alt

সাময়িকী

সমুদ্রসন্ধানে

‘দূরের কার্নিশ’

ওবায়েদ আকাশ

: বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সিকদার আমিনুল হক

কবিতার ঘনবুনট অরণ্য থেকে, তার প্রাকৃতিক মোহাচ্ছন্নতা কাটাতে চাইলেও একদিন কবি নিজেই কণ্টকিত হন আজীবনের পঙ্ক্তিভারে। এই যে ক্ষত, তাতে লুকানো থাকে আরো ঢের মায়া, আরো বেশি নিবিড়তা, আরো বেশি একাকিত্ব। আহত কবি কোলাহলে থেকেও যেন একা হয়ে যান। ভিড়ের মধ্যে হেঁটেও এক নিঃসঙ্গ পথিক হয়ে পড়েন। একার যাপন তাঁকে বার বার নিয়ে যায় মৃত্যুর কাছাকাছি। এই যে মৃত্যুকে বারবার ছুঁয়ে দেখার পরিভ্রমণ, এতে কবি পিছন ফিরে দেখেন, তাঁর সঙ্গে কেউ নেই, চারদিকে খাঁ খাঁ শূন্যতার ভেতর এই বিচরণ যেন অনন্ত পথের। আর এই অনন্তের যাত্রাপথে কত যে অবহেলা, অসহায়ত্ব, উপেক্ষা, অপমান লুক্কায়িত থাকে, তা কেবল সেই আহত বিধ্বস্ত নিঃসঙ্গ কবি-হৃদয়ই জানে।

আহত হৃদয় একা, করপুট ধরে থাকে একা

শোকার্ত গৃহের কাছে নিরশ্রয় জটিল লণ্ঠন।

শিকড় নেমেছে একা, জল যায়, সেও বুঝি একা

আহত হৃদয় ঢাকা, জরায়ুর কবোষ্ণ জীবন।

প্রণতিপাতের জন্যে ধরে থাক নিজস্ব আঙুল

ভেঙেছে ঘরের বাহু, তেলজল, মন্দির প্রতিমা

আহত হৃদয় জানে, অপমানে অবিমৃষ্য ভুল

বুক জলে একা হও, করপুট ধরে আছে ক্ষমা।

[একা, দূরের কার্নিশ]

গত শতাব্দির ষাটের দশকের আলাদা স্বরের কবি সিকদার আমিনুল হকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “দূরের কার্নিশ”। প্রথম প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থেই তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন, তাঁর মতো আর নাই কেউ। এবং আমৃত্যু তিনি প্রকৃতার্থেই ছিলেন এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষার কবি। তিনি কী করে বুঝেছিলেন যে ষাটের দশকের সেই উত্তাল ভিড়ের মধ্যে থেকে তাঁকে নিজের মতো করেই একা হয়ে যেতে হবে! তা এক বিস্ময়কর ভাবনা। এবং সেই বিস্ময়কর ভাবনাকে যথার্থ পরিণতি দানই তাঁর প্রকৃত সাফল্য। তাঁর সেই সাফল্য অনুভূত হয়েছিল প্রথম গ্রন্থ ‘দূরের কার্নিশের’ ভিতর দিয়েই। এই গ্রন্থকে, এই গ্রন্থের প্রায় বেশ কিছু কবিতাকে তিনি এতটাই কবিতা করে তুলতে পেরেছেন যে, তাঁর পরবর্তী কাব্যযাত্রাটা এই গ্রন্থের ওপর, বা প্রথম স্তম্ভের উপর ভর করেই পাড়ি দেয়া সহজ হয়েছে। যদিও মাত্র ৬২ বছরের জীবনে তিনি আরো একাধিক শিল্পোত্তীর্ণ কাব্য রচনা করেছেন। ‘সতত ডানার মানুষ’, ‘আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছি’, ‘সুপ্রভাত হে বারান্দা’র মতো গ্রন্থগুলোও কবি সম্পর্কে, তাঁর স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে, তাঁর শক্তিমত্তা সম্পর্কে আরো বেশি নিঃসন্দিহান যেমন করে, পাশাপাশি তাঁকে আরেক স্বাতন্ত্র্যে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়। যদিও সিকদারের অধিকাংশ পাঠক তাঁর ‘সতত ডানার মানুষ’কে সবার উপরে জায়গা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। তবে সিকদারের সব পাঠকই তাঁর অভিনবত্ব এবং স্বকীয়তা সম্পর্কে একাত্মতা পোষণ করে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। এটি সত্যিকার অর্থে কবিজীবনের সর্বোচ্চ অর্জন। অনেক ভাল কবিতা লিখেও যদি একটি স্বতন্ত্র স্বর আবিষ্কার করা না যায়, তবে তাঁকে সহজে চিনে নেয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। যেমন: যেমন আমরা সিকদার আমিনুল হককে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘দূরের কার্নিশ’ দিয়েই অনায়াসে শনাক্ত করে ফেলি যে, এই কবি তাঁর সময়ের চেয়ে অগ্রগামী। এই কবি, তাঁর সময়ের অন্য কারো মতো নন। যদিও ষাটের দশকের আরো দু/তিন জন কবি আছেন- তাঁরা নিজেরাও কাব্যভাষায় স্বতন্ত্র।

সিকদার আমিনুল হক ‘দূরের কার্নিশ’ গ্রন্থে প্রথমেই আমাদের তাঁর শব্দভা-ার দিয়ে ঘায়েল করেন। তারপর ক্রমশ এর নিবদ্ধ বুনন এবং চিত্রকল্প, মেটাফরের পুনঃ পুনঃ অভিনবত্বে তিনি সময়কে ছাড়িয়ে যান। যা কোনো কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থে ধরা পড়ার ব্যাপারটা বিরল। কিন্তু সিকদার সেই উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। এই গ্রন্থের ভিতর দিয়েই তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ কাব্যসমুদ্রে ¯œানের অনিবার্যতা দৃঢ় করে গেছেন। এই গ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা আছে যা বারবার, বহুবার পাঠেও পাঠকের কাছে নতুন বলে উপস্থাপিত হয়। প্রথম প্রথম প্রতিভার উচ্চারণ যেন চিরকালীন হয়ে মুখরিত থাকে। এ গ্রন্থের তেমন একটি কবিতা ‘সহজিয়া’। নামকরণটি সহজিয়া হলেও এ কাব্যের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসা আর সহজ হয় না।

একশত দাম্ভিক গোলাপের কাছে আমি উন্মুক্ত প্রেমিকার মতো

প্রণত হয়েছি

গোলাপ একাগ্রতা বোঝে, প্রীত সবুজের নিঃস্ব অবিবেচনায়

মনে তো হলো না

দরজা রুদ্ধ ছিলো, আমি দরজায় মন্ত্রাপ্লুত হয়ে ডাকলুম

দরজা খোলেনি

সাধ্বী রমণীর মতো রৌদ্রে জ¦লে হীরা, স্বচ্ছতার দয়ার্দ্র দক্ষিণা

নীল বনভূমি

দুপুরে জ¦লেছে চিতা, অপরাধী মালঞ্চের বুকে গীতিকবিতার

ছায়া

অর্চনা করেছি যাকে, সেই নারী দুহাত তুলেছে বুকে প্রতিভার

ঘরবাড়ি।

[সহজিয়া, দূরের কার্নিশ]

