alt

উপ-সম্পাদকীয়

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনের সম্ভাবনা

খনরঞ্জন রায়

: শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

পর্যটন এখন শিল্পের জীবনতরীতে উঠে বসেছে। বিনোদন, অবসর কিংবা ব্যবসার উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অথবা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণকে পর্যটন শিল্প হিসাবে গ্রহণ করা হয়। পর্যটন থেকে পর্যটক হয়ে বিশ্বব্যাপী অবসরকালীন আমোদ-প্রমোদের এই মাধ্যমকে ইতিমধ্যে অনেক দেশ শিল্পের মর্যাদা দিয়েছে। সংকীর্ণতার ঘেরাটোপ থেকে বেড়িয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে। ট্যুরিস্ট গাইড, পর্যটন সংস্থা, বিনোদন কেন্দ্র, প্রমোদতরী, হোটেল, রিসোর্ট চিত্তবিনোদনের পার্ক, শপিংমল, সঙ্গীত মঞ্চ, থিয়েটার প্রদর্শন কেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহকে ঘষাঁমাজা করে বিনোদন আকর্ষণীয় হিসাবে উপস্থাপন হচ্ছে। প্রতিটি দেশের জাতীয় অর্থনীতির সহায়ক শক্তি হিসাবে অর্থ ব্যবস্থায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে। মোট জাতীয় উৎপাদনের বড় একটি অংশ সংযুক্ত হচ্ছে পর্যটন শিল্প খাত থেকে। এই শিল্পের প্রযোজক-পরিচালক হতে অনেক পন্ডিত বরেণ্য ব্যক্তি, শিল্পপতি অথবা ব্যবসা লোভী কুশীলর বা তাদের বলয় সৃষ্টি করছে।

বিশ্ব পর্যটন সংস্থা দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা, রাজস্ব আয়, পর্যটন খাতে ব্যয় মূল্যায়ন করে সদস্য দেশগুলোর একটি ক্রমতালিকা প্রস্তুত করে। জাতিসংঘের আওতাভুক্ত ভূখন্ড থেকে আসা পর্যটকের উজ্জ্বলতা নিয়ে বছরে তিনবার এই তালিকা প্রকাশ করে। দেখা গেছে আন্তর্জাতিক পর্যটন থেকে আসা রাজস্বে বরাবরই তালিকার শীর্ষে থাকে ইউএসএ। তাদের বাৎসরিক আয় প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। প্রতি বছর তা ৪.২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিমাণের দিক থেকে তাদের ধারেকাছে না থাকলেও তালিকার ক্রমানুসারে স্পেন, ফ্রান্স, চীন, ইতালি, জার্মানি, ইউকে, অস্ট্রেলিয়া, মেকাও, হংকংয়ের পর্যটন খাত বেশ জোরালো।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ও শ্রমঘম শিল্প খাত পর্যটন। প্রকৃতির নন্দিত আবহ তুলে ধরে এই খাতের গড় প্রবৃদ্ধি আগামী ১০ বছর অব্যহত থাকবে ৪.৩ শতাংশ হারে। এই হারের নির্যাস অব্যাহত রাখা খুব একটা কঠিন নয় বলে জানিয়েছে বিশ্ব পর্যটন সংস্থা। তারা জানিয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটনের অবদান বিশ্ব জিডিপির ১১ শতাংশ। বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের ৯ শতাংশ। রপ্তানির ১২ শতাংশ, বৈশ্বিক বিনিয়োগের ১১ শতাংশ। একজন পর্যটকের পেছনে গড়ে ১০ জনের কর্মসংস্থান হিসাব ধরলে প্রায় ৪০ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এই খাতে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ধারাবাহিক টেকসই ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রভাব ফেলা এই খাতের বাৎসরিক আয় বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯.২ ট্রিলিয়ন ডলার। সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এই পর্যটন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা কিংবা ব্যবসা পরিচালনার সুযোগের বাইরে সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনায় অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করে। বিস্তৃত পরিসরে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। পরিবহণ, নির্মাণ, প্রকৌশল, উৎপাদন, কৃষি, খাদ্য, টেলিকম, তথ্যপ্রযুক্তি, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবাসহ আরও অনেক খাতের লালন-পালন প্রয়োজন পড়ে।

বাংলাদেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, প্রতœতত্ত্ব নিদর্শন, ধর্মীয় সম্প্রীতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার পর্যটনের জন্য বহুমাত্রিক আকর্ষণ সমৃদ্ধ নতুন এক গন্তব্য। আর এই কারণেই অতীত থেকে যুগে যুগে ভ্রমণ পাগল দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে ভিড় জমিয়েছেন। আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে বিশ্ববাসীর নিকট সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। আধুনিকতা না থাকলেও ভ্রমণসমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কারণে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদানে ৪.৩০ শতাংশ। আধুনিক পর্যটনকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে ২০২৮ সালে জিডিপিতে নির্ধারণ করা অবদান ৬.৮ শতাংশ অসম্ভব নয়। এখানে জাদুকরি কোন বিদ্যার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন ইতিহাসের অভিজ্ঞতা আর সমসাময়িক বর্ণ ও অলংকরণ।

দেশে স্বনির্ভর পর্যটনের কিছু রুচির নির্মাতা থাকায় প্রতি বছর অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মোট তথ্য না থাকলেও বলা যায় এই সংখ্যা বছরে ন্যূনধিক ৩ কোটি। জীবন-জীবিকা নির্বাহের হিসাবে প্রায় ৪০ লাখ পর্যটনকর্মী এই খাতের সমৃদ্ধির পেছনে জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের বিনোদন পার্ক অ্যাসোসিয়েশন ‘বাপা’র তথ্যমতে সারা বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলে তিন শতাধিক বিনোদন পার্ক, থিম পার্ক, ইকোপার্ক রয়েছে। বর্তমানে বাপার আওতাধীন ১০০টি বিনোদন পার্কে ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। প্রতিদিন এর পরিধি গাণিতিক হারে বাড়ছে। প্রতিবছর ৬ কোটি দর্শনার্থীর আগমনে সেবাপ্রদানকারী কর্মী রয়েছেন প্রায় ৪ লক্ষাধিক।

বাপার আওতাবহির্ভূত বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরও প্রায় ২ সহস্রাধিক পর্যটন আকর্ষণীয় স্থান এই খাতকে তাদের একান্ত মনের তাগিদে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে। অন্তহীন কোন রাখালিয়া গান তাদের এই কাজকে উদ্বুদ্ধ করছে। পর্যটন বিষয়ক সরকারি-বেসরকারি এবং সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে দেশে প্রায় এক হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রায় তিন লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। দেশে ৮৭ হাজার ১৮২টি গ্রাম রয়েছে। কিছু কিছু গ্রাম নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত। পর্যটন সম্পদশালী গ্রামগুলোকে রাস্তাঘাট, অবকাঠামো সুবিধা ব্যবস্থা করতে পারলে গ্রামীণ ও অনগ্রসর এলাকার জনগোষ্ঠীর জীবনমানে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

দেশের ৭ জেলার ৪২৩টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভিত্তিক হাওর রয়েছে। হাওরভিত্তিক পর্যটন বিকশিত করা গেলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আধিবাসীদের বর্ষার অলস সময়ে কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হতো। দেশের ২৪১টি চা বাগান সংশ্লিষ্ট নৈসর্গিক সৌন্দর্যের স্থানসমূহে ভ্রমণপিপাসুকে আকৃষ্ট করলে, সঙ্গে এলাকার স্থানীয় জনগোষ্ঠী জীবন-জীবিকার নতুন খাত হিসাবে বেছে নিতে পারে। দেশের অপার সম্ভাবনার গন্তব্য পার্বত্য এলাকা। এখানের মূল উপকরণ হলো পাহাড়ঘেরা সবুজ প্রকৃতি, নদী, ঝরণা, পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী ও তাদের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জীবনধারা। এখানে ইকো ট্যুরিজম, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম, নেচার ট্যুরিজম, কালচারাল ট্যুরিজম, পাহাড়ে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা বিষয়ে পর্যটন ব্যবস্থা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রবাহ বৃদ্ধি করা যায়।

