alt

সাময়িকী

ফিওদর দস্তয়েভস্কি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

গৌতম গুহ রায়

: বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি / জন্ম: ১১ নভেম্বর ১৮২১; মৃত্যু: ০৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৮১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র স্বয়ং কথক, যে পাঠকের উপন্যাস পাঠের প্রচলিত ধারণার ‘নায়কোচিত’ নয়, বরং বলা যায় ‘প্রতিনায়ক’। পিটার্সবুর্গের এক পরিচয়হীন বুদ্ধিজীবী, বছর চল্লিশের এই মানুষটি নিজেকে বর্হিজগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ বা পাতালে আশ্রয় নিয়েছেন এবং যিনি মনে করেন সচেতনভাবে নিষ্ক্রিয় থাকা, আত্মগোপন করে থাকাই শ্রেয়, ‘Though we may sit forty years underground without speaking— when we do come out into the light of day and break out we talk and talk’। তাঁর নিজের স্বীকারোক্তিমূলক আত্মকথনই এই ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’।এই আখ্যানের সূচনায় কথক তাঁর স্বীকারোক্তি শুরু করেন নিজের অসুস্থতার কথায়, ‘I am sick man… I am a spiteful man, I am an unattravtive man. I belive my Liver is disessed.’ বলে। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামাঙ্কিত অধ্যায়ে তিনি স্বয়ং নিজেকে এবং তার দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থিত করেছেন এমনভাবে, যেন সত্যিই বুঝিবা, ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে কেন সে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিল আর কেনইবা নিজেকে উপস্থিত করতেচেয়েছিল।পরবর্তীঅধ্যায়, অর্থাৎ ‘সিক্ত তুষারের আখ্যান’ (APROPOS OF THE WET SNOW)-এ থাকছে তার প্রকৃত নোট বা বয়ানগুলো, তার জীবনের কিছু বিশেষ ঘটনার বিবরণ এখানে গ্রন্থিত থাকছে। এই আখ্যানের কথক আত্মগোপন করেছিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরের বাইরে কোনোঅজ্ঞাতবাসে, দস্তয়েভস্কি যখন উপন্যাসটি লেখেন তখন তিনি থাকতেন এই সেন্ট পিটার্সবুর্গেই। এই ‘কথক’ তার সময় ও সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণাগুলো মানতে চাইতেন না, চলতি প্রবণতাগুলোর বিরুদ্ধেই ছিলো তার বিদ্রোহ। তিনি কোনো রকম সমাজ-সাংস্কৃতিক সমঝোতার পক্ষপাতী ছিলেন না। সব বিষয়েই তিনি বিপরীত অবস্থানে নিজেকেরাখতেন, অসুস্থ কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যাবেন না, শিক্ষিত কিন্তু কুসংস্কার মানবেন, জীবনের মধ্য পথেই নিজেকে বৃদ্ধ দলভুক্ত মনে করতেন তিনি। মানুষের দীর্ঘ জীবনকে তিনি স্বীকার করতেন না, বলতেন যে কেবলমাত্র নির্বোধ ও অপদার্থরাই দীর্ঘজীবন বাঁচে। উত্তম পুরুষে লেখা এই আখ্যানে আমরা লাইনগুলো ও লাইনগুলোর মাঝের স্পেসে দেখতে পাই একজন নিঃসঙ্গ ও স্ববিরোধী মানুষকে। স্বনির্বাসিত এই আত্মগোপনকারী তার নোটস (বয়ান)পাঠকের জন্য সামনে এনে মাঝে মাঝেই তার পক্ষে পাঠকের সম্মতি প্রার্থনা করেছেন কথক। মতাদর্শবাদী প্রকল্পিত সমাজ শৃঙ্খলায় তার তৃপ্তি নেই, ‘something quite different-quite different-for which I am thirsting- but which I cannot find’। দশ বছর নির্বাসনদ- ভোগের পর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে এসে ফিওদর দস্তয়েভস্কি যখন নতুন করে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করলেন ততদিনে তাঁর সৃষ্টিতে সামাজিক সমস্যাকে ছাপিয়ে উঠেছে মানুষের আত্মিক ও জৈবিক সমস্যা। এই ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’ সম্পর্কে আদ্রে জিঁদ বলেছেন যে, এটিই দস্তয়েভস্কির সৃজন কর্মের প্রধান স্তম্ভ। ‘ম্যাজিক ফাউন্টেন’-এর জনক টমাস মান একে ‘মানব মনস্তত্ত্বের উপলব্ধির ভয়ঙ্কর শক্তির পরিচায়ক’ বলেছেন। মানবমনের আনাচে কানাচে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার যে প্রবৃত্তি, টমাস মান এটাকে লেখকের ‘অন্তদৃষ্টির এক ধরনের অপরাধমূলক কৌতূহল’ আখ্যা দিয়েছেন। যেহেতু এর ফলে ‘আমার আপনার নিজেদের এমন সব গোপন ভাবনাচিন্তার মুখোমুখি হয়ে পড়ি- যা আমরা কখনো

‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডার গ্রাউন্ড’-এর অন্তিম বয়ানে দস্তয়েভস্কি লিখেছেন-

‘...দস্তয়েভস্কির এই ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ আসলেএক নিঃসঙ্গ, সমাজ-বিচ্ছিন্ন আত্ম-অহংকারী মানুষের সংশয় ও বিদ্বেষের আখ্যান, যে চরিত্রের মধ্যে লেখক নিজেও কিছুটা রয়ে গেছেন। সাহিত্য সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় যথার্থভাবেই এই উপন্যাসটিকে‘দলিতদের সর্বত্রগামী ইস্তাহার’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই আখ্যানে দস্তয়েভস্কি যে একটি তুচ্ছ মানুষের বয়ান রেখেছেন, যে সামাজিক নিরতার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন তাতে ‘জড় কঙ্কালে রক্তাভা সঞ্চারিত হয়’।

