আবদুর রাজ্জাক
কবি শহীদ কাদরী তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থে সর্বসাকল্যে মাত্র ১৪২টি কবিতা লিখেছেন; তাঁর কিছু কবিতা হারিয়ে গেছে; এবং আরো কিছু অগ্রন্থিত কবিতা আছে- যা শিঘ্রই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে। কবিতাগুলো পত্রপত্রিকায়, বিশেষ করে কালি ও কলমে প্রকাশ হতে দেখেছি। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যাও মাত্র চার। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত মাত্র ১১ বছরের পরিধিতে তিনি তিনটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়েছেন। উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা (১৯৭৪), কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই (১৯৭৮), চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। প্রবল আত্মপ্রত্যয়ের কবি ছিলেন আমাদের শহীদ কাদরী।
ভীষণ আড্ডাপ্রিয় কবি শহীদ কাদরী বহুদিন কবিতা লেখা থেকে বিরত ছিলেন। মাতৃভূমি থেকে তিনি অনেক দূরে বসে অনুভব করেছিলেন যে তাঁর কবি সত্তার হনন হতে চলেছে। অবশেষ তিনি আবার কবিতা লেখা শুরু করেন। মানুষ হিসেবে তিনি খুব দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন। যৌবনের তিনটি কাব্যগ্রন্থ দিয়ে তিনি নিজেকে কবিতার রাজকুমার রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। কবিতার একটি স্বতন্ত্র কাব্যসত্তার স্বর তার অধিকারে ছিল। তার কবিবন্ধু কবি শামসুর রাহমান ঠিক দশ বছর আগে কবি জীবন থেকে মরজীবনে প্রস্থান করেন। বিউটি বোর্ডিং-এর আড্ডাটা শুরু হয়েছিল শহীদ কাদরীর চার বন্ধুকে ঘিরে। একজন শহীদ কাদরী, বাকি তিন বন্ধু বাচ্চু, তাহের এবং জাহাঙ্গীর। এঁদের মধ্যে একমাত্র নূরুল হক বাচ্চু একজন বড় ফিল্ম ডাইরেক্টর হয়েছিলেন, এবং অনেক ভালো সিনেমা তৈরি করেন। বাকি দুজন কালের স্রোতে ভেসে যায়।
সাহিত্যের, প্রথম দিকে আড্ডাটা শুরু হয় শহীদ কাদরীর বাসায়, তারপর বাড়ির কাছের মন্দির চত্বর। সেই সাথে বাংলাবাজারের গোবিন্দ রায়ের রেস্টুরেন্ট হয়ে বিউটি বোর্ডিং। সেই সময়ের আড্ডায় আসতেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন ও আরো অনেকে। তখন বিউটি বোর্ডিং ছিল সোনার বাংলা পত্রিকা অফিস। এই সোনার বাংলা পত্রিকাতেই শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ছাপা হয়। পরে পত্রিকা অফিসটিই বিউটি বোর্ডিং নামে একটি আবাসিক হোটেল করা হয়। বোর্ডিংয়ের নিচতলায় শুধুমাত্র বোর্ডাদের জন্য রেস্টুরেন্টও খোলা হয়।এইসব আড্ডাবাজ তরুণরা এখানে চা খেতে আসতেন। এককাপ চা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার কারণে বোর্ডিংপক্ষ তাদেরকে প্রায়ই চলে যেতে বলতেন। এদিক ওদিক ঘুরেফিরে আড্ডাবাজরা আবার ফিরে আসতেন বিউটি বোর্ডিং এর এই রেস্টুরেন্টে। এমনকি মালিক প্রহ্লাদ বাবুও একদিন খুব খারাপ ব্যবহার করেন। ঘটনাক্রমে এক বিশেষ ঘটনায় বিউটি বোর্ডিং-এ আড্ডা দেওয়াটা সহজ হয়ে যায়। হিন্দু মুসলমান মারামারির সময় একদল হিন্দু বিউটি বোর্ডিং এর দিকে তেড়ে এলে আড্ডাবাজ যুবকরা প্রহ্লাদ বাবুর পক্ষে দাঁড়িয়ে যান। এরপর থেকে নিয়মিত আড্ডা দিতে আর কোনো বাধা থাকে না।
একটি মজার ঘটনা হলো, সৈয়দ শামসুল হক থাকতেন লক্ষ্মীবাজারে, পড়তেন জগন্নাথ কলেজে। দেখা যেত তিনি চপ্পল পায়ে গলায় টাই ঝুলিয়ে কলেজে যেতেন। আড্ডাবাজ কবিরা বন্ধু কবি সৈয়দ শামসুল হকের উদ্দেশে সিটি বাজাতেন। তিনি ঘুরে দাঁড়াতেন, দেখতেন, কিন্তু কখনও কিছু বলতেন না। তবে সৈয়দ হক নিয়মিত কবিদের আড্ডায় আসতেন। কোনো এক আড্ডায় সৈয়দ হক কবি শামসুর রাহমানকে বললেন- আপনি শহীদ কাদরীর বাসায় যান, অথচ আমার বাসায় আসেন না। আমার বাসা তো কাছেই, লক্ষ্মীবাজারে। শহীদ কাদরীর বাসায় যেতেন, শামসুর রাহমান। শহীদ কাদরী এভাবেই বর্ণনা করেছেন। নিয়ম লঙ্ঘন করাই ছিল কাদরীর নিয়ম। তিনি প্রচুর সিগারেট খেতেন, মদ পানও করতেন। ১৯৫০ সালে কাদরীর বাবা মারা যান। ১৯৫২ সালে তারা ঢাকা চলে আসেন। কলকাতা ছেড়ে আসা ছাড়া তাঁদের হাতে আর কোনো অপশন থাকে না। কলকাতার ডানপিটে জীবনের অবসান ঘটিয়ে পার্ক সার্কাস ছেড়ে অবশেষে তাদেরকে ঢাকায় আসতে হয়েছিল। বাংলা তিনি জানতেন না, বাংলা ভাষা রপ্ত করতে তার বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়েনি। বাংলা ভাষার কবিতা ও ইউরোপের কবিতা তিনি একইভাবে পড়তেন। শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর তিনিই লিখেছিলেন, “আমি শামসুর রাহমানকে বাংলা ভাষার তিরিশের দশকের পাঁচজনের অব্যবহিত পরেই বড় কবি মনে করি। স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা নিউইয়র্ক রাজ্য থেকে তিনি কথাগুলো লিখেছিলেন। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। শামসুর রাহমান আর শহীদ কাদরীর বয়সের ব্যবধান ছিল মাত্র তেরো বছরের। শামসুর রাহমানের ভেতরে ছিল মিহি ভাবালুতা। আর শহীদ কাদরীর ভেতরটা ছিল ঋজু। কিন্তু বাড়তি শব্দ ব্যবহারে কাদরী ভয়ানক সতর্ক ও ভাবাবেগবর্জিত ছিলেন।
তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরেই তিনি বেছে নেন প্রবাস জীবন। তাঁর ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ কবিতা গ্রন্থটি তিনি তাঁর একমাত্র ছেলে আদনান কাদরীকে উৎসর্গ করেন। আদনান কাদরী অনেক আগে থেকেই আমেরিকায় থাকতেন। শুধু বিউটি বোর্ডিং-এ আল মাহমুদ আড্ডা দিতেন না। আড্ডা দিতেন অনেকেই। শহীদ কাদরী আল মাহমুদেরও বন্ধু ছিলেন। “এখনও কি তার সাথে আপনার যোগাযোগ আছে?” এক ইন্টারভিউয়ে তাঁকে এ প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, আল মাহমুদ সাম্প্রদায়িকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে গুলিয়ে ফেলেছে। আর ও তো প্রকাশ্যেই ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাথে মিশে গেছে। কিন্তু এটা তো আমার পক্ষে সমর্থন করা সম্ভব নয়। কিন্তু সে এখনও মনে করে সে খুব ভালো অবস্থানে আছে। শহীদ কাদরী বলেছেন, পৃথিবীর সব পাহাড় হিমালয় হবে না। ফরাসি কবি বোদলেয়ারের একটি মাত্র কাব্য গ্রন্থ ‘লে ফ্লর দ্যু মাল’। মোট কবিতার সংখ্যা মাত্র একশত আশিটি। খুব বড় কবি জাঁ আর্তুর র্যাবোঁর মাত্র দুটি বই। একজন লেখকের কোনো লেখারই পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। শহীদ কাদরীর জীবনের পাঁচ নম্বর কবিতাটি ‘এই শীতে ছাপা’ হয় বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায়। তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় ঢাকার স্পন্দন নামক একটি পত্রিকায়। “তোমার কবিতাটি মনোনীত হয়েছে” -বু. ব.। কবিতা পত্রিকায় কবিতাটি মনোনীত হওয়ার পর পোস্টকার্ডে বুদ্ধদেব বসু এই এক লাইন লিখেছিলেন