রুমা আক্তার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ-উত্তর ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে ব্যক্তির মানবীয় গুণাবলি, আবেগ-অনুভূতি ও মূল্যবোধগুলো যখন ধসে পড়েছে, চর্তুদিকে প্রতিয়মান হয়েছে ব্যক্তির সম্পর্কের বিপর্যয়, মানবতার সংকট, ঠিক সেই অস্থির ও হতাশা জর্জরিত সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন দুই মহাদেশের দুইজন কিংবদন্তি, অস্তিত্ববাদী লেখক, বাস্তববাদী ও কালজয়ী ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আলবেয়ার কামু। তাঁরা যুগযন্ত্রণাকে ধারণ করে শুধু যুগন্ধরই নন যুগোত্তীর্ণও হয়েছেন বটে। খসে পড়া সমাজ ব্যবস্থা, শাশ্বত চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন, অনুভূতিহীন সহজাত প্রবৃত্তি, আত্মিক বিনাশ, সমকালীন শিল্প-সাহিত্যকে প্রবল আলোড়িত ও প্রভাবিত করেছে। যাপিত জীবনের সূক্ষ্মতম অভিব্যক্তি ও তাঁদের উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে। সময়াবর্তে ঘটে যাওয়া নিপীড়িত মানবত্মার আর্তিগুলো বোধিসম্পন্ন ঔপন্যাসিকদ্বয় তাঁদের উপন্যাসে পারঙ্গমতার সাথে রূপায়ণ করেছেন। আত্মিক বিনাশকৃত ব্যক্তি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ছে। সবার সাথে বসবাস করেও মননে সে একাকীত্বতা ধারণ করছে। ফলশ্রুতিতে, নির্দিষ্ট কোন আদর্শে তারা স্থির থাকতে পারছে না। চিরাচরিত আদর্শ, সমাজ, সংস্কার, সংসার থেকে ছিটকে পড়া মানুষের মনোজাগতিক বিশ্লেষণ নিয়ে বিনির্মিত হয়েছে এ উপন্যাসদ্বয়। এ উপন্যাসদ্বয়ের তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ করে কালিক এগোব।
ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তি, বস্তুবাদী লেখক, মার্কসবাদী সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর একাগ্রতা, অধ্যবসায়, অন্তর্ভেদী অবলোকন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর রচিত উপন্যাস দিবারাত্রির কাব, পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি এবং গল্পসংকলন অতসীমামী, প্রাগৈতিহাসিক, ছোটবকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যাঙ্গনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তিনি ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব ও মার্কসীয় শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, মধ্যেবিত্ত শ্রেণির অর্ন্তদ্বন্দ্ব, দোলাচলবৃত্তিকে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর সাহিত্যগাঁথায়। প্রথম বিশ^যুদ্ধোত্তর ধ্বংসস্তূপে মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় নিয়ে তিনি সৃজন করেছেন দিবারাত্রির কাব্য উপন্যাসটি। উপন্যাসটি তিন পর্যায় বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম ভাগ: দিনের কবিতা, দ্বিতীয় ভাগ: রাতের কবিতা এবং তৃতীয় ভাগ: দিবারাত্রির কাব্য। তাঁর উপন্যাসে মানব জীবনের অবচেতন মনের নিগূঢ় রহস্য উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি অবক্ষয়িত জীবন ও সমাজের ক্লেদাক্ত রূপকে মূর্তায়ণ করেছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে।
বিশ শতকের বিরলপ্রজ লেখক, ফরাসি দার্শনিক, অস্তিত্ববাদী সাহিত্যিক ও নোবেল জয়ী ঔপন্যাসিক আলবেয়ার কামু। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে- দ্য আউটসাউডার, দি প্লেগ, দি মিথ অফ সিসিফাস, দি ফল এবং অ্যা হ্যাপি ডেথ। তাঁর সাহিত্যকর্মে যুগের সংশয়ী চেতনা, বিপর্যস্ত মানুষের দ্বৈতরূপ, মানুষের অস্তিত্বের সংকট, উদাসীন ও খেয়ালী মনের অযৌক্তিক ও অর্থহীন ক্রিয়াকর্ম পরিস্ফুটিত হয়েছে। জীবনকে তিনি এক ভিন্ন রকমের দ্যোতনা দিয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে।
