এম এ কাদের
দেশের উন্নয়নের জন্য, বাৎসরিক বাজেট একটি বড় বিষয়। যে দেশের বাৎসরিক বাজেট যত বেশি, সে দেশ তত উন্নত। চলতি অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২৪-২৫ সালে আমাদের দেশে মোট বাজেট ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, এর মধ্যে শুধু উন্নয়ন খাতে বাজেট ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ৩৪ শতাংশ। অপচয় রোধ এবং দুর্নীতি মুক্ত করে উন্নয়ন খাত থেকেই বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঠিকাদার নির্বাচন করা হলে ও অফিসের পারসেন্টেজ, দুর্নীতি বন্ধ হলে উন্নয়ন ব্যয় কমে আসবে। এতে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, অফিস-আদালত, নদীশাসনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে এবং বাস্তবায়িত অবকাঠামো সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে উল্লেখিত উন্নয়ন খাতের প্রায় ২৫% টাকা বাঁচানো সম্ভব। বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক ঠিকাদার নির্বাচন ও দুর্নীতি বন্ধের জন্য ই জি পি পদ্ধতি চালু হয়েছে, কিন্তু সর্বক্ষত্রে ঠিকাদারদের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নেয়া হয় নানা কৌশল। নির্ধারিত কিছু ঠিকাদারের সঙ্গে উপরের কর্তাদের সখ্য গড়ে ওঠায় এবং দরপত্রে প্রতিযোগী না হওয়া বা কম হওয়ার কারণে টার্নওভারসহ অন্যান্য জটিল শর্ত আরোপ করে আইনি মারপ্যাঁচে ঘুরেফিরে কাজ পাচ্ছে কিছু নির্ধারিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারী নির্মাণকাজের বিল দেয়ার সময় অহেতুক কাজের ভুল-ত্রুটি ধরে ঠিকাদারের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে নিচ্ছে। মনে হয় নির্মাণকাজের বিল পাসের এই পার্সেন্টেজের টাকা তাদের প্রাপ্য পাওনা। বেশির ভাগ ঠিকাদারি কাজ বণ্টনের ক্ষেত্রে বার্ষিক কাজের টার্নওভার চাওয়া হয়। টার্নওভার অর্থ বাৎসরিক গড় চুক্তিমূল্য, ওই বিভাগে বছরে তিনি কত টাকার কাজ করেছেন। এ কারণে সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ ঠিকাদার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না, ফলে প্রতিযোগিতা না হওয়ায় একই প্রতিষ্ঠান একাধিকবার কাজ পেয়ে থাকে। এ সমস্ত কাজ নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করতে না পারায় অধিক লাভে অন্য ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে দেয়, আবার কিছু কিছু ঠিকাদার নিজের টার্নওভারযোগ্য লাইসেন্সের মাধ্যমে অন্য ঠিকাদারের টেন্ডার দেয়ার সুযোগ করে দিয়ে ২% থেকে ৩% লাভ নিয়ে থাকেন। এভাবে ওই ঠিকাদার নিজে কাজ না করলেও তার টার্নওভার অভিজ্ঞতা বাড়তেই থাকে। অহেতুক এই টার্নওভার না রেখে অধিক ঠিকাদারের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে, বুক ভ্যালু থেকে যেখানে ২০% থেকে ২৫% নিম্নদরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেখানে অনেক কাজ সমদরে অথবা ৫% নিম্নদরে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এ কারণে বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। বর্তমান দেশের প্রায় ৫০% থেকে ৬০% ঠিকাদারের কোন টার্নওভার নেই, কারণ তাদের কাজ পাওয়ার সুযোগই রাখা হয়নি। এ কারণে দেশের প্রায় ৩০ হাজার ঠিকাদার বেকার হয়ে পড়েছে। নতুন ঠিকাদার তৈরির ক্ষেত্রে এলটিএম পদ্ধতি চালু রাখা হয়েছে, যেখানে কিছু কাজে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্ণওভার ছাড়া দরপত্রে অংশগ্রহণ করা যায়, কিন্তু সেখানে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অংশগ্রহণ করার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী সব ঠিকাদারকেই সমদরে (৫%) অংশগ্রহণ করতে হয়। এ কারণে কিছু কিছু একক কাজে ৫০০ জন পর্যন্ত ঠিকাদার অংশগ্রহণ করে থাকেন। এর মধ্যে লটারির মাধ্যমে মাত্র একজন কাজ পেয়ে থাকেন। ফলে হাজার হাজার ঠিকাদার বছরের পর বছর চেষ্টা করে লাখ লাখ টাকার দরপত্র খরিদ করেও, কাজ না পেয়ে মূলধনহারা হয়ে বেকার হয়ে পড়ে এবং উৎসাহ হারায়। তাছাড়া অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন ঠিকাদারের দীর্ঘদিন (২৫-৩০ বছর) কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ করা থাকলেও যে কোন কারণে বিগত ৫ বছরের টার্নওভার না থাকায় তার অভিজ্ঞতার কোন মূল্যই রাখা হয়নি। অনিয়ম বন্ধ করে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে টার্নওভার বন্ধ করে প্রতিযোগী বাড়াতে হবে এবং অফিস-আদালতের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য গোপন সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্নীতি নিরুৎসাহিত করার জন্য দুর্নীতিমুক্ত কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতি দিতে হবে এবং দুর্নীতিবাজদের পদোন্নতি বন্ধসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে টেন্ডারবাজি বন্ধ ও অহেতুক শর্তাবলি শিথিল করে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করা এবং প্রয়োজনে কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য টেন্ডার জামানতের টাকা দ্বিগুণ করা যেতে পারে। কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করলে অধিক দরপত্র বিক্রয়ের দরুণ সরকারের আয় অনেকাংশে বেড়ে যাবে এবং দেশে ৩০ হাজার বেকার ঠিকাদারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে দরপত্রে দরের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় অনেক কমে যাবে এবং দ্রুত কাজ বাস্তবায়ন হবে। বাস্তবায়িত প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই সংরক্ষণ ও দুর্নীতি বন্ধের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখলে উন্নয়ন খাতের টাকা থেকে প্রতি বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব হবে, ফলে দেশকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দুর্গম পথ আরও সুগম হবে।
[লেখক : সংবাদকর্মী]
এম এ কাদের
বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪
দেশের উন্নয়নের জন্য, বাৎসরিক বাজেট একটি বড় বিষয়। যে দেশের বাৎসরিক বাজেট যত বেশি, সে দেশ তত উন্নত। চলতি অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২৪-২৫ সালে আমাদের দেশে মোট বাজেট ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, এর মধ্যে শুধু উন্নয়ন খাতে বাজেট ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ৩৪ শতাংশ। অপচয় রোধ এবং দুর্নীতি মুক্ত করে উন্নয়ন খাত থেকেই বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঠিকাদার নির্বাচন করা হলে ও অফিসের পারসেন্টেজ, দুর্নীতি বন্ধ হলে উন্নয়ন ব্যয় কমে আসবে। এতে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, অফিস-আদালত, নদীশাসনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে এবং বাস্তবায়িত অবকাঠামো সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে উল্লেখিত উন্নয়ন খাতের প্রায় ২৫% টাকা বাঁচানো সম্ভব। বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক ঠিকাদার নির্বাচন ও দুর্নীতি বন্ধের জন্য ই জি পি পদ্ধতি চালু হয়েছে, কিন্তু সর্বক্ষত্রে ঠিকাদারদের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নেয়া হয় নানা কৌশল। নির্ধারিত কিছু ঠিকাদারের সঙ্গে উপরের কর্তাদের সখ্য গড়ে ওঠায় এবং দরপত্রে প্রতিযোগী না হওয়া বা কম হওয়ার কারণে টার্নওভারসহ অন্যান্য জটিল শর্ত আরোপ করে আইনি মারপ্যাঁচে ঘুরেফিরে কাজ পাচ্ছে কিছু নির্ধারিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারী নির্মাণকাজের বিল দেয়ার সময় অহেতুক কাজের ভুল-ত্রুটি ধরে ঠিকাদারের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে নিচ্ছে। মনে হয় নির্মাণকাজের বিল পাসের এই পার্সেন্টেজের টাকা তাদের প্রাপ্য পাওনা। বেশির ভাগ ঠিকাদারি কাজ বণ্টনের ক্ষেত্রে বার্ষিক কাজের টার্নওভার চাওয়া হয়। টার্নওভার অর্থ বাৎসরিক গড় চুক্তিমূল্য, ওই