তাঁকে। চার নম্বর কবিতা ‘গোধূলির গান’ ছাপা হয় ঢাকার পূর্বাশা পত্রিকায়। সেসময় ফজল শাহাবুদ্দীন খুব বিখ্যাত লেখক। তিনি হারুন এন্টারপ্রাইজের প্রেস অফিসে বসতেন ওয়ারীতে। আরো বিখ্যাতরা হলেন, শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, যিনি জুনিয়রদের সহ্য করতে পারতেন না। শহীদ কাদরীকে শামসুর রাহমান খুব পছন্দ করতেন। আর শহীদ কাদরী শামসুর রাহমানের বাসায়-ই যেতেন। পরের দিকে আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, কায়সুল হকও আসতেন। আমরা শামসুর রাহমান ছাড়া আর কাউকে রিকগনাইজড করতাম না। ফলে অন্যেরা আমাদেরকে হেট করতো। তখনকার অনুষ্ঠানগুলোতে আমাদেরকে ডাকা হতো না। আমরা যেতাম শামসুর রাহমানের কবিতা শোনার জন্য। শামসুর রাহমান শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্য গ্রন্থের উপর টেলিভিশনে এক ঘণ্টা আলোচনা করেছিলেন। রিভিউ করেছিলেন বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর। দৈনিক সংবাদে খুব ভালো রিভিউ করেছিলেন সন্তোষ কুমার গুপ্ত। ইউনিভারসিটির ক্লাসে ওই বই সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন মুনির চৌধুরী। রফিক আজাদ সে সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। কবিতাগুলি অনুবাদ করেছিলেন কবির চৌধুরী। সেই সময়েই বাংলা একাডেমির পত্রিকায় তাঁর অনুবাদ ছাপা হয়। সৈয়দ আলী আহসান তাঁর বই ‘আধুনিক কবিতা ও তার অনুসঙ্গ’ বইতে লিখেছিলেন শহীদ কাদরীর ওই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে। এই সময়েই ’৬৯-এর মুভমেন্ট শুরু হয়ে যায়। তারপর বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা আসে। তার ডাক পরা শুরু হয়ে যায়।
শহীদ কাদরীর মতে শামসুর রাহমানের টোটাল কাব্যকৃতি ত্রিশের সমমানের। “আর আল মাহমুদ কবি কিন্তু তার আছে মননের অভাব। মননের অভাবজনিত কারণে নেচারালি তাঁর কবিতা লিমিটেড। আর আমার কথা, আমি প্রস্তুতি নিয়েছিলাম বড় কবি হওয়ার। আমার মনন যে পরিমাণ বিস্তারিত সংহত এবং প্রতিষ্ঠিত, সেই পরিমাণ কবিতায় আনতে পারিনি।” শক্তি সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন হলো, “শক্তিকে আমি তত বড় কবি মনে করি না, তিনি মাঝেমধ্যে কিছু স্মরণীয় লিরিক লিখেছেন। বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য তাঁর কবিতায় নেই। এগুলো কবিতায় থাকতে হবে, তাও বলছি না। তাছাড়া শক্তির অনেক কবিতাই জীবনানন্দ দাশ দ্বারা আচ্ছন্ন। আমাদের সময়ের মেজর অনুভবপুঞ্জ শক্তির কাব্যে আসেনি। আমি তাকে মাইনর কবি বলে মনে করি। আল মাহমুদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাঙালি জাতির একটি প্রধান সময়ের দর্শক হয়েও তিনি সেই সময় কালের সাক্ষ্য রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। সময়কে ধারণ না করে উল্টোপথে যাত্রা করেছেন। বিউটি বোর্ডিং-এর আড্ডা কি এই আল মাহমুদকে চেয়েছিল?” প্রত্যেক ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকদের নামগুলো পাওয়া যায়। আমাদেরও আছে এবং থাকবে। “তোমার দেয়া কোমল লাল গোলাপ তীক্ষè হিম ছুরির মতো বিঁধলো যেন বুকে।” “শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো।” বাংলা সাহিত্য শহীদ কাদরীর কাব্য প্রতিভাকে স্মরণ করবে তাঁর কাব্য প্রতিভার কারণেই।
আবদুর রাজ্জাক
বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪
কবি শহীদ কাদরী তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থে সর্বসাকল্যে মাত্র ১৪২টি কবিতা লিখেছেন; তাঁর কিছু কবিতা হারিয়ে গেছে; এবং আরো কিছু অগ্রন্থিত কবিতা আছে- যা শিঘ্রই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে। কবিতাগুলো পত্রপত্রিকায়, বিশেষ করে কালি ও কলমে প্রকাশ হতে দেখেছি। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যাও মাত্র চার। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত মাত্র ১১ বছরের পরিধিতে তিনি তিনটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়েছেন। উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা (১৯৭৪), কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই (১৯৭৮), চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। প্রবল আত্মপ্রত্যয়ের কবি ছিলেন আমাদের শহীদ কাদরী।
ভীষণ আড্ডাপ্রিয় কবি শহীদ কাদরী বহুদিন কবিতা লেখা থেকে বিরত ছিলেন। মাতৃভূমি থেকে তিনি অনেক দূরে বসে অনুভব করেছিলেন যে তাঁর কবি সত্তার হনন হতে চলেছে। অবশেষ তিনি আবার কবিতা লেখা শুরু করেন। মানুষ হিসেবে তিনি খুব দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন। যৌবনের তিনটি কাব্যগ্রন্থ দিয়ে তিনি নিজেকে কবিতার রাজকুমার রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। কবিতার একটি স্বতন্ত্র কাব্যসত্তার স্বর তার অধিকারে ছিল। তার কবিবন্ধু কবি শামসুর রাহমান ঠিক দশ বছর আগে কবি জীবন থেকে মরজীবনে প্রস্থান করেন। বিউটি বোর্ডিং-এর আড্ডাটা শুরু হয়েছিল শহীদ কাদরীর চার বন্ধুকে ঘিরে। একজন শহীদ কাদরী, বাকি তিন বন্ধু বাচ্চু, তাহের এবং জাহাঙ্গীর। এঁদের মধ্যে একমাত্র নূরুল হক বাচ্চু একজন বড় ফিল্ম ডাইরেক্টর হয়েছিলেন, এবং অনেক ভালো সিনেমা তৈরি করেন। বাকি দুজন কালের স্রোতে ভেসে যায়।
সাহিত্যের, প্রথম দিকে আড্ডাটা শুরু হয় শহীদ কাদরীর বাসায়, তারপর বাড়ির কাছের মন্দির চত্বর। সেই সাথে বাংলাবাজারের গোবিন্দ রায়ের রেস্টুরেন্ট হয়ে বিউটি বোর্ডিং। সেই সময়ের আড্ডায় আসতেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন ও আরো অনেকে। তখন বিউটি বোর্ডিং ছিল সোনার বাংলা পত্রিকা অফিস। এই সোনার বাংলা পত্রিকাতেই শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ছাপা হয়। পরে পত্রিকা অফিসটিই বিউটি বোর্ডিং নামে একটি আবাসিক হোটেল করা হয়। বোর্ডিংয়ের নিচতলায় শুধুমাত্র বোর্ডাদের জন্য রেস্টুরেন্টও খোলা হয়।এইসব আড্ডাবাজ তরুণরা এখানে চা খেতে আসতেন। এককাপ চা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার কারণে বোর্ডিংপক্ষ তাদেরকে প্রায়ই চলে যেতে বলতেন। এদিক ওদিক ঘুরেফিরে আড্ডাবাজরা আবার ফিরে আসতেন বিউটি বোর্ডিং এর এই রেস্টুরেন্টে। এমনকি মালিক প্রহ্লাদ বাবুও একদিন খুব খারাপ ব্যবহার করেন। ঘটনাক্রমে এক বিশেষ ঘটনায় বিউটি বোর্ডিং-এ আড্ডা দেওয়াটা সহজ হয়ে যায়। হিন্দু মুসলমান মারামারির সময় একদল হিন্দু বিউটি বোর্ডিং এর দিকে তেড়ে এলে আড্ডাবাজ যুবকরা প্রহ্লাদ বাবুর পক্ষে দাঁড়িয়ে যান। এরপর থেকে নিয়মিত আড্ডা দিতে আর কোনো বাধা থাকে না।