তাঁর বহুল প্রচলিত এবং অধিক সমাদৃত উপন্যাস দ্য আউটসাইডার। এ উপন্যাসে তিনি প্রচলিত কাঠামো ভেঙ্গে নতুন কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন। যা কিছু ধ্রুব, চিরন্তন সত্য তা যেন অর্থহীন। তাইতো শে^তবর্ণের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মার্সোর জগতের কোন কিছুর ভিতরে কোন অর্থ খুঁজে পায় না, সমস্ত আবেগ, অনুভূতি এবং মূল্যবোধ তার কাছে অযৌক্তিক মনে হয়। একটা টেলিগ্রামের মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছেন যে, তার মা মারা গিয়েছে। অথচ তার মায়ের মৃত্যুতে তার কোনো আবেগ, অনুতাপ, অনুশোচনা অনুভব হচ্ছে না। তিনি মৃত্যুকে সাধারণ অনিবার্য কারণ হিসেবে অবলোকন করেছেন, নাকি তার আত্মিক মৃত্যু হয়েছে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। প্রথম বিশ^যুদ্ধে যে অগণিত মানুষ মারা গিয়েছে, সেই সামষ্টিক মৃত্যুর কাছে তার মায়ের মৃত্যুটা হয়তো তার কাছে নিছক মনে হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার মৃত মায়ের মুখটি পর্যন্ত তিনি দর্শন করেন নাই, এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেন নাই এমনকি সমাধি শেষে কবরের কাছে এক মুহূর্ত দাঁড়াননি। তার এ কঠোরতায় বিস্মিত হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমের সকলে : “মা আজ মারা গেছে। কিংবা, হয়তো গতকাল। আমি ঠিক বলতে পারছিনা। বৃদ্ধাবাস থেকে আসা টেলিগ্রামে বলা আছে, তোমার মা মারা গেছে। আগামীকাল সৎকার করা হবে। গভীর সহানুভূতি। এতে ব্যাপারটা সংশয় থেকে যায়।”
‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তামাটে বর্ণের মধ্যবিত্ত বাঙালি হেরম্ব। তিনি একজন বুদ্ধিজীবী এবং কলেজে অধ্যাপনা করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হেরম্ব চরিত্রের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাকে প্রতীকায়িত করেছেন পিঙ্গল সাহারা থেকে উঠে আসা কোনো এক আগন্তুক এর সাথে। যিনি সমাজ, সভ্যতার চিরাচরিত প্রথাকে তোয়াক্কা করেন না। এমনকি তার ভিতরে বনের সজীবতা এবং প্রাণচঞ্চলতা ও নেই। তার ভিতরে নেই কোন অনুশোচনাবোধ। তার বক্ষটা আবেগ-অনুভূতিহীন এক রিক্ত ও শূন্য মাঠ। সেই বক্ষে জীবনের কোনো আলো পৌঁছায়নি। তাইতো ঔপন্যাসিক বলেন-
“প্রাতে বন্ধু এসেছে পথিক
পিঙ্গল সাহারা হতে করিয়া চয়ন
শুষ্ক জীর্ণ তৃণ এক গাছি।
ক্ষত বুক তৃষ্ণার প্রতীক
রাতের কাজল-লোভী নয়ন
ওষ্ঠপুটে মৃত মৌমাছি
স্নিগ্ধ ছায়া ফেলে সে দাঁড়ায়
আমারে পোড়ায় তবু উত্তপ্ত নিশ^াস
গৃহাঙ্গনে মরীচিকা আনে।
বক্ষ রিক্ত তার মমতায়
এ জীবনে জীবনের এল না আভাস
বিবর্ণ বিশীর্ণ মরুতৃণে।”
দিবারাত্রির কাব্য উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হেরম্ব। হেরম্বর সাথে মিল রয়েছে দ্য আউটসাইডার উপন্যাসের মূল চরিত্র মার্সোর। দূরত্বের দিক থেকে দুজন দুই মহাদেশের হলেও মননগত দিক থেকে তারা দুজনই সহোদর এবং যুগযন্ত্রণার প্রতিভূ। দু’জনেরই মা মারা গিয়েছেন কিন্তু তাদের মধ্যে মাতৃশোকের বিন্দু মাত্র ছায়া নেই। খুব সহজ, সরল এবং সাবলীল ভাবে তারা তাদের মায়ের মৃত্যুকে বর্ণনা করেছেন। যেখানে পুরো পৃথিবীটাই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে , সেখানে মায়ের মৃত্যু তাদের কাছে অস্বাভাবিক বিষয় না। নিস্ব, রিক্ত, মেকী পৃথিবীতে জীবন অর্থহীন। তাইতো সুপ্রিয়ার কাছে হেরম্ব যখন তার মায়ের মৃত্যুর কথা প্রকাশ করেছে, তখন সুপ্রিয়া কাঁদলে ও কাঁদেনি হেরম্ব। নশ^র জীবনে কেউ চিরস্থায়ী নয়। এ অমোঘ সত্যকে যাপিত জীবনে বহন করেছেন হেরম্ব।
