alt

সাময়িকী

নিছক সাজুর গল্প

আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ

: বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০২৪

কাচাগোল্লার জন্য যে কালনার একটা সুনাম আছে, তা আজই প্রমাণ পেলো জ্বগদ্বীশ ঘোষের মিষ্টির দোকানে এসে। যেমন স্বাদ আর ঘ্রাণের কথা শুনেছিলো তেমনি-ই আছে বাস্তবে। প্রথমে ১০০ গ্রাম এবং পরে আরো ৫০ গ্রাম খেয়ে তৃপ্ত হয় সাজু। একটা পাতা বিড়ি ধরিয়ে একটানা কয়েকটা দম দিতে থাকে। কালনায় যাকে বলে কাচাগোল্লা, শান্তিপুরে তা মাখাসন্দেশ নামে পরিচিত। দুটো নামই কী চমৎকার! দুধের ছানা চিনি এবং গরমমসলা মিশ্রিত এই মিষ্ঠান্ন, মাখাসন্দেশ অর্থাৎ কাচাগোল্লাকে জড়িয়ে অনেক কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে স্থানীয় লোকের মুখে-মুখে।

একবার নাকি ভারতবর্ষের বিখ্যাত নেতা করমচাঁদ গান্ধী কালনার ওপর দিয়ে ট্রেনে যেতে গিয়ে কালনায় নেমেছিলেন এবং কিঞ্চিৎ মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, তোমাদের কবি অর্থাৎ বাঙালিবাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলো, বাংলায় আসলে কালনার মাখাসন্দেশ খেয়ো...

ওদিকে আরেকজন ধোপদুরস্ত আপদমস্তক বাঙালি বিদ্যাসাগর মহাশয়, সে তো আজীবন কালনার মাখাসন্দেশের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। জনশ্রুতি আছে, এমন কোনোদিন ছিলো না, কালনার মাখাসন্দেশ তার বাড়ি যায়নি। শুধু কি তাই! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তো শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে থাকার আগে থেকে কালনার মাখাসন্দেশে আসক্ত ছিলেন। লোকমুখে প্রচার, কালনার মাখাসন্দেশ, শান্তিপুরের রসগোল্লা আর বর্ধমানের মিহিদানা খাবার জন্যই নাকি কবিগুরু শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। আরেকজন তো বাদ পড়ে গেলো, হ্যাঁ ঝাঁকড়া বাবরি চুলের কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সে তো ওই কালনার পাশে চুরুলিয়ায় জন্মেছিলেন। বর্ধমানের মিহিদানা আর মাখাসন্দেশের মতো সুরোত নিয়ে কবির এই আর্বিভাব। মিষ্টির স্বাদ জিহ্বার আগায় থাকার কারণে বাংলার মানুষকে কঠিনভাবে বশীকরণ করতে পেরেছিলেন, কালনার মাখাসন্দেশ বাংলার সুনাম রক্ষা করেছে সন্দেহ নেই।

বিড়িটা শেষ করে আরো ২৫০ গ্রামের অর্ডার দেয় সাজু, শালপাতায় মুড়িয়ে দেওয়া হয় তাকে। দাম পরিশোধ শেষে দোকান থেকে বের হয়। শালপাতায় মোড়ানো মাখাসন্দেশ সাজুর হাতে। দত্তপাড়ায় যাবে কানাইলাল কবিরাজের বাড়ি। কালনায় প্রথম আসছে সে। দত্তপাড়া এখান থেকে আর কতোদূর তা ওর জানার কথা নয়। ঠিকানা অনুযায়ী লোকমারফতে জেনে-জেনে সেখানে পৌঁছাতে হবে, কালনা বাজার থেকে দক্ষিণের ইট বিছানো চার কিলোমিটার পথ। ভ্যানরিকশা এখন একমাত্র অবলম্বন। সাজু সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অবশেষে ভ্যানরিকশায় গিয়ে চাপলো। পেছনে দু’পা ঝুলিয়ে যেতে থাকে, তারপর অনেক চিন্তার মধ্যে ডুবে যায়।

দুপুর সন্নিকটে একেবারে। মাথার মাঝখানে হা-হাভাতের মতো গনগনে অগ্নিপি- সূর্যটা জিহ্বা বার করে রক্তলোলুপ চোখে তাকিয়ে। জ্যৈষ্ঠের মাটি ফাঁটা রোদের ভয়েই সাজু ফজর আজানের সাথে-সাথে বাড়ি থেকে বার হয়। কিন্তু আইজুলের মা যেভাবে এসে চেপে ধরলো, বাপ আমার হাসপাতালে একবার আইজুলকে দেখে আসিস...

আইজুল সপ্তাহ দুই ধরে শান্তিপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি। ছোড়াটা আর ভালো হলো না। বাপটা যে বছর মরলো, সে বছরই বাপের ব্যবসার পুঁজি-পাট্টা সিকেয় তুলে ফলিয়ার ফকির হয়ে গেলো। একেই বলে ভাগ্য আর কি! কিন্তু শালা ভাগ্য ব্যাটা করবেটা কী! নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে না জানলে ভাগ্য কি হাত ধরে তুলে দাঁড় করাবে। হাসপাতালে ওই আইজুলের সঙ্গে দুটো কথা আর সান্ত¡না দিতে গিয়েই বেলাটা বেড়ে গেলো। নয়তো ফলিয়া থেকে সরাসরি বাসে চেপে শান্তিপুর ডাকঘর মোড়ে এবং একটু হেঁটেই শান্তিনগর, সেখান থেকে ভ্যানরিকশায় কালনায় আসতে আর কতোক্ষণ। বড় জোর ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। কিন্তু হাসপাতালে গিয়েই সময়টা অকারণে খরচা হলো সাজুর।

বাপের পেশাটা ধরে রাখতে পারলো না হারামজাদা। তাঁতের কাজটা কি আর এই-সে-ই পেশা। বাব্বারে বাব্বা, একটু বুদ্ধি খাটালে তো কেল্লা ফাতে, কে আর পায় কাকে। ডালভাতের অভাব কোথায় পালিয়ে যায় শিয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে। নাহ্, তা ধরে রাখতে পারলো না জমিদার বাবু! তাঁতের কাজ করলে নাকি লোকে বলবে তাঁতি, কি এক আলতু-ফালতু যুক্তি দেখো দিকি।