এ কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে যে নতুনত্ব রচিত হয়েছে, তার উল্লেখ না করেও বলা যায়, “স্বচ্ছতার দয়ার্দ্র দক্ষিণা/নীল বনভূমি” কিংবা “সেই নারী দুহাত তুলেছে বুকে/প্রতিভার ঘরবাড়ি।” লাইনগুলোকে যেভাবে প্রতীকায়ন ও উপমায়িত করেছেন, এখানে যে মেটাফর নিয়ে এসেছেন, তার গভীরতা খুঁজতে গেলে কিনারা পাওয়া যায় না; তবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মোহাচ্ছন্ন করে সন্দেহ নেই।

এ গ্রন্থেই আমরা জেনে যাই সিকদারের কবিতা কতটা মেদশূন্য, ছন্দোবদ্ধ, কতটা টান টান উচ্চারণে কোথাও ঝুলে না-পড়ে পাঠককে স্তব্ধ করে দিতে পারে। কবিতার শুরু ও শেষ হওয়ার ব্যাপারটাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবিতার সাফল্য লুক্কায়িত থাকে। প্রায়শ দেখা যায়, কবিরা যেভাবে শুরু করেন সেভাবে ঠিক শেষটা টানতে পারেন না। আবার অনেক সময় অন্তে এমন এক সমাপ্তি অপেক্ষা করে যা পুরো কবিতাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আবার এমনও কবিতা আছে- যার শুরুটা এতটাই অভিনবত্ব দিয়ে হয়েছে যে, শেষ না করা পর্যন্ত তৃষ্ণা মেটে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাঠকের জন্য কী অবস্থান করছে, তা পাঠকের পক্ষে অনুমান করা সহজ নয়। তবে সমাপ্তি আশানুরূপ না হলে কিংবা নতুন কোনো অভিব্যক্তিতে অনুরণিত না হলে, প্রারম্ভ চমকটা খুব পানসে মনে হয়। এদিক থেকে বিচার করেও অনেক কবিকে আবিষ্কার করা যায়। এ নিরিখে, কখনো কখনো মনে হয় সিকদার আমিনুল হকের প্রতিটি কবিতার স্তবকের প্রথম লাইনই যেন সমগ্র কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি, আবার মনে হয় স্তবকের শেষ লাইনটাও সমগ্র কবিতার সমাপ্তি। এ রকম মনে হবার পিছনে থাকে কবির কাব্যশক্তিমত্তা, যা তাঁকে বিশিষ্টতা দিতে পারে।

ডাকছে মেঘ, বিকেল উড়–-উড়–

এখন তুমি কাঁপিয়ো নাকো ভুরু

মন কি তোমার শুধুই খোলা পাতা

গোলকধাঁধার তীব্র অসারতা

দিঘি, কুয়ো, অশ্রুপাতের নদী

মেঘের ছায়া পড়ছে নিরবধি

বুকের ছায়া আড়ালে তার সাপ

ইচ্ছামতীর চোখই এখন পাপ।

[ঈশ^রী কিন্তু আততায়ী]

ছোট্ট এই কবিতাটিতে মাত্র চারটি স্তবকে আটটি লাইন রয়েছে। সিকদার প্রতিটি দুই চরণের স্তবকে ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। যেন প্রতি দুই লাইনেই একটি একটি করে কবিতার মর্যাদা পাচ্ছে। এখানে সমগ্র কবিতার পরম্পরা মেলাতে গেলে পারম্পর্য আছে আবার নাই। আধুনিক থেকে আধুনিক-উত্তর তত্ত্বের নিরিখে বিচার করলে তার কবিতাটি দুটি তত্ত্বেরই শর্ত পূরণ করছে। একদিকে আছে পারম্পর্য আবার অন্যদিকে আছে পারম্পর্যহীনতা। আজকাল কবিতায় পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বিচ্ছিন্নতা যেন একটা রেওয়াজে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কবি উৎপলকুমার বসুকে তাঁর কবিতার পারম্পর্যহীনতা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “তুমি যে প্রতিদিন কত কাজ করো, তার কি কোনো পারম্পর্য আছে? তুমি কি বলতে পারো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুমি কী কী কাজ করে ঘরে ফিরতে পারবে? কোথা থেকে কোথায় চলে যাও, তার কি কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে?” আসলে মিলিয়ে দেখলে তো তেমনই। আমাদের সাম্প্রতিক কোলাহলমুখর জীবন কত না বিচ্ছিন্নতা, বৈপরীত্য, পারম্পর্যহীনতা দিয়ে পরিচালিত। এর অনেকটা যেমন অনিচ্ছাকৃত, আবার অনেকটা কিন্তু বাধ্যস্বেচ্ছাকৃত।

খুব বেশি দিন হয়নি আমরা সিকদারকে হারিয়েছি; যে কারণে এই প্রগাঢ় বিমুখতা, বিচ্ছিন্নতার হাততালি খেলা সিকদার তাঁর নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, আবার অনিবার্যতা নিয়েই তাঁর কবিতায় তা ঠাঁই পেয়েছে। তিনি আমাদেরকে এক ভিন্ন আচ্ছন্নতা দিয়ে গ্রাস করেন। স্বাদেশিকতার ভিতর থেকে তিনি আমাদের বিশ^ভ্রমণে পর্যটক করে ছাড়েন। ইউরোপীয় কবিতার দ্যুতি, ফরাসি কবিতার আলো দিয়ে যেমন হৃদয়কে আলোড়িত করেছেন, সেই আলোড়নে শিহরিত হয় পাঠক হৃদয়ও। কবির বিষাদাক্রান্ত হৃদয় স্বদেশে বসে বাংলা কবিতার পাশাপাশি বিশ^ কবিতার ওম নিয়ে নিজের দুঃখকে ভুলতে চায়। তখন তার একমাত্র আশ্রয় হয়ে ওঠে কবিতা, প্রেম ও বিরহ। আনন্দের মতো বিরহকেও যে উদযাপন করা যায় মর্ম দিয়ে, তা কবি অনুমান করে তার সত্যতা খুঁজে পান। এবং তখনই তার ভেতর জন্ম নেয় অকাট্য দার্শনিক বোধের। এবং কবিতায় শুরু হয় হিসাব নিকাশের মৌসুম। শুরু হয় দার্শনিক অভিব্যক্তির প্রকাশ।

তোমার চেয়ে দুরূহ যে তাকেই পাওয়া সহজ হলো

এই নিখিলে সহজ পাওয়া যায় না

নির্বিচারে গ্রহণ করার সেই অধিকার জর্জরিত

সমগ্রতার একটু ফাঁকি সয় না।

[আহত পাওয়া]