দ্য আউটসাইডার উপন্যাসে আলবেয়ার কামু মার্সোর চরিত্রের মাধ্যমে জীবনের বিভিন্ন মূল্যবোধের অসার্থকতার সুগভীর বেদনার স্ফুরণ করেছেন। তিনি রোম্যান্টিক ধারার নায়ক নন। রোম্যান্টিক আদর্শ তার কাছে শোকেজে সাজানো মেকি আসবাবপত্র। তিনি মনে করেন, ক্ষত-বিক্ষত আধুনিক জীবন ও যুগের চিত্র রোম্যান্টিক ভাবনা দিয়ে সম্ভব নয়। দিবারাত্রি কাব্য উপন্যাসের হেরম্ব যেনো মার্সোর প্রতিনিধিত্ব করছে। উভয় যুগযন্ত্রণার বিক্ষিপ্ত পথিক, রোমান্টিক বিষাদাচ্ছন্ন নায়ক। যে পথে নাই কোনো আশা, নাই কোনো স্বপ্ন, নাই কোনো ভালোবাসা। শুধু আছে রিক্ততা, শূন্যতা। তাইতো, সুপ্রিয়ার ভালোবাসার মর্যাদা হেরম্ব দিতে পারেনি। সুপ্রিয়া হেরম্বর এ হেন আচরণে প্রতিনিয়তই দগ্ধ হয়েছেন। হেরম্বের এ উদাসীনতা এবং বারংবার সুপ্রিয়াকে সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া সুপ্রিয়াকে আত্মিক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। যে মৃত্যু দৈহিক মৃত্যুর থেকেও ভয়াবহ।
মা, মাটি ও ভাষা ব্যক্তির অস্তিত্বের পরিচয়। মা ও মাটির সাথে মানুষের আত্মার সম্পর্ক। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু মাতৃত্ব ও পিতৃত্ব বোধের কোনো পার্থক্য থাকে না। এখানে এসে পৃথিবীর সকল পিতা-মাতা একীভূত হয়ে যান। যে পিতা-মাতা সন্তানের সুখের জন্য নিজের সমস্ত বিলাসিতাকে বির্সজন দেন, সেই সন্তান কীভাবে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে পারে? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায় সন্তান হিসেবে আমরা কতটা যোগ্য? যখন চারদিকে যুদ্ধের ভয়াবহতা, পরাশক্তিগুলোর ক্ষমতা লাভের দুর্বার আকাক্সক্ষা, মানবিকতার পরাজয় এবং যেখানে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হয়ে পড়ে, সেখানে ব্যক্তির সহজাত চিরন্তন অনুভূতিলো ফিকে হয়ে যায়। তেমনি হয়েছিলো মার্সোর জীবনে। তাইতো তিনি তার মাকে তার কর্মস্থলে না নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসে মানব মনের গভীরের কামনা বাসনাকে উন্মেচন করেছেন। কখনো কখনো অবচেতন মনের রহস্য প্রকাশ করার জন্যই চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে উদ্ভট ও বিকৃত। তাঁর এ মনোবিশ্লেষণমূলক ভঙ্গির জন্য চরিত্রগুলোর মধ্যে ইতিবাচক সত্তা থেকে নেতিবাচক সত্তা প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর মনোবিশ্লেষণ ভঙ্গি ব্যক্তি জীবনের চরম সত্যকে প্রতিকায়ীত করেছে। এজন্য হেরম্ব না সুপ্রিয়াকে নিয়ে ভালো থাকতে পেরেছে না আনন্দকে নিয়ে। বিচ্ছিন্নতাবোধ, অস্তিত্বের সংকট আত্মপীড়ন তাকে পিঙ্গল সাহারার পথিক করে তুলেছে। জীবনের এ অমোঘ সত্য থেকে হেরম্ব আত্মাকে বাঁচাতে পারে নাই।
