alt

সাময়িকী

যুদ্ধের জানালায় দাঁড়িয়ে

যাকিয়া সুমি সেতু

: বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

প্যারিসের আইসবল ঠাণ্ডা সকালে, কুয়াশার স্তব্ধতা ভেদ করে কফির সুবাস ভেসে আসছিল ক্যাফের ছোট্ট জানালা দিয়ে। ইংল্যান্ডের মেয়ে সেরেনা প্যারিসের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর “চার্লস দ্য গল” থেকে গাড়ি নিয়ে ছুটে আসে এখানে। এটি প্যারিসের বিখ্যাত ক্যাফে “দে লা রিভিয়ের”। ক্যাফেটির জানালার পাশেই বয়ে চলেছে স্বচ্ছ নীলাভ-সবুজ সেন নদী। নদীর জলের রঙ অদ্ভুত সুন্দর সেরেনার চোখের মতোই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ভেঙে রোদ গলে গলে পড়তে শুরু করে, সেন নদীর জলে ভেসে ওঠে ঝলমলে সোনালি মুক্তো। নদীর তীরেই উইলো গাছের ছায়ালীন রূপকথা- বাতাসে এর পাতা আলতো করে নদীর জল ছুঁয়ে থাকে তীব্র মহুয়ার নেশায়। নদীর ওপারে অপূর্ব বেইলিভ পাথরের পুরনো ব্রিজ। সিটি অফ লাইটের ঐতিহ্য নিয়ে কাব্যময় হয়ে আছে। প্রকৃত অর্থে এই অদ্ভুত সুন্দর ক্যাফেটি প্যারিসের প্রাণকেন্দ্রের একটি প্রাচীন স্থাপনা। এই ক্যাফেতে বসে সেরেনা অনুভব করেছিল, নদীর জলের সোনালি মুক্তোর মতোই যেন ওর বুকের ভেতরটা।

সেরেনা বসেছিলেন এক কোনার টেবিলে, নীরবে তাকিয়ে দেখছিলেন দুই ব্রিটিশ সেনার ক্লান্ত মুখ। খাকি ইউনিফর্মে মোড়া সেই দুজনের চোখে ফুটে উঠেছিল অনিদ্রা, ক্ষুধা আর অদম্য যুদ্ধক্ষেত্রের ছাপ। সেরেনা ওদের দেখেই ভেতরে এক অদ্ভুত ছক এঁকে ফেলে কমান্ডোর মতো। ক্যাফের বাতাসের গাঢ় গন্ধে, এক ধরনের জেদ আর নির্ভীকতা নিয়ে সে এগিয়ে যায় তাদের দিকে। তার স্বচ্ছ নীলাভ সবুজ চোখে গভীর প্রত্যয়।

“আমাকে সাহায্য করতে পারো?” তার কণ্ঠস্বর ছিল মোলায়েম, যেন এক মিষ্টি অনুরোধ।

একটি সিগারেটে আগুন ধরিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তারা তাকে জিজ্ঞাসা করল, “কী সাহায্য?”

সেরেনা হাসলো একটু , কিন্তু সেই হাসির আড়ালে লুকানো ছিল এক গভীর পরিকল্পনা। “তোমাদের সঙ্গে যেতে চাই। আমার একটি খাকি ইউনিফর্ম দরকার, আর তোমাদের সাহায্য।”

প্রথমে অবাক, চোখের কোণে মৃদু কৌতুক। সেরেনা সবকিছু খুলে বলে এবং বিনীতভাবে অনুরোধ করে। এক অদ্ভুত মানবিক নেশায় তারা রাজি হয়। সেই মুহূর্ত থেকে, সেরেনা তার নারীত্বের আচ্ছাদন ছিঁড়ে ফেলে দিতে শুরু করে। আঁটসাঁট সব ভেতরের কাপড়, তুলো দিয়ে কাঁধ বড় করে, যেন পুরুষের মতো দেখায়। শরীরের গোলাপি রঙটিকে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দিয়ে গাঢ় করে নিল, যেন হালকা সোনালি ত্বকের চেয়ে ক্লান্ত, ক্ষয়ে যাওয়া সৈনিকের মতো দেখায়। দুই ব্রিটিশ সেনার সাহায্যে স্কটিশ সামরিক পুলিশের সঙ্গেও বন্ধুত্ব করে তাদের বলে, “আমার চুলটা একটু ছোট করে কেটে দাও। আমাকে যেন তোমাদের মতো মনে হয়।”

