে যে ‘অর্থ আত্মসাৎ’ করা হয়, সেই টাকার একটা অংশ দিয়েই এসব পার্টি হয়।
তবে সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অভিযোগ অস্বীকার করেন প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘শিক্ষক প্রতিনিধিদের হয়তো একটু প্রাধান্য দেই। কারণ তাদের নিয়েই তো প্রতিষ্ঠান চালাতে হয়। তাই বলে একে সিন্ডিকেট বলা যাবে না।’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির ‘নাজুক’ পরিস্থিতির বিষয়টি স্বীকার করেন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। স্কুলের এমন পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা তিনিও করছেন বলে জানান। ‘আমি ৭-৮ মাস হলো সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছি। চেষ্টা করছি প্রতিষ্ঠানের সমস্যাগুলো নিরসনে। এজন্য আগামী ২০ তারিখ একটি সভাও ডেকেছি।’ সংবাদকে বলেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি।
যখন থেকে শুরু
১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যালয়টি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিমন্ডলে বেশ সুনাম অর্জন করে আসছিল। বিভিন্ন সময় স্কুলটির শিক্ষার্থীরা সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থানও অর্জন করেছে। প্রায় প্রতিবছরই মেধা তালিকার বেশকিছু স্থান দখলে থাকতো স্কুলটির শিক্ষার্থীদের।
সর্বশেষ ২০১৪ সালেও এসএসসিতে পাসের হার ছিল শতভাগ। কিন্তু এরপর থেকেই স্কুলটির ছন্দপতন শুরু হয়। যার প্রভাবে ক্রমে কমতে থাকে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। এই কয়েক বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে বলে স্কুলটির সূত্র জানায়। বর্তমানে স্কুলটির শিক্ষার্থী সংখ্যা হাজারের কম, যেটি আগে দুই হাজারের বেশি ছিল। অবশ্য প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন সংবাদকে বলেন, তিনি যোগদান করার পর থেকে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমেনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান দেলোয়ার হোসেন। তিনি যোগদান করার পরই ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে তোলেন। যার প্রভাব পড়ে স্কুলটির স্বাভাবিক কার্যক্রমে।
লিখিত অভিযোগ ও কয়েকজন শিক্ষকের বর্নানা অনুযায়ী, এই কয়েক বছরে অনেক সম্পদ গড়েছেন প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন। বিপুল সম্পদ গড়েছেন ‘সার্টিফিকেট জালিয়াতি’র অভিযোগ থাকা ও ‘সিন্ডিকেটের’ অন্যতম সদস্য শফিকুর রহমানও। তাদের মতো স্কুলটি থেকে অটেল অর্থ ‘হাতিয়ে’ নিচ্ছেন ‘সিন্ডিকেটের’ অন্য সদস্যরাও। তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যে বিদ্যালয়ে ধস নামছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ১৫ অক্টোবর স্কুলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের পর সিন্ডিকেটটি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এরপর থেকে যাকেই প্রতিপক্ষ মনে করছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
একসঙ্গে ৯ জনকে সরিয়ে ‘পথ পরিষ্কার’
গত ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ স্কুলটির পাঁচজন নারীসহ ৮ জন শিক্ষক ও ১ জন কর্মচারীকে প্রায় একই রকম চিঠি দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর মধ্যে ৪ জনকে স্থায়ী ও ৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তরা হলেন- সহকারী প্রধান শিক্ষক সাজেদুল হক, সহকারী শিক্ষক মোকাররম হোসেন, নাহিদ রোকসানা, দিলরুবা আক্তার, সারা হুদা, সৈয়দা রোকেয়া সুলতানা, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, নাজমুন্নাহার ও পিয়ন আবদুল বাতেন মিয়া।
চিঠিতে ‘শিক্ষার্থীদের স্কুলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে উৎসাহিত করা, শিক্ষার্থীকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা, শিক্ষকদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করা, ম্যানেজিং কমিটিকে কটূক্তি করা’সহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন এই শিক্ষকরা। তাদের উল্টো অভিযোগ, ‘মূলত প্রধান শিক্ষককে ঘিরে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটের অপকর্ম ঢাকতে ও দুর্নীতির জন্য পথ পরিষ্কারের জন্য বহিষ্কার করা হয়’ তাদের।