মার্সোর তার মায়ের অন্ত্যেষ্টি পর, তার প্রেমিকা মেরিকে নিয়ে সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি এক আরবীয়কে খুন করেন। একজন মানুষকে মারার জন্য একটা গুলিই যথেষ্ট। কিন্তু তিনি চার চারটে গুলি করেছেন সেই আরবীয়কে। কারণ, তিনি একটা গুলি করার পর অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, তার শান্তির দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই রাগে ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে তিনি বাকি তিনটি গুলি করেছেন। এমনকি তাকে যখন আদালতে জিজ্ঞাস করা হলো আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তিনি কোন উকিল নিয়োগ করেছেন কিনা? তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, না। কারণ, এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার তিনি আরবীয়কে খুন করেছেন। সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উকিল নিয়োগ করা তার কাছে প্রহসন মনে হয়েছে। ঔপন্যাসিক এ ঘটনার মাধ্যমে আমাদের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
সুপ্রিয়ার মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার একদিকে রয়েছে তার স্বামী যার সাথে সে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ অন্যদিকে রয়েছে হেরম্ব। স্বামীর প্রতি কতব্যকে যেমন সে অস্বীকার করতে পারেনি, তেমনি হেরম্বর ভালোবাসাকেও। হেরম্বর ভালোবাসা এবং তার উদাসীনতা সুপ্রিয়াকে প্রতিনিয়তই দগ্ধ করেছে। তবু হেরম্বকে ঘিরে সুপ্রিয়া তার কল্পনার স্বপ্নজগত অটুট রেখেছে। সুপ্রিয়ার বিপরীতে যাকে দেখতে পেয়েছি, সে হচ্ছে অনাত এবং মালতীর অষ্টাদশী মেয়ে আনন্দ। পুরীতে বাবা-মায়ের সাথে আশ্রমে থাকেন। তার চলাফেরা মার্জিত এবং কোমল। এ আনন্দ হেরম্বের জীবনে ক্ষণস্থায়ী দীপ্তি। তাৎক্ষণিক সৌন্দর্য প্রতিমা। আনন্দ নৃত্যকলায় পারদর্শী। নৃত্যের ছন্দে ছন্দে তার আনন্দ। সে আনন্দ দেহের এবং মনের। হেরম্বর কাছে প্রেম হচ্ছে শুঁটকি মাছ আর মানুষের জিভ হলো আসলে ছোটোলোক। প্রেম সম্পর্কে হেরম্বর এ বক্তব্য আনন্দকে ব্যথিত করে তুলেছে। কারণ, আনন্দ বিশ^াস করে প্রেমের প্রদীপ চিরন্তন কাল নিষ্কম্প, অবিচল থেকে জীবনকে আলোকিত করে। বাবা-মায়ের সম্পর্কের জটিল সমীকরণ আনন্দকে কষ্ট দিয়েছে। তাইতো সে হেরম্বকে আশ্রয় করে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে। মৃত্যুকে আনন্দ ভয় পায়। কিন্তু তার জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে শিক্ষা দিয়েছে যে, জীবনে শান্তি বড়োই দুর্লভ বস্তু। তাইতো জীবনের সমীকরণ যখন সে মেলাতে পারেনি, তখন সে চন্দ্রকলা নৃত্য করে হেরম্বর সামনে আত্মহুতি দিয়েছে। হেরম্ব মনে করেছেন ভালোবাসা বেশি দিন হলে বাঁচে না। তাই ভালোবাসকে বাঁচিয়ে রাখতেই আনন্দ নিজেকে আত্মহুতি দিয়েছে।
দ্য আউটসাইডার উপন্যাসে মার্সোর তার মায়ের মৃত্যুর পরের রবিবার প্রেমিকাকে নিয়ে হাসির সিনেমা দেখেছেন। আবার সমুদ্র স্নানে গিয়েছেন এমনকি সমুদ্র যাপন ও করেছেন। তিনি যখন ফাঁসির সাজা প্রাপ্ত আসামী তখন জেলকক্ষে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ম্যারির কথা স্মরণ করেছেন। আবার পরক্ষণে মনে করেছেন, ম্যারি হয়তো মারা গিয়েছে। তাই মৃত ব্যক্তির স্মৃতি বুকে আগলে রেখে কী হবে? এমনকি তার মৃত্যুতেও কারো কিছু হবে না সবাই তাকে ভুলে যাবে। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছেন। কারণ, তিনি ভান করতে জানেন না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আলবেয়ার কামু দুজন ঔপন্যাসিকই তাঁদের উপন্যাসে জীবন সম্পর্কে একটা গভীর বোধের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন অনুরক্ত পাঠককে। যে বোধ ব্যক্তি তথা সমাজ ব্যবস্থার ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছে, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে প্রচলিত প্রথাকে।