মনোজগতের এক জটিল সমীকরণ উত্থাপন করলেন সিকদার। সেই সমীকরণ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিগূঢ় বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারেন না। অকপট নেচে ওঠে তাঁর দোয়াতের কালি। যা তাঁকে দিয়ে বলায়- “স্থানকাল ছাড়া ভালোবাসা খুবই বিরক্তিকর শব্দ। যদি-বা বয়স / বিনিময় করি এই ভয়ে ভালোবাসা নাটকের অন্ধের মতো আমাদের / নির্বাসিত করে দেয়। আমি তাই নশ^র হাত অজান্তে লুকিয়ে ফেলে / সমাজের কাছে শোষিত প্রার্থনার কথা বলি।” [নির্বাসিত লাতিন] পঙ্ক্তিগুলোকে আমার প্রথমত কবিতা বলেই মনে হয়নি। এ যেন সাদামাটা গদ্যের উচ্চারণ। সরল অভিব্যক্তির অরস বর্ণনা। এ জাতীয় কবিতাকে পাঠক কীভাবে গ্রহণ করেন তার চেয়ে বড় কথা সিকদার এমন উচ্চারণে কবিতাকে আশ^স্ত করেন। কিন্তু ক্রমেই যখন কবি নতুন চিত্রকল্প মেটাফোরে এই বাস্তবতাকেই অনুরণিত করেন, তখন খুব নিস্তব্ধ কান পাততে হয়। যেমন: “অথচ তোমার পায়ের কাছে বাথরুমে এই জল অর্চনার শব্দে ভেঙে / পড়ে। যদিও জলের কোনো প্রবণতা নেই। / ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ আমার কদর্যতাকে ধর্মের প্রস্তুতি বলে ধরে নিয়েছিল।” [ঐ] শুরুটা সহজিয়া সারল্যে উচ্চারণ করে ক্ষণ পরেই এত অভাবনীয় উচ্চারণ করবেন কবি তা সিকদারের কবিতার একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ সিকদারের প্রতিটি কবিতাই সুসজ্জিত উচ্চারণে সজীব। “বুকের কাছে আগুন থাকে প্রেম আছে কি জানতে? / চৈত্র-দখল হলো সেবার সেই কথা কি মানতে?” [অপচয়]। এও এক কবি হৃদয়ের বুদ্ধিদীপ্ত ধাঁধা। যাকে কবি পঙ্ক্তিতে বসিয়ে উচ্চারণ করেন।

এই যে সিকদারের কবিতায় আমরা এত রকমের ঘোর রহস্য বা ভিন্নতা নিয়ে কত কথা বলি বা বলা হলো এতক্ষণ-, আসলে তার কতটুকু পাঠক অনুধাবন করতে পারেন, এবং সিকদারের এই নিয়ত ভাঙচুরের সঙ্গে পাঠক কতটুকু সম্পর্কযুক্ত? এ প্রসঙ্গে তাঁরই সমসামিয়ক আরেক কবি, সদ্য প্রয়াত হাবীবুল্লাহ সিরাজী ‘দূরের কার্নিশ’ বইটির আলোচনাক্রমে বলেন:

“সিকদারের কবিতা সাধারণ পাঠকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে কতোটুক সক্ষম? সে প্রশ্ন নিঃসন্দেহে তর্কের অতীত নয়। তাঁর কবিতার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধ’রে যাঁরা পরিচিত- তাঁরা ওঠা-নামার দৃষ্টিগ্রাহ্য রেখাচিত্রটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ না হ’লেও আংশিকভাবে অনুভব ক’রতে পারবেন। প্রণত এবং বিনীত এই কবির আলো-আঁধারের সম্পর্ক : প্রেম কী উত্তাপ, কৌশল কী অর্চনা, স্মৃতি কী ভবিষ্যৎ নিয়ে রচিত বিচরণের ভূখ-ে বিরাজ করে ন¤্র মোমের গহীন আলো। অন্তর্গত রঙে যে শিল্পী চিত্রাঙ্কনে অভ্যস্ত তাঁর ভাষা উজ্জ্বল হ’লেও অপ্রতুল স্পর্শী। মনে হয়, সিকদার নিজেকে কবিতার সঙ্গে যেভাবে সম্পৃক্ত ক’রতে চান, তা যেন মাটির সঙ্গে ফসলের আত্মীয়তার মতো। অবশ্য শিকড়ের ব্যাপ্তি এবং ফসলের পরিমাণ ও মান ভূমির জলবায়ু এবং ঊর্বরতার উপর নির্ভরশীল।”

[শালুক, সিকদার আমিনুল হক সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৭]

এবং ‘দূরের কার্নিশ’ গ্রন্থের কবিতাগুলো সম্পর্কে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী নির্দিষ্ট করে বলেন:

“মেজাজে সিকদার স্বল্প-ভাষী; আপেক্ষিক শব্দ নিয়ে তিনি কবিতাকে সহজ আড়ালে গ্রথিত করেন, প্রতীকী আচ্ছাদনে সর্বোত্রগামিতার বিরুদ্ধেই তাঁর পক্ষপাত। ফলে, পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার দৃশ্যমান চিত্রিত রূপটি তাঁর কবিতায় আসে নিজস্ব প্রিয় শব্দাবলীর পুনঃ-পুনঃ আগমনে, জটিল মনোময় আর্তিতে, ব্যর্থতায় এবং সুখদ অনুভূতিতে। আধুনিক মনের সন্দেহ এবং সিদ্ধান্তহীন উপাচার যে সিকদারের কবিতায় অন্বিত তা মনোযোগী পাঠক মাত্রেরই অনুভবযোগ্য। সুগঠিত বাক্যাংশে এবং কবিতার অঙ্গকুশলতায় তাঁর সুস্থিত এবং কল্যাণকর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে।” [ঐ]

সিকদার সরাসরি ফরাসি কবিতা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, এ কথাটা এতটা সহজে উচ্চারণে বিশ^াসী নই। সিকদার স্বল্পভাষী, এবং মৃদু উচ্চারণের প্রখর শক্তিধর কবি। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি যে বাংলায় ফরাসি কবিতাই লিখেছেন, এর ঠিক যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা চোখে পড়ে না। তবে সিকদার কবিতাকে প্রতীকায়িত করতে পছন্দ করেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ফরাসি সিম্বলিস্ট ধারাকেই তিনি পুরোপুরি অনুসরণ করেছেন। পৃথিবীতে এমন অনেক কবিই আছেন যাঁরা কবিতার প্রতীকী উপস্থাপনে বিশ^াসী। সিকদারের প্রচুর কবিতা আছে যা স্বদেশী ভাষা ও ঐহিত্য, এবং বাংলা কবিতারই ধারাবাহিক উচ্চারণ। বাংলা ও বাঙালির সহজাত প্রতীকায়ন। এবং তা এই গ্রন্থটিতেই।