সেরেনার নতুন নাম হলো স্যামন- নারী আর পুরুষের পরিচয়ের সীমানা এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। তারপর সেরেনা, ধীরে ধীরে পরিখার দিকে এগিয়ে যায়। রাস্তার অন্ধকারে, কোমরের ব্যাগের ভেতরে লুকানো জাল পরিচয়পত্রের সঙ্গে, তার হৃৎপি-ের ধুঁকপুকানি স্পষ্ট হয়ে ওঠে । নতুন নাম- প্রাইভেট স্যামন, প্রথম ব্যাটেলিয়ন, লিসেস্টারশায়ার রেজিমেন্টের একজন সৈনিক। সেরেনার পদক্ষেপ ছিল নির্ভীক, তার চোখে এক ধরনের দৃঢ় সংকল্প। ব্রিটিশ সেক্টরের দিকে সাইকেলে চেপে, সে অ্যালবার্ট পৌঁছে। রাস্তার পাশে ফেলে রাখা সৈনিকদের চেহারা দেখে বুঝে নেয়, যুদ্ধ এখানে কেবল অস্ত্রের নয়, একটি মহাযুদ্ধ চলছে তার ভেতরেও। যাত্রাপথে, অ্যালবার্ট শহরের ধুলোবালিতে ঢাকা এক সৈন্যের সাথে পরিচয় হয়- জ্যাক, একজন ল্যাঙ্কাশায়ারের কয়লা খনি থেকে আসা স্যাপার।

“আমার সঙ্গে এসো”, বলল জ্যাক, তার দৃষ্টিতে ছিল এক গভীর দুর্বলতা আর সহানুভূতির মিশ্রণ। “সেনলিসের জঙ্গলে একটি কুটির আছে। তুমি নিরাপদে ওখানে থাকতে পারবে।”

সেরেনার কাছে যুদ্ধক্ষেত্র এখন মহাচ্যালেঞ্জ, তার নিজের পরিচয়ের প্রতিফলন খোঁজার লড়াই। ব্রিটিশ সেনাদের ভেতর মিশে গিয়ে, সেরেনা প্রতিদিন ড্রিল করে, মার্চ করে, পায়ে সামরিক বুট। যেন তার হৃদয়ের মধ্যে অন্য এক পৃথিবীর দরজা খুলে যাচ্ছে। দিনের পর দিন জ্যাকের সাহায্যে সামনের লাইনে থেকে যুদ্ধ করে। কুটিরে ফিরে এসে, ভেজা মাদুর, শীতল বাতাস, আর ক্ষুধার্ত সৈন্যদের রেশনের টুকরোর ভেতর ঝরে পড়ে চোখের অবারিত জল। প্রতিটি রাত যেন এক নতুন যুদ্ধ, শুধু শত্রুর বিরুদ্ধে নয়, নিজের শরীরের বিরুদ্ধেও। ঠা-া শরীরে অনুভব করে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি- সেরেনার পায়ের শিরা ফুলে, হাতের আঙুলগুলো ব্যথায় অবশ হয়ে কষ্ট দিচ্ছে খুব। রাতের নিস্তব্ধতায় ফিসফিস করে তবুও একটিই শব্দ- “লিওন”।

ব্রিটিশ সেক্টরে এর পরদিনই এক ভয়ঙ্কর রাত আসে। কাঁপা কাঁপা ঠা-া বাতাসে সেরেনা এগিয়ে যায় একটি অন্ধকার ট্রেঞ্চের দিকে। প্রচ- এক গুলির শব্দ, আর সেই মুহূর্তে, তার সামনে লিওন। কিন্তু সে আর আগের লিওন নেই- শরীর রক্তে ভেজা, মুখে কোনো শব্দ নেই। সেরেনা বুকের গভীরে লিওনকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। এক পলক সেরেনার দিকে তাকিয়েই লিওনের নিশ্বাস থেমে যায় সেরেনার বুকেই। নিষ্প্রাণ লিওনের চোখে ছিল এক অসীম শান্তি, যেন সে মুক্তি পেয়েছে যুদ্ধ থেকে, আশ্রয় নিয়েছে সেরেনার বুকের ভেতর।

ব্রিটিশ সেনার খাকি পোশাকে সেরেনার ছদ্মবেশে যুদ্ধে নামার সেই সাহসী সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল শুধু লিওনকে খুঁজে বের করার প্রতিজ্ঞা। সেরেনাকে বলেই লিওন এই যুদ্ধে এসেছিল। সেরেনা জানতো, লিওন যুদ্ধের ফিল্ডেই আছে, কিন্তু কোথায়, তা অজানা ছিল। লিওনের নিষ্প্রাণ মুখের দিকে তাকিয়ে সেরেনার “অতীত” সাগরের ঢেউয়ের মতো ভাসিয়ে ওকে অতল করে দিচ্ছে।

