গৌতম রায়
গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে দাঁড়িয়ে যখন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পটভূমিকায় বরানগর থেকে কাঁচড়াপাড়া অঞ্চলে পাটশিল্পের বিকাশকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে মফস্বলের সার্বিক সমাজচিত্রবাহী ‘জগদ্দল’ সমরেশ বসু লিখছেন, তখনও এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে শক্ত বুনিয়াদে স্থিত থাকবার প্রধান রসদ জুগিয়ে চলছিল এই চটকলই। ব্যক্তি সমরেশের চটকল কেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা দুই বাংলাতেই ছড়ানো ছিল। সেই দিনের পূর্ববঙ্গ, যেকালে ঢাকার মুন্সিগঞ্জের পাটকলে কিশোর সমরেশ (তখন ওর নাম ‘সুরথ’) চাকরি করেছিলেন, আর যুবক সমরেশ ছয়ের দশকে যখন ‘জগদ্দল’ লিখছেন, বা তারও আগে ‘জগদ্দল’-এর পটভূমিকা নির্মাণে ‘উত্তরঙ্গ’ লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে পরিণত হয়ে, সেই পাটকলের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য কিছুটা হলেও বদলেছে।
অপরপক্ষে প্রথম যৌবনে পেটের তাগিদে নানাভাবে বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের যে পাটকলগুলির সঙ্গে সমরেশের একটা সংযোগ গড়ে উঠেছিল, এই উপন্যাসের রচনাকালের সময়ে, সেই পাটকল এবং তাকে ঘিরে পারিপার্শ্বিকের চেহারাও অনেকটাই বদলেছে। যে বদলের একটু একটু ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি সমরেশেরই ‘শ্রীমতী কাফে’ বা ‘বিটি রোডের ধারে’তে।
কেবল নিজের অভিজ্ঞতাই নয়, শুধুমাত্র দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটেও নয়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে, নীল চাষ যখন অস্তাচলে, রেশম চাষ ঘিরেও ব্রিটিশ পুঁজির সমৃদ্ধির দিন প্রায় শেষ, অথচ শিল্প বিপ্লব ইংলন্ডে যে পরিবর্তন এনেছে, তাকে ব্যবহারের সেভাবে পরিকাঠামো ব্রিটিশেরই তখন ভালোভাবে তৈরি হয়নি। সেই পরিকাঠামো নির্মাণের সলতে পাকানোর কাজে বাংলার নিস্তরঙ্গ চানকা বিধৌত হাবেলী শহর পরগণাকে বলি হাঁড়িকাঠে তুলতে ব্রিটিশের যে তোড়জোর, সেই প্রস্তুতির আহুতি এই অঞ্চলের যে মানুষ আর তাঁদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন, তার সার্বিক ছবি ফুটিয়ে তোলা- যে ঝুঁকি ইতিহাসের ছাত্ররা কখনও নেননি, সেই ঝুঁকি নিয়ে, অত্যন্ত সফলভাবে তা অতিক্রম করে সাফল্য ঘরে তোলা, এ বোধহয় সমরেশ বসু বলেই সম্ভব।
‘জগদ্দল’-এর শুরুতেই যে ভৌগোলিক এলাকা আগামী যন্ত্রপুরী হবে, সেখানকার নিস্তরঙ্গ, নিরুপদ্রব সমাজ জীবনের এক অসামান্য কাব্যগাথা রয়েছে। আজকের জগদ্দল বা তার আশেপাশের এলাকা দেখে কল্পনাতেও আনা শক্ত, এককালে এই অঞ্চলটি অমনতরো ছিল। আঠারোশো বিরাশির আতপুর, সেনপাড়া- যা আজকের জগদ্দল, কাঁকিনাড়া, ভাটপাড়া, গারুলিয়ার নিস্তরঙ্গ সামাজিক জীবন। তখন দুই সাহেবের এক শীতের সকালে ঘোড়ার পায়ের তালে বিচরণ কীভাবে কেবলমাত্র ভারত নয়, ব্রিটিশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদের ভিত নির্মাণের পদশব্দের সঙ্গে ধীরে ধীরে মিলে গেল বা বলা যেতে পারে ঘোড়ার ক্ষুরের সেই আওয়াজ রূপান্তরিত হলো ব্রিটিশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক সোপানে। সেটাই ‘জগদ্দলে’ সমরেশের ছায়া বিস্তারের প্রাথমিক পর্ব। এই ছায়াই ক্রমশ প্রলম্বিত হয়ে মানুষের স্মৃতি থেকে একদিন যে ‘সেনপাড়া’ হারিয়ে যাবে, হারিয়ে গিয়ে ‘জগদ্দল’ হবে, সেই স্থান নামের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দিলো সমরেশকে। তাই যাঁরা সমরেশ পড়েছেন সত্যি সত্যিই, তাঁদের কাছে যেন সমরেশের সমনাম হয়ে গেল ‘জগদ্দল’। আর যাঁরা না পড়েই সমরেশ বিশেষ অজ্ঞ হয়ে উঠেছেন, তাঁরাও প্রাইমারি স্কুলে নামতা পড়ার ঢঙে, সমরেশ উচ্চারণ করলেই ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’ (এই অংশের সমরেশপ্রেমীদের বেশিরভাগই ‘পাতক’ পড়া তো দূরের কথা, উপন্যাসটির নামই শোনেনি) -একটু ‘এ’ মার্কা সুড়সুড়ির সঙ্গেই ‘জগদ্দল’ আওড়াতে ভোলে না।
১৮৮২ সালের সময়কালকে সামনে ধরে সেই সময়ের শিল্প বিকাশের ধারা আর সমাজ ব্যবস্থার কথকতা দিয়ে এই মহাকাব্যের সূচনা সমরেশ করেছিলেন। এমন একটা সময়কালকে সামনে রেখে উপন্যাসের পটভূমি নির্মাণ, যে সময়কালে উপন্যাসটির ভৌগোলিক পটভূমি, অর্থাৎ বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের বিকাশমান অবস্থার ঊষালগ্ন, সেই কালপর্ব টি কিন্তু ১৮৫৭ সালে ঘটে যাওয়া ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের রেশ নিয়ে জেগে আছে। সেই জাগরণের উদ্দীপক পর্ব সমরেশ ‘উত্তরঙ্গের’ পটভূমি এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ইতিপূর্বেই এঁকে ফেলেছেন। ‘উত্তরবঙ্গ’ বাঙালি পাঠককে ইতিপূর্বেই বুঝিয়ে দিয়েছে, ভাষার জাগলারি না করে, সাধারণ পাঠকের মননলোককে স্পর্শ করে ‘ইতিহাস’, যে ইতিহাস তৈরি করে রাজরাজড়া নন, সামন্তপ্রভুরাও নন, সেটা তৈরি করে সাধারণ মানুষ, সেই ইতিহাসকে কীভাবে সাহিত্য উপজীব্য করে মানুষের কাছে তুলে ধরতে হয়।
সেই স্রোতধারার আরো প্রবাহিত পর্ব হলো ‘জগদ্দল’। এঁদো মফস্বলের শীতের শুরুর সময়কালের সকালবেলার ছবি দিয়ে উপন্যাসের শুরু।‘লেপ-কাঁথায় মুড়ি দিয়ে কেবলি ওম করে।যাব যাব করেও যেতে চায়না’- শীতের শুরুর নিছক বর্ণনা এই কটা লাইন কে ধরে নিলে ভীষণ ভুল হবে। উপন্যাসের শুরুতেই এই শব্দাবলীর ভিতর দিয়েসমরেশ বুঝিয়েদিতে চাইছেন ১৮৮২ সালের সদর লাগোয়া মফস্বল শহরের সামাজিক ছায়াচিত্রের একটা খ-চিত্র। এই চিত্রই আরো প্রলম্বিত হবে ভবিষৎতে ‘শ্রীমতী কাফে’র ‘ভজুলাট’ হয়ে, ‘ভানুমতী’ উপাখ্যানের ধারা বেয়ে, সমরেশের অনেকটা আত্মকথন আর ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের সঙ্কট, শিল্পাঞ্চলে কমিউনিস্ট ভাবধারার বিকাশের পথ বেয়ে লেখকের জীবন উপান্তের ‘খন্ডিতা’র ‘সতু’র আত্মপোলব্ধির ভিতর দিয়ে। যে সতু সদ্য ‘খ-িতা’ স্বদেশভূমির খ- রূপ দেখতে ছুটে গেছে রাডক্লিফের গ-ির অপরপ্রান্তে- মনে হচ্ছে যে কালকূট তাঁর ‘কোথায় পাব তারে’র যে অংশে বুড়িগঙ্গা ঘিরে শিশুর উপলব্ধি তুলে এনে গঙ্গার তীরে মুক্তারপুরে চিরশান্তিতে ঘুমিয়েরয়েছেন- সেই কালপর্বের সমাজকর্তন বা যুগকর্তন নয়, স্লাইডের মতো করে অতীতকে দেখাচ্ছেন, দেখাচ্ছেন ভবিষৎকে গড়বার সংকল্পে আগামীকে ব্রতী করতে।
