alt

সাময়িকী

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

: বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

(পূর্ব প্রকাশের পর)

২.

উপমহাদেশে সাহিত্যচর্চার সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব ছিল। ইংরেজ আমলে যেমন, পরেও তেমনি। ইংরেজের শাসনামলে মনে হয়েছিল রাষ্ট্র বাংলা সাহিত্যকে বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। তা করেছে বটে। বাংলা গদ্যের সৃষ্টি ইংরেজ আগমনের ফল, এ কথা ইতিহাসে লেখা আছে। যে-মধ্যবিত্ত শ্রেণি আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে অতটা এগিয়ে নিয়ে গেল তারাইবা কোথা থেকে আসতো, ইংরেজ না এলে। ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন না করলে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি করে না দিলে কেইবা পড়তো বাংলা সাহিত্য। সবই সত্য। কিন্তু বাঙালি যে ইংরেজির চর্চা না করে বাংলার চর্চা করলো এটা একটা রাষ্ট্রবিরোধিতা তো বটেই। সে মিশে গেল না। কেউ কউ গেল, যারা ইংরেজ হতে চাইলো। কিন্তু বড়মাপের অনেকগুলো মানুষ যে গেলেন না তারা যে মাতৃভাষার চর্চা করলেন সেই ঘটনা তো দিচ্ছে বলে যে, গ্রহণের অন্তরালে সুদৃঢ় একটা বর্জন রয়ে গেছে, মধুসূদন চলে গিয়েছিলেন, তিনি সাহেব হয়েছেন, মেম সাহেব বিয়ে করেছেন, ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছিলেন ইংরেজিতে লিখবেন ঠিক করেছিলেন; কিন্তু ওই যে ফিরে এলেন, হলেন বাঙালি লেখক, ওইখানেই তাঁর আসল বিদ্রোহ, ইংরেজ হওয়ার বিদ্রোহের চেয়ে যা অনেক গভীর।

রাষ্ট্রভাষা ছিল ইংরেজি। বাঙালি সে-ভাষার চর্চা করেছে; কিন্তু সে-ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেননি। না করে বাংলা ভাষাকেই বরঞ্চ এগিয়ে নিয়ে গেছে। স্বাধীনতার দাবি সেই সাহিত্যে এসেছে, নানানভাবে, নানান সুরে। কিন্তু রাষ্ট্র ছিল অত্যন্ত প্রবল। তার ক্ষমতা ছিল অপরিমেয়। তার ক্ষতিকর দাপটকে যে অস্বীকার করা যাবে তা সম্ভব ছিল না। না, সাহিত্যও পারেনি।

সাহিত্যের ক্ষতি হয়েছে দুটো। একটি সাম্প্রদায়িকতা, অপরটি শ্রেণিবিভাজন। বঙ্কিমচন্দ্রের দৃষ্টান্ত সহজেই আসে। তিনি অসামান্য ছিলেন যেমন ইহজাতিকতায়, তেমনি স্বাধীনতাপ্রিয়তা। স্বাধীনতার পক্ষে লিখতে গিয়ে তাঁর লেখবার কথা ছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে; কিন্তু তা লেখা সম্ভব ছিল না বলে আনন্দমঠ ও দেবী চৌধুরাণীতে শত্রু হিসেবে দাঁড় করালেন অনুপস্থিত মুসলমানকে। সাহিত্যে ওই যে সাম্প্রদায়িকতা প্রবেশ করলো, ওই যে নদী ঘুরে গেল তার স্বাভাবিক ধারা থেকে ভিন্ন দিকে তার প্রভাব পরবর্তীকালে অনেক ক্ষতির কারণ হয়েছে বাঙালির জন্য। ১৯৪৭-এ এসে বঙ্গদেশ যে দু’টুকরো হলো তার প্রধান কারণ সাম্প্রদায়িকতা এবং সেই কারণকে সাহিত্য প্রতিহত করেনি, বরঞ্চ পুষ্টই করেছে।

আর রইলো শ্রেণি। ইংরেজের রাষ্ট্র বিদ্যমান শ্রেণিবিভাজনকে আরো শক্ত করেছে। সাহিত্য তাকে ভাঙতে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি। সাহিত্য রয়ে গেছে বিত্তবান শ্রেণির সংস্কৃতি হিসেবে।

তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে আমরা বাংলা সাহিত্যের চর্চা করেছি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় নয়, রাষ্ট্রীয় বৈরিতার ভেতরে। হ্যাঁ, পুরস্কার ছিল পত্রিকা ছিল, গণমাধ্যমে প্রচার পাওয়া যেতো কিন্তু মূল সত্যটা ছিল এই যে, ওই রাষ্ট্র বাংলা ভাষাকে রাখতে চেয়েছিল উর্দুর নিচে, ঠিক যেমন ইংরেজরা চেয়েছিল ইংরেজিই হবে প্রধান, মোগলরা চেয়েছিল ফার্সির প্রাধান্য, আর্যরা সংস্কৃতের, তেমনি পাকিস্তানিরা চাইলো উর্দু হবে প্রধান, বাংলা দ্বিতীয়। বাঙালি সেটা মানেনি।

কিন্তু সাহিত্যে রাষ্ট্র-বিরোধিতা কতোটা এসেছে বা আসেনি সে প্রশ্নটা থাকে। না বেশি আসেনি। সাতচল্লিশের পরে আমাদের সাহিত্য ছিল কবিতাপ্রধান। আমাদের প্রধান কবিরা রাষ্ট্রের মহিমাকীর্তন করে অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন। সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো গ্লানি দেখা যায়নি। ফরাসি কিংবা রুশ বিপ্লবের পেছনে যেমন সাহিত্যের একটা ভূমিকা ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পশ্চাৎভূমিতে তেমন কোনো সাহিত্যিক ঘটনা ঘটেনি।

রাষ্ট্রের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের ব্যাপারটিকে গভীর ও প্রবল করতে না-পারা সাহিত্যের জন্য অবশ্যই একটা দুর্বলতা। সে-দুর্বলতা সেদিনও ছিল, আজও রয়েছে। মানুষের জীবনের অচরিতার্থতা ও দুঃখকে (কেবল বৈষয়িক অর্থে নয়, বুদ্ধবৃত্তিক ও অনুভূতিগত অর্থেও) নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারেনি। সে জন্য তার স্তরটা রয়ে গেছে বিনোদনের। আর ওই স্তরে যেহেতু টেলিভিশন ও ভিডিও কাজ করছে আরো জোরেশোরে, সাহিত্য তাই নিজেকে ততটা প্রয়োজনীয় করে তুলতে পারছে না, যতটা প্রয়োজনীয় হওয়া তার নিজের জন্য তো বটেই, আমাদের সংস্কৃতির জন্যও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

