মতিউর রহমান
বর্তমান বিশ্ব এমন এক ভার্চুয়াল যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে মানবজীবন ও সংস্কৃতির প্রায় প্রতিটি স্তর প্রযুক্তির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। যোগাযোগ এবং তথ্য আদান-প্রদানের এই মাধ্যমটি শুধু তথ্যের প্রবাহকেই বদলায়নি, বরং বদলে দিয়েছে মানুষের অস্তিত্বের সবচেয়ে মৌলিক ভিত্তি-আত্মপরিচয়। আজ ভালো লাগা (লাইক), ভাগ করা (শেয়ার), মন্তব্য এবং অনুসরণকারীর সংখ্যাই নতুন সামাজিক মাপকাঠি তৈরি করেছে, যা নির্ধারণ করে একজন মানুষের ভার্চুয়াল সামাজিক গুরুত্ব।
পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতির পরিসরে যে স্থির এবং সুসংহত আত্মপরিচয় একসময় গড়ে উঠত, তা আজ এই ভার্চুয়াল মঞ্চগুলোর অসংখ্য খণ্ডে ভাসমান ও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি কেবল মনের উদ্বেগ নয়, বরং এটি গভীর সমাজতাত্ত্বিক এক সংকট- যেখানে সামাজিক পরিচয়, পরোপকারিতা, সহমর্মিতা ও প্রভাব বিস্তার-এর মতো চিরায়ত ধারণাগুলো নতুন অর্থে গঠিত হচ্ছে। ভার্চুয়াল সভ্যতার এই ভাঙা আয়নায় মানুষ একদিকে যেমন দর্শক, তেমনি বহুধা বিভক্ত প্রতিফলনে নিজেদের অর্থও খুঁজে ফিরছে।
মানুষের আত্মপরিচয়ের মূলে রয়েছে ‘সম্পৃক্ততা’ বা যোগসূত্র। সমাজতত্ত্ববিদ হেনরি তাজফেল এবং জন টার্নার-এর ‘সামাজিক পরিচয় তত্ত্ব’ অনুসারে, মানুষ তার নিজের পরিচয় এবং আত্মমর্যাদার একটি বড় অংশ খুঁজে পায় সেইসব গোষ্ঠীর সঙ্গে যেখানে সে যুক্ত। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে এই গোষ্ঠীপরিচয়ের সীমানা আজ অত্যন্ত অস্পষ্ট ও পরিবর্তনশীল। এই জগৎ মানুষকে একইসঙ্গে একাধিক গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার সুযোগ দিয়েছে, যা তৈরি করেছে এক ধরনের ডিজিটাল বিখন্ডন। একেকটি সামাজিক মাধ্যম একেকটি মঞ্চ হিসেবে কাজ করে, যেখানে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করে। ফেসবুকে সে মানবিক বা পারিবারিক ভূমিকায়, টুইটারে সে তীক্ষè বা রাজনৈতিক, ইনস্টাগ্রামে তার পরিচয় নান্দনিক বা সফলতার প্রদর্শনী, আর লিংকডইনে সে সম্পূর্ণ পেশাদার।
আরভিং গফম্যানের ‘নাট্যশাস্ত্র’ তত্ত্বের সংযোগে বলা যায়, ভার্চুয়াল মঞ্চগুলি আমাদের জন্য নিত্যনতুন ‘মঞ্চ’ তৈরি করেছে, যেখানে মানুষ মূলত একটি ‘প্রদর্শনীমূলক পরিচয়’ নির্মাণ করে। পরিচয় তখন আর জীবনের গভীরে প্রোথিত নৈতিকতার অংশ থাকে না, বরং হয়ে ওঠে সামাজিক প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনের উপকরণ। এই বিভক্ত আত্মপরিচয় মানুষকে ক্রমে একরৈখিক সামাজিক নৈতিকতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, কারণ প্রতিটি মঞ্চে নৈতিকতার ভিন্ন মানদণ্ড তৈরি হয়। এর ফলস্বরূপ, সামাজিক সংহতির ভিত্তি দুর্বল হয় এবং নৈতিক বিচার হয়ে পড়ে পরিস্থিতি ও শ্রোতানির্ভর।
