শেখর ভট্টাচার্য

শ্রাবণ, ভাদ্রের হাওরে কুল নাই। দূর দিগন্তে তাকালে বিস্তৃত জলরাশি
শ্রাবণ, ভাদ্রের হাওরে কুল নাই। দূর দিগন্তে তাকালে বিস্তৃত জলরাশি। তীব্র ঢেউ। হাওরের তীব্র ঢেউয়ের নাম “আফাল”। বর্ষায় ঘন ঘন “আফাল”। পাহাড়ের মতো আফাল তছনছ করে দেয় সব কিছু। নৌকা, মাঝি, ছোট ছোট গাছসহ যা পায় গিলে খায়। সাক্ষাৎ দৈত্য। ডিঙি নৌকা কিংবা বড় নৌকার মাঝিরা টের পেয়ে যায়। আকাশের দিকে তাকালে হাওরের জলের খবর জানা হয়ে যায় মাঝিদের। একটি স্বল্প দৈর্ঘ, স্বল্প তীব্র “সমুদ্রে সাইক্লোনের” রূপ হলো আফাল। বর্ষাকালে মোহনগঞ্জ থেকে “ডিঙ্গাপোতা” হাওর দিয়ে সুনামগঞ্জের পথে রওয়ানা হলে আফালের দেখা পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাঝি টের পেয়ে গেলে দ্রুত নিরাপদ জায়গায় নৌকা ভিড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করে। জীবন বেঁচে যায়। মাঝি ভুল করলে আফালের জল গিলে খায়। প্রতি বছর কতো মানুষ আফালের জলে ভেসে যায়। আর ফিরে আসে না।
হাওরের পথে মালবাহী অজস্র নৌকা চলে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ইট, সিমেন্ট নিয়ে ভৈরব, কিশোরগঞ্জের হাওর দিয়ে সুনামগঞ্জ। মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর হয়ে যাত্রি নৌকা , মালের নৌকা নদীর ঢেউ কেটে কেটে এগিয়ে যায়। সে এক অন্য জীবন। নৌকায় রাঁধা , নৌকায় খাওয়া, নৌকায় ঘুম। বর্ষায় হাওর জেগে ওঠে। জেলেরা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মাছ ধরে নানারকম জাল দিয়ে। নিজের নাও, নিজের জাল হলে নিজের মাছ। মহাজনের নাওয়ে উঠলে অন্য হিসাব। মহাজনের কামলা কিংবা মজুর। টনে টনে মাছ ধরে মহাজনের অন্য মাছের নৌকায় তুলে দিতে হয়। মাছ ভর্তি নৌকা চলে যায় কুলিয়ারচর, ভৈরব। মহাজনের আড়ত আছে ওখানে। আড়ত থেকে লক্ষ, কোটি টাকার মাছ সারা দেশে চলে যায়। হাওরের রুই, কাতলা, বোয়াল, পাবদাসহ জানা-অজানা নামের দেশী মাছ ধরে যে জেলে তার ধরা মাছ থেকে একটি মাছও বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অধিকার নেই। ফেরার পথে হয়তো মজুরির টাকা দিয়ে স্থানীয় হাট থেকে চাষের পাঙ্গাশ মাছ কিনে বাড়িতে ফিরে যেতে হয়। এ যেনো সুকান্তের সেই কবিতার পঙ্ক্তি “আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, যে সন্ধ্যায়, রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে, অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য, নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।“ হাওরে এরকম অসংখ্য সুখ-দুঃখের গল্প উড়ে বেড়ায়। হাওরের জীবন ও জীবিকাকে জানতে হলে হাওরের মাটির সাথে আত্মীয়তা করতে হয়। হাওরের করচ, হিজলের ছায়ায় মায়ায় নিজেকে বাঁধতে না পারলে হাওর জীবনকে উপলব্ধি করা যায় না।