বিভাগে বছরে তিনি কত টাকার কাজ করেছেন। এ কারণে সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ ঠিকাদার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না, ফলে প্রতিযোগিতা না হওয়ায় একই প্রতিষ্ঠান একাধিকবার কাজ পেয়ে থাকে। এ সমস্ত কাজ নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করতে না পারায় অধিক লাভে অন্য ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে দেয়, আবার কিছু কিছু ঠিকাদার নিজের টার্নওভারযোগ্য লাইসেন্সের মাধ্যমে অন্য ঠিকাদারের টেন্ডার দেয়ার সুযোগ করে দিয়ে ২% থেকে ৩% লাভ নিয়ে থাকেন। এভাবে ওই ঠিকাদার নিজে কাজ না করলেও তার টার্নওভার অভিজ্ঞতা বাড়তেই থাকে। অহেতুক এই টার্নওভার না রেখে অধিক ঠিকাদারের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে, বুক ভ্যালু থেকে যেখানে ২০% থেকে ২৫% নিম্নদরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেখানে অনেক কাজ সমদরে অথবা ৫% নিম্নদরে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এ কারণে বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। বর্তমান দেশের প্রায় ৫০% থেকে ৬০% ঠিকাদারের কোন টার্নওভার নেই, কারণ তাদের কাজ পাওয়ার সুযোগই রাখা হয়নি। এ কারণে দেশের প্রায় ৩০ হাজার ঠিকাদার বেকার হয়ে পড়েছে। নতুন ঠিকাদার তৈরির ক্ষেত্রে এলটিএম পদ্ধতি চালু রাখা হয়েছে, যেখানে কিছু কাজে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্ণওভার ছাড়া দরপত্রে অংশগ্রহণ করা যায়, কিন্তু সেখানে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অংশগ্রহণ করার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী সব ঠিকাদারকেই সমদরে (৫%) অংশগ্রহণ করতে হয়। এ কারণে কিছু কিছু একক কাজে ৫০০ জন পর্যন্ত ঠিকাদার অংশগ্রহণ করে থাকেন। এর মধ্যে লটারির মাধ্যমে মাত্র একজন কাজ পেয়ে থাকেন। ফলে হাজার হাজার ঠিকাদার বছরের পর বছর চেষ্টা করে লাখ লাখ টাকার দরপত্র খরিদ করেও, কাজ না পেয়ে মূলধনহারা হয়ে বেকার হয়ে পড়ে এবং উৎসাহ হারায়। তাছাড়া অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন ঠিকাদারের দীর্ঘদিন (২৫-৩০ বছর) কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ করা থাকলেও যে কোন কারণে বিগত ৫ বছরের টার্নওভার না থাকায় তার অভিজ্ঞতার কোন মূল্যই রাখা হয়নি। অনিয়ম বন্ধ করে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে টার্নওভার বন্ধ করে প্রতিযোগী বাড়াতে হবে এবং অফিস-আদালতের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য গোপন সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্নীতি নিরুৎসাহিত করার জন্য দুর্নীতিমুক্ত কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতি দিতে হবে এবং দুর্নীতিবাজদের পদোন্নতি বন্ধসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে টেন্ডারবাজি বন্ধ ও অহেতুক শর্তাবলি শিথিল করে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করা এবং প্রয়োজনে কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য টেন্ডার জামানতের টাকা দ্বিগুণ করা যেতে পারে। কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করলে অধিক দরপত্র বিক্রয়ের দরুণ সরকারের আয় অনেকাংশে বেড়ে যাবে এবং দেশে ৩০ হাজার বেকার ঠিকাদারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে দরপত্রে দরের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় অনেক কমে যাবে এবং দ্রুত কাজ বাস্তবায়ন হবে। বাস্তবায়িত প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই সংরক্ষণ ও দুর্নীতি বন্ধের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখলে উন্নয়ন খাতের টাকা থেকে প্রতি বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব হবে, ফলে দেশকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দুর্গম পথ আরও সুগম হবে।
[লেখক : সংবাদকর্মী]