ভারতবাসীর একাংশ, যাঁদের ভিতরে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের বিপদ বুঝে, সে সম্পর্কে ঘৃণা কি অগ্নুৎপাত ঘটাতে শুরু করেছিল তা সমরেশ ‘উত্তরঙ্গে’ মনসার পুত্র বলে পরিচিত হয়ে-ওঠা কেন্দ্রীয়চরিত্রটির মধ্য দিয়েবুঝিয়েছিলেন।ভূমিস্তরের মানুষের একটা ছোট অংশের ভিতরে এই ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের প্রতি ঘৃণার উদ্রেকপর্ব, এই পর্ব ঘিরে বাংলা সাহিত্যে যে খুব একটা চর্চা সমরেশের আগে এভাবে হয়েছে, তা বলা যায়না। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের বারমাস্যার ভিতরে ইতিহাসের যে জীবন্ত উপাদান থাকে, বিশ শতকের একটা বড়পর্ব ধরে সেই উপাদান বাংলা সাহিত্যে সেভাবে আসে নি।সাধারণের যাপনচিত্রকে ইতিহাস হিশেবে দেখবার প্রশ্নে কথাসাহিত্যিকদের কোথায় যেন একটা দ্বিধা ছিল।সঙ্কোচ ছিল। কার্পণ্যও যে ছিল না, তা জোর দিয়েবলা যায়না।
কথাসাহিত্যের এই ধারা ভাঙতে শুরু করেন তারাশঙ্কর, মানিকেরা। সেই ধারাকে একটা অত্যুচ্চ পর্বে মেলে ধরা-এ কৃতিত্বের সূচনাকার হিশেবে অবশ্যই সমরেশ বসুর নাম করতে হয়। রিচার্ড কব লিখেছিলেন, ‘ইনহেরিটস’ নামক এক মহাগ্রন্থ। সেখানে ১৭৮৯ সালে গ্রাম থেকে পারী শহর দেখতে আসা একটি মেয়ের কথা আছে।পুলিশের ফাইল থেকে কব উদ্ধার করেছিলেন মেয়েটির পরিণতির কথা। সেইন নদীর জলে মেয়েটির লাশ উদ্ধার করেছিল ফরাসি দেশের পুলিশ। রিচার্ড কবের ভাষায়, মেয়েটি বিপ্লবের অন্য মনষ্ক বলি।
দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের এক জীবন্ত বলি হলো সমরেশের ‘উত্তরঙ্গে’র সেই জল থেকে উদ্ধার হওয়া মানুষটির সঙ্গে যেন বড়ো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় রিচার্ড কবের সৃষ্ট সেই নাম না জানা ফরাসি দেশের কোনো এক অজানা গাঁ থেকে পারী শহর দেখতে আসা মেয়েটির। ১৮৫৭-র যে প্রভাব বারাকপুর সংলগ্ন এলাকার সামাজিক জীবনে পড়েছিল, ঔপনিবেশিক শক্তি সম্পর্কে ঘৃণার জন্ম তখনও না হলেও, বিরক্তির সূচনা শুরু হয়েগিয়েছিল- এই চিত্রায়ণের যে নির্মাণ ‘উত্তরঙ্গ’তে সবেমাত্র ফুটতে শুরু করেছিল, তা একটা অসামান্য মুন্সিয়ানায় প্রোজ্জ্বল হতে শুরু করলো ‘জগদ্দল’-এর প্রায়শুরু থেকেই।সমাজজীবনের চিত্রায়ণের ভিতর দিয়ে সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতির অদলবদলের যে আভাস সমরেশ এখানে দিচ্ছেন, সেই আভাসের ভিতরেও কিন্তু প্রথম থেকেই ধ্বনিত হচ্ছে ভারতের বৈচিত্র্যময় মিশ্র সংস্কৃতির সুর।এই সুরটিই সমরেশের মানুষের জীবনযুদ্ধ ঘিরে প্রতিটি লেখা, তা সে উপন্যাসই হোক বা ছোটগল্প বা কালকূট নামের লেখাগুলো- সেসবের সব থেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। শিল্পায়ন, ধনতন্ত্রের বিকাশপর্ব কীভাবে শ্রমের বাজারকে প্রলম্বিত করছে, আর সেই প্রলম্বনের ভিতরে অতি সাধারণ মানুষের মধ্যেও মালিকের প্রতি একটা ঘৃণার পরিবেশের জন্ম নিচ্ছে, মালিক নিজের স্বার্থে কীভাবে শ্রমিকের ব্যক্তিজীবনকে পর্যন্ত নিজের কব্জায় পুড়তে চাইছে; এই যে চিত্রায়ণ- এই চিত্রায়ণই সমরেশ বসুর ‘জগদ্দল’ উপন্যাসকে কেবলমাত্র উপন্যাসের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখেনি; উপন্যাসটিকে করে তুলেছে এক অনবদ্য সমাজকথন- যাকে এককথায় ইতিহাসের একটি ভাষ্য বললে অত্যুক্তি হবে না কোনোমতেই।
শীতের ভোরে ধীরে ধীরে সেনপাড়া, আগুড়িপাড়া, বাগদিপাড়া, জগদ্দল, মুসলমানপাড়ার জাগা- এ জাগা কেবল আক্ষরিক অর্থে জাগা নয়, অষ্টাদশ শতকের সুষুপ্তি থেকে সদর লাগোয়া মফস্বলের জেগে উঠবার যেন একটা বিরামবিহীন প্রস্তুতিপর্ব। যে প্রস্তুতির আগাম কোনো মহলা ছিল না, তাই, ‘থই থেকে অথই দূর’- সমরেশ ব্যবহৃত এই অসামান্য শব্দটি যেন এক মহাসমুদ্রের জলদগম্ভীর গর্জনের মতো করে সেইসময়টাকে এই সময়ের পাঠকের কাছে মেলে ধরছে। যে পাঠক হয়ত গভীর ইতিহাসবোধ, ইতিহাসের তন্বিষ্ঠ আবেগ- এসব কোনো কিছু নিয়েই ‘জগদ্দল’ পড়তে বসেন নি। নিছক একটা উপন্যাস পড়বার ইচ্ছে থেকে কোথাও একটা তাগিদ অনুভব করেছেন ‘জগদ্দল’ পাঠের, সেই পাঠ তাঁকে ক্রমে লেখকের কথার একটা অসামান্য প্রয়োগিক উপলব্ধিতে ধীরে ধীরে নিয়েচলে যাবে। ফরাসডাঙা থেকে ভেসে আসা উড়তি বাজারের বাজনা পাঠককে যে ‘থই’ এর ভিতর দোলা দেবে, সেই দোলাই ক্রমে ‘অথই দূরে’ তাঁকে নিয়ে চলে যাবে।এই চলে যাওয়াই সমরেশের সুরেই পাঠককে স্থিত করবে সারা দেশ থেকে মহাদেশান্তরে।তারপরেও যদি তার ব্যাপ্তি থাকে, সমরেশের ভাষার মতই, ‘তার ছড়াছড়ি’ চলবেই।
উপন্যাসের প্রথম পৃষ্ঠাতেই ফরাসডাঙার প্রসঙ্গ লেখক নিয়েআসছেন। এই বিষয়টি ঔপনিবেশিকতার রকমফেরের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের প্রয়াস। সেই প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে লেখক দুটি ঔপনিবেশিক শক্তির একটা তুল্যমূল্যের আভাস দিচ্ছেন।উপন্যাস যত এগোচ্ছে, কাহিনির বিস্তার যত ঘটছে ধীরে ধীরে তত এই ঔপনিবেশিকতার রকমের দিকটা আরো পরিষ্কার হয়ে উঠছে। দুটি সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির বিন্যাসগত দিকের যে তুলনামূলক চিত্র সমরেশ ‘জগদ্দল’-এর একদম সূচনাপর্বেই নিয়েএসেছেন, সেখানে আমাদের জাতীয়আন্দোলনের চরমপন্থী পর্বে একটা অংশের বিপ্লবীদের ভিতরে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদকে এদেশ থেকে তাড়াবার প্রশ্নে ফরাসি অধ্যুষিত চন্দননগর (উপন্যাসের শুরুতে বর্ণিত ‘ফরাসডাঙা’) ঘিরে আকর্ষণ- সেই আকর্ষণের রাজনৈতিক ভিত্তির বিষয়টিকেও প্রশ্নের মুখে ফেলবার এক জাদুময়ইঙ্গিত সমরেশ করছেন।এই ইঙ্গিত থেকে এটাই মনেহয়, ইতিহাসবোধে কতটা নির্মোহ এবং বস্তুনিষ্ঠ হলে এমন মূল্যায়ন সম্ভব।তবে এই মূল্যায়নের ভিত্তিভূমি সমরেশের মননলোকে উদ্ভাসিত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর যে শ্রেণি সংগ্রামের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ততা- সেকথার উল্লেখ না করলে সমরেশ বসুর মননলোকের রেখাচিত্র অঙ্কন সূচনাপর্বেই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
এই বোধই সমরেশের সারা জীবনব্যাপী সৃষ্টিকর্মের মূল সুর হিশেবে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
দুটি ঔপনিবেশিক শক্তি, ব্রিটিশ আর ফরাসি, এই দুটির ভিতরে আলোচনাসাপেক্ষ কেউ বেশি মন্দ, কেউ কম মন্দ- এককালের রাজনীতিকদের এই ধারণার ভিতরে যে গলদ, আর সেই গলদের মাশুল যে দেশবাসীকে বেশ ভালোভাবেই দিতে হয়েছে- উপন্যাসের শুরুতেই দুই সা¤্রাজ্যবাদের প্রয়োগজনিত যে বৈশিষ্ট্য গুলির উল্লেখ সমরেশ করেছেন, তার ভিতর দিয়েই রাজনীতির দিকনির্দেশের এক গূঢ়তত্ত্বকে তিনি তুলে ধরছেন।না বলা কথার ভিতর দিয়েএই যে অনেক কিছু বলা, এটা কেবলমাত্র ‘জগদ্দল’ উপন্যাসে সমরেশের লেখন শৈলির বৈশিষ্ট্য নয়; তাঁর গোটা জীবনের লেখনশৈলির এটা একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক।এই না বলেও অনেককিছু বলবার বৈশিষ্ট্যগত প্রয়োগে সমরেশ কিন্তু কখনো শব্দচয়ণ, উপস্থাপনা- কোনো ক্ষেত্রেই একবারের জন্যেও সাধারণ মানুষের ধরাছোঁঁয়ার বাইরে নিজের কলমকে পরিচালিত করেন নি।সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্যক্তি সমরেশের নিবিড়সংযোগ যেন তাঁর কলমকেও সাধারণের মনের কথাকেই অসাধারণ করে উপস্থাপনার একটা শক্তি জুগিয়েছিল।