প্রকৃতি, জীবন, জীবিকা, প্রেম, ভালোবাসা, উৎসব সব কিছুর রূপ পাল্টায় মাসে মাসে, ঋতুতে ঋতুতে। বর্ষা হলো দূর দিগন্তে, হাটে বাজারে, আত্মীয় কুটুম্বের বাড়িতে বেড়ানোর জন্য সব চেয়ে সুবিধার সময়। হাওরের প্রধান বাহন নৌকা তখন ছুটে বেড়ায় এ’গ্রাম থেকে ও গ্রামে। নিজের নৌকা না থাকলে অসুবিধা নেই। ফেরির নৌকা যায় না এমন কোনো জায়গা নেই। হাওরের শিশুরা স্কুলে যায় ফেরির নৌকায়। এ এক অসাধারণ দৃশ্য। হাওরের বিয়েশাদি হয় বর্ষাকালে। থই থই জলের উপর দিয়ে কাগজ দিয়ে সাজানো নৌকা দিয়ে যায় বর, কনের বাড়ি। নৌকায় মাইক বাজে। ছেলে মেয়েরা নাচতে থাকে। ফেরার পথে নতুন বউকে নিয়ে রং-ঢং করতে করতে বাড়ি ফেরে বরযাত্রীরা। বিয়ের নাও দেখলেই অন্য নাও থেকে মানুষ আনন্দে হৈহৈ করে ওঠে। ভরা শীতে যখন মাছের দেখা নেই পুরুষেরা চলে যায় শহর, গঞ্জে কাজের খোঁজে। দরিদ্র জেলে পরিবারে ভীষণ দুঃখ নেমে আসে। বাড়ির আশে পাশে জাল ছোঁড়ে সামান্য যা মাছ পাওয়া যায় তা’ দিয়ে ডাল ভাতের ব্যবস্থা হয়। পাওয়া না গেলে উপোস থাকতে হয়।
হাওরের শরীরে যতো বেশি জল, ঢেউয়ের জোর ততো বাড়ে। ঢেউয়ের জোর বাড়লে বাড়ি ঘর, স্কুল, হাট বাজার স্রোতের তোড়ে ভেঙে যায়। হাওরের বাড়িগুলো যেখানে থাকে সে জায়গা গুলোকে বলে আটি বা হাটি। হাটি বড় হলে কখনো এক হাটিতেই গ্রাম। আবার ছোট হলে দু-তিনটি হাটি মিলে একটি গ্রাম। হাওরের হাটিগুলো বর্ষাকালে একটি বড় স্টিমার বা জাহাঝের মতো মনে হয়। চারদিকে জল। একটি হাটি যখন বিচ্ছিন্ন থাকে তখন মনে হয় সমুদ্রের মধ্যে একটি একটি স্টিমার ভাসছে। বর্ষায় বড় ভয় হাওর জনপদে। বাড়ি ঘর হারানোর ভয়। সারা রাত ভর স্রোত এসে আঘাত করে হাটিতে। মাটি ক্ষয়ে যায়। ক্ষয়ে যেতে যেতে এক সময় হাটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। খুঁজতে হয় নতুন হাটি কিংবা সবাই মিলে মাটি দিয়ে হাটি তৈরি করতে হয়। অনেক শ্রম, ঘাম, অর্থ লাগে। যদি অর্থ না থাকে হাটি বিলীন হওয়ার সাথে সাথে মানুষগুলোও হাওর এলাকা থেকে উবে যায়। অন্য গ্রাম, অন্য গঞ্জ, অন্য শহর। এই যে পাড়া পড়শীর গভীর আত্মীয়তা, তার সূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। শেকড়ের সাথে বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। আবার জীবনযুদ্ধ, আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা।
জীবিকার কারণে দশটি বছর নিরবিচ্ছিন্ন হাওর জীবন দেখার সুযোগ হয়েছে। হাওরের মানুষের মন উদার ও বিস্তীর্ণ। হাওরের বিস্তীর্নতার প্রতিফলন হাওরের মানুষের মনে। অধিকাংশ মানুষ কিছুটা ভাবুক। নৌকা নিয়ে অবারিত প্রান্তরে ঘুরে বেড়ালে মনতো ভাব সাগরে ডুব দেবেই। হাওরের প্রকৃতি থেকেই তাই উঠে আসেন হাছন, রাধারমন, শাহ করিমসহ অগণন মরমী সাধক। বস্তুগত জীবন তাদের কাছে তাই অর্থহীন। জমিদার হাছন তাই বিলিয়ে দেন হাজার হাজার একর জমি মানুষের মাঝে। জাগতিক সংকীর্নতা দুঃখ দেয়। বিলাস, ব্যাসন অমূল্য নয়। তাই তো হাছন বলে ওঠেন, “কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার, লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার।“ হাওরের মানুষের উদাসী মনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, হাওরের মধ্যেই তাদের স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। হাওরের বাড়ি, হাটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এক সময়ের জলাবনকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। হিজল, করচ বৃক্ষ এক সময় হাওরের হাটি গুলোকে ঢেউ থেকে রক্ষা করতো। সেই প্রাকৃতিক প্রতিরোধ মানুষ ধ্বংস করেছে। হাওর রক্ষার জন্য তাই আবার জলাবন তৈরি করতে হবে। হাওরের মধ্য দিয়ে স্থায়ী পাকা কিংবা পিচঢালা পথ তৈরি করা বন্ধ না হলে হাওরের প্রকৃতি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাবে।
অগ্রহায়নে হাওরের জমির সোনালী ধান, উৎসব, আনন্দ, বাউল গানকে বাঁচাতে হলে হাওর নিয়ে ভাবতে হবে গভীর ভাবে। হাওরের সম্ভাবনা অপার। প্রাকৃতিক মাছ, ধান হলো প্রধান সম্পদ যা সারা দেশের অর্থনীতির পালে হাওয়া দিচ্ছে অবিরত। হাওরে পরিকল্পিত পর্যটনের অসীম সম্ভাবনাকেও কাজে লাগাতে হবে। হাওরের মানুষের উদার, উদাস মানসিকতা, মানবিক মানুষ হওয়ার পথ দেখায়। মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, সংকীর্নতাকে দূর করতে হলে হাওরের চিরায়ত সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হবে। হাওর বাঁচলে তাই হাওরের সংস্কৃতিও বাঁচবে।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
শেখর ভট্টাচার্য

শ্রাবণ, ভাদ্রের হাওরে কুল নাই। দূর দিগন্তে তাকালে বিস্তৃত জলরাশি
রোববার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
শ্রাবণ, ভাদ্রের হাওরে কুল নাই। দূর দিগন্তে তাকালে বিস্তৃত জলরাশি। তীব্র ঢেউ। হাওরের তীব্র ঢেউয়ের নাম “আফাল”। বর্ষায় ঘন ঘন “আফাল”। পাহাড়ের মতো আফাল তছনছ করে দেয় সব কিছু। নৌকা, মাঝি, ছোট ছোট গাছসহ যা পায় গিলে খায়। সাক্ষাৎ দৈত্য। ডিঙি নৌকা কিংবা বড় নৌকার মাঝিরা টের পেয়ে যায়। আকাশের দিকে তাকালে হাওরের জলের খবর জানা হয়ে যায় মাঝিদের। একটি স্বল্প দৈর্ঘ, স্বল্প তীব্র “সমুদ্রে সাইক্লোনের” রূপ হলো আফাল। বর্ষাকালে মোহনগঞ্জ থেকে “ডিঙ্গাপোতা” হাওর দিয়ে সুনামগঞ্জের পথে রওয়ানা হলে আফালের দেখা পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাঝি টের পেয়ে গেলে দ্রুত নিরাপদ জায়গায় নৌকা ভিড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করে। জীবন বেঁচে যায়। মাঝি ভুল করলে আফালের জল গিলে খায়। প্রতি বছর কতো মানুষ আফালের জলে ভেসে যায়। আর ফিরে আসে না।
