alt

সাময়িকী

অর্ধেক জীবন

মোহাম্মদ আবদুল মাননান

: বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

“যাহাকে ভালবাস, তাহাকে নয়নের আড় করিও না। যদি প্রেমবন্ধন দৃঢ় রাখিবে, তবে সুতা ছোট করিও। বাঞ্ছিতকে চোখে চোখে রাখিও। অদর্শনে কত বিষময় ফল ফলে! যাহাকে বিদায় দিবার সময়ে কত কাঁদিয়াছ, মনে করিয়াছ, বুঝি তাহাকে ছাড়িয়া দিন কাটিবে না,- কয় বৎসর পরে তাহার সহিত আবার যখন দেখা হইয়াছে, তখন কেবল জিজ্ঞাসা করিয়াছ- ‘ভাল আছ তো?’ হয়ত সে কথাও হয় নাই- কথাই হয় নাই- আন্তরিক বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে। হয়ত রাগে, অভিমানে আর দেখাই হয় নাই। তত না হউক, একবার চক্ষের বাহির হইলেই, যা ছিল তাহা আর হয় না। যাহা যায়, তাহা আর আসে না। যাহা ভাঙ্গে, তাহা আর গড়ে না। মুক্তবেণীর পর যুক্তবেণী কোথায় দেখিয়াছ?’’ -বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

কয়েক সপ্তাহ মুষড়েই ছিল সাহিনা। ক্লাস-ডিপার্টমেন্ট হল কিংবা ক্যাম্পাস অথবা সংগঠনের কাজ- কিছুতেই মনোনিবেশ করা যায়নি, কিছুই ভাল লাগছিল না তার। বারবার মাথার মধ্যে একটি প্রশ্নই প্রবল ঝড়ের ন্যায় এসে আঘাত করছে- মৃত্যুপথযাত্রী একজনের সঙ্গে এই প্রকারের আচরণটা কেনো করেছিলাম! মানুষটি তো তাকে এক-দুনিয়া সমান ভালবাসতো; সাহিনাও কি তাকে এক-সমুদ্র সমান ভালবাসেনি! তাহলে? কী হয়েছিল তার?

আজ আবার খাম থেকে বের করে চেকটায় চোখ বুলাল সাহিনা। পড়ল সেই ছোট্ট চিঠি। আজ-কাল-পরশু মরে যাবেন জেনেও একজন মানুষ লিখেছেন একটি চিঠি; চিঠি না বলে চিরকূট বলাই সমীচীন হবে। কয়েকটি লাইনের চিঠি; বেশ অগোছালো হস্তাক্ষর- ‘মরেই যাচ্ছি। ডাক্তারি বিদ্যারও সাধ্য নেই আমায় বাঁচিয়ে রাখে- টাকা তো দূর-অস্ত। কিছুই নয়; তোমার ওই মুখটা দেখতে ভারি ইচ্ছে হয় আমার। মোবাইলে সারাক্ষণই দেখছি- কিন্তু ছুঁতে ইচ্ছে হয়। সবকিছুর উর্ধেই ছিল আমার ভালোবাসা। তুমিও জানতে। আমি না থাকলে একজনকে বিয়ে করতেই হবে আর তাতে মান্যতা দিতে আপত্তি করলে কী আর ভালবেসেছি তোমায়! কিন্তু এলে না। একটু কথা বলার উপায়ও রাখোনি। অথচ কত মূল্যবান সময় কেটেছে আমাদের। মিনিটের চোখের আড়ালও করতে চাওনি আমায়। ভালো থেকো। হ্যাঁ, কিছু রেখে গেলাম তোমার জন্য- আমার ভালোবাসার শেষ মূল্য। নিয়ে নিও- সোহেল।’

জাহিদই চেকটির ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল।

‘সোহেল নাকি তোমাকে বিশাল অংকের চেক দিয়ে গেছে। ক্যাশ করেছ?’

‘ক্যাশ?’

‘মানে তোমার ব্যাংক হিসেবে জমা দিয়েছ কি?’

‘তোমাকে এই চেকের ব্যাপারে বলেছি বলে তো মনে পড়ছে না।’

‘সে বলোনি। তবে শুনেছি। অনেকেই জানে হয়তো। অন্য থেকে শুনতে হলো আমাকে।’

‘দেখ, জাহিদ। এমনিতেই আমি আপসেট ছিলাম।’

‘কী করবে এতগুলো টাকা দিয়ে?’

‘এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি।’

‘এর সঙ্গে কিছু যোগ করে একটা ফ্ল্যাট কেনাই যায়। আমিও কন্ট্রিবুট করতে পারি। আমাদের বিয়ে তো সহসাই হয়ে যাচ্ছে।’

‘স্ত্রীর প্রাক্তন প্রেমিকের টাকায় ফ্ল্যাট কিনতে চাও? তোমাকে তো একটু উচ্চ-রুচির মানুষ ভেবেছিলাম।’

শেষের শব্দবন্ধ জাহিদের কলজের মধ্যে যেন ধাক্কা খেল। চুপ হয়ে আছে সে। সাহিনাই কথা বলে নীরবতা ভেঙে দিল।

‘টাকাটা নিতে চাইনে। খুব লাগছে আমার। সোহেলের বোনের সঙ্গে কথা বলে ফেরতও দিতে পারি।’

জাহিদ এই কথার জবাবে কিছুই বলে না। এখন বলা মানেই আরো রূঢ় কিছু শুনতে হতে পারে। শেষের দিকে সোহেলের কেবিনে না-যাওয়ার বিষয়ে জাহিদের খানিকটা ইচ্ছে ছিল। সে-রাগটাও এখন সুনামির মতো আছড়ে পড়ছে সাহিনার মধ্যে- যদিও জাহিদের ইচ্ছেই চূড়ান্ত ছিল না সেক্ষেত্রে।

নিজ থেকেই রাকিবুলকে চেকটির কথা বলেছিল সাহিনা। সোহেলের মৃত্যুসময়ে রাকিবুল দেশের বাইরে ছিল। ফিরে এসে নিজ থেকেই সোহেলের কথা জানতে চাইল রাকিবুল। বললো-

‘শেষের দিকে দু’-একবাার হাসপাতালে যেতে পারতে। গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?’

‘ব্যাপারটা আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে এখন। কষ্ট পাচ্ছি।’

‘খুবই স্বাভাবিক সেটা।’

‘জানো, সোহেল আমার নামে এক কোটি টাকার চেক লিখে রেখে গেছে।’

‘সে-কী?’

