alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪
image

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের জন্ম ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবিদ্বারের এলাহবাদ গ্রামে। বাবা কেয়াম উদ্দিন ভূঁইয়া ছিলেন স্কুলশিক্ষক। আর মা আফজারুন্নেছা। বাবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়েই তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয়েছিল। হোসেনতলা স্কুল ও জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশনে প্রাথমিক শেষে দেবিদ্বার রেয়াজ উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা শেষে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে প্রথম বিভাগে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করার পর শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র মোজাফফর আহমদের। দীর্ঘদিন বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সাল থেকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তখন বিট্রিশ শাসন। মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লার চান্দিনায় আসবেন শুনে বাড়ি থেকে বের হলেন পথেই জানতে পারেন গান্ধী বলে গেছেনÑ ‘হিন্দু মুসলমান এক হও, বিট্রিশ রাজা খতম কর।’ সেদিন থেকে তিনি গান্ধী ভক্ত হলেন, মুক্তির দিশারি হলেন। ছাত্র অবস্থায় পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হন।

১৯৫১ সালে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা শুরু করেন। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষকতা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালীন ১৯৫২ সালে তার বাসা ৮/আই আজিমপুরে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত করার প্রথম ঘরোয়া বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ, কৃষক প্রজাপার্টি ও বাম ধারা গণতান্ত্রিক দল মিলে হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে যে ২১ দফা দেয়া হয়েছিলÑ এ প্রক্রিয়ায়ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং একই বছর ১১ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে কুমিল্লার দেবিদ্বার থেকে প্রভাবশালী মুসলিম লীগের প্রার্থী ও শিক্ষামন্ত্রী মফিজুল ইসলামকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন বলেছিলেন পূর্ব বাংলার ৯৮% স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। তখন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ১৯৫৭ সালের ৩রা এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও মুদ্রা এই তিন বিষয় কেন্দ্রের হাতে রেখে যাবতীয় ক্ষমতা প্রদেশের হাতে অর্পণের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের ঐতিহাসিক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার পাকিস্তান গণপরিষদে তার প্রস্তাবের পক্ষে বক্তব্য রেখে জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ২৫ ও ২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধিতা (সিয়োটো- সেন্টোপাক মার্কিন সামরিক চুক্তি) গণতন্ত্র (এক লোক-এক ভোট) ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনের অন্যতম রূপকার ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। তিনি অবিভক্ত ন্যাপের যুগ্ন সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদসহ অনেক বিশিষ্ট রাজনীতিবিদের নামে হুলিয়া জারি করলে তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান। তাকে ধরিয়ে দেবার জন্য পাকিস্তান সরকার পুরস্কার ষোষণা করেছিল। তিনি আত্মগোপনে থাকা কালে ছদ্মবেশে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজ করেছেন। ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে হুলিয়া তুলে নিলে তিনি আবার প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। সে সময় বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রস্তাবে অন্য রাজনৈতিক দল সমর্থন না জানালেও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ দৃঢ়ভাবে ছয় দফাকে সমর্থন করেছিলেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শেষে আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে রাজনৈতিক নেতাদের যে গোলবৈঠক ডাকেন, শেখ মুজিবরের সঙ্গে সেই বৈঠকও তিনি আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেন এবং তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের নায্য দাবি-দাওয়া স্বীকৃত না হওয়ায় বৈঠক ব্যর্থ হয় এবং মুজিব ও মোজাফফর ঢাকায় ফিরে আসেন। রুশ-ভারত মতাদর্শগত কারণে ১৯৬৭ সালের ৩ নভেম্বর মতিঝিলের হোটেল ইডেনে ন্যাপের রিকিইজিশন সম্মেলনে মস্কোপন্থিরা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে সভাপতি করে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ পুনঃগঠন করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলনে ‘ডাক’ (উবসড়পৎধঃরপ অপঃরড়হ ঈড়সসরঃঃবব) গঠনে নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ হলে তিনি সূচারুরূপে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মে মাসে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের ১৯ হাজার গেরিলা বাহিনী গঠন ও তাদের সশস্ত্র ট্রেনিং প্রদানের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।

