পুলক হাসান
কবিতায় দরাজ আর্তি ও মর্মপীড়ার জন্য, অনেকেই মনে করেন তিনি আধুনিক মরমী কবি। কেউবা আবার সমকালীন বাস্তবতার নবরূপকার মনে করেন। কিন্তু তাঁর বড় অবদান গভীর জীবন বোধের সহজ রূপদান। হোক তা বাশোর হাইকুর মতো ছোট কিন্তু তা ভাববহুল ও অর্থবাহী। আর সে অর্থ যেমন যুক্তিগ্রাহ্য তেমনি সাধারণ বস্তুর ভেতর অস্তিত্বের অনুধাবন। নইলে তৃষ্ণা নিবারণের পর পরিত্যাজ্য একটি ডাবের ভেতর তিনি সেই অস্তিত্ব অনুভব করবেন কেন?
এই যে অস্তিত্ব অনুধাবন তা আসলে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর গভীর দর্শনেরই প্রতিফলন। তাঁর কবিতার সহজ চরণে আমরা তাই শুনি যাপিত জীবনেরই অনুরণন। আর সেই যাপন জুড়ে আছে অনুভবনের বিচিত্র কাহন। সহজ ধ্বনির সহজ বিকিরণ। যেন সেই সহজ বোধেই তাঁর কবিতার মর্মগাহন, উদ্ভাসন। বাক সংযমে নিবিড় প্রেমে এমন ভাবে কথা বলে তাঁর কবিতা, এমন দরদী, মনে হবে নিকটাত্মীয়। ভাষা না ভাব কি নিয়ে বহিছে তাঁর কবিতার অন্তঃস্রোত। তা হয়তো ভেবে দেখার আছে। তবে এদেশে ষাটের দশকে কবি নূরুল হক এর সহজ রূপকার।
আমরা মনে করি কবিতা-অন্ত এক সন্তের নাম কবি নূরুল হক। বাংলা কবিতায় তিনি নিজস্ব এক কাব্যরীতির প্রবর্তক। যে কারণে তিনি প্রবীণ হয়েও নবীন এক কবি। তার আরও কারণ তিনি আমাদের সাহিত্য জগতে চমক দেখিয়ে হঠাৎ আড়ালে চলে যান। সেই চমকটি ছিলো সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দের আলোচিত টানা গদ্যে লেখা কবিতাগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ নিয়ে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সাহিত্য ছোটকাগজ ‘সমকাল’-এ একটি ছোট আলোচনা লিখেই সাহিত্যবোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ। ৭০-এর দশকের আলোচিত সাহিত্য ছোট কাগজ ‘নাগরিক’-এ সম্পাদক কবি ও রবীন্দ্র গবেষক ডা. আহমদ রফিক তাঁর সম্পাদকীয়তে আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, শামীম আজাদসহ যে পাঁচ জন কবিকে নতুন ধারার কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন নূরুল হক তাঁদেরই একজন। কিন্তু এর পরেই তিনি দৃশ্যপটে নেই। ২০০৭ সালে ‘নিরন্তর’ থেকে প্রকাশিত ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে আবার ফিরে আসেন কবিতার কাফেলায়। অস্তিত্ববাদ ও প্রচ- দেশপ্রেম তাঁর কবিতার মূল সূরচেতনা। সমকালীন এমন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি কলম ধরেননি। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি তাই নতুন ধারার কবি হিসাবে চিহ্নিত। জীবনবাদী তিনি। তাঁর ভিতর একইসঙ্গে একজন রবীন্দ্রনাথ ও গানের মর্মখোলা এক বাউলের বাস। তাঁর অর্থবহ ছোট ছোট কবিতাকে তাই মনে হবে প্রাণের ছোট ছোট নিশ্বাস। আকৃতিটা অবিকল অ্যামেরিকার এই সময়ের জনপ্রিয় কবি এ. আর. অ্যামন্সের কবিতার সঙ্গেই তুলনীয়। অ্যামন্সের ছোট্ট একটি কবিতা-
Now I’m
into things
So small
When I
Say boo
I disappear
অর্থাৎ, আমি এখন যে বস্তুর মধ্যে আছি তা এতো ছোট যে যখন আমি বলি বু আমি অদৃশ্য হয়ে যাই। অলংকারবিহীন হয়েও কবিতাটি চমৎকার। একটি মুহূর্তের বিশেষ অনুভূতির সহজ প্রকাশ। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত, ভেতর থেকে উৎসারিত। জাপানি হাইকুর মতো ছোট্ট অ্যামন্সের এই কবিতাটির পাশে উদাহরণ হিসাবে আনা যেতে পারে কবি নূরুল হকের ‘কে জানে’ কবিতাটি।
বসে ছিলাম পার্কে
রোদে ও ছায়ায়
কে বসেছিল কে জানে।
নূরুল হকের এই কবিতাটিতেও আমরা দেখি একটি মুহূর্তেরই অনুভূতি প্রকাশ। এভাবে কবিতায় তিনি সহজিয়া শব্দ ও বাক্যে নানা মুহূর্তকেই গেঁথেছেন। দরাজ চরণেও তাই দেখি ফুটে উঠেছে স্বদেশের বিপন্ন ছবি:
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ
বুক ফুলিয়ে
পুড়তে পুড়তে
আজো নাকি
লকলকিয়ে বাঁচো,
জন্ম নিয়ে দেখতে এলাম
তুমি কেমন আছে?