আত্মপরিচয়ের এই বিভাজনের প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পরোপকারিতা ও সমাজমুখী আচরণের ক্ষেত্রে। প্রথাগত সমাজে সহমর্মিতা জন্ম নিত সরাসরি মানবিক সম্পর্ক থেকে, আজ তা নির্ভর করে গণনাবিধির প্রবাহ এবং প্রদর্শনের সুযোগের ওপর। অনলাইনে সাহায্যের আহ্বান মুহূর্তে ছড়িয়ে গেলেও, সেই সাহায্য অনেক সময়ই মিশে থাকে আত্মপ্রদর্শনের আকাক্সক্ষার সঙ্গে, যা জন্ম দিয়েছে ‘হ্যাশট্যাগ মানবিকতা’ বা ‘ভার্চুয়াল মঞ্চের দয়া’-এর মতো নতুন সংস্কৃতির।
সমাজতত্ত্ববিদ পিয়ের বুর্দিয়োর “প্রতীকী মূলধনের” ধারণা এই প্রসঙ্গে নতুন আকারে ফিরে আসে। প্রতীকী মূলধন হলো সেই মর্যাদা, স্বীকৃতি বা সম্মান, যা সমাজে স্বীকৃত হয়। ভার্চুয়াল যুগে, নৈতিকতা নিজেই হয়ে ওঠে একধরনের সামাজিক বিনিয়োগ, যা মর্যাদা অর্জনের পথÑভার্চুয়াল দান বা সমাজসেবামূলক পোস্টের মাধ্যমে মানুষ কেবল সাহায্যই করে না, বরং নিজের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এটি প্রতীকী মূলধন হিসেবে কাজ করে, যা ভালো লাগা ও ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে সামাজিক বৈধতা অর্জন করে।
এই নৈতিক বিনিয়োগের চূড়ান্ত ফল হলো সমাজতত্ত্ববিদ জিগমুন্ট বাউমানের ধারণায় “তরল সহানুভূতি”। বাউমান তাঁর ‘তরল আধুনিকতা’ তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, আধুনিক যুগের সম্পর্কগুলো ‘তরল’-দ্রুত গঠিত হয়, দ্রুত ভেঙে যায় এবং কোনো স্থায়ী রূপ নেয় না। ভার্চুয়াল যুগে মানবিকতাও তাই ‘তরল সহানুভূতি’-এটি তীব্র কিন্তু ক্ষণস্থায়ী অনুভূতি। বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া কষ্ট বা অন্যায় মুহূর্তেই আমাদের পর্দায় এসে পৌঁছায়, কিন্তু সেই সহানুভূতি টেকে না।
মন দ্রুত ক্লান্ত হয় অতিরিক্ত উদ্দীপনায় বা ‘সহানুভূতির ক্লান্তি’-তে, ফলে একটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ঘটনা শেষ না হতেই অন্যটি আসে, আর নৈতিক দায়বদ্ধতা হয়ে পড়ে সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী। এটি এক ধরনের আবেগভিত্তিক বাজার অর্থনীতি, যেখানে স্থায়ী নৈতিক সংহতির চেয়ে সাময়িক ক্ষোভ বা সহানুভূতি দ্রুত ছড়ায় এবং বিক্রি হয়।
প্রথাগত সমাজে প্রভাব বিস্তার-এর মূল অস্ত্র ছিল বিশ্বাসযোগ্যতা, যুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা। কিন্তু ভার্চুয়াল সমাজে প্রভাবের পরিমাপ হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন মানদণ্ডে-“মিথস্ক্রিয়া” বা এঙ্গেজমেন্ট। এই মিথস্ক্রিয়া-কেন্দ্রিক কাঠামোয় প্রভাবের চরিত্র মৌলিকভাবে বদলে গেছে। ছোট প্রভাবক বা ভিডিও নির্মাতারা গণনাবিধির সহায়তায় তৈরি করে প্রভাবের নতুন কাঠামো। গণনাবিধি মুনাফার স্বার্থে উত্তেজনা, নাটক ও বিভাজনকে উৎসাহিত করে। এখানে সংবাদের সত্যতা বা যুক্তির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আবেগকে দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা।
