কামরুজ্জামান
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত একমাত্র খালটি হলো লবলং। পুরো খালজুড়ে দেখা যায় কালো, ময়লাযুক্ত গরম পানি। এটি এখন যেন ময়লা-আবর্জনাযুক্ত বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। শ্রীপুর অঞ্চলের সব শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য ফেলার নিরাপদ জায়গা এখন এই লবলং খালই।
আজ লবলং খালে ময়লা, আবর্জনা, কঠিন বর্জ্য, পলিথিন, কালো পানি ও কারখানার বিষাক্ত তরল ছাড়া কিছুই নেই। দুই পাড়ের জমিতেও কৃষিকাজ হয় না বললেই চলে। একসময়ের মাছের আধার লবলং খাল এখন মৃত
একসময় লবলং নদীতে পালতোলা নৌকা নিয়ে কুমাররা আসত। নৌকায় ভর্তি থাকত মাটির হাঁড়িপাতিল। তাল, ধানের চিটা বা আখের চিটাগুড় দিয়ে কুমারের কাছ থেকে হাঁড়িপাতিল কেনা যেত। কুমাররা বাঁশের খাঁচায় করে হাঁড়িপাতিল মাথায় নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বিক্রি করত। নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকত দুই-তিন দিন, কখনও এক সপ্তাহ পর্যন্ত। হাঁড়িপাতিল বিক্রি শেষ হলে তারা চলে যেত। আমরা ছোটরা ঘাটে বাঁধা সেই নৌকায় উঠে খেলাধুলা করতাম। লবলং নদীর সেই ঘাটগুলোর নাম এখনও আমার মনে আছে-আমিনা বাপের ঘাট, বংশীঘাট, মুন্সিঘাট, মাঝিঘাট, বিলাইঘাট ইত্যাদি।
এখন লবলং নদী মৃত। দূষণে নিমজ্জিত লবলং আজ কেবল স্মৃতি। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানেই না, স্বচ্ছ জলের প্রবাহধারায় একসময় পালতোলা নৌকা চলত-বিশেষ করে ভরা বর্ষায় সেই দৃশ্য ছিল অপূর্ব।
স্বচ্ছ জলের লবলং খালের দুই পাড়ের জমিতে একসময় কৃষিকাজ হতো। বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি তরমুজ পর্যন্ত চাষ হতো। খাল ও খালের দুই পাড়ে সারা বছর দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। আমরা নানা উপায়ে সেই মাছ ধরতাম-যা আজও স্মৃতিতে মধুর হয়ে আছে।
বাঁশের তৈরি বানা, ধর্মজাল, টানাজাল, ঝাঁকিজাল-এসব দিয়েই মাছ ধরতাম। বর্ষার পানিতে খাল একপাশ থেকে অন্যপাশে মিশে যেত, আর তখন বানা পেতে বড় ছোট সব ধরনের মাছ ধরা যেত। খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে কিংবা খালের পানিতে নেমে টানাজাল দিয়ে মাছ ধরার আনন্দ আজও মনে পড়ে। প্রতিটি টানেই জালে উঠত মাছ।
ঝাঁকিজাল ফেলা ছিল সাধারণ দৃশ্য। কেউ কেউ পানিতে ডুব দিয়ে মাছ ধরত, কেউ জাল ছুড়ে আবার টেনে তুলত। খালের দুই পাড়ে হালচাষের পেছনেও মাছ ধরা যেত। আষাঢ় মাসে ধান রোপণের আগে জমি চাষের সময় ছোট মাছ পাওয়া যেত প্রচুর।
বরশী দিয়েও মাছ ধরা যেত সারা বছর। বর্ষার রাতে বড় বরশীতে ছোট মাছ গেঁথে পানিতে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সকালে গিয়ে দেখা যেত, বিশাল বোয়াল মাছ বরশীতে ঝুলে আছে। শরৎকালে যখন পানি নামতে শুরু করত, তখন ঠেলা জালি বা টানাজাল পেতে মাছ ধরা হতো।
শুকনো মৌসুমে খালের পানি সেচ করে মাছ ধরা ছিল এক বিশেষ কৌশল। বাঁশের তৈরি ‘উরি’ বা অ্যালুমিনিয়ামের বল দিয়ে দুই-তিনজন মিলে পানি তুলে সেচ করা হতো, পরে মাছ ধরা হতো। পরবর্তীকালে মেশিন দিয়েও পানি সেচ করে মাছ ধরেছি আমরা।
জমির ভাঙা আইল বা ধানক্ষেতের পানিভর্তি জমিতেও মাছ ধরা যেত। বর্ষায় জমির আইল ভেঙে গর্তে ছোট মাছ জমে থাকত। আমরা বিকল্প পথে পানি ছাড়িয়ে গর্ত শুকিয়ে টাকি, পুঁটি, গুতুম, বাইন ইত্যাদি মাছ ধরতাম।
বাঁশের তৈরি চাই পেতে রাতভর মাছ ধরা ছিল আরও এক মজার অভিজ্ঞতা। অনেক সময় মাছের সঙ্গে সাপও চাইয়ের ভেতরে ঢুকে যেত। তখন সেগুলো মেরে ফেলতাম-জানতাম না সাপও পরিবেশের উপকারী প্রাণী।
আজ লবলং খালে ময়লা, আবর্জনা, কঠিন বর্জ্য, পলিথিন, কালো পানি ও কারখানার বিষাক্ত তরল ছাড়া কিছুই নেই। দুই পাড়ের জমিতেও কৃষিকাজ হয় না বললেই চলে। একসময়ের মাছের আধার লবলং খাল এখন মৃত। এ দুঃখ কোথায় রাখি!
