আবুল হাসনাত
মহীবুল আজিজ
এ-জীবনে বকোয়াজি দেখতে দেখতেই বড় হলাম। সে যে কী বকোয়াজি একেকজনের। মুখে ফেনা উঠে যায়। যখনই পড়তে বসে গল্পে মাতি, কানের কাছে বাজে বাবার কণ্ঠস্বরÑ কথা কম কাজ বেশি। বাবা যাতে শুনতে না পান এমনভাবে উল্টোরথে চড়তাম আমরা, কাজ কম কথা বেশি। শেষ পর্যন্ত জীবনটা একটা চাকরিতেই কেটে গেলÑ কথকতা, কথাই সেখানে মূল মন্ত্র ও অস্ত্র। কিন্তু বেশি কথা না বলেও যে অনেক বেশি কাজ করা যায় সেই দৃষ্টান্ত আমার চোখের সামনেই দেখেছিÑ আবুল হাসনাত ওরফে কবি মাহমুদ আল জামান। হ্যাঁ, এই সেদিনও চোখের সামনেই ছিলেন, এখনও রয়েছেন, শারীরিকভাবে না হলেও তাঁর রেখে যাওয়া কর্মের মধ্য দিয়ে, অনিবার্যভাবেই।
বাবার কথা উঠবার কারণ আছে। ১ নভেম্বর ছিল আমার পিতার ষোড়শ মৃত্যুবার্ষিকীর দিন। সকাল থেকেই খানিকটা বিষণœতা ঘিরে ধরেছিল। আমার মনে হয় যে বাবা এই সেদিনই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কানের কাছে এখনও বাজে বাবার জীবনের স্মৃতিচারণাÑ যেখানে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। অর্থনীতি এবং আইন দুটো বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া আমার বাবা যখন ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ পর্যন্ত একনাগাড়ে বলে থামতেন, আমরা, ভাইবোনেরা অবাক হয়ে ভাবতাম, বাবা কেবল বলেই গেলেন কিন্তু কিছু লিখে রেখে গেলেন না। লিখলেন শুধু মক্কেলদের মামলা-মোকদ্দমার বৃত্তান্ত আর আইনের তাবৎ ধারা-উপধারা। বাবা’র স্মৃতিযাপনের মাঝখানেই আচমকা মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছায় হাসনাত ভাইয়ের। ৭৫ বছর বয়সে তিনি চলে গেছেন না-ফেরার লোকে।
বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে তাঁর অবস্থানটি ছিল মজবুত এবং সে-অবস্থানটি তিনি অর্জন করেছিলেন তাঁর সুদীর্ঘকালীন কর্মাবদানের বিনিময়ে। খবরদারি, জবরদস্তি বা অহৈতুকি প-িতির ধার না ধেরে প্রায় নেপথ্যচারির মতন কর্মের সাধনার এক অনন্য নজির তিনি রেখে গেলেন আমাদের জন্যে। সামরিক স্বৈরাচারী পর্বের সেই অবরুদ্ধতার কালো কাল থেকে শুরু করে আজকের মুক্ত সামাজিক প্রেক্ষাপটÑ বহু ওঠানামা আর উজান-ভাটার সাক্ষী আবুল হাসনাত কখনও নিজেকে নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে আটকে রাখেন নি। বরং, সাহিত্যিক-সাংগঠনিক-সাংস্কৃতিক সেইসব কর্মকা-ে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন যেসব কাজের আবেদন বর্তমান ও ভবিষ্যের সংযোগযুক্ত, যেসব কাজের পরিণাম বিন্দু থেকে বৃত্তের। সংকটগ্রস্ত অবস্থায় নিজের অস্তিত্বের পরীক্ষা দিয়ে পথ পেরোবার প্রাথমিক পর্ব ডিঙ্গোনোর বিষয়টা হয়তো তাঁর জন্যে নিয়তিনির্ধার্রিতই ছিল।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অন্ধকার আরও জমাটবদ্ধ রূপ ধারণ করলো ১৯৬৪-র ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। পুরনো ঢাকার বাসিন্দা আবুল হাসনাত তখন কেবলই টিনইয়ার্সের শেষ সিঁড়িতে। ঐ বয়সেই দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটিতে একজন কর্মী এবং সংগঠকের ভূমিকায় নামতে হলো তাঁকে। আর সেসময়টাতে বাম রাজনীতির ধারক পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টির সভ্য হওয়া মানে জেনেশুনে বিস্ফোরক বয়ে নিয়ে চলা। ১৯৫৪ সালে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া কম্যুনিস্ট পার্টির সমর্থক আবুল হাসনাত তাই উজান-¯্রােতের যাত্রী হয়েই পথ চলবার দীক্ষা নেন অল্প বয়সে। যখন জীবনের একটা স্বপ্নীল আচ্ছন্ন খানিকটা ঘোরের মতন অবস্থার মুখোমুখি হয় মানুষ, আবুল হাসনাত তখন সমকালীন দৈশিক-জাতীয় সংকটগ্রস্ততার উত্তরণে চেতন। স্বপ্ন তাঁকে ঠিকই আচ্ছন্ন করে, তবে সেই স্বপ্ন তাঁর একার নয়, সমগ্র জাতিরÑ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের।