বিষয়টা যে-কোনো বিষয়ে রাষ্ট্র্রের ব্যাপার তা নয়, রাষ্ট্রব্যবস্থারই ব্যাপার বটে। রাষ্ট্র গঠনে সাহিত্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে হয়তো করেছেও কখনো কখনো। কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে সাহিত্যের দ্বন্দ্ব একেবারেই স্থূলগত এবং দার্শনিক। রাষ্ট্র হচ্ছে রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান, চরিত্রগতভাবে অপরদিকে সাহিত্য চায় মুক্তি। প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের পক্ষে সাহিত্যকে তার নিজের দিকে আত্মচেষ্টা ফুলকে বৃন্তচ্যুত করার সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়।

কবিতা না-লিখলেও প্লেটো যে একজন কবি ছিলেন তা তাঁর গদ্য রচনার পরতে পরতে প্রমাণিত। উপমায়, রূপকে, শব্দ চয়নে ওই দার্শনিক তাঁর অন্তর্গত কবির কল্পনা ও সৌন্দর্যবুদ্ধি উভয়কেই ব্যবহার করে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে কবিতার গুণ ও আবেদন তিনি যে জানতেন তাতেও সন্দেহ করবার অবকাশ নেই। কিন্তু তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের জন্য কোনো জায়গা রাখেন নি। জায়গা রাখবেন কি, নির্দেশ দিয়েছেন তাদেরকেও বের করে দেবার জন্য। কবিদের সম্মান দেয়া হবে, মালা ও সুগন্ধী দিয়ে তাদের সজ্জিত করা যাবে, কিন্তু তাদেরকে সবিনয়ে বলতে হবে: মহাশয়বৃন্দ, আপনাদের জন্য আমাদের রাষ্ট্রে কোনো স্থান নেই।

কেন নেই? অভিযোগটা আপাতত এটা যে, তারা মিথ্যা কথা বলে। কিন্তু তার গভীরে আরো একটা ব্যাপার রয়েছে। সেটা এই যে, কবিরা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাকে বিপন্ন করে। প্লেটোর ‘সাম্যবাদ’ ফ্যাসিস্ট ধরনের; অর্থাৎ শ্রেণিবিভাজনকে মেনে নিয়ে, তবেই সবাই সমান, বিভাজনের ভেতরে সমান, ভেঙে দিয়ে নয়। সে-রাষ্ট্রে দার্শনিকেরা শাসন করবে, সৈনিকেরা করবে যুদ্ধ, শ্রমিকেরা করবে উৎপাদন। এই বিভাজন কিছুতেই ভাঙা যাবে না। কাব্য তথা সাহিত্য যে গ্রহণযোগ্য নয় তার মূল কারণটা নিহিত রয়েছে না-ভাঙার এই রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারেই।

সাহিত্য কী করে? সাহিত্য মানুষের আবেগ জাগিয়ে দেয়। মানুষকে সংবেদনশীল করে, যার ফলে মানুষ বিভাজন ডিঙ্গিয়ে যেতে চায়। দার্শনিক হয়তো শ্রমিকের দুঃখ দেখে কাতর হবে, শ্রমিক হয়তো চাইবে সে শাসক হবে, সৈনিক হয়তো ওপরে যেতে চাইবে, কিম্বা নিচে; তখন রাষ্ট্র ভেঙে পড়বে, তখন ‘ন্যায়’ বলে কিছু থাকবে না, অন্যায়ে ছেয়ে যাবে সমস্ত কিছু। প্লেটোর সে রাষ্ট্রের প্রধান কথা হলো নিরাপত্তা অক্ষুণœ রাখা, সেখানে তাই সাহিত্যের স্থান নেই। প্লেটোর রাষ্ট্রের জন্য সাহিত্য বিপজ্জনক, যেমন তা বিপজ্জনক ছিল হিটলারের রাষ্ট্রের জন্য।

রাষ্ট্রের অনেক কিছুই থাকে। সিপাহী, সান্ত্রী, আইন, আদালত- সব কিছুই আছে তার। বিবেক নেই? হ্যাঁ, বিবেকও আছে বৈকি। সেই বিবেক হচ্ছে শাসক শ্রেণির স্বার্থ। ‘ন্যায়’ও তাই, শাসক শ্রেণির স্বার্থ। ওদিকে সাহিত্যের কাজটাই হলো মানুষের ভেতর যে বিবেকবান, অর্থাৎ সংবেদনশীল মানুষটি থাকে তাকে জাগিয়ে রাখা, তাকে সতেজ করা। সাহিত্য তাই শ্রেণি-বিরোধী এবং সে-কারণে রাষ্ট্র-বিরোধী।

প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে এন্টিগনির যে গল্পটি আছে সেটি একটি বিদ্রোহের কাহিনী। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির বিদ্রোহ। শাসনের বিরুদ্ধে বিবেকের অভ্যুত্থান। এন্টিগনি বলেছে, তার মৃত ভ্রাতাকে সে কবর দেবে। দেবেই দেবে। কেননা এটি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্র বলছে দেয়া যাবে না, কেননা লোকটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহী। এই বিশেষ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মুখপাত্রটি অন্য কেউ নয়, তিনি হচ্ছেন এন্টিগনিরই আপন মামা, ক্রিয়ন। কিন্তু এখানে আত্মীয়তা কাজে দেয় না। রাজা বন্দী রা?????ীয় স্বার্থের শৃঙ্খলে। এন্টিগনি এগিয়ে গেল, ভাইকে কবর দিতে, ক্রিয়ন বিদ্রোহী এন্টিগনিকে আটক করে কবর দিয়ে দিলো, জ্যান্ত। ক্রিয়নের পুত্র তার প্রেমিকা এন্টিগনির কবরে গিয়ে মারা গেল কাঁদতে কাঁদতে। কিন্তু ক্রিয়নের কিছু করার ছিল না। রাজা হয়ে তিনি বন্দী। ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় রাজা তখন রাষ্ট্রের পক্ষে এবং ব্যক্তির বিরুদ্ধে, অতি অবশ্যই; নইলে তিনি রাজা কেন।

