alt

সাময়িকী

মাথার ওপর ছাতা

তাহমিনা কোরাইশী

: বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

হ্যায় খালাম্মা কি হরমু! চাইর ধারে কাউয়া যেমনে কা কা করে; হেমতে হেরাও কা কা করে। পুরুষ মানুষগুলার কামকাইজ নাই খালি পিছে পিছে হাঁডে। আগবাড়াইয়্যা কথা কয়। হাজারটা মাছির লাহাইন ভ্যান ভ্যান কইরা ঘুরে।

বেগম সাহেব মালতি কুলসুমের কথার লাগাম টেনে ধরে। বলে- আরে থামো থামো কুলসুম। আর বলতে হবে না। আমি কেবল জানতে চাইছিলাম তুমি কি আবার বিয়ে করেছো? তা না হলে তোমার তিনটি মেয়েকে নিয়ে কীভাবে চলছো?

খালাম্মা গো সেই কিসসাই তো কইতাম লাগছিলাম। অল্প বয়সে বিধবা হইয়া নতুন কইরা মানুষ চিনলাম। মানে পুরুষ মানুষ। পিঠাপিঠি তিনটা মাইয়্যা। হেগুলারে নিয়া কি করমু! কই থাকুম! কি খামু! তাই বুদ্ধি কইরা দেশে মায়ের কাছে মাইয়্যা তিনটারে রাইখ্যা রহিমা বুজির লগে ঢাকা শহরে আইছি। তখন বেবাগতে বুদ্ধি পরামর্শ দিল। একটা বিয়া কইরা ফালাও। ভালা থাকবা। শহরে একলা মাইয়্যা মানুষ মুসিবতে পড়বা। যেমন তোমার রূপ বয়স দেইখ্যা হগল বেডারাই তো পাগল হইয়া যাইবো। হেগো কি দোষ?

শরমের কথা খালাম্মা। তবুও আমি রাজি হই না। ঠিকই দশজনের দশ কথা শুনুন লাগে। আমি তো রাজি না। তবু কই- পামু কই এমন একখান ভালা বেডা যার লগে সুখদুঃখ ভাগ কইরা চলতাম পারমু। নিজের মাইয়্যাগুলার বিয়ার বয়স হইয়া যাইতাছে। এখন আমার বিয়া? শরমের কথা না! বিপদে যে পড়ছি তা বুঝছি খালাম্মা। একদিন রহিমাবু আর আলতাফ ভাই এই মোকলেস নামের বেডারে আমার লগে পরিচয় করাইয়্যা কয়- তোমরা দুইজন উপযুক্ত মানুষ বুদ্ধি বিবেচনা আছে নিজেরা বুইঝ্যা পইরা লাও। আমি তো সাত আসমানের উপর থাইক্যা পড়লাম। কি কয়, চিনি না, জানি না! আমার হাউও ভাউও দেইখ্যা রহিমাবু কয়- তোর লাইগ্যা কি অল্প বয়সি পোলা খুঁইজ্যা দিমু? তুই পোলা-মাইয়্যার মা, হেও এক পোল এক মাইয়্যার বাপ। বয়স তোর থাইক্যা দশ বছরের বড় হইবো। এক্যাবারে বুড়াও না। কুলসুম হকচকিয়ে যায়। বলে- না, তা না। তার তো বউ পোলামাইয়্যা আছে। রহিমাবুর উত্তর রেডি ছিল। সাথেই সাথেই বললো- অসুস্থ একখান বউ আছে। বাইতে পইড়া থাকে। হেয় তো ঢাকা শহরে একলাই ম্যাসের ভাত খায়। পোলা মাইয়্যা দেশে। দুই তিন মাস পরে একবার যায়। তারাতো আর ঢাকায় আইবো না। চলবো কেমতে চারজন মানুষ এই শহরে! ঘর ভাড়া খাওন লওন। মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাইয়া দেয়। হেগো মা-ঝিয়ে পোলার চইল্যা যায় বাইতে।