তারই ধারাবাহিকতায় তিনি হয়ে ওঠেন নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থায় স্থিরপ্রতিজ্ঞ। রাজধানী ঢাকায় রাজনৈতিক সাংগঠনিকতা এবং সাংস্কৃতিক তৎপরতার সমন্বয়ে তরুণদের সচেতন করে তোলা, এবং সচেতনতার মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করা, এগুলো তখনকার দিনগুলিতে ছিল দুরূহ কর্ম। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি বরাবরই অন্যান্য সংগঠনগুলোর রাজনীতির চাইতে খানিকটা ভিন্ন ধারার। এখানে কেবলই রাজনীতির শিক্ষা নয় পাশাপাশি জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গীকারের শক্ত ভিত্তিভূমি নির্মিত হয়। পৃথিবীর ইতিহাস, বস্তুবাদ, সমষ্টিবদ্ধ জীবনের জয়গানে উদ্দীপ্ত সাহিত্যের পাঠ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের যৌবরাজ্যে ঘটায় এক ধরনের বিপ্লব। বলা যায়, একটা নতুন সত্তা, একটা রূপান্তরিত সত্তা জন্ম নেয় তার মধ্যে। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরাও তাই জেনেছি। আমরা যখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র এবং ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক তখন তো বলতে গেলে পাকিস্তান আমলের সেই কম্যুনিস্ট-ঝুঁকির আবহটা আর নেই। গোর্কি, লু স্যুন, জ্যাক লন্ডন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়Ñ এসব লেখকের সাহিত্যপাঠ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নির্ধারিত কাজের অংশ ছিল। সেদিক থেকে আবুল হাসনাতের পরিস্থিতি ছিল অনেক বন্ধুর ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁদেরকে এগোতে হয়েছে ক্রমাগত বিপদ ঠেলে। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করে। পত্র-পত্রিকায় রবীন্দ্রচর্চার ওপরেও পড়ে শ্যেন দৃষ্টি। সেই বৈরী সময়টাতে আবুল হাসনাত শামিল হয়েছিলেন প্রতিবাদের মিছিলে। আনিসুজ্জামান, আবদুল হালিম এবং আরও অনেকের সঙ্গে মিলে তিনি বিবৃতি সংগ্রহের সাংগঠনিকতায় ব্যাপৃত হন। তারই পরিণতিতে পরবর্তীকালে ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় সচেতন রবীন্দ্রযাপন। দেশ ও জাতি তখন স্বাধীনতা-মুক্তির জন্যে উদ্বেল অপেক্ষায়। বাংলা একাডেমিতে ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক সংগঠন সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে আয়োজিত দু’দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসবে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল যথার্থই প্রতীকী। আবৃত্তি, সঙ্গীত এবং নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে রবীন্দ্র-উদযাপন অনেকটা শাসকের রক্তচক্ষুকে পাল্টা জবাব দেওয়ার মতো ব্যাপারই ছিল। তাছাড়া ড. আনিসুজ্জামানের মতো ব্যক্তিত্বকে আয়োজনে প্রধান অতিথি নির্বাচিত করাটাও ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, অনুষ্ঠান ঢাকা শহরে হলেও আনিসুজ্জামান তখন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে তিনি বৃত হন বিশেষ মর্যাদায়। বস্তুত এটি ছিল আবুল হাসনাত এবং তাঁর সমগোত্রীয় সচেতন তরুণদের সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফসল। ১৯৬৭ সালে শাসকগোষ্ঠির রবীন্দ্রবিরোধিতার পরিবেশেই প্রকাশিত হয়েছিল আনিসুজ্জামান সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটি। সেই গ্রন্থপ্রকাশেও সক্রিয় ছিল আবুল হাসনাতের সাংগঠনিক তৎপরতা। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধমুখী দেশের দুর্বার রাজনৈতিক ¯্রােতে এভাবেই গতির সঞ্চার অব্যাহত রাখেন জীবনবাদী সাংস্কৃতিক চেতনায় উজ্জীবিত সেই তরুণেরা। বিখ্যাত ছায়ানট-সাংগঠনিকতাতেও আবুল হাসনাতের সংশ্লিষ্টতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আবুল হাসনাতকে পাই ভিন্ন অপিচ তাঁর সেই ধ্রুপদী ঘরানার মানুষটিকেই। নিজের কাজটাকে নিজের কাছে অর্থপূর্ণ করবার সঙ্গে-সঙ্গে সেটিকে সমাজ-হিতৈষণায় রূপান্তরিত করবার এক দুর্লভ গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। মানুষ যাতে রুচিশীল, প্রগতিকামী এবং মানবিক গুণসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে সে-বিষয়ে সজাগ তাঁর দৃষ্টির প্রতিফলন আমরা লক্ষ করি তাঁর কর্মের মধ্যে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার ইতিহাসে ‘দৈনিক সংবাদ’-পত্রিকাটির কথা উল্লেখ করতে হবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই। আর, সেখানে আবুল হাসনাতের সহযোগ সত্যিকার অর্থে ছিল নিত্য গতিক্রিয়তা। আশি-নব্বইয়ের দশকের অন্তত কুড়িটি বছরের ‘দৈনিক সংবাদ’-পত্রিকা চোখের সামনে মেলে ধরলে বোঝা যাবে, একনাগাড়ে এত দীর্ঘ সময়ের একাগ্রতায় আদর্শ-সততা-রুচিঋদ্ধতাকে ধারণ করে রাখবার মতো কঠিন দায়িত্ব অন্য কোনো পত্রিকার পক্ষে পরিপালন করা সম্ভব হয়েছিল কিনা বলা মুশকিল। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যের পাতা কতটা আকর্ষণীয় ও সমৃদ্ধ হতে পারে তার অদ্বিতীয় নজির ‘দৈনিক সংবাদ’-এর ‘সাহিত্য সাময়িকী’। জানি না, কিসের জোরে বা কার পরিচালনায় চার পৃষ্ঠার সাহিত্য-পাতা প্রকাশ করবার মতো সাহস দেখিয়েছিল পত্রিকাটির তখনকার মালিকপক্ষ। আশি-নব্বইয়ের দশকে আমরা যারা লেখালেখি করেছি, আক্ষরিক অর্থেই বলতে হয়, প্রতি সপ্তাহে ‘সাহিত্য সাময়িকী’র ঐ চার পৃষ্ঠা পাঠ করতে না পারলে আমাদের পেটের অন্ন হজম হতো না। সাহিত্য-সাময়িকীর একেকটি চার-পৃষ্ঠা যেন একেকটি ছোট কাগজের উপস্থাপনা ছিল আমাদের কাছে। আমাদের মনে পড়তো বুদ্ধদেব বসুর কথা। ভাবতাম, বুদ্ধদেবের মতনই কেউ তাঁর মেধা-মনন দিয়ে এমন নিয়মিত প্রকাশনাকে সচল রেখে চলেছে। প্রবন্ধ-গল্প-কবিতা-গ্রন্থালোচনা-শিল্পালোচনা-অনুবাদ-সাক্ষাৎকার-কলামÑ মোটকথা অনতিপরিসরে যতটা সম্ভব তার সর্বোচ্চ দিয়ে ‘সাহিত্য সাময়িকী’ তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের চাহিদা পূরণে সচেষ্টতা দেখিয়ে গেছে। আমরা গর্বভরে লক্ষ করি, ‘সাহিত্য সাময়িকী’ আজও তার চার-পৃষ্ঠার ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে। এসব কথা বলবার অর্থ, যে-জায়মান তারুণ্য সমকালীন নানা প্রতিকূলতা-অস্থিরতা ডিঙ্গিয়ে একটি সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যতের অভিমুখে চলমান তার সামনে দৃষ্টান্তযোগ্য সৃজনশীলতার উপস্থাপনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্ববহ কাজ। দিনের পর দিন সেই কাজ করে গেছেন আবুল হাসনাত। একদিন দুই দিন বা এক-দুই বছর নয়, দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর। আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘দৈনিক সংবাদ’-এর ‘সাহিত্য সাময়িকী’-র সমগ্র গ্রন্থরূপ প্রকাশ করলে বোঝা যাবে, একজন ব্যক্তি দেশ ও জাতিকে কতটা মননসম্পদে ঋণী করে গেছেন। কয়েক বছর ইংল্যান্ডে বসবাস করবার সূত্রে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্য-সাময়িকীগুলো পাঠ করবার। সেখানকার ‘টাইমস্’-পত্রিকার সাপ্তাহিক আয়োজন ‘টিএলএস’-এর সঙ্গে তুলনা করতে পারি আমাদের ‘সাহিত্য সাময়িকী’র। আর, সেই গৌরব ও মর্যাদা প্রাপ্তি ঘটে আবুল হাসনাতেরই সুবাদে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের রচনায় সমৃদ্ধ থাকতো সাময়িকীর প্রতিটি সংখ্যা। আনিসুজ্জামান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হায়াৎ মামুদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রশীদ করীম, ইমদাদুল হক মিলন, সুশান্ত মজুমদার, ভাস্কর চৌধুরীÑ এরকম অসংখ্য নাম স্মরণ করা যায় যাঁরা অনবরত লিখে গেছেন সাময়িকীতে। সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি প্রায় নির্জনে থাকা কথাশিল্পী কায়েস আহমেদকে পেলাম নিয়মিত কলামে ‘সাহিত্য সাময়িকী’তে। ‘অন্য অবলোকন’ নামে একটি সাহিত্যিক কলাম বেশ কিছুদিন ধরে প্রকাশিত হয় সাময়িকীর সাপ্তাহিক আয়োজনে। মুক্তিযুদ্ধপূর্বকালে কামাল-বিন মাহতাব সম্পদিত ‘ছোটগল্প’-পত্রিকায় কায়েস আহমেদ যে-ঘরানায় নিজের সাহিত্য-কথকতাকে তুলে ধরতেন, ‘অন্য অবলোকনে’ আবার তাঁকে ফিরে পাওয়া গেল এবং সেই কৃতিত্ব আবুল হাসনাতের। সৈয়দ শামসুল হকের মতো ব্যস্ত লেখককে ভাগ্যিস তিনি সাময়িকীর পাতায় নিয়মিত লেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন যার ফলে আমরা পেলাম ‘হৃৎকলমের টানে’র মতো অসাধারণ সাহিত্যিক কলাম। পরবর্তীতে তিনি ‘কথা সামান্যই’ নামে রচনা করেন আরও একটি কলাম। সৈয়দ হক ‘বিচিত্রা’য় লিখতেন ‘মার্জিনে মন্তব্য’। বলাবাহুল্য, এই তিনটি কলাম সমন্বিত সৈয়দ হকের সাহিত্যিক সত্তা তাঁরই এক ভিন্ন মাত্রিকতা যেটির উদ্ভাবনীর নেপথ্যে ভূমিকা ছিল আবুল হাসনাতেরও।