হাওরের পথে মালবাহী অজস্র নৌকা চলে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ইট, সিমেন্ট নিয়ে ভৈরব, কিশোরগঞ্জের হাওর দিয়ে সুনামগঞ্জ। মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর হয়ে যাত্রি নৌকা , মালের নৌকা নদীর ঢেউ কেটে কেটে এগিয়ে যায়। সে এক অন্য জীবন। নৌকায় রাঁধা , নৌকায় খাওয়া, নৌকায় ঘুম। বর্ষায় হাওর জেগে ওঠে। জেলেরা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মাছ ধরে নানারকম জাল দিয়ে। নিজের নাও, নিজের জাল হলে নিজের মাছ। মহাজনের নাওয়ে উঠলে অন্য হিসাব। মহাজনের কামলা কিংবা মজুর। টনে টনে মাছ ধরে মহাজনের অন্য মাছের নৌকায় তুলে দিতে হয়। মাছ ভর্তি নৌকা চলে যায় কুলিয়ারচর, ভৈরব। মহাজনের আড়ত আছে ওখানে। আড়ত থেকে লক্ষ, কোটি টাকার মাছ সারা দেশে চলে যায়। হাওরের রুই, কাতলা, বোয়াল, পাবদাসহ জানা-অজানা নামের দেশী মাছ ধরে যে জেলে তার ধরা মাছ থেকে একটি মাছও বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অধিকার নেই। ফেরার পথে হয়তো মজুরির টাকা দিয়ে স্থানীয় হাট থেকে চাষের পাঙ্গাশ মাছ কিনে বাড়িতে ফিরে যেতে হয়। এ যেনো সুকান্তের সেই কবিতার পঙ্ক্তি “আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, যে সন্ধ্যায়, রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে, অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য, নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।“ হাওরে এরকম অসংখ্য সুখ-দুঃখের গল্প উড়ে বেড়ায়। হাওরের জীবন ও জীবিকাকে জানতে হলে হাওরের মাটির সাথে আত্মীয়তা করতে হয়। হাওরের করচ, হিজলের ছায়ায় মায়ায় নিজেকে বাঁধতে না পারলে হাওর জীবনকে উপলব্ধি করা যায় না।
প্রকৃতি, জীবন, জীবিকা, প্রেম, ভালোবাসা, উৎসব সব কিছুর রূপ পাল্টায় মাসে মাসে, ঋতুতে ঋতুতে। বর্ষা হলো দূর দিগন্তে, হাটে বাজারে, আত্মীয় কুটুম্বের বাড়িতে বেড়ানোর জন্য সব চেয়ে সুবিধার সময়। হাওরের প্রধান বাহন নৌকা তখন ছুটে বেড়ায় এ’গ্রাম থেকে ও গ্রামে। নিজের নৌকা না থাকলে অসুবিধা নেই। ফেরির নৌকা যায় না এমন কোনো জায়গা নেই। হাওরের শিশুরা স্কুলে যায় ফেরির নৌকায়। এ এক অসাধারণ দৃশ্য। হাওরের বিয়েশাদি হয় বর্ষাকালে। থই থই জলের উপর দিয়ে কাগজ দিয়ে সাজানো নৌকা দিয়ে যায় বর, কনের বাড়ি। নৌকায় মাইক বাজে। ছেলে মেয়েরা নাচতে থাকে। ফেরার পথে নতুন বউকে নিয়ে রং-ঢং করতে করতে বাড়ি ফেরে বরযাত্রীরা। বিয়ের নাও দেখলেই অন্য নাও থেকে মানুষ আনন্দে হৈহৈ করে ওঠে। ভরা শীতে যখন মাছের দেখা নেই পুরুষেরা চলে যায় শহর, গঞ্জে কাজের খোঁজে। দরিদ্র জেলে পরিবারে ভীষণ দুঃখ নেমে আসে। বাড়ির আশে পাশে জাল ছোঁড়ে সামান্য যা মাছ পাওয়া যায় তা’ দিয়ে ডাল ভাতের ব্যবস্থা হয়। পাওয়া না গেলে উপোস থাকতে হয়।
হাওরের শরীরে যতো বেশি জল, ঢেউয়ের জোর ততো বাড়ে। ঢেউয়ের জোর বাড়লে বাড়ি ঘর, স্কুল, হাট বাজার স্রোতের তোড়ে ভেঙে যায়। হাওরের বাড়িগুলো যেখানে থাকে সে জায়গা গুলোকে বলে আটি বা হাটি। হাটি বড় হলে কখনো এক হাটিতেই গ্রাম। আবার ছোট হলে দু-তিনটি হাটি মিলে একটি গ্রাম। হাওরের হাটিগুলো বর্ষাকালে একটি বড় স্টিমার বা জাহাঝের মতো মনে হয়। চারদিকে জল। একটি হাটি যখন বিচ্ছিন্ন থাকে তখন মনে হয় সমুদ্রের মধ্যে একটি একটি স্টিমার