কুলসুম মনে মনে ভাবে বিয়া না বইলে কিছু পয়সাপাতি জমাইতে পরতো। এই বেডা যদি কুলসুমের টাকাপয়সার ওপর লোভ দেখায়; তখন কুলসুমের আম আর ছালা সবই যাইবো। রহিমাবু কুলসুমের দোনামনা দেখে কিছু কথা পরিষ্কার করে দেয়। বলে- বেডারে দেওন লাগবো না। যার যার খরচ তার তার। রহিমাবুর ঠিক করে দেয়া সেই কথাটাই প্রযোজ্য হলো।

কাজের যোগান তো ভালাই আছিল। নিজের পয়সায় নিজে ভালাই চলতে পারতো কুলসুম। তিনডা মাইয়ার আর মায়ের লাইগ্যা টাকা পাঠাইতো আর ভালোই টাকা জমা থাকতো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- ঢাকা শহরে যে এমন আখাইতার পুত পথে পথে ঘুরে কি কমু খালাম্মা! বিয়া কইরা মাথার উপরে একটা ছাতি ধরছি। ঝড়তুফান থাইক্যা বাঁচার লাইগ্যা। তার কামাই আমার লাগে না। আমি হ্যার চে বেশি রোজগার করতাম। হঠাৎই যেন ঠাডা পড়লো সেই করোনার সমায় থাইক্যা। স্কুল, কলেজ, অফিস হগলধার দিয়া। সব যখন বন্ধ হইতে আরম্ভ করলো। দেশে মানুষ আচানক মরতে লাগলো শতে শতে। তখন থাইক্যা আমারও অভাব শুরু। বুকের মইধ্যে ভয় বাসা বাঁধলো। কি কমু খালাম্মা! সবে তার লগে বিয়া হইছে। বড় কাজটাও হারাইলাম। সেই সময় স্কুল কলেজের হোস্টেলের রান্নার কাজ করতাম। আমার খাওনের চিন্তা আছিল না। করোনার সময় আস্তে আস্তে স্কুল কলেজ অফিস সব বন্ধ হইতে শুরু করলো। জীবন আগে না কাজ! দুই বাসায় ছুটা নিলাম বেতন তেমন বেশি দিতে চায় না তারা। আজই আছি কাইল থাকমু কি না কে জানে!

আপদে বিপদে দুইজন দুজনারে দেখি। দেখলাম মানুষটা ভালাই। অসুখে বিসুখে খেয়াল করে। হের বাড়ির কোনো কথা আমারে কয় না। আমার কথাও জানতে চায় না। কিন্তু শরমে আমিও আমার বাইতে পোলা মাইয়্যারে জানাই না। মায়েরে কইছি মা একলা থাকন বড় বিপদ ঢাকা শহরে তাই এক বেডার লগে আছি। তায় কলেমা পইড়্যা কবুল কইরাই হেরে স্বামী মানছি। উপায় নাই মা। তুমি বুঝবা না এই শহরের লীলাখেলা। মায়ে কয়- লাগবো না টাহাপয়সা। মা তুই দেশে ফিরা আয়। একটা না একটা ব্যবস্থা হইবো।

- কি হইবো খালাম্মা আমি তো জানি। জমি নাই জিরাত নেই আছে একখান ঘর। সেই সম্বল। মাথাগুজার ঠাঁই।

মালতি বলে- তুমি তো ভীষণ সাহসী। যুদ্ধ শিখে গেছো। নিজেকে রক্ষার কৌশলো আয়ত্ব করেছো।

জ্বী খালাম্মা। মূর্খ মানুষ এতো কিছু বুঝি না। বুঝি নিজের পথ পরিস্কার রাখতে। রাত দিন গাধার মতো কাজ কইরা টেকাপয়সা ভালোই জমাইছি। এক সাথে দুই মাইয়্যার বিয়া দিছি গত বছর। ছোডো মাইয়্যাডা কয়- মা, আমি স্কুলে পড়মু।তাই হেইডারে পড়ামু। বিয়া এক সময় কোপালে থাকলে হইবো। ভালাই আছি খালাম্মা।

কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে কুলসুম বাড়ি গেছে। দুই মেয়েকে নাইয়র করাবে। সুবিধা মতো ছোটকেও বিয়ে দেবে। কিন্তু কুলসুম তো কথা দিয়ে কথা রাখে। এতো দেরি তো কখনো করে না। সেল ফোনটাও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। দিন যায় মাস যায় কুলসুমের খবর আসে না। অগত্যা ওর স্বামীর সাথে যোগাযোগ করতে বাধ্য হলো মালতি।

স্বামী মোকলেস জানালো সেও চিন্তিত। কী করবে বুঝতে পারছে না। কুলসুমের সাথে কথা না বলে ওর দেশেও তো যেতে পারছে না। ফোন বন্ধ। দেশে সেখানে মোকলেসকে কেউ চেনে না। কী বিপদে পড়েছে কুলসুম কে জানে!

মালতি মোকলেসকে সান্ত¡না দিয়ে বুঝিয়ে বলে- চিন্তা তো আমারও হচ্ছে কী অবস্থায় আছে কে জানে! প্রায় দু’মাস গড়িয়ে গেলো একটা খবর নেই। এমন তো কখনও হয়নি। আমার মনে হয় তুমি ওর দেশে চলে যাও। যাই ঘটুক তার সামনা সামনি হও।

মোকলেস আমতা আমতা করে বলে- আমারও তাই মনে হয়। হের মা তো জানে আমাগো সম্পর্কের কথা। মাইয়্যারা হেগো জামাইরা জানে না।

- আর ভেবে লাভ নেই। ভালো মন্দ যাই হোক নিজের চোখে দেখে আসো। আমিও শান্তি পাই। তুমিও নিশ্চিত হতে পারো।

মালতি ম্যাডামের কথা মাথায় রেখে মোকলেস কুলসুমের দেশের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা করে। যদিও ভয়ে মনটা দুরু দুরু করছে। তবুও দায়িত্ব কর্তব্য অবহেলা হবে না। মুখে বলে আল্লাহ ভরসা।

অবশেষে কুলসুমের বাড়ি খুঁজে বের করে মোকলেস। বাড়ি পৌঁছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে কতক্ষণ। আবহাওয়া বোঝার চেষ্টা করে। এরই মাঝে চোখাচোখি হয়ে যায় কুলসুমের মায়ের সাথে। বুড়ো মানুষ কী জানি কী ভেবেছে বা না বুঝেই চিৎকার জুড়ে দেয়। এ যে, এই তুমি কেডা? এই তুমি কেডা? কারে চাউ? কুলসুমরে?

ঘরের ভেতর থেকে কুলসুম বলে- কেডা মা? ঘরে আইতে দাও।

মোকলেস মুখ খুলে কিছুটা সাহস যোগাড় করে বলে- আমি মোকলেস। ঢাকা থেইক্যা আইছি।

কুলসুম কি ওর নামটা শুনতে পেয়েছে! মাথার ভেতরটায় সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। সামনে আরো কোনো বিপদের আশংকায় নিজেকে গুটিয়ে নেয়। হঠাৎ করেই চুপ হয়ে যায়। মোকলেস আর কারো অনুমতির অপেক্ষা করে না। সাহসী হয়ে ওঠে। সরাসরি ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। কী হয়েছে তার বউটার জানার অধিকার তার আছে।

- ড্যাব ড্যাব করে ভেজা ভেজা চোখে কুলসুমকে দেখে আর বলে- একটা খবর নেই। বাঁইচ্যা আছো না কি মইরা গেছো তা তো জানান লাগে? কথাগুলো বলতে বলতে একনজর ভালো করে দেখে নেয় কুলসুমের দেহ অবয়ব। সোনার অঙ্গ পুড়ে কালশিটা পড়ে গেছে। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ।

কী হইছে তোমার? মোকলেসের চোখে জল। কুলসুমের পাশে গিয়ে বসে। বলে- দুইডা মাস কোনো একটা খবর নাই। ফোনটাও কি হারায়্যা গেছে?

আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয় কুলসুমের মা। কাছে এসে ওদের পাশে বসে। তার চোখ গড়িয়ে জলের বন্যা নাকে মুখেও। বলতে থেকে কি যে সর্বনাশা এক দিনের ঘটনা। কুলসুম অনেক কষ্টে বিছানা থেকে উঠে বসে।

- পাড়ায় ইয়াসিন মাতব্বরেকে একজন খবর দিছে। কুলসুম শহরে দেহ ব্যাবসা করে পয়সা রোজগার করে। এক বেডার লাগে থাকে, সে মাগির দালাল।

মাথায় হাত দিয়ে সব বিবরণ শোনে মোকলেস। সালিসি দরবারি বসায় গ্রামে লোকজন লইয়্যা। এই গ্রামের এক লোক তারে দেখছে সেই আইস্যা খবর করছে। সালিসিতে তারে আদেশ দেয় এই বিচারের রায় যা হইছে সেই মতো কাজ করতে। কুলসুমের কথা কেউ শোনে না। সে কইছে সে বিয়া করছে।

- হ্যায়, বিয়া করছে! বিয়া করলে গ্রামের কেউ কেন জানে না? জামাই লইয়া একবার সবাইরে কেন দেখায়্যা যায় নাই? সবই ডাহা মিথ্যা কথা। ফোন কর তোর ভাতাররে। আইতে ক। মাতব্বর বলে কুলসুমরে।

কুলসুম আর কথা বলে না। মা মেয়ে চুপ করেই থাকে। সেই বেডারে ডাকলে তার আবার কোন বিপদ হয় সেই ভয়। কুলসুমের প্রতি কারো কোনো সহানুভূতি জাগা না। মাতব্বরের হুকুম অনুযায়ী ২০টা লাঠির বাড়ি দিয়ে তাকে হাতে পায়ে পঙ্গু করে ছেড়ে দেওয়া হোক। নির্দেশ মোতাবেক সেই লোকটা গুনে গুনে ২০টা বাড়ি দিয়ে তার হাত পা ভেঙে দেয়। ওরা ফোনটাও নিয়ে ভেঙে ফেলে। সবার সামনেই সিমটা পুড়িয়ে ফেলে। সমাজের মোড়লরা একজন নারীকে অসম্মানিত অপমানিত করলো। কলঙ্কিত করলো। তার মনের গভীরতা মাপার কেউ নেই। কুলসুমের দু’চোখের জল শুকিয়ে গেছে। তার কাছে সেই ছাতাটিও নেই। একজন নারী এই শাস্তি মাথা পেতে নিয়ে এসেছে ঘরে বন্দী জীবনে।

মোকলেস প্রচ- বেদনা বা আক্রোশে দ্বৈত সত্তার মাঝে। বলে- মুখ বুইজ্যা সব সহ্য করছো কেন কুলসুম? আমারে বা রহিমা বুজিরে একটা ফোন দিতা ঐ সালিশি থাইক্যা। ধর্ম মতে, আল্লাহ তায়ালারে সাক্ষী রাইখ্যা বিয়া করছি।

কুলসুম বলে- আচনক্যাই ঘটনা ঘইট্টা গেছে। বুদ্ধিতে কুলায় নাই। আর তোমার পরিবার জানে না। এই কথাটাও সত্য। তোমারে বিপদে ফালামু কেন? তাই সাহস করতে পারি নাই।

মোকলেস লজ্জিত দুঃখিত। কেনো অপমানের বোঝাটি একলা কুলসুমের কাঁধে? সে কি নারী বলেই! তাকে জানালেও কি সে সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারতো! ভাবনার বিষয় তো বটে।

অপরাধীর মতো হঠাৎই চুপ হয়ে যায় মোকলেস। আর ভাবে। তবে কি আমি অপরাধী?

নরী কি ধরিত্র! নারী কি সীতা! সব অপবাদ মাথায় নিয়ে মটিতে মিশে যাওয়াই তার ধর্ম!