সমরেশ কখনো রাজনীতি নিরপেক্ষ ছিলেন না। আবার সমরেশের মননে রাজনীতি মানে কখনোই কোনো দলীয় রাজনীতির প্রতি হেলে পড়া নয়; সমরেশের রাজনীতি ছিল আদর্শবাদের প্রতি প্রগাঢ় আস্থা। আর সেই আস্থার পক্ষপাতিত্বটা ছিল শ্রেণি সংগ্রামের পক্ষের শক্তির প্রতি। নিজের প্রথম জীবনের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক যাপন তাঁকে ‘মানুষ রতন’ নামক কালজয়ী ছোটগল্পের অভিজ্ঞতা দিয়েছিল। রাজনৈতিক দর্শনে আস্থা যত দৃঢ়ই হোক না কেন, সবার উপরে ফ্রাকশনিজিম, তাহার উপর নাই- এই বিকৃত বোধ রাজনীতির নামে পরিবেশন করলে তার কি বিষময়পরিণতি রাজনীতি এবং রাজনীতিকের জীবনে ঘটতে পারে, সমরেশ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন এই ‘মানোষ রতন’-এর মত গল্পে, ‘তিন পুরুষে’র মত উপন্যাসে।
গঙ্গার পশ্চিমপারে ফরাসডাঙায় ‘উড়তিবাজার’ আর পূর্বপারে সাহেবের এক্কাগাড়ির কৌচের, ‘গদির মাথায় নকশা কাটা রুপোর পাতের মাঝে মিনে করা হয়েছে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার মূর্তি’- দুই সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির বহিরঙ্গের প্রকাশভঙ্গিমা যে অন্তরঙ্গকে আড়াল করতে পারে না- এই বোধের উপর যখন সমরেশ তাঁর এই উপন্যাসের মুখরাটা রচনা করেন, তখনই বুঝতে পারা যায়রাজনৈতিক বোধ আর সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার আত্মস্থ বোধ লেখককে কোন চরম মেধায় উন্নীত করেছিল- যার জেরে সদ্য স্বাধীন ভারত, যে সময়ে সমরেশ উনিশ শতকের প্রথম পর্বকে পটভূমিতে রেখে এই উপন্যাস লিখছেন, সেই সময়কালেও একটা বড়অংশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভিতরে ফরাসি ঔপনিবেশিকতা সম্পর্কে একটা মোহ থাকলেও সঠিক রাজনৈতিক বোধের ফলে সেই মোহের ফাঁদে পড়ে লেখক সমরেশ কিন্তু একবারের জন্যেও হাবুডুবু খাচ্ছেন না। ডোবা তো দূরের কথা।
‘উড়তিবাজার’ আর ‘মহারাণী ভিক্টোরিয়া’- দুই যে অভিন্ন সাম্রাজ্যবাদের এক ই মুদ্রার দুটি দিক- আমাদের জাতীয়আন্দোলনকালে চরমপন্থী ভাবধারার মানুষ সেটা বুঝতেই চাননি।তাইই আলিপুর বোমা মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে অরবিন্দ ঘোষ তাঁর ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্যে বেছে নিয়েছিলেন আমাদের দেশে ফরাসি উপনিবেশকে।তারপর তো তাঁর আধ্যাত্মিক ভাবান্তরের আর একটা ভিন্ন পর্যায়।
উপন্যাসের শুরুতেই ব্রিটিশ মদদে পুঁজির বিকাশের এই পর্ব, যা ভারতে শিল্পায়নের প্রথম পর্ব হিশেবে চিহ্নিত, এই পর্বকাল বাংলা এবং বাঙালির সমাজজীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করলো- ‘জগদ্দল’ উপন্যাসে এই কালপর্বের আখ্যান কেবলমাত্র একটা উপন্যাসে বর্ণিত কাহিনি নয়; বাংলা যেহেতু তখনও ঔপনিবেশিক শাসকদের ইচ্ছায় গোটা ভারতের রাজধানী, তাই বাংলায় শিল্পায়ন, বাঙালির সামাজিক জীবনকে কীভাবে,ধীরে ধীরে একটা অদলবদলের দিকে নিতে শুরু করলো সেটা বোঝবার নিরিখে সমরেশ বসুর কলম যেভাবে ছুঁটেছে, তাকে কেবলমাত্র সাহিত্যিকের কলম বলা যায়না।সমরেশ এখানে একাধারে সাহিত্যিক, একাধারে ঐতিহাসিক, সর্বোপরি একজন সমাজবিজ্ঞানী।সমাজবিজ্ঞানের কত গভীরে প্রবেশ করতে পারলে শতবর্ষ প্রাচীন জনজীবনের এমন অনুপুঙ্খ যাপনচিত্রের চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব, সেটা শিখবার জন্য সমাজবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার অনুরাগী ছাত্র, শিক্ষক, পাঠককে সমরেশ বসুর এই লেখা বার বার পড়তে হয়। নতজানু হতে হয় এই কালোত্তীর্ণ ¯্রষ্ঠার কাছে।
যে সময়কালের কথা সমরেশ বলছেন, সেই কালপর্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার সামাজিক বিন্যাস বদলে দিয়েছে অনেকখানি। ব্রিটিশের সঙ্গে, ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য, মুৎসুদ্দিগিরি করেবাঙালিরএকটা অংশের অর্থনৈতিক জীবনের বিন্যাসের অনেকখানি অদলবদল হয়েছে। গ্রামীণ বাংলার ভূমি ব্যবস্থাতেও অনেকখানি পরিবর্তন এসেছে। বনেদি জমিদারকুলের অনেকখানিই ব্রিটিশের নতুন কর ব্যবস্থার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি।জমিদারি তাঁদের হাত বদল হয়েছে। ব্রিটিশের সঙ্গে বাণিজ্য করে হঠাৎ বডলোক হয়েওঠা, কলকাতায়এসে বসবাস করতে থাকা একটা অংশের মানুষ নতুন করে জমিদার হয়েছেন। এই নতুন জমিদারদের জমিদারি পরিচালনার ক্ষেত্রে অতীতের বনেদি জমিদারদের কার্যকলাপের সঙ্গে বেশ খানিকটা ফারাক তখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। কলকাতানির্ভর এই জমিদারদের তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, আজকের বাংলাদেশে জমিদারির অবস্থান, জমিদার আর প্রজাদের ভিতরে বিস্তর দূরত্ব তৈরি করছে।এই যে জমিদার আর প্রজার ভিতরে ভৌগোলিক দূরত্ব, তা সহজেই তৈরি করছে সামাজিক দূরত্ব। আর সেই সামাজিক দূরত্বের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জমিদারি পরিচালনা ঘিরে প্রজা আর জমিদারদের মধ্যে দূরত্ব।যা ক্রমে রচনা করছে একটা একটা সংঘাতের পরিবেশ। এই পরিবেশের প্রভাব গোটা বাংলা জুড়েই নানাভাবে পড়তে থাকে।চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে যে জমিদারেরা ছিলেন, জাত্যাভিমান তাঁদের ভিতর যে জায়গায়ছিল, সেটা পরবর্তী পর্বের জমিদারদের অনেকেই বহন করে চলেছিলেন। সেই সঙ্গে জমিদারদের একটা অংশের ভিতরে নিম্নবর্গীয় হিন্দু এবং মুসলমান- উভয়ের প্রতিই যে নেতিবাচক মানসিকতা ছিল, সেটা থেকে নতুন জমিদাররা কোনোভাবেই নিজেদের মুক্ত করতে প্রয়াসী হয়নি।
সামাজিক বিন্যাসের এই বদল শ্রীচৈতন্য পরবর্তী বাংলায়ধীরে ধীরে তন্ত্র সাধনার নামে যে বামাচারী ধারা, যা ক্রমে বৌদ্ধ ধর্মের ভিতরেও প্রবেশ করতে থাকে, তার ব্যাপ্তি যে পূর্ববঙ্গকে অতিক্রম করে কলকাতা সন্নিহিত অঞ্চলের সামাজিক পরিবেশেও কতোখানি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিল, তা উপন্যাসে উল্লিখিত অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিব্যাপ্তিতে ঘটনাক্রমকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমরেশ দেখিয়েছিলেন ‘উত্তরঙ্গ’ত।‘কালী’ দেবীকে ঘিরে বিশ্বাস আর লোকাচারের যে প্রাবল্যের একটা হালকা ছবি ‘উত্তরঙ্গে’ রয়েছে, সেই ছবিই হলো, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে বাংলার সামাজিক পরিম-লে বামাচারী তন্ত্রসাধনার ধারা উপধারার একটা ছোট্ট খ- চিত্র।