প্যারিস থেকে পড়তে আসা লিওনের সঙ্গে সেরেনার পরিচয় হয়েছিল সেন্ট পিটার্স ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে। লিওন একটি পুরোনো বইয়ের খোলা পাতায় নিবিষ্ট চোখে পড়ছিল। কপালের উপর পড়ে থাকা সোজা চুলগুলো আলোর প্রভায় চিকচিক করছিল। বই পড়ার মধ্যে লিওনের এক ধরনের নীরব সৌন্দর্য ছিল, যে সৌন্দর্য প্রতিটি বাক্যের গভীরতায় যেন প্রবাহিত। সেরেনাও বইয়ের মধ্যেই, ব্লন্ড লম্বা চুলে, ঝকঝকে গোলাপি রঙে গোলাপের মতো ফুটেছিল। সেখানেই প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম। প্রেমের সেই গভীরতায় দুজনেই হারিয়ে গিয়েছিল শব্দের মায়ায়। তারা ঠিক করেছিল একদিন একটি লাইব্রেরি করবে- যেখানে মানুষ আশ্রয় নেবে “জ্ঞান আর শান্তির” জন্য।

লিওন প্যারিসের কাছাকাছি মন্টমার্ট্রে এলাকায় থাকতো। মন্টমার্ট্র পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত “সাকার কুর ব্যাসিলিকা” থেকে পুরো প্যারিস শহরের একটি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়। লিওনের সাথে সেরেনা ওর বাবার সাথে দেখা করতে এখানে দুবার এসেছিল। এখানকার সংকীর্ণ রাস্তা, পাথরের সিঁড়ি, এবং চারপাশের সবুজে মন্টমার্ট্র- যেন এক নিঃশব্দ শিল্পী- যা সেরেনার অন্তর ছুঁয়েছিল। এর কয়েক মাস পরেই শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপজুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। প্যারিস ছিল এই যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যেখানে সামরিক কার্যকলাপ, গুপ্তচরবৃত্তি, এবং স্ট্র্যাটেজিক অপারেশনগুলো হতো। লিওন ইংল্যান্ডের ওর পিএইচডি অসমাপ্ত রেখেই যুদ্ধে চলে আসে। সেরেনা, লিওনের বিচ্ছেদ আর মানতে পারছিল না। ইংল্যান্ডের গ্রিনউড গ্রামে সেরেনা ওর মায়ের সাথে থাকে, মা ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। লিওনকে ওর মাও অনেক পছন্দ করেন। মায়ের অনুমতি নিয়েই সেরেনার এখানে আসা।

লিওনের এই বিয়োগ আর যুদ্ধক্ষেত্রের শৃঙ্খলার কঠোরতায় এবার ধরা পড়ে গেল সেরেনা কমান্ডিং সার্জেন্টের হাতে। স্যামন থেকে সেরেনায় মুখোশ এবার উন্মোচিত হয়ে যায়। তাকে ফিরিয়ে আনা হয় আবার ইংল্যান্ডে। ইঊঋ সদর দপ্তরে একজন কর্নেল তাকে গুপ্তচর ভেবে গ্রেপ্তার করে। একটি ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে, কর্নেল সেরেনাকে জিজ্ঞেস করলেন। “তুমি কে?”

“আমি সেরেনা, একজন নারী, লিওনের ভালোবাসা।” এতো দৃঢ়তা, কণ্ঠে নিবেদিত একাগ্রতা আর নীল-সবুজ দুচোখ ভরা লিওনের ছবি- বিস্মিত করে তুলেছে এই পরিবেশকে।

কর্নেল সেরেনার চোখের দিকে তাকিয়ে, চুপচাপ বসে থাকলেন। যেনো সেই ক্ষণস্থায়ী নীরবতা বলছিল- “যুদ্ধ আর প্রেমে” সবকিছু সম্ভব। এরপর ২১ বছরের সেরেনাকে জিপে করে পৌঁছে দেন গ্রিনউড গ্রামে, ওর মায়ের কাছে।

সেরেনা, লিওনের স্মৃতি কিছুতেই মুছতে পারে না ওর হৃদয় থেকে। লিওনের সঙ্গে কাটানো তিনটি বছরের মুহূর্তগুলো তাকে পুরোনো স্মৃতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই লাইব্রেরি, বই, প্রথম দেখা, প্রথম প্রেম!