তুমি প্রসন্ন হও; দেখবে ফুল হবে, মাছ হবে দেবদারুর

দীর্ঘ শাখা হবে সমুদ্র-পাহাড়,

অনন্ত নক্ষত্রবীথি হবে অন্ধকার

আমার প্রতিভা হবে সবুজ কাঠুরে

বলেছিলাম, বলেছিলাম-

[যাকে বলেছিলাম]

এখানে একজন জাত বাঙালি ঘরানার ও খাঁটি বাঙালি কবিকে তাঁর স্বভূমির নিসর্গকে চিত্রায়িত করতে দেখি। সিকদারের কবিচারিত্র্য আরো সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সত্তরের দশকের বিশিষ্ট কবি শিহাব সরকার। তিনি দীর্ঘদিন সিকাদারের সান্নিধ্য পেয়েছেন, তাঁর কবিতার করণকৌশল অনুধাবন করেছেন, আবার কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর কবিতা লেখার যৌবন-সমাপ্তি। তাঁর এই উচ্চারণকে তাই নিহিত সত্য বলেই ধরে নেয়া যায়:

“কবিতা নিয়ে সিকদার আমিনুল হকের ‘হোমওয়ার্ক’ বিস্ময়কর। সমসাময়িক ও অনুজতর কবিদের মতো তাঁর বাস্তব জগতের সীমা খুব বিস্তৃত বা কোলাহলমুখর ছিলো না। নিরিবিলি, অন্তরঙ্গ পরিবেশের জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি, স্বেচ্ছানির্বাসনের মতো অনেকটা। এ জীবন এক পর্যায়ে তাঁর জন্য হয়ে দাঁড়ায় বিশুদ্ধ কবিতাযাপন। পার্থিব জীবনের ক্লেদ-কর্দম, নানা ধরনের যুদ্ধ ও অর্থহীন দৌড়ঝাঁপ থেকে তিনি নিজেকে অনেকটা সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন সৌভাগ্যবশত। একজন কবির অনিবার্য রক্তপাত থেকে তিনি অবশ্য মুক্ত থাকতে পারেননি। তাঁর জন্য এটা হয়ে দাঁড়ায় আশীর্বাদ। না হলে কবি জীবনের মধ্য পর্যায়ে পৌঁছে তিনি কীভাবে পেয়ে যান তাঁর জাদুকরী কাব্যভাষা; চিত্রকল্প-উপমা-রূপক-বিরোধাভাস ইত্যাদি মিলিয়ে যা আমাদের কানে বাজে এক ঐন্দ্রজালিক সঙ্গীতের মতো।

সব পাঠকের কবি নন সিকদার আমিনুল হক। মনে হতে পারে তিনি দুরূহ। আসলে বই থেকে বইয়ে তিনি অভিনব থেকে অভিনবতর গন্তব্য খুঁজেছেন। কবিতার, বৃহত্তর অর্থে শিল্পের। তিনি এক পর্যায়ে আমাদের কাছে হয়ে পড়েন সম্পূর্ণ নতুন চরিত্রের এক কবি। একটি খাঁটি বাঙালি সত্তাকে ধারণ করেও তিনি পাঠককে নিজের পরিচয় দেন এক অবিশ্রান্ত যাযাবর হিসেবে। শুরুর দিকে তাঁর কবিতার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো নিসর্গ, প্রেম, বিষণœতা ও নানা পর্যায়ে ব্যক্তির মানসচিত্র। তাঁর বাচনভঙ্গি ছিলো একরৈখিক। পাঠক আন্দাজ করতে পারেনি, চেনা আবহের অন্তরালে তিনি কী অক্লান্তভাবে নিজের রূপান্তর ঘটিয়ে চলেছেন।” [ঐ]

বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হয় তার ‘দূরের কার্নিশ’ গ্রন্থের অনেক কবিতায়ও :

প্রশ্ন আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলো। সমনে তোরণ আছে, এমন আশ^াসের পতাকাও নড়ে ওঠেনি। বিক্রেতার কাছে ওরা জানতে এসেছিল আমি কাকে উৎসর্গ করবো।

[এক অস্থির তোরণ]

আমাকে শিখতে হয়েছে সব একা, নবজাতকের মতো। ঘ্রাণের মধ্যে আমি ঝোড়ো হাওয়ার চিহ্ন পাই। অশ্রুত পথের পাশে দাঁড়িয়ে মৌমাছির মতো বলতে পারি সোজাসুজি ফুলেদের নাম। তবু সে বালক কোনো সম্মান পায়নি!

[বৃত্তান্ত]

আহত চিবুকের পাশে আজ তাই কোনো তাপ বা স্পন্দন নেই। আগুনের কোনো প্রার্থনা তাকে এখন চুম্বকের মতো টানে না। তবু এই সমর্পণের ঝোড়ো হাওয়া দিগন্তের উৎস থেকে বয়ে আনে অঙ্কুরের আশ^াস।

[এই হাত]

কতটা জীবন নিংড়ে এই উচ্চারণ, তা পাঠকমাত্র অনুধাবন করতে পারেন। তাঁর এই গভীর স্বভাবজাত স্বরে মনুষ্যম-লের এই নিহিত ব্যথাকে যেভাবে তিনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই উচ্চারণ করতে পেরেছেন, তিনি যতই স্বল্পায়ু হোন না কেন, তাঁর হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে কোথাও না কোথাও বাঁধা থাকবে কবিতার ভবিষ্যৎ, অঙ্কুরের আশ^াস।

সত্তরের দশকের আরেক বিশিষ্ট কবি মিনার মনসুর, যিনি সর্বদা সিকদারের সহোদরের মতো বেষ্টিত থাকতেন সুখে ও দুঃখে- সিকদারের কবিতা সম্পর্কে দুতিন বাক্যে তার সারকথাটি এখানে উল্লেখ না করলে লেখাটি হয়তো পূর্ণতা পাবে না। মিনার মনসুর ‘সিকাদার আমিনুল হক রচনাসমগ্রে’র ‘ভূমিকা’য় লিখেছেন:

“তাঁর কবিতায় বহির্জগতের ছায়াপাত আছে তবে তা গৌণ, মুখ্য হলো অন্তর্জগৎ। বিশাল তার ব্যাপ্তি। মহাসমুদ্রের মতো সর্বক্ষণই তা ফেনিল ও তরঙ্গময়।”

‘দূরের কার্নিশ’ সেই উত্তাল সিন্ধুর প্রথম ঊর্মিমালা, সৈকতে দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটককে সমুদ্রস্নানের আহ্বান।

ছবি

অর্ধেক জীবন

ছবি

ক্যান্ডি, শ্রীলঙ্কায় বেড়ানোর আদর্শ জায়গা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কবিতায় উড়ন্ত সারস

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

রবীন্দ্রসংগীত চর্চা, বাংলাদেশে-

শক্তিমান কবির কলমে গল্প

ছবি

শহীদুল হকের জীবন ও আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা

ছবি

জলবন্দী স্বপ্ন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কমল চক্রবর্তী, আদি ও অকৃত্রিম রিংমাস্টার