বখাটে আর ছন্নছাড়া বন্ধুদের কথা শুনে হারামজাদা তাঁতের কল বিক্রি করে শান্তিপুর সিনেমা হলের টিকিট চেকারের চাকুরি নিলো। সাজু তখনো দেখেছে ওকে, সে কি শালার অহংকার। বাবরি চুল মাথা ভর্তি, প্যান্টের ভেতর জামা গুঁজে ফুল বাবু সেজে ফি সপ্তাহে ফলিয়ায় যেতো। ডান হাতে ঘড়ি, বাম হাতে ব্যান্ড বাঁধা, চোখে কালার সানগ্লাস, হিল তোলা জুতো। সে কি তার চেহারার চেকনাই। শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খুলে বুকের কালো-কালো পশম দেখিয়ে হাঁটতো চোখ আকাশের দিকে তুলে। মুম্বের শাহরুখ খান বা সালমান খান যেনবা, সবই স্মরণে আছে সাজুর।

সেই শালা আইজুল আজ শান্তিপুর হাসপাতালে। তাও আবার বেডের নিচে ফ্লডিংয়ে, জীবনে এই প্রথম সাজু শান্তিপুর হাসপাতালে ঢুকলো। কী বিচ্ছিরি ব্যবস্থা, মশা-মাছি-আরশোলা রক্ত-পূজ-বমি-পায়খানা। ফিনাইন-ডিটল ঔষধ আর নোংরা দুগর্ন্ধে শরীর ঘিনঘিন করছে এখনো। তারও পর ওইটুকু রুমে গাদাগাদি দশ/বারো জনের জায়গায় বাইশ থেকে ছাব্বিশ জন রোগী, আবার আত্মীয়স্বজন তো আছেই।

কলকাতা চিড়িয়াখানার সাপের ঘরের মতো অবস্থা। একেই বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। কী দরকার ছিলো বাবা, রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া। মানুষ তো ইচ্ছে করলেই আস্তে-সুস্তেও বড় হতে পারে। কে আর কাকে আটকাচ্ছে একালে। হারামজাদা সিনেমা হলের মালিকের বাড়ি ডাকাতি করতে যাওয়াটা উচিত হয় কি? যে তোর অন্ন জোগায়, যার টাকায় উটকো ফুটানি মারতিস, তার ওপর ওমন হয় কি? ওমন অত্যাচার কি আল্লাও সহ্য করে কখনো। বন্ধু-বান্ধব এখন কোথায়? বাস্তব কতো কঠিন। এখন বাস্তবে ফিরে এসে দেখ্ শালা! কতো ধানে কতো চাল!

জীবন যেমন কঠিন, জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়াও বড় কঠিন। যাদের নিয়ে একসঙ্গে মালিকের বাড়ি ডাকাতি করতে গেলি, তারা সব কোথায় এখন। কেউ তো এগিয়ে আসছে না। এখন হাড়ে-হাড়ে বুঝে নে, জীবন মানেই পালিয়ে বেড়ানো। সবাই পালিয়ে যেতে পারলো ঠিকই আর ধরা পড়ে তুই এখন... একেই বলে অন্যায় করলে কারো নিস্তার নেই। রামধোলাই খেয়ে মরছিস ব্যাটা হাসপাতালে। এর চেয়ে কি বাপের পেশা ভালো ছিলো না। নিজের দেশে কোন্ শালার ক্ষমতা ঘাড়ে হাত দেয়, এরই নাম অতি লোভে তাতি নষ্ট।

শালপাতায় মোড়ানো মাখাসন্দেশ হাতে দত্তপাড়ার কানাই কবিরাজের বাড়ির কাছাকাছি আসে সাজু। দুপুরটা এখন মাথার ওপর। বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে পানি পিপাশায়। কানাই কবিরাজের বাড়ি পানি পাওয়া যাবে না। সেকেলে আর রক্ষণশীল মানুষ বলে পুরানো চিন্তাটা এখনো আঁকড়ে আছে। ম্লেচ্ছ যবন অর্থাৎ মুসলমানদের একটু বাঁকা চোখেই দেখে। বাড়ির আঙিনা অবধি প্রবেশ করতে পারে কিন্তু নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সে অধিকারও নেই। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম বলা যায়। বাইরে থেকে ডাকলে কবিরাজ নিজে গিয়ে দেখা করে কথা বলে। জাত ফাত বা বর্ণবাদের কথা কেউ তার সামনে মুখ ফসকে বললে, সে তখন আচমকা খেঁকিয়ে উত্তর দেয়, দুটো পয়সার জন্য কি জাতটাকে খুইয়ে বসবো...

তারপর আরো খানিক ক্ষিপ্ত হয়ে জানায়, আরে মশাই উটকো বোলচাল ছাড়ো দিকিনি, গরিব হয়েছি বলে কি ধর্ম-কর্ম ছেড়ে দেবো বলতে চাও।

সাজু বাইরের একটা চায়ের স্টলে ঢোকে। বিস্কুট আর কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে নিজেকে একটু সতেজ করে। তারপর চায়ের পেয়ালায় মুখ দেয়। কানাই কবিরাজের হাতযশ বেশ।

গরম বাতাস জাঁপটে এসে শরীরে ধাক্কা দেয় অকস্মাৎ। কোথায় একটা পাখি ডেকে উঠলো। সাজু আনমনে চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাখিটার অস্তিত্ব আবিস্কার করতে থাকে। তারপর ক্ষণিক তাকিয়ে থাকে তন্ময় হয়ে নীল আকাশের দিকে। কানাই কবিরাজ ভারি ধান্দাবাজ মানুষ বটে। টাকা ছাড়া অন্য কিছুই বোঝে না। টাকা নাকি তাকে আজো বাঁচিয়ে রেখেছে, সাত-পাঁচ গাঁয়ের লোকে তাই অনুমান করে। নয়তো এতো বয়সে মানুষ বাঁচে কেমন ভাবে। বয়স তার যতোই হোক না কেন। কবিরাজী ঔষধ লতাপাতা শেকড়বাকড় খেয়ে নাকি শরীর আর যৌবনকে আজো পঁচিশ/তিরিশ বছরের যুবকের মতো রেখেছে। যৌবনের কেমন শক্তি, তার প্রমাণ ঘরে ওর চার চারটে জ্বল-জ্বলন্ত বউ আজো। এবং তারা পুরোদস্তুর স্বামী সেবাই অস্থির থাকে। তাছাড়াও কানাই কবিরাজের কৃষ্ণের স্বভাব আছে। কখনো-সখনো এদিকে সেদিকে ছুটে যায়। সেই দড়ি ছাড়া পাগলা ষাঁড়ের মতো।