এই চিত্রের পরিব্যাপ্তি আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘জগদ্দলে’র শুরুর দিকেও। গারুলিয়ার ভৌগোলিক বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রসন্ন ঠাকুরদের প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রহ্মময়ী’ কালী মন্দিরের উল্লেখ এই অঞ্চলের সঙ্গে নবজাগরণকালের বিশিষ্টজনেদের সংযোগের একটা ছবি তুলে ধরছে।ক্রমে উপন্যাসের গহীনে যখন আমরা প্রবেশ করব, তখন দেখতে পাব, গারুলিয়ার পাশে ভাটপাড়ার অবাঙালি পাশ্চাত্য, দাক্ষিণাত্য ব্রাহ্মণকুলের সঙ্গে এই শাক্ত মত ধারার সংঘাত। দশরথনন্দন ‘রাম’কে ঘিরে আজ গোটা ভারতেরাজনীতির যে দড়িটানাটানি, বাংলায়, সেই ধনুর্ধারী রামকে ঘিরে ভাবাবেগ তৈরির বিষয়টিও যে উত্তরপ্রদেশের কনৌজ থেকে বাংলায়এসে, থেকে যাওয়া পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণেরাই করেছিল- রাম-শৈবভাবনা এবং শাক্তভাবনার সংঘাতের সেদিন রূপ বর্ণনের ভিতর দিয়েসমরেশ বসু যেন আজকের বিপর্যস্ত বারাকপুর শিল্পাঞ্চলটিকেই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন।
তন্ত্রশাস্ত্রের ধারাবাহিকতাকে কেন্দ্র করে ‘কালী’ দেবীর প্রতি ভক্তি এবং চর্চার ধারা ঔপনিবেশিক যুগের প্রথম পর্বে ‘জগদ্দল’ উপন্যাসের ভৌগোলিক পটভূমিতে কতটা প্রকট ছিল তা আমরা ‘উত্তরবঙ্গ’-এ দেখেছি। ‘জগদ্দল’-এ দেখছি, ‘কালীবাড়িত বাজছে কাঁসরঘণ্টা।পাথুরেঘাটার পেসন্ন ঠাকুরের অর্থাৎ প্রসন্ন ঠাকুরের কালীবাড়ি। মেয়ের নামে কালীর নাম রেখেছেন ব্রহ্মময়ী। শ্যামনগরে তাঁদের জমিদারিতে ব্রহ্মময়ী অধিষ্ঠিতা। লোকে বলে ব্রেহ্মময়ী রেললাইনের ধারে একখানি ঘর, ঘরের বাইরে প্ল্যাটফর্মের শেষ সীমায় একটি ইট সিমেন্টের পোস্টের গায়ে লেখা আছে ঝঐটগঘটএএজ বোধহয় ওটাই শ্যামনগরের ইংরেজি বানান।’
এই অঞ্চলের প্রাচীন জমিদারেরা কীভাবে জমিদারি হারিয়েছেন তার ধারাভাষ্য রয়েছে ‘উত্তরঙ্গ’তে।চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভূমি ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন এনেছে, তার জেরেই ইংরেজদের মুৎসুদ্দিগিরি করে বাইরে থেকে নতুন গড়েওঠা কলকাতায় এসেছেন এই প্রসন্ন ঠাকুর।ব্যবসার জোরে বিত্তবান হয়েছেন। সেই বিত্তের জোরেই আগের দিনের জমিদারদের সঙ্কটের সুযোগ নিয়েজমিদারি কিনেছেন।এই অঞ্চলের জমিদার হয়েছেন।
এই যে জমি ব্যবস্থার বদলের সঙ্গে জমিদারি ব্যবস্থার বদলের যে ছবি সমরেশ আঁকছেন, সেই রেখাচিত্রের ভিতর দিয়ে গ্রামীণ বাংলার সামাজিক পটচিত্রের ক্রম পরিবর্তনশীল ছবি উঠে আসছে। একটা উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে প্রবেশের আগে, সমাজচিত্রের এই বদলের চিহ্নটাকে আঁকবার যে আঙ্গিক সমরেশ ‘জগদ্দলে’ ফুটিয়েতুলছেন, এটা একজন সমাজবীক্ষণরত শিল্পীর চোখ। এই বীক্ষণের ইচ্ছে, আকাক্সক্ষা কেবলমাত্র একজন কথাকারের হয়না। মু-ক্য উপনিষদের বাণী, ‘যা আমাকে অমৃত না করবে, তা দিয়ে আমি কী করব’- এই বোধের অনুরণন যে সমরেশ বসুকে লেখক জীবনের শুরু থেকে জীবনদীপ নির্বাণের মুহূর্ত পর্যন্ত তাড়িত করত- সেই অন্তহীন জাগরের স্ফুরণই ‘জগদ্দল’-এর সূচনাপর্বেই বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই মানুষে, সেই মানুষের সন্ধানে সমরেশের গোটা জীবনের পথচলার অন্ধিসন্ধির এক রেখাচিত্রকে।
শ্রীচৈতন্যকে কেন্দ্র করে বাংলায় ভক্তি আন্দোলন, যা প্রবাহমান ভারতের সমন্বয়ী ধারার এক অনবদ্য পুনরুজ্জীবন, সেই ধারা কিন্তু ‘জগদ্দল’ উপন্যাসের ভৌগোলিক পটভূমিকাতে ব্রাহ্মণ্যবাদের ভয়ঙ্কর জাত্যাভিমানের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল।‘জগদ্দল’ উপন্যাসের ভৌগোলিক পটভূমিকার ভিতরে শ্রীচৈতন্যের দীক্ষাগুরুর আবাসভূমি। সেখানে প্রথম জীবনে চৈতন্যদেব এসেছিলেন। থেকেছিলেন। গুরুর কাছে দীক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যবাদের মধ্যেকার আভ্যন্তরীণ সঙ্কট এবং দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য সমাজের স্মৃতিশাস্ত্র নির্ভর কূপম-ূকতা বনাম বরেন্দ্র ব্রাহ্মণদের দর্শন শাস্ত্র চর্চা, নারীর অধিকার, ঔপনিবেশিক শাসন, নবজাগরণের প্রভাব গঙ্গানদীর পশ্চিমপারে, হুগলী-গুপ্তিপাড়া থেকে হালিশহর- এসব জীবনবীক্ষণকে কেন্দ্র করে সমরেশের অনবদ্য সৃষ্টি ‘ভানুমতী’ যাকে ‘জগদ্দল’ পর্বের একটা অংশ বললে ভুল হবে না। সেই সৃষ্টিতেও যে সামাজিক দ্বন্দ্ব আছে উনিশ শতকের প্রারম্ভে শিল্পের বিকাশ, বিশেষ করে চটকল তৈরি, সামাজিক বিন্যাসের গ্রন্থিমোচন- এসব যেন এককালে শ্রীচৈতন্যকে ঘিরে ভাটপাড়ার চরম প্রতিক্রিয়াশীল পাশ্চাত্য এবং দাক্ষিণাত্য ব্রাহ্মণ সমাজ, যারা আদৌ বাঙালিই নয়, বাংলায়থাকতে থাকতে বাংলা ভাষা রপ্ত করে বাঙালি হয়েওঠার চেষ্টা করে চলেছে, এই অংশটি যেভাবে এই অঞ্চল দিয়ে শ্রীচৈতন্যের গমনাগমনে অন্তরায়হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যা ‘জগদ্দল’ উপন্যাসের যে ভৌগোলিক বিস্তারের ক্ষেত্র, সেই অঞ্চলকে কীভাবে জাত্যাভিমান এবং ধর্মের নামে প্রতিক্রিশীরতার আঁঁতুরঘর নির্মাণের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল, তা এই ‘ব্রহ্মময়ী’ কালী মন্দিরের উল্লেখের মধ্যে দিয়েই কিছু না বলেও অনেককিছু বলবার চেষ্টা করেছেন সমরেশ বসু।
জোড়াসাঁকোর পাথুরেঘাটা শাখার প্রসন্ন ঠাকুরের যে উল্লেখ সমরেশ করছেন ‘জগদ্দল’ উপন্যাসে, সেই উল্লেখকে নিছক শ্যামনগরের ‘ব্রহ্মময়ী’ কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার নামের উল্লেখ করতে করা, এমনটা মনে করলে, সমরেশের এই উল্লেখপর্বের সম্যক দিকটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে না। ‘জগদ্দল’ উপন্যাসের বিস্তৃত পটভূমিকায় চরিত্রগুলির ভিতরের যে দ্বন্দ্ব, সেলফ কনট্রাডিকশন, চরিত্রগুলির দ্বিমুখী, এমনকি ত্রিমুখী ধারা, তার সঙ্গে সমসাময়িক সমাজচিত্রের ভেতর যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব- সেসবের আভাস দিতে ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের চরিত্র সম্পন্ন উনিশ শতকের নবজাগরণ পর্বের অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র প্রসন্ন ঠাকুরের নামটি কি সমরেশ উল্লেখ করেছেন? তন্ত্র সাধনার এক বামাচারী ধারা প্রবর্তনের চেষ্টা কি আজকের বারাকপুর শিল্পাঞ্চলে করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন প্রসন্ন ঠাকুর বা তাঁর অনুরাগীরা? তাই তন্ত্র সাধক ‘বামাক্ষেপা’র এই ব্রহ্মময়ী কালী মন্দিরে কিছুকাল অবস্থানের বিষয়টা কি সমাজসন্ধানী সমরেশের মনের গহীনে এই অঞ্চলের সমাজচিত্রের একটা ভিন্ন ধারার প্রয়াসে একদল লোকের চেষ্টার দিকে ইঙ্গিতবাহী হয়েই এই প্রসন্ন ঠাকুরের নামোল্লেখ?