বাংলাদেশের আরেক অরণ্য রানী সুন্দরবন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। দেশে তো আছে পুরো; পৃথিবীর পর্যটকদের অপার বিনোদন আকর্ষণের এই জায়গা বড়ই অবহেলিত। বিচ্ছিন্ন নয় পরিকল্পিতভাবে পর্যটনবান্ধব করা গেলে পর্যটনের নতুন পর্দা উন্মোচন হতো। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষিত ৫২১টি প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা আছে। এইস্থান-স্থাপনাকে একটি আদর্শ সামনে রেখে পর্যটন সেবামূলক করা গেলে লক্ষ-কোটি মানুষের আগ্রহ-আকাক্সক্ষার জায়গা হতো। ক্ষুদ্র-মাঝারি-স্থানীয় লাখ লাখ জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ধারণ করা যেত। কক্সবাজার পৃথিবীর বিস্ময়। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ধারণ করে আছে প্রাকৃতিক সম্পদের উজ্জ্বল আধার। বিশ্বব্যাপী দর্শন সুখপ্রিয় মানুষের অক্লান্ত আকাক্সক্ষা কক্সবাজার ভ্রমণ। বড়ই দুর্ভাগা জাতি। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের হাতচ্ছানি দেয়া কক্সবাজারে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। বলছি বর্তমান প্রেক্ষাপটের আধুনিক নন্দনতাত্ত্বিক সড়ক ব্যবস্থা। স্বর্পিল-আঁকাবাঁকা এক লেনের এই সড়কযাত্রা এখনো মরণফাঁদ।

বিশ্বে এখন পেশাভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে। পর্যটনের বেলায় আরও দক্ষ অভিজ্ঞ চৌকস ট্যুরিস্ট গাইড সময়ের দাবি

বিশ্ব এখন পেশাভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে। পর্যটনের বেলায় আরও দক্ষ অভিজ্ঞ চৌকস ট্যুরিস্ট গাইড সময়ের দাবি। যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে মাথাভারী করা হচ্ছে পর্যটনকে। এই বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়েছে। অথচ আমাদের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দরকার পর্যটন বিষয়ে মধ্যম মেধার মধ্যম শ্রেণীর শিক্ষা কোর্স। এখানটায় বেশ অবহেলার শিকার। পর্যটন করপোরেশনের মাধ্যমে ৩-৬-৯ মাস মেয়াদি স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই কম। গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের ভাবনা-চিন্তা এখনো পরিকল্পনার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। পর্যটন সেবাদানে দক্ষ জনশক্তি আর নিবিড়ত দারকির জোরালো ব্যবস্থা না থাকায় নিয়ত প্রতিনিয়তই ভ্রমণযাত্রীদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। সলিল সমাধি ঘটে আমাদের তরুণ-যুব-ভ্রমণপ্রিয় জনগোষ্ঠীর। এই দায় বাংলাদেশের পর্যটন মন্ত্রণালয়, পর্যটন করপোরেশন, পর্যটন বোর্ড এড়াতে পারে না।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনের অপার সম্ভাবনা মাঝে মাঝে ধূলোয় মিশে যায়। এক ধরনের অনিশ্চয়তা নেমে আসে। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে অব্যহত রাখতে পর্যটনের খাতকে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার স্পর্শ বুলাতে হবে। পর্যটন দিবসের ভাবনাও এই। স্বতঃষ্ফূর্তভাবে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো। পর্যটনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানবিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতা আর সচেতনতা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা। বাংলাদেশ সেই চ্যালেঞ্জ সানন্দে গ্রহণ করবে আজকের দিনে এই প্রত্যাশা।

[লেখক : সমাজকর্মী ]

মানুষের পর কারা হবে বিশ্বজয়ী

স্বাস্থ্য খাতে ফার্মাসিস্টদের অবদান

টেকসই রাষ্ট্রীয় সংস্কারে শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যাহত বিনির্মাণের বিকল্প নাই

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়নের ভূমিকা

বিশ্ব নরসুন্দর দিবস

মধু পূর্ণিমা ও প্রাসঙ্গিক কথা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

ছয়টি কমিশন গঠিত হলো কিন্তু শিক্ষা কোথায়?

বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

শিক্ষাব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

বন্যা পরবর্তী রোগবালাই

রম্যগদ্য : থামব কবে কাইজ্জা-ফ্যাসাদ

প্রসঙ্গ : জাতীয় সংগীত

পানির ব্যবহার, পানির রাজনীতি

রবীন্দ্র ভাবনায় কৃষি এবং আজকের প্রেক্ষাপট

শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

‘আবার তোরা মানুষ হ’

ভোজ্যতেল সংকট মেটাতে পাম চাষের গুরুত্ব

গোপনে ধারণকৃত ভিডিও ও ছবি দিয়ে প্রতারণা

হুন্ডি কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনের সম্ভাবনা

খনরঞ্জন রায়

শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

পর্যটন এখন শিল্পের জীবনতরীতে উঠে বসেছে। বিনোদন, অবসর কিংবা ব্যবসার উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অথবা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণকে পর্যটন শিল্প হিসাবে গ্রহণ করা হয়। পর্যটন থেকে পর্যটক হয়ে বিশ্বব্যাপী অবসরকালীন আমোদ-প্রমোদের এই মাধ্যমকে ইতিমধ্যে অনেক দেশ শিল্পের মর্যাদা দিয়েছে। সংকীর্ণতার ঘেরাটোপ থেকে বেড়িয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে। ট্যুরিস্ট গাইড, পর্যটন সংস্থা, বিনোদন কেন্দ্র, প্রমোদতরী, হোটেল, রিসোর্ট চিত্তবিনোদনের পার্ক, শপিংমল, সঙ্গীত মঞ্চ, থিয়েটার প্রদর্শন কেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহকে ঘষাঁমাজা করে বিনোদন আকর্ষণীয় হিসাবে উপস্থাপন হচ্ছে। প্রতিটি দেশের জাতীয় অর্থনীতির সহায়ক শক্তি হিসাবে অর্থ ব্যবস্থায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে। মোট জাতীয় উৎপাদনের বড় একটি অংশ সংযুক্ত হচ্ছে পর্যটন শিল্প খাত থেকে। এই শিল্পের প্রযোজক-পরিচালক হতে অনেক পন্ডিত বরেণ্য ব্যক্তি, শিল্পপতি অথবা ব্যবসা লোভী কুশীলর বা তাদের বলয় সৃষ্টি করছে।

বিশ্ব পর্যটন সংস্থা দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা, রাজস্ব আয়, পর্যটন খাতে ব্যয় মূল্যায়ন করে সদস্য দেশগুলোর একটি ক্রমতালিকা প্রস্তুত করে। জাতিসংঘের আওতাভুক্ত ভূখন্ড থেকে আসা পর্যটকের উজ্জ্বলতা নিয়ে বছরে তিনবার এই তালিকা প্রকাশ করে। দেখা গেছে আন্তর্জাতিক পর্যটন থেকে আসা রাজস্বে বরাবরই তালিকার শীর্ষে থাকে ইউএসএ। তাদের বাৎসরিক আয় প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। প্রতি বছর তা ৪.২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিমাণের দিক থেকে তাদের ধারেকাছে না থাকলেও তালিকার ক্রমানুসারে স্পেন, ফ্রান্স, চীন, ইতালি, জার্মানি, ইউকে, অস্ট্রেলিয়া, মেকাও, হংকংয়ের পর্যটন খাত বেশ জোরালো।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ও শ্রমঘম শিল্প খাত পর্যটন। প্রকৃতির নন্দিত আবহ তুলে ধরে এই খাতের গড় প্রবৃদ্ধি আগামী ১০ বছর অব্যহত থাকবে ৪.৩ শতাংশ হারে। এই হারের নির্যাস অব্যাহত রাখা খুব একটা কঠিন নয় বলে জানিয়েছে বিশ্ব পর্যটন সংস্থা। তারা জানিয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটনের অবদান বিশ্ব জিডিপির ১১ শতাংশ। বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের ৯ শতাংশ। রপ্তানির ১২ শতাংশ, বৈশ্বিক বিনিয়োগের ১১ শতাংশ। একজন পর্যটকের পেছনে গড়ে ১০ জনের কর্মসংস্থান হিসাব ধরলে প্রায় ৪০ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এই খাতে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ধারাবাহিক টেকসই ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রভাব ফেলা এই খাতের বাৎসরিক আয় বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯.২ ট্রিলিয়ন ডলার। সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এই পর্যটন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা কিংবা ব্যবসা পরিচালনার সুযোগের বাইরে সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনায় অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করে। বিস্তৃত পরিসরে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। পরিবহণ, নির্মাণ, প্রকৌশল, উৎপাদন, কৃষি, খাদ্য, টেলিকম, তথ্যপ্রযুক্তি, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবাসহ আরও অনেক খাতের লালন-পালন প্রয়োজন পড়ে।

বাংলাদেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, প্রতœতত্ত্ব নিদর্শন, ধর্মীয় সম্প্রীতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার পর্যটনের জন্য বহুমাত্রিক আকর্ষণ সমৃদ্ধ নতুন এক গন্তব্য। আর এই কারণেই অতীত থেকে যুগে যুগে ভ্রমণ পাগল দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে ভিড় জমিয়েছেন। আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে বিশ্ববাসীর নিকট সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। আধুনিকতা না থাকলেও ভ্রমণসমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কারণে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদানে ৪.৩০ শতাংশ। আধুনিক পর্যটনকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে ২০২৮ সালে জিডিপিতে নির্ধারণ করা অবদান ৬.৮ শতাংশ অসম্ভব নয়। এখানে জাদুকরি কোন বিদ্যার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন ইতিহাসের অভিজ্ঞতা আর সমসাময়িক বর্ণ ও অলংকরণ।

দেশে স্বনির্ভর পর্যটনের কিছু রুচির নির্মাতা থাকায় প্রতি বছর অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মোট তথ্য না থাকলেও বলা যায় এই সংখ্যা বছরে ন্যূনধিক ৩ কোটি। জীবন-জীবিকা নির্বাহের হিসাবে প্রায় ৪০ লাখ পর্যটনকর্মী এই খাতের সমৃদ্ধির পেছনে জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের বিনোদন পার্ক অ্যাসোসিয়েশন ‘বাপা’র তথ্যমতে সারা বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলে তিন শতাধিক বিনোদন পার্ক, থিম পার্ক, ইকোপার্ক রয়েছে। বর্তমানে বাপার আওতাধীন ১০০টি বিনোদন পার্কে ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। প্রতিদিন এর পরিধি গাণিতিক হারে বাড়ছে। প্রতিবছর ৬ কোটি দর্শনার্থীর আগমনে সেবাপ্রদানকারী কর্মী রয়েছেন প্রায় ৪ লক্ষাধিক।

বাপার আওতাবহির্ভূত বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরও প্রায় ২ সহস্রাধিক পর্যটন আকর্ষণীয় স্থান এই খাতকে তাদের একান্ত মনের তাগিদে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে। অন্তহীন কোন রাখালিয়া গান তাদের এই কাজকে উদ্বুদ্ধ করছে। পর্যটন বিষয়ক সরকারি-বেসরকারি এবং সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে দেশে প্রায় এক হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রায় তিন লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। দেশে ৮৭ হাজার ১৮২টি গ্রাম রয়েছে। কিছু কিছু গ্রাম নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত। পর্যটন সম্পদশালী গ্রামগুলোকে রাস্তাঘাট, অবকাঠামো সুবিধা ব্যবস্থা করতে পারলে গ্রামীণ ও অনগ্রসর এলাকার জনগোষ্ঠীর জীবনমানে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

দেশের ৭ জেলার ৪২৩টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভিত্তিক হাওর রয়েছে। হাওরভিত্তিক পর্যটন বিকশিত করা গেলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আধিবাসীদের বর্ষার অলস সময়ে কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হতো। দেশের ২৪১টি চা বাগান সংশ্লিষ্ট নৈসর্গিক সৌন্দর্যের স্থানসমূহে ভ্রমণপিপাসুকে আকৃষ্ট করলে, সঙ্গে এলাকার স্থানীয় জনগোষ্ঠী জীবন-জীবিকার নতুন খাত হিসাবে বেছে নিতে পারে। দেশের অপার সম্ভাবনার গন্তব্য পার্বত্য এলাকা। এখানের মূল উপকরণ হলো পাহাড়ঘেরা সবুজ প্রকৃতি, নদী, ঝরণা, পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী ও তাদের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জীবনধারা। এখানে ইকো ট্যুরিজম, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম, নেচার ট্যুরিজম, কালচারাল ট্যুরিজম, পাহাড়ে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা বিষয়ে পর্যটন ব্যবস্থা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রবাহ বৃদ্ধি করা যায়।