সাজু সবই ওই মানুষের মুখে মুখে শুনেছে আর কি। তবে কয়েকদিন ওই সেই শান্তিপুরের ঢাকিপাড়ার টুলটুলির ঘরে দেখেছিলো সাজু। টুলটুলি হলো নদীয়া অপেরার ঝুমুরওয়ালী। সরু কোমর চওড়া মাজা দোলানো দেখতে কতো সাহেব সুবো পতঙ্গের মতো ছুটে আসে। সাজুও একসময় মাঝে-সাঝে যেতো-টেতো ওর চাতালে। কানায়ের ক্ষমতা আছে ঢের। এমন মানুষও যে সমাজে আছে এখনো, তা ভাবলে শরীরে শিহরন জাগে। শুধু ফলিয়ার হামিদালী মিস্ত্রীর পরামর্শে জানতে পেরেছে কানায়ের কথা। তাছাড়া কি এমন প্রয়োজন ছিলো এমন লোকের সংবাদ জানার। সাজুর রোগ অনেককালের, কোনোদিনই রোগের কথাটা ফাঁস করতো না সে। কিন্তু সেদিন কৃষ্ণনগরের বলাকা দলের যাত্রা দেখে ফিরছিলো হামিদালীর সাইকেলে চেপে। একসময় হামিদালী বলে ওঠে, চলো মিয়া রাতটা আর ফলিয়ায় ফিরে না গিয়ে বরং সীমা বাইজীর দাওয়ায়...

সাজু কথাটা শুনে একটু ইতস্তত করে, ঘরে তো আমার বউ আছে গো!

বউ শব্দটা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে হামিদালী। তারপর নিজেকে সংবরণ করলো, দূর মিয়া, তুমি তো দেখছি একটা ইয়ে, ইয়ে মানে রাঙা মুলো, বউ কি শালা শুধু তোমারই আছে,আমরা বুঝি খোঁজা নাকি!

সাজু অনেকক্ষণ ঘ্যাঁত মেরে থাকে, না থাক্, এর বেশি কথা বাড়ানো উচিত নয়। হামিদালী লোকটা একটু ওমনই মুখরো। মুখে যা আসে তাই বকর-বকর করে আউড়ে যায়।

বেশ কিছুসময় সাত-পাঁচ ভেবে সাজু নিজে থেকেই আবার বললো, হামিদ ভাই একটা কথা বলবো, পরামর্শ দেবেন কি?

হিসহিসিয়ে হামিদালী একটু খেঁকিয়ে ওঠে, পরামর্শ দেবো মানে কিসের ব্যাপারে আগে বলবে তো!

রাত্রের থকথকে কালো অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে না পেলেও দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাস স্পষ্ট টের পায়। আর ফলিয়ার টিকি এখনো অনেক অনেক দূরে, হামিদালীর শরীরে নেশা ধরেছে বোঝে সাজু। সীমা বাইজী তার এই পরম নেশা দূর করতে পারবে হয়তো। যাত্রার মেয়েটি যেভাবে সরু কোমর আর চওড়া নিতম্ব দুলিয়ে, সে সঙ্গে বুকের উপরিভাগের মাংসপি- ফুলিয়ে, দৃষ্টিনন্দন করে নাচতে শুরু করেছিলো তাতে হামিদালী তো হামিদালী, দশ/বারো বছরের ছোড়াও স্থির থাকতে পারবে না কিছুতেই। একেই বলে যৌবনের শ্রাবণ। বাড়ির ওই বউদের, দেখতে-দেখতে আর চাকতে-চাখতে একেবারে পানসে হয়ে গেছে চোখ। রুচি পালটানো দরকার মাঝে-মধ্যে।

হামিদালীর কথা শুনে সাজু তখন লজ্জা পেলেও নিজের শরীরের কোনো রকম উত্তেজনা অনুভব করে না। এ ভয়াবহ অসুখটা আর এভাবে চেপে রাখাও সমীচিন নয়।

কিংঞ্চিৎ রেগে যায় হামিদালী, আবোলতাবোল কথা বন্ধ করে বলে, কিসের পরামর্শ বলবে তো, একেবারে আদাড় বনের শেয়াল যে বাঘ হয়ে গেলে দেখছি!

সাজু আমতা-আমতা করতে থাকে। ওমন কথাটা কীভাবে বলবে বুঝে পায় না। আকাশ-পাতাল চিন্তায় কপালের চামড়া কুঁকড়ে যায়। আচমকা হামিদালী ধমক দেয়, তুমি তো দেখছি শালা ঘরের মাগীদের মতো। অর্ধেক কথা মুখে তো অর্ধেক কথা ইয়েতে...

সাজু অকস্মাৎ ঘাঁবড়ে যায় একটু। মনে মনে স্থির করে, হ্যাঁ কথাটা বলাই দরকার। আর দেরী করাও উচিত হবে না। কিন্তু এমন এক ধরনের গোপনীয় ব্যাপার যা মুখ ফুটে বলতেও কেমন খটকা। একসময় সাজু একেবারে নির্বোধের মতো আচমকা বলে, হামিদ ভাই আমার ইয়ে তেমনটা... মানে ওর মনের মতো হয় না গো! সাজুর কথা আচমকা কেড়ে নেয় বাঘের মতো হামিদালী। খিস্তি-খেউড় আর চিৎকার করতে থাকে।

আক্ষেপ করে অবশেষে বলে, এমন একটা অসুখ নিয়ে তুমি কি না, নাহ্ তোমাকে নিয়ে কিছুই হবে না।

লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে সাজুর, কাকে যে কী বললো, আল্লা মালুম! না জানি কতো শত লোকে জানবে অথবা বলে বেড়াবে মিস্ত্রীর বাচ্চা হামিদালী। নিজের ভুলের জন্য নিজের কাছেই অনুশোচনা করে সাজু। আলুলায়িত অনেক চিন্তা মাথার মধ্যে তোলপাড় করতে থাকে। সাজুর বুকের ভেতরটা কেমন হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করে ওঠে।

এর মধ্যে হামিদালী একেবারে অন্যরকম। হালকা স্বরে বলে, অসুখ কি কেউ চেপে রাখে বোকারাম। আগে বলোনি কেনো? জানো না প্রকৃত বন্ধুরাই পারে বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে, আরে আমার সঙ্গে এতোকাল মিশছো মিয়া, ঠাট্টা-তামাশা করি ঠিকই কিন্তু এতো কাছাকাছি থেকেও আমাকে চিনলে না।

সাজু এবার নির্বাক হয়ে যায়। তবে কি তাহলে এতো লেজেগোবরে থেকেও প্রকৃত বন্ধু চিনতে পারেনি। মানুষের এমনও ভুল হয় কখনো।

হামিদালীর ওপর এতোকাল যতো ঘৃণা আর মন্দ ধারণা বাসা বেঁধেছিলো তার মনে, ক্রমে-ক্রমে একটু একটু কেমন দূর হয়ে যাচ্ছে যেন। সত্যিই বান্ধব চিনতে পারেনি।

হামিদালী আবার বললো, মানুষ দাঁত থাকতে যেমন মর্যাদা জানে না, ঠিক তোমার ক্ষেত্রেও দেখছি তাই হলো মিয়া! আরে উল্লুক ক্যা পাঁঠা তোমার তো স্মরণ করা উচিৎ ছিলো যে আমি শালা একজন পুরানো ক্যানভাসার...