দস্তয়েভস্কির আর একটি কম আলোচিত উপন্যাস ‘মোস্ট আনফচ্যুনেট’কে আমি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এই কারণে যে, সামাজিক শ্রেণি অবস্থান থকে একজন নিজেকে ‘ডি-ক্লাসড’ করতে চাইলেই তা সহজে পারেন না- এই বিষয়টিকে এই আখ্যানের মধ্যে দিয়ে রেখেছেন দস্তয়েভস্কি। একজন সেনা আধিকারিক তার এক দরিদ্র ও প্রান্তিক স্তরের অধস্তনের বিয়ের অনুষ্ঠানে হঠাৎ গিয়ে হাজির হন, আমন্ত্রণ ছিলো না বা আয়োজনের স্বল্পতায় তাকে আহ্বান করার সামর্থ্যও ছিলো না সেই কর্মচারির। কিন্তু সে সাধ্যমত চেষ্টা করে তার এই আনাহূত কর্তার সেবার। এরপর ধীরেধীরে এক অনভিপ্রেত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। মদ্যপানে জ্ঞান হারানো উচ্চপদস্থ মেজর নিম্ন স্তরের এক কর্মচারীর বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠানকে বিষাদ ও বিড়ম্বনার আয়োজনে পরিণত করেন। অথচ মেজর তাঁর মনথেকে চাননি তাঁর উপস্থিতির এই পরিণতি হোক। শ্রেণি অবস্থান বৈষম্য থেকেই এই পরিণতির উদ্ভব হয়। এখানে এক আশ্চর্য চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়, তিনি সরকারি ট্রেজারির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ম্লেকোপিতায়েভে।

দস্তয়েভস্কি ও তাঁর নব বিবাহিত স্ত্রী আনা স্নিতকিনা,১৪ এপ্রিল ১৮৬৭, মধুচন্দ্রিমায় ইউরোপ গেলেন। জার্মানির বার্লিন থেকে ড্রেসডেন শহরে এলেন তাঁরা। এরপর ফ্রাংকফুর্ট, ড্রামস্টাড, হাইডেলবার্গ এবং কার্লসরুহে হয়ে বাদেব বাদেন। ড্রেসডেন শহরের শুরু করেন তার নতুন উপন্যাস ‘ইডিয়ট’। এই সময় অর্থ কষ্ট তাঁদের ঘিরে ধরে। মাত্র ত্রিশ ফ্রাং নিয়ে সস্ত্রীক পৌঁছন সুইডেনের জেনিভা শহরে, ১৮৬৭-র আগস্ট মাসে। এখানে ‘লিগ অব পিস এন্ড লিবার্টি’র এক সভায় যোগ দেন। এখানেই পরিচয় হয় বাকুনিন ও গ্যারিবল্ডির সঙ্গে। এইআর্থিকদুর্দিনে আয়াপ্পোলান মাইকাভ নামের এক বন্ধু তাঁকে ১৫০ রুবল দিয়ে সাহায্য করেন। এদিকে তাঁর উপন্যাস ‘ইডিয়ট’-এর লেখা চলছে তখন। নানা পটপরিবর্তন, চরিত্রের বয়ান পালটে পালটে এগোচ্ছিলো ‘দ্য ইডিয়ট’;অবশেষে তিনি এটি দ্রুত শেষ করার তাগিদ অনুভব করেলন। মাত্র তেইশ দিনে এর ১০০ পৃষ্ঠা লিখে ফেললেন। ১৮৬৮-র জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে এটি প্রকাশ হতে শুরু করলো ‘রাশিয়ান মেসেঞ্জার’-এ।

দস্তয়েভস্কি যখন প্রবাসে ‘ইডিয়ট’ লিখছেন তখন তাঁর ব্যক্তি জীবনে একের পর এক ঝড় বয়ে যায়। এই সময় তাঁর ও আনার প্রথম সন্তান জন্ম নেয়, ১৯৬৬-র ৫ মার্চ। কিন্তু মাত্র তিনমাসের মধ্যেই এই প্রিয় সন্তান নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই ঘটনা বিধ্বস্ত করে ফেলে দম্পতিকে। আনার স্মৃতিচারণে, “...মহিলারা দুঃখের আঘাতে যেমন কেঁদে চলেন,ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, তেমনি তিনি সর্বক্ষণ চোখের জল ফেলতেন, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলতেন”। আর্থিক দুরবস্থায় বারংবার ঠিকানা পাল্টাতে হয়েছে, বাসা বদল করতে হয়েছে তাঁদের। জেনিভা থেকে ভেভেই, সেখান থেকে মিলান, এরপর ফ্লোরেন্স। ১৮৬৯-এর জানুয়ারিতে ‘ইডফিয়ট’-এর অন্তিম পর্ব লেখা হয়।

‘ইডিয়ট’ দস্তয়েভস্কির অন্যতম প্রিয় সৃজন। এতে বর্ণিত চরিত্রগুলোররূপায়নে দস্তয়েভস্কির কলমের প্রখরতার চিহ্ন ধরা আছে। আড়াই লক্ষ শব্দের এই উপন্যাসে বিস্তৃত ঊনবিংশ শতকের পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকের রাশিয়ার কেন্দ্রভূমি পিটার্সবুর্গের পটভূমি। সেই সময়কার রুশি সমাজের নানা স্তরের বিভিন্ন চরিত্রের রূপায়ণ করেছেন আসাধরণ মুন্সিয়ানায়।এই উপন্যাসে দস্তয়েভস্কি প্রচুর চরিত্রের সমাহার করেছেন,ধূর্ত, ধান্দাবাজ, লোভী, কামুক চরিত্রের মধ্য দিয়ে সেই সময়ের রুশি সমাজের অভ্যন্তরের ক্ষত চিহ্নিত করেছে তিনি, রাশিয়ার বাইরে থেকে, নির্মোহ বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন এই ‘ইডিয়ট’-এ। উচ্চাকাক্সক্ষী ও অসামাজিক মানুষেরা ক্ষমতার ও বৃত্তেরলোভে কতটা ‘ইডিয়ট’ হতে পারে তা এই উপন্যাসে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন লেখক। এখানে তাই দেখা যায় সামাজিক অবক্ষয়ের প্রকট রূপের প্রতিফলন ভ্রষ্টাচার, অহংবোধ ও স্বার্থপর সমাজের অধপতনে। ‘ইডিয়ট’প্রসঙ্গে দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেন, ‘এই উপন্যাসের ভাবনা অনেকদিনের, কিন্তু এতটাই কঠিন ছিল এই কাজ যে দীর্ঘদিন আমি সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারি নি। উপন্যাসের ভাবনা ছিলো ক্ষতমগ্ন সমাজের চিত্র তুলেধরে এক যথার্থ সুন্দর ব্যক্তিত্ব উপস্থাপনা। পৃথিবীতে এর চাইতে দুরূহ কাজ আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না’।