[দেখতে এলাম/ এ জীবন খসড়া জীবন পৃ. ১৪]
নিখাদ এক দেশপ্রেমিকেরই অন্তর্গত প্রশ্ন।
তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘এ জীবন খসড়া জীবন’-এর প্রায় কবিতার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে এ ধরনের গভীর জীবনবোধের অকপট উচ্চারণ।
কবিতায় সহজ অলংকারে নূরুল হক যে দার্শনিক প্রতিবিম্ব তৈরি করেন তা আমাদের চমৎকৃতই নয় শুধু, ভাবায়ও।
সময় বিগলিত হয়ে
ঝরছে
নিঃসীম রৌদ্র থেকে
মলমূত্র মাঝে।
চিন্তাগুলো নির্জনবাতির মতো
নিঃসঙ্গ জ্বলছে।
অলিখিত।
[বস্তি/ এ জীবন খসড়া জীবন পৃ. ৫১]
কিংবা
ধুলোতে উড়িয়ে দিই
পোকার বাসরঘর উস্কে দিই কটি ঝরাপাতা
তা-ও যদি নিয়ে যায়
গরিবের চিঠি
যুগান্তরে।
[ধুলোর ডাকঘর/এজীবন খসড়া জীবন, পৃ. ৫৩]
কিংবা
এখনো চেনা হয়নি কিছুই।
বুকের রক্ত ঢেলে হয়ত
চিনে নেব সব।
টুকরো কিছু সময়ের ভেতর
আমাদের আত্মা বাসা বেঁধেছিল
পথিমধ্যে,
পাখিরা যেমন বাসা বেঁধে থাকে
গাছ-গাছালির ডালে, ছায়ায়।
তেমনি।
এর বেশি হয়ত আমি কিছুই বলতে পারব না।
হায়,
এক জীবনের একটি বাক্য হলো এই পৃথিবী।
[একটি বাক্য/এ জীবন খসড়া জীবন পৃ. ৩৯]
উদ্ধৃত কবিতা তিনটির মধ্যে কবি নূরুল হক আমাদের যে বাস্তবতার কথা বলতে চান তা ‘নির্জনবাতি’, নিঃসঙ্গ জ্বলছে, ঝরাপাতা, গরিবের চিঠি, টুকরো সময়, আত্মা বাসা, পথিমধ্যে, ইত্যাকার শব্দ ও অনুপ্রাসের মধ্যেই আমরা পেয়ে যাই কবিতাগুলোর অন্তর্গত ছবি এবং টের পাই এর অনুরণন। তা যেমন নির্জলা অনুভবের অকুণ্ঠ প্রকাশ তেমনি সংবেদি ও সংশ্লেষীও।
এ ধরনের কবিতাকে স্প্যানিশ কবি হিমেনেথ বলেছেন ‘নগ্ন কবিতা’। তাঁর মতে, ‘না কবিতা’ হচ্ছে সেই কবিতা যার অলংকার থাকবে না, থাকবে শুধু দিব্য উচ্চারণ। নূরুল হকের কবিতার মধ্যেও আমরা শুনতে পাই সেই দিব্য উচ্চারণ। জীবনানন্দের কবিতায় যখন প্রতিষ্ঠিত সত্য ‘চিত্রকল্পই কবিতা’। উপমা, রূপক ও প্রতীকের হাত ধরেই কবিতা।
এর বাইরে কবিতার অস্তিত্ব চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু অ্যামন্স ও হিমেনেথরা বলছেন অন্য কথা। তাদের যুক্তি হচ্ছে অলংকার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে বটে আবার প্রকৃত সৌন্দর্যকে আড়ালও করে। অর্থাৎ কেবল চিত্রকল্প, রূপক ও উপমার মধ্যে নয়, কবিতার প্রাণভোমরার বাস বোধের গভীরে। সেজন্য সহজ প্রকাশের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে প্রাণময় কবিতা, পাওয়া যেতে পারে জীবনের অমোঘ এক বার্তা।
তখন আমেরিকার অ্যামন্স, নূরুল হক ও ভারতের কবি সংযম পালের চিন্তার আকাশ এসে মিলে যায় একই আকাশে।