সাজুর আরো ভুল ভাঙে এবার। তাই তো হামিদালী রাজমিস্ত্রী হলেও প্রথম যৌবনে সে যে ক্যানভাসার ছিলো, তখন ট্রেনে বাসে চেপে নগর থেকে মহানগরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঔষধ বিক্রি করতো। সে গল্প হামিদালী অনেক করেছে সাজুর কাছে। অথচ সবই ভুলে ছিলো নিজের বেলায়। আফসোস করে প্রিয় আপনজনের মতো হয় একসময়। তারপর হামিদালী স্পষ্ট বলে, কালনার দত্তপাড়ার কানাই কবিরাজের কথা। সেই সঙ্গে সর্তক করেও দেয় খানিক। হামিদালীর একসময় খুব কাছের মানুষ ছিলো এই কানাই। এখন নাকি দু’হাতে পয়সা রোজগার করছে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে। সমাজে এমন মানুষও আছে, যারা আঙুল ফুলে দু’দিনেই একেবারে কলাগাছ হয়। এ সমস্ত লোকেদের ওপরে উঠতে সময় লাগে না এতোটুকু। কানাই কবিরাজও যে এদের মধ্যে একজন। সে কথা ভুলে গেলে নেহাৎ অন্যায় করা হবে বৈ কি।

ভরদুপুরে কারো বাড়ি যাওয়া সংকোচের হলেও সাজু তো যাচ্ছে রোগী হয়ে কানাই কবিরাজের কাছে। এতে কোনো লাজ-লজ্জা থাকার কথা নয়। দরোজায় কড়া নেড়েই পেয়ে যায় কবিরাজকে সে। অত্যন্ত গম্ভীর মানুষ। সাজু নিজের পরিচয় দেওয়ার আগেই আলগোছে হামিদালীর কথা জানায়। ওমনি কবিরাজ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। তার আরো অনেক খোঁজখবর জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। সাজুও তেমনি পই পই সব বলে যায় কলের পুতুলের মতো। একসময় আসার হেতু বলে ফেলে নিঃসংকোচে কবিরাজের কাছে। কিছুটা আনমনা হয়ে সবই শুনে যায় কবিরাজ। সাজুর চোখে তখন আলোর দ্যুতি, আলোর বিজলী বাতি কে যেন চোখে ঢেলে দেয় মুহূর্তে।

অনেকটা সময় কেটে যায় এভাবে। কানাই কবিরাজ আচম্বি বলে, হামিদালী একসময় আমার কাছ থেকে ঔষধ-পথ্য কিনে বেচতো, আমার প্রতি ওর বেশ বিশ্বাস...

সাজু দূরের আকাশের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। আবার কবিরাজ একটু মলিন হাসে, কবিরাজী আমার পেশা ঠিকই কিন্তু এতে আমার এতোটুকু বিশ্বাস নেই ভাই। সাজু অবাক হয়। হ্যাঁ ভাই, আমি তো জানি এটা এক ধরনের সান্ত¡না বৈ তো কিছু নয়। সাজু বুঝতে পারে, কানাই কবিরাজ লোকটা যতোটা খারাপ সে ভেবেছিলো, আসলে ততটা নয়, এ’ সমাজে মানুষ চেনা বড় কঠিন। সাজুর কাছে মনে হলো পৃথিবীতে মানুষ এখনো একেবারে পচে যায়নি। জীবন জীবিকার কারণে কেউ-কেউ শুধু হয়তোবা অভিনয় বা ভনিতা করে ঠিকই কিন্তু তাদের মনেপ্রাণেও অপরাধবোধ আছে। প্রাচীরের ওপাশের বাড়ির টিনের চালে কয়েকটা কাক এলোমেলো বেড়াচ্ছে। হঠাৎ দেখে পিটালী গাছের গায়ে একটা রক্তচোষা গিরগিটি হাঁপাচ্ছে এখনো। দূরে কোথাও একটা অতি পরিচিত গান বাজছে রেডিও অথবা ক্যাসেটে কারো। কানাই কবিরাজ বলে উঠলো, কিছু অসুখ বিসুখ অবশ্যই গাছ-গাছরার রস বা হালুয়া খেলে সারে, তবে নিশ্চিত নয়, যদি আমরাই পারতাম তাহলে দেশে বড় বড় পাস করা ডাক্তারের প্রয়োজন হতো না। আর সরকারইবা কোটি-কোটি টাকা খরচা করে... সাজু আর কিছুই বলতে পারে না। হাতের মাখাসন্দেশের প্যাকেটখানা নিয়ে উঠে যায় আস্তে-আস্তে। বাতাসে তখনো আগুনের হলকা। চারদিকে তাকানোর আর কোনো প্রয়োজন নেই। মনের ভেতর অপরাধবোধ জাগে। নিজের অসুখ কেনো তবে এতোকাল চাপা দিয়ে রেখেছে, ভালো-মন্দ যাই হোক ডাক্তারের কাছে যাওয়া কি তার উচিত ছিলো না? কানাই কবিরাজ অনেকখানি পথ এগিয়ে দিয়ে যায় তাকে।

সাজু এবার হাঁটতে-হাঁটতে দেখে মাখাসন্দেশের প্যাকেটখানা তার হাতে আছে কি না! কোথাকার মাখাসন্দেশ এখন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে, কানাই কবিরাজের উদ্দেশ্যে এনেও তার ভাগ্যে শিকে ছিড়লো না তো ওই বা করবেটা কি? পা চালিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে হবে এখন, নদীটা পার হয়েই ভ্যানে চেপে শান্তিপুর, একটু হেঁটেই বাসে চেপে তাকে ফলিয়ায় যেতে হবে।

সন্ধ্যা অনেক আগেই নেমে এসেছে, ভালোয়-ভালোয় নৌকায় জায়গা পেলে বাঁচা। সাজু তারপর হাঁটতে থাকে। কোনোদিকে তাকানোর আর সময় নেই, বাতাসে এখনো গরমের ভাব।