রুমা আক্তার
বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ-উত্তর ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে ব্যক্তির মানবীয় গুণাবলি, আবেগ-অনুভূতি ও মূল্যবোধগুলো যখন ধসে পড়েছে, চর্তুদিকে প্রতিয়মান হয়েছে ব্যক্তির সম্পর্কের বিপর্যয়, মানবতার সংকট, ঠিক সেই অস্থির ও হতাশা জর্জরিত সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন দুই মহাদেশের দুইজন কিংবদন্তি, অস্তিত্ববাদী লেখক, বাস্তববাদী ও কালজয়ী ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আলবেয়ার কামু। তাঁরা যুগযন্ত্রণাকে ধারণ করে শুধু যুগন্ধরই নন যুগোত্তীর্ণও হয়েছেন বটে। খসে পড়া সমাজ ব্যবস্থা, শাশ্বত চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন, অনুভূতিহীন সহজাত প্রবৃত্তি, আত্মিক বিনাশ, সমকালীন শিল্প-সাহিত্যকে প্রবল আলোড়িত ও প্রভাবিত করেছে। যাপিত জীবনের সূক্ষ্মতম অভিব্যক্তি ও তাঁদের উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে। সময়াবর্তে ঘটে যাওয়া নিপীড়িত মানবত্মার আর্তিগুলো বোধিসম্পন্ন ঔপন্যাসিকদ্বয় তাঁদের উপন্যাসে পারঙ্গমতার সাথে রূপায়ণ করেছেন। আত্মিক বিনাশকৃত ব্যক্তি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ছে। সবার সাথে বসবাস করেও মননে সে একাকীত্বতা ধারণ করছে। ফলশ্রুতিতে, নির্দিষ্ট কোন আদর্শে তারা স্থির থাকতে পারছে না। চিরাচরিত আদর্শ, সমাজ, সংস্কার, সংসার থেকে ছিটকে পড়া মানুষের মনোজাগতিক বিশ্লেষণ নিয়ে বিনির্মিত হয়েছে এ উপন্যাসদ্বয়। এ উপন্যাসদ্বয়ের তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ করে কালিক এগোব।
ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তি, বস্তুবাদী লেখক, মার্কসবাদী সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর একাগ্রতা, অধ্যবসায়, অন্তর্ভেদী অবলোকন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর রচিত উপন্যাস দিবারাত্রির কাব, পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি এবং গল্পসংকলন অতসীমামী, প্রাগৈতিহাসিক, ছোটবকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যাঙ্গনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তিনি ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব ও মার্কসীয় শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, মধ্যেবিত্ত শ্রেণির অর্ন্তদ্বন্দ্ব, দোলাচলবৃত্তিকে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর সাহিত্যগাঁথায়। প্রথম বিশ^যুদ্ধোত্তর ধ্বংসস্তূপে মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় নিয়ে তিনি সৃজন করেছেন দিবারাত্রির কাব্য উপন্যাসটি। উপন্যাসটি তিন পর্যায় বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম ভাগ: দিনের কবিতা, দ্বিতীয় ভাগ: রাতের কবিতা এবং তৃতীয় ভাগ: দিবারাত্রির কাব্য। তাঁর উপন্যাসে মানব জীবনের অবচেতন মনের নিগূঢ় রহস্য উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি অবক্ষয়িত জীবন ও সমাজের ক্লেদাক্ত রূপকে মূর্তায়ণ করেছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে।
বিশ শতকের বিরলপ্রজ লেখক, ফরাসি দার্শনিক, অস্তিত্ববাদী সাহিত্যিক ও নোবেল জয়ী ঔপন্যাসিক আলবেয়ার কামু। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে- দ্য আউটসাউডার, দি প্লেগ, দি মিথ অফ সিসিফাস, দি ফল এবং অ্যা হ্যাপি ডেথ। তাঁর সাহিত্যকর্মে যুগের সংশয়ী চেতনা, বিপর্যস্ত মানুষের দ্বৈতরূপ, মানুষের অস্তিত্বের সংকট, উদাসীন ও খেয়ালী মনের অযৌক্তিক ও অর্থহীন ক্রিয়াকর্ম পরিস্ফুটিত হয়েছে। জীবনকে তিনি এক ভিন্ন রকমের দ্যোতনা দিয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে।
