মনির উদ্দিন
কাঁঠালমূলত ভারতীয় উপমহাদেশের ফল যা গ্রীষ্মম-লীয় দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনসহ অন্যান্য গ্রীষ্মম-লীয় দেশে জন্মায়। সারাদেশেই কমবেশি উৎপাদন হওয়ায় কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল হিসেবে বিবেচিত। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে এমন কোনো জেলা নেই যেখানে কাঁঠাল হয় না। লালমাটি কাঁঠাল উৎপাদনের জন্য সর্বোত্তম। আর এজন্য সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয় মধুপুর ও ভাওয়াল গড় এলাকা ও তিন পার্বত্য জেলায়।
কাঁঠালের খুব বিস্তৃত কৃষি-বাস্তুসংস্থানীয় অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে যার কারণে দেশের প্রতিটি গ্রামেই কাঁঠাল গাছ দেখা যায়। ফল ব্যতীত কাঁঠাল গাছের অন্যসব অংশের অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। দেশে বিশেষ কিছু এলাকায় কাঁঠাল বেশি পরিমাণে হয়ে থাকে যার মধ্যে মধুপুর ও ভাওয়াল গড়, পার্বত্য জেলা বান্দরবন, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট উল্লেখযোগ্য। ২০ বছর আগে কাঁঠাল ও আম এ দেশের প্রধান ফল ছিল। সময়ের ব্যবধানে দেশের ফল উৎপাদনে এক নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এখন কাঁঠালের মৌসুমে বাহারি রকমের আম, লিচু, আনারস, পেয়ারাসহ বিভিন্ন রকম ফলের উৎপাদন বেড়েছে যার কারণে চাহিদা কমেছে জাতীয় ফল কাঁঠালের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে বছরে প্রায় ১৯ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয় এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ এই ফলটির ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। অন্য সূত্রমতে, ২০২১ সালে ৬৫,৩৬৪ হেক্টর জমিতে ১৮.৬৯ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়েছে যার ফলন হেক্টর প্রতি ২৮.৫৯ টন। আগের বছরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে ৩,৪৯০ টন। কাঁঠাল দেশের ফল উৎপাদনের প্রায় ২২ শতাংশ। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে, দেশের মোট ফল উৎপাদন ছিল ১.২২ কোটি টন। দেশের ৩২.১ মিলিয়ন পরিবারের বসতবাড়িতে অবহেলা ও অযত্নে জন্মায় এই জাতীয় ফল।
কাঁঠাল হলো শীর্ষ শ্রেণীর ফল যার মধ্যে পুষ্টির মাত্রা সর্বোচ্চ। দেশের মানুষের খাদ্য তালিকায় কাঁঠাল ফাইবার, ভিটামিন, প্রোটিন, খনিজ এবং ক্যালরির উৎস হিসেবে গ্রামীণ ও শহরের মানুষের পুষ্টিতে অবদান রাখে। তাছাড়া কাঁচা ও পাকা উভয় কাঁঠালের মধ্যে যেসব পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়-ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন-এ, থায়ামিন, রিবোফ্লোবিন, ভিটামিন-সি, পাইরিডক্সিন, নায়াসিন, ফলিক এসিড উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন প্রকারœ ডালে ২০-২৬ শতাংশ প্রোটিন থাকে, গরুর মাংসে প্রোটিন ২৬-২৭ শতাংশ, মুরগির মাংসে ৩১ শতাংশ, মাছে ১০-১৭ শতাংশ, আর কাঁচা কাঁঠালে প্রোটিন পাওয়া যায় ১০ শতাংশ। তাই, কাঁঠাল হতে পারে মাছ বা মাংসের বিকল্প খাদ্য উৎস।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, আমাদের শরীরের অর্ধেকেরও বেশি ক্যালরি আসে মাত্র নয়টি উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে, যদিও আনুমানিক ২৭,৫০০টি ভোজ্য উদ্ভিদ সারাবিশ্বে রয়েছে। অব্যবহ্নত ধরনের খাদ্যের বৈচিত্র্য আনা হলো খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা উন্নত করার একটি অন্যতম উপায়। আর তার সহজ এক উদাহরণ হলো কাঁঠালের খাদ্যপণ্যের উৎপাদনের মধ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসা। বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণে একশ্রেণীর মানুষের বিশেষ করে চল্লিশর্ধো মানুষের অনেকেই পাকা কাঁঠাল খেতে পারছেন না। অন্যদিকে আঠাযুক্ত হওয়ার কারণে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও পাকা কাঁঠাল খাওয়ার প্রবণতা অনেক কম। আর এ সমস্ত কারণে কাঁঠালের এই ব্যাপক পরিমাণ অপচয় হয়ে থাকে।