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

ছবি

শিল্পচর্চায় তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি ইনোভেটিভ

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতা বৈভব ও বহুমাত্রিকতা

ছবি

উইলিয়াম রাদিচের অধ্যয়নে অনন্য রবীন্দ্রনাথ

দিলারা হাফিজের কবিতা

ছবি

অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি

ছবি

আহমদুল কবির স্মরণে

ছবি

আহমদুল কবিরের সদাশয়তা

tab

সাময়িকী

নিছক সাজুর গল্প

আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ

বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০২৪

কাচাগোল্লার জন্য যে কালনার একটা সুনাম আছে, তা আজই প্রমাণ পেলো জ্বগদ্বীশ ঘোষের মিষ্টির দোকানে এসে। যেমন স্বাদ আর ঘ্রাণের কথা শুনেছিলো তেমনি-ই আছে বাস্তবে। প্রথমে ১০০ গ্রাম এবং পরে আরো ৫০ গ্রাম খেয়ে তৃপ্ত হয় সাজু। একটা পাতা বিড়ি ধরিয়ে একটানা কয়েকটা দম দিতে থাকে। কালনায় যাকে বলে কাচাগোল্লা, শান্তিপুরে তা মাখাসন্দেশ নামে পরিচিত। দুটো নামই কী চমৎকার! দুধের ছানা চিনি এবং গরমমসলা মিশ্রিত এই মিষ্ঠান্ন, মাখাসন্দেশ অর্থাৎ কাচাগোল্লাকে জড়িয়ে অনেক কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে স্থানীয় লোকের মুখে-মুখে।

একবার নাকি ভারতবর্ষের বিখ্যাত নেতা করমচাঁদ গান্ধী কালনার ওপর দিয়ে ট্রেনে যেতে গিয়ে কালনায় নেমেছিলেন এবং কিঞ্চিৎ মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, তোমাদের কবি অর্থাৎ বাঙালিবাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলো, বাংলায় আসলে কালনার মাখাসন্দেশ খেয়ো...

ওদিকে আরেকজন ধোপদুরস্ত আপদমস্তক বাঙালি বিদ্যাসাগর মহাশয়, সে তো আজীবন কালনার মাখাসন্দেশের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। জনশ্রুতি আছে, এমন কোনোদিন ছিলো না, কালনার মাখাসন্দেশ তার বাড়ি যায়নি। শুধু কি তাই! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তো শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে থাকার আগে থেকে কালনার মাখাসন্দেশে আসক্ত ছিলেন। লোকমুখে প্রচার, কালনার মাখাসন্দেশ, শান্তিপুরের রসগোল্লা আর বর্ধমানের মিহিদানা খাবার জন্যই নাকি কবিগুরু শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। আরেকজন তো বাদ পড়ে গেলো, হ্যাঁ ঝাঁকড়া বাবরি চুলের কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সে তো ওই কালনার পাশে চুরুলিয়ায় জন্মেছিলেন। বর্ধমানের মিহিদানা আর মাখাসন্দেশের মতো সুরোত নিয়ে কবির এই আর্বিভাব। মিষ্টির স্বাদ জিহ্বার আগায় থাকার কারণে বাংলার মানুষকে কঠিনভাবে বশীকরণ করতে পেরেছিলেন, কালনার মাখাসন্দেশ বাংলার সুনাম রক্ষা করেছে সন্দেহ নেই।

বিড়িটা শেষ করে আরো ২৫০ গ্রামের অর্ডার দেয় সাজু, শালপাতায় মুড়িয়ে দেওয়া হয় তাকে। দাম পরিশোধ শেষে দোকান থেকে বের হয়। শালপাতায় মোড়ানো মাখাসন্দেশ সাজুর হাতে। দত্তপাড়ায় যাবে কানাইলাল কবিরাজের বাড়ি। কালনায় প্রথম আসছে সে। দত্তপাড়া এখান থেকে আর কতোদূর তা ওর জানার কথা নয়। ঠিকানা অনুযায়ী লোকমারফতে জেনে-জেনে সেখানে পৌঁছাতে হবে, কালনা বাজার থেকে দক্ষিণের ইট বিছানো চার কিলোমিটার পথ। ভ্যানরিকশা এখন একমাত্র অবলম্বন। সাজু সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অবশেষে ভ্যানরিকশায় গিয়ে চাপলো। পেছনে দু’পা ঝুলিয়ে যেতে থাকে, তারপর অনেক চিন্তার মধ্যে ডুবে যায়।

দুপুর সন্নিকটে একেবারে। মাথার মাঝখানে হা-হাভাতের মতো গনগনে অগ্নিপি- সূর্যটা জিহ্বা বার করে রক্তলোলুপ চোখে তাকিয়ে। জ্যৈষ্ঠের মাটি ফাঁটা রোদের ভয়েই সাজু ফজর আজানের সাথে-সাথে বাড়ি থেকে বার হয়। কিন্তু আইজুলের মা যেভাবে এসে চেপে ধরলো, বাপ আমার হাসপাতালে একবার আইজুলকে দেখে আসিস...

আইজুল সপ্তাহ দুই ধরে শান্তিপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি। ছোড়াটা আর ভালো হলো না। বাপটা যে বছর মরলো, সে বছরই বাপের ব্যবসার পুঁজি-পাট্টা সিকেয় তুলে ফলিয়ার ফকির হয়ে গেলো। একেই বলে ভাগ্য আর কি! কিন্তু শালা ভাগ্য ব্যাটা করবেটা কী! নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে না জানলে ভাগ্য কি হাত ধরে তুলে দাঁড় করাবে। হাসপাতালে ওই আইজুলের সঙ্গে দুটো কথা আর সান্ত¡না দিতে গিয়েই বেলাটা বেড়ে গেলো। নয়তো ফলিয়া থেকে সরাসরি বাসে চেপে শান্তিপুর ডাকঘর মোড়ে এবং একটু হেঁটেই শান্তিনগর, সেখান থেকে ভ্যানরিকশায় কালনায় আসতে আর কতোক্ষণ। বড় জোর ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। কিন্তু হাসপাতালে গিয়েই সময়টা অকারণে খরচা হলো সাজুর।

বাপের পেশাটা ধরে রাখতে পারলো না হারামজাদা। তাঁতের কাজটা কি আর এই-সে-ই পেশা। বাব্বারে বাব্বা, একটু বুদ্ধি খাটালে তো কেল্লা ফাতে, কে আর পায় কাকে। ডালভাতের অভাব কোথায় পালিয়ে যায় শিয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে। নাহ্, তা ধরে রাখতে পারলো না জমিদার বাবু! তাঁতের কাজ করলে নাকি লোকে বলবে তাঁতি, কি এক আলতু-ফালতু যুক্তি দেখো দিকি।