আতপুর, জগদ্দল, শ্যামনগর- এই এলাকাগুলিতে বামাচারি তান্ত্রিক প্রক্রিয়ার চর্চার একটা জোরদার আভাস সমরেশ রেখেছিলেন ‘উত্তরঙ্গ’তে। সেই চর্চার সঙ্গে ডাকাতি ইত্যাদির বিষয়গুলিকেও তিনি সম্পৃক্ত করেছিলেন। আগ্রহের তাগিদে এই ধরনের চর্চার লোকেদের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের পরিচয় থাকবার এক অসামান্য খ-চিত্রও সমরেশ এঁকেছিলেন ‘উত্তরঙ্গ’তে। সেই সমরেশ, যিনি মাটির কাছে থাকা জীবনের বারমাস্যা ঘিরে মানুষের জীবনকাহিনি লিখে গেলেন চিরকাল, স্থানীয়ব্যক্তিত্ব হিশেবেই এই উপন্যাসের পূর্ববর্তী অংশ ‘উত্তরঙ্গ’তে উল্লেখ করলেন কাঁঠালপাড়া, সেখানকার সুসন্তান বঙ্কিমকে, কিন্তু সেই উল্লেখ কখনো বঙ্কিমকে ঘিরে কোনো উচ্ছ্বাস থেকে তিনি একবারের জন্যেও করলেন না। সেই সমরেশই যখন প্রায়ত্রিবিধ দ্বন্দ্বের মধ্যে জীবন কাটানো প্রসন্ন ঠাকুরের কথা বলছেন, তখন বোঝা যাচ্ছে, হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠাতার পুত্র প্রসন্ন, রামমোহনের সতীদাহ নিবারণের অন্যতম সহযোগী, তিনিই আবার ১৮৫৭’র প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের তীব্রবিরোধী, রামমোহন সহযোগী হয়েও, পৌত্তলিকতার সমালোচক হয়েও বাড়িতে দুর্গাপুজো করছেন। একাণ্ডের প্রবল সমালোচনা করেছিলেন ডিরোজিও। আবার লেবেদেফের প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ফর্মে নিজের বাড়িতে থিয়েটার করছেন।ইনিই কিন্তু তন্ত্রসাধক বামাক্ষেপাকে আবার নিজের এমারেল বাওয়ারে রেখে দিচ্ছেন।
উপন্যাসে প্রসন্ন ঠাকুরের এই উল্লেখকে নিছক ইনফরমেটিভ ভাবলে মনেহয়সমরেশের সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা সমাজবীক্ষণের চিন্তাকে আমরা বুঝতে ভুল করব।‘জগদ্দল’-এর কালপর্বে সমাজপতি এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের যে বহুমুখী চরিত্র তাদের শ্রেণিস্বার্থে পরিচালিত হয়ে চলেছিল- সেই বিষয়টির দিকে কিছু না বলেও অনেক কিছু বলবার তাগিদেই সমরেশের এই ‘প্রসন্ন ঠাকুর’-এর উল্লেখ।
গৌতম রায়
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে দাঁড়িয়ে যখন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পটভূমিকায় বরানগর থেকে কাঁচড়াপাড়া অঞ্চলে পাটশিল্পের বিকাশকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে মফস্বলের সার্বিক সমাজচিত্রবাহী ‘জগদ্দল’ সমরেশ বসু লিখছেন, তখনও এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে শক্ত বুনিয়াদে স্থিত থাকবার প্রধান রসদ জুগিয়ে চলছিল এই চটকলই। ব্যক্তি সমরেশের চটকল কেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা দুই বাংলাতেই ছড়ানো ছিল। সেই দিনের পূর্ববঙ্গ, যেকালে ঢাকার মুন্সিগঞ্জের পাটকলে কিশোর সমরেশ (তখন ওর নাম ‘সুরথ’) চাকরি করেছিলেন, আর যুবক সমরেশ ছয়ের দশকে যখন ‘জগদ্দল’ লিখছেন, বা তারও আগে ‘জগদ্দল’-এর পটভূমিকা নির্মাণে ‘উত্তরঙ্গ’ লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে পরিণত হয়ে, সেই পাটকলের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য কিছুটা হলেও বদলেছে।
অপরপক্ষে প্রথম যৌবনে পেটের তাগিদে নানাভাবে বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের যে পাটকলগুলির সঙ্গে সমরেশের একটা সংযোগ গড়ে উঠেছিল, এই উপন্যাসের রচনাকালের সময়ে, সেই পাটকল এবং তাকে ঘিরে পারিপার্শ্বিকের চেহারাও অনেকটাই বদলেছে। যে বদলের একটু একটু ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি সমরেশেরই ‘শ্রীমতী কাফে’ বা ‘বিটি রোডের ধারে’তে।
কেবল নিজের অভিজ্ঞতাই নয়, শুধুমাত্র দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটেও নয়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে, নীল চাষ যখন অস্তাচলে, রেশম চাষ ঘিরেও ব্রিটিশ পুঁজির সমৃদ্ধির দিন প্রায় শেষ, অথচ শিল্প বিপ্লব ইংলন্ডে যে পরিবর্তন এনেছে, তাকে ব্যবহারের সেভাবে পরিকাঠামো ব্রিটিশেরই তখন ভালোভাবে তৈরি হয়নি। সেই পরিকাঠামো নির্মাণের সলতে পাকানোর কাজে বাংলার নিস্তরঙ্গ চানকা বিধৌত হাবেলী শহর পরগণাকে বলি হাঁড়িকাঠে তুলতে ব্রিটিশের যে তোড়জোর, সেই প্রস্তুতির আহুতি এই অঞ্চলের যে মানুষ আর তাঁদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন, তার সার্বিক ছবি ফুটিয়ে তোলা- যে ঝুঁকি ইতিহাসের ছাত্ররা কখনও নেননি, সেই ঝুঁকি নিয়ে, অত্যন্ত সফলভাবে তা অতিক্রম করে সাফল্য ঘরে তোলা, এ বোধহয় সমরেশ বসু বলেই সম্ভব।
‘জগদ্দল’-এর শুরুতেই যে ভৌগোলিক এলাকা আগামী যন্ত্রপুরী হবে, সেখানকার নিস্তরঙ্গ, নিরুপদ্রব সমাজ জীবনের এক অসামান্য কাব্যগাথা রয়েছে। আজকের জগদ্দল বা তার আশেপাশের এলাকা দেখে কল্পনাতেও আনা শক্ত, এককালে এই অঞ্চলটি অমনতরো ছিল। আঠারোশো বিরাশির আতপুর, সেনপাড়া- যা আজকের জগদ্দল, কাঁকিনাড়া, ভাটপাড়া, গারুলিয়ার নিস্তরঙ্গ সামাজিক জীবন। তখন দুই সাহেবের এক শীতের সকালে ঘোড়ার পায়ের তালে বিচরণ কীভাবে কেবলমাত্র ভারত নয়, ব্রিটিশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদের ভিত নির্মাণের পদশব্দের সঙ্গে ধীরে ধীরে মিলে গেল বা বলা যেতে পারে ঘোড়ার ক্ষুরের সেই আওয়াজ রূপান্তরিত হলো ব্রিটিশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক সোপানে। সেটাই ‘জগদ্দলে’ সমরেশের ছায়া বিস্তারের প্রাথমিক পর্ব। এই ছায়াই ক্রমশ প্রলম্বিত হয়ে মানুষের স্মৃতি থেকে একদিন যে ‘সেনপাড়া’ হারিয়ে যাবে, হারিয়ে গিয়ে ‘জগদ্দল’ হবে, সেই স্থান নামের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দিলো সমরেশকে। তাই যাঁরা সমরেশ পড়েছেন সত্যি সত্যিই, তাঁদের কাছে যেন সমরেশের সমনাম হয়ে গেল ‘জগদ্দল’। আর যাঁরা না পড়েই সমরেশ বিশেষ অজ্ঞ হয়ে উঠেছেন, তাঁরাও প্রাইমারি স্কুলে নামতা পড়ার ঢঙে, সমরেশ উচ্চারণ করলেই ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’ (এই অংশের সমরেশপ্রেমীদের বেশিরভাগই ‘পাতক’ পড়া তো দূরের কথা, উপন্যাসটির নামই শোনেনি) -একটু ‘এ’ মার্কা সুড়সুড়ির সঙ্গেই ‘জগদ্দল’ আওড়াতে ভোলে না।
১৮৮২ সালের সময়কালকে সামনে ধরে সেই সময়ের শিল্প বিকাশের ধারা আর সমাজ ব্যবস্থার কথকতা দিয়ে এই মহাকাব্যের সূচনা সমরেশ করেছিলেন। এমন একটা সময়কালকে সামনে রেখে উপন্যাসের পটভূমি নির্মাণ, যে সময়কালে উপন্যাসটির ভৌগোলিক পটভূমি, অর্থাৎ বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের বিকাশমান অবস্থার ঊষালগ্ন, সেই কালপর্ব টি কিন্তু ১৮৫৭ সালে ঘটে যাওয়া ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের রেশ নিয়ে জেগে আছে। সেই জাগরণের উদ্দীপক পর্ব সমরেশ ‘উত্তরঙ্গের’ পটভূমি এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ইতিপূর্বেই এঁকে ফেলেছেন। ‘উত্তরবঙ্গ’ বাঙালি পাঠককে ইতিপূর্বেই বুঝিয়ে দিয়েছে, ভাষার জাগলারি না করে, সাধারণ পাঠকের মননলোককে স্পর্শ করে ‘ইতিহাস’, যে ইতিহাস তৈরি করে রাজরাজড়া নন, সামন্তপ্রভুরাও নন, সেটা তৈরি করে সাধারণ মানুষ, সেই ইতিহাসকে কীভাবে সাহিত্য উপজীব্য করে মানুষের কাছে তুলে ধরতে হয়।