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

ছবি

শিল্পচর্চায় তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি ইনোভেটিভ

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতা বৈভব ও বহুমাত্রিকতা

ছবি

উইলিয়াম রাদিচের অধ্যয়নে অনন্য রবীন্দ্রনাথ

দিলারা হাফিজের কবিতা

ছবি

অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি

ছবি

আহমদুল কবির স্মরণে

ছবি

আহমদুল কবিরের সদাশয়তা

tab

সাময়িকী

মাথার ওপর ছাতা

তাহমিনা কোরাইশী

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

হ্যায় খালাম্মা কি হরমু! চাইর ধারে কাউয়া যেমনে কা কা করে; হেমতে হেরাও কা কা করে। পুরুষ মানুষগুলার কামকাইজ নাই খালি পিছে পিছে হাঁডে। আগবাড়াইয়্যা কথা কয়। হাজারটা মাছির লাহাইন ভ্যান ভ্যান কইরা ঘুরে।

বেগম সাহেব মালতি কুলসুমের কথার লাগাম টেনে ধরে। বলে- আরে থামো থামো কুলসুম। আর বলতে হবে না। আমি কেবল জানতে চাইছিলাম তুমি কি আবার বিয়ে করেছো? তা না হলে তোমার তিনটি মেয়েকে নিয়ে কীভাবে চলছো?

খালাম্মা গো সেই কিসসাই তো কইতাম লাগছিলাম। অল্প বয়সে বিধবা হইয়া নতুন কইরা মানুষ চিনলাম। মানে পুরুষ মানুষ। পিঠাপিঠি তিনটা মাইয়্যা। হেগুলারে নিয়া কি করমু! কই থাকুম! কি খামু! তাই বুদ্ধি কইরা দেশে মায়ের কাছে মাইয়্যা তিনটারে রাইখ্যা রহিমা বুজির লগে ঢাকা শহরে আইছি। তখন বেবাগতে বুদ্ধি পরামর্শ দিল। একটা বিয়া কইরা ফালাও। ভালা থাকবা। শহরে একলা মাইয়্যা মানুষ মুসিবতে পড়বা। যেমন তোমার রূপ বয়স দেইখ্যা হগল বেডারাই তো পাগল হইয়া যাইবো। হেগো কি দোষ?

শরমের কথা খালাম্মা। তবুও আমি রাজি হই না। ঠিকই দশজনের দশ কথা শুনুন লাগে। আমি তো রাজি না। তবু কই- পামু কই এমন একখান ভালা বেডা যার লগে সুখদুঃখ ভাগ কইরা চলতাম পারমু। নিজের মাইয়্যাগুলার বিয়ার বয়স হইয়া যাইতাছে। এখন আমার বিয়া? শরমের কথা না! বিপদে যে পড়ছি তা বুঝছি খালাম্মা। একদিন রহিমাবু আর আলতাফ ভাই এই মোকলেস নামের বেডারে আমার লগে পরিচয় করাইয়্যা কয়- তোমরা দুইজন উপযুক্ত মানুষ বুদ্ধি বিবেচনা আছে নিজেরা বুইঝ্যা পইরা লাও। আমি তো সাত আসমানের উপর থাইক্যা পড়লাম। কি কয়, চিনি না, জানি না! আমার হাউও ভাউও দেইখ্যা রহিমাবু কয়- তোর লাইগ্যা কি অল্প বয়সি পোলা খুঁইজ্যা দিমু? তুই পোলা-মাইয়্যার মা, হেও এক পোল এক মাইয়্যার বাপ। বয়স তোর থাইক্যা দশ বছরের বড় হইবো। এক্যাবারে বুড়াও না। কুলসুম হকচকিয়ে যায়। বলে- না, তা না। তার তো বউ পোলামাইয়্যা আছে। রহিমাবুর উত্তর রেডি ছিল। সাথেই সাথেই বললো- অসুস্থ একখান বউ আছে। বাইতে পইড়া থাকে। হেয় তো ঢাকা শহরে একলাই ম্যাসের ভাত খায়। পোলা মাইয়্যা দেশে। দুই তিন মাস পরে একবার যায়। তারাতো আর ঢাকায় আইবো না। চলবো কেমতে চারজন মানুষ এই শহরে! ঘর ভাড়া খাওন লওন। মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাইয়া দেয়। হেগো মা-ঝিয়ে পোলার চইল্যা যায় বাইতে।

