alt

সাময়িকী

রুবেন দারিও-র কবিতা

অনুবাদ: কামরুল ইসলাম

: বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

রুবেন দারিও

আমরা জানি ‘ মদের্নিসমো সাহিত্য আন্দোলন’-এ রুবেন দারিও-রবলিষ্ঠ নেতৃত্বের কথা। এই আন্দোলন ছিল লাতিন আমেরিকার মাটি থেকে উত্থিত এবং এই অঞ্চলের হাওয়া-জলে বিকশিত। এটি পশ্চিমের আধুনিকতাবাদী আন্দোলন থেকে আলাদাভাবে গড়ে উঠেছিল। মাত্র ৪৯ বছরের জীবনে কবিতা নিয়ে, কবিতার আধুনিকায়নে তার শ্রম ও নিষ্ঠা কবিতাপ্রেমিক মানুষের স্মরণে থাকবে অনেককাল। গত শতাব্দীর শেষের দিকে, স্প্যানিশ-ভাষী বিশ্বের কবিতা ছিল নিস্তেজ, দুর্বল, মৃতপ্রায়। এর জন্য প্রয়োজন ছিল নতুন জীবন এবং একটি নতুন দিকনির্দেশনা। নিকারাগুয়ার ফেলিক্স রুবেন গার্সিয়া সারমিয়েন্টো (১৮৬৭-১৯১৬), যিনি নিজেকে রুবেন দারিও বলে ডাকতেন, স্প্যানিশ কবিতার গতিপথ পরিবর্তন করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন এবং এটিকে বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার মূলধারায় নিয়ে এসেছিলেন। সেই সময়ের ফরাসি কবিতার দিকে তার মনোযোগ ছিল প্রবল। আফ্রিকান কবিতা থেকেও তিনি অনেক কিছু গ্রহণ করেছিলেন। প্রবল প্রভাবসঞ্চারী এই কবি লাতিন কবিতার আধুনিক পর্বের বাতাবরণ তৈরি করে দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রুবেন দারিও (১৮৬৭-১৯১৬) স্ত্রী ফ্রান্সিসকা ও দুই পুত্র সন্তানকে ফেলে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কবিতাগুলো পড়তে শুরু করেন। ১৯১৫ সালের শেষদিকে নিকারাগুয়ায় ফিরে আসেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর কূটনৈতিক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে প্যারিসে চলে যান। সেখানে তিনি তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই লেখার কাজ শুরু করেন। সেখানে অবস্থানকালে অতিরিক্ত মধ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। এসময়ে তিনি বার বার শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পতিত হন। তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। ১৯১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৪৯ বছর বয়সে লিওনে তাঁর মৃত্যু হয়। শবানুষ্ঠানে তাঁকে অভূতপূর্ব সম্মান দেখানো হয়েছিল। ১৯১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শহরের গির্জায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। বিশ^কবিতার আধুনিকায়নে লাতিন আমেরিকার এই কবির অবদান চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। কারণ, তার পরে লাতিন ভূখ-ে যাঁরা কবিতা লিখতে এসেছেন, প্রায় সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে তাঁর কবিতা থেকে নতুন কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।