‘ইডিয়ট’-এ দস্তয়েভস্কির ব্যক্তিগত জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত হয়েছে। তাঁর কারাবাস, মৃত্যুদ-, মৃগী রোগ, আশপাশের মানুষের ক্রূরতা, মিথ্যাচার, সামাজিক ক্ষয়িষ্ণু চেহারা, ঐতিহ্য উদাসীনতার আখ্যান এই ‘ইডিয়ট’। মূল চরিত্র লেভ নিকোলায়েভিচ মিশকিন চরিত্রের মধ্য নিজেকেই ধরে রেখেছেনে লেখক। মিশকিনের দীর্ঘদিনের মৃগী রোগ, অসুস্থতা এবং একজন এমন রুগ্ণ মানুষের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ছবি তুলে ধরেছেন দস্তয়েভস্কি। কিন্তু এই সামাজিক উপেক্ষিত মিশকিন প্রকৃতই একজন প্রখর মেধাবী, সামাজিক সচেতন ও বিবেকবান মানুষ যিনি নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে ভাবেন ও সুস্পষ্ট ধারণা পোষণ করেন। বিনয় ও অনুভূতিপ্রবণ মিশকিনের চরিত্রে আমরা দস্তয়েভস্কির চেহারা দেখতে পাই। লেখকের মতই নিজের জন্মভূমি ও জন্মভূমির সংস্কৃতির প্রতি টান তার। লেখক দস্তয়েভস্কির মতই তার বিশ্বাস রুশ জাতীর স্বগৃহীত মতাদর্শকে ভিত্তি করে জাতির উত্তরণ ও মুক্তির পথ খুঁজে নেওয়া।মিশকিনের প্রেমিকা নাস্তাসিয়া ফিলিপোভনা সুন্দরী, বুদ্ধিমতী কিন্তু ক্রূর ও কুটিল। তাঁর শৈশবের দুঃসহ অভিজ্ঞতা তাকে এমন করেছে। মাত্র সাত বছর বয়সে অনাথ হয়ে স্বজনের দ্বারা যৌন হিংসার শিকার হয়েছিলেন ফিলিপোভনা। এই কারনে প্রেম ও ঘৃণার টানাপোড়েনে তিনি ছিলেন আবেগতাড়িত ও ধ্বংসাত্মক। আর একটি চরিত্র রোগোঝিন সেমিওনোভিচ, মিশকিনের আর এক প্রেম।প্রথম পরিচয়ে মিশকিনের প্রতি আসক্ত হলেও ক্রমশ তাদের সম্পর্ক বিষিয়ে যায়। আর একজনও এসেছেলো মিশকিনের জীবনে, সে আগলাইয়া ইভানোভনা, সেনা আধিকারিকের আদুরে কন্যা। এমন নানা চরিত্র মিশকিনকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ‘ইডিয়ট’-এ।

দস্তয়েভস্কির প্রাথমিক খসড়ায় মিশকিনকেএকজন সৎ ও বিবেকবান পুরুষ হিসাবে গড়তে চাননি, বরং একজন ধূর্ত ও বদমাইশ হিসাবে ভেবেছিলেন লেখক। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে দস্তয়েভস্কির ভিন্নতর ও দুঃসহ অভিজ্ঞতার কারণে এই চরিত্রটিকে পালটে দেন। বন্ধু আয়াপোলিয়েন মাইকভকে লেখা একটি চিঠি এর সাক্ষ্য বহন করছে। সেখানে তিনি লেখেছেন যে নিজের দুর্দশা ও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করেছে পরিকল্পনা পালটে দিতে। তিনি ‘একটি সম্পূর্ণ সুন্দর মানবাত্মার চিত্রায়ণ করতে চান। যে মানুষটি ক্রমশ এক সৎ ও সুন্দর আদর্শবান চরিত্র হয়ে উঠবে’। তিনি চেয়েছিলেন একজন সৎ মানুষ কীভাবে তাঁর চারপাশের ঘটনাবলির সঙ্গে যুঝছেন। সেই পরিপার্শিক জগৎ তাকে কি ভাবে গ্রহণ করছে। একের পর এক ঘটনাবলির সমাহারে দস্তয়েভস্কি দেখিয়েছেন সমাজের অভ্যন্তরের কলুষ ও তাকে অতিক্রম করার যুদ্ধকে। ‘ইডিয়ট’-এর কাহিনীতে বর্ণিত নানা বিবাদ ও বিসংবাদের মধ্যেও মিশকিন সবসময় মধ্যস্থতাকারির ভূমিকা নিয়েছেন একজন সমাজসচেতন ও যুক্তিবাদী মানুষের মতো। মন থেকেই মিশকিন বিশ্বাস করতেন যে ভালোবাসায় যে কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, এমনকি সামাজিক শ্রেণি বৈষম্যজনিত সমস্যারও। কিন্তু মানুষ তাঁর এই মাহানুভাবতাকে বুঝতে পারে না, অনেকেই তাঁকে বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে সরে যায়।