বাংলাদেশের আরেক অরণ্য রানী সুন্দরবন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। দেশে তো আছে পুরো; পৃথিবীর পর্যটকদের অপার বিনোদন আকর্ষণের এই জায়গা বড়ই অবহেলিত। বিচ্ছিন্ন নয় পরিকল্পিতভাবে পর্যটনবান্ধব করা গেলে পর্যটনের নতুন পর্দা উন্মোচন হতো। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষিত ৫২১টি প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা আছে। এইস্থান-স্থাপনাকে একটি আদর্শ সামনে রেখে পর্যটন সেবামূলক করা গেলে লক্ষ-কোটি মানুষের আগ্রহ-আকাক্সক্ষার জায়গা হতো। ক্ষুদ্র-মাঝারি-স্থানীয় লাখ লাখ জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ধারণ করা যেত। কক্সবাজার পৃথিবীর বিস্ময়। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ধারণ করে আছে প্রাকৃতিক সম্পদের উজ্জ্বল আধার। বিশ্বব্যাপী দর্শন সুখপ্রিয় মানুষের অক্লান্ত আকাক্সক্ষা কক্সবাজার ভ্রমণ। বড়ই দুর্ভাগা জাতি। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের হাতচ্ছানি দেয়া কক্সবাজারে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। বলছি বর্তমান প্রেক্ষাপটের আধুনিক নন্দনতাত্ত্বিক সড়ক ব্যবস্থা। স্বর্পিল-আঁকাবাঁকা এক লেনের এই সড়কযাত্রা এখনো মরণফাঁদ।

বিশ্বে এখন পেশাভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে। পর্যটনের বেলায় আরও দক্ষ অভিজ্ঞ চৌকস ট্যুরিস্ট গাইড সময়ের দাবি

বিশ্ব এখন পেশাভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে। পর্যটনের বেলায় আরও দক্ষ অভিজ্ঞ চৌকস ট্যুরিস্ট গাইড সময়ের দাবি। যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে মাথাভারী করা হচ্ছে পর্যটনকে। এই বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়েছে। অথচ আমাদের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দরকার পর্যটন বিষয়ে মধ্যম মেধার মধ্যম শ্রেণীর শিক্ষা কোর্স। এখানটায় বেশ অবহেলার শিকার। পর্যটন করপোরেশনের মাধ্যমে ৩-৬-৯ মাস মেয়াদি স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই কম। গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের ভাবনা-চিন্তা এখনো পরিকল্পনার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। পর্যটন সেবাদানে দক্ষ জনশক্তি আর নিবিড়ত দারকির জোরালো ব্যবস্থা না থাকায় নিয়ত প্রতিনিয়তই ভ্রমণযাত্রীদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। সলিল সমাধি ঘটে আমাদের তরুণ-যুব-ভ্রমণপ্রিয় জনগোষ্ঠীর। এই দায় বাংলাদেশের পর্যটন মন্ত্রণালয়, পর্যটন করপোরেশন, পর্যটন বোর্ড এড়াতে পারে না।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনের অপার সম্ভাবনা মাঝে মাঝে ধূলোয় মিশে যায়। এক ধরনের অনিশ্চয়তা নেমে আসে। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে অব্যহত রাখতে পর্যটনের খাতকে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার স্পর্শ বুলাতে হবে। পর্যটন দিবসের ভাবনাও এই। স্বতঃষ্ফূর্তভাবে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো। পর্যটনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানবিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতা আর সচেতনতা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা। বাংলাদেশ সেই চ্যালেঞ্জ সানন্দে গ্রহণ করবে আজকের দিনে এই প্রত্যাশা।

[লেখক : সমাজকর্মী ]

back to top