তাই কবি সংযম পাল যখন কবিতায় বলেনÑ
মরে যাওয়ার আগে
একটা ভাষা তৈরি করে নিতে হবে, যাতে
মরে যাওয়ার পরেও
তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি।
তখন তার পাশাপাশি নির্দ্বিধায় দাঁড় করাতে পারি কবি নূরুল হকের এই কবিতাটি:
মৃত্যুতে আমার কোনো সমস্যা নেই
কারণ
জীবনে তো মৃত্যুই ভরা আছে
তাতেই তো বসবাস করি
তাই
মৃত্যুতে আমার কোনো গড়িমসি নেই
যখনই লগ্ন হবে তখনই পাড়ি
কিন্তু
মৃত্যু হলে
পৃথিবীটা ঠিকঠাক চলছে কিনা
তা জানব কী করে?
এই যা সমস্যা।
[সমস্যা/এ জীবন খসড়া জীবন, পৃ. ৯]
ফুট কবিতার মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে কবির জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকার প্রত্যয়। যদিও দুজনের প্রকাশ এক রকম নয়।
আমেরিকান কবি এ. আর. অ্যামন্সের সঙ্গেও নূরুল হকের কবিতার মিলটা আকৃতি ও প্রয়াণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অ্যামনস শিল্পকে মনে করেন একটা যাতনা বৃক্ষের ফল। এই ফল আস্তে আস্তে বড় হয় অনিঃশেষিত জীবনের বাগানে। নূরুল হকের কবিতার মধ্যে সরাসরি কষ্টপ্রকাশ ততটা তীব্র নয়। তিনি বরং কবিতার সঙ্গে তথা শিল্পের মধ্যে লুকোচুরিটা দেখতে পান। তাই জীবনের অন্ধকার পাহারা দেয়াটা তার জন্য বিব্রতকরই।
কেমনে পাহারা দিই এই অন্ধকার
যেদিকে নিশ্চিন্ত থাকি
সেই দিক থেকে ঢুকে পড়ে অগোচরে
তড়িঘড়ি করে
ফুল ছুঁড়ে দিয়ে নৈঃশব্দ্য দোলাতে থাকে
ফুলগুলি যেন দরোজা
হৃদয়ের কাছে।
খুলে যায় আপনা আপনি
আড়ালে আবডালে।
[আড়ালে আবডালে/এ জীবন খসড়া জীবন, পৃ. ৬১]
নূরুল হকের অধিকাংশ কবিতা তাই অ্যামন্সের কবিতার মতো ক্ষুদ্র হলেও তাতে ভাবের উচ্ছ্বাস নেই। বরং বাশোর হাইকুর মতো ছোট কিন্তু ভাবসংযমী ও অর্থবহ। তিনি প্রকৃত অর্থে একজন জীবনবাদী। তাঁর ভিতরে একজন ছোটখাটো রবীন্দ্রনাথেরই বসবাস। যদিও তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে আন্দোলন, সংগ্রাম ও প্রতিমুহূর্তের চিত্র। সমকালীন জাতীয় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর কলমে এতটাই জীবন্ত যে, মনে হবে তিনিই প্রতিনিধিত্ব করছেন নতুন প্রজন্মের। তাঁর কবিতার মধ্যে সেই তারুণ্যও দীপ্ত ও জ্বলজ্বলে। তবে তিনি তারুণ্যেই শুর উজ্জীবিত নন, বার্ধ্যকেও বিচলিত। ফলে কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে বেলাশেষের নেই। অসহায়ত্বের আকুতিও। যেমন:
বেলা শেষে
চারদিকে জলীয় মুহূর্ত সব
সর্বক্ষণ
টলমল করে।
[কে যেন সরিয়ে নিচ্ছে সব/এ জীবন খসড়া জীবন, পৃ. ৭৭]
কিংবা
সীমাহীনতায়?