সোহেলের চিঠিটা মেলে ধরলো রাকিবুলের চোখের সামনে। রাকিবুল বার-তিনেক পড়লো সোহেলের চিরকূটসম চিঠিটা।

‘গ্রেট। স্যালুট, সোহেল ভাইকে। সেরা প্রেমিকের তালিকায় ওঁর নাম যেতেই পারে।’

‘কী করবো এতগুলো টাকা দিয়ে। আমি তো এই পরিমাণ টাকা কোনকালে চোখে দেখব বলেও ভাবিনি। আর শোন, জীবিত সোহেলের চেয়ে মৃত সোহেলকেই মনে হয় বেশি ভালোবাসি।’

শেষের কথাটা বলে সাহিনা রাকিবুলর দিকে তাকাল। এই কথায় রাকিবুলের বিশেষ হেলদেল লক্ষ করলো না সাহিনা।

‘কী করবে, সেও তোমার সিদ্ধান্ত। বলছি কি, একজন দিয়েছেন বলেই নিতে হবে, তারও মানে নেই। আর ওই টাকা আমার পরিবারে খুবই সামান্য টাকা।’

আড়চোখে রাকিবুলের দিকে তাকাল সাহিনা।

‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। তাছাড়া মৃত্যুপথযাত্রী যে-মানুষটি থেকে নিজের সমুদয় ভালোবাসা আর সকল দায় ফিরিয়ে নিয়েছ, তার টাকা নেবে কোন মুখে? আমি তো বলব, এই আইফোনটাও তোমার আর হাতে নেয়া ঠিক না।’

এই নিয়ে আর কোন কথা হয় না। কফির বিল চুকিয়ে রাকিবুল চলে যায় নিজের গন্তব্যে।

হলের সিঙ্গেল রুমে দিনে দুই-তিনবার চেকটার দিকে তাকায় আর চিঠিটা বারবার পড়ে সাহিনা। কতক্ষণ চোখে পানি। কতক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা। অনুসূয়াকে খুব মনে পড়ছে আজ। একই সাবজেক্টের না। আবার একই সংগঠনও করে না। অথচ অনুসূয়াকেই এই হলজীবনে একান্ত বিশ^স্ত আর নির্ভরযোগ্য মনে হয়। অনুসূয়া অনেকেরই আস্থা আর বিশ^স্ততার প্রতীক হয়ে আছে। ফোন করতেই অনুসূয়া বললো, ‘দু’দিন আমিও ভাবছি তোকে। আছিস কেমন?’

‘আছি। এদিকে একবার আসবি?’

‘আজ হবে না রে। বৌদিকে নিয়ে একটু চেক-আপে বের হব। ছ’মাস তো। কোনো জটিলতা নেই। তারপরও এখন ঘনঘন ডাক্তারের কাছে দৌড়াতেই হয়। কাল বা পরশু দেখছি একবার।’

‘হলেই চলে আছিস।’

‘সে না হয় ফোন করে ঠিক করে নেব।’

কতগুলো অদ্ভুত আর উল্লাপাল্টা ব্যাপার ঘটেই। সাহিনার যা চাই, তা নেই- যা চাইনে তা হাতের কাছেই। চাওয়া আর না-পাওয়ার বৈপরীত্যে ভরপুর এক-একজন মানুষের জীবন। রাকিবুলের সঙ্গে তো কথাই হয় না সাহিনার। ফোন করলেই ব্যবসার কাজে ব্যস্ততার কথা। নিজ থেকে রাকিবুল আর ফোনও করছে না। একটামাত্র চেকই সাহিনার চোখ ফুটিয়ে দিয়েছে যেন। বুঝে গেছে জাহিদ আর রাকিবুলের পার্থক্যটুকুন। এদিকে জাহিদ শিক্ষক হয়ে গেছে। কে একজন বলছে, প্রক্টরের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের কথাবার্তা বহুদূর এগিয়ে গেছে। জাহিদের এক-বন্ধু বলে গেছে, জাহিদ শিক্ষক হওয়ায় রাকিবুলও ক্রমশ দূরে সরছে। জাহিদ হয়তো জেনে গেছে, ব্যবসায়ীর চেয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকই সাহিনার অধিক পছন্দ। কিন্তু মধ্যখানে কয়েক মাসের মুষড়ে থাকায় জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগেও ভাটার টান পড়েছে; সে হয়তো রাকিবুল জানেই না। রাকিবুলকে অধিক পছন্দ হলেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার জাহিদ থেকে অনুরক্তি হ্রাস পেয়েছে দ্রুত- বিশেষ করে সোহেলের এককোটি টাকার প্রতি ওর লোভের কথা ভেবে।

এরি মধ্যে অনুসূয়া চলে এসেছে।

‘তুই হল ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমি তো একা হয়ে গেছিরে।’

‘একা! তোর রুমে না সারাক্ষণ জুনিয়ররা ভিড় করত, মানে তোর দলের মেয়েরা।’

‘আসছে না আর। আমিও সংগঠনের কাজে বের হচ্ছি না। একটা কাজই এখন বাকি। মাস্টার্সটা।’

‘অনার্সে তো ভালোই জিপিএ ছিল তোর। কেন যে ড্রপ দিতে গেলি! বুঝি না রে।’

‘তখন তো ভিপি কিংবা জিএস হতে চেয়েছিলাম। এরপর সেন্ট্রাল কমিটি।’

‘ইচ্ছে নেই আর? উবে গেল কি!’

‘অনেকটা সে-রকমই।’

‘কেনো রে, সাহিনা?’

‘সোহেলের মৃত্যু আমাকে বদলে দিয়েছে। নব্বই ডিগ্রি উল্টো ঘুরছি এখন, অনু।’

‘মানে কি?’

‘রাজনীতিটা আর নয়। সোহেল হাতে ধরেই এই পথে এনেছিল। ওর জন্যই তরতর করে ওপরে উঠেছি। ও আমাকে আরো ওপরে দেখতে চেয়েছিল। আমি তো আদতে গ্রাম দেখেই এসেছি। পড়ালেখা শেষ করেই নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়া আর ছোট্ট একটা চাকরি। নির্ঝঞ্ঝাট একটা সংসার।’

‘এখন এইসব বলছিস কেনো।’

‘না ওপরে যাওয়ার সিঁিড় আমাদের জন্য কখনোই সহজ ছিল না। জানিস তো, আমাদের চৌদ্দগুষ্ঠিতে রাজনীতি নেই।’

‘শেষটায় সোহেলদার সঙ্গে দেখা করলি না কেনো?’

‘এই প্রশ্নটা আর করিস না। কষ্টটা নিতে পারিনে। তবে একটা জবাব রেডি করেছি।’

‘কী?’

‘তুই জানিস, সেই সময়ে জাহিদ ও রাকিবুল, দু’জনই ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমিও দু’জনের কাছেই নিজেকে স্বার্থপরের মতো মেলে ধরতে চেয়েছি। কিন্তু অন্যদের জন্য উত্তরটা এই যে, সোহেলকে ওই অবস্থায়, ওই শরীরে দেখে ঠিক থাকতে পারতাম না।’

‘হুম। অনেকেই জবাবটা খাবে। কিন্তু জাহিদ ও রাকিবুলের বিষয় যারা জানে, তারা বলবে, ওই এককোটি টাকা হজম করার জন্যই সাহিনা এখন এসব বলছে।’

‘হতেই পারে। আর আদপেই এখন আমি জীবিত সোহেলের চেয়ে মৃত সোহেলকে বেশি ভালোবাসি। সোহেলের কথা ভেবে ভেবে আর আমাদের স্মৃতিগুলো আগলে রেখেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। নারী-পুরুষে কী হয়, সে আস্বাদ তো সোহেল আমাকে দিয়েই গেছে। মনের বিয়ে তো হয়েছিল আমাদের। আর না হলেও চলবে।’

‘কী বলিস, তুই? এমন পরিবর্তন তোর মধ্যে!’

‘হ্যাঁ।’

‘ওই জাহিদ কিংবা রাকিবুল?’