তাঁর বহুল প্রচলিত এবং অধিক সমাদৃত উপন্যাস দ্য আউটসাইডার। এ উপন্যাসে তিনি প্রচলিত কাঠামো ভেঙ্গে নতুন কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন। যা কিছু ধ্রুব, চিরন্তন সত্য তা যেন অর্থহীন। তাইতো শে^তবর্ণের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মার্সোর জগতের কোন কিছুর ভিতরে কোন অর্থ খুঁজে পায় না, সমস্ত আবেগ, অনুভূতি এবং মূল্যবোধ তার কাছে অযৌক্তিক মনে হয়। একটা টেলিগ্রামের মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছেন যে, তার মা মারা গিয়েছে। অথচ তার মায়ের মৃত্যুতে তার কোনো আবেগ, অনুতাপ, অনুশোচনা অনুভব হচ্ছে না। তিনি মৃত্যুকে সাধারণ অনিবার্য কারণ হিসেবে অবলোকন করেছেন, নাকি তার আত্মিক মৃত্যু হয়েছে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। প্রথম বিশ^যুদ্ধে যে অগণিত মানুষ মারা গিয়েছে, সেই সামষ্টিক মৃত্যুর কাছে তার মায়ের মৃত্যুটা হয়তো তার কাছে নিছক মনে হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার মৃত মায়ের মুখটি পর্যন্ত তিনি দর্শন করেন নাই, এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেন নাই এমনকি সমাধি শেষে কবরের কাছে এক মুহূর্ত দাঁড়াননি। তার এ কঠোরতায় বিস্মিত হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমের সকলে : “মা আজ মারা গেছে। কিংবা, হয়তো গতকাল। আমি ঠিক বলতে পারছিনা। বৃদ্ধাবাস থেকে আসা টেলিগ্রামে বলা আছে, তোমার মা মারা গেছে। আগামীকাল সৎকার করা হবে। গভীর সহানুভূতি। এতে ব্যাপারটা সংশয় থেকে যায়।”
‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তামাটে বর্ণের মধ্যবিত্ত বাঙালি হেরম্ব। তিনি একজন বুদ্ধিজীবী এবং কলেজে অধ্যাপনা করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হেরম্ব চরিত্রের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাকে প্রতীকায়িত করেছেন পিঙ্গল সাহারা থেকে উঠে আসা কোনো এক আগন্তুক এর সাথে। যিনি সমাজ, সভ্যতার চিরাচরিত প্রথাকে তোয়াক্কা করেন না। এমনকি তার ভিতরে বনের সজীবতা এবং প্রাণচঞ্চলতা ও নেই। তার ভিতরে নেই কোন অনুশোচনাবোধ। তার বক্ষটা আবেগ-অনুভূতিহীন এক রিক্ত ও শূন্য মাঠ। সেই বক্ষে জীবনের কোনো আলো পৌঁছায়নি। তাইতো ঔপন্যাসিক বলেন-
“প্রাতে বন্ধু এসেছে পথিক
পিঙ্গল সাহারা হতে করিয়া চয়ন
শুষ্ক জীর্ণ তৃণ এক গাছি।
ক্ষত বুক তৃষ্ণার প্রতীক
রাতের কাজল-লোভী নয়ন
ওষ্ঠপুটে মৃত মৌমাছি
স্নিগ্ধ ছায়া ফেলে সে দাঁড়ায়
আমারে পোড়ায় তবু উত্তপ্ত নিশ^াস
গৃহাঙ্গনে মরীচিকা আনে।
বক্ষ রিক্ত তার মমতায়
এ জীবনে জীবনের এল না আভাস
বিবর্ণ বিশীর্ণ মরুতৃণে।”
দিবারাত্রির কাব্য উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হেরম্ব। হেরম্বর সাথে মিল রয়েছে দ্য আউটসাইডার উপন্যাসের মূল চরিত্র মার্সোর। দূরত্বের দিক থেকে দুজন দুই মহাদেশের হলেও মননগত দিক থেকে তারা দুজনই সহোদর এবং যুগযন্ত্রণার প্রতিভূ। দু’জনেরই মা মারা গিয়েছেন কিন্তু তাদের মধ্যে মাতৃশোকের বিন্দু মাত্র ছায়া নেই। খুব সহজ, সরল এবং সাবলীল ভাবে তারা তাদের মায়ের মৃত্যুকে বর্ণনা করেছেন। যেখানে পুরো পৃথিবীটাই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে , সেখানে মায়ের মৃত্যু তাদের কাছে অস্বাভাবিক বিষয় না। নিস্ব, রিক্ত, মেকী পৃথিবীতে জীবন অর্থহীন। তাইতো সুপ্রিয়ার কাছে হেরম্ব যখন তার মায়ের মৃত্যুর কথা প্রকাশ করেছে, তখন সুপ্রিয়া কাঁদলে ও কাঁদেনি হেরম্ব। নশ^র জীবনে কেউ চিরস্থায়ী নয়। এ অমোঘ সত্যকে যাপিত জীবনে বহন করেছেন হেরম্ব।