লিওনের সেই কথাগুলোও আজ নদীর জলে, পাহাড়ের উপত্যকায়, ওক গাছ, হর্নবিম, হলি, সিলভার বার্চের সব পাতায় সুর হয়ে কাঁদে। লিওন, সেরেনাকে বলেছিল “সেরেনা আমার পুরো জীবনটাই এখন তোমার। আমরা আমাদের ভালোবাসার একটি স্মৃতিঘর বানাবো, সেটা হবে অজ¯্র বই দিয়ে সাজানো একটি লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরি চিরকাল আমাদের প্রেমের কথা বলবে।”

লিওনের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে, সেরেনা গ্রিনউড গ্রামেই গড়ে তোলে ওর স্কলারশিপের জমানো অর্থে একটি ভিন্নরকম লাইব্রেরি। লাইব্রেরিটির প্রবেশদ্বার এক বিশাল জানালা দিয়ে তৈরি। সেই জানালার পাশেই অজ¯্র লাল বেরির ‘মাউন্টেন অ্যাশ’।

ওপারে দেখা যায় ছোট ছোট পাহাড়, সবুজ মাঠের বিশাল আকাশ। সবকিছু মিলিয়ে এখানে রঙ- লাল, সবুজ, নীল। এই লাইব্রেরির প্রতিটি বই, প্রতিটি শব্দ যেন জীবনের একেকটি জানালা- যুদ্ধ, প্রেম, একাত্মতার আর বিচ্ছিন্নতার চিত্রকল্প।

লাইব্রেরির কেন্দ্রে রয়েছে একটি কাঁচের টেবিল, যেখানে রাখা সেই বই, যা লিওন পড়ছিল, যেদিন তারা প্রথম দেখা করে। বইটি লিওন সেরেনাকে উপহার দিয়েছিল সেদিনই। মিষ্টি সুগন্ধভরা সেই বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো কখনো বন্ধ করেনি সেরেনা। কারণ সেরেনা চেয়েছিল, যেন লিওনের হাতের ছোঁয়া চিরকাল বেঁচে থাকবে বইটির পৃষ্ঠা জুড়ে। সেজন্য বইটি সেই পৃষ্ঠা নিয়েই খোলা রয়েছে।

লাইব্রেরির প্রতিটি কোনায়, প্রতিটি চেয়ারে লিওনের উপস্থিতি অনুভব করে সেরেনা। সেই গল্পের গভীরতা এখনো সেখানকার বাতাসে ভেসে বেড়ায়, প্রতিটি বইয়ের পাতায় লিওন আর সেরেনার মুগ্ধতা ছড়িয়ে। খোলা বইটির সামনেই রয়েছে লিওনের বিশাল একটি ছবি। এই ছবিটি এঁকেছে সেরেনা নিজেই। ছোটবেলায় রূপকথার গল্প বলে বলে সেরেনার চিত্রশিল্পী মা ওকে ছবি আঁকা শিখিয়েছিল।

সেরেনা লিওনের একটি অপূর্ব ছবি এঁকেছে, যা তার গভীর আবেগ ও ভালোবাসার প্রতিফলন। লিওনের মুখে “পীচ-গোলাপি” ছায়া ফুঁটে উঠেছে, তার ত্বকের কোমলতাকে প্রকাশ করে। চোখে “চকোলেট ব্রাউন” ও “মসৃণ কালো” রঙ ব্যবহার করে, সেরেনা, লিওনের চাহনিতে এক গভীরতা এনেছে, যেখানে “সিলভার” আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। লিওনের চুলের তরঙ্গগুলো “কাফে ব্রাউন” ও “গোল্ডেন ইয়েলো” রঙে সূর্যের আলোয় চকচক করছে। পোশাকের জন্য “ডিপ ব্লু” ও “সাইপিয়ান গ্রে” রঙ ব্যবহার করেছে, যা লিওনের ব্যক্তিত্বের শৈল্পিক দিককে ফুটিয়ে তুলছে। পটভূমিতে “অ্যাকোয়া ব্লু” ও “ফিরোজা সবুজ” ছায়া দিয়ে লিওনকে যেন আরও জীবন্ত করে তুলেছে, যেখানে লিওনের উপস্থিতি সারাজীবনের জন্য আটকে আছে সেরেনার তুলিতে।

অনেক দূর দূরান্ত থেকে আজও অনেকেই আসে শুধু এই লাইব্রেরিটি দেখতে, ইংল্যান্ডের ছোট গ্রিনউড গ্রামে। এই লাইব্রেরির প্রতিটি বই যেন লিওনের কণ্ঠস্বর- যুদ্ধের ছেঁড়া ক্যানভাসে আঁকা শূন্যতার শব্দ। গ্রিনউডের নীরব রাতে, বইয়ের পাতা উল্টানোর শব্দে গুনগুন করে ওঠে সেরেনা, লিওনের নক্ষত্র প্রেম। শিল্পের মতো লিওনের স্মৃতিতে গড়া লাইব্রেরিটির নাম দিয়েছিল সেরেনা “যুদ্ধের জানালায় দাঁড়িয়ে”। এক নির্মোহ বন্ধনে আবদ্ধ আজও সেরেনা, লিওন, বই আর বইয়ের এই লাইব্রেরি।