কোথায় আমার শুরু?
কোথায়ই বা সীমান্ত-বাঁধুনি?
কীভাবে তা মাপজোখ করি,
... ... ...
যদি জানতাম আমি
সেই সীমারেখা
যদি জানতাম।
[যাত্রার প্রাক্কালে/এ জীবন খসড়া জীবন, পৃ. ৭৯]
কিংবা
বসে আছি
শুকনো ধুলোর মতো,
উড়ে যেতে হবে কোনোদিকে।
আকাশের ঝুলানো আঁধারে
জীবনের শত মিথ্যা
মিটমিট করে,
দূরের তারার মতো।
সমুদ্রের মতিগতি দেখে
বোঝ না কি
কার ঘণ্টা বাজে এইখানে?
[এ মুহূর্তে/মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প ও অন্যান্য কবিতা, পৃ. ৯৫]
প্যাট্রিক কারনাফ বলেছেন, জীবনে অভিজ্ঞতার প্রাচুর্য বেড়ে গেলেই তার প্রকাশ হয় সহজ ওসাল। কবি নূরুল হকের বেলায় তাঁর এই উক্তি যেন শতভাগ সত্য। আসলে নূরুল হকের কবিতা তাঁর জীবন অভিজ্ঞতারই সরল প্রকাশ, তাঁর জীবন অভিজ্ঞতারই ফুটনোট তাঁর কবিতা।
কবির অস্তিত্ব যদি মনে করি তাঁর সৃজনে তবে তাঁর পক্ষে এমন উচ্চারণই স্বাভাবিক। যেমনটি বলেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে’। যেমনটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন কবি আবুল হাসান ‘সব রৌদ্র হারিয়ে যায় না’ ঠিক একইভাবে নূরুল হকও জানান দিতেই পারেন:
একদিন কাকপক্ষীর মতো এসে
দুয়ারে দাঁড়ালে
বুঝবে, আমি কে?
পরিচয়
পুলক হাসান
বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
কবিতায় দরাজ আর্তি ও মর্মপীড়ার জন্য, অনেকেই মনে করেন তিনি আধুনিক মরমী কবি। কেউবা আবার সমকালীন বাস্তবতার নবরূপকার মনে করেন। কিন্তু তাঁর বড় অবদান গভীর জীবন বোধের সহজ রূপদান। হোক তা বাশোর হাইকুর মতো ছোট কিন্তু তা ভাববহুল ও অর্থবাহী। আর সে অর্থ যেমন যুক্তিগ্রাহ্য তেমনি সাধারণ বস্তুর ভেতর অস্তিত্বের অনুধাবন। নইলে তৃষ্ণা নিবারণের পর পরিত্যাজ্য একটি ডাবের ভেতর তিনি সেই অস্তিত্ব অনুভব করবেন কেন?
এই যে অস্তিত্ব অনুধাবন তা আসলে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর গভীর দর্শনেরই প্রতিফলন। তাঁর কবিতার সহজ চরণে আমরা তাই শুনি যাপিত জীবনেরই অনুরণন। আর সেই যাপন জুড়ে আছে অনুভবনের বিচিত্র কাহন। সহজ ধ্বনির সহজ বিকিরণ। যেন সেই সহজ বোধেই তাঁর কবিতার মর্মগাহন, উদ্ভাসন। বাক সংযমে নিবিড় প্রেমে এমন ভাবে কথা বলে তাঁর কবিতা, এমন দরদী, মনে হবে নিকটাত্মীয়। ভাষা না ভাব কি নিয়ে বহিছে তাঁর কবিতার অন্তঃস্রোত। তা হয়তো ভেবে দেখার আছে। তবে এদেশে ষাটের দশকে কবি নূরুল হক এর সহজ রূপকার।