এর ফলে প্রভাব বিস্তার গণতান্ত্রিক হলেও তা প্রায়শই বিকৃত হয়, এবং সহানুভূতির চেয়ে ক্ষোভ ও নেতিবাচকতা দ্রুত ছড়ায়। ‘ভুয়া খবর’ এবং ‘ডিপ ফেক’ প্রযুক্তির উত্থান এই আবেগকে পুঁজি করে প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করেছে। এই এনগেজমেন্ট-কেন্দ্রিক কাঠামো সমাজকে এক নব্য-জ্ঞানতাত্ত্বিক (জ্ঞান সম্পর্কীয়) সংকটে ফেলেছে। যখন সত্য ও মিথ্যা, যুক্তি ও আবেগ একই ফ্রেমে বিবেচিত হয়, তখন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। সমাজে বিশ্বাসযোগ্যতা আর কোনো একক গুণ থাকে না, বরং তা নির্ভর করে কার প্রভাব কতটুকু শক্তিশালী, তার ওপর। এই কাঠামোয় প্রভাব বিস্তার মানে কেবল মত পরিবর্তন নয়, বরং মনোযোগের অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার।
ভার্চুয়াল আত্মপরিচয়ের এই সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক নতুন ধরনের পর্যবেক্ষণ-সংস্কৃতি। দার্শনিক মিশেল ফুকো তাঁর ‘সর্বক্ষণ-দর্শন’ ধারণায় দেখিয়েছিলেন যে, অদৃশ্য পর্যবেক্ষকের উপস্থিতির কারণে বন্দীরা নিজেরাই নিজেদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। আজ সামাজিক মাধ্যম সেই ধারণাটিকে আধুনিক রূপ দিয়েছে। এখন আর প্রহরী বাইরে থাকে না, আমরা নিজেরাই প্রহরী এবং একইসঙ্গে প্রদর্শিত। প্রতিটি পোস্ট, ভালো লাগা, মন্তব্য হয়ে দাঁড়ায় তথ্য, যা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের আচরণ। আমরা নিজেদের এমনভাবে ‘স্ব-পর্যবেক্ষণ’ বা ‘স্ব-সংবরণ’ করি, যাতে আমরা আমাদের ভার্চুয়াল গোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হই। এই নজরদারির সমাজে পরোপকারিতাও হয়ে যায় পণ্যÑমানবিকতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ নয়, বরং সামাজিক প্রতিযোগিতার উপকরণ।
অন্যদিকে, ভার্চুয়াল সহানুভূতি প্রায়ই ‘গোষ্ঠীগত নৈতিকতা’-এ পরিণত হয়-যেখানে সংহতি ও সহানুভূতি শুধু নিজের ভার্চুয়াল গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত থাকে, এবং বাইরের গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সহজে ঘৃণা বা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করা হয়। এটি সমাজের বিচ্ছিন্নতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ‘জেন জি’ এবং ‘জেন আলফা’-এর মতো নতুন প্রজন্ম এই পরিস্থিতিতে তাদের আত্মপরিচয় ভার্চুয়াল পরিসরে গঠন করে, যারা দ্রুত সহমর্মী হলেও অনেক সময় গভীর সংলাপ বা ধৈর্যের অভাব দেখায়। তাদের জীবন স্থানীয় ও বৈশ্বিক দুই বাস্তবতাকেই একইসঙ্গে ধারণ করে।
তবুও, এই পুরো চিত্র কেবল হতাশার নয়। বড় ধরনের সামাজিক আন্দোলনগুলো প্রমাণ করে, সামাজিক মাধ্যম নতুন ধরনের নৈতিক সংহতি তৈরি করতে পারেÑযা স্থান নয়, বরং অনুভূতি ও মতাদর্শের ভিত্তিতে একতার জন্ম দেয়। সমাজতত্ত্ববিদ এমিল দুর্খেইম যাকে বলেছিলেন “সমষ্টিগত উদ্দীপনা”-ভার্চুয়াল যুগে তা ফিরে এসেছে ভার্চুয়াল সংহতির আকারে। এই প্রসঙ্গে, ম্যাক্স ওয়েবারের দৃষ্টিতে, সামাজিক কর্মকে বুঝতে হবে তার ব্যক্তিগত অর্থ এবং সামাজিক ফলাফলের উভয় দিক থেকেই। কেউ যদি নিজেকে দেখানোর জন্য দানও করে, সেই কাজের সামাজিক প্রভাব তবুও ইতিবাচক। ভার্চুয়াল পরোপকারিতা হয়তো অমিশ্র নয়, কিন্তু এটি নৈতিকতার ধারণাকে জনপরিসরে সক্রিয় রাখে।