‘রাকিবুল শীঘ্রই বিয়ে করছে। যতটা জেনেছি, একজন সংসদ সদস্য শাশুড়ি হচ্ছে ওর।’

‘কিছু বলবি না তাকে?’

‘না। ইচ্ছেই নেই আর।’

‘আসতে বলেছিস কেনো?’

‘হ্যাঁ। আসল কথাই হলো না। ওই চেকটা কী করি, অনু?’

‘তোর ইচ্ছেটা কী, শুনি।’

‘অনেক নিয়েছি। ব্যাংকের টাকাগুলো সোহেলের; তোকে বলেছি। শুনে অবাক হবি, বাড়িতে টিনের ঘর সেমি-পাকাও হয়েছে সোহেলের টাকায়। ছোটভাইয়ের চাকরি, তাও ওর অবদান।’

‘বলিস কী, সাহি!’

‘বাবা তো প্রশ্নই করেছিলেন, “কোথায় পেয়েছিস এই টাকা?”

‘কী বললি?’

‘বাবাকে কিছুই বলিনি। মাকে বলেছি, জামাই বেড়াতে আসলে একটু থাকতে তো দিতে হবে, মা।’

‘এই এক কোটি টাকার কথা জানবে না!’

‘না। বলিনি তো এখনো। আর বলতে চাইনে আপাতত।’

‘সে বরং ভালো।

‘চেকটা সোহেলের বোনকে ফেরত দিতে চাই।’

‘এই চেক তো আর ফেরত দেয়া যাবে না। এটা তোর নামেই জমা করতে হবে। একটা কাজ র্ক, চেকটা তোর হিসাবে জমা দিয়ে দে। পরে যা করার করবি।’

‘সেক্ষেত্রে সোহেলের বোনকে আর একটা চেক দেয়া যায়।’

‘ঠিক। কিন্তু সোহেলের বোন এই টাকা নেবে কিনা তাতে আমার বিস্তর সন্দেহ আছে। ক’দিনে মেয়েটাকে দেখলাম তো। খুবই ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন।’

‘তুই-আমি বুঝিয়ে বললে যদি...।’

‘চেকটা দেয়ার সময়েই বলেছিল, “ভাইয়ার শেষ ইচ্ছে। আমাকে পালন করতেই হবে’’। ফলে এটা নেবে বলে মনে হয় না। হয়তো বলেই বসবে, “এটা ফিরিয়ে নিলে আমার ভাইয়ের আত্মা কষ্ট পাবে’’। পারবি, কিছু বলতে আর!’

‘তাহলে!’

‘চেকটার তারিখ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে তোর হিসাবে জমা দে। দেরি করিস না।’

‘এরপর?’

‘নানা অপশনই আছে। বোন না দিলে কোন কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে দেয়া যায়। অথবা সোহেলের নামেই একটা ট্রাস্ট করা যায়। নিজের জন্য কিছু রেখে দেয়াও সম্ভব।’

‘ঠিক আছে। ভালো কথা, তোর বাইরে যাওয়ার কতটা হলো।’

‘একটু দেরিই হবে। পরবর্তী জুনের সেশন ধরতে হবে।’

‘দেরি কেনো?’

‘বলিস না, অমিয় বাবু বিয়ের জন্য বারবার বলছে। বাবা-মাকেও ম্যানেজ করে ফেলেছে। ফলে বিয়েটা করে একসঙ্গেই যেতে চাই। ডাক্তার বাবুও বিদেশেই হায়ার ডিগ্রি করতে চায়।’

‘ভালো তো।’

এরপর বহুদিন দেখা নেই অনুসূয়ার সঙ্গে। অনেকটাই একা হয়ে গেছে সাহিনা। তবে অনুর সঙ্গে ফোনে কথা হয়। এদিকে সাহিনার মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে আর ওদিকে কুমিল্লায় অনুর বিয়ে। পরীক্ষার রুটিনে ফাঁক ছিল বিয়ের দিনে, চাইলে যাওয়া যেত। কিন্তু সাহিনার নতুন করে এক-সমস্যা দেখা দিয়েছে। শরীরের ক্রিটেনিন বেড়ে গেছে এবং কিডনি পয়েন্টে প্রচ- ব্যথা হচ্ছে। শরীরও শুকিয়ে যাচ্ছে। কিছুই মুখে নিতে পারছে না। এর মধ্যেও মাস্টার্স পরীক্ষাটা কোনোভাবে শেষ করলো সাহিনা। অতঃপর এই ডাক্তার, সেই ডাক্তার আর হরেক পরীক্ষার পর একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ জানালেন, ডানদিকের কিডনিতে একটা সিস্ট আছে। দ্রুত এই সিস্ট রিমুভ করা দরকার। সিস্টে ম্যালিগন্যান্ট থাকলে ডান-কিডনিও ফেলে দিতে হবে, আর এটাই চিকিৎসা। চোখে অন্ধকার দেখলো সাহিনা। প্রথমেই অনুসূয়াকে তলব দিল সে।

অনুসূয়ার ভাইয়ের ফকিরাপুলের বাসায় ডা. অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায় স্ত্রীর বান্ধবীর রিপোর্টগুলো বহুক্ষণ ধরে দেখছেন।

বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে অপারেশনের আগে ম্যালিগন্যান্ট নিশ্চিত-অনিশ্চিতের ওপর নির্ভর করবে কেবল সিস্ট সরাতে হবে, না ডানদিকের কিডনিও।’

এরপর বললেন, ‘অনু, আমি রিপোর্টগুলো একটু চেন্নাইয়ে পাঠাতে চাই। ওখানের নেফ্রোলজির বিভাগের প্রধানের সঙ্গে আমার কিছুটা জানাশোনা আছে।’ বলেই তিনি তাকালেন সাহিনার দিকে। বললেন, ‘কী বলেন, দিদি?’

‘ও কী বলবে! তুমি পাঠিয়ে দাও। আর সাহিনার চিকিৎসার দায়ভার এখন তোমার-আমার। এক-সময়ে অনেকেই ছিল, কিন্তু এখন এই ঢাকায় ওর তেমন কেউ নেই। নিকটজন থাকে সেই বরিশালের হিজলায়। একমাত্র ভাই প্রাইমারির শিক্ষক; জীবনে একবারই ঢাকায় এসেছে। বুঝলে, ডাক্তার।’

‘দরকার হলে আসবে। তবে বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসা ঠিক হবে না।’

‘কাউকেই আপাতত দরকার নেই। দরকার হলে মাসিমা একবার আসবেন। আর শোন্, পরের মাসেই আমি বাসা নিচ্ছি। হলের পাততাড়ি গুটিয়ে সরাসরি আমার বাসায় ওঠে যা। ফাইনাল কিন্তু।’

‘তোদের সমস্যা হবে যে।’

‘সমস্যা! তোকে নিয়ে? মনে নেই, বেঘোরে জ¦রে ভুগছিলি। বললি, “বিফ্ খেতে ইচ্ছে করছে”। হলের রুমেই রান্না করতে চেয়েছিলাম। তুইই বললি, “থাক, ঝামেলা করিসনে’’। এরপর হোটেল থেকে বিফ্ এনে তোকে কে খাইয়েছে, বল্ একবার। অথচ আমি বামুনের মেয়ে।’