আমরা মনে করি কবিতা-অন্ত এক সন্তের নাম কবি নূরুল হক। বাংলা কবিতায় তিনি নিজস্ব এক কাব্যরীতির প্রবর্তক। যে কারণে তিনি প্রবীণ হয়েও নবীন এক কবি। তার আরও কারণ তিনি আমাদের সাহিত্য জগতে চমক দেখিয়ে হঠাৎ আড়ালে চলে যান। সেই চমকটি ছিলো সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দের আলোচিত টানা গদ্যে লেখা কবিতাগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ নিয়ে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সাহিত্য ছোটকাগজ ‘সমকাল’-এ একটি ছোট আলোচনা লিখেই সাহিত্যবোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ। ৭০-এর দশকের আলোচিত সাহিত্য ছোট কাগজ ‘নাগরিক’-এ সম্পাদক কবি ও রবীন্দ্র গবেষক ডা. আহমদ রফিক তাঁর সম্পাদকীয়তে আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, শামীম আজাদসহ যে পাঁচ জন কবিকে নতুন ধারার কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন নূরুল হক তাঁদেরই একজন। কিন্তু এর পরেই তিনি দৃশ্যপটে নেই। ২০০৭ সালে ‘নিরন্তর’ থেকে প্রকাশিত ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে আবার ফিরে আসেন কবিতার কাফেলায়। অস্তিত্ববাদ ও প্রচ- দেশপ্রেম তাঁর কবিতার মূল সূরচেতনা। সমকালীন এমন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি কলম ধরেননি। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি তাই নতুন ধারার কবি হিসাবে চিহ্নিত। জীবনবাদী তিনি। তাঁর ভিতর একইসঙ্গে একজন রবীন্দ্রনাথ ও গানের মর্মখোলা এক বাউলের বাস। তাঁর অর্থবহ ছোট ছোট কবিতাকে তাই মনে হবে প্রাণের ছোট ছোট নিশ্বাস। আকৃতিটা অবিকল অ্যামেরিকার এই সময়ের জনপ্রিয় কবি এ. আর. অ্যামন্সের কবিতার সঙ্গেই তুলনীয়। অ্যামন্সের ছোট্ট একটি কবিতা-
Now I’m
into things
So small
When I
Say boo
I disappear
অর্থাৎ, আমি এখন যে বস্তুর মধ্যে আছি তা এতো ছোট যে যখন আমি বলি বু আমি অদৃশ্য হয়ে যাই। অলংকারবিহীন হয়েও কবিতাটি চমৎকার। একটি মুহূর্তের বিশেষ অনুভূতির সহজ প্রকাশ। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত, ভেতর থেকে উৎসারিত। জাপানি হাইকুর মতো ছোট্ট অ্যামন্সের এই কবিতাটির পাশে উদাহরণ হিসাবে আনা যেতে পারে কবি নূরুল হকের ‘কে জানে’ কবিতাটি।
বসে ছিলাম পার্কে
রোদে ও ছায়ায়
কে বসেছিল কে জানে।
নূরুল হকের এই কবিতাটিতেও আমরা দেখি একটি মুহূর্তেরই অনুভূতি প্রকাশ। এভাবে কবিতায় তিনি সহজিয়া শব্দ ও বাক্যে নানা মুহূর্তকেই গেঁথেছেন। দরাজ চরণেও তাই দেখি ফুটে উঠেছে স্বদেশের বিপন্ন ছবি:
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ
বুক ফুলিয়ে
পুড়তে পুড়তে
আজো নাকি
লকলকিয়ে বাঁচো,
জন্ম নিয়ে দেখতে এলাম
তুমি কেমন আছে?