বখাটে আর ছন্নছাড়া বন্ধুদের কথা শুনে হারামজাদা তাঁতের কল বিক্রি করে শান্তিপুর সিনেমা হলের টিকিট চেকারের চাকুরি নিলো। সাজু তখনো দেখেছে ওকে, সে কি শালার অহংকার। বাবরি চুল মাথা ভর্তি, প্যান্টের ভেতর জামা গুঁজে ফুল বাবু সেজে ফি সপ্তাহে ফলিয়ায় যেতো। ডান হাতে ঘড়ি, বাম হাতে ব্যান্ড বাঁধা, চোখে কালার সানগ্লাস, হিল তোলা জুতো। সে কি তার চেহারার চেকনাই। শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খুলে বুকের কালো-কালো পশম দেখিয়ে হাঁটতো চোখ আকাশের দিকে তুলে। মুম্বের শাহরুখ খান বা সালমান খান যেনবা, সবই স্মরণে আছে সাজুর।

সেই শালা আইজুল আজ শান্তিপুর হাসপাতালে। তাও আবার বেডের নিচে ফ্লডিংয়ে, জীবনে এই প্রথম সাজু শান্তিপুর হাসপাতালে ঢুকলো। কী বিচ্ছিরি ব্যবস্থা, মশা-মাছি-আরশোলা রক্ত-পূজ-বমি-পায়খানা। ফিনাইন-ডিটল ঔষধ আর নোংরা দুগর্ন্ধে শরীর ঘিনঘিন করছে এখনো। তারও পর ওইটুকু রুমে গাদাগাদি দশ/বারো জনের জায়গায় বাইশ থেকে ছাব্বিশ জন রোগী, আবার আত্মীয়স্বজন তো আছেই।

কলকাতা চিড়িয়াখানার সাপের ঘরের মতো অবস্থা। একেই বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। কী দরকার ছিলো বাবা, রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া। মানুষ তো ইচ্ছে করলেই আস্তে-সুস্তেও বড় হতে পারে। কে আর কাকে আটকাচ্ছে একালে। হারামজাদা সিনেমা হলের মালিকের বাড়ি ডাকাতি করতে যাওয়াটা উচিত হয় কি? যে তোর অন্ন জোগায়, যার টাকায় উটকো ফুটানি মারতিস, তার ওপর ওমন হয় কি? ওমন অত্যাচার কি আল্লাও সহ্য করে কখনো। বন্ধু-বান্ধব এখন কোথায়? বাস্তব কতো কঠিন। এখন বাস্তবে ফিরে এসে দেখ্ শালা! কতো ধানে কতো চাল!

জীবন যেমন কঠিন, জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়াও বড় কঠিন। যাদের নিয়ে একসঙ্গে মালিকের বাড়ি ডাকাতি করতে গেলি, তারা সব কোথায় এখন। কেউ তো এগিয়ে আসছে না। এখন হাড়ে-হাড়ে বুঝে নে, জীবন মানেই পালিয়ে বেড়ানো। সবাই পালিয়ে যেতে পারলো ঠিকই আর ধরা পড়ে তুই এখন... একেই বলে অন্যায় করলে কারো নিস্তার নেই। রামধোলাই খেয়ে মরছিস ব্যাটা হাসপাতালে। এর চেয়ে কি বাপের পেশা ভালো ছিলো না। নিজের দেশে কোন্ শালার ক্ষমতা ঘাড়ে হাত দেয়, এরই নাম অতি লোভে তাতি নষ্ট।

শালপাতায় মোড়ানো মাখাসন্দেশ হাতে দত্তপাড়ার কানাই কবিরাজের বাড়ির কাছাকাছি আসে সাজু। দুপুরটা এখন মাথার ওপর। বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে পানি পিপাশায়। কানাই কবিরাজের বাড়ি পানি পাওয়া যাবে না। সেকেলে আর রক্ষণশীল মানুষ বলে পুরানো চিন্তাটা এখনো আঁকড়ে আছে। ম্লেচ্ছ যবন অর্থাৎ মুসলমানদের একটু বাঁকা চোখেই দেখে। বাড়ির আঙিনা অবধি প্রবেশ করতে পারে কিন্তু নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সে অধিকারও নেই। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম বলা যায়। বাইরে থেকে ডাকলে কবিরাজ নিজে গিয়ে দেখা করে কথা বলে। জাত ফাত বা বর্ণবাদের কথা কেউ তার সামনে মুখ ফসকে বললে, সে তখন আচমকা খেঁকিয়ে উত্তর দেয়, দুটো পয়সার জন্য কি জাতটাকে খুইয়ে বসবো...

তারপর আরো খানিক ক্ষিপ্ত হয়ে জানায়, আরে মশাই উটকো বোলচাল ছাড়ো দিকিনি, গরিব হয়েছি বলে কি ধর্ম-কর্ম ছেড়ে দেবো বলতে চাও।

সাজু বাইরের একটা চায়ের স্টলে ঢোকে। বিস্কুট আর কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে নিজেকে একটু সতেজ করে। তারপর চায়ের পেয়ালায় মুখ দেয়। কানাই কবিরাজের হাতযশ বেশ।

গরম বাতাস জাঁপটে এসে শরীরে ধাক্কা দেয় অকস্মাৎ। কোথায় একটা পাখি ডেকে উঠলো। সাজু আনমনে চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাখিটার অস্তিত্ব আবিস্কার করতে থাকে। তারপর ক্ষণিক তাকিয়ে থাকে তন্ময় হয়ে নীল আকাশের দিকে। কানাই কবিরাজ ভারি ধান্দাবাজ মানুষ বটে। টাকা ছাড়া অন্য কিছুই বোঝে না। টাকা নাকি তাকে আজো বাঁচিয়ে রেখেছে, সাত-পাঁচ গাঁয়ের লোকে তাই অনুমান করে। নয়তো এতো বয়সে মানুষ বাঁচে কেমন ভাবে। বয়স তার যতোই হোক না কেন। কবিরাজী ঔষধ লতাপাতা শেকড়বাকড় খেয়ে নাকি শরীর আর যৌবনকে আজো পঁচিশ/তিরিশ বছরের যুবকের মতো রেখেছে। যৌবনের কেমন শক্তি, তার প্রমাণ ঘরে ওর চার চারটে জ্বল-জ্বলন্ত বউ আজো। এবং তারা পুরোদস্তুর স্বামী সেবাই অস্থির থাকে। তাছাড়াও কানাই কবিরাজের কৃষ্ণের স্বভাব আছে। কখনো-সখনো এদিকে সেদিকে ছুটে যায়। সেই দড়ি ছাড়া পাগলা ষাঁড়ের মতো।