এই সংকটের সমাধান নিহিত আছে “প্রতিফলিত ভার্চুয়াল নাগরিকত্ব” বা সচেতন ভার্চুয়াল আচরণের মধ্যে। এটি মানে শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করা নয়, বরং দায়িত্বশীল সংলাপ এবং মানবিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার প্রয়াসে অংশগ্রহণ করা। এটি মানে গণনাবিধির পক্ষপাতিত্ব সম্পর্কে অবগত থাকা এবং আবেগভিত্তিক বাজারের পণ্য হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, দেশের তরুণ সমাজ ভার্চুয়াল মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তুলছে। কিন্তু একই সঙ্গে বাড়ছে ‘ভার্চুয়াল মঞ্চের কর্মকাণ্ড’-এর সীমাবদ্ধতা এবং বাস্তব সংলাপের অভাব। তাই এখন প্রয়োজন এমন এক সংস্কৃতি, যেখানে প্রভাব বিস্তার হবে সহমর্মিতার জন্য, আর পরোপকারিতা হবে বাস্তব মানবিকতার চর্চা। ভার্চুয়াল যুগের আত্মপরিচয় সংকট মানে আত্মবিলোপ নয়, বরং আত্মনির্মাণের নতুন পর্যায়। সেই অনুসন্ধানে যদি আমরা মানবিকতা, সহমর্মিতা ও সংলাপকে ধরে রাখতে পারি, তবে ভার্চুয়াল আয়নাও একদিন প্রতিফলিত করবে এক নতুন, ঐক্যবদ্ধ ও প্রতিফলিত মানব-সত্তা।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতিউর রহমান
রোববার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
বর্তমান বিশ্ব এমন এক ভার্চুয়াল যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে মানবজীবন ও সংস্কৃতির প্রায় প্রতিটি স্তর প্রযুক্তির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। যোগাযোগ এবং তথ্য আদান-প্রদানের এই মাধ্যমটি শুধু তথ্যের প্রবাহকেই বদলায়নি, বরং বদলে দিয়েছে মানুষের অস্তিত্বের সবচেয়ে মৌলিক ভিত্তি-আত্মপরিচয়। আজ ভালো লাগা (লাইক), ভাগ করা (শেয়ার), মন্তব্য এবং অনুসরণকারীর সংখ্যাই নতুন সামাজিক মাপকাঠি তৈরি করেছে, যা নির্ধারণ করে একজন মানুষের ভার্চুয়াল সামাজিক গুরুত্ব।
পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতির পরিসরে যে স্থির এবং সুসংহত আত্মপরিচয় একসময় গড়ে উঠত, তা আজ এই ভার্চুয়াল মঞ্চগুলোর অসংখ্য খণ্ডে ভাসমান ও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি কেবল মনের উদ্বেগ নয়, বরং এটি গভীর সমাজতাত্ত্বিক এক সংকট- যেখানে সামাজিক পরিচয়, পরোপকারিতা, সহমর্মিতা ও প্রভাব বিস্তার-এর মতো চিরায়ত ধারণাগুলো নতুন অর্থে গঠিত হচ্ছে। ভার্চুয়াল সভ্যতার এই ভাঙা আয়নায় মানুষ একদিকে যেমন দর্শক, তেমনি বহুধা বিভক্ত প্রতিফলনে নিজেদের অর্থও খুঁজে ফিরছে।