[দেখতে এলাম/ এ জীবন খসড়া জীবন পৃ. ১৪]
নিখাদ এক দেশপ্রেমিকেরই অন্তর্গত প্রশ্ন।
তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘এ জীবন খসড়া জীবন’-এর প্রায় কবিতার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে এ ধরনের গভীর জীবনবোধের অকপট উচ্চারণ।
কবিতায় সহজ অলংকারে নূরুল হক যে দার্শনিক প্রতিবিম্ব তৈরি করেন তা আমাদের চমৎকৃতই নয় শুধু, ভাবায়ও।
সময় বিগলিত হয়ে
ঝরছে
নিঃসীম রৌদ্র থেকে
মলমূত্র মাঝে।
চিন্তাগুলো নির্জনবাতির মতো
নিঃসঙ্গ জ্বলছে।
অলিখিত।
[বস্তি/ এ জীবন খসড়া জীবন পৃ. ৫১]
কিংবা
ধুলোতে উড়িয়ে দিই
পোকার বাসরঘর উস্কে দিই কটি ঝরাপাতা
তা-ও যদি নিয়ে যায়
গরিবের চিঠি
যুগান্তরে।
[ধুলোর ডাকঘর/এজীবন খসড়া জীবন, পৃ. ৫৩]
কিংবা
এখনো চেনা হয়নি কিছুই।
বুকের রক্ত ঢেলে হয়ত
চিনে নেব সব।
টুকরো কিছু সময়ের ভেতর
আমাদের আত্মা বাসা বেঁধেছিল
পথিমধ্যে,
পাখিরা যেমন বাসা বেঁধে থাকে
গাছ-গাছালির ডালে, ছায়ায়।
তেমনি।
এর বেশি হয়ত আমি কিছুই বলতে পারব না।
হায়,
এক জীবনের একটি বাক্য হলো এই পৃথিবী।
[একটি বাক্য/এ জীবন খসড়া জীবন পৃ. ৩৯]
উদ্ধৃত কবিতা তিনটির মধ্যে কবি নূরুল হক আমাদের যে বাস্তবতার কথা বলতে চান তা ‘নির্জনবাতি’, নিঃসঙ্গ জ্বলছে, ঝরাপাতা, গরিবের চিঠি, টুকরো সময়, আত্মা বাসা, পথিমধ্যে, ইত্যাকার শব্দ ও অনুপ্রাসের মধ্যেই আমরা পেয়ে যাই কবিতাগুলোর অন্তর্গত ছবি এবং টের পাই এর অনুরণন। তা যেমন নির্জলা অনুভবের অকুণ্ঠ প্রকাশ তেমনি সংবেদি ও সংশ্লেষীও।
এ ধরনের কবিতাকে স্প্যানিশ কবি হিমেনেথ বলেছেন ‘নগ্ন কবিতা’। তাঁর মতে, ‘না কবিতা’ হচ্ছে সেই কবিতা যার অলংকার থাকবে না, থাকবে শুধু দিব্য উচ্চারণ। নূরুল হকের কবিতার মধ্যেও আমরা শুনতে পাই সেই দিব্য উচ্চারণ। জীবনানন্দের কবিতায় যখন প্রতিষ্ঠিত সত্য ‘চিত্রকল্পই কবিতা’। উপমা, রূপক ও প্রতীকের হাত ধরেই কবিতা।
এর বাইরে কবিতার অস্তিত্ব চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু অ্যামন্স ও হিমেনেথরা বলছেন অন্য কথা। তাদের যুক্তি হচ্ছে অলংকার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে বটে আবার প্রকৃত সৌন্দর্যকে আড়ালও করে। অর্থাৎ কেবল চিত্রকল্প, রূপক ও উপমার মধ্যে নয়, কবিতার প্রাণভোমরার বাস বোধের গভীরে। সেজন্য সহজ প্রকাশের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে প্রাণময় কবিতা, পাওয়া যেতে পারে জীবনের অমোঘ এক বার্তা।
তখন আমেরিকার অ্যামন্স, নূরুল হক ও ভারতের কবি সংযম পালের চিন্তার আকাশ এসে মিলে যায় একই আকাশে।
তাই কবি সংযম পাল যখন কবিতায় বলেনÑ
মরে যাওয়ার আগে
একটা ভাষা তৈরি করে নিতে হবে, যাতে
মরে যাওয়ার পরেও
তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি।
তখন তার পাশাপাশি নির্দ্বিধায় দাঁড় করাতে পারি কবি নূরুল হকের এই কবিতাটি:
মৃত্যুতে আমার কোনো সমস্যা নেই
কারণ
জীবনে তো মৃত্যুই ভরা আছে
তাতেই তো বসবাস করি
তাই
মৃত্যুতে আমার কোনো গড়িমসি নেই
যখনই লগ্ন হবে তখনই পাড়ি
কিন্তু
মৃত্যু হলে
পৃথিবীটা ঠিকঠাক চলছে কিনা
তা জানব কী করে?