সেই স্রোতধারার আরো প্রবাহিত পর্ব হলো ‘জগদ্দল’। এঁদো মফস্বলের শীতের শুরুর সময়কালের সকালবেলার ছবি দিয়ে উপন্যাসের শুরু।‘লেপ-কাঁথায় মুড়ি দিয়ে কেবলি ওম করে।যাব যাব করেও যেতে চায়না’- শীতের শুরুর নিছক বর্ণনা এই কটা লাইন কে ধরে নিলে ভীষণ ভুল হবে। উপন্যাসের শুরুতেই এই শব্দাবলীর ভিতর দিয়েসমরেশ বুঝিয়েদিতে চাইছেন ১৮৮২ সালের সদর লাগোয়া মফস্বল শহরের সামাজিক ছায়াচিত্রের একটা খ-চিত্র। এই চিত্রই আরো প্রলম্বিত হবে ভবিষৎতে ‘শ্রীমতী কাফে’র ‘ভজুলাট’ হয়ে, ‘ভানুমতী’ উপাখ্যানের ধারা বেয়ে, সমরেশের অনেকটা আত্মকথন আর ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের সঙ্কট, শিল্পাঞ্চলে কমিউনিস্ট ভাবধারার বিকাশের পথ বেয়ে লেখকের জীবন উপান্তের ‘খন্ডিতা’র ‘সতু’র আত্মপোলব্ধির ভিতর দিয়ে। যে সতু সদ্য ‘খ-িতা’ স্বদেশভূমির খ- রূপ দেখতে ছুটে গেছে রাডক্লিফের গ-ির অপরপ্রান্তে- মনে হচ্ছে যে কালকূট তাঁর ‘কোথায় পাব তারে’র যে অংশে বুড়িগঙ্গা ঘিরে শিশুর উপলব্ধি তুলে এনে গঙ্গার তীরে মুক্তারপুরে চিরশান্তিতে ঘুমিয়েরয়েছেন- সেই কালপর্বের সমাজকর্তন বা যুগকর্তন নয়, স্লাইডের মতো করে অতীতকে দেখাচ্ছেন, দেখাচ্ছেন ভবিষৎকে গড়বার সংকল্পে আগামীকে ব্রতী করতে।
ভারতবাসীর একাংশ, যাঁদের ভিতরে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের বিপদ বুঝে, সে সম্পর্কে ঘৃণা কি অগ্নুৎপাত ঘটাতে শুরু করেছিল তা সমরেশ ‘উত্তরঙ্গে’ মনসার পুত্র বলে পরিচিত হয়ে-ওঠা কেন্দ্রীয়চরিত্রটির মধ্য দিয়েবুঝিয়েছিলেন।ভূমিস্তরের মানুষের একটা ছোট অংশের ভিতরে এই ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের প্রতি ঘৃণার উদ্রেকপর্ব, এই পর্ব ঘিরে বাংলা সাহিত্যে যে খুব একটা চর্চা সমরেশের আগে এভাবে হয়েছে, তা বলা যায়না। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের বারমাস্যার ভিতরে ইতিহাসের যে জীবন্ত উপাদান থাকে, বিশ শতকের একটা বড়পর্ব ধরে সেই উপাদান বাংলা সাহিত্যে সেভাবে আসে নি।সাধারণের যাপনচিত্রকে ইতিহাস হিশেবে দেখবার প্রশ্নে কথাসাহিত্যিকদের কোথায় যেন একটা দ্বিধা ছিল।সঙ্কোচ ছিল। কার্পণ্যও যে ছিল না, তা জোর দিয়েবলা যায়না।
কথাসাহিত্যের এই ধারা ভাঙতে শুরু করেন তারাশঙ্কর, মানিকেরা। সেই ধারাকে একটা অত্যুচ্চ পর্বে মেলে ধরা-এ কৃতিত্বের সূচনাকার হিশেবে অবশ্যই সমরেশ বসুর নাম করতে হয়। রিচার্ড কব লিখেছিলেন, ‘ইনহেরিটস’ নামক এক মহাগ্রন্থ। সেখানে ১৭৮৯ সালে গ্রাম থেকে পারী শহর দেখতে আসা একটি মেয়ের কথা আছে।পুলিশের ফাইল থেকে কব উদ্ধার করেছিলেন মেয়েটির পরিণতির কথা। সেইন নদীর জলে মেয়েটির লাশ উদ্ধার করেছিল ফরাসি দেশের পুলিশ। রিচার্ড কবের ভাষায়, মেয়েটি বিপ্লবের অন্য মনষ্ক বলি।
দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের এক জীবন্ত বলি হলো সমরেশের ‘উত্তরঙ্গে’র সেই জল থেকে উদ্ধার হওয়া মানুষটির সঙ্গে যেন বড়ো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় রিচার্ড কবের সৃষ্ট সেই নাম না জানা ফরাসি দেশের কোনো এক অজানা গাঁ থেকে পারী শহর দেখতে আসা মেয়েটির। ১৮৫৭-র যে প্রভাব বারাকপুর সংলগ্ন এলাকার সামাজিক জীবনে পড়েছিল, ঔপনিবেশিক শক্তি সম্পর্কে ঘৃণার জন্ম তখনও না হলেও, বিরক্তির সূচনা শুরু হয়েগিয়েছিল- এই চিত্রায়ণের যে নির্মাণ ‘উত্তরঙ্গ’তে সবেমাত্র ফুটতে শুরু করেছিল, তা একটা অসামান্য মুন্সিয়ানায় প্রোজ্জ্বল হতে শুরু করলো ‘জগদ্দল’-এর প্রায়শুরু থেকেই।সমাজজীবনের চিত্রায়ণের ভিতর দিয়ে সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতির অদলবদলের যে আভাস সমরেশ এখানে দিচ্ছেন, সেই আভাসের ভিতরেও কিন্তু প্রথম থেকেই ধ্বনিত হচ্ছে ভারতের বৈচিত্র্যময় মিশ্র সংস্কৃতির সুর।এই সুরটিই সমরেশের মানুষের জীবনযুদ্ধ ঘিরে প্রতিটি লেখা, তা সে উপন্যাসই হোক বা ছোটগল্প বা কালকূট নামের লেখাগুলো- সেসবের সব থেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। শিল্পায়ন, ধনতন্ত্রের বিকাশপর্ব কীভাবে শ্রমের বাজারকে প্রলম্বিত করছে, আর সেই প্রলম্বনের ভিতরে অতি সাধারণ মানুষের মধ্যেও মালিকের প্রতি একটা ঘৃণার পরিবেশের জন্ম নিচ্ছে, মালিক নিজের স্বার্থে কীভাবে শ্রমিকের ব্যক্তিজীবনকে পর্যন্ত নিজের কব্জায় পুড়তে চাইছে; এই যে চিত্রায়ণ- এই চিত্রায়ণই সমরেশ বসুর ‘জগদ্দল’ উপন্যাসকে কেবলমাত্র উপন্যাসের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখেনি; উপন্যাসটিকে করে তুলেছে এক অনবদ্য সমাজকথন- যাকে এককথায় ইতিহাসের একটি ভাষ্য বললে অত্যুক্তি হবে না কোনোমতেই।
শীতের ভোরে ধীরে ধীরে সেনপাড়া, আগুড়িপাড়া, বাগদিপাড়া, জগদ্দল, মুসলমানপাড়ার জাগা- এ জাগা কেবল আক্ষরিক অর্থে জাগা নয়, অষ্টাদশ শতকের সুষুপ্তি থেকে সদর লাগোয়া মফস্বলের জেগে উঠবার যেন একটা বিরামবিহীন প্রস্তুতিপর্ব। যে প্রস্তুতির আগাম কোনো মহলা ছিল না, তাই, ‘থই থেকে অথই দূর’- সমরেশ ব্যবহৃত এই অসামান্য শব্দটি যেন এক মহাসমুদ্রের জলদগম্ভীর গর্জনের মতো করে সেইসময়টাকে এই সময়ের পাঠকের কাছে মেলে ধরছে। যে পাঠক হয়ত গভীর ইতিহাসবোধ, ইতিহাসের তন্বিষ্ঠ আবেগ- এসব কোনো কিছু নিয়েই ‘জগদ্দল’ পড়তে বসেন নি। নিছক একটা উপন্যাস পড়বার ইচ্ছে থেকে কোথাও একটা তাগিদ অনুভব করেছেন ‘জগদ্দল’ পাঠের, সেই পাঠ তাঁকে ক্রমে লেখকের কথার একটা অসামান্য প্রয়োগিক উপলব্ধিতে ধীরে ধীরে নিয়েচলে যাবে। ফরাসডাঙা থেকে ভেসে আসা উড়তি বাজারের বাজনা পাঠককে যে ‘থই’ এর ভিতর দোলা দেবে, সেই দোলাই ক্রমে ‘অথই দূরে’ তাঁকে নিয়ে চলে যাবে।এই চলে যাওয়াই সমরেশের সুরেই পাঠককে স্থিত করবে সারা দেশ থেকে মহাদেশান্তরে।তারপরেও যদি তার ব্যাপ্তি থাকে, সমরেশের ভাষার মতই, ‘তার ছড়াছড়ি’ চলবেই।
উপন্যাসের প্রথম পৃষ্ঠাতেই ফরাসডাঙার প্রসঙ্গ লেখক নিয়েআসছেন। এই বিষয়টি ঔপনিবেশিকতার রকমফেরের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের প্রয়াস। সেই প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে লেখক দুটি ঔপনিবেশিক শক্তির একটা তুল্যমূল্যের আভাস দিচ্ছেন।উপন্যাস যত এগোচ্ছে, কাহিনির বিস্তার যত ঘটছে ধীরে ধীরে তত এই ঔপনিবেশিকতার রকমের দিকটা আরো পরিষ্কার হয়ে উঠছে। দুটি সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির বিন্যাসগত দিকের যে তুলনামূলক চিত্র সমরেশ ‘জগদ্দল’-এর একদম সূচনাপর্বেই নিয়েএসেছেন, সেখানে আমাদের জাতীয়আন্দোলনের চরমপন্থী পর্বে একটা অংশের বিপ্লবীদের ভিতরে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদকে এদেশ থেকে তাড়াবার প্রশ্নে ফরাসি অধ্যুষিত চন্দননগর (উপন্যাসের শুরুতে বর্ণিত ‘ফরাসডাঙা’) ঘিরে আকর্ষণ- সেই আকর্ষণের রাজনৈতিক ভিত্তির বিষয়টিকেও প্রশ্নের মুখে ফেলবার এক জাদুময়ইঙ্গিত সমরেশ করছেন।এই ইঙ্গিত থেকে এটাই মনেহয়, ইতিহাসবোধে কতটা নির্মোহ এবং বস্তুনিষ্ঠ হলে এমন মূল্যায়ন সম্ভব।তবে এই মূল্যায়নের ভিত্তিভূমি সমরেশের মননলোকে উদ্ভাসিত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর যে শ্রেণি সংগ্রামের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ততা- সেকথার উল্লেখ না করলে সমরেশ বসুর মননলোকের রেখাচিত্র অঙ্কন সূচনাপর্বেই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
এই বোধই সমরেশের সারা জীবনব্যাপী সৃষ্টিকর্মের মূল সুর হিশেবে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
দুটি ঔপনিবেশিক শক্তি, ব্রিটিশ আর ফরাসি, এই দুটির ভিতরে আলোচনাসাপেক্ষ কেউ বেশি মন্দ, কেউ কম মন্দ- এককালের রাজনীতিকদের এই ধারণার ভিতরে যে গলদ, আর সেই গলদের মাশুল যে দেশবাসীকে বেশ ভালোভাবেই দিতে হয়েছে- উপন্যাসের শুরুতেই দুই সা¤্রাজ্যবাদের প্রয়োগজনিত যে বৈশিষ্ট্য গুলির উল্লেখ সমরেশ করেছেন, তার ভিতর দিয়েই রাজনীতির দিকনির্দেশের এক গূঢ়তত্ত্বকে তিনি তুলে ধরছেন।না বলা কথার ভিতর দিয়েএই যে অনেক কিছু বলা, এটা কেবলমাত্র ‘জগদ্দল’ উপন্যাসে সমরেশের লেখন শৈলির বৈশিষ্ট্য নয়; তাঁর গোটা জীবনের লেখনশৈলির এটা একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক।এই না বলেও অনেককিছু বলবার বৈশিষ্ট্যগত প্রয়োগে সমরেশ কিন্তু কখনো শব্দচয়ণ, উপস্থাপনা- কোনো ক্ষেত্রেই একবারের জন্যেও সাধারণ মানুষের ধরাছোঁঁয়ার বাইরে নিজের কলমকে পরিচালিত করেন নি।সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্যক্তি সমরেশের নিবিড়সংযোগ যেন তাঁর কলমকেও সাধারণের মনের কথাকেই অসাধারণ করে উপস্থাপনার একটা শক্তি জুগিয়েছিল।