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

ছবি

শিল্পচর্চায় তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি ইনোভেটিভ

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতা বৈভব ও বহুমাত্রিকতা

ছবি

উইলিয়াম রাদিচের অধ্যয়নে অনন্য রবীন্দ্রনাথ

দিলারা হাফিজের কবিতা

ছবি

অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি

ছবি

আহমদুল কবির স্মরণে

ছবি

আহমদুল কবিরের সদাশয়তা

tab

সাময়িকী

যুদ্ধের জানালায় দাঁড়িয়ে

যাকিয়া সুমি সেতু

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্যারিসের আইসবল ঠাণ্ডা সকালে, কুয়াশার স্তব্ধতা ভেদ করে কফির সুবাস ভেসে আসছিল ক্যাফের ছোট্ট জানালা দিয়ে। ইংল্যান্ডের মেয়ে সেরেনা প্যারিসের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর “চার্লস দ্য গল” থেকে গাড়ি নিয়ে ছুটে আসে এখানে। এটি প্যারিসের বিখ্যাত ক্যাফে “দে লা রিভিয়ের”। ক্যাফেটির জানালার পাশেই বয়ে চলেছে স্বচ্ছ নীলাভ-সবুজ সেন নদী। নদীর জলের রঙ অদ্ভুত সুন্দর সেরেনার চোখের মতোই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ভেঙে রোদ গলে গলে পড়তে শুরু করে, সেন নদীর জলে ভেসে ওঠে ঝলমলে সোনালি মুক্তো। নদীর তীরেই উইলো গাছের ছায়ালীন রূপকথা- বাতাসে এর পাতা আলতো করে নদীর জল ছুঁয়ে থাকে তীব্র মহুয়ার নেশায়। নদীর ওপারে অপূর্ব বেইলিভ পাথরের পুরনো ব্রিজ। সিটি অফ লাইটের ঐতিহ্য নিয়ে কাব্যময় হয়ে আছে। প্রকৃত অর্থে এই অদ্ভুত সুন্দর ক্যাফেটি প্যারিসের প্রাণকেন্দ্রের একটি প্রাচীন স্থাপনা। এই ক্যাফেতে বসে সেরেনা অনুভব করেছিল, নদীর জলের সোনালি মুক্তোর মতোই যেন ওর বুকের ভেতরটা।

সেরেনা বসেছিলেন এক কোনার টেবিলে, নীরবে তাকিয়ে দেখছিলেন দুই ব্রিটিশ সেনার ক্লান্ত মুখ। খাকি ইউনিফর্মে মোড়া সেই দুজনের চোখে ফুটে উঠেছিল অনিদ্রা, ক্ষুধা আর অদম্য যুদ্ধক্ষেত্রের ছাপ। সেরেনা ওদের দেখেই ভেতরে এক অদ্ভুত ছক এঁকে ফেলে কমান্ডোর মতো। ক্যাফের বাতাসের গাঢ় গন্ধে, এক ধরনের জেদ আর নির্ভীকতা নিয়ে সে এগিয়ে যায় তাদের দিকে। তার স্বচ্ছ নীলাভ সবুজ চোখে গভীর প্রত্যয়।

“আমাকে সাহায্য করতে পারো?” তার কণ্ঠস্বর ছিল মোলায়েম, যেন এক মিষ্টি অনুরোধ।

একটি সিগারেটে আগুন ধরিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তারা তাকে জিজ্ঞাসা করল, “কী সাহায্য?”

সেরেনা হাসলো একটু , কিন্তু সেই হাসির আড়ালে লুকানো ছিল এক গভীর পরিকল্পনা। “তোমাদের সঙ্গে যেতে চাই। আমার একটি খাকি ইউনিফর্ম দরকার, আর তোমাদের সাহায্য।”

প্রথমে অবাক, চোখের কোণে মৃদু কৌতুক। সেরেনা সবকিছু খুলে বলে এবং বিনীতভাবে অনুরোধ করে। এক অদ্ভুত মানবিক নেশায় তারা রাজি হয়। সেই মুহূর্ত থেকে, সেরেনা তার নারীত্বের আচ্ছাদন ছিঁড়ে ফেলে দিতে শুরু করে। আঁটসাঁট সব ভেতরের কাপড়, তুলো দিয়ে কাঁধ বড় করে, যেন পুরুষের মতো দেখায়। শরীরের গোলাপি রঙটিকে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দিয়ে গাঢ় করে নিল, যেন হালকা সোনালি ত্বকের চেয়ে ক্লান্ত, ক্ষয়ে যাওয়া সৈনিকের মতো দেখায়। দুই ব্রিটিশ সেনার সাহায্যে স্কটিশ সামরিক পুলিশের সঙ্গেও বন্ধুত্ব করে তাদের বলে, “আমার চুলটা একটু ছোট করে কেটে দাও। আমাকে যেন তোমাদের মতো মনে হয়।”