‘তুই আদতে প্রথমে একজন মানুষ। এরপর একজন কমিউনিস্ট। তোর মধ্যে বিন্দু-বিসর্গ ব্রাহ্মণ্য অবশিষ্ট নেই এখন।’

দু’দিনেই চেন্নাই অ্যাপোলোর রিপ্লাই চলে এসেছে। যত দ্রুত সম্ভব, ওখানে যাওয়ার জন্য মেইলে বিশেষ করে বলা হয়েছে। ডাক্তার আরো লিখেছেন, ‘এখানে একটু ভিড় আছে বটে। কিন্তু অমিয় বাবুর অনুরোধে দ্রুত ব্যবস্থা করা যাবে।’

কয়েক দিনের মধ্যেই সাহিনার মেডিকেল ভিসা হয়ে গেছে। অনুসূয়া সঙ্গে যাবে। ওর স্বামীও যেতে রাজি হয়েছেন। সাহিনা বললো, ‘অনু, আমি অসুস্থ, তাতে কী। তোদের হানিমুনটাও হয়ে যাবে।’

‘এসব ছাড়। নিজের সুস্থতার কথা ভাব্ তো।’

হয়তো বিধাতার লিখনই হবে। সেই চেন্নাই অ্যাপোলো। সোহেল রোগমুক্তির জন্য এখানেই এসেছিলেন। মনে করতেই কাঁদছে সাহিনা। সান্ত¡না দিয়েও কূল পাচ্ছে না অনুসূয়া। এখানে ডানদিকের কিডনি রিমুভই করতে হলো। সিস্টে ক্যানসারের নমুনা মিলেছে। ঢাকায় ফিরে অনুর বাসাতেই থাকছে সাহিনা। কিন্তু বিপদ পিছু ছাড়ছে না তার। একটা যেতে না যেতে আর একটা- এমনই হয়। বাঁ কিডনিও ফাংশন করছে না। ক্রিটিনিন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ডায়ালিসিস শুরু করা বই বিকল্প নেই। অমিয় বাবু বারডেমের কথা বলছিলেন। সাহিনা বললো, ‘না রে অনু, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ভার্সিটিই হোক।’ ডায়ালিসিস করতে হবে সপ্তাহে দু’বার। কিন্তু তিন-চারবার ডায়ালিসিস হওয়ার পর ডাক্তার রোগীকে ধরে রাখলেন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের জন্য। এবার কেবিনই নিতে হলো সাহিনার জন্য। দু’দিন যেতেই অনুর কথায় একজন ডাক্তার বন্ধুকে বলে ৩১৭ নম্বর কেবিনই সাহিনার জন্য বরাদ্দ করাতে সক্ষম হলেন ডা. অমিয়।

বলাই হয়, রক্ত ডায়ালিসিস মানেই ব্যাংক অ্যাকাউন্টেরও ডায়লিসিস হতে থাকে। চেন্নাইয়ে অনেক টাকাই খরচ হয়ে গেছে। এবার এক কোটিতে হাত পড়ে গেল। অনু বললো, ‘সোহেলদা কি ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন? নইলে এই টাকা তোর জন্য রেখে গেছেন কেনো!’

চেকটা পাওয়ার পর, তখন জাহিদ কিংবা রাকিবুল দু’জন থেকেই এক-রকমের বিচ্ছিন্ন সাাহিনা- নিজকে চরম অপরাধী মনে হচ্ছিলো তখন; বারবারই জীবিত সোহেলকে শেষ না-দেখার গভীর অনুতপ্তবোধ কুরে কুরে খাচ্ছিলো সাহিনাকে। ছেড়ে দিয়েছে পার্টির কাজ। তখন, সোহেলের কথা ভেবে ভেবে মনে হচ্ছিল, মরে গেলেই ভাল হয়। কি জানি, সেই চাওয়াই হয়তো মঞ্জুর হয়ে গেছে আকাশ কিংবা পাতালের কোন-এক জায়গায়- নয় তো, সেই ৩১৭ কেবিনেই শুয়ে থাকতে হচ্ছে ! বিধির কী এক অমোঘ বিধান।

দুদিন আগেই বলেছিল অনুসূয়াকে, অর্ধেক জীবন আমার। তোর সোহেলদারও তাই ছিল। দুইজনের মিলে এক-জীবন।’

সাহিনার মরদেহ বরিশালেই পাঠানো হবে। ওর বাবার ইচ্ছে এটাই। শেষের দিকে সাহিনার মা-ও হাসপাতালের কেবিনে ছিলেন কতক দিন। ভাইও এখন ঢাকায়। বোনকে নিয়ে যাবে। জীবিত নয়, মৃতাবোনকে।

গতকাল রাত তিনটার দিকে জোরালো শ্বাসকষ্ট অক্সিজেন দিয়েও সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি। সোহেলের পথেই যেতেই হলো সাহিনাকে; সবাই যাবে- কেবল দিনক্ষণ ভিন্ন। বারডেমের হিম ঘর থেকে একটু পর লাশবাহী গাড়ি যাত্রা করবে বরিশালের উদ্দেশ্যে। অনুসূয়ার চোখের জল সবটাই বেরিয়ে গেছে। হলজীবনে যা ছিল, ছিলোই। কিন্তু সোহেল আহমেদের চলে যাওয়ার পর অনুসূয়া যেন সাহিনার আপ্ত-সহোদরাই হয়ে গেছে। চিকিৎসার সব দায় নিয়েছে। সেই বান্ধবী কিংবা বোন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে এখন; কোনো মানে আছে?। হায়, জীবন!

অনুসূয়া মনে মনে বললো, সাহি তোর জীবনই বরং পূর্ণ, পরিপূর্ণ। স্বার্থক। কতদিন বেঁেচ থাকলি তা ম্যাটার করে না। তোদের ভালোবাসা অর্ধেক নয়-সম্পূর্ণ। কতজনই তো ভালোবাসছে, প্রেম করছে। বিয়ে হচ্ছে, হচ্ছে বিচ্ছেদও। কারোরটাই এমন নয়। ভালোবাসার ভুবনে তুই আর সোহেলদাই সেরা হয়ে থাকবি রে। বিদায়, বন্ধু। পরপারে ভালো থাকিস, সাহি।

এভাবেই চোখের জলে সাহিনাকে বিদায় জানাল অনুসূয়া। বিষাদের পেয়ালায় যেন ডুবে যাচ্ছে সে। অনুসূয়ার হৃদয়ে ধ্বনিত হতে থাকে-

“আমার দুই আঁখি ওই সুরে

যায় হারিয়ে সজল ধারায় ওই ছায়াময় দূরে।

ভিজে হাওয়ায় থেকে থেকে কোন্ সাথি মোর যায় যে ডেকে,

একলা দিনের বুকের ভিতর ব্যথার তুফান তোলে।’’

ছবি

ক্যান্ডি, শ্রীলঙ্কায় বেড়ানোর আদর্শ জায়গা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘দূরের কার্নিশ’

ছবি

কবিতায় উড়ন্ত সারস

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

রবীন্দ্রসংগীত চর্চা, বাংলাদেশে-

শক্তিমান কবির কলমে গল্প

ছবি

শহীদুল হকের জীবন ও আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা

ছবি

জলবন্দী স্বপ্ন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কমল চক্রবর্তী, আদি ও অকৃত্রিম রিংমাস্টার