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দেশের গবেষকরা কাঁঠাল দিয়ে এমন কিছু খাদ্যপণ্য তৈরি করার চেষ্টা করছেন যা কয়েক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে শুধু পাকা কাঁঠাল খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। যেহেতু পাকা কাঁঠাল খাওয়ার প্রবণতা বিভিন্ন কারণে কমে গিয়েছে তাই এর বিকল্প অর্থাৎ কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে উঠে এসেছে, কাঁচা কাঁঠালের মধ্যে ১০ শতাংশ পর্যন্ত প্রোটিন পাওয়া যায় যা মাংস বা মাছের বিকল্প হিসেবে খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার যত বেশি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করা হবে তত বেশি এই ফলের অপচয় কমে আসবে। কাঁঠাল উৎপাদনের বড় একটি অংশ যদি কাঁচা হিসেবে ব্যবহার বাড়ানো যায় তা একদিকে যেমন খাদ্যনিরাপত্তায় সহায়ক হবে সেই সঙ্গে মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তায়ও ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
অনেক মানুষের ধারণা যে, কাঁঠাল শুধু পাকলেই খাওয়া যায়। কাঁচা কাঁঠাল যে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি করে খাওয়া যায় এবং কাঁচা কাঁঠালে যে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিনসহ নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে তা আমরা জানি না। প্রোটিনের বিকল্প হিসেবে কাঁচা কাঁঠাল আমাদের খাদ্য তালিকায় যুক্ত হতে পারে। পাকা কাঁঠালের পাল্প বা কোয়া খাওয়া হয়। কাঁঠাল স্বাদের দিক দিয়ে দুই রকমের হয়ে থাকে। প্রথমত, খাজা কাঁঠাল যার পাল্প কিছুটা শক্ত প্রকৃতির, খেতে কচ কচ করে এবং অনেকের কাছে এই কাঁঠাল বেশি পছন্দের। অন্যটি গালা কাঁঠাল যার পাল্প নরম ও রসালো এবং এটি রস করে খাওয়ার জন্য খুবই উপযোগী। কাঁঠালের বীজ একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদপণ্য যা বিভিন্নভাবে খাওয়া যায়। গ্রামীণ এলাকায় কাঁঠালের বীজ সিদ্ধ করে ভর্তা বানিয়ে ভাতের সঙ্গে খাওয়া একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। অন্য তরকারির সঙ্গেও কাঁঠালের বীজ ব্যবহার করা হয়। আবার বীজ ভেজে খাওয়া যায় যার অন্যরকম একটি স্বাদ রয়েছে।
সাপ¥্রতিক সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কাঁঠাল থেকে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি করে সফল হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে কাঁঠালের জ্যাম, আচার, চাঁনি, চিপস, কাটলেট, আইসক্রিম, দই, মাংসের বিকল্প হিসেবে কাঁচা কাঁঠালের সব্জি বা তরকারি রান্না করে খাওয়া, কাঁঠালের পাউডার, কাঁঠালের বীজের পাউডার এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্যাকেটজাত পণ্য যাতে করে গ্রাহকরা সারা বছর কাঁঠালের তৈরি বিভিন্ন পণ্য বাজারে পেতে পারেন। অর্থাৎ কাঁঠাল থেকে ৩০টিরও বেশি বিকল্প খাদ্যপণ্য তৈরি করে সারাবছর ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমানে বাজারে কাঁচা কাঁঠালের ভেজিটেবল রোল, কাটলেট, সিংগারা তৈরি করে বাজারে বিক্রয় হচ্ছে। আবার পাকা কাঁঠালের রস দিয়ে আইসক্রিম, কেক, ফ্রুট রোল-আপ তৈরি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁঠালের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কাঁঠাল রপ্তানি ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কাঁঠাল রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১,০০০ টন। হবিগঞ্জের বড় ও ভালোমানের কাঁঠাল রপ্তানি হয় কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে। প্রক্রিয়াজাত কাঁঠালও রপ্তানির তালিকায় রয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে প্রক্রিয়াজাত কাঁঠাল পণ্য রপ্তানি শুরু করে এবং এর মাধ্যমে দেশের রপ্তানির পরিসরে বৈচিত্র্য আসে। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনকারী এবং বণিক সমিতির (ইঅচচগঅ) অধীনে ২০১৯ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশে কাঁঠাল থেকে তৈরি অসমেটিক ডিহাইড্রেটেড খাবার ও কাঁঠালের বীজের গুঁড়া রপ্তানি করেছে।