ছবি

নূরুল হক : আধুনিক মরমি কবি

ছবি

ও. হেনরি : ছোটগল্পের কালজয়ী অগ্রদূত

ছবি

নজরুল : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতন

ছবি

নিছক সাজুর গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কবিতায় বিশ্বস্ত স্বর

ছবি

স্মৃতির আয়নাজুড়ে শহীদ ভাই

ছবি

ব্যক্তিগত শহীদ

ছবি

দূরের তারাটিকে

ছবি

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

ছবি

যেদিন সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন

ছবি

ফিরবে না তা জানি

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

tab

সাময়িকী

সমুদ্রসন্ধানে

‘দূরের কার্নিশ’

ওবায়েদ আকাশ

সিকদার আমিনুল হক

বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কবিতার ঘনবুনট অরণ্য থেকে, তার প্রাকৃতিক মোহাচ্ছন্নতা কাটাতে চাইলেও একদিন কবি নিজেই কণ্টকিত হন আজীবনের পঙ্ক্তিভারে। এই যে ক্ষত, তাতে লুকানো থাকে আরো ঢের মায়া, আরো বেশি নিবিড়তা, আরো বেশি একাকিত্ব। আহত কবি কোলাহলে থেকেও যেন একা হয়ে যান। ভিড়ের মধ্যে হেঁটেও এক নিঃসঙ্গ পথিক হয়ে পড়েন। একার যাপন তাঁকে বার বার নিয়ে যায় মৃত্যুর কাছাকাছি। এই যে মৃত্যুকে বারবার ছুঁয়ে দেখার পরিভ্রমণ, এতে কবি পিছন ফিরে দেখেন, তাঁর সঙ্গে কেউ নেই, চারদিকে খাঁ খাঁ শূন্যতার ভেতর এই বিচরণ যেন অনন্ত পথের। আর এই অনন্তের যাত্রাপথে কত যে অবহেলা, অসহায়ত্ব, উপেক্ষা, অপমান লুক্কায়িত থাকে, তা কেবল সেই আহত বিধ্বস্ত নিঃসঙ্গ কবি-হৃদয়ই জানে।

আহত হৃদয় একা, করপুট ধরে থাকে একা

শোকার্ত গৃহের কাছে নিরশ্রয় জটিল লণ্ঠন।

শিকড় নেমেছে একা, জল যায়, সেও বুঝি একা

আহত হৃদয় ঢাকা, জরায়ুর কবোষ্ণ জীবন।

প্রণতিপাতের জন্যে ধরে থাক নিজস্ব আঙুল

ভেঙেছে ঘরের বাহু, তেলজল, মন্দির প্রতিমা

আহত হৃদয় জানে, অপমানে অবিমৃষ্য ভুল

বুক জলে একা হও, করপুট ধরে আছে ক্ষমা।

[একা, দূরের কার্নিশ]

গত শতাব্দির ষাটের দশকের আলাদা স্বরের কবি সিকদার আমিনুল হকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “দূরের কার্নিশ”। প্রথম প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থেই তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন, তাঁর মতো আর নাই কেউ। এবং আমৃত্যু তিনি প্রকৃতার্থেই ছিলেন এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষার কবি। তিনি কী করে বুঝেছিলেন যে ষাটের দশকের সেই উত্তাল ভিড়ের মধ্যে থেকে তাঁকে নিজের মতো করেই একা হয়ে যেতে হবে! তা এক বিস্ময়কর ভাবনা। এবং সেই বিস্ময়কর ভাবনাকে যথার্থ পরিণতি দানই তাঁর প্রকৃত সাফল্য। তাঁর সেই সাফল্য অনুভূত হয়েছিল প্রথম গ্রন্থ ‘দূরের কার্নিশের’ ভিতর দিয়েই। এই গ্রন্থকে, এই গ্রন্থের প্রায় বেশ কিছু কবিতাকে তিনি এতটাই কবিতা করে তুলতে পেরেছেন যে, তাঁর পরবর্তী কাব্যযাত্রাটা এই গ্রন্থের ওপর, বা প্রথম স্তম্ভের উপর ভর করেই পাড়ি দেয়া সহজ হয়েছে। যদিও মাত্র ৬২ বছরের জীবনে তিনি আরো একাধিক শিল্পোত্তীর্ণ কাব্য রচনা করেছেন। ‘সতত ডানার মানুষ’, ‘আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছি’, ‘সুপ্রভাত হে বারান্দা’র মতো গ্রন্থগুলোও কবি সম্পর্কে, তাঁর স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে, তাঁর শক্তিমত্তা সম্পর্কে আরো বেশি নিঃসন্দিহান যেমন করে, পাশাপাশি তাঁকে আরেক স্বাতন্ত্র্যে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়। যদিও সিকদারের অধিকাংশ পাঠক তাঁর ‘সতত ডানার মানুষ’কে সবার উপরে জায়গা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। তবে সিকদারের সব পাঠকই তাঁর অভিনবত্ব এবং স্বকীয়তা সম্পর্কে একাত্মতা পোষণ করে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। এটি সত্যিকার অর্থে কবিজীবনের সর্বোচ্চ অর্জন। অনেক ভাল কবিতা লিখেও যদি একটি স্বতন্ত্র স্বর আবিষ্কার করা না যায়, তবে তাঁকে সহজে চিনে নেয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। যেমন: যেমন আমরা সিকদার আমিনুল হককে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘দূরের কার্নিশ’ দিয়েই অনায়াসে শনাক্ত করে ফেলি যে, এই কবি তাঁর সময়ের চেয়ে অগ্রগামী। এই কবি, তাঁর সময়ের অন্য কারো মতো নন। যদিও ষাটের দশকের আরো দু/তিন জন কবি আছেন- তাঁরা নিজেরাও কাব্যভাষায় স্বতন্ত্র।

সিকদার আমিনুল হক ‘দূরের কার্নিশ’ গ্রন্থে প্রথমেই আমাদের তাঁর শব্দভা-ার দিয়ে ঘায়েল করেন। তারপর ক্রমশ এর নিবদ্ধ বুনন এবং চিত্রকল্প, মেটাফরের পুনঃ পুনঃ অভিনবত্বে তিনি সময়কে ছাড়িয়ে যান। যা কোনো কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থে ধরা পড়ার ব্যাপারটা বিরল। কিন্তু সিকদার সেই উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। এই গ্রন্থের ভিতর দিয়েই তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ কাব্যসমুদ্রে ¯œানের অনিবার্যতা দৃঢ় করে গেছেন। এই গ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা আছে যা বারবার, বহুবার পাঠেও পাঠকের কাছে নতুন বলে উপস্থাপিত হয়। প্রথম প্রথম প্রতিভার উচ্চারণ যেন চিরকালীন হয়ে মুখরিত থাকে। এ গ্রন্থের তেমন একটি কবিতা ‘সহজিয়া’। নামকরণটি সহজিয়া হলেও এ কাব্যের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসা আর সহজ হয় না।