দস্তয়েভস্কির যাবতীয় লেখালেখির মুখোমুখি হলে পাঠকের মনে যে কষ্ট জন্মে সেটা কি লেখকের জয়? না কি সেই চরিত্রগুলোর জন্য, যেগুলো মানব ইতিহাসের আবহমানকালের যন্ত্রণা ও নিঃসঙ্গতা নিয়ে টিকে আছে? প্রাবন্ধিক ও ফিল্ম সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গেলিখেছেন, ‘... তিনি যে চরিত্রের সমাবেশ করেছেন তা মহাভারতের কলমে অথবা ট্রয়ের যুদ্ধে দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু আধুনিক বলেই তিনি নির্জন-নিঃসঙ্গ-পরিত্রাণহীন মৃত্যু পথযাত্রী, হাতে সর্বনাশের একমাত্র ইস্তাহার; এই আমরা যারা চিরদিনের জন্য স্বর্গ থেকে পতিত: কারাযন্ত্রণার মধ্যে অথবা মাতৃগর্ভের অন্ধকারে আমরা যে গোপন চিরকূট বিনিময় করি তাতে একমাত্রদস্তয়েভস্কির স্বাক্ষরই থাকে। তিনি, একমাত্র তিনিই আমাদের পাপ ও পতনের মধ্যে বলতে পারেন- ‘আমি একা, এবং আমিই সর্বত্রগামী’। এই ‘একা ও সর্বত্রগামী’ মানুষটি, ফিওদর দস্তয়েভস্কির স্মরণের কারণ তাঁর জন্মগ্রহণের দু’শ’ বছর, অথবা আবহমানকালের দ্বন্দ্ব ও যন্ত্রণার, মানুষের একাকিত্বের কথোয়ালের অনতিক্রম্য সৃষ্টি। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কথায় কথা মিলিয়ে আমিও বলতে চাই যে, ‘যদি কোনো অলৌকিক অগ্নুৎপাত অথবা প্লাবনে পৃথিবী নামের এই গ্রহ আবার হিম গোলকে রূপান্তরিত হয় তবেও কারমাজভ পরিবারের কয়েকটি ছিন্ন পাতা, রাসকলনিকভ বা প্রিন্স মিসকিনের আর্ত জিজ্ঞাসা, মহাকাল ও মহাকাশকে জানিয়ে দেবে এই গ্রহে মানুষ বেঁচে ছিল’। দস্তয়েভস্কির প্রায় সমস্ত উপন্যাসেই মৃত্যু, মৃত্যুর আশঙ্কা, মৃত্যু ভয় ও মনস্তাপ, প্রায়শ্চিত্যের ধ্বনি অনুরণিত হয়।মৃত্যু আসলে তাঁর কাছে জীবনেরই কথা কয়, আলিয়সার মুখ দিয়ে তাই বলিয়ে নেন এইস্মরণযোগ্য কথাগুলো, ‘আমার মনে হয় পৃথিবীতে সকলের উচিত সবার উপরে জীবনকে ভালোবাসা’। ইভানের জিজ্ঞাসার উত্তরে সে তাই বলে, ‘যুক্তি তর্কের ওপরে, যুক্তিতর্ক ছাপিয়ে জীবনকে ভালোবাসা’। এটা হলো অর্ধেক, বাকি অর্ধেক হলো, ‘মৃতদের পুনরুত্থান, এমনও হতে পারে তাদের আদৌ মৃত্যু হয়নি, কখনো হয়নি’।

ইভান, কারমাজভ পরিবার, রাসকলনিকভ বা প্রিন্স মিশকিনের মতো চরিত্রের কান্না ও আর্তি পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসের আকাশে চিরকাল উজ্জ্বল আগ্নিগোলকের মতো মানবের চিন্তা চেতনায় আঘাত হানবে, তাকে সজীব রাখবে। সাহিত্য আলোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, “কলকাতা শহরে যখন আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শতবর্ষ অথবা ফ্রান্ৎস কাফকার ১২৫ বৎসর কাটাচ্ছি তখন দেখি যে আধুনিক যুগে সমস্তপ্রতিভাই দস্তয়েভস্কির স্বপ্নের অংশমাত্র। জোসেফ কে এবং শশি দুজনেই কোনো না কোনো সময় সেন্ট পিটার্সবুর্গের নেভস্কি প্রসপেক্ট নামক সড়কে হেঁটেছে, তারপর ইতস্তত যে যার স্বর্গের সন্ধানে চলে গেছেন, প্রাগে কিংবা ফরিদপুরে। দস্তয়েভস্কিকে আমি কোনো উপন্যাসকার বা কাহিনীকার এমনকি দার্শনিকওবলতে রাজি নই। তিনি, একমাত্র তিনিই, আমাদের রুগ্ণ আত্মার প্রথম ও শেষ পাহারাদার। যিনি নজর রাখেন আমরা যাতে নরকের পথে হারিয়ে না যাই।স্বর্গ আমাদের অজানাই থাকবে। কিন্তু সকৃতজ্ঞ চিত্তে যেন মনে রাখি মর্তের ঈষৎ দূরে অন্তরীক্ষে ফিওদর দস্তয়েভস্কি, শাপভ্রষ্ঠ দেবদূত, আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন।” (সমাপ্ত)