তিনি দূর সময়ের কবি। চিত্রকল্প নির্মাণের কলাকৌশল, মিথের নানামাত্রিক ব্যবহার কিংবা উল্লেখ, ইতিহাস ও বিভিন্ন শিল্পকলা থেকে গ্রহণ তাঁর কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে, অন্তর্লীন সৌন্দর্যে সমীকৃত করেছে। অ জড়ড়ংবাবষঃ কবিতায় তিনি লাতিন দেশসমূহে আমেরিকার আগ্রাসী সা¤্রাজ্যবিস্তারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। আমেরিকা তার শ্রেষ্ঠত্বকে জাহির করতে লাতিন আমেরিকার স্বাধীনতা ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক আবহকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে- এসব নিয়ে তিনি তাঁর উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন এই কবিতায়। তাঁর কবিতার মধ্যে জীবন ও জগতের সেইসব পথের সন্ধান মেলে, যার দিকে তাকালে যে কোনো কবিতা-পাঠকের মনে হবে, তিনি যেন আমার জন্যই এখনই লিখলেন এই কবিতা। ‘আগামীকাল লাশ হয়ে যাবার নিশ্চিত আতঙ্ক’ যেমন ঘিরে রাখে আমাদের, তেমনি এই অতলান্ত প্রশ্নও জীবনব্যাপী আমাদের তাড়া করে ফেরে-‘আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি: কখন ভোর হবে?’ তিনি অজানা-অচেনা আমেরিকার মৃত্তিকার গভীরে চাষ করে যে সব অমূল্য রতনের সন্ধান করেছেন এবং বিশেষ করে কবিতার সোনা ফলিয়েছেন, তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁরই কবিতার পঙ্ক্তি- ‘জীবিত থাকার মতো আর কোনো বড় যন্ত্রণা নেই’। এই যন্ত্রণাময় পথের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেছেন এই কবি নিজের মাটি ও বিপন্ন-রক্তাক্ত মানুষের নিরাসক্ত আইডেন্টিটির সন্ধানে, যারা কালের কুয়াশায় ছিল অদৃশ্য। রুবেন দারিও আত্মবিশ^াসের সাথে বলেছেন- গু ঢ়রপশ রং ড়িৎশরহম ফববঢ় রহ ঃযব ংড়রষ ড়ভ ঃযরং ঁহশহড়হি অসবৎরপধ, ঃঁৎহরহম ড়ঁঃ মড়ষফ ধহফ ড়ঢ়ধষং ধহফ ঢ়ৎবপরড়ঁং ংঃড়হবং, ধহ ধষঃধৎ, ধ নৎড়শবহ ংঃধঃঁব. অহফ ঃযব গঁংব ফরারহবং ঃযব সবধহরহম ড়ভ ঃযব যরবৎড়মষুঢ়যরপং. ঞযব ংঃৎধহমব ষরভব ড়ভ ধ াধহরংযবফ ঢ়বড়ঢ়ষব বসবৎমবং ভৎড়স ঃযব সরংঃ ড়ভ ঃরসব. অনূদিত কবিতাগুলো ঝবষবপঃবফ চড়বসং ( ২০২০) এর অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো অফধস ঋবরহংঃবরহ স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।

একটি খোলক

আমি তীরে পড়ে থাকতে দেখলাম একটি সোনালি খোলক

বৃহদায়তনের, দন্তচিকিৎসকের চিত্র-শোভিত মুক্তোর মতো;

ইউরোপা তা স্পর্শ করলো তার স্বর্গীয় হাত দিয়ে

যখন ঐশ^রিক ষাঁড়ের মতো এই সমুদ্র সেপার হলো

আমি আমার ঠোঁটের কাছে তুলে আনলাম এই বাজতে থাকা খোলকটি

এবং জাগিয়ে তুললাম সমুদ্রের প্রভাতী ড্রাম পেটানোর আবহ

আমি এটা আমার কানের কাছে ধরলাম, গোপন সম্পদের

নীল খনিগুলো আমার সাথে অনুচ্চস্বরে কথা বলল।

এভাবেই ঐসব তীক্ষè ঝড়ের লবণ আমার দিকে আসে

আরগো তার ভেতরে স্ফীত পালগুলো অনুভব করল

যখন স্বর্গের নক্ষত্রেরা খুব ভালোবেসেছিল জেসনের স্বপ্ন:

একটি অচেনা কণ্ঠস্বর ‘মধ্যতরঙ্গের শব্দ, গভীর স্ফীত সমুদ্র

এবং রহস্যময় বাতাস আমি দেখি’।

(এটা যেন হৃদয়ের আকৃতির, ঐ বেজে যাওয়া খোলক)।

নিশীথচিত্র

রাতের নীরবতা, একটা বিষণœ, নিশাচর নৈঃশব্দ্য-

আমার আত্মা কেন কেঁপে উঠছে?

আমি আমার রক্তের গুনগুন শুনি,

এবং একটি সরল ঝড় আমার মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে বহে যায়।

নিদ্রাহীনতা! ঘুমোতে পারি না, আমার স্বপ্ন দেখাও হয় নি।

আমি আত্মার ব্যবচ্ছেদের স্বয়ংক্রিয় নমুনা, স্বয়ংক্রিয় হ্যামলেট!