দ্য আউটসাইডার উপন্যাসে আলবেয়ার কামু মার্সোর চরিত্রের মাধ্যমে জীবনের বিভিন্ন মূল্যবোধের অসার্থকতার সুগভীর বেদনার স্ফুরণ করেছেন। তিনি রোম্যান্টিক ধারার নায়ক নন। রোম্যান্টিক আদর্শ তার কাছে শোকেজে সাজানো মেকি আসবাবপত্র। তিনি মনে করেন, ক্ষত-বিক্ষত আধুনিক জীবন ও যুগের চিত্র রোম্যান্টিক ভাবনা দিয়ে সম্ভব নয়। দিবারাত্রি কাব্য উপন্যাসের হেরম্ব যেনো মার্সোর প্রতিনিধিত্ব করছে। উভয় যুগযন্ত্রণার বিক্ষিপ্ত পথিক, রোমান্টিক বিষাদাচ্ছন্ন নায়ক। যে পথে নাই কোনো আশা, নাই কোনো স্বপ্ন, নাই কোনো ভালোবাসা। শুধু আছে রিক্ততা, শূন্যতা। তাইতো, সুপ্রিয়ার ভালোবাসার মর্যাদা হেরম্ব দিতে পারেনি। সুপ্রিয়া হেরম্বর এ হেন আচরণে প্রতিনিয়তই দগ্ধ হয়েছেন। হেরম্বের এ উদাসীনতা এবং বারংবার সুপ্রিয়াকে সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া সুপ্রিয়াকে আত্মিক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। যে মৃত্যু দৈহিক মৃত্যুর থেকেও ভয়াবহ।
মা, মাটি ও ভাষা ব্যক্তির অস্তিত্বের পরিচয়। মা ও মাটির সাথে মানুষের আত্মার সম্পর্ক। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু মাতৃত্ব ও পিতৃত্ব বোধের কোনো পার্থক্য থাকে না। এখানে এসে পৃথিবীর সকল পিতা-মাতা একীভূত হয়ে যান। যে পিতা-মাতা সন্তানের সুখের জন্য নিজের সমস্ত বিলাসিতাকে বির্সজন দেন, সেই সন্তান কীভাবে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে পারে? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায় সন্তান হিসেবে আমরা কতটা যোগ্য? যখন চারদিকে যুদ্ধের ভয়াবহতা, পরাশক্তিগুলোর ক্ষমতা লাভের দুর্বার আকাক্সক্ষা, মানবিকতার পরাজয় এবং যেখানে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হয়ে পড়ে, সেখানে ব্যক্তির সহজাত চিরন্তন অনুভূতিলো ফিকে হয়ে যায়। তেমনি হয়েছিলো মার্সোর জীবনে। তাইতো তিনি তার মাকে তার কর্মস্থলে না নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসে মানব মনের গভীরের কামনা বাসনাকে উন্মেচন করেছেন। কখনো কখনো অবচেতন মনের রহস্য প্রকাশ করার জন্যই চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে উদ্ভট ও বিকৃত। তাঁর এ মনোবিশ্লেষণমূলক ভঙ্গির জন্য চরিত্রগুলোর মধ্যে ইতিবাচক সত্তা থেকে নেতিবাচক সত্তা প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর মনোবিশ্লেষণ ভঙ্গি ব্যক্তি জীবনের চরম সত্যকে প্রতিকায়ীত করেছে। এজন্য হেরম্ব না সুপ্রিয়াকে নিয়ে ভালো থাকতে পেরেছে না আনন্দকে নিয়ে। বিচ্ছিন্নতাবোধ, অস্তিত্বের সংকট আত্মপীড়ন তাকে পিঙ্গল সাহারার পথিক করে তুলেছে। জীবনের এ অমোঘ সত্য থেকে হেরম্ব আত্মাকে বাঁচাতে পারে নাই।