এন্টিগনির মতো যারা বিবেকবান মানুষ রাষ্ট্র তাদের ভয় করে। আর সাহিত্যের কাজই হচ্ছে সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে মানুষকে বিবেকবানে পরিণত করা। সাহিত্য আনন্দ দেয় এ আমরা জানি; সাহিত্য শিক্ষা দেয় এ-ও আমরা মানি; কিন্তু তবু সাহিত্য বিনোদনের অনুষ্ঠান নয়, যেমন নয় সে প-িতের পাঠশালা; সাহিত্যে ওই দু’য়েরই ভূমিকা থাকে, কেননা এরা উভয়েই সাহিত্যের মূল কর্তব্যের অংশ, যেটি হলো মানুষের হৃদয়কে সংবেদনশীল করা। সাহিত্যের শিক্ষা মস্তিষ্কের নয়, হৃদয়ের। হৃদয়বান মানুষরাই বিবেকবান, যে-জন্য হৃদয়কে রাষ্ট্রের বড় ভয়।

রাজনৈতিকভাবে শেক্সপিয়র ছিলেন রক্ষণশীল। তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু বড় শিল্পী ছিলেন বলেই শেক্সপিয়র বারবার তাঁর নাটকে দেখিয়েছেন রাষ্ট্র কী করে ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করে। রাজপুত্র হ্যামলেট একা লড়ছেন রাজার বিরুদ্ধে। কিন্তু রাজা একা নয়, রাষ্ট্র আছে তার আজ্ঞাবাহরূপে দাঁড়িয়ে। হ্যামলেট দেখছেন একজন দুর্বৃত্ত যেহেতু বসে আছে সিংহাসনে তাই সবকিছুই রওনা হয়েছে নষ্টের অভিমুখে। রাষ্ট্র বড়ই কঠিন প্রাণি।

৩.

টলস্টয় (১৮২৯-১৯১০) শেক্সপিয়রকে পছন্দ করতেন না। মনে করতেন শেক্সপিয়র রাজা বাদশাদেরই গ্রহণ করেছেন পাত্র-পাত্রী হিসেবে জনগণকে বিশেষ মর্যাদা দেননি। হ্যাঁ, শেক্সপিয়রের দেশপ্রেমও ছিল সঙ্কীর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন তো চরিত্রের অবস্থান নয়, প্রশ্ন হচ্ছে চরিত্রের মানবিক পরিচয়। পোশাক, কিংবা সামাজিক পরিচয় যাই হোক শেক্সপিয়র দেখেছেন, অন্তর্গত মানুষটিকে। সেই মানুষটি রাজা নন, রাজাপুত্র নন, শুধুই একজন মানুষ। বিবেকবান রাজপুত্র হ্যামলেটের রাষ্ট্রও মিত্র নয়, শত্রু বটে। রাষ্ট্র তাকে হত্যা করার প্রচেষ্টার কোনো অবধি রাখে না।

সাহিত্য দেশ মানে না। কাল মানে না। রাষ্ট্র মানে না। শুধু মানে না বললে যথেষ্ট বলা হবে না, সাহিত্য ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বটাকে তুলে ধরে। সাহিত্য স্থান ও কালবিরোধী যতটা নয় রাষ্ট্রবিরোধী সে-তুলনায় অনেক বেশি। টলস্টয়ের নিজের লেখাতেও রাষ্ট্র বিরোধিতা অত্যন্ত স্পষ্ট। স্বভাবতই। সেই অতি বৃহৎ উপন্যাস যুদ্ধ ও শান্তিতে টলস্টয় দেখাচ্ছেন যুদ্ধ ব্যাপারটা রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রেরই সংঘর্ষ আসলে, কিন্তু দুর্ভোগটা সাধারণ মানুষেরই। আর রাষ্ট্রনায়কেরাও সাধারণ মানুষই পর্যন্ত, যদিও তারা ভান করতে ভালোবাসে অসাধারণত্বের। আন্না কারেনিনার নায়ক-নায়িকারা অধিকাংশই রাষ্ট্রের সেবক। আন্নার স্বামী মস্ত বড় আমলা, তার প্রেমিক সেনাবাহিনীর অফিসার। আন্নার ভাইও বড় সরকারি কর্মচারী। ওই সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ভেতরই আন্নার চলাফেরা ওঠাবসা ও জীবনযাপন। অনেক দিক দিয়েই অসাধারণ এই মেয়ে; সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে, মেধায় ও আচরণে নিজের বৃত্তের সব মানুষকে ছাড়িয়ে ওঠে বিশেষভাবে ব্যতিক্রমী হলো তার আন্তরিকতা। এই মানুষটিকে চরিতার্থতা দেবার ক্ষমতা তার স্বামীর নেই, তার প্রেমিকেরও নেই। বেচারা আন্না বেশি বয়সী স্বামীকে ছেড়ে প্রায় সমবয়সী প্রেমিকার কাছে যায়, কিন্তু চরিতার্থ না দিলো তাকে তার আমলা স্বামী, না তার সৈনিক প্রেমিক। উভয়েই সামান্য তারা, রাষ্ট্রলালিত বুর্জোয়া স্বার্থপরতার বন্ধনে আবদ্ধ হবার কারণেই, বিশেষভাবে। এ উপন্যাসে রাষ্ট্রবিরোধী রাজনৈতিক লোকেরাও রয়েছে তারা ছায়া ছায়া, খুব প্রত্যক্ষ নয়। তারা নতুন ব্যবস্থার কথা ভাবে, কমিউনিজমের কথাও। মোট বিষয়টা দাঁড়ায় এই যে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যর্থ হয়ে গেছে, এটা ভেঙ্গে পড়ছে। আন্নার মতো মানুষদের পক্ষ এখানে তাই আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকছে না। টলস্টয়ের এ উপন্যাসে আন্নার বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। রেলগাড়ির নিচে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে ওই রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষের স্বপ্নগুলো ওইভাবেই কেটে টুকরো টুকরো করবে, যদি বিপরীতে কিছু না ঘটে।

এক অর্থে টলস্টয় রক্ষণশীল। তিনি রক্তপাত পছন্দ করতেন না, রাষ্ট্রবিপ্লবও নয়; কিন্তু তার লেখার ভেতর দিয়ে রুশ বিপ্লবকে এগিয়ে আনছিলেন তিনি বিদ্যমান রাষ্ট্রের অন্তঃসারশূন্যতা ও নিষ্ঠুরতাকে উন্মোচিত করে দিয়ে। এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল; হৃদয় দিয়ে বুঝছেন এবং অন্যের হৃদয়ে সেই বুঝাটাকে সংক্রমিত করে দিয়েছেন।