ছবি

নূরুল হক : আধুনিক মরমি কবি

ছবি

ও. হেনরি : ছোটগল্পের কালজয়ী অগ্রদূত

ছবি

নজরুল : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতন

ছবি

নিছক সাজুর গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কবিতায় বিশ্বস্ত স্বর

ছবি

স্মৃতির আয়নাজুড়ে শহীদ ভাই

ছবি

ব্যক্তিগত শহীদ

ছবি

দূরের তারাটিকে

ছবি

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

ছবি

যেদিন সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন

ছবি

ফিরবে না তা জানি

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

tab

সাময়িকী

অর্ধেক জীবন

মোহাম্মদ আবদুল মাননান

বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

“যাহাকে ভালবাস, তাহাকে নয়নের আড় করিও না। যদি প্রেমবন্ধন দৃঢ় রাখিবে, তবে সুতা ছোট করিও। বাঞ্ছিতকে চোখে চোখে রাখিও। অদর্শনে কত বিষময় ফল ফলে! যাহাকে বিদায় দিবার সময়ে কত কাঁদিয়াছ, মনে করিয়াছ, বুঝি তাহাকে ছাড়িয়া দিন কাটিবে না,- কয় বৎসর পরে তাহার সহিত আবার যখন দেখা হইয়াছে, তখন কেবল জিজ্ঞাসা করিয়াছ- ‘ভাল আছ তো?’ হয়ত সে কথাও হয় নাই- কথাই হয় নাই- আন্তরিক বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে। হয়ত রাগে, অভিমানে আর দেখাই হয় নাই। তত না হউক, একবার চক্ষের বাহির হইলেই, যা ছিল তাহা আর হয় না। যাহা যায়, তাহা আর আসে না। যাহা ভাঙ্গে, তাহা আর গড়ে না। মুক্তবেণীর পর যুক্তবেণী কোথায় দেখিয়াছ?’’ -বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

কয়েক সপ্তাহ মুষড়েই ছিল সাহিনা। ক্লাস-ডিপার্টমেন্ট হল কিংবা ক্যাম্পাস অথবা সংগঠনের কাজ- কিছুতেই মনোনিবেশ করা যায়নি, কিছুই ভাল লাগছিল না তার। বারবার মাথার মধ্যে একটি প্রশ্নই প্রবল ঝড়ের ন্যায় এসে আঘাত করছে- মৃত্যুপথযাত্রী একজনের সঙ্গে এই প্রকারের আচরণটা কেনো করেছিলাম! মানুষটি তো তাকে এক-দুনিয়া সমান ভালবাসতো; সাহিনাও কি তাকে এক-সমুদ্র সমান ভালবাসেনি! তাহলে? কী হয়েছিল তার?

আজ আবার খাম থেকে বের করে চেকটায় চোখ বুলাল সাহিনা। পড়ল সেই ছোট্ট চিঠি। আজ-কাল-পরশু মরে যাবেন জেনেও একজন মানুষ লিখেছেন একটি চিঠি; চিঠি না বলে চিরকূট বলাই সমীচীন হবে। কয়েকটি লাইনের চিঠি; বেশ অগোছালো হস্তাক্ষর- ‘মরেই যাচ্ছি। ডাক্তারি বিদ্যারও সাধ্য নেই আমায় বাঁচিয়ে রাখে- টাকা তো দূর-অস্ত। কিছুই নয়; তোমার ওই মুখটা দেখতে ভারি ইচ্ছে হয় আমার। মোবাইলে সারাক্ষণই দেখছি- কিন্তু ছুঁতে ইচ্ছে হয়। সবকিছুর উর্ধেই ছিল আমার ভালোবাসা। তুমিও জানতে। আমি না থাকলে একজনকে বিয়ে করতেই হবে আর তাতে মান্যতা দিতে আপত্তি করলে কী আর ভালবেসেছি তোমায়! কিন্তু এলে না। একটু কথা বলার উপায়ও রাখোনি। অথচ কত মূল্যবান সময় কেটেছে আমাদের। মিনিটের চোখের আড়ালও করতে চাওনি আমায়। ভালো থেকো। হ্যাঁ, কিছু রেখে গেলাম তোমার জন্য- আমার ভালোবাসার শেষ মূল্য। নিয়ে নিও- সোহেল।’

জাহিদই চেকটির ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল।

‘সোহেল নাকি তোমাকে বিশাল অংকের চেক দিয়ে গেছে। ক্যাশ করেছ?’

‘ক্যাশ?’

‘মানে তোমার ব্যাংক হিসেবে জমা দিয়েছ কি?’

‘তোমাকে এই চেকের ব্যাপারে বলেছি বলে তো মনে পড়ছে না।’

‘সে বলোনি। তবে শুনেছি। অনেকেই জানে হয়তো। অন্য থেকে শুনতে হলো আমাকে।’

‘দেখ, জাহিদ। এমনিতেই আমি আপসেট ছিলাম।’

‘কী করবে এতগুলো টাকা দিয়ে?’

‘এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি।’

‘এর সঙ্গে কিছু যোগ করে একটা ফ্ল্যাট কেনাই যায়। আমিও কন্ট্রিবুট করতে পারি। আমাদের বিয়ে তো সহসাই হয়ে যাচ্ছে।’

‘স্ত্রীর প্রাক্তন প্রেমিকের টাকায় ফ্ল্যাট কিনতে চাও? তোমাকে তো একটু উচ্চ-রুচির মানুষ ভেবেছিলাম।’

শেষের শব্দবন্ধ জাহিদের কলজের মধ্যে যেন ধাক্কা খেল। চুপ হয়ে আছে সে। সাহিনাই কথা বলে নীরবতা ভেঙে দিল।

‘টাকাটা নিতে চাইনে। খুব লাগছে আমার। সোহেলের বোনের সঙ্গে কথা বলে ফেরতও দিতে পারি।’

জাহিদ এই কথার জবাবে কিছুই বলে না। এখন বলা মানেই আরো রূঢ় কিছু শুনতে হতে পারে। শেষের দিকে সোহেলের কেবিনে না-যাওয়ার বিষয়ে জাহিদের খানিকটা ইচ্ছে ছিল। সে-রাগটাও এখন সুনামির মতো আছড়ে পড়ছে সাহিনার মধ্যে- যদিও জাহিদের ইচ্ছেই চূড়ান্ত ছিল না সেক্ষেত্রে।

নিজ থেকেই রাকিবুলকে চেকটির কথা বলেছিল সাহিনা। সোহেলের মৃত্যুসময়ে রাকিবুল দেশের বাইরে ছিল। ফিরে এসে নিজ থেকেই সোহেলের কথা জানতে চাইল রাকিবুল। বললো-

‘শেষের দিকে দু’-একবাার হাসপাতালে যেতে পারতে। গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?’

‘ব্যাপারটা আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে এখন। কষ্ট পাচ্ছি।’

‘খুবই স্বাভাবিক সেটা।’

‘জানো, সোহেল আমার নামে এক কোটি টাকার চেক লিখে রেখে গেছে।’

‘সে-কী?’