সেরেনার নতুন নাম হলো স্যামন- নারী আর পুরুষের পরিচয়ের সীমানা এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। তারপর সেরেনা, ধীরে ধীরে পরিখার দিকে এগিয়ে যায়। রাস্তার অন্ধকারে, কোমরের ব্যাগের ভেতরে লুকানো জাল পরিচয়পত্রের সঙ্গে, তার হৃৎপি-ের ধুঁকপুকানি স্পষ্ট হয়ে ওঠে । নতুন নাম- প্রাইভেট স্যামন, প্রথম ব্যাটেলিয়ন, লিসেস্টারশায়ার রেজিমেন্টের একজন সৈনিক। সেরেনার পদক্ষেপ ছিল নির্ভীক, তার চোখে এক ধরনের দৃঢ় সংকল্প। ব্রিটিশ সেক্টরের দিকে সাইকেলে চেপে, সে অ্যালবার্ট পৌঁছে। রাস্তার পাশে ফেলে রাখা সৈনিকদের চেহারা দেখে বুঝে নেয়, যুদ্ধ এখানে কেবল অস্ত্রের নয়, একটি মহাযুদ্ধ চলছে তার ভেতরেও। যাত্রাপথে, অ্যালবার্ট শহরের ধুলোবালিতে ঢাকা এক সৈন্যের সাথে পরিচয় হয়- জ্যাক, একজন ল্যাঙ্কাশায়ারের কয়লা খনি থেকে আসা স্যাপার।

“আমার সঙ্গে এসো”, বলল জ্যাক, তার দৃষ্টিতে ছিল এক গভীর দুর্বলতা আর সহানুভূতির মিশ্রণ। “সেনলিসের জঙ্গলে একটি কুটির আছে। তুমি নিরাপদে ওখানে থাকতে পারবে।”

সেরেনার কাছে যুদ্ধক্ষেত্র এখন মহাচ্যালেঞ্জ, তার নিজের পরিচয়ের প্রতিফলন খোঁজার লড়াই। ব্রিটিশ সেনাদের ভেতর মিশে গিয়ে, সেরেনা প্রতিদিন ড্রিল করে, মার্চ করে, পায়ে সামরিক বুট। যেন তার হৃদয়ের মধ্যে অন্য এক পৃথিবীর দরজা খুলে যাচ্ছে। দিনের পর দিন জ্যাকের সাহায্যে সামনের লাইনে থেকে যুদ্ধ করে। কুটিরে ফিরে এসে, ভেজা মাদুর, শীতল বাতাস, আর ক্ষুধার্ত সৈন্যদের রেশনের টুকরোর ভেতর ঝরে পড়ে চোখের অবারিত জল। প্রতিটি রাত যেন এক নতুন যুদ্ধ, শুধু শত্রুর বিরুদ্ধে নয়, নিজের শরীরের বিরুদ্ধেও। ঠা-া শরীরে অনুভব করে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি- সেরেনার পায়ের শিরা ফুলে, হাতের আঙুলগুলো ব্যথায় অবশ হয়ে কষ্ট দিচ্ছে খুব। রাতের নিস্তব্ধতায় ফিসফিস করে তবুও একটিই শব্দ- “লিওন”।

ব্রিটিশ সেক্টরে এর পরদিনই এক ভয়ঙ্কর রাত আসে। কাঁপা কাঁপা ঠা-া বাতাসে সেরেনা এগিয়ে যায় একটি অন্ধকার ট্রেঞ্চের দিকে। প্রচ- এক গুলির শব্দ, আর সেই মুহূর্তে, তার সামনে লিওন। কিন্তু সে আর আগের লিওন নেই- শরীর রক্তে ভেজা, মুখে কোনো শব্দ নেই। সেরেনা বুকের গভীরে লিওনকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। এক পলক সেরেনার দিকে তাকিয়েই লিওনের নিশ্বাস থেমে যায় সেরেনার বুকেই। নিষ্প্রাণ লিওনের চোখে ছিল এক অসীম শান্তি, যেন সে মুক্তি পেয়েছে যুদ্ধ থেকে, আশ্রয় নিয়েছে সেরেনার বুকের ভেতর।

ব্রিটিশ সেনার খাকি পোশাকে সেরেনার ছদ্মবেশে যুদ্ধে নামার সেই সাহসী সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল শুধু লিওনকে খুঁজে বের করার প্রতিজ্ঞা। সেরেনাকে বলেই লিওন এই যুদ্ধে এসেছিল। সেরেনা জানতো, লিওন যুদ্ধের ফিল্ডেই আছে, কিন্তু কোথায়, তা অজানা ছিল। লিওনের নিষ্প্রাণ মুখের দিকে তাকিয়ে সেরেনার “অতীত” সাগরের ঢেউয়ের মতো ভাসিয়ে ওকে অতল করে দিচ্ছে।