‘গণসাহিত্য’ ‘সাহিত্য সামিয়িকী’ এবং ‘কালি ও কলম’ আবুল হাসনাতের সৃজন ও মননের ঋদ্ধ উৎসার। অনেক সময় আমাদের মনেই থাকে না, ইনিই আরেক সৃজন-অস্তিত্বের ধারক। মাহমুদ আল জামান নামে রচনা করেন কবিতা এবং শিশু-কিশোর সাহিত্য। জ্যোৎ¯œা ও দুর্বিপাক, কোন একদিন ভুবনডাঙায়, স্টিমার সিটি দিয়ে যায়, টুকু ও সমুদ্রের গল্প, যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুরে, রানুর দুঃখ-ভালোবাসা এবং আরও অনেক গ্রন্থ দিয়ে চেনা যায় তাঁর সুকুমার শিল্প-সাহিত্যের বোধসম্পন্ন ভাবজগতটিকে। লেখালেখির জন্যে অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২) বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১৩) ইত্যাদিও তাঁর অর্জিত হয় কিন্তু, নিজের সাহিত্যিক সত্তার প্রতি খানিকটা অবিচারই তিনি করেছিলেন অথবা, সেইটিই ছিল তাঁর ধাত। একদিন ‘আঠার বছর বয়স’-এর সমস্ত জীবনী শক্তি নিয়ে ঠাটারি বাজারের বাসিন্দা হাসনাত ছুটে গিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান এবং আরও অনেকের নিকটে। লক্ষ্য ছিল, বৈরিতা ও সংকীর্ণতার বিষবাষ্প থেকে মানুষকে উদ্ধার করা। পরবর্তীতে সেই এষণাই প্রকাশ পেয়েছে ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন রূপান্তরে। তবে, লক্ষ করতে হয়, আঠার/উনিশ বছর বয়সে তিনি তাঁর অভিভাবক হিসেবে যে-আনিসুজ্জামানকে পান জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই আনিসুজ্জামান থাকেন তাঁর সমান্তরালে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আবুল হাসনাতের মনন-পরিচর্যায় থাকে তাঁর শিক্ষক আনিসুজ্জামানের সহৃদয় পরিপোষকতা। তাঁর শেষ পর্বে ‘কালি ও কলম’-পত্রিকার প্রকাশনা-সম্পাদনায় গুরু-শিষ্যের যৌথতা প্রকৃত অর্থেই লাভ করে সুপরিণতি। পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যা ধারণ করে ‘গণসহিত্য’ ও ‘সাহিত্য সাময়িকী’ স্পৃষ্ট হাসনাতীয় ভাবনা-দর্শন। এর সাধারণ সংখ্যাই শুধু নয় বিশেষ সংখ্যাগুলোও বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে সঞ্চারিত করে নতুনতর চেতনার। এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে ‘কালি ও কলম’-এর শামসুর রাহমান, মাযহারুল ইসলাম, শহীদ কাদরী, মুর্তজা বশির এবং আনিসুজ্জামান স্মরণে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যাগুলোর কথা। যতদূর জেনেছি, মৃত্যুর পূর্বে তিনি ব্যস্ত ছিলেন পত্রিকাটির ‘বিদ্যাসাগর’-বিশেষ সংখ্যার প্রকাশনা নিয়ে।
বৈরি ¯্রােতে অভিযাত্রাই ছিল আবুল হাসনাতের জীবনেষণার মুখ্য শক্তি। বাংলাদেশ যখন সামরিক স্বৈরাচার কবলিত, যখন মৌলবাদের বিস্তার দূরপ্রসারী, এবং যখন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃতির শিকার তখন সেই করাল পরিবেশে আবুল হাসনাতের সৃজন-মননশীলতা উদ্যোগী হয়ে ওঠে উদ্ধারের অনুপম মন্ত্র নিয়ে। মিলান কুন্ডেরা যে বলেছিলেন, উপন্যাস হচ্ছে ইতিহাসের সমান্তরাল পথ, সেই কথাটাকে হয়তো তিনি পরিচালিত করেন অন্য বাঁকের দিকে। সৃজনশীল সাহিত্যের শক্তি দিয়ে তিনি মোকাবিলা করেন ইতিহাসের আপাত সংকটগ্রস্ততাকে। তাঁর সম্পদিত দু’টি গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধের গল্প এবং মুক্তিযুদ্ধের কবিতা উন্মোচন করলো এক নতুন অনুপ্রেরণার দিগন্ত। সেই সময়টাতে বঙ্গবন্ধু শব্দটিকে পরিণত করা হয়েছিল প্রায় ট্যাবুতে। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই পাশ কাটানোর বহুবিধ ক্রীড়া আমরা লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় প্রকাশিত গ্রন্থ দু’টি ইতিহাসের সমান্তরালে দাঁড় করিয়েই ক্ষান্ত হয় না বরং একথাটাই মনে করিয়ে দেয়, ইতিহাস যেখানে চলা থামিয়ে দেয় সেখানেও শুরু হতে পারে সাহিত্যের চলা- আমরা বরং সেটিকে বলতে পারি নতুন চলা। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সাহিত্যজগত মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার অপরিমিত সম্ভাবনার চর্চাক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু, দুষ্কালের কা-ারি হিসেবে অপরিমেয় সাহসের দৃষ্টান্তটি স্থাপন করেছিলেন আবুল হাসনাত।
আবুল হাসনাত
মহীবুল আজিজ
বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪
এ-জীবনে বকোয়াজি দেখতে দেখতেই বড় হলাম। সে যে কী বকোয়াজি একেকজনের। মুখে ফেনা উঠে যায়। যখনই পড়তে বসে গল্পে মাতি, কানের কাছে বাজে বাবার কণ্ঠস্বরÑ কথা কম কাজ বেশি। বাবা যাতে শুনতে না পান এমনভাবে উল্টোরথে চড়তাম আমরা, কাজ কম কথা বেশি। শেষ পর্যন্ত জীবনটা একটা চাকরিতেই কেটে গেলÑ কথকতা, কথাই সেখানে মূল মন্ত্র ও অস্ত্র। কিন্তু বেশি কথা না বলেও যে অনেক বেশি কাজ করা যায় সেই দৃষ্টান্ত আমার চোখের সামনেই দেখেছিÑ আবুল হাসনাত ওরফে কবি মাহমুদ আল জামান। হ্যাঁ, এই সেদিনও চোখের সামনেই ছিলেন, এখনও রয়েছেন, শারীরিকভাবে না হলেও তাঁর রেখে যাওয়া কর্মের মধ্য দিয়ে, অনিবার্যভাবেই।
বাবার কথা উঠবার কারণ আছে। ১ নভেম্বর ছিল আমার পিতার ষোড়শ মৃত্যুবার্ষিকীর দিন। সকাল থেকেই খানিকটা বিষণœতা ঘিরে ধরেছিল। আমার মনে হয় যে বাবা এই সেদিনই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কানের কাছে এখনও বাজে বাবার জীবনের স্মৃতিচারণাÑ যেখানে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। অর্থনীতি এবং আইন দুটো বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া আমার বাবা যখন ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ পর্যন্ত একনাগাড়ে বলে থামতেন, আমরা, ভাইবোনেরা অবাক হয়ে ভাবতাম, বাবা কেবল বলেই গেলেন কিন্তু কিছু লিখে রেখে গেলেন না। লিখলেন শুধু মক্কেলদের মামলা-মোকদ্দমার বৃত্তান্ত আর আইনের তাবৎ ধারা-উপধারা। বাবা’র স্মৃতিযাপনের মাঝখানেই আচমকা মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছায় হাসনাত ভাইয়ের। ৭৫ বছর বয়সে তিনি চলে গেছেন না-ফেরার লোকে।
বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে তাঁর অবস্থানটি ছিল মজবুত এবং সে-অবস্থানটি তিনি অর্জন করেছিলেন তাঁর সুদীর্ঘকালীন কর্মাবদানের বিনিময়ে। খবরদারি, জবরদস্তি বা অহৈতুকি প-িতির ধার না ধেরে প্রায় নেপথ্যচারির মতন কর্মের সাধনার এক অনন্য নজির তিনি রেখে গেলেন আমাদের জন্যে। সামরিক স্বৈরাচারী পর্বের সেই অবরুদ্ধতার কালো কাল থেকে শুরু করে আজকের মুক্ত সামাজিক প্রেক্ষাপটÑ বহু ওঠানামা আর উজান-ভাটার সাক্ষী আবুল হাসনাত কখনও নিজেকে নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে আটকে রাখেন নি। বরং, সাহিত্যিক-সাংগঠনিক-সাংস্কৃতিক সেইসব কর্মকা-ে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন যেসব কাজের আবেদন বর্তমান ও ভবিষ্যের সংযোগযুক্ত, যেসব কাজের পরিণাম বিন্দু থেকে বৃত্তের। সংকটগ্রস্ত অবস্থায় নিজের অস্তিত্বের পরীক্ষা দিয়ে পথ পেরোবার প্রাথমিক পর্ব ডিঙ্গোনোর বিষয়টা হয়তো তাঁর জন্যে নিয়তিনির্ধার্রিতই ছিল।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অন্ধকার আরও জমাটবদ্ধ রূপ ধারণ করলো ১৯৬৪-র ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। পুরনো ঢাকার বাসিন্দা আবুল হাসনাত তখন কেবলই টিনইয়ার্সের শেষ সিঁড়িতে। ঐ বয়সেই দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটিতে একজন কর্মী এবং সংগঠকের ভূমিকায় নামতে হলো তাঁকে। আর সেসময়টাতে বাম রাজনীতির ধারক পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টির সভ্য হওয়া মানে জেনেশুনে বিস্ফোরক বয়ে নিয়ে চলা। ১৯৫৪ সালে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া কম্যুনিস্ট পার্টির সমর্থক আবুল হাসনাত তাই উজান-¯্রােতের যাত্রী হয়েই পথ চলবার দীক্ষা নেন অল্প বয়সে। যখন জীবনের একটা স্বপ্নীল আচ্ছন্ন খানিকটা ঘোরের মতন অবস্থার মুখোমুখি হয় মানুষ, আবুল হাসনাত তখন সমকালীন দৈশিক-জাতীয় সংকটগ্রস্ততার উত্তরণে চেতন। স্বপ্ন তাঁকে ঠিকই আচ্ছন্ন করে, তবে সেই স্বপ্ন তাঁর একার নয়, সমগ্র জাতিরÑ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের।