একটি মজার ঘটনা হলো, সৈয়দ শামসুল হক থাকতেন লক্ষ্মীবাজারে, পড়তেন জগন্নাথ কলেজে। দেখা যেত তিনি চপ্পল পায়ে গলায় টাই ঝুলিয়ে কলেজে যেতেন। আড্ডাবাজ কবিরা বন্ধু কবি সৈয়দ শামসুল হকের উদ্দেশে সিটি বাজাতেন। তিনি ঘুরে দাঁড়াতেন, দেখতেন, কিন্তু কখনও কিছু বলতেন না। তবে সৈয়দ হক নিয়মিত কবিদের আড্ডায় আসতেন। কোনো এক আড্ডায় সৈয়দ হক কবি শামসুর রাহমানকে বললেন- আপনি শহীদ কাদরীর বাসায় যান, অথচ আমার বাসায় আসেন না। আমার বাসা তো কাছেই, লক্ষ্মীবাজারে। শহীদ কাদরীর বাসায় যেতেন, শামসুর রাহমান। শহীদ কাদরী এভাবেই বর্ণনা করেছেন। নিয়ম লঙ্ঘন করাই ছিল কাদরীর নিয়ম। তিনি প্রচুর সিগারেট খেতেন, মদ পানও করতেন। ১৯৫০ সালে কাদরীর বাবা মারা যান। ১৯৫২ সালে তারা ঢাকা চলে আসেন। কলকাতা ছেড়ে আসা ছাড়া তাঁদের হাতে আর কোনো অপশন থাকে না। কলকাতার ডানপিটে জীবনের অবসান ঘটিয়ে পার্ক সার্কাস ছেড়ে অবশেষে তাদেরকে ঢাকায় আসতে হয়েছিল। বাংলা তিনি জানতেন না, বাংলা ভাষা রপ্ত করতে তার বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়েনি। বাংলা ভাষার কবিতা ও ইউরোপের কবিতা তিনি একইভাবে পড়তেন। শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর তিনিই লিখেছিলেন, “আমি শামসুর রাহমানকে বাংলা ভাষার তিরিশের দশকের পাঁচজনের অব্যবহিত পরেই বড় কবি মনে করি। স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা নিউইয়র্ক রাজ্য থেকে তিনি কথাগুলো লিখেছিলেন। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। শামসুর রাহমান আর শহীদ কাদরীর বয়সের ব্যবধান ছিল মাত্র তেরো বছরের। শামসুর রাহমানের ভেতরে ছিল মিহি ভাবালুতা। আর শহীদ কাদরীর ভেতরটা ছিল ঋজু। কিন্তু বাড়তি শব্দ ব্যবহারে কাদরী ভয়ানক সতর্ক ও ভাবাবেগবর্জিত ছিলেন।
তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরেই তিনি বেছে নেন প্রবাস জীবন। তাঁর ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ কবিতা গ্রন্থটি তিনি তাঁর একমাত্র ছেলে আদনান কাদরীকে উৎসর্গ করেন। আদনান কাদরী অনেক আগে থেকেই আমেরিকায় থাকতেন। শুধু বিউটি বোর্ডিং-এ আল মাহমুদ আড্ডা দিতেন না। আড্ডা দিতেন অনেকেই। শহীদ কাদরী আল মাহমুদেরও বন্ধু ছিলেন। “এখনও কি তার সাথে আপনার যোগাযোগ আছে?” এক ইন্টারভিউয়ে তাঁকে এ প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, আল মাহমুদ সাম্প্রদায়িকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে গুলিয়ে ফেলেছে। আর ও তো প্রকাশ্যেই ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাথে মিশে গেছে। কিন্তু এটা তো আমার পক্ষে সমর্থন করা সম্ভব নয়। কিন্তু সে এখনও মনে করে সে খুব ভালো অবস্থানে আছে। শহীদ কাদরী বলেছেন, পৃথিবীর সব পাহাড় হিমালয় হবে না। ফরাসি কবি বোদলেয়ারের একটি মাত্র কাব্য গ্রন্থ ‘লে ফ্লর দ্যু মাল’। মোট কবিতার সংখ্যা মাত্র একশত আশিটি। খুব বড় কবি জাঁ আর্তুর র্যাবোঁর মাত্র দুটি বই। একজন লেখকের কোনো লেখারই পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। শহীদ কাদরীর জীবনের পাঁচ নম্বর কবিতাটি ‘এই শীতে ছাপা’ হয় বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায়। তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় ঢাকার স্পন্দন নামক একটি পত্রিকায়। “তোমার কবিতাটি মনোনীত হয়েছে” -বু. ব.। কবিতা পত্রিকায় কবিতাটি মনোনীত হওয়ার পর পোস্টকার্ডে বুদ্ধদেব