প্যারিস থেকে পড়তে আসা লিওনের সঙ্গে সেরেনার পরিচয় হয়েছিল সেন্ট পিটার্স ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে। লিওন একটি পুরোনো বইয়ের খোলা পাতায় নিবিষ্ট চোখে পড়ছিল। কপালের উপর পড়ে থাকা সোজা চুলগুলো আলোর প্রভায় চিকচিক করছিল। বই পড়ার মধ্যে লিওনের এক ধরনের নীরব সৌন্দর্য ছিল, যে সৌন্দর্য প্রতিটি বাক্যের গভীরতায় যেন প্রবাহিত। সেরেনাও বইয়ের মধ্যেই, ব্লন্ড লম্বা চুলে, ঝকঝকে গোলাপি রঙে গোলাপের মতো ফুটেছিল। সেখানেই প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম। প্রেমের সেই গভীরতায় দুজনেই হারিয়ে গিয়েছিল শব্দের মায়ায়। তারা ঠিক করেছিল একদিন একটি লাইব্রেরি করবে- যেখানে মানুষ আশ্রয় নেবে “জ্ঞান আর শান্তির” জন্য।

লিওন প্যারিসের কাছাকাছি মন্টমার্ট্রে এলাকায় থাকতো। মন্টমার্ট্র পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত “সাকার কুর ব্যাসিলিকা” থেকে পুরো প্যারিস শহরের একটি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়। লিওনের সাথে সেরেনা ওর বাবার সাথে দেখা করতে এখানে দুবার এসেছিল। এখানকার সংকীর্ণ রাস্তা, পাথরের সিঁড়ি, এবং চারপাশের সবুজে মন্টমার্ট্র- যেন এক নিঃশব্দ শিল্পী- যা সেরেনার অন্তর ছুঁয়েছিল। এর কয়েক মাস পরেই শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপজুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। প্যারিস ছিল এই যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যেখানে সামরিক কার্যকলাপ, গুপ্তচরবৃত্তি, এবং স্ট্র্যাটেজিক অপারেশনগুলো হতো। লিওন ইংল্যান্ডের ওর পিএইচডি অসমাপ্ত রেখেই যুদ্ধে চলে আসে। সেরেনা, লিওনের বিচ্ছেদ আর মানতে পারছিল না। ইংল্যান্ডের গ্রিনউড গ্রামে সেরেনা ওর মায়ের সাথে থাকে, মা ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। লিওনকে ওর মাও অনেক পছন্দ করেন। মায়ের অনুমতি নিয়েই সেরেনার এখানে আসা।

লিওনের এই বিয়োগ আর যুদ্ধক্ষেত্রের শৃঙ্খলার কঠোরতায় এবার ধরা পড়ে গেল সেরেনা কমান্ডিং সার্জেন্টের হাতে। স্যামন থেকে সেরেনায় মুখোশ এবার উন্মোচিত হয়ে যায়। তাকে ফিরিয়ে আনা হয় আবার ইংল্যান্ডে। ইঊঋ সদর দপ্তরে একজন কর্নেল তাকে গুপ্তচর ভেবে গ্রেপ্তার করে। একটি ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে, কর্নেল সেরেনাকে জিজ্ঞেস করলেন। “তুমি কে?”

“আমি সেরেনা, একজন নারী, লিওনের ভালোবাসা।” এতো দৃঢ়তা, কণ্ঠে নিবেদিত একাগ্রতা আর নীল-সবুজ দুচোখ ভরা লিওনের ছবি- বিস্মিত করে তুলেছে এই পরিবেশকে।

কর্নেল সেরেনার চোখের দিকে তাকিয়ে, চুপচাপ বসে থাকলেন। যেনো সেই ক্ষণস্থায়ী নীরবতা বলছিল- “যুদ্ধ আর প্রেমে” সবকিছু সম্ভব। এরপর ২১ বছরের সেরেনাকে জিপে করে পৌঁছে দেন গ্রিনউড গ্রামে, ওর মায়ের কাছে।

সেরেনা, লিওনের স্মৃতি কিছুতেই মুছতে পারে না ওর হৃদয় থেকে। লিওনের সঙ্গে কাটানো তিনটি বছরের মুহূর্তগুলো তাকে পুরোনো স্মৃতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই লাইব্রেরি, বই, প্রথম দেখা, প্রথম প্রেম!