আন্না কারোনিনার পরের উপন্যাস ‘পুনরুজ্জীবন’। এতে রাষ্ট্রের মুখচ্ছবি আরো প্রত্যক্ষ। কাটিউসা মাসলোভা একজন নিরপরাধ কিশোরী। সামন্ত পরিবারের যুবক নেখলিউদভ তাকে নষ্ট করলো। মাসলোভার সন্তান হবে, কিন্তু সন্তানের পিতা নেখলিউদভ তখন অনেক দূরে। সে তখন সেনাবাহিনীর নবীন অফিসার। মাসলোভা কাজ করে, দেহ বিক্রয় করে জেলও খাটে। সবই বাঁচার চেষ্টায়। আসামি হিসেবে আদালতে এসেছে মাসলোভা। অদৃষ্টের কী কৌতুকবোধ, সেই বিচারে জুরীদের একজন হয়ে বসে আছে নেখলিউদভ। নেখলিউদভ চিনেছে ওই মেয়েকে। তার ভেতরে পাপের বোধ জেগেছে। সে চাইলো মাসলোভাকে রক্ষা করবে। কিন্তু পারলো না। বিচারে জেল হলো নির্বাসন হয়েছিল মাসলোভার। জেলটা মওকুফ করলো নেখলিউদভ, আমলাদের কাছে দেন-দরবার করে। কিন্তু নির্বাসন বলবৎ রইলো।

মাসলোভা চলেছে সাইবেরিয়াতে। নেখলিউদভ চলেছে পিছু পিছু। তার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। সে প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়, সে মাফ চাইবে। মাসলোভার রাজি হলে তাকে বিয়ে করবে। শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটা নেখলিউদভ করতে পারলো মাসলোভার কাছ সাইবেরিয়াতে গিয়ে। আশা করেছিল মাসলোভা কাল বিলম্ব করবে না, সম্মত হতে। কিন্তু মাসলোভা ওই প্রস্তাবে সম্মত নয়। তার প্রত্যাখ্যানটা খুবই দৃঢ়। সে বললো, বুঝি সেবার আমার দেহটা ব্যবহার করেছো, এবার ব্যবহার করতে চাইছো আমার আত্মটাকে। না, তা হবে না।

আসলে মাসলোভারও পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। সেও আর আগের সেই পথহারা মেয়েটি নেই। পথের সন্ধান এরা অন্য ধরনের মানুষ। এরা সংযমী মেধার; এরা বই পড়ে একজনের থলের ভেতর দেখা যায় মার্কসের পুঁজি বইটি উঁকি দিচ্ছে। এদেরই একজন হচ্ছে সাইমনসন। তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে মাসলোভার। তারা ভালোবেসে ফেলেছে পরস্পরকে। তাদের বিয়ে হবে।

নেখলিউদভরা যতই যা করুক তারা বন্দী বটে, রাষ্ট্রের বৃত্তের ভেতর আবদ্ধ। ওই বৃত্তে কারোরই মুক্তি নেই, না নেখলিউদভের, না মাসলোভার, না সাইমনসনের বিশেষভাবে পীড়িত হবে মাসালোভারা। নেখলিউদভ তাদেরকে ব্যবহার করবে নিজেদের বিশেষ প্রয়োজনে। মানুষের মুক্তির জন্য নতুন ব্যবস্থা প্রয়োজন হবে। যে-ব্যবস্থার পক্ষে সাইমনসনেরা লড়ছে। বলা বাহুল্য, ওদের মধ্যেই লেনিন ছিলেন, যার সন্ধান টলস্টয় তখনও পাননি, পুনরুজ্জীবন উপন্যাসটি যখন তিনি লিখে শেষ করেন, ১৮৯৯-এ লেখক যদি রক্ষণশীল হন তবুও এটা নিশ্চয় করে বলা যাবে না যে, তাঁর লেখা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার পক্ষে যাবে। এক্ষেত্রে ব্যালজাকের (১৭৯৯-১৮৫০) কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ব্যালজাক নিজে রক্ষণশীল ছিলেন। কিন্তু মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতার যথার্থই মনে করেন যে তার লেখা সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী ধারণাকে সাহায্য করেছে। এমিল জোলা (১৮৪০-১৯১২) ব্যালজাকের যা মূল্য তা একশ’জন জোলা পূরণ করতে পারবেন না। কেননা ব্যালজাকের রাজনীতিক মতবাদ যাই হোক না কেন তার সাহিত্যের বাস্তববাদিতা সমাজের নিষ্ঠুরতা ও অন্তঃসারশূন্যতাকে উন্মোচিত করে দিয়েছিল।

৪.

শুরুর কথাতেই ফিরে যেতে হয় এ কথা অসত্য নয় যে, দর্শন ও সাহিত্যে বিস্তর দূঢ়ত্ব রয়েছে। দর্শন সাহিত্য নয়, সাহিত্যও দর্শন নয়, তবু সাহিত্য দর্শনকে বোঝা তার নিজের প্রয়োজনে। দর্শন সাহিত্যকে গভীরতা দেয়। সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান যে সর্বদা প্রত্যক্ষ তা নয়, অনেক সময়েই তা অপ্রত্যক্ষ বটে। (সমাপ্ত)

ছবি

নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক

ছবি

শহীদ কাদরীর কবি হয়ে ওঠা

ছবি

মাথার ওপর ছাতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অমিয়ভূষণ : ধ্রুপদীয়া আর স্ববিরোধের সমন্বয়

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব

ছবি

মার্কেস ও আমার বিস্ময়

ছবি

অস্থির পৃথিবীর মায়াবী কবি

ছবি

সম্প্রীতির সাধক মরমী বাউল উকিল মুন্সী

ছবি

‘দিবারাত্রির কাব্য’ এবং ‘দ্য আউটসাইডার’ এক নিবিড় সাযুজ্য

ছবি

চুক্তি লিখন

ছবি

লিওপল্ড সেদর সেঙ্ঘর-এর কবিতা

ছবি

হিমু ও হুমায়ূন আহমেদ

শরতের পদাবলি

সাময়িকী কবিতা

মার্কিন চলচ্চিত্র জগতের প্রাণকেন্দ্র লস এঞ্জেলেস

ছবি

যুদ্ধের জানালায় দাঁড়িয়ে

ছবি

শব্দঘর : বিপ্লব, দ্রোহ ও গুচ্ছ কবিতা সংখ্যা

ছবি

সালভাতর কোয়াসিমোদোর কবিতা

ছবি

টুটু

ছবি

অর্ধেক জীবন

ছবি

ক্যান্ডি, শ্রীলঙ্কায় বেড়ানোর আদর্শ জায়গা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘দূরের কার্নিশ’