সোহেলের চিঠিটা মেলে ধরলো রাকিবুলের চোখের সামনে। রাকিবুল বার-তিনেক পড়লো সোহেলের চিরকূটসম চিঠিটা।

‘গ্রেট। স্যালুট, সোহেল ভাইকে। সেরা প্রেমিকের তালিকায় ওঁর নাম যেতেই পারে।’

‘কী করবো এতগুলো টাকা দিয়ে। আমি তো এই পরিমাণ টাকা কোনকালে চোখে দেখব বলেও ভাবিনি। আর শোন, জীবিত সোহেলের চেয়ে মৃত সোহেলকেই মনে হয় বেশি ভালোবাসি।’

শেষের কথাটা বলে সাহিনা রাকিবুলর দিকে তাকাল। এই কথায় রাকিবুলের বিশেষ হেলদেল লক্ষ করলো না সাহিনা।

‘কী করবে, সেও তোমার সিদ্ধান্ত। বলছি কি, একজন দিয়েছেন বলেই নিতে হবে, তারও মানে নেই। আর ওই টাকা আমার পরিবারে খুবই সামান্য টাকা।’

আড়চোখে রাকিবুলের দিকে তাকাল সাহিনা।

‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। তাছাড়া মৃত্যুপথযাত্রী যে-মানুষটি থেকে নিজের সমুদয় ভালোবাসা আর সকল দায় ফিরিয়ে নিয়েছ, তার টাকা নেবে কোন মুখে? আমি তো বলব, এই আইফোনটাও তোমার আর হাতে নেয়া ঠিক না।’

এই নিয়ে আর কোন কথা হয় না। কফির বিল চুকিয়ে রাকিবুল চলে যায় নিজের গন্তব্যে।

হলের সিঙ্গেল রুমে দিনে দুই-তিনবার চেকটার দিকে তাকায় আর চিঠিটা বারবার পড়ে সাহিনা। কতক্ষণ চোখে পানি। কতক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা। অনুসূয়াকে খুব মনে পড়ছে আজ। একই সাবজেক্টের না। আবার একই সংগঠনও করে না। অথচ অনুসূয়াকেই এই হলজীবনে একান্ত বিশ^স্ত আর নির্ভরযোগ্য মনে হয়। অনুসূয়া অনেকেরই আস্থা আর বিশ^স্ততার প্রতীক হয়ে আছে। ফোন করতেই অনুসূয়া বললো, ‘দু’দিন আমিও ভাবছি তোকে। আছিস কেমন?’

‘আছি। এদিকে একবার আসবি?’

‘আজ হবে না রে। বৌদিকে নিয়ে একটু চেক-আপে বের হব। ছ’মাস তো। কোনো জটিলতা নেই। তারপরও এখন ঘনঘন ডাক্তারের কাছে দৌড়াতেই হয়। কাল বা পরশু দেখছি একবার।’

‘হলেই চলে আছিস।’

‘সে না হয় ফোন করে ঠিক করে নেব।’

কতগুলো অদ্ভুত আর উল্লাপাল্টা ব্যাপার ঘটেই। সাহিনার যা চাই, তা নেই- যা চাইনে তা হাতের কাছেই। চাওয়া আর না-পাওয়ার বৈপরীত্যে ভরপুর এক-একজন মানুষের জীবন। রাকিবুলের সঙ্গে তো কথাই হয় না সাহিনার। ফোন করলেই ব্যবসার কাজে ব্যস্ততার কথা। নিজ থেকে রাকিবুল আর ফোনও করছে না। একটামাত্র চেকই সাহিনার চোখ ফুটিয়ে দিয়েছে যেন। বুঝে গেছে জাহিদ আর রাকিবুলের পার্থক্যটুকুন। এদিকে জাহিদ শিক্ষক হয়ে গেছে। কে একজন বলছে, প্রক্টরের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের কথাবার্তা বহুদূর এগিয়ে গেছে। জাহিদের এক-বন্ধু বলে গেছে, জাহিদ শিক্ষক হওয়ায় রাকিবুলও ক্রমশ দূরে সরছে। জাহিদ হয়তো জেনে গেছে, ব্যবসায়ীর চেয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকই সাহিনার অধিক পছন্দ। কিন্তু মধ্যখানে কয়েক মাসের মুষড়ে থাকায় জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগেও ভাটার টান পড়েছে; সে হয়তো রাকিবুল জানেই না। রাকিবুলকে অধিক পছন্দ হলেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার জাহিদ থেকে অনুরক্তি হ্রাস পেয়েছে দ্রুত- বিশেষ করে সোহেলের এককোটি টাকার প্রতি ওর লোভের কথা ভেবে।

এরি মধ্যে অনুসূয়া চলে এসেছে।

‘তুই হল ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমি তো একা হয়ে গেছিরে।’

‘একা! তোর রুমে না সারাক্ষণ জুনিয়ররা ভিড় করত, মানে তোর দলের মেয়েরা।’

‘আসছে না আর। আমিও সংগঠনের কাজে বের হচ্ছি না। একটা কাজই এখন বাকি। মাস্টার্সটা।’

‘অনার্সে তো ভালোই জিপিএ ছিল তোর। কেন যে ড্রপ দিতে গেলি! বুঝি না রে।’

‘তখন তো ভিপি কিংবা জিএস হতে চেয়েছিলাম। এরপর সেন্ট্রাল কমিটি।’

‘ইচ্ছে নেই আর? উবে গেল কি!’

‘অনেকটা সে-রকমই।’

‘কেনো রে, সাহিনা?’

‘সোহেলের মৃত্যু আমাকে বদলে দিয়েছে। নব্বই ডিগ্রি উল্টো ঘুরছি এখন, অনু।’

‘মানে কি?’

‘রাজনীতিটা আর নয়। সোহেল হাতে ধরেই এই পথে এনেছিল। ওর জন্যই তরতর করে ওপরে উঠেছি। ও আমাকে আরো ওপরে দেখতে চেয়েছিল। আমি তো আদতে গ্রাম দেখেই এসেছি। পড়ালেখা শেষ করেই নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়া আর ছোট্ট একটা চাকরি। নির্ঝঞ্ঝাট একটা সংসার।’

‘এখন এইসব বলছিস কেনো।’

‘না ওপরে যাওয়ার সিঁিড় আমাদের জন্য কখনোই সহজ ছিল না। জানিস তো, আমাদের চৌদ্দগুষ্ঠিতে রাজনীতি নেই।’

‘শেষটায় সোহেলদার সঙ্গে দেখা করলি না কেনো?’

‘এই প্রশ্নটা আর করিস না। কষ্টটা নিতে পারিনে। তবে একটা জবাব রেডি করেছি।’

‘কী?’

‘তুই জানিস, সেই সময়ে জাহিদ ও রাকিবুল, দু’জনই ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমিও দু’জনের কাছেই নিজেকে স্বার্থপরের মতো মেলে ধরতে চেয়েছি। কিন্তু অন্যদের জন্য উত্তরটা এই যে, সোহেলকে ওই অবস্থায়, ওই শরীরে দেখে ঠিক থাকতে পারতাম না।’

‘হুম। অনেকেই জবাবটা খাবে। কিন্তু জাহিদ ও রাকিবুলের বিষয় যারা জানে, তারা বলবে, ওই এককোটি টাকা হজম করার জন্যই সাহিনা এখন এসব বলছে।’

‘হতেই পারে। আর আদপেই এখন আমি জীবিত সোহেলের চেয়ে মৃত সোহেলকে বেশি ভালোবাসি। সোহেলের কথা ভেবে ভেবে আর আমাদের স্মৃতিগুলো আগলে রেখেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। নারী-পুরুষে কী হয়, সে আস্বাদ তো সোহেল আমাকে দিয়েই গেছে। মনের বিয়ে তো হয়েছিল আমাদের। আর না হলেও চলবে।’

‘কী বলিস, তুই? এমন পরিবর্তন তোর মধ্যে!’