চিঠিতে অসংগতি রয়েছে জানিয়ে একজন শিক্ষক বলেন, ‘চিঠি ইস্যু হয়েছে ১২ ডিসেম্বর। আর একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগের ঘটনার ১৫ ডিসেম্বরের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে যখন সমালোচনা শুরু হলো তখন ঘটনার তারিখটি ১৫ নভেম্বর উল্লেখ করে পরিপত্র জারি করা হয়। চিঠি ইস্যুর তিন মাস পর এই পরিপত্র জারি করে।’
বহিষ্কারাদেশ পাওয়া আরেকজন শিক্ষক বলেন, ‘আসলে কোন কারণ ছাড়াই অনৈতিকভাবে আমাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। আর চিঠি ইস্যু করতে হবে, কারণও দেখাতে- তাই মিথ্যা অভিযোগ বানিয়ে চিঠিতে লিখে দেয়া হয়েছে।’
বহিষ্কারদের পাওয়া একাধিক শিক্ষকের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে একজন পিয়নকেও বহিষ্কার করা হয়েছে মূলত দুটো কারণে। একটি ‘নিজেদের অপকর্ম থেকে রক্ষা’ পেতে। আরেকটি সবার মধ্যে ‘ভয় তৈরি’ করতে। যাতে পিয়ন থেকে শুরু করে ‘কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা না বলে’।
তবে সম্প্রতি সাময়িক বহিষ্কার পাওয়া ৫ জনকে চাকরিতে ‘শর্তসাপেক্ষে’ পুনর্বহাল করা হয়েছে। একাদিক সূত্র জানায়, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আগে যখন মামলার প্রস্তুতি চলছিল তখন তাদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য বৈঠক করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। সেখানে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর মাধ্যমে চাকরিতে পুনর্বহালের শর্তজুড়ে দেয়া হয়। কিন্তু বহিষ্কারাদেশপ্রাপ্তরা স্কুল প্যাডে দেয়ার শর্তে রাজি হোন। পরবর্তীতে সমঝোতার মাধ্যমে তাদের বহিষ্কারদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘সুনিদিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই তাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল।’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে শর্ত তো থাকবেই।’
অনিয়মের প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি
প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগ উঠে। এসব অভিযোগের মধ্যে কোন কোনটি প্রমাণিতও হয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালে অনিয়ম করে স্কুলের মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের অভিযোগ। অভিযোগ দিয়েছিলেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। এ সংক্রান্ত একটি তদন্ত প্রতিবেদন সংবাদের হাতে এসেছে।
২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর তারিখে স্বাক্ষরিত ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিভিন্ন তারিখে ও ৪টি রশিদে পুরাতন মালামাল বিক্রয় করা হয়েছে তার কোন প্রমাণপত্র নেই। বিক্রীত মালামালের কোন তালিকা তৈরি করা হয়নি। বিক্রয়ের পূর্বে কোন টেন্ডার করা হয়নি বা কোন কোটেশনও গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া গাছ বিক্রয়ের টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে বিভিন্ন খাতে খরচ করা ও কিছু টাকা হাতে নগদ রাখা বিধিসম্মত হয়নি।’
তবে ওই তদন্ত প্রতিবেদনের পর কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষক। আর প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারীরা ‘মিথ্যা’ অভিযোগ দিয়েছেন। আর সেটি ‘মিথ্যা প্রমাণও’ হয়েছে।
প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
শুধুই মালামাল ও গাছ বিক্রিই নয়, ‘অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির’ অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করেছে স্কুলটির শিক্ষক-কর্মচারীরা। দুদকে দেয়া এক অভিযোগে বলা হয়, ‘প্রধান শিক্ষক দেলোয়ারের যোগদানের পর স্বেচ্ছাচারিতা, অযোগ্যতা ও ভয়াবহ রকমের দুর্নীতির কারণে বিদ্যালয়টি এখন ধ্বংসের মুখে প্রায়। শিক্ষার্থী সংখ্যাও কমে আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। তার অমানবিক নির্যাতনে অসহায় শিক্ষক-কর্মচারীরা অভিযোগ জানাতে বাধ্য হচ্ছে।’
অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘প্রধান শিক্ষক পদে থেকে তিনি বিদ্যালয়ের পুরনো সব আসবাবপত্র, বেঞ্চ, লোহা-লক্কর, পরীক্ষার খাতাপত্র, গাছ বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেন। বিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে মাত্র পাঁচকক্ষ বিশিষ্ট একতলা একটি ভবনের নির্মাণ খরচ এক কোটি পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা দেখিয়ে সেখান থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন তিনি। এছাড়া বিদ্যালয়ে যোগদানের পর কয়েক বছরে (ক) সিলিকনসিটিতে একটি প্লট (খ) মধু সিটিতে একটি প্লট (গ) ঢাকা উদ্যানে একটি ফ্ল্যাট এবং নিজ গ্রামে যৌথভাবে একটি ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করেন তিনি, তার এ অর্থের উৎস সন্দেহজনক।’
সম্প্রতি দুদকে দেয়া একটি অভিযোগে বলা হয়, ঢাকা ও কেরানীগঞ্জ ছাড়াও ময়মনসিংহ, সাভারেও জমি ও ভবন তৈরি করেছেন দেলোয়ার। এগুলো হলো- ময়মনসিংহের কোতয়ালী থানার গোহাইলকান্দি মৌজার এসএ খতিয়ান ৬৩ ও সাভারের আমিন বাজারের হিজলা গ্রাম (দলিল নং ১১০৯২/২০১৮)।
ঢাকা কেরানীগঞ্জের মধু সিটির যে প্লট কিনেছেন সেটির কিছু নথিপত্র সংবাদের কাছে এসেছে। টাকা পরিশোধের কিছু মানি রিসিটও আছে। মধু সিটির নথি অনুযায়ী, প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্লটটি (ব্লক-বি, রোড-২) কিনেছেন ২৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে। এর মধ্যে প্রথম কিস্তি তথা প্লট বুকিংয়ের সময় সোয়া ৬ লাখ টাকা জমা করেন। আর সর্বশেষ আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করেন। আর অন্য কিস্তিগুলো ৮৫ হাজার টাকা করে পরিশোধ করেন।
দুদকে দেয়া অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘প্রধান শিক্ষক পদে দেলোয়ার হোসেনের নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি লিখিত পরীক্ষায় এক থেকে তিনের মধ্যে না খাকলেও তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।’
একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে একটি লিখিত অভিযোগ করেন বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক ও কর্মচারীরা। ওই অভিযোগে বলা হয়, ‘বিদ্যালয়ে যোগদানের এক বছরের মধ্যেই প্রধান শিক্ষক আড়াই লাখ টাকার চেক গ্রহণ করে নিম্নমানের বই পাঠ্য করতে চেয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানির পর টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন তিনি।’
এছাড়া বিদ্যালয়ের মাঠ ও অডিটরিয়াম ভাড়া দিয়ে ‘টাকা আত্মসাতেরও’ অভিযোগ করা হয়েছে। নির্মাণাধীন ছয়তলা একটি ভবনে নিম্নমানের উপকরণ সরবরাহের সুযোগ দিয়ে ‘অনৈতিক বাণিজ্যের’ও অভিযোগ করা হয়েছে।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, প্রধান শিক্ষক তার এসব ‘অপকর্ম’ ঢাকতে ‘অযথা’ সাধারণ শিক্ষকদের শোকজ করতেন। তিনি বিদ্যালয়ের যোগাদানের পর থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষককে নিয়মিত মিটিংয়ে রাখতেন না। এছাড়া প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিভাবকদের সঙ্গে অকথ্য ভাষায় কথা বলা এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মারধরের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
কয়েকজন শিক্ষকের বর্ণনা থেকে জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানকালে দেলোয়ার হোসেনের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পরপরই স্কুলটির কয়েকজন শিক্ষক ঘুরতে গিয়েছিলেন দেলোয়ার হোসেনের গ্রামের বাড়িতে। ঘুরতে যাওয়া এক শিক্ষক সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন তার (দেলোয়ার হোসেন) বাড়িতে। জড়াজীর্ণ বাড়ি ছিল তার। তিনি তখন অনেক গরিব ছিলেন।’
তবে প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে দেয়া সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’
শিক্ষক শফিকের ফিরিস্তি
সহকারী শিক্ষক শফিকুর রহমান ‘ভুয়া সনদে’ ১৮ বছর ধরে চাকরি করছেন বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, ২০০৪ সালে প্রথমে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হলেও একই দিনে তাকে পদোন্নতি দিয়ে কম্পিউটার বিষয়ের সহকারী শিক্ষক করা হয়।