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পাকা কাঁঠালের ১০-১২টি কোয়া খেলে তার অর্ধেক দিনের আহার হয়ে যায়। কাঁঠাল পাকার পর বেশি দিন সংরক্ষণ করা য়ায় না। তাই এর বিকল্প ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে সব শ্রেণীর মানুষের পুষ্টিমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। কাঁঠালের বীজ ও ফল শুকিয়ে বেকিং ময়দা তৈরি করা যায় যা যে কোন সবজি বা তরকারিতে ব্যবহার করে খাদ্যের মান বাড়ানো যায়। বিএআরসি (ইঅজঈ) কাঁঠালের বার্গারের ফুড ভেল্যু পরীক্ষা করে যা পেয়েছে তাতে কাঁচা কাঁঠালের তৈরি বার্গারের প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালের প্যাটিতে ৯.৭৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১০.৮৭ গ্রাম প্রোটিন, ৮.৪৭ গ্রাম চর্বি, ১৯.৩২ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার এবং ১৫৯ কিলোক্যালরি শক্তি থাকে। নিরামিষভোজীদের জন্য কাঁচা কাঁঠালের বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্য জোগান দিতে পারে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও চর্বি। অথচ যথাযথ প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে এই ফলের বিভিন্ন খাদ্যপণ্য দেশের মানুষের পুষ্টিমান উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্বের অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের পুষ্টি উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
দেশে প্রতি বছর উৎপাদিত প্রায় ১৯ লাখ টন কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে এবং এজন্য সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং দেশের প্রাইভেট সেক্টরগুলোকে একসঙ্গে মিলে কাজ করে যেতে হবে। আর এভাবেই দেশের জাতীয় ফলের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে এর অপচয় রোধ হবে।
[লেখক: কৃষিবিদ; কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ]
মনির উদ্দিন
শনিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৪
কাঁঠালমূলত ভারতীয় উপমহাদেশের ফল যা গ্রীষ্মম-লীয় দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনসহ অন্যান্য গ্রীষ্মম-লীয় দেশে জন্মায়। সারাদেশেই কমবেশি উৎপাদন হওয়ায় কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল হিসেবে বিবেচিত। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে এমন কোনো জেলা নেই যেখানে কাঁঠাল হয় না। লালমাটি কাঁঠাল উৎপাদনের জন্য সর্বোত্তম। আর এজন্য সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয় মধুপুর ও ভাওয়াল গড় এলাকা ও তিন পার্বত্য জেলায়।
কাঁঠালের খুব বিস্তৃত কৃষি-বাস্তুসংস্থানীয় অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে যার কারণে দেশের প্রতিটি গ্রামেই কাঁঠাল গাছ দেখা যায়। ফল ব্যতীত কাঁঠাল গাছের অন্যসব অংশের অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। দেশে বিশেষ কিছু এলাকায় কাঁঠাল বেশি পরিমাণে হয়ে থাকে যার মধ্যে মধুপুর ও ভাওয়াল গড়, পার্বত্য জেলা বান্দরবন, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট উল্লেখযোগ্য। ২০ বছর আগে কাঁঠাল ও আম এ দেশের প্রধান ফল ছিল। সময়ের ব্যবধানে দেশের ফল উৎপাদনে এক নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এখন কাঁঠালের মৌসুমে বাহারি রকমের আম, লিচু, আনারস, পেয়ারাসহ বিভিন্ন রকম ফলের উৎপাদন বেড়েছে যার কারণে চাহিদা কমেছে জাতীয় ফল কাঁঠালের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে বছরে প্রায় ১৯ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয় এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ এই ফলটির ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। অন্য সূত্রমতে, ২০২১ সালে ৬৫,৩৬৪ হেক্টর জমিতে ১৮.৬৯ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়েছে যার ফলন হেক্টর প্রতি ২৮.৫৯ টন। আগের বছরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে ৩,৪৯০ টন। কাঁঠাল দেশের ফল উৎপাদনের প্রায় ২২ শতাংশ। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে, দেশের মোট ফল উৎপাদন ছিল ১.২২ কোটি টন। দেশের ৩২.১ মিলিয়ন পরিবারের বসতবাড়িতে অবহেলা ও অযত্নে জন্মায় এই জাতীয় ফল।