ছবি

কবিতায় উড়ন্ত সারস

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

রবীন্দ্রসংগীত চর্চা, বাংলাদেশে-

শক্তিমান কবির কলমে গল্প

ছবি

শহীদুল হকের জীবন ও আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা

ছবি

জলবন্দী স্বপ্ন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কমল চক্রবর্তী, আদি ও অকৃত্রিম রিংমাস্টার

ছবি

নূরুল হক : আধুনিক মরমি কবি

ছবি

ও. হেনরি : ছোটগল্পের কালজয়ী অগ্রদূত

ছবি

নজরুল : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতন

ছবি

নিছক সাজুর গল্প

tab

সাময়িকী

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

(পূর্ব প্রকাশের পর)

২.

উপমহাদেশে সাহিত্যচর্চার সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব ছিল। ইংরেজ আমলে যেমন, পরেও তেমনি। ইংরেজের শাসনামলে মনে হয়েছিল রাষ্ট্র বাংলা সাহিত্যকে বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। তা করেছে বটে। বাংলা গদ্যের সৃষ্টি ইংরেজ আগমনের ফল, এ কথা ইতিহাসে লেখা আছে। যে-মধ্যবিত্ত শ্রেণি আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে অতটা এগিয়ে নিয়ে গেল তারাইবা কোথা থেকে আসতো, ইংরেজ না এলে। ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন না করলে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি করে না দিলে কেইবা পড়তো বাংলা সাহিত্য। সবই সত্য। কিন্তু বাঙালি যে ইংরেজির চর্চা না করে বাংলার চর্চা করলো এটা একটা রাষ্ট্রবিরোধিতা তো বটেই। সে মিশে গেল না। কেউ কউ গেল, যারা ইংরেজ হতে চাইলো। কিন্তু বড়মাপের অনেকগুলো মানুষ যে গেলেন না তারা যে মাতৃভাষার চর্চা করলেন সেই ঘটনা তো দিচ্ছে বলে যে, গ্রহণের অন্তরালে সুদৃঢ় একটা বর্জন রয়ে গেছে, মধুসূদন চলে গিয়েছিলেন, তিনি সাহেব হয়েছেন, মেম সাহেব বিয়ে করেছেন, ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছিলেন ইংরেজিতে লিখবেন ঠিক করেছিলেন; কিন্তু ওই যে ফিরে এলেন, হলেন বাঙালি লেখক, ওইখানেই তাঁর আসল বিদ্রোহ, ইংরেজ হওয়ার বিদ্রোহের চেয়ে যা অনেক গভীর।

রাষ্ট্রভাষা ছিল ইংরেজি। বাঙালি সে-ভাষার চর্চা করেছে; কিন্তু সে-ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেননি। না করে বাংলা ভাষাকেই বরঞ্চ এগিয়ে নিয়ে গেছে। স্বাধীনতার দাবি সেই সাহিত্যে এসেছে, নানানভাবে, নানান সুরে। কিন্তু রাষ্ট্র ছিল অত্যন্ত প্রবল। তার ক্ষমতা ছিল অপরিমেয়। তার ক্ষতিকর দাপটকে যে অস্বীকার করা যাবে তা সম্ভব ছিল না। না, সাহিত্যও পারেনি।

সাহিত্যের ক্ষতি হয়েছে দুটো। একটি সাম্প্রদায়িকতা, অপরটি শ্রেণিবিভাজন। বঙ্কিমচন্দ্রের দৃষ্টান্ত সহজেই আসে। তিনি অসামান্য ছিলেন যেমন ইহজাতিকতায়, তেমনি স্বাধীনতাপ্রিয়তা। স্বাধীনতার পক্ষে লিখতে গিয়ে তাঁর লেখবার কথা ছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে; কিন্তু তা লেখা সম্ভব ছিল না বলে আনন্দমঠ ও দেবী চৌধুরাণীতে শত্রু হিসেবে দাঁড় করালেন অনুপস্থিত মুসলমানকে। সাহিত্যে ওই যে সাম্প্রদায়িকতা প্রবেশ করলো, ওই যে নদী ঘুরে গেল তার স্বাভাবিক ধারা থেকে ভিন্ন দিকে তার প্রভাব পরবর্তীকালে অনেক ক্ষতির কারণ হয়েছে বাঙালির জন্য। ১৯৪৭-এ এসে বঙ্গদেশ যে দু’টুকরো হলো তার প্রধান কারণ সাম্প্রদায়িকতা এবং সেই কারণকে সাহিত্য প্রতিহত করেনি, বরঞ্চ পুষ্টই করেছে।

আর রইলো শ্রেণি। ইংরেজের রাষ্ট্র বিদ্যমান শ্রেণিবিভাজনকে আরো শক্ত করেছে। সাহিত্য তাকে ভাঙতে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি। সাহিত্য রয়ে গেছে বিত্তবান শ্রেণির সংস্কৃতি হিসেবে।

তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে আমরা বাংলা সাহিত্যের চর্চা করেছি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় নয়, রাষ্ট্রীয় বৈরিতার ভেতরে। হ্যাঁ, পুরস্কার ছিল পত্রিকা ছিল, গণমাধ্যমে প্রচার পাওয়া যেতো কিন্তু মূল সত্যটা ছিল এই যে, ওই রাষ্ট্র বাংলা ভাষাকে রাখতে চেয়েছিল উর্দুর নিচে, ঠিক যেমন ইংরেজরা চেয়েছিল ইংরেজিই হবে প্রধান, মোগলরা চেয়েছিল ফার্সির প্রাধান্য, আর্যরা সংস্কৃতের, তেমনি পাকিস্তানিরা চাইলো উর্দু হবে প্রধান, বাংলা দ্বিতীয়। বাঙালি সেটা মানেনি।