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অন্য নিরিখে দেখা

ছবি

হেলাল হাফিজের চলে যাওয়া

ছবি

হেলাল হাফিজের কবিতা

ছবি

কেন এত পাঠকপ্রিয় হেলাল হাফিজ

ছবি

নারী শিক্ষাবিদ : বেগম রোকেয়া

ছবি

বাসার তাসাউফ

ছবি

‘জগদ্দল’-এর শক্তি ও সমরেশ বসু

ছবি

রুবেন দারিও-র কবিতা

‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

ছবি

শিল্পচর্চায় তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি ইনোভেটিভ

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতা বৈভব ও বহুমাত্রিকতা

ছবি

উইলিয়াম রাদিচের অধ্যয়নে অনন্য রবীন্দ্রনাথ

দিলারা হাফিজের কবিতা

ছবি

অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি

ছবি

আহমদুল কবির স্মরণে

ছবি

আহমদুল কবিরের সদাশয়তা

ছবি

রবীন্দ্রসংগীতের অপাপভূমি

tab

সাময়িকী

ফিওদর দস্তয়েভস্কি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

গৌতম গুহ রায়

ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি / জন্ম: ১১ নভেম্বর ১৮২১; মৃত্যু: ০৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৮১

বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

(পূর্ব প্রকাশের পর)

‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র স্বয়ং কথক, যে পাঠকের উপন্যাস পাঠের প্রচলিত ধারণার ‘নায়কোচিত’ নয়, বরং বলা যায় ‘প্রতিনায়ক’। পিটার্সবুর্গের এক পরিচয়হীন বুদ্ধিজীবী, বছর চল্লিশের এই মানুষটি নিজেকে বর্হিজগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ বা পাতালে আশ্রয় নিয়েছেন এবং যিনি মনে করেন সচেতনভাবে নিষ্ক্রিয় থাকা, আত্মগোপন করে থাকাই শ্রেয়, ‘Though we may sit forty years underground without speaking— when we do come out into the light of day and break out we talk and talk’। তাঁর নিজের স্বীকারোক্তিমূলক আত্মকথনই এই ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’।এই আখ্যানের সূচনায় কথক তাঁর স্বীকারোক্তি শুরু করেন নিজের অসুস্থতার কথায়, ‘I am sick man… I am a spiteful man, I am an unattravtive man. I belive my Liver is disessed.’ বলে। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামাঙ্কিত অধ্যায়ে তিনি স্বয়ং নিজেকে এবং তার দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থিত করেছেন এমনভাবে, যেন সত্যিই বুঝিবা, ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে কেন সে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিল আর কেনইবা নিজেকে উপস্থিত করতেচেয়েছিল।পরবর্তীঅধ্যায়, অর্থাৎ ‘সিক্ত তুষারের আখ্যান’ (APROPOS OF THE WET SNOW)-এ থাকছে তার প্রকৃত নোট বা বয়ানগুলো, তার জীবনের কিছু বিশেষ ঘটনার বিবরণ এখানে গ্রন্থিত থাকছে। এই আখ্যানের কথক আত্মগোপন করেছিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরের বাইরে কোনোঅজ্ঞাতবাসে, দস্তয়েভস্কি যখন উপন্যাসটি লেখেন তখন তিনি থাকতেন এই সেন্ট পিটার্সবুর্গেই। এই ‘কথক’ তার সময় ও সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণাগুলো মানতে চাইতেন না, চলতি প্রবণতাগুলোর বিরুদ্ধেই ছিলো তার বিদ্রোহ। তিনি কোনো রকম সমাজ-সাংস্কৃতিক সমঝোতার পক্ষপাতী ছিলেন না। সব বিষয়েই তিনি বিপরীত অবস্থানে নিজেকেরাখতেন, অসুস্থ কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যাবেন না, শিক্ষিত কিন্তু কুসংস্কার মানবেন, জীবনের মধ্য পথেই নিজেকে বৃদ্ধ দলভুক্ত মনে করতেন তিনি। মানুষের দীর্ঘ জীবনকে তিনি স্বীকার করতেন না, বলতেন যে কেবলমাত্র নির্বোধ ও অপদার্থরাই দীর্ঘজীবন বাঁচে। উত্তম পুরুষে লেখা এই আখ্যানে আমরা লাইনগুলো ও লাইনগুলোর মাঝের স্পেসে দেখতে পাই একজন নিঃসঙ্গ ও স্ববিরোধী মানুষকে। স্বনির্বাসিত এই আত্মগোপনকারী তার নোটস (বয়ান)পাঠকের জন্য সামনে এনে মাঝে মাঝেই তার পক্ষে পাঠকের সম্মতি প্রার্থনা করেছেন কথক। মতাদর্শবাদী প্রকল্পিত সমাজ শৃঙ্খলায় তার তৃপ্তি নেই, ‘something quite different-quite different-for which I am thirsting- but which I cannot find’। দশ বছর নির্বাসনদ- ভোগের পর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে এসে ফিওদর দস্তয়েভস্কি যখন নতুন করে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করলেন ততদিনে তাঁর সৃষ্টিতে সামাজিক সমস্যাকে ছাপিয়ে উঠেছে মানুষের আত্মিক ও জৈবিক সমস্যা। এই ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’ সম্পর্কে আদ্রে জিঁদ বলেছেন যে, এটিই দস্তয়েভস্কির সৃজন কর্মের প্রধান স্তম্ভ। ‘ম্যাজিক ফাউন্টেন’-এর জনক টমাস মান একে ‘মানব মনস্তত্ত্বের উপলব্ধির ভয়ঙ্কর শক্তির পরিচায়ক’ বলেছেন। মানবমনের আনাচে কানাচে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার যে প্রবৃত্তি, টমাস মান এটাকে লেখকের ‘অন্তদৃষ্টির এক ধরনের অপরাধমূলক কৌতূহল’ আখ্যা দিয়েছেন। যেহেতু এর ফলে ‘আমার আপনার নিজেদের এমন সব গোপন ভাবনাচিন্তার মুখোমুখি হয়ে পড়ি- যা আমরা কখনো

‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডার গ্রাউন্ড’-এর অন্তিম বয়ানে দস্তয়েভস্কি লিখেছেন-