এই যা সমস্যা।
[সমস্যা/এ জীবন খসড়া জীবন, পৃ. ৯]
ফুট কবিতার মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে কবির জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকার প্রত্যয়। যদিও দুজনের প্রকাশ এক রকম নয়।
আমেরিকান কবি এ. আর. অ্যামন্সের সঙ্গেও নূরুল হকের কবিতার মিলটা আকৃতি ও প্রয়াণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অ্যামনস শিল্পকে মনে করেন একটা যাতনা বৃক্ষের ফল। এই ফল আস্তে আস্তে বড় হয় অনিঃশেষিত জীবনের বাগানে। নূরুল হকের কবিতার মধ্যে সরাসরি কষ্টপ্রকাশ ততটা তীব্র নয়। তিনি বরং কবিতার সঙ্গে তথা শিল্পের মধ্যে লুকোচুরিটা দেখতে পান। তাই জীবনের অন্ধকার পাহারা দেয়াটা তার জন্য বিব্রতকরই।
কেমনে পাহারা দিই এই অন্ধকার
যেদিকে নিশ্চিন্ত থাকি
সেই দিক থেকে ঢুকে পড়ে অগোচরে
তড়িঘড়ি করে
ফুল ছুঁড়ে দিয়ে নৈঃশব্দ্য দোলাতে থাকে
ফুলগুলি যেন দরোজা
হৃদয়ের কাছে।
খুলে যায় আপনা আপনি
আড়ালে আবডালে।
[আড়ালে আবডালে/এ জীবন খসড়া জীবন, পৃ. ৬১]
নূরুল হকের অধিকাংশ কবিতা তাই অ্যামন্সের কবিতার মতো ক্ষুদ্র হলেও তাতে ভাবের উচ্ছ্বাস নেই। বরং বাশোর হাইকুর মতো ছোট কিন্তু ভাবসংযমী ও অর্থবহ। তিনি প্রকৃত অর্থে একজন জীবনবাদী। তাঁর ভিতরে একজন ছোটখাটো রবীন্দ্রনাথেরই বসবাস। যদিও তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে আন্দোলন, সংগ্রাম ও প্রতিমুহূর্তের চিত্র। সমকালীন জাতীয় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর কলমে এতটাই জীবন্ত যে, মনে হবে তিনিই প্রতিনিধিত্ব করছেন নতুন প্রজন্মের। তাঁর কবিতার মধ্যে সেই তারুণ্যও দীপ্ত ও জ্বলজ্বলে। তবে তিনি তারুণ্যেই শুর উজ্জীবিত নন, বার্ধ্যকেও বিচলিত। ফলে কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে বেলাশেষের নেই। অসহায়ত্বের আকুতিও। যেমন:
বেলা শেষে
চারদিকে জলীয় মুহূর্ত সব
সর্বক্ষণ
টলমল করে।
[কে যেন সরিয়ে নিচ্ছে সব/এ জীবন খসড়া জীবন, পৃ. ৭৭]
কিংবা
সীমাহীনতায়?
কোথায় আমার শুরু?
কোথায়ই বা সীমান্ত-বাঁধুনি?
কীভাবে তা মাপজোখ করি,
... ... ...
যদি জানতাম আমি
সেই সীমারেখা
যদি জানতাম।
[যাত্রার প্রাক্কালে/এ জীবন খসড়া জীবন, পৃ. ৭৯]
কিংবা
বসে আছি
শুকনো ধুলোর মতো,
উড়ে যেতে হবে কোনোদিকে।
আকাশের ঝুলানো আঁধারে
জীবনের শত মিথ্যা
মিটমিট করে,
দূরের তারার মতো।
সমুদ্রের মতিগতি দেখে
বোঝ না কি
কার ঘণ্টা বাজে এইখানে?
[এ মুহূর্তে/মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প ও অন্যান্য কবিতা, পৃ. ৯৫]
প্যাট্রিক কারনাফ বলেছেন, জীবনে অভিজ্ঞতার প্রাচুর্য বেড়ে গেলেই তার প্রকাশ হয় সহজ ওসাল। কবি নূরুল হকের বেলায় তাঁর এই উক্তি যেন শতভাগ সত্য। আসলে নূরুল হকের কবিতা তাঁর জীবন অভিজ্ঞতারই সরল প্রকাশ, তাঁর জীবন অভিজ্ঞতারই ফুটনোট তাঁর কবিতা।
কবির অস্তিত্ব যদি মনে করি তাঁর সৃজনে তবে তাঁর পক্ষে এমন উচ্চারণই স্বাভাবিক। যেমনটি বলেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে’। যেমনটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন কবি আবুল হাসান ‘সব রৌদ্র হারিয়ে যায় না’ ঠিক একইভাবে নূরুল হকও জানান দিতেই পারেন:
একদিন কাকপক্ষীর মতো এসে
দুয়ারে দাঁড়ালে
বুঝবে, আমি কে?
পরিচয়