মার্সোর তার মায়ের অন্ত্যেষ্টি পর, তার প্রেমিকা মেরিকে নিয়ে সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি এক আরবীয়কে খুন করেন। একজন মানুষকে মারার জন্য একটা গুলিই যথেষ্ট। কিন্তু তিনি চার চারটে গুলি করেছেন সেই আরবীয়কে। কারণ, তিনি একটা গুলি করার পর অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, তার শান্তির দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই রাগে ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে তিনি বাকি তিনটি গুলি করেছেন। এমনকি তাকে যখন আদালতে জিজ্ঞাস করা হলো আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তিনি কোন উকিল নিয়োগ করেছেন কিনা? তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, না। কারণ, এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার তিনি আরবীয়কে খুন করেছেন। সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উকিল নিয়োগ করা তার কাছে প্রহসন মনে হয়েছে। ঔপন্যাসিক এ ঘটনার মাধ্যমে আমাদের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
সুপ্রিয়ার মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার একদিকে রয়েছে তার স্বামী যার সাথে সে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ অন্যদিকে রয়েছে হেরম্ব। স্বামীর প্রতি কতব্যকে যেমন সে অস্বীকার করতে পারেনি, তেমনি হেরম্বর ভালোবাসাকেও। হেরম্বর ভালোবাসা এবং তার উদাসীনতা সুপ্রিয়াকে প্রতিনিয়তই দগ্ধ করেছে। তবু হেরম্বকে ঘিরে সুপ্রিয়া তার কল্পনার স্বপ্নজগত অটুট রেখেছে। সুপ্রিয়ার বিপরীতে যাকে দেখতে পেয়েছি, সে হচ্ছে অনাত এবং মালতীর অষ্টাদশী মেয়ে আনন্দ। পুরীতে বাবা-মায়ের সাথে আশ্রমে থাকেন। তার চলাফেরা মার্জিত এবং কোমল। এ আনন্দ হেরম্বের জীবনে ক্ষণস্থায়ী দীপ্তি। তাৎক্ষণিক সৌন্দর্য প্রতিমা। আনন্দ নৃত্যকলায় পারদর্শী। নৃত্যের ছন্দে ছন্দে তার আনন্দ। সে আনন্দ দেহের এবং মনের। হেরম্বর কাছে প্রেম হচ্ছে শুঁটকি মাছ আর মানুষের জিভ হলো আসলে ছোটোলোক। প্রেম সম্পর্কে হেরম্বর এ বক্তব্য আনন্দকে ব্যথিত করে তুলেছে। কারণ, আনন্দ বিশ^াস করে প্রেমের প্রদীপ চিরন্তন কাল নিষ্কম্প, অবিচল থেকে জীবনকে আলোকিত করে। বাবা-মায়ের সম্পর্কের জটিল সমীকরণ আনন্দকে কষ্ট দিয়েছে। তাইতো সে হেরম্বকে আশ্রয় করে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে। মৃত্যুকে আনন্দ ভয় পায়। কিন্তু তার জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে শিক্ষা দিয়েছে যে, জীবনে শান্তি বড়োই দুর্লভ বস্তু। তাইতো জীবনের সমীকরণ যখন সে মেলাতে পারেনি, তখন সে চন্দ্রকলা নৃত্য করে হেরম্বর সামনে আত্মহুতি দিয়েছে। হেরম্ব মনে করেছেন ভালোবাসা বেশি দিন হলে বাঁচে না। তাই ভালোবাসকে বাঁচিয়ে রাখতেই আনন্দ নিজেকে আত্মহুতি দিয়েছে।
দ্য আউটসাইডার উপন্যাসে মার্সোর তার মায়ের মৃত্যুর পরের রবিবার প্রেমিকাকে নিয়ে হাসির সিনেমা দেখেছেন। আবার সমুদ্র স্নানে গিয়েছেন এমনকি সমুদ্র যাপন ও করেছেন। তিনি যখন ফাঁসির সাজা প্রাপ্ত আসামী তখন জেলকক্ষে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ম্যারির কথা স্মরণ করেছেন। আবার পরক্ষণে মনে করেছেন, ম্যারি হয়তো মারা গিয়েছে। তাই মৃত ব্যক্তির স্মৃতি বুকে আগলে রেখে কী হবে? এমনকি তার মৃত্যুতেও কারো কিছু হবে না সবাই তাকে ভুলে যাবে। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছেন। কারণ, তিনি ভান করতে জানেন না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আলবেয়ার কামু দুজন ঔপন্যাসিকই তাঁদের উপন্যাসে জীবন সম্পর্কে একটা গভীর বোধের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন অনুরক্ত পাঠককে। যে বোধ ব্যক্তি তথা সমাজ ব্যবস্থার ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছে, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে প্রচলিত প্রথাকে।