একশত দাম্ভিক গোলাপের কাছে আমি উন্মুক্ত প্রেমিকার মতো

প্রণত হয়েছি

গোলাপ একাগ্রতা বোঝে, প্রীত সবুজের নিঃস্ব অবিবেচনায়

মনে তো হলো না

দরজা রুদ্ধ ছিলো, আমি দরজায় মন্ত্রাপ্লুত হয়ে ডাকলুম

দরজা খোলেনি

সাধ্বী রমণীর মতো রৌদ্রে জ¦লে হীরা, স্বচ্ছতার দয়ার্দ্র দক্ষিণা

নীল বনভূমি

দুপুরে জ¦লেছে চিতা, অপরাধী মালঞ্চের বুকে গীতিকবিতার

ছায়া

অর্চনা করেছি যাকে, সেই নারী দুহাত তুলেছে বুকে প্রতিভার

ঘরবাড়ি।

[সহজিয়া, দূরের কার্নিশ]

এ কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে যে নতুনত্ব রচিত হয়েছে, তার উল্লেখ না করেও বলা যায়, “স্বচ্ছতার দয়ার্দ্র দক্ষিণা/নীল বনভূমি” কিংবা “সেই নারী দুহাত তুলেছে বুকে/প্রতিভার ঘরবাড়ি।” লাইনগুলোকে যেভাবে প্রতীকায়ন ও উপমায়িত করেছেন, এখানে যে মেটাফর নিয়ে এসেছেন, তার গভীরতা খুঁজতে গেলে কিনারা পাওয়া যায় না; তবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মোহাচ্ছন্ন করে সন্দেহ নেই।

এ গ্রন্থেই আমরা জেনে যাই সিকদারের কবিতা কতটা মেদশূন্য, ছন্দোবদ্ধ, কতটা টান টান উচ্চারণে কোথাও ঝুলে না-পড়ে পাঠককে স্তব্ধ করে দিতে পারে। কবিতার শুরু ও শেষ হওয়ার ব্যাপারটাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবিতার সাফল্য লুক্কায়িত থাকে। প্রায়শ দেখা যায়, কবিরা যেভাবে শুরু করেন সেভাবে ঠিক শেষটা টানতে পারেন না। আবার অনেক সময় অন্তে এমন এক সমাপ্তি অপেক্ষা করে যা পুরো কবিতাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আবার এমনও কবিতা আছে- যার শুরুটা এতটাই অভিনবত্ব দিয়ে হয়েছে যে, শেষ না করা পর্যন্ত তৃষ্ণা মেটে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাঠকের জন্য কী অবস্থান করছে, তা পাঠকের পক্ষে অনুমান করা সহজ নয়। তবে সমাপ্তি আশানুরূপ না হলে কিংবা নতুন কোনো অভিব্যক্তিতে অনুরণিত না হলে, প্রারম্ভ চমকটা খুব পানসে মনে হয়। এদিক থেকে বিচার করেও অনেক কবিকে আবিষ্কার করা যায়। এ নিরিখে, কখনো কখনো মনে হয় সিকদার আমিনুল হকের প্রতিটি কবিতার স্তবকের প্রথম লাইনই যেন সমগ্র কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি, আবার মনে হয় স্তবকের শেষ লাইনটাও সমগ্র কবিতার সমাপ্তি। এ রকম মনে হবার পিছনে থাকে কবির কাব্যশক্তিমত্তা, যা তাঁকে বিশিষ্টতা দিতে পারে।

ডাকছে মেঘ, বিকেল উড়–-উড়–

এখন তুমি কাঁপিয়ো নাকো ভুরু

মন কি তোমার শুধুই খোলা পাতা

গোলকধাঁধার তীব্র অসারতা

দিঘি, কুয়ো, অশ্রুপাতের নদী

মেঘের ছায়া পড়ছে নিরবধি

বুকের ছায়া আড়ালে তার সাপ

ইচ্ছামতীর চোখই এখন পাপ।

[ঈশ^রী কিন্তু আততায়ী]

ছোট্ট এই কবিতাটিতে মাত্র চারটি স্তবকে আটটি লাইন রয়েছে। সিকদার প্রতিটি দুই চরণের স্তবকে ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। যেন প্রতি দুই লাইনেই একটি একটি করে কবিতার মর্যাদা পাচ্ছে। এখানে সমগ্র কবিতার পরম্পরা মেলাতে গেলে পারম্পর্য আছে আবার নাই। আধুনিক থেকে আধুনিক-উত্তর তত্ত্বের নিরিখে বিচার করলে তার কবিতাটি দুটি তত্ত্বেরই শর্ত পূরণ করছে। একদিকে আছে পারম্পর্য আবার অন্যদিকে আছে পারম্পর্যহীনতা। আজকাল কবিতায় পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বিচ্ছিন্নতা যেন একটা রেওয়াজে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কবি উৎপলকুমার বসুকে তাঁর কবিতার পারম্পর্যহীনতা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “তুমি যে প্রতিদিন কত কাজ করো, তার কি কোনো পারম্পর্য আছে? তুমি কি বলতে পারো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুমি কী কী কাজ করে ঘরে ফিরতে পারবে? কোথা থেকে কোথায় চলে যাও, তার কি কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে?” আসলে মিলিয়ে দেখলে তো তেমনই। আমাদের সাম্প্রতিক কোলাহলমুখর জীবন কত না বিচ্ছিন্নতা, বৈপরীত্য, পারম্পর্যহীনতা দিয়ে পরিচালিত। এর অনেকটা যেমন অনিচ্ছাকৃত, আবার অনেকটা কিন্তু বাধ্যস্বেচ্ছাকৃত।

খুব বেশি দিন হয়নি আমরা সিকদারকে হারিয়েছি; যে কারণে এই প্রগাঢ় বিমুখতা, বিচ্ছিন্নতার হাততালি খেলা সিকদার তাঁর নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, আবার অনিবার্যতা নিয়েই তাঁর কবিতায় তা ঠাঁই পেয়েছে। তিনি আমাদেরকে এক ভিন্ন আচ্ছন্নতা দিয়ে গ্রাস করেন। স্বাদেশিকতার ভিতর থেকে তিনি আমাদের বিশ^ভ্রমণে পর্যটক করে ছাড়েন। ইউরোপীয় কবিতার দ্যুতি, ফরাসি কবিতার আলো দিয়ে যেমন হৃদয়কে আলোড়িত করেছেন, সেই আলোড়নে শিহরিত হয় পাঠক হৃদয়ও। কবির বিষাদাক্রান্ত হৃদয় স্বদেশে বসে বাংলা কবিতার পাশাপাশি বিশ^ কবিতার ওম নিয়ে নিজের দুঃখকে ভুলতে চায়। তখন তার একমাত্র আশ্রয় হয়ে ওঠে কবিতা, প্রেম ও বিরহ। আনন্দের মতো বিরহকেও যে উদযাপন করা যায় মর্ম দিয়ে, তা কবি অনুমান করে তার সত্যতা খুঁজে পান। এবং তখনই তার ভেতর জন্ম নেয় অকাট্য দার্শনিক বোধের। এবং কবিতায় শুরু হয় হিসাব নিকাশের মৌসুম। শুরু হয় দার্শনিক অভিব্যক্তির প্রকাশ।