মানুষের আত্মপরিচয়ের মূলে রয়েছে ‘সম্পৃক্ততা’ বা যোগসূত্র। সমাজতত্ত্ববিদ হেনরি তাজফেল এবং জন টার্নার-এর ‘সামাজিক পরিচয় তত্ত্ব’ অনুসারে, মানুষ তার নিজের পরিচয় এবং আত্মমর্যাদার একটি বড় অংশ খুঁজে পায় সেইসব গোষ্ঠীর সঙ্গে যেখানে সে যুক্ত। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে এই গোষ্ঠীপরিচয়ের সীমানা আজ অত্যন্ত অস্পষ্ট ও পরিবর্তনশীল। এই জগৎ মানুষকে একইসঙ্গে একাধিক গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার সুযোগ দিয়েছে, যা তৈরি করেছে এক ধরনের ডিজিটাল বিখন্ডন। একেকটি সামাজিক মাধ্যম একেকটি মঞ্চ হিসেবে কাজ করে, যেখানে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করে। ফেসবুকে সে মানবিক বা পারিবারিক ভূমিকায়, টুইটারে সে তীক্ষè বা রাজনৈতিক, ইনস্টাগ্রামে তার পরিচয় নান্দনিক বা সফলতার প্রদর্শনী, আর লিংকডইনে সে সম্পূর্ণ পেশাদার।
আরভিং গফম্যানের ‘নাট্যশাস্ত্র’ তত্ত্বের সংযোগে বলা যায়, ভার্চুয়াল মঞ্চগুলি আমাদের জন্য নিত্যনতুন ‘মঞ্চ’ তৈরি করেছে, যেখানে মানুষ মূলত একটি ‘প্রদর্শনীমূলক পরিচয়’ নির্মাণ করে। পরিচয় তখন আর জীবনের গভীরে প্রোথিত নৈতিকতার অংশ থাকে না, বরং হয়ে ওঠে সামাজিক প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনের উপকরণ। এই বিভক্ত আত্মপরিচয় মানুষকে ক্রমে একরৈখিক সামাজিক নৈতিকতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, কারণ প্রতিটি মঞ্চে নৈতিকতার ভিন্ন মানদণ্ড তৈরি হয়। এর ফলস্বরূপ, সামাজিক সংহতির ভিত্তি দুর্বল হয় এবং নৈতিক বিচার হয়ে পড়ে পরিস্থিতি ও শ্রোতানির্ভর।
আত্মপরিচয়ের এই বিভাজনের প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পরোপকারিতা ও সমাজমুখী আচরণের ক্ষেত্রে। প্রথাগত সমাজে সহমর্মিতা জন্ম নিত সরাসরি মানবিক সম্পর্ক থেকে, আজ তা নির্ভর করে গণনাবিধির প্রবাহ এবং প্রদর্শনের সুযোগের ওপর। অনলাইনে সাহায্যের আহ্বান মুহূর্তে ছড়িয়ে গেলেও, সেই সাহায্য অনেক সময়ই মিশে থাকে আত্মপ্রদর্শনের আকাক্সক্ষার সঙ্গে, যা জন্ম দিয়েছে ‘হ্যাশট্যাগ মানবিকতা’ বা ‘ভার্চুয়াল মঞ্চের দয়া’-এর মতো নতুন সংস্কৃতির।
সমাজতত্ত্ববিদ পিয়ের বুর্দিয়োর “প্রতীকী মূলধনের” ধারণা এই প্রসঙ্গে নতুন আকারে ফিরে আসে। প্রতীকী মূলধন হলো সেই মর্যাদা, স্বীকৃতি বা সম্মান, যা সমাজে স্বীকৃত হয়। ভার্চুয়াল যুগে, নৈতিকতা নিজেই হয়ে ওঠে একধরনের সামাজিক বিনিয়োগ, যা মর্যাদা অর্জনের পথÑভার্চুয়াল দান বা সমাজসেবামূলক পোস্টের মাধ্যমে মানুষ কেবল সাহায্যই করে না, বরং নিজের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এটি প্রতীকী মূলধন হিসেবে কাজ করে, যা ভালো লাগা ও ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে সামাজিক বৈধতা অর্জন করে।
এই নৈতিক বিনিয়োগের চূড়ান্ত ফল হলো সমাজতত্ত্ববিদ জিগমুন্ট বাউমানের ধারণায় “তরল সহানুভূতি”। বাউমান তাঁর ‘তরল আধুনিকতা’ তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, আধুনিক যুগের সম্পর্কগুলো ‘তরল’-দ্রুত গঠিত হয়, দ্রুত ভেঙে যায় এবং কোনো স্থায়ী রূপ নেয় না। ভার্চুয়াল যুগে মানবিকতাও তাই ‘তরল সহানুভূতি’-এটি তীব্র কিন্তু ক্ষণস্থায়ী অনুভূতি। বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া কষ্ট বা অন্যায় মুহূর্তেই আমাদের পর্দায় এসে পৌঁছায়, কিন্তু সেই সহানুভূতি টেকে না।