অন্ধকারের বিস্ময়কর স্ফটিক কিংবা রাতের শরাবে

আমার দুঃখগুলো তরলিত করার জন্য-

আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি: কখন ভোর হবে?

কেউ বন্ধ করেছে দরজা

কেউ পাশ দিয়ে হঁটে চলে গেছে-

ঘড়িতে তিনটা বাজার শব্দ- এটা যদি সে হতো!

নশ^রতা

গাছেরা সুখী কারণ কোনোকিছু অনুভব করার ক্ষমতা তাদের প্রায়ই নেই;

কঠিন শিলা অধিকতর সুখী, এটা কিছুই অনুভব করে না:

জীবিত থাকার মতো আর কোনো বড়ো যন্ত্রণা নেই,

সচেতন জীবনের চেয়ে আর কোনো বোঝা নেই অতোটা ভারি।

কী হবো তার কিছুই জানা নেই, পথ জানা নেই,

যা হয়েছি সেটাও ভয়ের, ভবিষ্যৎ আতঙ্কের...

এবং আগামীকাল লাশ হয়ে যাবার নিশ্চিত আতঙ্ক,

সারাজীবন কষ্ট পাওয়া, অন্ধকারের মধ্য দিয়ে হাঁটা,

কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি জানি না আমরা, সন্দেহও করি না

আর যে মাংস শীতল আঙ্গুর গুচ্ছের সাথে আমাদের প্রলুব্ধ করে,

এবং সমাধি যা আমাদের অপেক্ষায় রাখে সুগন্ধিজলসহ,

জানি না আমরা কোথায় যাবো,

এবং কোথা থেকে এসেছি...

শরতে যা ঘটেছিল

আমি জানি এমন মানুষ আছে যারা জিজ্ঞেস করে: সে কেন

আগের মতো একইধরনের বুনো সুরে গান করে না?

কিন্তু তারা দেখে নাই এক ঘণ্টার শ্রম, এক মিনিটের কাজ,

এক বছরের সব বিস্ময়কর জিনিস।

আমি একটি বয়স্ক বৃক্ষ, যখন আমি বেড়ে উঠছিলাম

আমি এক অস্পষ্ট, মিষ্ট শব্দ উচ্চারণ করেছিলাম

যখন মৃদুমন্দ বাতাস আমাকে আদর করেছিল।

যৌবনের সেই হাসিগুলোর সময় পার হয়ে গেছে:

এখন, একটি ঘূর্ণিঝড় আমার হৃদয়কে ঘূর্ণনে ঘূর্ণনে গানের দিকে নিয়ে যাক!

অনেক দূরে

আমার বালকবেলায় আমি একটি ষাঁড় দেখেছিলাম

তুমি যখন নিকারাগুয়ার সূর্যের ওপরের জ¦লন্ত স্বর্ণের ভেতরে

বাষ্প চালিত করেছিলে।

সেখানে গ্রীষ্মম-ীয় সুরসঙ্গতির মধ্যে খুব সমৃদ্ধ বৃক্ষরোপণ চলছে

বনভূমির ঘুঘু, বিস্তৃত বনরাজি যা কুঠারের, পাখির, বন্য ষাঁড়ের

এবং বাতাসের শব্দের সাথে গান করছিল:

আমি তোমাদের উভয়কে স্যালুট করি, কারণ তোমরা উভয়ই আমার জীবন।

তুমি শক্তিমান ষাঁড়, একটি সুভদ্র প্রত্যুষকে জাগিয়ে তোল

এটা সংকেত দিয়েছিল এখন গাভী দহনের সময়,

যখন আমার অস্তিত্বের সবটাই সাদা এবং গোলাপি:

এবং তুমি মিষ্টিপাহাড়ের ঘুঘু, ডেকে যাচ্ছ আনমনে

তুমি বোঝাতে চাও এ সবই আমার বসন্তকাল, এখন

অনেক অনেক দূরে, ঈশ^রের অধিকারে আছে সেই বসন্ত

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

ছবি

শিল্পচর্চায় তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি ইনোভেটিভ

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতা বৈভব ও বহুমাত্রিকতা

ছবি

উইলিয়াম রাদিচের অধ্যয়নে অনন্য রবীন্দ্রনাথ

দিলারা হাফিজের কবিতা

ছবি

অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি

ছবি

আহমদুল কবির স্মরণে

ছবি

আহমদুল কবিরের সদাশয়তা

ছবি

রবীন্দ্রসংগীতের অপাপভূমি

tab

সাময়িকী

রুবেন দারিও-র কবিতা

অনুবাদ: কামরুল ইসলাম

রুবেন দারিও

বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

আমরা জানি ‘ মদের্নিসমো সাহিত্য আন্দোলন’-এ রুবেন দারিও-রবলিষ্ঠ নেতৃত্বের কথা। এই আন্দোলন ছিল লাতিন আমেরিকার মাটি থেকে উত্থিত এবং এই অঞ্চলের হাওয়া-জলে বিকশিত। এটি পশ্চিমের আধুনিকতাবাদী আন্দোলন থেকে আলাদাভাবে গড়ে উঠেছিল। মাত্র ৪৯ বছরের জীবনে কবিতা নিয়ে, কবিতার আধুনিকায়নে তার শ্রম ও নিষ্ঠা কবিতাপ্রেমিক মানুষের স্মরণে থাকবে অনেককাল। গত শতাব্দীর শেষের দিকে, স্প্যানিশ-ভাষী বিশ্বের কবিতা ছিল নিস্তেজ, দুর্বল, মৃতপ্রায়। এর জন্য প্রয়োজন ছিল নতুন জীবন এবং একটি নতুন দিকনির্দেশনা। নিকারাগুয়ার ফেলিক্স রুবেন গার্সিয়া সারমিয়েন্টো (১৮৬৭-১৯১৬), যিনি নিজেকে রুবেন দারিও বলে ডাকতেন, স্প্যানিশ কবিতার গতিপথ পরিবর্তন করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন এবং এটিকে বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার মূলধারায় নিয়ে এসেছিলেন। সেই সময়ের ফরাসি কবিতার দিকে তার মনোযোগ ছিল প্রবল। আফ্রিকান কবিতা থেকেও তিনি অনেক কিছু গ্রহণ করেছিলেন। প্রবল প্রভাবসঞ্চারী এই কবি লাতিন কবিতার আধুনিক পর্বের বাতাবরণ তৈরি করে দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রুবেন দারিও (১৮৬৭-১৯১৬) স্ত্রী ফ্রান্সিসকা ও দুই পুত্র সন্তানকে ফেলে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কবিতাগুলো পড়তে শুরু করেন। ১৯১৫ সালের শেষদিকে নিকারাগুয়ায় ফিরে আসেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর কূটনৈতিক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে প্যারিসে চলে যান। সেখানে তিনি তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই লেখার কাজ শুরু করেন। সেখানে অবস্থানকালে অতিরিক্ত মধ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। এসময়ে তিনি বার বার শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পতিত হন। তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। ১৯১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৪৯ বছর বয়সে লিওনে তাঁর মৃত্যু হয়। শবানুষ্ঠানে তাঁকে অভূতপূর্ব সম্মান দেখানো হয়েছিল। ১৯১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শহরের গির্জায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। বিশ^কবিতার আধুনিকায়নে লাতিন আমেরিকার এই কবির অবদান চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। কারণ, তার পরে লাতিন ভূখ-ে যাঁরা কবিতা লিখতে এসেছেন, প্রায় সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে তাঁর কবিতা থেকে নতুন কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।