‘...দস্তয়েভস্কির এই ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ আসলেএক নিঃসঙ্গ, সমাজ-বিচ্ছিন্ন আত্ম-অহংকারী মানুষের সংশয় ও বিদ্বেষের আখ্যান, যে চরিত্রের মধ্যে লেখক নিজেও কিছুটা রয়ে গেছেন। সাহিত্য সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় যথার্থভাবেই এই উপন্যাসটিকে‘দলিতদের সর্বত্রগামী ইস্তাহার’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই আখ্যানে দস্তয়েভস্কি যে একটি তুচ্ছ মানুষের বয়ান রেখেছেন, যে সামাজিক নিরতার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন তাতে ‘জড় কঙ্কালে রক্তাভা সঞ্চারিত হয়’।

দস্তয়েভস্কির আর একটি কম আলোচিত উপন্যাস ‘মোস্ট আনফচ্যুনেট’কে আমি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এই কারণে যে, সামাজিক শ্রেণি অবস্থান থকে একজন নিজেকে ‘ডি-ক্লাসড’ করতে চাইলেই তা সহজে পারেন না- এই বিষয়টিকে এই আখ্যানের মধ্যে দিয়ে রেখেছেন দস্তয়েভস্কি। একজন সেনা আধিকারিক তার এক দরিদ্র ও প্রান্তিক স্তরের অধস্তনের বিয়ের অনুষ্ঠানে হঠাৎ গিয়ে হাজির হন, আমন্ত্রণ ছিলো না বা আয়োজনের স্বল্পতায় তাকে আহ্বান করার সামর্থ্যও ছিলো না সেই কর্মচারির। কিন্তু সে সাধ্যমত চেষ্টা করে তার এই আনাহূত কর্তার সেবার। এরপর ধীরেধীরে এক অনভিপ্রেত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। মদ্যপানে জ্ঞান হারানো উচ্চপদস্থ মেজর নিম্ন স্তরের এক কর্মচারীর বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠানকে বিষাদ ও বিড়ম্বনার আয়োজনে পরিণত করেন। অথচ মেজর তাঁর মনথেকে চাননি তাঁর উপস্থিতির এই পরিণতি হোক। শ্রেণি অবস্থান বৈষম্য থেকেই এই পরিণতির উদ্ভব হয়। এখানে এক আশ্চর্য চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়, তিনি সরকারি ট্রেজারির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ম্লেকোপিতায়েভে।

দস্তয়েভস্কি ও তাঁর নব বিবাহিত স্ত্রী আনা স্নিতকিনা,১৪ এপ্রিল ১৮৬৭, মধুচন্দ্রিমায় ইউরোপ গেলেন। জার্মানির বার্লিন থেকে ড্রেসডেন শহরে এলেন তাঁরা। এরপর ফ্রাংকফুর্ট, ড্রামস্টাড, হাইডেলবার্গ এবং কার্লসরুহে হয়ে বাদেব বাদেন। ড্রেসডেন শহরের শুরু করেন তার নতুন উপন্যাস ‘ইডিয়ট’। এই সময় অর্থ কষ্ট তাঁদের ঘিরে ধরে। মাত্র ত্রিশ ফ্রাং নিয়ে সস্ত্রীক পৌঁছন সুইডেনের জেনিভা শহরে, ১৮৬৭-র আগস্ট মাসে। এখানে ‘লিগ অব পিস এন্ড লিবার্টি’র এক সভায় যোগ দেন। এখানেই পরিচয় হয় বাকুনিন ও গ্যারিবল্ডির সঙ্গে। এইআর্থিকদুর্দিনে আয়াপ্পোলান মাইকাভ নামের এক বন্ধু তাঁকে ১৫০ রুবল দিয়ে সাহায্য করেন। এদিকে তাঁর উপন্যাস ‘ইডিয়ট’-এর লেখা চলছে তখন। নানা পটপরিবর্তন, চরিত্রের বয়ান পালটে পালটে এগোচ্ছিলো ‘দ্য ইডিয়ট’;অবশেষে তিনি এটি দ্রুত শেষ করার তাগিদ অনুভব করেলন। মাত্র তেইশ দিনে এর ১০০ পৃষ্ঠা লিখে ফেললেন। ১৮৬৮-র জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে এটি প্রকাশ হতে শুরু করলো ‘রাশিয়ান মেসেঞ্জার’-এ।

দস্তয়েভস্কি যখন প্রবাসে ‘ইডিয়ট’ লিখছেন তখন তাঁর ব্যক্তি জীবনে একের পর এক ঝড় বয়ে যায়। এই সময় তাঁর ও আনার প্রথম সন্তান জন্ম নেয়, ১৯৬৬-র ৫ মার্চ। কিন্তু মাত্র তিনমাসের মধ্যেই এই প্রিয় সন্তান নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই ঘটনা বিধ্বস্ত করে ফেলে দম্পতিকে। আনার স্মৃতিচারণে, “...মহিলারা দুঃখের আঘাতে যেমন কেঁদে চলেন,ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, তেমনি তিনি সর্বক্ষণ চোখের জল ফেলতেন, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলতেন”। আর্থিক দুরবস্থায় বারংবার ঠিকানা পাল্টাতে হয়েছে, বাসা বদল করতে হয়েছে তাঁদের। জেনিভা থেকে ভেভেই, সেখান থেকে মিলান, এরপর ফ্লোরেন্স। ১৮৬৯-এর জানুয়ারিতে ‘ইডফিয়ট’-এর অন্তিম পর্ব লেখা হয়।