কিন্তু সাহিত্যে রাষ্ট্র-বিরোধিতা কতোটা এসেছে বা আসেনি সে প্রশ্নটা থাকে। না বেশি আসেনি। সাতচল্লিশের পরে আমাদের সাহিত্য ছিল কবিতাপ্রধান। আমাদের প্রধান কবিরা রাষ্ট্রের মহিমাকীর্তন করে অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন। সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো গ্লানি দেখা যায়নি। ফরাসি কিংবা রুশ বিপ্লবের পেছনে যেমন সাহিত্যের একটা ভূমিকা ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পশ্চাৎভূমিতে তেমন কোনো সাহিত্যিক ঘটনা ঘটেনি।

রাষ্ট্রের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের ব্যাপারটিকে গভীর ও প্রবল করতে না-পারা সাহিত্যের জন্য অবশ্যই একটা দুর্বলতা। সে-দুর্বলতা সেদিনও ছিল, আজও রয়েছে। মানুষের জীবনের অচরিতার্থতা ও দুঃখকে (কেবল বৈষয়িক অর্থে নয়, বুদ্ধবৃত্তিক ও অনুভূতিগত অর্থেও) নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারেনি। সে জন্য তার স্তরটা রয়ে গেছে বিনোদনের। আর ওই স্তরে যেহেতু টেলিভিশন ও ভিডিও কাজ করছে আরো জোরেশোরে, সাহিত্য তাই নিজেকে ততটা প্রয়োজনীয় করে তুলতে পারছে না, যতটা প্রয়োজনীয় হওয়া তার নিজের জন্য তো বটেই, আমাদের সংস্কৃতির জন্যও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

বিষয়টা যে-কোনো বিষয়ে রাষ্ট্র্রের ব্যাপার তা নয়, রাষ্ট্রব্যবস্থারই ব্যাপার বটে। রাষ্ট্র গঠনে সাহিত্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে হয়তো করেছেও কখনো কখনো। কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে সাহিত্যের দ্বন্দ্ব একেবারেই স্থূলগত এবং দার্শনিক। রাষ্ট্র হচ্ছে রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান, চরিত্রগতভাবে অপরদিকে সাহিত্য চায় মুক্তি। প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের পক্ষে সাহিত্যকে তার নিজের দিকে আত্মচেষ্টা ফুলকে বৃন্তচ্যুত করার সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়।

কবিতা না-লিখলেও প্লেটো যে একজন কবি ছিলেন তা তাঁর গদ্য রচনার পরতে পরতে প্রমাণিত। উপমায়, রূপকে, শব্দ চয়নে ওই দার্শনিক তাঁর অন্তর্গত কবির কল্পনা ও সৌন্দর্যবুদ্ধি উভয়কেই ব্যবহার করে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে কবিতার গুণ ও আবেদন তিনি যে জানতেন তাতেও সন্দেহ করবার অবকাশ নেই। কিন্তু তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের জন্য কোনো জায়গা রাখেন নি। জায়গা রাখবেন কি, নির্দেশ দিয়েছেন তাদেরকেও বের করে দেবার জন্য। কবিদের সম্মান দেয়া হবে, মালা ও সুগন্ধী দিয়ে তাদের সজ্জিত করা যাবে, কিন্তু তাদেরকে সবিনয়ে বলতে হবে: মহাশয়বৃন্দ, আপনাদের জন্য আমাদের রাষ্ট্রে কোনো স্থান নেই।

কেন নেই? অভিযোগটা আপাতত এটা যে, তারা মিথ্যা কথা বলে। কিন্তু তার গভীরে আরো একটা ব্যাপার রয়েছে। সেটা এই যে, কবিরা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাকে বিপন্ন করে। প্লেটোর ‘সাম্যবাদ’ ফ্যাসিস্ট ধরনের; অর্থাৎ শ্রেণিবিভাজনকে মেনে নিয়ে, তবেই সবাই সমান, বিভাজনের ভেতরে সমান, ভেঙে দিয়ে নয়। সে-রাষ্ট্রে দার্শনিকেরা শাসন করবে, সৈনিকেরা করবে যুদ্ধ, শ্রমিকেরা করবে উৎপাদন। এই বিভাজন কিছুতেই ভাঙা যাবে না। কাব্য তথা সাহিত্য যে গ্রহণযোগ্য নয় তার মূল কারণটা নিহিত রয়েছে না-ভাঙার এই রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারেই।

সাহিত্য কী করে? সাহিত্য মানুষের আবেগ জাগিয়ে দেয়। মানুষকে সংবেদনশীল করে, যার ফলে মানুষ বিভাজন ডিঙ্গিয়ে যেতে চায়। দার্শনিক হয়তো শ্রমিকের দুঃখ দেখে কাতর হবে, শ্রমিক হয়তো চাইবে সে শাসক হবে, সৈনিক হয়তো ওপরে যেতে চাইবে, কিম্বা নিচে; তখন রাষ্ট্র ভেঙে পড়বে, তখন ‘ন্যায়’ বলে কিছু থাকবে না, অন্যায়ে ছেয়ে যাবে সমস্ত কিছু। প্লেটোর সে রাষ্ট্রের প্রধান কথা হলো নিরাপত্তা অক্ষুণœ রাখা, সেখানে তাই সাহিত্যের স্থান নেই। প্লেটোর রাষ্ট্রের জন্য সাহিত্য বিপজ্জনক, যেমন তা বিপজ্জনক ছিল হিটলারের রাষ্ট্রের জন্য।

রাষ্ট্রের অনেক কিছুই থাকে। সিপাহী, সান্ত্রী, আইন, আদালত- সব কিছুই আছে তার। বিবেক নেই? হ্যাঁ, বিবেকও আছে বৈকি। সেই বিবেক হচ্ছে শাসক শ্রেণির স্বার্থ। ‘ন্যায়’ও তাই, শাসক শ্রেণির স্বার্থ। ওদিকে সাহিত্যের কাজটাই হলো মানুষের ভেতর যে বিবেকবান, অর্থাৎ সংবেদনশীল মানুষটি থাকে তাকে জাগিয়ে রাখা, তাকে সতেজ করা। সাহিত্য তাই শ্রেণি-বিরোধী এবং সে-কারণে রাষ্ট্র-বিরোধী।