তিনি দূর সময়ের কবি। চিত্রকল্প নির্মাণের কলাকৌশল, মিথের নানামাত্রিক ব্যবহার কিংবা উল্লেখ, ইতিহাস ও বিভিন্ন শিল্পকলা থেকে গ্রহণ তাঁর কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে, অন্তর্লীন সৌন্দর্যে সমীকৃত করেছে। অ জড়ড়ংবাবষঃ কবিতায় তিনি লাতিন দেশসমূহে আমেরিকার আগ্রাসী সা¤্রাজ্যবিস্তারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। আমেরিকা তার শ্রেষ্ঠত্বকে জাহির করতে লাতিন আমেরিকার স্বাধীনতা ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক আবহকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে- এসব নিয়ে তিনি তাঁর উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন এই কবিতায়। তাঁর কবিতার মধ্যে জীবন ও জগতের সেইসব পথের সন্ধান মেলে, যার দিকে তাকালে যে কোনো কবিতা-পাঠকের মনে হবে, তিনি যেন আমার জন্যই এখনই লিখলেন এই কবিতা। ‘আগামীকাল লাশ হয়ে যাবার নিশ্চিত আতঙ্ক’ যেমন ঘিরে রাখে আমাদের, তেমনি এই অতলান্ত প্রশ্নও জীবনব্যাপী আমাদের তাড়া করে ফেরে-‘আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি: কখন ভোর হবে?’ তিনি অজানা-অচেনা আমেরিকার মৃত্তিকার গভীরে চাষ করে যে সব অমূল্য রতনের সন্ধান করেছেন এবং বিশেষ করে কবিতার সোনা ফলিয়েছেন, তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁরই কবিতার পঙ্ক্তি- ‘জীবিত থাকার মতো আর কোনো বড় যন্ত্রণা নেই’। এই যন্ত্রণাময় পথের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেছেন এই কবি নিজের মাটি ও বিপন্ন-রক্তাক্ত মানুষের নিরাসক্ত আইডেন্টিটির সন্ধানে, যারা কালের কুয়াশায় ছিল অদৃশ্য। রুবেন দারিও আত্মবিশ^াসের সাথে বলেছেন- গু ঢ়রপশ রং ড়িৎশরহম ফববঢ় রহ ঃযব ংড়রষ ড়ভ ঃযরং ঁহশহড়হি অসবৎরপধ, ঃঁৎহরহম ড়ঁঃ মড়ষফ ধহফ ড়ঢ়ধষং ধহফ ঢ়ৎবপরড়ঁং ংঃড়হবং, ধহ ধষঃধৎ, ধ নৎড়শবহ ংঃধঃঁব. অহফ ঃযব গঁংব ফরারহবং ঃযব সবধহরহম ড়ভ ঃযব যরবৎড়মষুঢ়যরপং. ঞযব ংঃৎধহমব ষরভব ড়ভ ধ াধহরংযবফ ঢ়বড়ঢ়ষব বসবৎমবং ভৎড়স ঃযব সরংঃ ড়ভ ঃরসব. অনূদিত কবিতাগুলো ঝবষবপঃবফ চড়বসং ( ২০২০) এর অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো অফধস ঋবরহংঃবরহ স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।

একটি খোলক

আমি তীরে পড়ে থাকতে দেখলাম একটি সোনালি খোলক

বৃহদায়তনের, দন্তচিকিৎসকের চিত্র-শোভিত মুক্তোর মতো;

ইউরোপা তা স্পর্শ করলো তার স্বর্গীয় হাত দিয়ে

যখন ঐশ^রিক ষাঁড়ের মতো এই সমুদ্র সেপার হলো

আমি আমার ঠোঁটের কাছে তুলে আনলাম এই বাজতে থাকা খোলকটি

এবং জাগিয়ে তুললাম সমুদ্রের প্রভাতী ড্রাম পেটানোর আবহ

আমি এটা আমার কানের কাছে ধরলাম, গোপন সম্পদের

নীল খনিগুলো আমার সাথে অনুচ্চস্বরে কথা বলল।

এভাবেই ঐসব তীক্ষè ঝড়ের লবণ আমার দিকে আসে

আরগো তার ভেতরে স্ফীত পালগুলো অনুভব করল

যখন স্বর্গের নক্ষত্রেরা খুব ভালোবেসেছিল জেসনের স্বপ্ন:

একটি অচেনা কণ্ঠস্বর ‘মধ্যতরঙ্গের শব্দ, গভীর স্ফীত সমুদ্র

এবং রহস্যময় বাতাস আমি দেখি’।

(এটা যেন হৃদয়ের আকৃতির, ঐ বেজে যাওয়া খোলক)।

নিশীথচিত্র

রাতের নীরবতা, একটা বিষণœ, নিশাচর নৈঃশব্দ্য-

আমার আত্মা কেন কেঁপে উঠছে?