সাজু সবই ওই মানুষের মুখে মুখে শুনেছে আর কি। তবে কয়েকদিন ওই সেই শান্তিপুরের ঢাকিপাড়ার টুলটুলির ঘরে দেখেছিলো সাজু। টুলটুলি হলো নদীয়া অপেরার ঝুমুরওয়ালী। সরু কোমর চওড়া মাজা দোলানো দেখতে কতো সাহেব সুবো পতঙ্গের মতো ছুটে আসে। সাজুও একসময় মাঝে-সাঝে যেতো-টেতো ওর চাতালে। কানায়ের ক্ষমতা আছে ঢের। এমন মানুষও যে সমাজে আছে এখনো, তা ভাবলে শরীরে শিহরন জাগে। শুধু ফলিয়ার হামিদালী মিস্ত্রীর পরামর্শে জানতে পেরেছে কানায়ের কথা। তাছাড়া কি এমন প্রয়োজন ছিলো এমন লোকের সংবাদ জানার। সাজুর রোগ অনেককালের, কোনোদিনই রোগের কথাটা ফাঁস করতো না সে। কিন্তু সেদিন কৃষ্ণনগরের বলাকা দলের যাত্রা দেখে ফিরছিলো হামিদালীর সাইকেলে চেপে। একসময় হামিদালী বলে ওঠে, চলো মিয়া রাতটা আর ফলিয়ায় ফিরে না গিয়ে বরং সীমা বাইজীর দাওয়ায়...

সাজু কথাটা শুনে একটু ইতস্তত করে, ঘরে তো আমার বউ আছে গো!

বউ শব্দটা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে হামিদালী। তারপর নিজেকে সংবরণ করলো, দূর মিয়া, তুমি তো দেখছি একটা ইয়ে, ইয়ে মানে রাঙা মুলো, বউ কি শালা শুধু তোমারই আছে,আমরা বুঝি খোঁজা নাকি!

সাজু অনেকক্ষণ ঘ্যাঁত মেরে থাকে, না থাক্, এর বেশি কথা বাড়ানো উচিত নয়। হামিদালী লোকটা একটু ওমনই মুখরো। মুখে যা আসে তাই বকর-বকর করে আউড়ে যায়।

বেশ কিছুসময় সাত-পাঁচ ভেবে সাজু নিজে থেকেই আবার বললো, হামিদ ভাই একটা কথা বলবো, পরামর্শ দেবেন কি?

হিসহিসিয়ে হামিদালী একটু খেঁকিয়ে ওঠে, পরামর্শ দেবো মানে কিসের ব্যাপারে আগে বলবে তো!

রাত্রের থকথকে কালো অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে না পেলেও দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাস স্পষ্ট টের পায়। আর ফলিয়ার টিকি এখনো অনেক অনেক দূরে, হামিদালীর শরীরে নেশা ধরেছে বোঝে সাজু। সীমা বাইজী তার এই পরম নেশা দূর করতে পারবে হয়তো। যাত্রার মেয়েটি যেভাবে সরু কোমর আর চওড়া নিতম্ব দুলিয়ে, সে সঙ্গে বুকের উপরিভাগের মাংসপি- ফুলিয়ে, দৃষ্টিনন্দন করে নাচতে শুরু করেছিলো তাতে হামিদালী তো হামিদালী, দশ/বারো বছরের ছোড়াও স্থির থাকতে পারবে না কিছুতেই। একেই বলে যৌবনের শ্রাবণ। বাড়ির ওই বউদের, দেখতে-দেখতে আর চাকতে-চাখতে একেবারে পানসে হয়ে গেছে চোখ। রুচি পালটানো দরকার মাঝে-মধ্যে।

হামিদালীর কথা শুনে সাজু তখন লজ্জা পেলেও নিজের শরীরের কোনো রকম উত্তেজনা অনুভব করে না। এ ভয়াবহ অসুখটা আর এভাবে চেপে রাখাও সমীচিন নয়।

কিংঞ্চিৎ রেগে যায় হামিদালী, আবোলতাবোল কথা বন্ধ করে বলে, কিসের পরামর্শ বলবে তো, একেবারে আদাড় বনের শেয়াল যে বাঘ হয়ে গেলে দেখছি!

সাজু আমতা-আমতা করতে থাকে। ওমন কথাটা কীভাবে বলবে বুঝে পায় না। আকাশ-পাতাল চিন্তায় কপালের চামড়া কুঁকড়ে যায়। আচমকা হামিদালী ধমক দেয়, তুমি তো দেখছি শালা ঘরের মাগীদের মতো। অর্ধেক কথা মুখে তো অর্ধেক কথা ইয়েতে...

সাজু অকস্মাৎ ঘাঁবড়ে যায় একটু। মনে মনে স্থির করে, হ্যাঁ কথাটা বলাই দরকার। আর দেরী করাও উচিত হবে না। কিন্তু এমন এক ধরনের গোপনীয় ব্যাপার যা মুখ ফুটে বলতেও কেমন খটকা। একসময় সাজু একেবারে নির্বোধের মতো আচমকা বলে, হামিদ ভাই আমার ইয়ে তেমনটা... মানে ওর মনের মতো হয় না গো! সাজুর কথা আচমকা কেড়ে নেয় বাঘের মতো হামিদালী। খিস্তি-খেউড় আর চিৎকার করতে থাকে।

আক্ষেপ করে অবশেষে বলে, এমন একটা অসুখ নিয়ে তুমি কি না, নাহ্ তোমাকে নিয়ে কিছুই হবে না।

লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে সাজুর, কাকে যে কী বললো, আল্লা মালুম! না জানি কতো শত লোকে জানবে অথবা বলে বেড়াবে মিস্ত্রীর বাচ্চা হামিদালী। নিজের ভুলের জন্য নিজের কাছেই অনুশোচনা করে সাজু। আলুলায়িত অনেক চিন্তা মাথার মধ্যে তোলপাড় করতে থাকে। সাজুর বুকের ভেতরটা কেমন হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করে ওঠে।

এর মধ্যে হামিদালী একেবারে অন্যরকম। হালকা স্বরে বলে, অসুখ কি কেউ চেপে রাখে বোকারাম। আগে বলোনি কেনো? জানো না প্রকৃত বন্ধুরাই পারে বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে, আরে আমার সঙ্গে এতোকাল মিশছো মিয়া, ঠাট্টা-তামাশা করি ঠিকই কিন্তু এতো কাছাকাছি থেকেও আমাকে চিনলে না।

সাজু এবার নির্বাক হয়ে যায়। তবে কি তাহলে এতো লেজেগোবরে থেকেও প্রকৃত বন্ধু চিনতে পারেনি। মানুষের এমনও ভুল হয় কখনো।

হামিদালীর ওপর এতোকাল যতো ঘৃণা আর মন্দ ধারণা বাসা বেঁধেছিলো তার মনে, ক্রমে-ক্রমে একটু একটু কেমন দূর হয়ে যাচ্ছে যেন। সত্যিই বান্ধব চিনতে পারেনি।

হামিদালী আবার বললো, মানুষ দাঁত থাকতে যেমন মর্যাদা জানে না, ঠিক তোমার ক্ষেত্রেও দেখছি তাই হলো মিয়া! আরে উল্লুক ক্যা পাঁঠা তোমার তো স্মরণ করা উচিৎ ছিলো যে আমি শালা একজন পুরানো ক্যানভাসার...