কাঁঠাল হলো শীর্ষ শ্রেণীর ফল যার মধ্যে পুষ্টির মাত্রা সর্বোচ্চ। দেশের মানুষের খাদ্য তালিকায় কাঁঠাল ফাইবার, ভিটামিন, প্রোটিন, খনিজ এবং ক্যালরির উৎস হিসেবে গ্রামীণ ও শহরের মানুষের পুষ্টিতে অবদান রাখে। তাছাড়া কাঁচা ও পাকা উভয় কাঁঠালের মধ্যে যেসব পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়-ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন-এ, থায়ামিন, রিবোফ্লোবিন, ভিটামিন-সি, পাইরিডক্সিন, নায়াসিন, ফলিক এসিড উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন প্রকারœ ডালে ২০-২৬ শতাংশ প্রোটিন থাকে, গরুর মাংসে প্রোটিন ২৬-২৭ শতাংশ, মুরগির মাংসে ৩১ শতাংশ, মাছে ১০-১৭ শতাংশ, আর কাঁচা কাঁঠালে প্রোটিন পাওয়া যায় ১০ শতাংশ। তাই, কাঁঠাল হতে পারে মাছ বা মাংসের বিকল্প খাদ্য উৎস।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, আমাদের শরীরের অর্ধেকেরও বেশি ক্যালরি আসে মাত্র নয়টি উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে, যদিও আনুমানিক ২৭,৫০০টি ভোজ্য উদ্ভিদ সারাবিশ্বে রয়েছে। অব্যবহ্নত ধরনের খাদ্যের বৈচিত্র্য আনা হলো খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা উন্নত করার একটি অন্যতম উপায়। আর তার সহজ এক উদাহরণ হলো কাঁঠালের খাদ্যপণ্যের উৎপাদনের মধ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসা। বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণে একশ্রেণীর মানুষের বিশেষ করে চল্লিশর্ধো মানুষের অনেকেই পাকা কাঁঠাল খেতে পারছেন না। অন্যদিকে আঠাযুক্ত হওয়ার কারণে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও পাকা কাঁঠাল খাওয়ার প্রবণতা অনেক কম। আর এ সমস্ত কারণে কাঁঠালের এই ব্যাপক পরিমাণ অপচয় হয়ে থাকে।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দেশের গবেষকরা কাঁঠাল দিয়ে এমন কিছু খাদ্যপণ্য তৈরি করার চেষ্টা করছেন যা কয়েক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে শুধু পাকা কাঁঠাল খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। যেহেতু পাকা কাঁঠাল খাওয়ার প্রবণতা বিভিন্ন কারণে কমে গিয়েছে তাই এর বিকল্প অর্থাৎ কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে উঠে এসেছে, কাঁচা কাঁঠালের মধ্যে ১০ শতাংশ পর্যন্ত প্রোটিন পাওয়া যায় যা মাংস বা মাছের বিকল্প হিসেবে খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার যত বেশি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করা হবে তত বেশি এই ফলের অপচয় কমে আসবে। কাঁঠাল উৎপাদনের বড় একটি অংশ যদি কাঁচা হিসেবে ব্যবহার বাড়ানো যায় তা একদিকে যেমন খাদ্যনিরাপত্তায় সহায়ক হবে সেই সঙ্গে মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তায়ও ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
অনেক মানুষের ধারণা যে, কাঁঠাল শুধু পাকলেই খাওয়া যায়। কাঁচা কাঁঠাল যে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি করে খাওয়া যায় এবং কাঁচা কাঁঠালে যে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিনসহ নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে তা আমরা জানি না। প্রোটিনের বিকল্প হিসেবে কাঁচা কাঁঠাল আমাদের খাদ্য তালিকায় যুক্ত হতে পারে। পাকা কাঁঠালের পাল্প বা কোয়া খাওয়া হয়। কাঁঠাল স্বাদের দিক দিয়ে দুই রকমের হয়ে থাকে। প্রথমত, খাজা কাঁঠাল যার পাল্প কিছুটা শক্ত প্রকৃতির, খেতে কচ কচ করে এবং অনেকের কাছে এই কাঁঠাল বেশি পছন্দের। অন্যটি গালা কাঁঠাল যার পাল্প নরম ও রসালো এবং এটি রস করে খাওয়ার জন্য খুবই উপযোগী। কাঁঠালের বীজ একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদপণ্য যা বিভিন্নভাবে খাওয়া যায়। গ্রামীণ এলাকায় কাঁঠালের বীজ সিদ্ধ করে ভর্তা বানিয়ে ভাতের সঙ্গে খাওয়া একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। অন্য তরকারির সঙ্গেও কাঁঠালের বীজ ব্যবহার করা হয়। আবার বীজ ভেজে খাওয়া যায় যার অন্যরকম একটি স্বাদ রয়েছে।