‘ইডিয়ট’ দস্তয়েভস্কির অন্যতম প্রিয় সৃজন। এতে বর্ণিত চরিত্রগুলোররূপায়নে দস্তয়েভস্কির কলমের প্রখরতার চিহ্ন ধরা আছে। আড়াই লক্ষ শব্দের এই উপন্যাসে বিস্তৃত ঊনবিংশ শতকের পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকের রাশিয়ার কেন্দ্রভূমি পিটার্সবুর্গের পটভূমি। সেই সময়কার রুশি সমাজের নানা স্তরের বিভিন্ন চরিত্রের রূপায়ণ করেছেন আসাধরণ মুন্সিয়ানায়।এই উপন্যাসে দস্তয়েভস্কি প্রচুর চরিত্রের সমাহার করেছেন,ধূর্ত, ধান্দাবাজ, লোভী, কামুক চরিত্রের মধ্য দিয়ে সেই সময়ের রুশি সমাজের অভ্যন্তরের ক্ষত চিহ্নিত করেছে তিনি, রাশিয়ার বাইরে থেকে, নির্মোহ বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন এই ‘ইডিয়ট’-এ। উচ্চাকাক্সক্ষী ও অসামাজিক মানুষেরা ক্ষমতার ও বৃত্তেরলোভে কতটা ‘ইডিয়ট’ হতে পারে তা এই উপন্যাসে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন লেখক। এখানে তাই দেখা যায় সামাজিক অবক্ষয়ের প্রকট রূপের প্রতিফলন ভ্রষ্টাচার, অহংবোধ ও স্বার্থপর সমাজের অধপতনে। ‘ইডিয়ট’প্রসঙ্গে দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেন, ‘এই উপন্যাসের ভাবনা অনেকদিনের, কিন্তু এতটাই কঠিন ছিল এই কাজ যে দীর্ঘদিন আমি সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারি নি। উপন্যাসের ভাবনা ছিলো ক্ষতমগ্ন সমাজের চিত্র তুলেধরে এক যথার্থ সুন্দর ব্যক্তিত্ব উপস্থাপনা। পৃথিবীতে এর চাইতে দুরূহ কাজ আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না’।

‘ইডিয়ট’-এ দস্তয়েভস্কির ব্যক্তিগত জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত হয়েছে। তাঁর কারাবাস, মৃত্যুদ-, মৃগী রোগ, আশপাশের মানুষের ক্রূরতা, মিথ্যাচার, সামাজিক ক্ষয়িষ্ণু চেহারা, ঐতিহ্য উদাসীনতার আখ্যান এই ‘ইডিয়ট’। মূল চরিত্র লেভ নিকোলায়েভিচ মিশকিন চরিত্রের মধ্য নিজেকেই ধরে রেখেছেনে লেখক। মিশকিনের দীর্ঘদিনের মৃগী রোগ, অসুস্থতা এবং একজন এমন রুগ্ণ মানুষের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ছবি তুলে ধরেছেন দস্তয়েভস্কি। কিন্তু এই সামাজিক উপেক্ষিত মিশকিন প্রকৃতই একজন প্রখর মেধাবী, সামাজিক সচেতন ও বিবেকবান মানুষ যিনি নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে ভাবেন ও সুস্পষ্ট ধারণা পোষণ করেন। বিনয় ও অনুভূতিপ্রবণ মিশকিনের চরিত্রে আমরা দস্তয়েভস্কির চেহারা দেখতে পাই। লেখকের মতই নিজের জন্মভূমি ও জন্মভূমির সংস্কৃতির প্রতি টান তার। লেখক দস্তয়েভস্কির মতই তার বিশ্বাস রুশ জাতীর স্বগৃহীত মতাদর্শকে ভিত্তি করে জাতির উত্তরণ ও মুক্তির পথ খুঁজে নেওয়া।মিশকিনের প্রেমিকা নাস্তাসিয়া ফিলিপোভনা সুন্দরী, বুদ্ধিমতী কিন্তু ক্রূর ও কুটিল। তাঁর শৈশবের দুঃসহ অভিজ্ঞতা তাকে এমন করেছে। মাত্র সাত বছর বয়সে অনাথ হয়ে স্বজনের দ্বারা যৌন হিংসার শিকার হয়েছিলেন ফিলিপোভনা। এই কারনে প্রেম ও ঘৃণার টানাপোড়েনে তিনি ছিলেন আবেগতাড়িত ও ধ্বংসাত্মক। আর একটি চরিত্র রোগোঝিন সেমিওনোভিচ, মিশকিনের আর এক প্রেম।প্রথম পরিচয়ে মিশকিনের প্রতি আসক্ত হলেও ক্রমশ তাদের সম্পর্ক বিষিয়ে যায়। আর একজনও এসেছেলো মিশকিনের জীবনে, সে আগলাইয়া ইভানোভনা, সেনা আধিকারিকের আদুরে কন্যা। এমন নানা চরিত্র মিশকিনকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ‘ইডিয়ট’-এ।

দস্তয়েভস্কির প্রাথমিক খসড়ায় মিশকিনকেএকজন সৎ ও বিবেকবান পুরুষ হিসাবে গড়তে চাননি, বরং একজন ধূর্ত ও বদমাইশ হিসাবে ভেবেছিলেন লেখক। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে দস্তয়েভস্কির ভিন্নতর ও দুঃসহ অভিজ্ঞতার কারণে এই চরিত্রটিকে পালটে দেন। বন্ধু আয়াপোলিয়েন মাইকভকে লেখা একটি চিঠি এর সাক্ষ্য বহন করছে। সেখানে তিনি লেখেছেন যে নিজের দুর্দশা ও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করেছে পরিকল্পনা পালটে দিতে। তিনি ‘একটি সম্পূর্ণ সুন্দর মানবাত্মার চিত্রায়ণ করতে চান। যে মানুষটি ক্রমশ এক সৎ ও সুন্দর আদর্শবান চরিত্র হয়ে উঠবে’। তিনি চেয়েছিলেন একজন সৎ মানুষ কীভাবে তাঁর চারপাশের ঘটনাবলির সঙ্গে যুঝছেন। সেই পরিপার্শিক জগৎ তাকে কি ভাবে গ্রহণ করছে। একের পর এক ঘটনাবলির সমাহারে দস্তয়েভস্কি দেখিয়েছেন সমাজের অভ্যন্তরের কলুষ ও তাকে অতিক্রম করার যুদ্ধকে। ‘ইডিয়ট’-এর কাহিনীতে বর্ণিত নানা বিবাদ ও বিসংবাদের মধ্যেও মিশকিন সবসময় মধ্যস্থতাকারির ভূমিকা নিয়েছেন একজন সমাজসচেতন ও যুক্তিবাদী মানুষের মতো। মন থেকেই মিশকিন বিশ্বাস করতেন যে ভালোবাসায় যে কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, এমনকি সামাজিক শ্রেণি বৈষম্যজনিত সমস্যারও। কিন্তু মানুষ তাঁর এই মাহানুভাবতাকে বুঝতে পারে না, অনেকেই তাঁকে বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে সরে যায়।