তারই ধারাবাহিকতায় তিনি হয়ে ওঠেন নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থায় স্থিরপ্রতিজ্ঞ। রাজধানী ঢাকায় রাজনৈতিক সাংগঠনিকতা এবং সাংস্কৃতিক তৎপরতার সমন্বয়ে তরুণদের সচেতন করে তোলা, এবং সচেতনতার মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করা, এগুলো তখনকার দিনগুলিতে ছিল দুরূহ কর্ম। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি বরাবরই অন্যান্য সংগঠনগুলোর রাজনীতির চাইতে খানিকটা ভিন্ন ধারার। এখানে কেবলই রাজনীতির শিক্ষা নয় পাশাপাশি জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গীকারের শক্ত ভিত্তিভূমি নির্মিত হয়। পৃথিবীর ইতিহাস, বস্তুবাদ, সমষ্টিবদ্ধ জীবনের জয়গানে উদ্দীপ্ত সাহিত্যের পাঠ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের যৌবরাজ্যে ঘটায় এক ধরনের বিপ্লব। বলা যায়, একটা নতুন সত্তা, একটা রূপান্তরিত সত্তা জন্ম নেয় তার মধ্যে। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরাও তাই জেনেছি। আমরা যখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র এবং ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক তখন তো বলতে গেলে পাকিস্তান আমলের সেই কম্যুনিস্ট-ঝুঁকির আবহটা আর নেই। গোর্কি, লু স্যুন, জ্যাক লন্ডন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়Ñ এসব লেখকের সাহিত্যপাঠ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নির্ধারিত কাজের অংশ ছিল। সেদিক থেকে আবুল হাসনাতের পরিস্থিতি ছিল অনেক বন্ধুর ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁদেরকে এগোতে হয়েছে ক্রমাগত বিপদ ঠেলে। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করে। পত্র-পত্রিকায় রবীন্দ্রচর্চার ওপরেও পড়ে শ্যেন দৃষ্টি। সেই বৈরী সময়টাতে আবুল হাসনাত শামিল হয়েছিলেন প্রতিবাদের মিছিলে। আনিসুজ্জামান, আবদুল হালিম এবং আরও অনেকের সঙ্গে মিলে তিনি বিবৃতি সংগ্রহের সাংগঠনিকতায় ব্যাপৃত হন। তারই পরিণতিতে পরবর্তীকালে ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় সচেতন রবীন্দ্রযাপন। দেশ ও জাতি তখন স্বাধীনতা-মুক্তির জন্যে উদ্বেল অপেক্ষায়। বাংলা একাডেমিতে ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক সংগঠন সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে আয়োজিত দু’দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসবে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল যথার্থই প্রতীকী। আবৃত্তি, সঙ্গীত এবং নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে রবীন্দ্র-উদযাপন অনেকটা শাসকের রক্তচক্ষুকে পাল্টা জবাব দেওয়ার মতো ব্যাপারই ছিল। তাছাড়া ড. আনিসুজ্জামানের মতো ব্যক্তিত্বকে আয়োজনে প্রধান অতিথি নির্বাচিত করাটাও ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, অনুষ্ঠান ঢাকা শহরে হলেও আনিসুজ্জামান তখন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে তিনি বৃত হন বিশেষ মর্যাদায়। বস্তুত এটি ছিল আবুল হাসনাত এবং তাঁর সমগোত্রীয় সচেতন তরুণদের সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফসল। ১৯৬৭ সালে শাসকগোষ্ঠির রবীন্দ্রবিরোধিতার পরিবেশেই প্রকাশিত হয়েছিল আনিসুজ্জামান সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটি। সেই গ্রন্থপ্রকাশেও সক্রিয় ছিল আবুল হাসনাতের সাংগঠনিক তৎপরতা। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধমুখী দেশের দুর্বার রাজনৈতিক ¯্রােতে এভাবেই গতির সঞ্চার অব্যাহত রাখেন জীবনবাদী সাংস্কৃতিক চেতনায় উজ্জীবিত সেই তরুণেরা। বিখ্যাত ছায়ানট-সাংগঠনিকতাতেও আবুল হাসনাতের সংশ্লিষ্টতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আবুল হাসনাতকে পাই ভিন্ন অপিচ তাঁর সেই ধ্রুপদী ঘরানার মানুষটিকেই। নিজের কাজটাকে নিজের কাছে অর্থপূর্ণ করবার সঙ্গে-সঙ্গে সেটিকে সমাজ-হিতৈষণায় রূপান্তরিত করবার এক দুর্লভ গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। মানুষ যাতে রুচিশীল, প্রগতিকামী এবং মানবিক গুণসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে সে-বিষয়ে সজাগ তাঁর দৃষ্টির প্রতিফলন আমরা লক্ষ করি তাঁর কর্মের মধ্যে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার ইতিহাসে ‘দৈনিক সংবাদ’-পত্রিকাটির কথা উল্লেখ করতে হবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই। আর, সেখানে আবুল হাসনাতের সহযোগ সত্যিকার অর্থে ছিল নিত্য গতিক্রিয়তা। আশি-নব্বইয়ের দশকের অন্তত কুড়িটি বছরের ‘দৈনিক সংবাদ’-পত্রিকা চোখের সামনে মেলে ধরলে বোঝা যাবে, একনাগাড়ে এত দীর্ঘ সময়ের একাগ্রতায় আদর্শ-সততা-রুচিঋদ্ধতাকে ধারণ করে রাখবার মতো কঠিন দায়িত্ব অন্য কোনো পত্রিকার পক্ষে পরিপালন করা সম্ভব হয়েছিল কিনা বলা মুশকিল। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যের পাতা কতটা আকর্ষণীয় ও সমৃদ্ধ হতে পারে তার অদ্বিতীয় নজির ‘দৈনিক সংবাদ’-এর ‘সাহিত্য সাময়িকী’। জানি না, কিসের জোরে বা কার পরিচালনায় চার পৃষ্ঠার সাহিত্য-পাতা প্রকাশ করবার মতো সাহস দেখিয়েছিল পত্রিকাটির তখনকার মালিকপক্ষ। আশি-নব্বইয়ের দশকে আমরা যারা লেখালেখি করেছি, আক্ষরিক অর্থেই বলতে হয়, প্রতি সপ্তাহে ‘সাহিত্য সাময়িকী’র ঐ চার পৃষ্ঠা পাঠ করতে না পারলে আমাদের পেটের অন্ন হজম হতো না। সাহিত্য-সাময়িকীর একেকটি চার-পৃষ্ঠা যেন একেকটি ছোট কাগজের উপস্থাপনা ছিল আমাদের কাছে। আমাদের মনে পড়তো বুদ্ধদেব বসুর কথা। ভাবতাম, বুদ্ধদেবের মতনই কেউ তাঁর মেধা-মনন দিয়ে এমন নিয়মিত প্রকাশনাকে সচল রেখে চলেছে। প্রবন্ধ-গল্প-কবিতা-গ্রন্থালোচনা-শিল্পালোচনা-অনুবাদ-সাক্ষাৎকার-কলামÑ মোটকথা অনতিপরিসরে যতটা সম্ভব তার সর্বোচ্চ দিয়ে ‘সাহিত্য সাময়িকী’ তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের চাহিদা পূরণে সচেষ্টতা দেখিয়ে গেছে। আমরা গর্বভরে লক্ষ করি, ‘সাহিত্য সাময়িকী’ আজও তার চার-পৃষ্ঠার ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে। এসব কথা বলবার অর্থ, যে-জায়মান তারুণ্য সমকালীন নানা প্রতিকূলতা-অস্থিরতা ডিঙ্গিয়ে একটি সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যতের অভিমুখে চলমান তার সামনে দৃষ্টান্তযোগ্য সৃজনশীলতার উপস্থাপনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্ববহ কাজ। দিনের পর দিন সেই কাজ করে গেছেন আবুল হাসনাত। একদিন দুই দিন বা এক-দুই বছর নয়, দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর। আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘দৈনিক সংবাদ’-এর ‘সাহিত্য সাময়িকী’-র সমগ্র গ্রন্থরূপ প্রকাশ করলে বোঝা যাবে, একজন ব্যক্তি দেশ ও জাতিকে কতটা মননসম্পদে ঋণী করে গেছেন। কয়েক বছর ইংল্যান্ডে বসবাস করবার সূত্রে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্য-সাময়িকীগুলো পাঠ করবার। সেখানকার ‘টাইমস্’-পত্রিকার সাপ্তাহিক আয়োজন ‘টিএলএস’-এর সঙ্গে তুলনা করতে পারি আমাদের ‘সাহিত্য সাময়িকী’র। আর, সেই গৌরব ও মর্যাদা প্রাপ্তি ঘটে আবুল হাসনাতেরই সুবাদে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের রচনায় সমৃদ্ধ থাকতো সাময়িকীর প্রতিটি সংখ্যা। আনিসুজ্জামান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হায়াৎ মামুদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রশীদ করীম, ইমদাদুল হক মিলন, সুশান্ত মজুমদার, ভাস্কর চৌধুরীÑ এরকম অসংখ্য নাম স্মরণ করা যায় যাঁরা অনবরত লিখে গেছেন সাময়িকীতে। সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি প্রায় নির্জনে থাকা কথাশিল্পী কায়েস আহমেদকে পেলাম নিয়মিত কলামে ‘সাহিত্য সাময়িকী’তে। ‘অন্য অবলোকন’ নামে একটি সাহিত্যিক কলাম বেশ কিছুদিন ধরে প্রকাশিত হয় সাময়িকীর সাপ্তাহিক আয়োজনে। মুক্তিযুদ্ধপূর্বকালে কামাল-বিন মাহতাব সম্পদিত ‘ছোটগল্প’-পত্রিকায় কায়েস আহমেদ যে-ঘরানায় নিজের সাহিত্য-কথকতাকে তুলে ধরতেন, ‘অন্য অবলোকনে’ আবার তাঁকে ফিরে পাওয়া গেল এবং সেই কৃতিত্ব আবুল হাসনাতের। সৈয়দ শামসুল হকের মতো ব্যস্ত লেখককে ভাগ্যিস তিনি সাময়িকীর পাতায় নিয়মিত লেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন যার ফলে আমরা পেলাম ‘হৃৎকলমের টানে’র মতো অসাধারণ সাহিত্যিক কলাম। পরবর্তীতে তিনি ‘কথা সামান্যই’ নামে রচনা করেন আরও একটি কলাম। সৈয়দ হক ‘বিচিত্রা’য় লিখতেন ‘মার্জিনে মন্তব্য’। বলাবাহুল্য, এই তিনটি কলাম সমন্বিত সৈয়দ হকের সাহিত্যিক সত্তা তাঁরই এক ভিন্ন মাত্রিকতা যেটির উদ্ভাবনীর নেপথ্যে ভূমিকা ছিল আবুল হাসনাতেরও।