সাজুর আরো ভুল ভাঙে এবার। তাই তো হামিদালী রাজমিস্ত্রী হলেও প্রথম যৌবনে সে যে ক্যানভাসার ছিলো, তখন ট্রেনে বাসে চেপে নগর থেকে মহানগরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঔষধ বিক্রি করতো। সে গল্প হামিদালী অনেক করেছে সাজুর কাছে। অথচ সবই ভুলে ছিলো নিজের বেলায়। আফসোস করে প্রিয় আপনজনের মতো হয় একসময়। তারপর হামিদালী স্পষ্ট বলে, কালনার দত্তপাড়ার কানাই কবিরাজের কথা। সেই সঙ্গে সর্তক করেও দেয় খানিক। হামিদালীর একসময় খুব কাছের মানুষ ছিলো এই কানাই। এখন নাকি দু’হাতে পয়সা রোজগার করছে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে। সমাজে এমন মানুষও আছে, যারা আঙুল ফুলে দু’দিনেই একেবারে কলাগাছ হয়। এ সমস্ত লোকেদের ওপরে উঠতে সময় লাগে না এতোটুকু। কানাই কবিরাজও যে এদের মধ্যে একজন। সে কথা ভুলে গেলে নেহাৎ অন্যায় করা হবে বৈ কি।

ভরদুপুরে কারো বাড়ি যাওয়া সংকোচের হলেও সাজু তো যাচ্ছে রোগী হয়ে কানাই কবিরাজের কাছে। এতে কোনো লাজ-লজ্জা থাকার কথা নয়। দরোজায় কড়া নেড়েই পেয়ে যায় কবিরাজকে সে। অত্যন্ত গম্ভীর মানুষ। সাজু নিজের পরিচয় দেওয়ার আগেই আলগোছে হামিদালীর কথা জানায়। ওমনি কবিরাজ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। তার আরো অনেক খোঁজখবর জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। সাজুও তেমনি পই পই সব বলে যায় কলের পুতুলের মতো। একসময় আসার হেতু বলে ফেলে নিঃসংকোচে কবিরাজের কাছে। কিছুটা আনমনা হয়ে সবই শুনে যায় কবিরাজ। সাজুর চোখে তখন আলোর দ্যুতি, আলোর বিজলী বাতি কে যেন চোখে ঢেলে দেয় মুহূর্তে।

অনেকটা সময় কেটে যায় এভাবে। কানাই কবিরাজ আচম্বি বলে, হামিদালী একসময় আমার কাছ থেকে ঔষধ-পথ্য কিনে বেচতো, আমার প্রতি ওর বেশ বিশ্বাস...

সাজু দূরের আকাশের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। আবার কবিরাজ একটু মলিন হাসে, কবিরাজী আমার পেশা ঠিকই কিন্তু এতে আমার এতোটুকু বিশ্বাস নেই ভাই। সাজু অবাক হয়। হ্যাঁ ভাই, আমি তো জানি এটা এক ধরনের সান্ত¡না বৈ তো কিছু নয়। সাজু বুঝতে পারে, কানাই কবিরাজ লোকটা যতোটা খারাপ সে ভেবেছিলো, আসলে ততটা নয়, এ’ সমাজে মানুষ চেনা বড় কঠিন। সাজুর কাছে মনে হলো পৃথিবীতে মানুষ এখনো একেবারে পচে যায়নি। জীবন জীবিকার কারণে কেউ-কেউ শুধু হয়তোবা অভিনয় বা ভনিতা করে ঠিকই কিন্তু তাদের মনেপ্রাণেও অপরাধবোধ আছে। প্রাচীরের ওপাশের বাড়ির টিনের চালে কয়েকটা কাক এলোমেলো বেড়াচ্ছে। হঠাৎ দেখে পিটালী গাছের গায়ে একটা রক্তচোষা গিরগিটি হাঁপাচ্ছে এখনো। দূরে কোথাও একটা অতি পরিচিত গান বাজছে রেডিও অথবা ক্যাসেটে কারো। কানাই কবিরাজ বলে উঠলো, কিছু অসুখ বিসুখ অবশ্যই গাছ-গাছরার রস বা হালুয়া খেলে সারে, তবে নিশ্চিত নয়, যদি আমরাই পারতাম তাহলে দেশে বড় বড় পাস করা ডাক্তারের প্রয়োজন হতো না। আর সরকারইবা কোটি-কোটি টাকা খরচা করে... সাজু আর কিছুই বলতে পারে না। হাতের মাখাসন্দেশের প্যাকেটখানা নিয়ে উঠে যায় আস্তে-আস্তে। বাতাসে তখনো আগুনের হলকা। চারদিকে তাকানোর আর কোনো প্রয়োজন নেই। মনের ভেতর অপরাধবোধ জাগে। নিজের অসুখ কেনো তবে এতোকাল চাপা দিয়ে রেখেছে, ভালো-মন্দ যাই হোক ডাক্তারের কাছে যাওয়া কি তার উচিত ছিলো না? কানাই কবিরাজ অনেকখানি পথ এগিয়ে দিয়ে যায় তাকে।

সাজু এবার হাঁটতে-হাঁটতে দেখে মাখাসন্দেশের প্যাকেটখানা তার হাতে আছে কি না! কোথাকার মাখাসন্দেশ এখন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে, কানাই কবিরাজের উদ্দেশ্যে এনেও তার ভাগ্যে শিকে ছিড়লো না তো ওই বা করবেটা কি? পা চালিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে হবে এখন, নদীটা পার হয়েই ভ্যানে চেপে শান্তিপুর, একটু হেঁটেই বাসে চেপে তাকে ফলিয়ায় যেতে হবে।

সন্ধ্যা অনেক আগেই নেমে এসেছে, ভালোয়-ভালোয় নৌকায় জায়গা পেলে বাঁচা। সাজু তারপর হাঁটতে থাকে। কোনোদিকে তাকানোর আর সময় নেই, বাতাসে এখনো গরমের ভাব।

back to top