সংবাদের কাছে থাকা নথিপত্র অনুযায়ী, মোহাম্মদপুর উচ্চ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ২০০৪ সালের ১১ জুন ম্যানেজিং কমিটির সভায় শফিকুর রহমানকে অস্থায়ীভাবে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেটি রেজুলেশন বা সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হলেও একই সভায় তাকে কম্পিউটার বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।
রেজুলেশনে দেখা গেছে, ওই সভায় ৯ জন সদস্যের নাম উল্লেখ থাকলেও তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন না বলে সিদ্ধান্তে তাদের স্বাক্ষর নেই।
এই শিক্ষকের সাবেক এক সহকর্মী সংবাদকে বলেন, ‘সভাটি যে প্রতারণামূলক ছিল সেটি রেজুলেশন পেপারই প্রমাণ করে। মূলত তৎকালীন এমপির সুপারিশ বাস্তবায়ন করতেই ওই সভাটি করা হয়েছিল।’
এ নিয়ে মাউশি ও দুদকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে পৃথক পৃথক লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। দাখিল করা অভিযোগগুলোর অনুলিপি সংবাদ সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি যে সার্টিফিকেট দিয়ে শফিকুর রহমান কম্পিউটার অপারেটর ও কম্পিউটার শিক্ষক পদোন্নতি পান, সেটিও সংবাদের কাছে এসেছে।
তিনি সার্টিফিকেটটি নিয়েছেন ‘ন্যাশনাল ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং একাডেমি’ থেকে। সার্টিফিকেট অনুযায়ী, সেখানে ২০০০ সালে এক বছর মেয়াদি ‘গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা’ কোর্স করেন। অনুসন্ধান করে এই নামে একটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পায় সংবাদ। সেটির বর্তমান অবস্থান রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে।
যদিও প্রতিষ্ঠানটি সার্টিফিকেটটি যাচাই করে জানায়, ‘এটি তাদের নয়।’ প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, সার্টিফিকেটটি হাতে লেখা। তাছাড়া তৎকালীন সময় এক বছর মেয়াদি ‘ডিপ্লোমা’ কোর্স থাকলেও ‘গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা’ নামে কোন কোর্স ছিল না।
এই শিক্ষকের কয়েকজন সাবেক সহকর্মী সংবাদকে বলেন, ‘মূলত প্রভাব খাটিয়ে এবং ‘সিন্ডিকেট মেইনটেইন’ করে নিজের চাকরি টিকিয়ে রেখেছেন শফিকুর রহমান। তার সার্টিফিকেটের বিষয়টি স্কুলে ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু তার ‘ক্ষমতার কারণে কেউ কিছু বলতে পারে না’। তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে বলা হয়, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৩১ নং ওয়ার্ডের বিএনপি দলীয় প্রয়াত কমিশনার কে এম আহাম্মেদ রাজুর দেহরক্ষী ছিলেন শফিকুর রহমান’।
কয়েকজন সহকর্মীর বর্ণানা অনুযায়ী, ‘সেই সূত্র ধরেই চাকরি হয়েছিল তার। নিয়োগ পাওয়ার সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ছিলেন বিএনপির নেতা প্রয়াত অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহাবুব। তিনিই সুপারিশ করেছিলেন। সেই সুপারিশেই তৎকালীন কমিটি তাকে নিয়োগ দেয়। রেজুলেশনেও সেটি উল্লেখ রয়েছে।’
শফিকুরের সাবেক কয়েকজন সহকর্মীর ভাষ্য: নিয়োগ পাওয়ার পর ক্রমেই প্রভাব বিস্তার শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে সরকার পাল্টালে খোলসও পাল্টে ফেলেন। বর্তমানে স্কুলটিতে তার প্রভাব আকাশচুম্বী। বিগত দুই দশকে তিনি ‘অটেল সম্পদের মালিক’ বনে গেছেন।
একটি লিখিত অভিযোগে বলা হয়, এই সময়ে ‘মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডের ২৩/৬ নং প্লটে ‘৮ কোটি’ টাকা দিয়ে একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করেছেন শফিকুর। মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকেও একটি ভবন নির্মাণ করেছেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জের বড়মনোহরিয়ার আটিবাজার এলাকায় ৩ কাঠার একটি প্লট কিনেন, যার ঠিকানা- মধু সিটি ০২, ব্লক বি, রোড নং ০২, প্লট নং ১২। একই ঠিকানায় ১৬ নম্বর প্লটটি বোনের নামে ক্রয় করেন। এছাড়াও তিনি গাড়িসহ অনেক সম্পদ গড়েছেন।
এ ব্যাপারে শফিকুর রহমানের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা।’ সম্পদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো আমার পৈত্রিক সম্পদ।’ তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে দুদক এবং মাউশিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে তদন্ত হচ্ছে বলে সংবাদকে একাধিক সূত্র জানায়।