আমি আমার রক্তের গুনগুন শুনি,

এবং একটি সরল ঝড় আমার মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে বহে যায়।

নিদ্রাহীনতা! ঘুমোতে পারি না, আমার স্বপ্ন দেখাও হয় নি।

আমি আত্মার ব্যবচ্ছেদের স্বয়ংক্রিয় নমুনা, স্বয়ংক্রিয় হ্যামলেট!

অন্ধকারের বিস্ময়কর স্ফটিক কিংবা রাতের শরাবে

আমার দুঃখগুলো তরলিত করার জন্য-

আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি: কখন ভোর হবে?

কেউ বন্ধ করেছে দরজা

কেউ পাশ দিয়ে হঁটে চলে গেছে-

ঘড়িতে তিনটা বাজার শব্দ- এটা যদি সে হতো!

নশ^রতা

গাছেরা সুখী কারণ কোনোকিছু অনুভব করার ক্ষমতা তাদের প্রায়ই নেই;

কঠিন শিলা অধিকতর সুখী, এটা কিছুই অনুভব করে না:

জীবিত থাকার মতো আর কোনো বড়ো যন্ত্রণা নেই,

সচেতন জীবনের চেয়ে আর কোনো বোঝা নেই অতোটা ভারি।

কী হবো তার কিছুই জানা নেই, পথ জানা নেই,

যা হয়েছি সেটাও ভয়ের, ভবিষ্যৎ আতঙ্কের...

এবং আগামীকাল লাশ হয়ে যাবার নিশ্চিত আতঙ্ক,

সারাজীবন কষ্ট পাওয়া, অন্ধকারের মধ্য দিয়ে হাঁটা,

কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি জানি না আমরা, সন্দেহও করি না

আর যে মাংস শীতল আঙ্গুর গুচ্ছের সাথে আমাদের প্রলুব্ধ করে,

এবং সমাধি যা আমাদের অপেক্ষায় রাখে সুগন্ধিজলসহ,

জানি না আমরা কোথায় যাবো,

এবং কোথা থেকে এসেছি...

শরতে যা ঘটেছিল

আমি জানি এমন মানুষ আছে যারা জিজ্ঞেস করে: সে কেন

আগের মতো একইধরনের বুনো সুরে গান করে না?

কিন্তু তারা দেখে নাই এক ঘণ্টার শ্রম, এক মিনিটের কাজ,

এক বছরের সব বিস্ময়কর জিনিস।

আমি একটি বয়স্ক বৃক্ষ, যখন আমি বেড়ে উঠছিলাম

আমি এক অস্পষ্ট, মিষ্ট শব্দ উচ্চারণ করেছিলাম

যখন মৃদুমন্দ বাতাস আমাকে আদর করেছিল।

যৌবনের সেই হাসিগুলোর সময় পার হয়ে গেছে:

এখন, একটি ঘূর্ণিঝড় আমার হৃদয়কে ঘূর্ণনে ঘূর্ণনে গানের দিকে নিয়ে যাক!

অনেক দূরে

আমার বালকবেলায় আমি একটি ষাঁড় দেখেছিলাম

তুমি যখন নিকারাগুয়ার সূর্যের ওপরের জ¦লন্ত স্বর্ণের ভেতরে

বাষ্প চালিত করেছিলে।

সেখানে গ্রীষ্মম-ীয় সুরসঙ্গতির মধ্যে খুব সমৃদ্ধ বৃক্ষরোপণ চলছে

বনভূমির ঘুঘু, বিস্তৃত বনরাজি যা কুঠারের, পাখির, বন্য ষাঁড়ের

এবং বাতাসের শব্দের সাথে গান করছিল:

আমি তোমাদের উভয়কে স্যালুট করি, কারণ তোমরা উভয়ই আমার জীবন।

তুমি শক্তিমান ষাঁড়, একটি সুভদ্র প্রত্যুষকে জাগিয়ে তোল

এটা সংকেত দিয়েছিল এখন গাভী দহনের সময়,

যখন আমার অস্তিত্বের সবটাই সাদা এবং গোলাপি:

এবং তুমি মিষ্টিপাহাড়ের ঘুঘু, ডেকে যাচ্ছ আনমনে

তুমি বোঝাতে চাও এ সবই আমার বসন্তকাল, এখন

অনেক অনেক দূরে, ঈশ^রের অধিকারে আছে সেই বসন্ত

back to top