বসু এই এক লাইন লিখেছিলেন তাঁকে। চার নম্বর কবিতা ‘গোধূলির গান’ ছাপা হয় ঢাকার পূর্বাশা পত্রিকায়। সেসময় ফজল শাহাবুদ্দীন খুব বিখ্যাত লেখক। তিনি হারুন এন্টারপ্রাইজের প্রেস অফিসে বসতেন ওয়ারীতে। আরো বিখ্যাতরা হলেন, শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, যিনি জুনিয়রদের সহ্য করতে পারতেন না। শহীদ কাদরীকে শামসুর রাহমান খুব পছন্দ করতেন। আর শহীদ কাদরী শামসুর রাহমানের বাসায়-ই যেতেন। পরের দিকে আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, কায়সুল হকও আসতেন। আমরা শামসুর রাহমান ছাড়া আর কাউকে রিকগনাইজড করতাম না। ফলে অন্যেরা আমাদেরকে হেট করতো। তখনকার অনুষ্ঠানগুলোতে আমাদেরকে ডাকা হতো না। আমরা যেতাম শামসুর রাহমানের কবিতা শোনার জন্য। শামসুর রাহমান শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্য গ্রন্থের উপর টেলিভিশনে এক ঘণ্টা আলোচনা করেছিলেন। রিভিউ করেছিলেন বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর। দৈনিক সংবাদে খুব ভালো রিভিউ করেছিলেন সন্তোষ কুমার গুপ্ত। ইউনিভারসিটির ক্লাসে ওই বই সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন মুনির চৌধুরী। রফিক আজাদ সে সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। কবিতাগুলি অনুবাদ করেছিলেন কবির চৌধুরী। সেই সময়েই বাংলা একাডেমির পত্রিকায় তাঁর অনুবাদ ছাপা হয়। সৈয়দ আলী আহসান তাঁর বই ‘আধুনিক কবিতা ও তার অনুসঙ্গ’ বইতে লিখেছিলেন শহীদ কাদরীর ওই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে। এই সময়েই ’৬৯-এর মুভমেন্ট শুরু হয়ে যায়। তারপর বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা আসে। তার ডাক পরা শুরু হয়ে যায়।
শহীদ কাদরীর মতে শামসুর রাহমানের টোটাল কাব্যকৃতি ত্রিশের সমমানের। “আর আল মাহমুদ কবি কিন্তু তার আছে মননের অভাব। মননের অভাবজনিত কারণে নেচারালি তাঁর কবিতা লিমিটেড। আর আমার কথা, আমি প্রস্তুতি নিয়েছিলাম বড় কবি হওয়ার। আমার মনন যে পরিমাণ বিস্তারিত সংহত এবং প্রতিষ্ঠিত, সেই পরিমাণ কবিতায় আনতে পারিনি।” শক্তি সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন হলো, “শক্তিকে আমি তত বড় কবি মনে করি না, তিনি মাঝেমধ্যে কিছু স্মরণীয় লিরিক লিখেছেন। বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য তাঁর কবিতায় নেই। এগুলো কবিতায় থাকতে হবে, তাও বলছি না। তাছাড়া শক্তির অনেক কবিতাই জীবনানন্দ দাশ দ্বারা আচ্ছন্ন। আমাদের সময়ের মেজর অনুভবপুঞ্জ শক্তির কাব্যে আসেনি। আমি তাকে মাইনর কবি বলে মনে করি। আল মাহমুদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাঙালি জাতির একটি প্রধান সময়ের দর্শক হয়েও তিনি সেই সময় কালের সাক্ষ্য রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। সময়কে ধারণ না করে উল্টোপথে যাত্রা করেছেন। বিউটি বোর্ডিং-এর আড্ডা কি এই আল মাহমুদকে চেয়েছিল?” প্রত্যেক ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকদের নামগুলো পাওয়া যায়। আমাদেরও আছে এবং থাকবে। “তোমার দেয়া কোমল লাল গোলাপ তীক্ষè হিম ছুরির মতো বিঁধলো যেন বুকে।” “শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো।” বাংলা সাহিত্য শহীদ কাদরীর কাব্য প্রতিভাকে স্মরণ করবে তাঁর কাব্য প্রতিভার কারণেই।