কুলসুম মনে মনে ভাবে বিয়া না বইলে কিছু পয়সাপাতি জমাইতে পরতো। এই বেডা যদি কুলসুমের টাকাপয়সার ওপর লোভ দেখায়; তখন কুলসুমের আম আর ছালা সবই যাইবো। রহিমাবু কুলসুমের দোনামনা দেখে কিছু কথা পরিষ্কার করে দেয়। বলে- বেডারে দেওন লাগবো না। যার যার খরচ তার তার। রহিমাবুর ঠিক করে দেয়া সেই কথাটাই প্রযোজ্য হলো।

কাজের যোগান তো ভালাই আছিল। নিজের পয়সায় নিজে ভালাই চলতে পারতো কুলসুম। তিনডা মাইয়ার আর মায়ের লাইগ্যা টাকা পাঠাইতো আর ভালোই টাকা জমা থাকতো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- ঢাকা শহরে যে এমন আখাইতার পুত পথে পথে ঘুরে কি কমু খালাম্মা! বিয়া কইরা মাথার উপরে একটা ছাতি ধরছি। ঝড়তুফান থাইক্যা বাঁচার লাইগ্যা। তার কামাই আমার লাগে না। আমি হ্যার চে বেশি রোজগার করতাম। হঠাৎই যেন ঠাডা পড়লো সেই করোনার সমায় থাইক্যা। স্কুল, কলেজ, অফিস হগলধার দিয়া। সব যখন বন্ধ হইতে আরম্ভ করলো। দেশে মানুষ আচানক মরতে লাগলো শতে শতে। তখন থাইক্যা আমারও অভাব শুরু। বুকের মইধ্যে ভয় বাসা বাঁধলো। কি কমু খালাম্মা! সবে তার লগে বিয়া হইছে। বড় কাজটাও হারাইলাম। সেই সময় স্কুল কলেজের হোস্টেলের রান্নার কাজ করতাম। আমার খাওনের চিন্তা আছিল না। করোনার সময় আস্তে আস্তে স্কুল কলেজ অফিস সব বন্ধ হইতে শুরু করলো। জীবন আগে না কাজ! দুই বাসায় ছুটা নিলাম বেতন তেমন বেশি দিতে চায় না তারা। আজই আছি কাইল থাকমু কি না কে জানে!

আপদে বিপদে দুইজন দুজনারে দেখি। দেখলাম মানুষটা ভালাই। অসুখে বিসুখে খেয়াল করে। হের বাড়ির কোনো কথা আমারে কয় না। আমার কথাও জানতে চায় না। কিন্তু শরমে আমিও আমার বাইতে পোলা মাইয়্যারে জানাই না। মায়েরে কইছি মা একলা থাকন বড় বিপদ ঢাকা শহরে তাই এক বেডার লগে আছি। তায় কলেমা পইড়্যা কবুল কইরাই হেরে স্বামী মানছি। উপায় নাই মা। তুমি বুঝবা না এই শহরের লীলাখেলা। মায়ে কয়- লাগবো না টাহাপয়সা। মা তুই দেশে ফিরা আয়। একটা না একটা ব্যবস্থা হইবো।

- কি হইবো খালাম্মা আমি তো জানি। জমি নাই জিরাত নেই আছে একখান ঘর। সেই সম্বল। মাথাগুজার ঠাঁই।

মালতি বলে- তুমি তো ভীষণ সাহসী। যুদ্ধ শিখে গেছো। নিজেকে রক্ষার কৌশলো আয়ত্ব করেছো।

জ্বী খালাম্মা। মূর্খ মানুষ এতো কিছু বুঝি না। বুঝি নিজের পথ পরিস্কার রাখতে। রাত দিন গাধার মতো কাজ কইরা টেকাপয়সা ভালোই জমাইছি। এক সাথে দুই মাইয়্যার বিয়া দিছি গত বছর। ছোডো মাইয়্যাডা কয়- মা, আমি স্কুলে পড়মু।তাই হেইডারে পড়ামু। বিয়া এক সময় কোপালে থাকলে হইবো। ভালাই আছি খালাম্মা।

কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে কুলসুম বাড়ি গেছে। দুই মেয়েকে নাইয়র করাবে। সুবিধা মতো ছোটকেও বিয়ে দেবে। কিন্তু কুলসুম তো কথা দিয়ে কথা রাখে। এতো দেরি তো কখনো করে না। সেল ফোনটাও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। দিন যায় মাস যায় কুলসুমের খবর আসে না। অগত্যা ওর স্বামীর সাথে যোগাযোগ করতে বাধ্য হলো মালতি।

স্বামী মোকলেস জানালো সেও চিন্তিত। কী করবে বুঝতে পারছে না। কুলসুমের সাথে কথা না বলে ওর দেশেও তো যেতে পারছে না। ফোন বন্ধ। দেশে সেখানে মোকলেসকে কেউ চেনে না। কী বিপদে পড়েছে কুলসুম কে জানে!

মালতি মোকলেসকে সান্ত¡না দিয়ে বুঝিয়ে বলে- চিন্তা তো আমারও হচ্ছে কী অবস্থায় আছে কে জানে! প্রায় দু’মাস গড়িয়ে গেলো একটা খবর নেই। এমন তো কখনও হয়নি। আমার মনে হয় তুমি ওর দেশে চলে যাও। যাই ঘটুক তার সামনা সামনি হও।

মোকলেস আমতা আমতা করে বলে- আমারও তাই মনে হয়। হের মা তো জানে আমাগো সম্পর্কের কথা। মাইয়্যারা হেগো জামাইরা জানে না।

- আর ভেবে লাভ নেই। ভালো মন্দ যাই হোক নিজের চোখে দেখে আসো। আমিও শান্তি পাই। তুমিও নিশ্চিত হতে পারো।

মালতি ম্যাডামের কথা মাথায় রেখে মোকলেস কুলসুমের দেশের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা করে। যদিও ভয়ে মনটা দুরু দুরু করছে। তবুও দায়িত্ব কর্তব্য অবহেলা হবে না। মুখে বলে আল্লাহ ভরসা।

অবশেষে কুলসুমের বাড়ি খুঁজে বের করে মোকলেস। বাড়ি পৌঁছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে কতক্ষণ। আবহাওয়া বোঝার চেষ্টা করে। এরই মাঝে চোখাচোখি হয়ে যায় কুলসুমের মায়ের সাথে। বুড়ো মানুষ কী জানি কী ভেবেছে বা না বুঝেই চিৎকার জুড়ে দেয়। এ যে, এই তুমি কেডা? এই তুমি কেডা? কারে চাউ? কুলসুমরে?

ঘরের ভেতর থেকে কুলসুম বলে- কেডা মা? ঘরে আইতে দাও।

মোকলেস মুখ খুলে কিছুটা সাহস যোগাড় করে বলে- আমি মোকলেস। ঢাকা থেইক্যা আইছি।

কুলসুম কি ওর নামটা শুনতে পেয়েছে! মাথার ভেতরটায় সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। সামনে আরো কোনো বিপদের আশংকায় নিজেকে গুটিয়ে নেয়। হঠাৎ করেই চুপ হয়ে যায়। মোকলেস আর কারো অনুমতির অপেক্ষা করে না। সাহসী হয়ে ওঠে। সরাসরি ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। কী হয়েছে তার বউটার জানার অধিকার তার আছে।

- ড্যাব ড্যাব করে ভেজা ভেজা চোখে কুলসুমকে দেখে আর বলে- একটা খবর নেই। বাঁইচ্যা আছো না কি মইরা গেছো তা তো জানান লাগে? কথাগুলো বলতে বলতে একনজর ভালো করে দেখে নেয় কুলসুমের দেহ অবয়ব। সোনার অঙ্গ পুড়ে কালশিটা পড়ে গেছে। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ।

কী হইছে তোমার? মোকলেসের চোখে জল। কুলসুমের পাশে গিয়ে বসে। বলে- দুইডা মাস কোনো একটা খবর নাই। ফোনটাও কি হারায়্যা গেছে?

আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয় কুলসুমের মা। কাছে এসে ওদের পাশে বসে। তার চোখ গড়িয়ে জলের বন্যা নাকে মুখেও। বলতে থেকে কি যে সর্বনাশা এক দিনের ঘটনা। কুলসুম অনেক কষ্টে বিছানা থেকে উঠে বসে।

- পাড়ায় ইয়াসিন মাতব্বরেকে একজন খবর দিছে। কুলসুম শহরে দেহ ব্যাবসা করে পয়সা রোজগার করে। এক বেডার লাগে থাকে, সে মাগির দালাল।

মাথায় হাত দিয়ে সব বিবরণ শোনে মোকলেস। সালিসি দরবারি বসায় গ্রামে লোকজন লইয়্যা। এই গ্রামের এক লোক তারে দেখছে সেই আইস্যা খবর করছে। সালিসিতে তারে আদেশ দেয় এই বিচারের রায় যা হইছে সেই মতো কাজ করতে। কুলসুমের কথা কেউ শোনে না। সে কইছে সে বিয়া করছে।

- হ্যায়, বিয়া করছে! বিয়া করলে গ্রামের কেউ কেন জানে না? জামাই লইয়া একবার সবাইরে কেন দেখায়্যা যায় নাই? সবই ডাহা মিথ্যা কথা। ফোন কর তোর ভাতাররে। আইতে ক। মাতব্বর বলে কুলসুমরে।

কুলসুম আর কথা বলে না। মা মেয়ে চুপ করেই থাকে। সেই বেডারে ডাকলে তার আবার কোন বিপদ হয় সেই ভয়। কুলসুমের প্রতি কারো কোনো সহানুভূতি জাগা না। মাতব্বরের হুকুম অনুযায়ী ২০টা লাঠির বাড়ি দিয়ে তাকে হাতে পায়ে পঙ্গু করে ছেড়ে দেওয়া হোক। নির্দেশ মোতাবেক সেই লোকটা গুনে গুনে ২০টা বাড়ি দিয়ে তার হাত পা ভেঙে দেয়। ওরা ফোনটাও নিয়ে ভেঙে ফেলে। সবার সামনেই সিমটা পুড়িয়ে ফেলে। সমাজের মোড়লরা একজন নারীকে অসম্মানিত অপমানিত করলো। কলঙ্কিত করলো। তার মনের গভীরতা মাপার কেউ নেই। কুলসুমের দু’চোখের জল শুকিয়ে গেছে। তার কাছে সেই ছাতাটিও নেই। একজন নারী এই শাস্তি মাথা পেতে নিয়ে এসেছে ঘরে বন্দী জীবনে।

মোকলেস প্রচ- বেদনা বা আক্রোশে দ্বৈত সত্তার মাঝে। বলে- মুখ বুইজ্যা সব সহ্য করছো কেন কুলসুম? আমারে বা রহিমা বুজিরে একটা ফোন দিতা ঐ সালিশি থাইক্যা। ধর্ম মতে, আল্লাহ তায়ালারে সাক্ষী রাইখ্যা বিয়া করছি।

কুলসুম বলে- আচনক্যাই ঘটনা ঘইট্টা গেছে। বুদ্ধিতে কুলায় নাই। আর তোমার পরিবার জানে না। এই কথাটাও সত্য। তোমারে বিপদে ফালামু কেন? তাই সাহস করতে পারি নাই।

মোকলেস লজ্জিত দুঃখিত। কেনো অপমানের বোঝাটি একলা কুলসুমের কাঁধে? সে কি নারী বলেই! তাকে জানালেও কি সে সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারতো! ভাবনার বিষয় তো বটে।

অপরাধীর মতো হঠাৎই চুপ হয়ে যায় মোকলেস। আর ভাবে। তবে কি আমি অপরাধী?

নরী কি ধরিত্র! নারী কি সীতা! সব অপবাদ মাথায় নিয়ে মটিতে মিশে যাওয়াই তার ধর্ম!

back to top