স্বাধীনতা উত্তরকালে তার নেতৃত্বে ন্যাপ স্বৈরাচাররিরোধী, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৮২ সালে স্বৈরশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে তাকে আবার কারারুদ্ধ হতে হয়। তিনি সারা জীবন গণমানুষের মুক্তি তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নীতিতে অবিচল ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একই নীতিতে অটল ছিলেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনো রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেননি। তিনি একাধারে জাতীয়তাবাদী, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদ রিরোধী ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি সমাজ বাস্তবতার নিরিখে রাজনীতি বিশ্লেষণ ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করেছেন। ১৯৯২ সালে নেতাকর্মী হতাশ হয়ে আদর্শ ও দলত্যাগ করলেও তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলেন, ‘সমাজতন্ত্র ছিল আছে থাকবে, আঁকা-বাঁকা পথে এগিয়ে চলছে।’ ২০০৬-২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দিন, জেনারেল মঈনুদ্দীনরা সরকার গঠন করার পর ড. ফখরুদ্দীন সাহেব ফোন করে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি নাকোচ করে দেন। মাইনাস টু ফর্মুলার সমর্থন পেতে সে সময় ড. কামাল হোসেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সঙ্গে দেখা করতে তার সেগুনবাগিচার বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

এই ব্যক্তিত্ব বারেবারে এগিয়ে এসেছেন মানুষের গণঅধিকারের দাবিতে, নিজের জীবনের সুবর্ণ সময়েও গণমানুষের পাশে দাঁড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। জানতেন এই পথ ভীষণ দুর্গম; কিন্তু আমৃত্যু স্রোতের প্রতিকূলে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানের সাহস ছিল তার। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ২৩ আগস্ট ২০১৯ সালে রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। ত্রিকালদর্শী (ব্রিটিশ, ভারত, বাংলাদেশ) অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আজ শুধু ব্যক্তি নেতা নন, এক অনুকরণীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। ইতিহাস সৃষ্টিকারী মানুষ ক্ষণজন্মা। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ক্ষণজন্মাদের একজন। তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের মানসপটে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

image

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের জন্ম ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবিদ্বারের এলাহবাদ গ্রামে। বাবা কেয়াম উদ্দিন ভূঁইয়া ছিলেন স্কুলশিক্ষক। আর মা আফজারুন্নেছা। বাবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়েই তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয়েছিল। হোসেনতলা স্কুল ও জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশনে প্রাথমিক শেষে দেবিদ্বার রেয়াজ উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা শেষে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে প্রথম বিভাগে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করার পর শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র মোজাফফর আহমদের। দীর্ঘদিন বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সাল থেকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তখন বিট্রিশ শাসন। মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লার চান্দিনায় আসবেন শুনে বাড়ি থেকে বের হলেন পথেই জানতে পারেন গান্ধী বলে গেছেনÑ ‘হিন্দু মুসলমান এক হও, বিট্রিশ রাজা খতম কর।’ সেদিন থেকে তিনি গান্ধী ভক্ত হলেন, মুক্তির দিশারি হলেন। ছাত্র অবস্থায় পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হন।