তোমার চেয়ে দুরূহ যে তাকেই পাওয়া সহজ হলো

এই নিখিলে সহজ পাওয়া যায় না

নির্বিচারে গ্রহণ করার সেই অধিকার জর্জরিত

সমগ্রতার একটু ফাঁকি সয় না।

[আহত পাওয়া]

মনোজগতের এক জটিল সমীকরণ উত্থাপন করলেন সিকদার। সেই সমীকরণ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিগূঢ় বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারেন না। অকপট নেচে ওঠে তাঁর দোয়াতের কালি। যা তাঁকে দিয়ে বলায়- “স্থানকাল ছাড়া ভালোবাসা খুবই বিরক্তিকর শব্দ। যদি-বা বয়স / বিনিময় করি এই ভয়ে ভালোবাসা নাটকের অন্ধের মতো আমাদের / নির্বাসিত করে দেয়। আমি তাই নশ^র হাত অজান্তে লুকিয়ে ফেলে / সমাজের কাছে শোষিত প্রার্থনার কথা বলি।” [নির্বাসিত লাতিন] পঙ্ক্তিগুলোকে আমার প্রথমত কবিতা বলেই মনে হয়নি। এ যেন সাদামাটা গদ্যের উচ্চারণ। সরল অভিব্যক্তির অরস বর্ণনা। এ জাতীয় কবিতাকে পাঠক কীভাবে গ্রহণ করেন তার চেয়ে বড় কথা সিকদার এমন উচ্চারণে কবিতাকে আশ^স্ত করেন। কিন্তু ক্রমেই যখন কবি নতুন চিত্রকল্প মেটাফোরে এই বাস্তবতাকেই অনুরণিত করেন, তখন খুব নিস্তব্ধ কান পাততে হয়। যেমন: “অথচ তোমার পায়ের কাছে বাথরুমে এই জল অর্চনার শব্দে ভেঙে / পড়ে। যদিও জলের কোনো প্রবণতা নেই। / ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ আমার কদর্যতাকে ধর্মের প্রস্তুতি বলে ধরে নিয়েছিল।” [ঐ] শুরুটা সহজিয়া সারল্যে উচ্চারণ করে ক্ষণ পরেই এত অভাবনীয় উচ্চারণ করবেন কবি তা সিকদারের কবিতার একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ সিকদারের প্রতিটি কবিতাই সুসজ্জিত উচ্চারণে সজীব। “বুকের কাছে আগুন থাকে প্রেম আছে কি জানতে? / চৈত্র-দখল হলো সেবার সেই কথা কি মানতে?” [অপচয়]। এও এক কবি হৃদয়ের বুদ্ধিদীপ্ত ধাঁধা। যাকে কবি পঙ্ক্তিতে বসিয়ে উচ্চারণ করেন।

এই যে সিকদারের কবিতায় আমরা এত রকমের ঘোর রহস্য বা ভিন্নতা নিয়ে কত কথা বলি বা বলা হলো এতক্ষণ-, আসলে তার কতটুকু পাঠক অনুধাবন করতে পারেন, এবং সিকদারের এই নিয়ত ভাঙচুরের সঙ্গে পাঠক কতটুকু সম্পর্কযুক্ত? এ প্রসঙ্গে তাঁরই সমসামিয়ক আরেক কবি, সদ্য প্রয়াত হাবীবুল্লাহ সিরাজী ‘দূরের কার্নিশ’ বইটির আলোচনাক্রমে বলেন:

“সিকদারের কবিতা সাধারণ পাঠকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে কতোটুক সক্ষম? সে প্রশ্ন নিঃসন্দেহে তর্কের অতীত নয়। তাঁর কবিতার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধ’রে যাঁরা পরিচিত- তাঁরা ওঠা-নামার দৃষ্টিগ্রাহ্য রেখাচিত্রটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ না হ’লেও আংশিকভাবে অনুভব ক’রতে পারবেন। প্রণত এবং বিনীত এই কবির আলো-আঁধারের সম্পর্ক : প্রেম কী উত্তাপ, কৌশল কী অর্চনা, স্মৃতি কী ভবিষ্যৎ নিয়ে রচিত বিচরণের ভূখ-ে বিরাজ করে ন¤্র মোমের গহীন আলো। অন্তর্গত রঙে যে শিল্পী চিত্রাঙ্কনে অভ্যস্ত তাঁর ভাষা উজ্জ্বল হ’লেও অপ্রতুল স্পর্শী। মনে হয়, সিকদার নিজেকে কবিতার সঙ্গে যেভাবে সম্পৃক্ত ক’রতে চান, তা যেন মাটির সঙ্গে ফসলের আত্মীয়তার মতো। অবশ্য শিকড়ের ব্যাপ্তি এবং ফসলের পরিমাণ ও মান ভূমির জলবায়ু এবং ঊর্বরতার উপর নির্ভরশীল।”

[শালুক, সিকদার আমিনুল হক সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৭]

এবং ‘দূরের কার্নিশ’ গ্রন্থের কবিতাগুলো সম্পর্কে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী নির্দিষ্ট করে বলেন:

“মেজাজে সিকদার স্বল্প-ভাষী; আপেক্ষিক শব্দ নিয়ে তিনি কবিতাকে সহজ আড়ালে গ্রথিত করেন, প্রতীকী আচ্ছাদনে সর্বোত্রগামিতার বিরুদ্ধেই তাঁর পক্ষপাত। ফলে, পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার দৃশ্যমান চিত্রিত রূপটি তাঁর কবিতায় আসে নিজস্ব প্রিয় শব্দাবলীর পুনঃ-পুনঃ আগমনে, জটিল মনোময় আর্তিতে, ব্যর্থতায় এবং সুখদ অনুভূতিতে। আধুনিক মনের সন্দেহ এবং সিদ্ধান্তহীন উপাচার যে সিকদারের কবিতায় অন্বিত তা মনোযোগী পাঠক মাত্রেরই অনুভবযোগ্য। সুগঠিত বাক্যাংশে এবং কবিতার অঙ্গকুশলতায় তাঁর সুস্থিত এবং কল্যাণকর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে।” [ঐ]

সিকদার সরাসরি ফরাসি কবিতা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, এ কথাটা এতটা সহজে উচ্চারণে বিশ^াসী নই। সিকদার স্বল্পভাষী, এবং মৃদু উচ্চারণের প্রখর শক্তিধর কবি। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি যে বাংলায় ফরাসি কবিতাই লিখেছেন, এর ঠিক যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা চোখে পড়ে না। তবে সিকদার কবিতাকে প্রতীকায়িত করতে পছন্দ করেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ফরাসি সিম্বলিস্ট ধারাকেই তিনি পুরোপুরি অনুসরণ করেছেন। পৃথিবীতে এমন অনেক কবিই আছেন যাঁরা কবিতার প্রতীকী উপস্থাপনে বিশ^াসী। সিকদারের প্রচুর কবিতা আছে যা স্বদেশী ভাষা ও ঐহিত্য, এবং বাংলা কবিতারই ধারাবাহিক উচ্চারণ। বাংলা ও বাঙালির সহজাত প্রতীকায়ন। এবং তা এই গ্রন্থটিতেই।