প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে এন্টিগনির যে গল্পটি আছে সেটি একটি বিদ্রোহের কাহিনী। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির বিদ্রোহ। শাসনের বিরুদ্ধে বিবেকের অভ্যুত্থান। এন্টিগনি বলেছে, তার মৃত ভ্রাতাকে সে কবর দেবে। দেবেই দেবে। কেননা এটি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্র বলছে দেয়া যাবে না, কেননা লোকটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহী। এই বিশেষ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মুখপাত্রটি অন্য কেউ নয়, তিনি হচ্ছেন এন্টিগনিরই আপন মামা, ক্রিয়ন। কিন্তু এখানে আত্মীয়তা কাজে দেয় না। রাজা বন্দী রা?????ীয় স্বার্থের শৃঙ্খলে। এন্টিগনি এগিয়ে গেল, ভাইকে কবর দিতে, ক্রিয়ন বিদ্রোহী এন্টিগনিকে আটক করে কবর দিয়ে দিলো, জ্যান্ত। ক্রিয়নের পুত্র তার প্রেমিকা এন্টিগনির কবরে গিয়ে মারা গেল কাঁদতে কাঁদতে। কিন্তু ক্রিয়নের কিছু করার ছিল না। রাজা হয়ে তিনি বন্দী। ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় রাজা তখন রাষ্ট্রের পক্ষে এবং ব্যক্তির বিরুদ্ধে, অতি অবশ্যই; নইলে তিনি রাজা কেন।

এন্টিগনির মতো যারা বিবেকবান মানুষ রাষ্ট্র তাদের ভয় করে। আর সাহিত্যের কাজই হচ্ছে সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে মানুষকে বিবেকবানে পরিণত করা। সাহিত্য আনন্দ দেয় এ আমরা জানি; সাহিত্য শিক্ষা দেয় এ-ও আমরা মানি; কিন্তু তবু সাহিত্য বিনোদনের অনুষ্ঠান নয়, যেমন নয় সে প-িতের পাঠশালা; সাহিত্যে ওই দু’য়েরই ভূমিকা থাকে, কেননা এরা উভয়েই সাহিত্যের মূল কর্তব্যের অংশ, যেটি হলো মানুষের হৃদয়কে সংবেদনশীল করা। সাহিত্যের শিক্ষা মস্তিষ্কের নয়, হৃদয়ের। হৃদয়বান মানুষরাই বিবেকবান, যে-জন্য হৃদয়কে রাষ্ট্রের বড় ভয়।

রাজনৈতিকভাবে শেক্সপিয়র ছিলেন রক্ষণশীল। তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু বড় শিল্পী ছিলেন বলেই শেক্সপিয়র বারবার তাঁর নাটকে দেখিয়েছেন রাষ্ট্র কী করে ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করে। রাজপুত্র হ্যামলেট একা লড়ছেন রাজার বিরুদ্ধে। কিন্তু রাজা একা নয়, রাষ্ট্র আছে তার আজ্ঞাবাহরূপে দাঁড়িয়ে। হ্যামলেট দেখছেন একজন দুর্বৃত্ত যেহেতু বসে আছে সিংহাসনে তাই সবকিছুই রওনা হয়েছে নষ্টের অভিমুখে। রাষ্ট্র বড়ই কঠিন প্রাণি।

৩.

টলস্টয় (১৮২৯-১৯১০) শেক্সপিয়রকে পছন্দ করতেন না। মনে করতেন শেক্সপিয়র রাজা বাদশাদেরই গ্রহণ করেছেন পাত্র-পাত্রী হিসেবে জনগণকে বিশেষ মর্যাদা দেননি। হ্যাঁ, শেক্সপিয়রের দেশপ্রেমও ছিল সঙ্কীর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন তো চরিত্রের অবস্থান নয়, প্রশ্ন হচ্ছে চরিত্রের মানবিক পরিচয়। পোশাক, কিংবা সামাজিক পরিচয় যাই হোক শেক্সপিয়র দেখেছেন, অন্তর্গত মানুষটিকে। সেই মানুষটি রাজা নন, রাজাপুত্র নন, শুধুই একজন মানুষ। বিবেকবান রাজপুত্র হ্যামলেটের রাষ্ট্রও মিত্র নয়, শত্রু বটে। রাষ্ট্র তাকে হত্যা করার প্রচেষ্টার কোনো অবধি রাখে না।

সাহিত্য দেশ মানে না। কাল মানে না। রাষ্ট্র মানে না। শুধু মানে না বললে যথেষ্ট বলা হবে না, সাহিত্য ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বটাকে তুলে ধরে। সাহিত্য স্থান ও কালবিরোধী যতটা নয় রাষ্ট্রবিরোধী সে-তুলনায় অনেক বেশি। টলস্টয়ের নিজের লেখাতেও রাষ্ট্র বিরোধিতা অত্যন্ত স্পষ্ট। স্বভাবতই। সেই অতি বৃহৎ উপন্যাস যুদ্ধ ও শান্তিতে টলস্টয় দেখাচ্ছেন যুদ্ধ ব্যাপারটা রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রেরই সংঘর্ষ আসলে, কিন্তু দুর্ভোগটা সাধারণ মানুষেরই। আর রাষ্ট্রনায়কেরাও সাধারণ মানুষই পর্যন্ত, যদিও তারা ভান করতে ভালোবাসে অসাধারণত্বের। আন্না কারেনিনার নায়ক-নায়িকারা অধিকাংশই রাষ্ট্রের সেবক। আন্নার স্বামী মস্ত বড় আমলা, তার প্রেমিক সেনাবাহিনীর অফিসার। আন্নার ভাইও বড় সরকারি কর্মচারী। ওই সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ভেতরই আন্নার চলাফেরা ওঠাবসা ও জীবনযাপন। অনেক দিক দিয়েই অসাধারণ এই মেয়ে; সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে, মেধায় ও আচরণে নিজের বৃত্তের সব মানুষকে ছাড়িয়ে ওঠে বিশেষভাবে ব্যতিক্রমী হলো তার আন্তরিকতা। এই মানুষটিকে চরিতার্থতা দেবার ক্ষমতা তার স্বামীর নেই, তার প্রেমিকেরও নেই। বেচারা আন্না বেশি বয়সী স্বামীকে ছেড়ে প্রায় সমবয়সী প্রেমিকার কাছে যায়, কিন্তু চরিতার্থ না দিলো তাকে তার আমলা স্বামী, না তার সৈনিক প্রেমিক। উভয়েই সামান্য তারা, রাষ্ট্রলালিত বুর্জোয়া স্বার্থপরতার বন্ধনে আবদ্ধ হবার কারণেই, বিশেষভাবে। এ উপন্যাসে রাষ্ট্রবিরোধী রাজনৈতিক লোকেরাও রয়েছে তারা ছায়া ছায়া, খুব প্রত্যক্ষ নয়। তারা নতুন ব্যবস্থার কথা ভাবে, কমিউনিজমের কথাও। মোট বিষয়টা দাঁড়ায় এই যে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যর্থ হয়ে গেছে, এটা ভেঙ্গে পড়ছে। আন্নার মতো মানুষদের পক্ষ এখানে তাই আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকছে না। টলস্টয়ের এ উপন্যাসে আন্নার বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। রেলগাড়ির নিচে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে ওই রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষের স্বপ্নগুলো ওইভাবেই কেটে টুকরো টুকরো করবে, যদি বিপরীতে কিছু না ঘটে।