১৯৫১ সালে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা শুরু করেন। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষকতা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালীন ১৯৫২ সালে তার বাসা ৮/আই আজিমপুরে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত করার প্রথম ঘরোয়া বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ, কৃষক প্রজাপার্টি ও বাম ধারা গণতান্ত্রিক দল মিলে হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে যে ২১ দফা দেয়া হয়েছিলÑ এ প্রক্রিয়ায়ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং একই বছর ১১ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে কুমিল্লার দেবিদ্বার থেকে প্রভাবশালী মুসলিম লীগের প্রার্থী ও শিক্ষামন্ত্রী মফিজুল ইসলামকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন বলেছিলেন পূর্ব বাংলার ৯৮% স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। তখন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ১৯৫৭ সালের ৩রা এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও মুদ্রা এই তিন বিষয় কেন্দ্রের হাতে রেখে যাবতীয় ক্ষমতা প্রদেশের হাতে অর্পণের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের ঐতিহাসিক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার পাকিস্তান গণপরিষদে তার প্রস্তাবের পক্ষে বক্তব্য রেখে জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ২৫ ও ২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধিতা (সিয়োটো- সেন্টোপাক মার্কিন সামরিক চুক্তি) গণতন্ত্র (এক লোক-এক ভোট) ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনের অন্যতম রূপকার ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। তিনি অবিভক্ত ন্যাপের যুগ্ন সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদসহ অনেক বিশিষ্ট রাজনীতিবিদের নামে হুলিয়া জারি করলে তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান। তাকে ধরিয়ে দেবার জন্য পাকিস্তান সরকার পুরস্কার ষোষণা করেছিল। তিনি আত্মগোপনে থাকা কালে ছদ্মবেশে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজ করেছেন। ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে হুলিয়া তুলে নিলে তিনি আবার প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। সে সময় বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রস্তাবে অন্য রাজনৈতিক দল সমর্থন না জানালেও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ দৃঢ়ভাবে ছয় দফাকে সমর্থন করেছিলেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শেষে আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে রাজনৈতিক নেতাদের যে গোলবৈঠক ডাকেন, শেখ মুজিবরের সঙ্গে সেই বৈঠকও তিনি আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেন এবং তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের নায্য দাবি-দাওয়া স্বীকৃত না হওয়ায় বৈঠক ব্যর্থ হয় এবং মুজিব ও মোজাফফর ঢাকায় ফিরে আসেন। রুশ-ভারত মতাদর্শগত কারণে ১৯৬৭ সালের ৩ নভেম্বর মতিঝিলের হোটেল ইডেনে ন্যাপের রিকিইজিশন সম্মেলনে মস্কোপন্থিরা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে সভাপতি করে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ পুনঃগঠন করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলনে ‘ডাক’ (উবসড়পৎধঃরপ অপঃরড়হ ঈড়সসরঃঃবব) গঠনে নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ হলে তিনি সূচারুরূপে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মে মাসে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের ১৯ হাজার গেরিলা বাহিনী গঠন ও তাদের সশস্ত্র ট্রেনিং প্রদানের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।

স্বাধীনতা উত্তরকালে তার নেতৃত্বে ন্যাপ স্বৈরাচাররিরোধী, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৮২ সালে স্বৈরশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে তাকে আবার কারারুদ্ধ হতে হয়। তিনি সারা জীবন গণমানুষের মুক্তি তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নীতিতে অবিচল ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একই নীতিতে অটল ছিলেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনো রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেননি। তিনি একাধারে জাতীয়তাবাদী, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদ রিরোধী ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি সমাজ বাস্তবতার নিরিখে রাজনীতি বিশ্লেষণ ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করেছেন। ১৯৯২ সালে নেতাকর্মী হতাশ হয়ে আদর্শ ও দলত্যাগ করলেও তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলেন, ‘সমাজতন্ত্র ছিল আছে থাকবে, আঁকা-বাঁকা পথে এগিয়ে চলছে।’ ২০০৬-২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দিন, জেনারেল মঈনুদ্দীনরা সরকার গঠন করার পর ড. ফখরুদ্দীন সাহেব ফোন করে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি নাকোচ করে দেন। মাইনাস টু ফর্মুলার সমর্থন পেতে সে সময় ড. কামাল হোসেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সঙ্গে দেখা করতে তার সেগুনবাগিচার বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

এই ব্যক্তিত্ব বারেবারে এগিয়ে এসেছেন মানুষের গণঅধিকারের দাবিতে, নিজের জীবনের সুবর্ণ সময়েও গণমানুষের পাশে দাঁড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। জানতেন এই পথ ভীষণ দুর্গম; কিন্তু আমৃত্যু স্রোতের প্রতিকূলে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানের সাহস ছিল তার। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ২৩ আগস্ট ২০১৯ সালে রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। ত্রিকালদর্শী (ব্রিটিশ, ভারত, বাংলাদেশ) অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আজ শুধু ব্যক্তি নেতা নন, এক অনুকরণীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। ইতিহাস সৃষ্টিকারী মানুষ ক্ষণজন্মা। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ক্ষণজন্মাদের একজন। তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের মানসপটে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top