লিওনের সেই কথাগুলোও আজ নদীর জলে, পাহাড়ের উপত্যকায়, ওক গাছ, হর্নবিম, হলি, সিলভার বার্চের সব পাতায় সুর হয়ে কাঁদে। লিওন, সেরেনাকে বলেছিল “সেরেনা আমার পুরো জীবনটাই এখন তোমার। আমরা আমাদের ভালোবাসার একটি স্মৃতিঘর বানাবো, সেটা হবে অজ¯্র বই দিয়ে সাজানো একটি লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরি চিরকাল আমাদের প্রেমের কথা বলবে।”

লিওনের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে, সেরেনা গ্রিনউড গ্রামেই গড়ে তোলে ওর স্কলারশিপের জমানো অর্থে একটি ভিন্নরকম লাইব্রেরি। লাইব্রেরিটির প্রবেশদ্বার এক বিশাল জানালা দিয়ে তৈরি। সেই জানালার পাশেই অজ¯্র লাল বেরির ‘মাউন্টেন অ্যাশ’।

ওপারে দেখা যায় ছোট ছোট পাহাড়, সবুজ মাঠের বিশাল আকাশ। সবকিছু মিলিয়ে এখানে রঙ- লাল, সবুজ, নীল। এই লাইব্রেরির প্রতিটি বই, প্রতিটি শব্দ যেন জীবনের একেকটি জানালা- যুদ্ধ, প্রেম, একাত্মতার আর বিচ্ছিন্নতার চিত্রকল্প।

লাইব্রেরির কেন্দ্রে রয়েছে একটি কাঁচের টেবিল, যেখানে রাখা সেই বই, যা লিওন পড়ছিল, যেদিন তারা প্রথম দেখা করে। বইটি লিওন সেরেনাকে উপহার দিয়েছিল সেদিনই। মিষ্টি সুগন্ধভরা সেই বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো কখনো বন্ধ করেনি সেরেনা। কারণ সেরেনা চেয়েছিল, যেন লিওনের হাতের ছোঁয়া চিরকাল বেঁচে থাকবে বইটির পৃষ্ঠা জুড়ে। সেজন্য বইটি সেই পৃষ্ঠা নিয়েই খোলা রয়েছে।

লাইব্রেরির প্রতিটি কোনায়, প্রতিটি চেয়ারে লিওনের উপস্থিতি অনুভব করে সেরেনা। সেই গল্পের গভীরতা এখনো সেখানকার বাতাসে ভেসে বেড়ায়, প্রতিটি বইয়ের পাতায় লিওন আর সেরেনার মুগ্ধতা ছড়িয়ে। খোলা বইটির সামনেই রয়েছে লিওনের বিশাল একটি ছবি। এই ছবিটি এঁকেছে সেরেনা নিজেই। ছোটবেলায় রূপকথার গল্প বলে বলে সেরেনার চিত্রশিল্পী মা ওকে ছবি আঁকা শিখিয়েছিল।

সেরেনা লিওনের একটি অপূর্ব ছবি এঁকেছে, যা তার গভীর আবেগ ও ভালোবাসার প্রতিফলন। লিওনের মুখে “পীচ-গোলাপি” ছায়া ফুঁটে উঠেছে, তার ত্বকের কোমলতাকে প্রকাশ করে। চোখে “চকোলেট ব্রাউন” ও “মসৃণ কালো” রঙ ব্যবহার করে, সেরেনা, লিওনের চাহনিতে এক গভীরতা এনেছে, যেখানে “সিলভার” আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। লিওনের চুলের তরঙ্গগুলো “কাফে ব্রাউন” ও “গোল্ডেন ইয়েলো” রঙে সূর্যের আলোয় চকচক করছে। পোশাকের জন্য “ডিপ ব্লু” ও “সাইপিয়ান গ্রে” রঙ ব্যবহার করেছে, যা লিওনের ব্যক্তিত্বের শৈল্পিক দিককে ফুটিয়ে তুলছে। পটভূমিতে “অ্যাকোয়া ব্লু” ও “ফিরোজা সবুজ” ছায়া দিয়ে লিওনকে যেন আরও জীবন্ত করে তুলেছে, যেখানে লিওনের উপস্থিতি সারাজীবনের জন্য আটকে আছে সেরেনার তুলিতে।

অনেক দূর দূরান্ত থেকে আজও অনেকেই আসে শুধু এই লাইব্রেরিটি দেখতে, ইংল্যান্ডের ছোট গ্রিনউড গ্রামে। এই লাইব্রেরির প্রতিটি বই যেন লিওনের কণ্ঠস্বর- যুদ্ধের ছেঁড়া ক্যানভাসে আঁকা শূন্যতার শব্দ। গ্রিনউডের নীরব রাতে, বইয়ের পাতা উল্টানোর শব্দে গুনগুন করে ওঠে সেরেনা, লিওনের নক্ষত্র প্রেম। শিল্পের মতো লিওনের স্মৃতিতে গড়া লাইব্রেরিটির নাম দিয়েছিল সেরেনা “যুদ্ধের জানালায় দাঁড়িয়ে”। এক নির্মোহ বন্ধনে আবদ্ধ আজও সেরেনা, লিওন, বই আর বইয়ের এই লাইব্রেরি।

back to top