‘গণসাহিত্য’ ‘সাহিত্য সামিয়িকী’ এবং ‘কালি ও কলম’ আবুল হাসনাতের সৃজন ও মননের ঋদ্ধ উৎসার। অনেক সময় আমাদের মনেই থাকে না, ইনিই আরেক সৃজন-অস্তিত্বের ধারক। মাহমুদ আল জামান নামে রচনা করেন কবিতা এবং শিশু-কিশোর সাহিত্য। জ্যোৎ¯œা ও দুর্বিপাক, কোন একদিন ভুবনডাঙায়, স্টিমার সিটি দিয়ে যায়, টুকু ও সমুদ্রের গল্প, যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুরে, রানুর দুঃখ-ভালোবাসা এবং আরও অনেক গ্রন্থ দিয়ে চেনা যায় তাঁর সুকুমার শিল্প-সাহিত্যের বোধসম্পন্ন ভাবজগতটিকে। লেখালেখির জন্যে অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২) বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১৩) ইত্যাদিও তাঁর অর্জিত হয় কিন্তু, নিজের সাহিত্যিক সত্তার প্রতি খানিকটা অবিচারই তিনি করেছিলেন অথবা, সেইটিই ছিল তাঁর ধাত। একদিন ‘আঠার বছর বয়স’-এর সমস্ত জীবনী শক্তি নিয়ে ঠাটারি বাজারের বাসিন্দা হাসনাত ছুটে গিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান এবং আরও অনেকের নিকটে। লক্ষ্য ছিল, বৈরিতা ও সংকীর্ণতার বিষবাষ্প থেকে মানুষকে উদ্ধার করা। পরবর্তীতে সেই এষণাই প্রকাশ পেয়েছে ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন রূপান্তরে। তবে, লক্ষ করতে হয়, আঠার/উনিশ বছর বয়সে তিনি তাঁর অভিভাবক হিসেবে যে-আনিসুজ্জামানকে পান জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই আনিসুজ্জামান থাকেন তাঁর সমান্তরালে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আবুল হাসনাতের মনন-পরিচর্যায় থাকে তাঁর শিক্ষক আনিসুজ্জামানের সহৃদয় পরিপোষকতা। তাঁর শেষ পর্বে ‘কালি ও কলম’-পত্রিকার প্রকাশনা-সম্পাদনায় গুরু-শিষ্যের যৌথতা প্রকৃত অর্থেই লাভ করে সুপরিণতি। পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যা ধারণ করে ‘গণসহিত্য’ ও ‘সাহিত্য সাময়িকী’ স্পৃষ্ট হাসনাতীয় ভাবনা-দর্শন। এর সাধারণ সংখ্যাই শুধু নয় বিশেষ সংখ্যাগুলোও বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে সঞ্চারিত করে নতুনতর চেতনার। এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে ‘কালি ও কলম’-এর শামসুর রাহমান, মাযহারুল ইসলাম, শহীদ কাদরী, মুর্তজা বশির এবং আনিসুজ্জামান স্মরণে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যাগুলোর কথা। যতদূর জেনেছি, মৃত্যুর পূর্বে তিনি ব্যস্ত ছিলেন পত্রিকাটির ‘বিদ্যাসাগর’-বিশেষ সংখ্যার প্রকাশনা নিয়ে।
বৈরি ¯্রােতে অভিযাত্রাই ছিল আবুল হাসনাতের জীবনেষণার মুখ্য শক্তি। বাংলাদেশ যখন সামরিক স্বৈরাচার কবলিত, যখন মৌলবাদের বিস্তার দূরপ্রসারী, এবং যখন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃতির শিকার তখন সেই করাল পরিবেশে আবুল হাসনাতের সৃজন-মননশীলতা উদ্যোগী হয়ে ওঠে উদ্ধারের অনুপম মন্ত্র নিয়ে। মিলান কুন্ডেরা যে বলেছিলেন, উপন্যাস হচ্ছে ইতিহাসের সমান্তরাল পথ, সেই কথাটাকে হয়তো তিনি পরিচালিত করেন অন্য বাঁকের দিকে। সৃজনশীল সাহিত্যের শক্তি দিয়ে তিনি মোকাবিলা করেন ইতিহাসের আপাত সংকটগ্রস্ততাকে। তাঁর সম্পদিত দু’টি গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধের গল্প এবং মুক্তিযুদ্ধের কবিতা উন্মোচন করলো এক নতুন অনুপ্রেরণার দিগন্ত। সেই সময়টাতে বঙ্গবন্ধু শব্দটিকে পরিণত করা হয়েছিল প্রায় ট্যাবুতে। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই পাশ কাটানোর বহুবিধ ক্রীড়া আমরা লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় প্রকাশিত গ্রন্থ দু’টি ইতিহাসের সমান্তরালে দাঁড় করিয়েই ক্ষান্ত হয় না বরং একথাটাই মনে করিয়ে দেয়, ইতিহাস যেখানে চলা থামিয়ে দেয় সেখানেও শুরু হতে পারে সাহিত্যের চলা- আমরা বরং সেটিকে বলতে পারি নতুন চলা। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সাহিত্যজগত মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার অপরিমিত সম্ভাবনার চর্চাক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু, দুষ্কালের কা-ারি হিসেবে অপরিমেয় সাহসের দৃষ্টান্তটি স্থাপন করেছিলেন আবুল হাসনাত।