মন দ্রুত ক্লান্ত হয় অতিরিক্ত উদ্দীপনায় বা ‘সহানুভূতির ক্লান্তি’-তে, ফলে একটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ঘটনা শেষ না হতেই অন্যটি আসে, আর নৈতিক দায়বদ্ধতা হয়ে পড়ে সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী। এটি এক ধরনের আবেগভিত্তিক বাজার অর্থনীতি, যেখানে স্থায়ী নৈতিক সংহতির চেয়ে সাময়িক ক্ষোভ বা সহানুভূতি দ্রুত ছড়ায় এবং বিক্রি হয়।
প্রথাগত সমাজে প্রভাব বিস্তার-এর মূল অস্ত্র ছিল বিশ্বাসযোগ্যতা, যুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা। কিন্তু ভার্চুয়াল সমাজে প্রভাবের পরিমাপ হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন মানদণ্ডে-“মিথস্ক্রিয়া” বা এঙ্গেজমেন্ট। এই মিথস্ক্রিয়া-কেন্দ্রিক কাঠামোয় প্রভাবের চরিত্র মৌলিকভাবে বদলে গেছে। ছোট প্রভাবক বা ভিডিও নির্মাতারা গণনাবিধির সহায়তায় তৈরি করে প্রভাবের নতুন কাঠামো। গণনাবিধি মুনাফার স্বার্থে উত্তেজনা, নাটক ও বিভাজনকে উৎসাহিত করে। এখানে সংবাদের সত্যতা বা যুক্তির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আবেগকে দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা।
এর ফলে প্রভাব বিস্তার গণতান্ত্রিক হলেও তা প্রায়শই বিকৃত হয়, এবং সহানুভূতির চেয়ে ক্ষোভ ও নেতিবাচকতা দ্রুত ছড়ায়। ‘ভুয়া খবর’ এবং ‘ডিপ ফেক’ প্রযুক্তির উত্থান এই আবেগকে পুঁজি করে প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করেছে। এই এনগেজমেন্ট-কেন্দ্রিক কাঠামো সমাজকে এক নব্য-জ্ঞানতাত্ত্বিক (জ্ঞান সম্পর্কীয়) সংকটে ফেলেছে। যখন সত্য ও মিথ্যা, যুক্তি ও আবেগ একই ফ্রেমে বিবেচিত হয়, তখন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। সমাজে বিশ্বাসযোগ্যতা আর কোনো একক গুণ থাকে না, বরং তা নির্ভর করে কার প্রভাব কতটুকু শক্তিশালী, তার ওপর। এই কাঠামোয় প্রভাব বিস্তার মানে কেবল মত পরিবর্তন নয়, বরং মনোযোগের অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার।
ভার্চুয়াল আত্মপরিচয়ের এই সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক নতুন ধরনের পর্যবেক্ষণ-সংস্কৃতি। দার্শনিক মিশেল ফুকো তাঁর ‘সর্বক্ষণ-দর্শন’ ধারণায় দেখিয়েছিলেন যে, অদৃশ্য পর্যবেক্ষকের উপস্থিতির কারণে বন্দীরা নিজেরাই নিজেদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। আজ সামাজিক মাধ্যম সেই ধারণাটিকে আধুনিক রূপ দিয়েছে। এখন আর প্রহরী বাইরে থাকে না, আমরা নিজেরাই প্রহরী এবং একইসঙ্গে প্রদর্শিত। প্রতিটি পোস্ট, ভালো লাগা, মন্তব্য হয়ে দাঁড়ায় তথ্য, যা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের আচরণ। আমরা নিজেদের এমনভাবে ‘স্ব-পর্যবেক্ষণ’ বা ‘স্ব-সংবরণ’ করি, যাতে আমরা আমাদের ভার্চুয়াল গোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হই। এই নজরদারির সমাজে পরোপকারিতাও হয়ে যায় পণ্যÑমানবিকতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ নয়, বরং সামাজিক প্রতিযোগিতার উপকরণ।