দস্তয়েভস্কির যাবতীয় লেখালেখির মুখোমুখি হলে পাঠকের মনে যে কষ্ট জন্মে সেটা কি লেখকের জয়? না কি সেই চরিত্রগুলোর জন্য, যেগুলো মানব ইতিহাসের আবহমানকালের যন্ত্রণা ও নিঃসঙ্গতা নিয়ে টিকে আছে? প্রাবন্ধিক ও ফিল্ম সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গেলিখেছেন, ‘... তিনি যে চরিত্রের সমাবেশ করেছেন তা মহাভারতের কলমে অথবা ট্রয়ের যুদ্ধে দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু আধুনিক বলেই তিনি নির্জন-নিঃসঙ্গ-পরিত্রাণহীন মৃত্যু পথযাত্রী, হাতে সর্বনাশের একমাত্র ইস্তাহার; এই আমরা যারা চিরদিনের জন্য স্বর্গ থেকে পতিত: কারাযন্ত্রণার মধ্যে অথবা মাতৃগর্ভের অন্ধকারে আমরা যে গোপন চিরকূট বিনিময় করি তাতে একমাত্রদস্তয়েভস্কির স্বাক্ষরই থাকে। তিনি, একমাত্র তিনিই আমাদের পাপ ও পতনের মধ্যে বলতে পারেন- ‘আমি একা, এবং আমিই সর্বত্রগামী’। এই ‘একা ও সর্বত্রগামী’ মানুষটি, ফিওদর দস্তয়েভস্কির স্মরণের কারণ তাঁর জন্মগ্রহণের দু’শ’ বছর, অথবা আবহমানকালের দ্বন্দ্ব ও যন্ত্রণার, মানুষের একাকিত্বের কথোয়ালের অনতিক্রম্য সৃষ্টি। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কথায় কথা মিলিয়ে আমিও বলতে চাই যে, ‘যদি কোনো অলৌকিক অগ্নুৎপাত অথবা প্লাবনে পৃথিবী নামের এই গ্রহ আবার হিম গোলকে রূপান্তরিত হয় তবেও কারমাজভ পরিবারের কয়েকটি ছিন্ন পাতা, রাসকলনিকভ বা প্রিন্স মিসকিনের আর্ত জিজ্ঞাসা, মহাকাল ও মহাকাশকে জানিয়ে দেবে এই গ্রহে মানুষ বেঁচে ছিল’। দস্তয়েভস্কির প্রায় সমস্ত উপন্যাসেই মৃত্যু, মৃত্যুর আশঙ্কা, মৃত্যু ভয় ও মনস্তাপ, প্রায়শ্চিত্যের ধ্বনি অনুরণিত হয়।মৃত্যু আসলে তাঁর কাছে জীবনেরই কথা কয়, আলিয়সার মুখ দিয়ে তাই বলিয়ে নেন এইস্মরণযোগ্য কথাগুলো, ‘আমার মনে হয় পৃথিবীতে সকলের উচিত সবার উপরে জীবনকে ভালোবাসা’। ইভানের জিজ্ঞাসার উত্তরে সে তাই বলে, ‘যুক্তি তর্কের ওপরে, যুক্তিতর্ক ছাপিয়ে জীবনকে ভালোবাসা’। এটা হলো অর্ধেক, বাকি অর্ধেক হলো, ‘মৃতদের পুনরুত্থান, এমনও হতে পারে তাদের আদৌ মৃত্যু হয়নি, কখনো হয়নি’।

ইভান, কারমাজভ পরিবার, রাসকলনিকভ বা প্রিন্স মিশকিনের মতো চরিত্রের কান্না ও আর্তি পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসের আকাশে চিরকাল উজ্জ্বল আগ্নিগোলকের মতো মানবের চিন্তা চেতনায় আঘাত হানবে, তাকে সজীব রাখবে। সাহিত্য আলোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, “কলকাতা শহরে যখন আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শতবর্ষ অথবা ফ্রান্ৎস কাফকার ১২৫ বৎসর কাটাচ্ছি তখন দেখি যে আধুনিক যুগে সমস্তপ্রতিভাই দস্তয়েভস্কির স্বপ্নের অংশমাত্র। জোসেফ কে এবং শশি দুজনেই কোনো না কোনো সময় সেন্ট পিটার্সবুর্গের নেভস্কি প্রসপেক্ট নামক সড়কে হেঁটেছে, তারপর ইতস্তত যে যার স্বর্গের সন্ধানে চলে গেছেন, প্রাগে কিংবা ফরিদপুরে। দস্তয়েভস্কিকে আমি কোনো উপন্যাসকার বা কাহিনীকার এমনকি দার্শনিকওবলতে রাজি নই। তিনি, একমাত্র তিনিই, আমাদের রুগ্ণ আত্মার প্রথম ও শেষ পাহারাদার। যিনি নজর রাখেন আমরা যাতে নরকের পথে হারিয়ে না যাই।স্বর্গ আমাদের অজানাই থাকবে। কিন্তু সকৃতজ্ঞ চিত্তে যেন মনে রাখি মর্তের ঈষৎ দূরে অন্তরীক্ষে ফিওদর দস্তয়েভস্কি, শাপভ্রষ্ঠ দেবদূত, আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন।” (সমাপ্ত)

back to top