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
কামরুজ্জামান
শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত একমাত্র খালটি হলো লবলং। পুরো খালজুড়ে দেখা যায় কালো, ময়লাযুক্ত গরম পানি। এটি এখন যেন ময়লা-আবর্জনাযুক্ত বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। শ্রীপুর অঞ্চলের সব শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য ফেলার নিরাপদ জায়গা এখন এই লবলং খালই।
আজ লবলং খালে ময়লা, আবর্জনা, কঠিন বর্জ্য, পলিথিন, কালো পানি ও কারখানার বিষাক্ত তরল ছাড়া কিছুই নেই। দুই পাড়ের জমিতেও কৃষিকাজ হয় না বললেই চলে। একসময়ের মাছের আধার লবলং খাল এখন মৃত
একসময় লবলং নদীতে পালতোলা নৌকা নিয়ে কুমাররা আসত। নৌকায় ভর্তি থাকত মাটির হাঁড়িপাতিল। তাল, ধানের চিটা বা আখের চিটাগুড় দিয়ে কুমারের কাছ থেকে হাঁড়িপাতিল কেনা যেত। কুমাররা বাঁশের খাঁচায় করে হাঁড়িপাতিল মাথায় নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বিক্রি করত। নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকত দুই-তিন দিন, কখনও এক সপ্তাহ পর্যন্ত। হাঁড়িপাতিল বিক্রি শেষ হলে তারা চলে যেত। আমরা ছোটরা ঘাটে বাঁধা সেই নৌকায় উঠে খেলাধুলা করতাম। লবলং নদীর সেই ঘাটগুলোর নাম এখনও আমার মনে আছে-আমিনা বাপের ঘাট, বংশীঘাট, মুন্সিঘাট, মাঝিঘাট, বিলাইঘাট ইত্যাদি।
এখন লবলং নদী মৃত। দূষণে নিমজ্জিত লবলং আজ কেবল স্মৃতি। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানেই না, স্বচ্ছ জলের প্রবাহধারায় একসময় পালতোলা নৌকা চলত-বিশেষ করে ভরা বর্ষায় সেই দৃশ্য ছিল অপূর্ব।
স্বচ্ছ জলের লবলং খালের দুই পাড়ের জমিতে একসময় কৃষিকাজ হতো। বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি তরমুজ পর্যন্ত চাষ হতো। খাল ও খালের দুই পাড়ে সারা বছর দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। আমরা নানা উপায়ে সেই মাছ ধরতাম-যা আজও স্মৃতিতে মধুর হয়ে আছে।
বাঁশের তৈরি বানা, ধর্মজাল, টানাজাল, ঝাঁকিজাল-এসব দিয়েই মাছ ধরতাম। বর্ষার পানিতে খাল একপাশ থেকে অন্যপাশে মিশে যেত, আর তখন বানা পেতে বড় ছোট সব ধরনের মাছ ধরা যেত। খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে কিংবা খালের পানিতে নেমে টানাজাল দিয়ে মাছ ধরার আনন্দ আজও মনে পড়ে। প্রতিটি টানেই জালে উঠত মাছ।
ঝাঁকিজাল ফেলা ছিল সাধারণ দৃশ্য। কেউ কেউ পানিতে ডুব দিয়ে মাছ ধরত, কেউ জাল ছুড়ে আবার টেনে তুলত। খালের দুই পাড়ে হালচাষের পেছনেও মাছ ধরা যেত। আষাঢ় মাসে ধান রোপণের আগে জমি চাষের সময় ছোট মাছ পাওয়া যেত প্রচুর।
বরশী দিয়েও মাছ ধরা যেত সারা বছর। বর্ষার রাতে বড় বরশীতে ছোট মাছ গেঁথে পানিতে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সকালে গিয়ে দেখা যেত, বিশাল বোয়াল মাছ বরশীতে ঝুলে আছে। শরৎকালে যখন পানি নামতে শুরু করত, তখন ঠেলা জালি বা টানাজাল পেতে মাছ ধরা হতো।
শুকনো মৌসুমে খালের পানি সেচ করে মাছ ধরা ছিল এক বিশেষ কৌশল। বাঁশের তৈরি ‘উরি’ বা অ্যালুমিনিয়ামের বল দিয়ে দুই-তিনজন মিলে পানি তুলে সেচ করা হতো, পরে মাছ ধরা হতো। পরবর্তীকালে মেশিন দিয়েও পানি সেচ করে মাছ ধরেছি আমরা।
জমির ভাঙা আইল বা ধানক্ষেতের পানিভর্তি জমিতেও মাছ ধরা যেত। বর্ষায় জমির আইল ভেঙে গর্তে ছোট মাছ জমে থাকত। আমরা বিকল্প পথে পানি ছাড়িয়ে গর্ত শুকিয়ে টাকি, পুঁটি, গুতুম, বাইন ইত্যাদি মাছ ধরতাম।
বাঁশের তৈরি চাই পেতে রাতভর মাছ ধরা ছিল আরও এক মজার অভিজ্ঞতা। অনেক সময় মাছের সঙ্গে সাপও চাইয়ের ভেতরে ঢুকে যেত। তখন সেগুলো মেরে ফেলতাম-জানতাম না সাপও পরিবেশের উপকারী প্রাণী।
আজ লবলং খালে ময়লা, আবর্জনা, কঠিন বর্জ্য, পলিথিন, কালো পানি ও কারখানার বিষাক্ত তরল ছাড়া কিছুই নেই। দুই পাড়ের জমিতেও কৃষিকাজ হয় না বললেই চলে। একসময়ের মাছের আধার লবলং খাল এখন মৃত। এ দুঃখ কোথায় রাখি!
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]