সমরেশ কখনো রাজনীতি নিরপেক্ষ ছিলেন না। আবার সমরেশের মননে রাজনীতি মানে কখনোই কোনো দলীয় রাজনীতির প্রতি হেলে পড়া নয়; সমরেশের রাজনীতি ছিল আদর্শবাদের প্রতি প্রগাঢ় আস্থা। আর সেই আস্থার পক্ষপাতিত্বটা ছিল শ্রেণি সংগ্রামের পক্ষের শক্তির প্রতি। নিজের প্রথম জীবনের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক যাপন তাঁকে ‘মানুষ রতন’ নামক কালজয়ী ছোটগল্পের অভিজ্ঞতা দিয়েছিল। রাজনৈতিক দর্শনে আস্থা যত দৃঢ়ই হোক না কেন, সবার উপরে ফ্রাকশনিজিম, তাহার উপর নাই- এই বিকৃত বোধ রাজনীতির নামে পরিবেশন করলে তার কি বিষময়পরিণতি রাজনীতি এবং রাজনীতিকের জীবনে ঘটতে পারে, সমরেশ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন এই ‘মানোষ রতন’-এর মত গল্পে, ‘তিন পুরুষে’র মত উপন্যাসে।
গঙ্গার পশ্চিমপারে ফরাসডাঙায় ‘উড়তিবাজার’ আর পূর্বপারে সাহেবের এক্কাগাড়ির কৌচের, ‘গদির মাথায় নকশা কাটা রুপোর পাতের মাঝে মিনে করা হয়েছে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার মূর্তি’- দুই সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির বহিরঙ্গের প্রকাশভঙ্গিমা যে অন্তরঙ্গকে আড়াল করতে পারে না- এই বোধের উপর যখন সমরেশ তাঁর এই উপন্যাসের মুখরাটা রচনা করেন, তখনই বুঝতে পারা যায়রাজনৈতিক বোধ আর সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার আত্মস্থ বোধ লেখককে কোন চরম মেধায় উন্নীত করেছিল- যার জেরে সদ্য স্বাধীন ভারত, যে সময়ে সমরেশ উনিশ শতকের প্রথম পর্বকে পটভূমিতে রেখে এই উপন্যাস লিখছেন, সেই সময়কালেও একটা বড়অংশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভিতরে ফরাসি ঔপনিবেশিকতা সম্পর্কে একটা মোহ থাকলেও সঠিক রাজনৈতিক বোধের ফলে সেই মোহের ফাঁদে পড়ে লেখক সমরেশ কিন্তু একবারের জন্যেও হাবুডুবু খাচ্ছেন না। ডোবা তো দূরের কথা।
‘উড়তিবাজার’ আর ‘মহারাণী ভিক্টোরিয়া’- দুই যে অভিন্ন সাম্রাজ্যবাদের এক ই মুদ্রার দুটি দিক- আমাদের জাতীয়আন্দোলনকালে চরমপন্থী ভাবধারার মানুষ সেটা বুঝতেই চাননি।তাইই আলিপুর বোমা মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে অরবিন্দ ঘোষ তাঁর ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্যে বেছে নিয়েছিলেন আমাদের দেশে ফরাসি উপনিবেশকে।তারপর তো তাঁর আধ্যাত্মিক ভাবান্তরের আর একটা ভিন্ন পর্যায়।
উপন্যাসের শুরুতেই ব্রিটিশ মদদে পুঁজির বিকাশের এই পর্ব, যা ভারতে শিল্পায়নের প্রথম পর্ব হিশেবে চিহ্নিত, এই পর্বকাল বাংলা এবং বাঙালির সমাজজীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করলো- ‘জগদ্দল’ উপন্যাসে এই কালপর্বের আখ্যান কেবলমাত্র একটা উপন্যাসে বর্ণিত কাহিনি নয়; বাংলা যেহেতু তখনও ঔপনিবেশিক শাসকদের ইচ্ছায় গোটা ভারতের রাজধানী, তাই বাংলায় শিল্পায়ন, বাঙালির সামাজিক জীবনকে কীভাবে,ধীরে ধীরে একটা অদলবদলের দিকে নিতে শুরু করলো সেটা বোঝবার নিরিখে সমরেশ বসুর কলম যেভাবে ছুঁটেছে, তাকে কেবলমাত্র সাহিত্যিকের কলম বলা যায়না।সমরেশ এখানে একাধারে সাহিত্যিক, একাধারে ঐতিহাসিক, সর্বোপরি একজন সমাজবিজ্ঞানী।সমাজবিজ্ঞানের কত গভীরে প্রবেশ করতে পারলে শতবর্ষ প্রাচীন জনজীবনের এমন অনুপুঙ্খ যাপনচিত্রের চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব, সেটা শিখবার জন্য সমাজবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার অনুরাগী ছাত্র, শিক্ষক, পাঠককে সমরেশ বসুর এই লেখা বার বার পড়তে হয়। নতজানু হতে হয় এই কালোত্তীর্ণ ¯্রষ্ঠার কাছে।
যে সময়কালের কথা সমরেশ বলছেন, সেই কালপর্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার সামাজিক বিন্যাস বদলে দিয়েছে অনেকখানি। ব্রিটিশের সঙ্গে, ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য, মুৎসুদ্দিগিরি করেবাঙালিরএকটা অংশের অর্থনৈতিক জীবনের বিন্যাসের অনেকখানি অদলবদল হয়েছে। গ্রামীণ বাংলার ভূমি ব্যবস্থাতেও অনেকখানি পরিবর্তন এসেছে। বনেদি জমিদারকুলের অনেকখানিই ব্রিটিশের নতুন কর ব্যবস্থার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি।জমিদারি তাঁদের হাত বদল হয়েছে। ব্রিটিশের সঙ্গে বাণিজ্য করে হঠাৎ বডলোক হয়েওঠা, কলকাতায়এসে বসবাস করতে থাকা একটা অংশের মানুষ নতুন করে জমিদার হয়েছেন। এই নতুন জমিদারদের জমিদারি পরিচালনার ক্ষেত্রে অতীতের বনেদি জমিদারদের কার্যকলাপের সঙ্গে বেশ খানিকটা ফারাক তখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। কলকাতানির্ভর এই জমিদারদের তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, আজকের বাংলাদেশে জমিদারির অবস্থান, জমিদার আর প্রজাদের ভিতরে বিস্তর দূরত্ব তৈরি করছে।এই যে জমিদার আর প্রজার ভিতরে ভৌগোলিক দূরত্ব, তা সহজেই তৈরি করছে সামাজিক দূরত্ব। আর সেই সামাজিক দূরত্বের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জমিদারি পরিচালনা ঘিরে প্রজা আর জমিদারদের মধ্যে দূরত্ব।যা ক্রমে রচনা করছে একটা একটা সংঘাতের পরিবেশ। এই পরিবেশের প্রভাব গোটা বাংলা জুড়েই নানাভাবে পড়তে থাকে।চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে যে জমিদারেরা ছিলেন, জাত্যাভিমান তাঁদের ভিতর যে জায়গায়ছিল, সেটা পরবর্তী পর্বের জমিদারদের অনেকেই বহন করে চলেছিলেন। সেই সঙ্গে জমিদারদের একটা অংশের ভিতরে নিম্নবর্গীয় হিন্দু এবং মুসলমান- উভয়ের প্রতিই যে নেতিবাচক মানসিকতা ছিল, সেটা থেকে নতুন জমিদাররা কোনোভাবেই নিজেদের মুক্ত করতে প্রয়াসী হয়নি।
সামাজিক বিন্যাসের এই বদল শ্রীচৈতন্য পরবর্তী বাংলায়ধীরে ধীরে তন্ত্র সাধনার নামে যে বামাচারী ধারা, যা ক্রমে বৌদ্ধ ধর্মের ভিতরেও প্রবেশ করতে থাকে, তার ব্যাপ্তি যে পূর্ববঙ্গকে অতিক্রম করে কলকাতা সন্নিহিত অঞ্চলের সামাজিক পরিবেশেও কতোখানি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিল, তা উপন্যাসে উল্লিখিত অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিব্যাপ্তিতে ঘটনাক্রমকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমরেশ দেখিয়েছিলেন ‘উত্তরঙ্গ’ত।‘কালী’ দেবীকে ঘিরে বিশ্বাস আর লোকাচারের যে প্রাবল্যের একটা হালকা ছবি ‘উত্তরঙ্গে’ রয়েছে, সেই ছবিই হলো, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে বাংলার সামাজিক পরিম-লে বামাচারী তন্ত্রসাধনার ধারা উপধারার একটা ছোট্ট খ- চিত্র।
এই চিত্রের পরিব্যাপ্তি আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘জগদ্দলে’র শুরুর দিকেও। গারুলিয়ার ভৌগোলিক বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রসন্ন ঠাকুরদের প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রহ্মময়ী’ কালী মন্দিরের উল্লেখ এই অঞ্চলের সঙ্গে নবজাগরণকালের বিশিষ্টজনেদের সংযোগের একটা ছবি তুলে ধরছে।ক্রমে উপন্যাসের গহীনে যখন আমরা প্রবেশ করব, তখন দেখতে পাব, গারুলিয়ার পাশে ভাটপাড়ার অবাঙালি পাশ্চাত্য, দাক্ষিণাত্য ব্রাহ্মণকুলের সঙ্গে এই শাক্ত মত ধারার সংঘাত। দশরথনন্দন ‘রাম’কে ঘিরে আজ গোটা ভারতেরাজনীতির যে দড়িটানাটানি, বাংলায়, সেই ধনুর্ধারী রামকে ঘিরে ভাবাবেগ তৈরির বিষয়টিও যে উত্তরপ্রদেশের কনৌজ থেকে বাংলায়এসে, থেকে যাওয়া পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণেরাই করেছিল- রাম-শৈবভাবনা এবং শাক্তভাবনার সংঘাতের সেদিন রূপ বর্ণনের ভিতর দিয়েসমরেশ বসু যেন আজকের বিপর্যস্ত বারাকপুর শিল্পাঞ্চলটিকেই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন।