ভাসছে। বর্ষায় বড় ভয় হাওর জনপদে। বাড়ি ঘর হারানোর ভয়। সারা রাত ভর স্রোত এসে আঘাত করে হাটিতে। মাটি ক্ষয়ে যায়। ক্ষয়ে যেতে যেতে এক সময় হাটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। খুঁজতে হয় নতুন হাটি কিংবা সবাই মিলে মাটি দিয়ে হাটি তৈরি করতে হয়। অনেক শ্রম, ঘাম, অর্থ লাগে। যদি অর্থ না থাকে হাটি বিলীন হওয়ার সাথে সাথে মানুষগুলোও হাওর এলাকা থেকে উবে যায়। অন্য গ্রাম, অন্য গঞ্জ, অন্য শহর। এই যে পাড়া পড়শীর গভীর আত্মীয়তা, তার সূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। শেকড়ের সাথে বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। আবার জীবনযুদ্ধ, আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা।
জীবিকার কারণে দশটি বছর নিরবিচ্ছিন্ন হাওর জীবন দেখার সুযোগ হয়েছে। হাওরের মানুষের মন উদার ও বিস্তীর্ণ। হাওরের বিস্তীর্নতার প্রতিফলন হাওরের মানুষের মনে। অধিকাংশ মানুষ কিছুটা ভাবুক। নৌকা নিয়ে অবারিত প্রান্তরে ঘুরে বেড়ালে মনতো ভাব সাগরে ডুব দেবেই। হাওরের প্রকৃতি থেকেই তাই উঠে আসেন হাছন, রাধারমন, শাহ করিমসহ অগণন মরমী সাধক। বস্তুগত জীবন তাদের কাছে তাই অর্থহীন। জমিদার হাছন তাই বিলিয়ে দেন হাজার হাজার একর জমি মানুষের মাঝে। জাগতিক সংকীর্নতা দুঃখ দেয়। বিলাস, ব্যাসন অমূল্য নয়। তাই তো হাছন বলে ওঠেন, “কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার, লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার।“ হাওরের মানুষের উদাসী মনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, হাওরের মধ্যেই তাদের স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। হাওরের বাড়ি, হাটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এক সময়ের জলাবনকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। হিজল, করচ বৃক্ষ এক সময় হাওরের হাটি গুলোকে ঢেউ থেকে রক্ষা করতো। সেই প্রাকৃতিক প্রতিরোধ মানুষ ধ্বংস করেছে। হাওর রক্ষার জন্য তাই আবার জলাবন তৈরি করতে হবে। হাওরের মধ্য দিয়ে স্থায়ী পাকা কিংবা পিচঢালা পথ তৈরি করা বন্ধ না হলে হাওরের প্রকৃতি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাবে।
অগ্রহায়নে হাওরের জমির সোনালী ধান, উৎসব, আনন্দ, বাউল গানকে বাঁচাতে হলে হাওর নিয়ে ভাবতে হবে গভীর ভাবে। হাওরের সম্ভাবনা অপার। প্রাকৃতিক মাছ, ধান হলো প্রধান সম্পদ যা সারা দেশের অর্থনীতির পালে হাওয়া দিচ্ছে অবিরত। হাওরে পরিকল্পিত পর্যটনের অসীম সম্ভাবনাকেও কাজে লাগাতে হবে। হাওরের মানুষের উদার, উদাস মানসিকতা, মানবিক মানুষ হওয়ার পথ দেখায়। মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, সংকীর্নতাকে দূর করতে হলে হাওরের চিরায়ত সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হবে। হাওর বাঁচলে তাই হাওরের সংস্কৃতিও বাঁচবে।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]