তুমি প্রসন্ন হও; দেখবে ফুল হবে, মাছ হবে দেবদারুর

দীর্ঘ শাখা হবে সমুদ্র-পাহাড়,

অনন্ত নক্ষত্রবীথি হবে অন্ধকার

আমার প্রতিভা হবে সবুজ কাঠুরে

বলেছিলাম, বলেছিলাম-

[যাকে বলেছিলাম]

এখানে একজন জাত বাঙালি ঘরানার ও খাঁটি বাঙালি কবিকে তাঁর স্বভূমির নিসর্গকে চিত্রায়িত করতে দেখি। সিকদারের কবিচারিত্র্য আরো সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সত্তরের দশকের বিশিষ্ট কবি শিহাব সরকার। তিনি দীর্ঘদিন সিকাদারের সান্নিধ্য পেয়েছেন, তাঁর কবিতার করণকৌশল অনুধাবন করেছেন, আবার কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর কবিতা লেখার যৌবন-সমাপ্তি। তাঁর এই উচ্চারণকে তাই নিহিত সত্য বলেই ধরে নেয়া যায়:

“কবিতা নিয়ে সিকদার আমিনুল হকের ‘হোমওয়ার্ক’ বিস্ময়কর। সমসাময়িক ও অনুজতর কবিদের মতো তাঁর বাস্তব জগতের সীমা খুব বিস্তৃত বা কোলাহলমুখর ছিলো না। নিরিবিলি, অন্তরঙ্গ পরিবেশের জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি, স্বেচ্ছানির্বাসনের মতো অনেকটা। এ জীবন এক পর্যায়ে তাঁর জন্য হয়ে দাঁড়ায় বিশুদ্ধ কবিতাযাপন। পার্থিব জীবনের ক্লেদ-কর্দম, নানা ধরনের যুদ্ধ ও অর্থহীন দৌড়ঝাঁপ থেকে তিনি নিজেকে অনেকটা সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন সৌভাগ্যবশত। একজন কবির অনিবার্য রক্তপাত থেকে তিনি অবশ্য মুক্ত থাকতে পারেননি। তাঁর জন্য এটা হয়ে দাঁড়ায় আশীর্বাদ। না হলে কবি জীবনের মধ্য পর্যায়ে পৌঁছে তিনি কীভাবে পেয়ে যান তাঁর জাদুকরী কাব্যভাষা; চিত্রকল্প-উপমা-রূপক-বিরোধাভাস ইত্যাদি মিলিয়ে যা আমাদের কানে বাজে এক ঐন্দ্রজালিক সঙ্গীতের মতো।

সব পাঠকের কবি নন সিকদার আমিনুল হক। মনে হতে পারে তিনি দুরূহ। আসলে বই থেকে বইয়ে তিনি অভিনব থেকে অভিনবতর গন্তব্য খুঁজেছেন। কবিতার, বৃহত্তর অর্থে শিল্পের। তিনি এক পর্যায়ে আমাদের কাছে হয়ে পড়েন সম্পূর্ণ নতুন চরিত্রের এক কবি। একটি খাঁটি বাঙালি সত্তাকে ধারণ করেও তিনি পাঠককে নিজের পরিচয় দেন এক অবিশ্রান্ত যাযাবর হিসেবে। শুরুর দিকে তাঁর কবিতার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো নিসর্গ, প্রেম, বিষণœতা ও নানা পর্যায়ে ব্যক্তির মানসচিত্র। তাঁর বাচনভঙ্গি ছিলো একরৈখিক। পাঠক আন্দাজ করতে পারেনি, চেনা আবহের অন্তরালে তিনি কী অক্লান্তভাবে নিজের রূপান্তর ঘটিয়ে চলেছেন।” [ঐ]

বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হয় তার ‘দূরের কার্নিশ’ গ্রন্থের অনেক কবিতায়ও :

প্রশ্ন আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলো। সমনে তোরণ আছে, এমন আশ^াসের পতাকাও নড়ে ওঠেনি। বিক্রেতার কাছে ওরা জানতে এসেছিল আমি কাকে উৎসর্গ করবো।

[এক অস্থির তোরণ]

আমাকে শিখতে হয়েছে সব একা, নবজাতকের মতো। ঘ্রাণের মধ্যে আমি ঝোড়ো হাওয়ার চিহ্ন পাই। অশ্রুত পথের পাশে দাঁড়িয়ে মৌমাছির মতো বলতে পারি সোজাসুজি ফুলেদের নাম। তবু সে বালক কোনো সম্মান পায়নি!

[বৃত্তান্ত]

আহত চিবুকের পাশে আজ তাই কোনো তাপ বা স্পন্দন নেই। আগুনের কোনো প্রার্থনা তাকে এখন চুম্বকের মতো টানে না। তবু এই সমর্পণের ঝোড়ো হাওয়া দিগন্তের উৎস থেকে বয়ে আনে অঙ্কুরের আশ^াস।

[এই হাত]

কতটা জীবন নিংড়ে এই উচ্চারণ, তা পাঠকমাত্র অনুধাবন করতে পারেন। তাঁর এই গভীর স্বভাবজাত স্বরে মনুষ্যম-লের এই নিহিত ব্যথাকে যেভাবে তিনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই উচ্চারণ করতে পেরেছেন, তিনি যতই স্বল্পায়ু হোন না কেন, তাঁর হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে কোথাও না কোথাও বাঁধা থাকবে কবিতার ভবিষ্যৎ, অঙ্কুরের আশ^াস।

সত্তরের দশকের আরেক বিশিষ্ট কবি মিনার মনসুর, যিনি সর্বদা সিকদারের সহোদরের মতো বেষ্টিত থাকতেন সুখে ও দুঃখে- সিকদারের কবিতা সম্পর্কে দুতিন বাক্যে তার সারকথাটি এখানে উল্লেখ না করলে লেখাটি হয়তো পূর্ণতা পাবে না। মিনার মনসুর ‘সিকাদার আমিনুল হক রচনাসমগ্রে’র ‘ভূমিকা’য় লিখেছেন:

“তাঁর কবিতায় বহির্জগতের ছায়াপাত আছে তবে তা গৌণ, মুখ্য হলো অন্তর্জগৎ। বিশাল তার ব্যাপ্তি। মহাসমুদ্রের মতো সর্বক্ষণই তা ফেনিল ও তরঙ্গময়।”

‘দূরের কার্নিশ’ সেই উত্তাল সিন্ধুর প্রথম ঊর্মিমালা, সৈকতে দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটককে সমুদ্রস্নানের আহ্বান।

back to top