‘হ্যাঁ।’

‘ওই জাহিদ কিংবা রাকিবুল?’

‘রাকিবুল শীঘ্রই বিয়ে করছে। যতটা জেনেছি, একজন সংসদ সদস্য শাশুড়ি হচ্ছে ওর।’

‘কিছু বলবি না তাকে?’

‘না। ইচ্ছেই নেই আর।’

‘আসতে বলেছিস কেনো?’

‘হ্যাঁ। আসল কথাই হলো না। ওই চেকটা কী করি, অনু?’

‘তোর ইচ্ছেটা কী, শুনি।’

‘অনেক নিয়েছি। ব্যাংকের টাকাগুলো সোহেলের; তোকে বলেছি। শুনে অবাক হবি, বাড়িতে টিনের ঘর সেমি-পাকাও হয়েছে সোহেলের টাকায়। ছোটভাইয়ের চাকরি, তাও ওর অবদান।’

‘বলিস কী, সাহি!’

‘বাবা তো প্রশ্নই করেছিলেন, “কোথায় পেয়েছিস এই টাকা?”

‘কী বললি?’

‘বাবাকে কিছুই বলিনি। মাকে বলেছি, জামাই বেড়াতে আসলে একটু থাকতে তো দিতে হবে, মা।’

‘এই এক কোটি টাকার কথা জানবে না!’

‘না। বলিনি তো এখনো। আর বলতে চাইনে আপাতত।’

‘সে বরং ভালো।

‘চেকটা সোহেলের বোনকে ফেরত দিতে চাই।’

‘এই চেক তো আর ফেরত দেয়া যাবে না। এটা তোর নামেই জমা করতে হবে। একটা কাজ র্ক, চেকটা তোর হিসাবে জমা দিয়ে দে। পরে যা করার করবি।’

‘সেক্ষেত্রে সোহেলের বোনকে আর একটা চেক দেয়া যায়।’

‘ঠিক। কিন্তু সোহেলের বোন এই টাকা নেবে কিনা তাতে আমার বিস্তর সন্দেহ আছে। ক’দিনে মেয়েটাকে দেখলাম তো। খুবই ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন।’

‘তুই-আমি বুঝিয়ে বললে যদি...।’

‘চেকটা দেয়ার সময়েই বলেছিল, “ভাইয়ার শেষ ইচ্ছে। আমাকে পালন করতেই হবে’’। ফলে এটা নেবে বলে মনে হয় না। হয়তো বলেই বসবে, “এটা ফিরিয়ে নিলে আমার ভাইয়ের আত্মা কষ্ট পাবে’’। পারবি, কিছু বলতে আর!’

‘তাহলে!’

‘চেকটার তারিখ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে তোর হিসাবে জমা দে। দেরি করিস না।’

‘এরপর?’

‘নানা অপশনই আছে। বোন না দিলে কোন কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে দেয়া যায়। অথবা সোহেলের নামেই একটা ট্রাস্ট করা যায়। নিজের জন্য কিছু রেখে দেয়াও সম্ভব।’

‘ঠিক আছে। ভালো কথা, তোর বাইরে যাওয়ার কতটা হলো।’

‘একটু দেরিই হবে। পরবর্তী জুনের সেশন ধরতে হবে।’

‘দেরি কেনো?’

‘বলিস না, অমিয় বাবু বিয়ের জন্য বারবার বলছে। বাবা-মাকেও ম্যানেজ করে ফেলেছে। ফলে বিয়েটা করে একসঙ্গেই যেতে চাই। ডাক্তার বাবুও বিদেশেই হায়ার ডিগ্রি করতে চায়।’

‘ভালো তো।’

এরপর বহুদিন দেখা নেই অনুসূয়ার সঙ্গে। অনেকটাই একা হয়ে গেছে সাহিনা। তবে অনুর সঙ্গে ফোনে কথা হয়। এদিকে সাহিনার মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে আর ওদিকে কুমিল্লায় অনুর বিয়ে। পরীক্ষার রুটিনে ফাঁক ছিল বিয়ের দিনে, চাইলে যাওয়া যেত। কিন্তু সাহিনার নতুন করে এক-সমস্যা দেখা দিয়েছে। শরীরের ক্রিটেনিন বেড়ে গেছে এবং কিডনি পয়েন্টে প্রচ- ব্যথা হচ্ছে। শরীরও শুকিয়ে যাচ্ছে। কিছুই মুখে নিতে পারছে না। এর মধ্যেও মাস্টার্স পরীক্ষাটা কোনোভাবে শেষ করলো সাহিনা। অতঃপর এই ডাক্তার, সেই ডাক্তার আর হরেক পরীক্ষার পর একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ জানালেন, ডানদিকের কিডনিতে একটা সিস্ট আছে। দ্রুত এই সিস্ট রিমুভ করা দরকার। সিস্টে ম্যালিগন্যান্ট থাকলে ডান-কিডনিও ফেলে দিতে হবে, আর এটাই চিকিৎসা। চোখে অন্ধকার দেখলো সাহিনা। প্রথমেই অনুসূয়াকে তলব দিল সে।

অনুসূয়ার ভাইয়ের ফকিরাপুলের বাসায় ডা. অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায় স্ত্রীর বান্ধবীর রিপোর্টগুলো বহুক্ষণ ধরে দেখছেন।

বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে অপারেশনের আগে ম্যালিগন্যান্ট নিশ্চিত-অনিশ্চিতের ওপর নির্ভর করবে কেবল সিস্ট সরাতে হবে, না ডানদিকের কিডনিও।’

এরপর বললেন, ‘অনু, আমি রিপোর্টগুলো একটু চেন্নাইয়ে পাঠাতে চাই। ওখানের নেফ্রোলজির বিভাগের প্রধানের সঙ্গে আমার কিছুটা জানাশোনা আছে।’ বলেই তিনি তাকালেন সাহিনার দিকে। বললেন, ‘কী বলেন, দিদি?’

‘ও কী বলবে! তুমি পাঠিয়ে দাও। আর সাহিনার চিকিৎসার দায়ভার এখন তোমার-আমার। এক-সময়ে অনেকেই ছিল, কিন্তু এখন এই ঢাকায় ওর তেমন কেউ নেই। নিকটজন থাকে সেই বরিশালের হিজলায়। একমাত্র ভাই প্রাইমারির শিক্ষক; জীবনে একবারই ঢাকায় এসেছে। বুঝলে, ডাক্তার।’

‘দরকার হলে আসবে। তবে বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসা ঠিক হবে না।’

‘কাউকেই আপাতত দরকার নেই। দরকার হলে মাসিমা একবার আসবেন। আর শোন্, পরের মাসেই আমি বাসা নিচ্ছি। হলের পাততাড়ি গুটিয়ে সরাসরি আমার বাসায় ওঠে যা। ফাইনাল কিন্তু।’

‘তোদের সমস্যা হবে যে।’

‘সমস্যা! তোকে নিয়ে? মনে নেই, বেঘোরে জ¦রে ভুগছিলি। বললি, “বিফ্ খেতে ইচ্ছে করছে”। হলের রুমেই রান্না করতে চেয়েছিলাম। তুইই বললি, “থাক, ঝামেলা করিসনে’’। এরপর হোটেল থেকে বিফ্ এনে তোকে কে খাইয়েছে, বল্ একবার। অথচ আমি বামুনের মেয়ে।’

‘তুই আদতে প্রথমে একজন মানুষ। এরপর একজন কমিউনিস্ট। তোর মধ্যে বিন্দু-বিসর্গ ব্রাহ্মণ্য অবশিষ্ট নেই এখন।’

দু’দিনেই চেন্নাই অ্যাপোলোর রিপ্লাই চলে এসেছে। যত দ্রুত সম্ভব, ওখানে যাওয়ার জন্য মেইলে বিশেষ করে বলা হয়েছে। ডাক্তার আরো লিখেছেন, ‘এখানে একটু ভিড় আছে বটে। কিন্তু অমিয় বাবুর অনুরোধে দ্রুত ব্যবস্থা করা যাবে।’

কয়েক দিনের মধ্যেই সাহিনার মেডিকেল ভিসা হয়ে গেছে। অনুসূয়া সঙ্গে যাবে। ওর স্বামীও যেতে রাজি হয়েছেন। সাহিনা বললো, ‘অনু, আমি অসুস্থ, তাতে কী। তোদের হানিমুনটাও হয়ে যাবে।’

‘এসব ছাড়। নিজের সুস্থতার কথা ভাব্ তো।’

হয়তো বিধাতার লিখনই হবে। সেই চেন্নাই অ্যাপোলো। সোহেল রোগমুক্তির জন্য এখানেই এসেছিলেন। মনে করতেই কাঁদছে সাহিনা। সান্ত¡না দিয়েও কূল পাচ্ছে না অনুসূয়া। এখানে ডানদিকের কিডনি রিমুভই করতে হলো। সিস্টে ক্যানসারের নমুনা মিলেছে। ঢাকায় ফিরে অনুর বাসাতেই থাকছে সাহিনা। কিন্তু বিপদ পিছু ছাড়ছে না তার। একটা যেতে না যেতে আর একটা- এমনই হয়। বাঁ কিডনিও ফাংশন করছে না। ক্রিটিনিন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ডায়ালিসিস শুরু করা বই বিকল্প নেই। অমিয় বাবু বারডেমের কথা বলছিলেন। সাহিনা বললো, ‘না রে অনু, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ভার্সিটিই হোক।’ ডায়ালিসিস করতে হবে সপ্তাহে দু’বার। কিন্তু তিন-চারবার ডায়ালিসিস হওয়ার পর ডাক্তার রোগীকে ধরে রাখলেন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের জন্য। এবার কেবিনই নিতে হলো সাহিনার জন্য। দু’দিন যেতেই অনুর কথায় একজন ডাক্তার বন্ধুকে বলে ৩১৭ নম্বর কেবিনই সাহিনার জন্য বরাদ্দ করাতে সক্ষম হলেন ডা. অমিয়।

বলাই হয়, রক্ত ডায়ালিসিস মানেই ব্যাংক অ্যাকাউন্টেরও ডায়লিসিস হতে থাকে। চেন্নাইয়ে অনেক টাকাই খরচ হয়ে গেছে। এবার এক কোটিতে হাত পড়ে গেল। অনু বললো, ‘সোহেলদা কি ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন? নইলে এই টাকা তোর জন্য রেখে গেছেন কেনো!’

চেকটা পাওয়ার পর, তখন জাহিদ কিংবা রাকিবুল দু’জন থেকেই এক-রকমের বিচ্ছিন্ন সাাহিনা- নিজকে চরম অপরাধী মনে হচ্ছিলো তখন; বারবারই জীবিত সোহেলকে শেষ না-দেখার গভীর অনুতপ্তবোধ কুরে কুরে খাচ্ছিলো সাহিনাকে। ছেড়ে দিয়েছে পার্টির কাজ। তখন, সোহেলের কথা ভেবে ভেবে মনে হচ্ছিল, মরে গেলেই ভাল হয়। কি জানি, সেই চাওয়াই হয়তো মঞ্জুর হয়ে গেছে আকাশ কিংবা পাতালের কোন-এক জায়গায়- নয় তো, সেই ৩১৭ কেবিনেই শুয়ে থাকতে হচ্ছে ! বিধির কী এক অমোঘ বিধান।

দুদিন আগেই বলেছিল অনুসূয়াকে, অর্ধেক জীবন আমার। তোর সোহেলদারও তাই ছিল। দুইজনের মিলে এক-জীবন।’

সাহিনার মরদেহ বরিশালেই পাঠানো হবে। ওর বাবার ইচ্ছে এটাই। শেষের দিকে সাহিনার মা-ও হাসপাতালের কেবিনে ছিলেন কতক দিন। ভাইও এখন ঢাকায়। বোনকে নিয়ে যাবে। জীবিত নয়, মৃতাবোনকে।

গতকাল রাত তিনটার দিকে জোরালো শ্বাসকষ্ট অক্সিজেন দিয়েও সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি। সোহেলের পথেই যেতেই হলো সাহিনাকে; সবাই যাবে- কেবল দিনক্ষণ ভিন্ন। বারডেমের হিম ঘর থেকে একটু পর লাশবাহী গাড়ি যাত্রা করবে বরিশালের উদ্দেশ্যে। অনুসূয়ার চোখের জল সবটাই বেরিয়ে গেছে। হলজীবনে যা ছিল, ছিলোই। কিন্তু সোহেল আহমেদের চলে যাওয়ার পর অনুসূয়া যেন সাহিনার আপ্ত-সহোদরাই হয়ে গেছে। চিকিৎসার সব দায় নিয়েছে। সেই বান্ধবী কিংবা বোন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে এখন; কোনো মানে আছে?। হায়, জীবন!

অনুসূয়া মনে মনে বললো, সাহি তোর জীবনই বরং পূর্ণ, পরিপূর্ণ। স্বার্থক। কতদিন বেঁেচ থাকলি তা ম্যাটার করে না। তোদের ভালোবাসা অর্ধেক নয়-সম্পূর্ণ। কতজনই তো ভালোবাসছে, প্রেম করছে। বিয়ে হচ্ছে, হচ্ছে বিচ্ছেদও। কারোরটাই এমন নয়। ভালোবাসার ভুবনে তুই আর সোহেলদাই সেরা হয়ে থাকবি রে। বিদায়, বন্ধু। পরপারে ভালো থাকিস, সাহি।

এভাবেই চোখের জলে সাহিনাকে বিদায় জানাল অনুসূয়া। বিষাদের পেয়ালায় যেন ডুবে যাচ্ছে সে। অনুসূয়ার হৃদয়ে ধ্বনিত হতে থাকে-

“আমার দুই আঁখি ওই সুরে

যায় হারিয়ে সজল ধারায় ওই ছায়াময় দূরে।

ভিজে হাওয়ায় থেকে থেকে কোন্ সাথি মোর যায় যে ডেকে,

একলা দিনের বুকের ভিতর ব্যথার তুফান তোলে।’’

back to top