তন্ত্রশাস্ত্রের ধারাবাহিকতাকে কেন্দ্র করে ‘কালী’ দেবীর প্রতি ভক্তি এবং চর্চার ধারা ঔপনিবেশিক যুগের প্রথম পর্বে ‘জগদ্দল’ উপন্যাসের ভৌগোলিক পটভূমিতে কতটা প্রকট ছিল তা আমরা ‘উত্তরবঙ্গ’-এ দেখেছি। ‘জগদ্দল’-এ দেখছি, ‘কালীবাড়িত বাজছে কাঁসরঘণ্টা।পাথুরেঘাটার পেসন্ন ঠাকুরের অর্থাৎ প্রসন্ন ঠাকুরের কালীবাড়ি। মেয়ের নামে কালীর নাম রেখেছেন ব্রহ্মময়ী। শ্যামনগরে তাঁদের জমিদারিতে ব্রহ্মময়ী অধিষ্ঠিতা। লোকে বলে ব্রেহ্মময়ী রেললাইনের ধারে একখানি ঘর, ঘরের বাইরে প্ল্যাটফর্মের শেষ সীমায় একটি ইট সিমেন্টের পোস্টের গায়ে লেখা আছে ঝঐটগঘটএএজ বোধহয় ওটাই শ্যামনগরের ইংরেজি বানান।’
এই অঞ্চলের প্রাচীন জমিদারেরা কীভাবে জমিদারি হারিয়েছেন তার ধারাভাষ্য রয়েছে ‘উত্তরঙ্গ’তে।চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভূমি ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন এনেছে, তার জেরেই ইংরেজদের মুৎসুদ্দিগিরি করে বাইরে থেকে নতুন গড়েওঠা কলকাতায় এসেছেন এই প্রসন্ন ঠাকুর।ব্যবসার জোরে বিত্তবান হয়েছেন। সেই বিত্তের জোরেই আগের দিনের জমিদারদের সঙ্কটের সুযোগ নিয়েজমিদারি কিনেছেন।এই অঞ্চলের জমিদার হয়েছেন।
এই যে জমি ব্যবস্থার বদলের সঙ্গে জমিদারি ব্যবস্থার বদলের যে ছবি সমরেশ আঁকছেন, সেই রেখাচিত্রের ভিতর দিয়ে গ্রামীণ বাংলার সামাজিক পটচিত্রের ক্রম পরিবর্তনশীল ছবি উঠে আসছে। একটা উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে প্রবেশের আগে, সমাজচিত্রের এই বদলের চিহ্নটাকে আঁকবার যে আঙ্গিক সমরেশ ‘জগদ্দলে’ ফুটিয়েতুলছেন, এটা একজন সমাজবীক্ষণরত শিল্পীর চোখ। এই বীক্ষণের ইচ্ছে, আকাক্সক্ষা কেবলমাত্র একজন কথাকারের হয়না। মু-ক্য উপনিষদের বাণী, ‘যা আমাকে অমৃত না করবে, তা দিয়ে আমি কী করব’- এই বোধের অনুরণন যে সমরেশ বসুকে লেখক জীবনের শুরু থেকে জীবনদীপ নির্বাণের মুহূর্ত পর্যন্ত তাড়িত করত- সেই অন্তহীন জাগরের স্ফুরণই ‘জগদ্দল’-এর সূচনাপর্বেই বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই মানুষে, সেই মানুষের সন্ধানে সমরেশের গোটা জীবনের পথচলার অন্ধিসন্ধির এক রেখাচিত্রকে।
শ্রীচৈতন্যকে কেন্দ্র করে বাংলায় ভক্তি আন্দোলন, যা প্রবাহমান ভারতের সমন্বয়ী ধারার এক অনবদ্য পুনরুজ্জীবন, সেই ধারা কিন্তু ‘জগদ্দল’ উপন্যাসের ভৌগোলিক পটভূমিকাতে ব্রাহ্মণ্যবাদের ভয়ঙ্কর জাত্যাভিমানের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল।‘জগদ্দল’ উপন্যাসের ভৌগোলিক পটভূমিকার ভিতরে শ্রীচৈতন্যের দীক্ষাগুরুর আবাসভূমি। সেখানে প্রথম জীবনে চৈতন্যদেব এসেছিলেন। থেকেছিলেন। গুরুর কাছে দীক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যবাদের মধ্যেকার আভ্যন্তরীণ সঙ্কট এবং দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য সমাজের স্মৃতিশাস্ত্র নির্ভর কূপম-ূকতা বনাম বরেন্দ্র ব্রাহ্মণদের দর্শন শাস্ত্র চর্চা, নারীর অধিকার, ঔপনিবেশিক শাসন, নবজাগরণের প্রভাব গঙ্গানদীর পশ্চিমপারে, হুগলী-গুপ্তিপাড়া থেকে হালিশহর- এসব জীবনবীক্ষণকে কেন্দ্র করে সমরেশের অনবদ্য সৃষ্টি ‘ভানুমতী’ যাকে ‘জগদ্দল’ পর্বের একটা অংশ বললে ভুল হবে না। সেই সৃষ্টিতেও যে সামাজিক দ্বন্দ্ব আছে উনিশ শতকের প্রারম্ভে শিল্পের বিকাশ, বিশেষ করে চটকল তৈরি, সামাজিক বিন্যাসের গ্রন্থিমোচন- এসব যেন এককালে শ্রীচৈতন্যকে ঘিরে ভাটপাড়ার চরম প্রতিক্রিয়াশীল পাশ্চাত্য এবং দাক্ষিণাত্য ব্রাহ্মণ সমাজ, যারা আদৌ বাঙালিই নয়, বাংলায়থাকতে থাকতে বাংলা ভাষা রপ্ত করে বাঙালি হয়েওঠার চেষ্টা করে চলেছে, এই অংশটি যেভাবে এই অঞ্চল দিয়ে শ্রীচৈতন্যের গমনাগমনে অন্তরায়হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যা ‘জগদ্দল’ উপন্যাসের যে ভৌগোলিক বিস্তারের ক্ষেত্র, সেই অঞ্চলকে কীভাবে জাত্যাভিমান এবং ধর্মের নামে প্রতিক্রিশীরতার আঁঁতুরঘর নির্মাণের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল, তা এই ‘ব্রহ্মময়ী’ কালী মন্দিরের উল্লেখের মধ্যে দিয়েই কিছু না বলেও অনেককিছু বলবার চেষ্টা করেছেন সমরেশ বসু।
জোড়াসাঁকোর পাথুরেঘাটা শাখার প্রসন্ন ঠাকুরের যে উল্লেখ সমরেশ করছেন ‘জগদ্দল’ উপন্যাসে, সেই উল্লেখকে নিছক শ্যামনগরের ‘ব্রহ্মময়ী’ কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার নামের উল্লেখ করতে করা, এমনটা মনে করলে, সমরেশের এই উল্লেখপর্বের সম্যক দিকটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে না। ‘জগদ্দল’ উপন্যাসের বিস্তৃত পটভূমিকায় চরিত্রগুলির ভিতরের যে দ্বন্দ্ব, সেলফ কনট্রাডিকশন, চরিত্রগুলির দ্বিমুখী, এমনকি ত্রিমুখী ধারা, তার সঙ্গে সমসাময়িক সমাজচিত্রের ভেতর যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব- সেসবের আভাস দিতে ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের চরিত্র সম্পন্ন উনিশ শতকের নবজাগরণ পর্বের অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র প্রসন্ন ঠাকুরের নামটি কি সমরেশ উল্লেখ করেছেন? তন্ত্র সাধনার এক বামাচারী ধারা প্রবর্তনের চেষ্টা কি আজকের বারাকপুর শিল্পাঞ্চলে করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন প্রসন্ন ঠাকুর বা তাঁর অনুরাগীরা? তাই তন্ত্র সাধক ‘বামাক্ষেপা’র এই ব্রহ্মময়ী কালী মন্দিরে কিছুকাল অবস্থানের বিষয়টা কি সমাজসন্ধানী সমরেশের মনের গহীনে এই অঞ্চলের সমাজচিত্রের একটা ভিন্ন ধারার প্রয়াসে একদল লোকের চেষ্টার দিকে ইঙ্গিতবাহী হয়েই এই প্রসন্ন ঠাকুরের নামোল্লেখ?
আতপুর, জগদ্দল, শ্যামনগর- এই এলাকাগুলিতে বামাচারি তান্ত্রিক প্রক্রিয়ার চর্চার একটা জোরদার আভাস সমরেশ রেখেছিলেন ‘উত্তরঙ্গ’তে। সেই চর্চার সঙ্গে ডাকাতি ইত্যাদির বিষয়গুলিকেও তিনি সম্পৃক্ত করেছিলেন। আগ্রহের তাগিদে এই ধরনের চর্চার লোকেদের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের পরিচয় থাকবার এক অসামান্য খ-চিত্রও সমরেশ এঁকেছিলেন ‘উত্তরঙ্গ’তে। সেই সমরেশ, যিনি মাটির কাছে থাকা জীবনের বারমাস্যা ঘিরে মানুষের জীবনকাহিনি লিখে গেলেন চিরকাল, স্থানীয়ব্যক্তিত্ব হিশেবেই এই উপন্যাসের পূর্ববর্তী অংশ ‘উত্তরঙ্গ’তে উল্লেখ করলেন কাঁঠালপাড়া, সেখানকার সুসন্তান বঙ্কিমকে, কিন্তু সেই উল্লেখ কখনো বঙ্কিমকে ঘিরে কোনো উচ্ছ্বাস থেকে তিনি একবারের জন্যেও করলেন না। সেই সমরেশই যখন প্রায়ত্রিবিধ দ্বন্দ্বের মধ্যে জীবন কাটানো প্রসন্ন ঠাকুরের কথা বলছেন, তখন বোঝা যাচ্ছে, হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠাতার পুত্র প্রসন্ন, রামমোহনের সতীদাহ নিবারণের অন্যতম সহযোগী, তিনিই আবার ১৮৫৭’র প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের তীব্রবিরোধী, রামমোহন সহযোগী হয়েও, পৌত্তলিকতার সমালোচক হয়েও বাড়িতে দুর্গাপুজো করছেন। একাণ্ডের প্রবল সমালোচনা করেছিলেন ডিরোজিও। আবার লেবেদেফের প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ফর্মে নিজের বাড়িতে থিয়েটার করছেন।ইনিই কিন্তু তন্ত্রসাধক বামাক্ষেপাকে আবার নিজের এমারেল বাওয়ারে রেখে দিচ্ছেন।
উপন্যাসে প্রসন্ন ঠাকুরের এই উল্লেখকে নিছক ইনফরমেটিভ ভাবলে মনেহয়সমরেশের সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা সমাজবীক্ষণের চিন্তাকে আমরা বুঝতে ভুল করব।‘জগদ্দল’-এর কালপর্বে সমাজপতি এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের যে বহুমুখী চরিত্র তাদের শ্রেণিস্বার্থে পরিচালিত হয়ে চলেছিল- সেই বিষয়টির দিকে কিছু না বলেও অনেক কিছু বলবার তাগিদেই সমরেশের এই ‘প্রসন্ন ঠাকুর’-এর উল্লেখ।