অন্যদিকে, ভার্চুয়াল সহানুভূতি প্রায়ই ‘গোষ্ঠীগত নৈতিকতা’-এ পরিণত হয়-যেখানে সংহতি ও সহানুভূতি শুধু নিজের ভার্চুয়াল গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত থাকে, এবং বাইরের গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সহজে ঘৃণা বা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করা হয়। এটি সমাজের বিচ্ছিন্নতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ‘জেন জি’ এবং ‘জেন আলফা’-এর মতো নতুন প্রজন্ম এই পরিস্থিতিতে তাদের আত্মপরিচয় ভার্চুয়াল পরিসরে গঠন করে, যারা দ্রুত সহমর্মী হলেও অনেক সময় গভীর সংলাপ বা ধৈর্যের অভাব দেখায়। তাদের জীবন স্থানীয় ও বৈশ্বিক দুই বাস্তবতাকেই একইসঙ্গে ধারণ করে।
তবুও, এই পুরো চিত্র কেবল হতাশার নয়। বড় ধরনের সামাজিক আন্দোলনগুলো প্রমাণ করে, সামাজিক মাধ্যম নতুন ধরনের নৈতিক সংহতি তৈরি করতে পারেÑযা স্থান নয়, বরং অনুভূতি ও মতাদর্শের ভিত্তিতে একতার জন্ম দেয়। সমাজতত্ত্ববিদ এমিল দুর্খেইম যাকে বলেছিলেন “সমষ্টিগত উদ্দীপনা”-ভার্চুয়াল যুগে তা ফিরে এসেছে ভার্চুয়াল সংহতির আকারে। এই প্রসঙ্গে, ম্যাক্স ওয়েবারের দৃষ্টিতে, সামাজিক কর্মকে বুঝতে হবে তার ব্যক্তিগত অর্থ এবং সামাজিক ফলাফলের উভয় দিক থেকেই। কেউ যদি নিজেকে দেখানোর জন্য দানও করে, সেই কাজের সামাজিক প্রভাব তবুও ইতিবাচক। ভার্চুয়াল পরোপকারিতা হয়তো অমিশ্র নয়, কিন্তু এটি নৈতিকতার ধারণাকে জনপরিসরে সক্রিয় রাখে।
এই সংকটের সমাধান নিহিত আছে “প্রতিফলিত ভার্চুয়াল নাগরিকত্ব” বা সচেতন ভার্চুয়াল আচরণের মধ্যে। এটি মানে শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করা নয়, বরং দায়িত্বশীল সংলাপ এবং মানবিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার প্রয়াসে অংশগ্রহণ করা। এটি মানে গণনাবিধির পক্ষপাতিত্ব সম্পর্কে অবগত থাকা এবং আবেগভিত্তিক বাজারের পণ্য হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, দেশের তরুণ সমাজ ভার্চুয়াল মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তুলছে। কিন্তু একই সঙ্গে বাড়ছে ‘ভার্চুয়াল মঞ্চের কর্মকাণ্ড’-এর সীমাবদ্ধতা এবং বাস্তব সংলাপের অভাব। তাই এখন প্রয়োজন এমন এক সংস্কৃতি, যেখানে প্রভাব বিস্তার হবে সহমর্মিতার জন্য, আর পরোপকারিতা হবে বাস্তব মানবিকতার চর্চা। ভার্চুয়াল যুগের আত্মপরিচয় সংকট মানে আত্মবিলোপ নয়, বরং আত্মনির্মাণের নতুন পর্যায়। সেই অনুসন্ধানে যদি আমরা মানবিকতা, সহমর্মিতা ও সংলাপকে ধরে রাখতে পারি, তবে ভার্চুয়াল আয়নাও একদিন প্রতিফলিত করবে এক নতুন, ঐক্যবদ্ধ ও প্রতিফলিত মানব-সত্তা।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]