এক অর্থে টলস্টয় রক্ষণশীল। তিনি রক্তপাত পছন্দ করতেন না, রাষ্ট্রবিপ্লবও নয়; কিন্তু তার লেখার ভেতর দিয়ে রুশ বিপ্লবকে এগিয়ে আনছিলেন তিনি বিদ্যমান রাষ্ট্রের অন্তঃসারশূন্যতা ও নিষ্ঠুরতাকে উন্মোচিত করে দিয়ে। এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল; হৃদয় দিয়ে বুঝছেন এবং অন্যের হৃদয়ে সেই বুঝাটাকে সংক্রমিত করে দিয়েছেন।

আন্না কারোনিনার পরের উপন্যাস ‘পুনরুজ্জীবন’। এতে রাষ্ট্রের মুখচ্ছবি আরো প্রত্যক্ষ। কাটিউসা মাসলোভা একজন নিরপরাধ কিশোরী। সামন্ত পরিবারের যুবক নেখলিউদভ তাকে নষ্ট করলো। মাসলোভার সন্তান হবে, কিন্তু সন্তানের পিতা নেখলিউদভ তখন অনেক দূরে। সে তখন সেনাবাহিনীর নবীন অফিসার। মাসলোভা কাজ করে, দেহ বিক্রয় করে জেলও খাটে। সবই বাঁচার চেষ্টায়। আসামি হিসেবে আদালতে এসেছে মাসলোভা। অদৃষ্টের কী কৌতুকবোধ, সেই বিচারে জুরীদের একজন হয়ে বসে আছে নেখলিউদভ। নেখলিউদভ চিনেছে ওই মেয়েকে। তার ভেতরে পাপের বোধ জেগেছে। সে চাইলো মাসলোভাকে রক্ষা করবে। কিন্তু পারলো না। বিচারে জেল হলো নির্বাসন হয়েছিল মাসলোভার। জেলটা মওকুফ করলো নেখলিউদভ, আমলাদের কাছে দেন-দরবার করে। কিন্তু নির্বাসন বলবৎ রইলো।

মাসলোভা চলেছে সাইবেরিয়াতে। নেখলিউদভ চলেছে পিছু পিছু। তার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। সে প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়, সে মাফ চাইবে। মাসলোভার রাজি হলে তাকে বিয়ে করবে। শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটা নেখলিউদভ করতে পারলো মাসলোভার কাছ সাইবেরিয়াতে গিয়ে। আশা করেছিল মাসলোভা কাল বিলম্ব করবে না, সম্মত হতে। কিন্তু মাসলোভা ওই প্রস্তাবে সম্মত নয়। তার প্রত্যাখ্যানটা খুবই দৃঢ়। সে বললো, বুঝি সেবার আমার দেহটা ব্যবহার করেছো, এবার ব্যবহার করতে চাইছো আমার আত্মটাকে। না, তা হবে না।

আসলে মাসলোভারও পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। সেও আর আগের সেই পথহারা মেয়েটি নেই। পথের সন্ধান এরা অন্য ধরনের মানুষ। এরা সংযমী মেধার; এরা বই পড়ে একজনের থলের ভেতর দেখা যায় মার্কসের পুঁজি বইটি উঁকি দিচ্ছে। এদেরই একজন হচ্ছে সাইমনসন। তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে মাসলোভার। তারা ভালোবেসে ফেলেছে পরস্পরকে। তাদের বিয়ে হবে।

নেখলিউদভরা যতই যা করুক তারা বন্দী বটে, রাষ্ট্রের বৃত্তের ভেতর আবদ্ধ। ওই বৃত্তে কারোরই মুক্তি নেই, না নেখলিউদভের, না মাসলোভার, না সাইমনসনের বিশেষভাবে পীড়িত হবে মাসালোভারা। নেখলিউদভ তাদেরকে ব্যবহার করবে নিজেদের বিশেষ প্রয়োজনে। মানুষের মুক্তির জন্য নতুন ব্যবস্থা প্রয়োজন হবে। যে-ব্যবস্থার পক্ষে সাইমনসনেরা লড়ছে। বলা বাহুল্য, ওদের মধ্যেই লেনিন ছিলেন, যার সন্ধান টলস্টয় তখনও পাননি, পুনরুজ্জীবন উপন্যাসটি যখন তিনি লিখে শেষ করেন, ১৮৯৯-এ লেখক যদি রক্ষণশীল হন তবুও এটা নিশ্চয় করে বলা যাবে না যে, তাঁর লেখা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার পক্ষে যাবে। এক্ষেত্রে ব্যালজাকের (১৭৯৯-১৮৫০) কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ব্যালজাক নিজে রক্ষণশীল ছিলেন। কিন্তু মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতার যথার্থই মনে করেন যে তার লেখা সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী ধারণাকে সাহায্য করেছে। এমিল জোলা (১৮৪০-১৯১২) ব্যালজাকের যা মূল্য তা একশ’জন জোলা পূরণ করতে পারবেন না। কেননা ব্যালজাকের রাজনীতিক মতবাদ যাই হোক না কেন তার সাহিত্যের বাস্তববাদিতা সমাজের নিষ্ঠুরতা ও অন্তঃসারশূন্যতাকে উন্মোচিত করে দিয়েছিল।

৪.

শুরুর কথাতেই ফিরে যেতে হয় এ কথা অসত্য নয় যে, দর্শন ও সাহিত্যে বিস্তর দূঢ়ত্ব রয়েছে। দর্শন সাহিত্য নয়, সাহিত্যও দর্শন নয়, তবু সাহিত্য দর্শনকে বোঝা তার নিজের প্রয়োজনে। দর্শন সাহিত্যকে গভীরতা দেয়। সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান যে সর্বদা প্রত্যক্ষ তা নয়, অনেক সময়েই তা অপ্রত্যক্ষ বটে। (সমাপ্ত)

back to top