সাপ¥্রতিক সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কাঁঠাল থেকে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি করে সফল হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে কাঁঠালের জ্যাম, আচার, চাঁনি, চিপস, কাটলেট, আইসক্রিম, দই, মাংসের বিকল্প হিসেবে কাঁচা কাঁঠালের সব্জি বা তরকারি রান্না করে খাওয়া, কাঁঠালের পাউডার, কাঁঠালের বীজের পাউডার এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্যাকেটজাত পণ্য যাতে করে গ্রাহকরা সারা বছর কাঁঠালের তৈরি বিভিন্ন পণ্য বাজারে পেতে পারেন। অর্থাৎ কাঁঠাল থেকে ৩০টিরও বেশি বিকল্প খাদ্যপণ্য তৈরি করে সারাবছর ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমানে বাজারে কাঁচা কাঁঠালের ভেজিটেবল রোল, কাটলেট, সিংগারা তৈরি করে বাজারে বিক্রয় হচ্ছে। আবার পাকা কাঁঠালের রস দিয়ে আইসক্রিম, কেক, ফ্রুট রোল-আপ তৈরি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁঠালের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কাঁঠাল রপ্তানি ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কাঁঠাল রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১,০০০ টন। হবিগঞ্জের বড় ও ভালোমানের কাঁঠাল রপ্তানি হয় কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে। প্রক্রিয়াজাত কাঁঠালও রপ্তানির তালিকায় রয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে প্রক্রিয়াজাত কাঁঠাল পণ্য রপ্তানি শুরু করে এবং এর মাধ্যমে দেশের রপ্তানির পরিসরে বৈচিত্র্য আসে। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনকারী এবং বণিক সমিতির (ইঅচচগঅ) অধীনে ২০১৯ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশে কাঁঠাল থেকে তৈরি অসমেটিক ডিহাইড্রেটেড খাবার ও কাঁঠালের বীজের গুঁড়া রপ্তানি করেছে।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পাকা কাঁঠালের ১০-১২টি কোয়া খেলে তার অর্ধেক দিনের আহার হয়ে যায়। কাঁঠাল পাকার পর বেশি দিন সংরক্ষণ করা য়ায় না। তাই এর বিকল্প ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে সব শ্রেণীর মানুষের পুষ্টিমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। কাঁঠালের বীজ ও ফল শুকিয়ে বেকিং ময়দা তৈরি করা যায় যা যে কোন সবজি বা তরকারিতে ব্যবহার করে খাদ্যের মান বাড়ানো যায়। বিএআরসি (ইঅজঈ) কাঁঠালের বার্গারের ফুড ভেল্যু পরীক্ষা করে যা পেয়েছে তাতে কাঁচা কাঁঠালের তৈরি বার্গারের প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালের প্যাটিতে ৯.৭৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১০.৮৭ গ্রাম প্রোটিন, ৮.৪৭ গ্রাম চর্বি, ১৯.৩২ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার এবং ১৫৯ কিলোক্যালরি শক্তি থাকে। নিরামিষভোজীদের জন্য কাঁচা কাঁঠালের বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্য জোগান দিতে পারে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও চর্বি। অথচ যথাযথ প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে এই ফলের বিভিন্ন খাদ্যপণ্য দেশের মানুষের পুষ্টিমান উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্বের অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের পুষ্টি উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
দেশে প্রতি বছর উৎপাদিত প্রায় ১৯ লাখ টন কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে এবং এজন্য সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং দেশের প্রাইভেট সেক্টরগুলোকে একসঙ্গে মিলে কাজ করে যেতে হবে। আর এভাবেই দেশের জাতীয় ফলের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে এর অপচয় রোধ হবে।
[লেখক: কৃষিবিদ; কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ]